| 10 ডিসেম্বর 2024
Categories
শারদ অর্ঘ্য ২০২৩

শারদ অর্ঘ্য গল্প: প্রত্যাবর্তনের খুঁটিনাটি । ইমতিয়ার শামীম

আনুমানিক পঠনকাল: 21 মিনিট

চার-চারটা মাস―একেবারে কম তো না! এর মধ্যে এই মানা ক্যাম্পে নাকি ওই আকাশে সূর্যটা কতবার যে উঠল আর ডুবল, কতবার মেঘ-বৃষ্টি-ঝড়ের সঙ্গে পাঞ্জাও লড়ল কিন্তু তারপরও নিখিল ঠিক ধরতে পারল না, যুদ্ধটা ঠিক হচ্ছে কোথায় আর শেষই বা হবে কোনখানে। তাছাড়া এটাও এখনও বুঝতে পারছে না সে, যুদ্ধ মানেই কি এই রকম বালিশে মাথা রেখে ঘুম দেওয়া! একটা বালিশ এরকম তেল চিটচিটে হয় কী করে ?

যুদ্ধটা শুরু হলো একদিন হঠাৎ করে। কত শত পোস্টারই না লাগানো হয়েছিল ভোটের সময় তাদের ঘরবাড়ি আর গাঁয়ে। কতগুলো নৌকাই না বানানো হয়েছিল বাঁশ কেটে কেটে। সেসবের সবই তারা বিসর্জন দিয়ে এল হজিরগাঙে। আবারও যেন ভোটের আগেকার মতো কী এক নিস্তব্ধতা নেমে এল তাদের খ্যাগড়াঘাটে। তবে নিখিল অবশ্যি বেশ খুশিই হয়েছিল এই যুদ্ধ লাগায়। যদিও ধরতে পারেনি, যুদ্ধটা ঠিক হচ্ছে কোনখানে আর হচ্ছেই বা কেমন করে। যেমন সে জানে, কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা হয় তার মায়ের বাপের বাড়ি। সেই দিন এমন জোছনা ওঠে―এমনই জোছনা ওঠে যে, পলানটুক খেলতে গিয়ে রাতের বেলায়ও ঝোঁপঝাড়ে লুকাতে সমস্যা হয়। তাছাড়া মানুষের ছায়াও দিব্যি স্পষ্ট বোঝা যায় দিনদুপুরের মতো। আরও একটা ব্যাপার আছে, বছরের ঠিক এই সময়েই মা তার নিজের বাপের বাড়ি যায় ড্যাং ড্যাং করে। সারা বছর যেমন তেমন ওই সময় হঠাৎ করেই মাকে কেমন হৃষ্টপুষ্ট লাগে নিখিলের। এখন মরার এই মানা ক্যাম্পে এসে সুধীনের কাছে থেকে সে কয়েক দিন আগে জানতে পেরেছে, কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা নাকি সব জায়গায়ই হয়! সুধীন এও বলেছে, নিখিলের যদি কোনও বোন থাকত আর সেই বোনের যদি বিয়ে হয়ে যেত তাহলে সেও প্রতি বছর কোজাগরীর সময় নিখিলদের বাড়িতে চলে আসত। নিখিলের মায়ের বাপের বাড়ি যাওয়া তখন লাটে উঠত! ব্যাপারটা কেমন তাজ্জব না ? সুধীন নিশ্চয়ই মিথ্যা বলছে, ধরে নিতো সে কিন্তু মাও বলছে, ও নাকি ঠিকই বলেছে। দুর্গাপূজার পর আশ্বিনের পূর্ণিমায় লক্ষ্মীপূজা সবখানেই হয়। আর খালি আশ্বিনের পূর্ণিমায় কেন, বড়লোকরা নাকি প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়ই লক্ষ্মীপূজা করে, লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়ে আর আরাধনা করে। তখন নাড়ু, মোয়াও খাওয়া যায় প্রাণভরে। মনপ্রাণ ভরে গেছে নিখিলের মায়ের এ কথা শুনে। তার বাপের ঘরদোর আর গোলাঘরের অবস্থা এত ভালো―তারপরও মামারা কেন যেন ফিসফিসায়, অবস্থা ভালো না! তা তার বাপের অবস্থা ভালো না হোক, নানুদের অবস্থা তো মোটামুটি ভালোই, তারা কি পারে না প্রত্যেক বৃহস্পতিবারে লক্ষ্মীপূজা করতে? লক্ষ্মীর পাঁচালি না পড়ুক, আরাধনা না করুক, তারা কি পারে না প্রত্যেক বৃহস্পতিবারে একটু নাড়ু-মোয়া বানাতে ? যুদ্ধটা শেষ হলে এর একটা হেনস্থা করতে হবে। মনে মনে এই চিন্তা শান দিতে থাকে নিখিল কিন্তু এই এত বড় ক্যাম্পের এধার থেকে ওধারে গিয়েও কূল করতে পারে না, সেটা শেষ হবে কবে!

স্কুল তাদের বন্ধ হয়ে গিয়েছিল যুদ্ধ লাগার আগেই। মুজিবের নির্দেশ―সবকিছু বন্ধ। সেই বন্ধ হওয়ার সময় থেকেই সবকিছু ভালো লাগতে শুরু করে নিখিলের। এখন কোনও ভার নাই মনের ওপর, কোনও কাজের ভার নাই কাঁধের ওপর―কাজ বলতে এই যে, সারা দিন টইটই করে ঘুরে ফেরো আর তক্কে তক্কে থাকো, কোন সময় খানবাড়ির লোকজন রেডিওতে গান শুনবে। সঙ্গে সঙ্গে তারা পাড়ার সবাই হুমড়ি খেয়ে ঘিরে ধরত রেডিওর চারপাশে। তবে যুদ্ধ লাগলে সেই রেডিও শোনাও বন্ধ হয়ে গেল তাদের মতো পোলাপানদের। বড়রা অবশ্য বাদ দেয় নাই। লুকিয়েচুরিয়ে রেডিওতে কী শুনত, কে জানে। তা নিয়ে আলাপসালাপও করত ফিসফিসিয়ে। তা যা করে করুক, তাদের যে আর ঘোরাঘুরি করতে দিত না; সেটাই হলো বড় মুশকিল। অতএব মনে হতে লাগল, যুদ্ধের আগেই তো ভালো ছিল। তারা অন্তত এখানে ওখানে দাবড়াদাবড়ি করতে পারত। তবে এখন খানসেনা আর রাজাকারদের দাবড়ানি খেয়ে এই ক্যাম্পে চলে আসার পর হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে নিখিল যত ভালো মনে করেছিল যুদ্ধ আসলে তত ভালো নয়। স্কুলটুল বন্ধ করে দিলে কী হবে। হেডমাস্টার আর পণ্ডিত স্যারের চেয়েও তাফালিংয়ের মধ্যে আছে নিখিল এই যুদ্ধ লেগে। তাদের পাড়ার পুটি আর ময়নার বাপ নাকি মরে গেছে এই পাড়ে পালিয়ে আসতে গিয়ে। মারা গেছে পুরো জোলাখালির মানুষজন। আরও কত কী যে ঘটেছে। কেউ তো আর তার কাছে বলে না স্পষ্ট করে। এই মাসকয়েক আগেও মা তাকে সেধে সেধে খাওয়াতে পারত না আর এখন এত ক্ষুধা লাগে। মায়ের কাছে এতবার খেতে চায় কিন্তু মা কিছুই বলে না। কখনও আবার প্রচণ্ড রাগে বলে ওঠে, ‘খালি খাই খাই করস, দেহস না, যুদ্ধ লাগিচ্ছে ?’

‘যুদ্দো লাগিচ্ছে তো কী হচ্ছে ? তুই আমাক খাবার দিবি না ?’

দৈনিক এরকমই হচ্ছে এখন। এরকম ঠেলাঠেলি, যখন তখন। মাত্র নয়-দশ বছরের জিভ,  তারপরও এর মধ্যেই ওটাকে মায়ের কথার পিঠে সমান তালে কথা কওয়ানোর কাজে লাগাতে ওস্তাদ বনে গেছে নিখিল। বিশেষ করে এই ক্যাম্পে এসে। এক্কেরে পয়লা দিন থেকেই ঝগড়াঝাটি বেঁধে যাচ্ছে। অশান্তি; অশান্তির এক শেষ। মাঝেমধ্যে নিখিলের মনে হয়, এর চেয়ে খানসেনাদের গুলি খেয়ে মরে গেলেও শান্তিতে থাকা যেত। কিন্তু মরে যাওয়া তো কপালে জুটল না।  বারো নদী আর তেরো খালের চৌদ্দ ঘাটের জল খেতে খেতে বেঁচেই থাকল শেষ পর্যন্ত। কয়েক দিন তো রাতের বেলা ঘুমাতে হলো স্রেফ গাছের মূলের ওপর মাথাটা রেখে। আরেক দিন আবার ঘুমাতে হলো এক্কেরে গাছের ওপর চড়ে একটা অ্যাচানো-প্যাঁচানো বাটুল মার্কা ডালের ফাঁকে মাথাটা গুঁজে। এক দিন ভোর রাতে ঘুম ভেঙে দেখল কাছেই একটা সাপ ঘুম দিচ্ছে তার মতো করেই শরীরটা গোল বানিয়ে। তখন অবশ্য মৃত্যুভয়ে চিৎকার করে উঠেছিল। এত ঝড়ঝঞ্ঝা গেল, তারপরও মাঝেমধ্যে বেশ ভালোও লেগেছিল। নিজেকে মাঝেমধ্যে বেশ যাত্রার সেই রাজপুত্রের মতোও মনে হতো। যে কি না ডাইনির চক্রান্তে বনেবাদাড়ে ঘুরেফিরে জীবন কাটাচ্ছে। কিন্তু ক্যাম্পে প্রথম রাতেই ওই বালিশ দেখে তার চোখ গোল হয়ে গিয়েছিল, এইটা আবার কী! এইটা দিচ্ছে কেন! খ্যাগড়াঘাটের বিমল সরকারের একমাত্র ছেলেকে এরকম একটা বালিশে শুতে দেয়, কার এত সাহস! তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই নিশ্চিত হয়েছিল, শুধু মাটির ওপর নয়, ওরকম একটা বালিশেই নাকি রাত কাটাতে হবে মাথাটা রেখে। এদিক ওদিক তাকিয়েছিল সে, নাহ্, কোনও উপায় নাই। মা-বাবা, কাকা-কাকি সবার জন্যেই বন্দোবস্ত একই রকম―এই ন্যাড়ন্যাড়া হয়ে পড়া তেল চিটচিটে বালিশ। কারও সঙ্গে যে পাল্টে নেবে, তারও উপায় নাই। এখানে একেকটা তাঁবুতে থাকতে দিয়েছে দুটো করে পরিবার। নিখিলের কাকা অমল পূর্ববঙ্গের হলে কী হবে, বেশ ঝানু বাঙালি। এখানে আসার আগেই খোঁজ নেওয়া হয়ে গেছে তার। একটা তাবুতে মাত্র দুটো করে পরিবারকে থাকতে দিচ্ছে আর পরিবার বলতে ওদের হিসাবে একেবারে আদ্যিকালের পরিবার। মানে যৌথর বাবা যৌথ পরিবার―তা একটার সদস্যসংখ্যা যতই হোক না কেন। আরেকটার সঙ্গে থাকতে হবে তাল মিলিয়ে, সদ্ভাব বজায় রেখে। কাকার মাথায় বুদ্ধি খেলতে সময় লাগেনি, মুহূর্তেই কথাবার্তা সাজিয়ে নিয়েছিল সে, তারা আসলে দুই পরিবার। একজনদের বাড়ি ওই বাগেরহাটে আর আরেকজনের ওই দিনাজপুরে। খানসেনাদের দাবাড় খেয়ে পালিয়ে আসতে আসতে মাত্র কয়েক দিনেই দুই পরিবারে এমন সদ্ভাব হয়ে গেছে যে, মানুষজনের কাছে মনে হয় তারা বোধহয় একই মায়ের দুই সন্তান। ‘এক মায়ের সন্তান না হলিও আমরা একই কাস্টের তো’―মুখে একটা পেলব প্রশ্রয় পাওয়ার হাসি জাগিয়ে আর্জি জানিয়েছিল অমল। এভাবে একটা পরিবারকেই দুই ভাগে ভাগ করে আস্ত তাবুর বন্দোবস্ত করায় একটু আরামে থাকা যাচ্ছে অবশ্য কিন্তু মুশকিল হলো, পর্যাপ্ত বালিশ মিলছে না। এমনকি ওই জয় বাংলা ঘেন্টুটাও দৈনিক ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না। রাগারাগি করেছে, কেঁদেছে, কখনও তারস্বরে, কখনও ফুঁপিয়ে, না শুয়ে বসে থেকে রাত জেগেছে কিন্তু তাতে কোনও কাজ হয়নি। তাতে বরং অলোকদারা একটু হাত-পা ছড়িয়ে আরাম করে ঘুমাতে পেরেছে। অনেক ভেবেচিন্তে শেষ পর্যন্ত সন্ধি করার চেষ্টা চালিয়েছিল নিখিল, ‘ঠিক আচে মা। বালিশ না দিবার পারো, তোমার গামছাখান দাও, গামছাটা বালিশে জড়ায়ে―’

কথা শেষ করতে পারেনি, মা কিছু বলার আগেই তারস্বরে চিৎকার করে উঠেছিল তার বোন ঝর্না, ‘মুখ দিয়া তোর দিনরাইত ২৪ ঘণ্টা লালা গড়ায়। তর ওই লালা লাগা গামছায় আমরা মুখ মুছমু, শয়তানের বাচ্চা ?’

নাহ্, কী দিয়ে কী যে হচ্ছে! নিখিল আর এগোয় নাই। যুদ্ধটা যে কী, তা ঠিক মতো না বুঝলেও এইটুকু বুঝেছিল, এইটা মুখের ডাশা খুলে দেয়। নইলে যত রাগারাগিই হোক না কেন, তাদের ভাইবোনদের মধ্যে অমুকের বাচ্চা কিংবা তমুকের বাচ্চা বলে গালি দেয়ার রেওয়াজ কোনও দিনই ছিল না। যুদ্ধ নিশ্চয়ই মাথা খারাপ করে দিয়েছে, নইলে এরকম হবে কেন! গতকাল তো আবার দেখল, ঝর্না পাশের তাবুর কাকে যেন খরখরে তীক্ষ্ণ গলায় গালি দিচ্ছে, ‘জাউরার বাচ্চা…’। কেমনে কী! গালিটার মানে ঠিক জানা নাই নিখিলের কিন্তু তাদের তামাম গাঁয়েই এইটার বেশ জনপ্রিয়তা আছে। অতএব শেষ পর্যন্ত হার মেনেছে নিখিলও, শুতে শুরু করেছে ওই বালিশেই। তাছাড়া এ পর্যন্ত যতগুলো বালিশ তাদের এই ক্যাম্পে দেখেছে তাতে নিখিল মোটামুটি নিশ্চিত যে, দেশে ফিরতে না পারলে বাকি জীবনটা তাকে এই বালিশেই ঘুমিয়ে যেতে হবে। এরকম বালিশে ঘুমাতে হয় বলে খানসেনাদের ঘুম থেকে ওঠার পর একবার, ঘুমাতে যাওয়ার আগে আরেকবার মন ভরে গালি দেয় সে। প্রস্রাব করতে গেলেও তার পক্ষীটা নাচাতে নাচাতে এদিক সেদিক মূত্র ছড়ায় আর তিক্ত গলায় বলে চলে, ‘খা খা ভালো কইরা খা, ব্যাটা খানসেনা পাঞ্জাবি, হারামজাদা টিক্কা এহিয়া…’

মাঝেমধ্যে আবার নিখিলের মনে হয়, তেল জমতে জমতে, শুকাতে শুকাতে বোধহয় খৈলের গাঢ় প্রলেপ জমতে শুরু করেছে বালিশগুলোর ওপর। তখন মাথার খুসকি-চুলকানি নিয়ে সে যেন হঠাৎ করেই সজাগ হয়ে ওঠে আর ভাবে, না জানি কত ময়লা জমেছে এই মাথার ওপর আর চুলের গোড়ায়! সত্যিই যদি এইভাবে বালিশে খৈল জমত, তাও তো কাজের কাজ হতো একখান, সাফ-সুতরো করা যেত মাথাটা ভালো করে। কত দিন যে এই মাথার চুলে একটু সাবান দূরে থাক, খৈল কিংবা একটু এঁটেল মাটিও ঘষা হয় না―তা আর মনেই পড়ে না তার। আর খালি মাথার চুল কেন, এই পুরো শরীরটায়ও তো আজ কয় মাস গেল, কোনও কিছুর ঘষা পড়ে না। বাড়িঘরে থাকলে আর কিছু না হোক, নদীখালে, কোনও একখানে ঝাঁপ দিয়ে খানিকক্ষণ সাঁতরায়ে চামড়ায় জমা ময়লাগুলো একটু নরম করে একটা তিতাদুম্বা দিয়ে এক-আধবার ডলা দিতে পারত। আর ওই এক-আধবার ডলা মারতে পারলেও তো কাজ হতো, ঝকঝকে ঝরঝরে হয়ে যেত শরীরটা। কিন্তু তা আর পারে কই ? জোলার পাড়ের মতো এখানে কি আর অত ঝোপজঙ্গল আছে ? আছে নাকি লকলকিয়ে উঠে যাওয়া তিতাদুম্বার লতা ? দু-একটা নিমগাছ, তাও তো নাই! আছে খালি খোলা স্কুলমাঠের মধ্যে থরে থরে সাজানো তাঁবু, আছে খালি চুলকানির বেছন। তা হলে এই বালিশে, এই শরীরে আর এই চুলকানিতে নিখিল ভালো থাকে কেমন করে! সারাদিন খালি গা চুলকায় আর শাপশাপান্ত দেয় কাকাকে। কাকার জন্যেই তো বাড়িঘর সব ছেড়ে আসতে হলো, নইলে বাবা তো দোমনাই ছিল। তার ওপর দাদু যখন গুলি খেয়ে মারা গেছে শুনল তখন তো বাবা ধপাস করে মাটির ওপর শুয়ে গড়াগড়ি দিতে দিতে বার বার বলছিল, ‘আমি আর কুনুখানেও যাবো না রে। বাপ এইহানে, মা এইহানে, আমারেও এইহানে রাখ্যে যা তরা…’।

অবশ্য তার আগেও কত ঘটনা! একটার পর একটা―এরকমভাবে আর সাজাতে পারে না নিখিল। এলোমেলো হয়ে যায়। পরের ঘটনা আগে চলে আসে, পরের ঘটনা চলে যায় আগে। মনে পড়ে, এক দিন এসেছিল খানের ব্যাটা খান, মানে জব্বার খান। খানের ব্যাটা খান জব্বার এল, কাগজপত্রে সই-স্বাক্ষর নিলো আর কী সুন্দর করে বলল, ‘সময় খারাপ, কী দিয়া কী যে হয়, তোমরা কুনু চিন্তা করবা না। তোমাগের যা রাখ্যি যাব্যা, যেমনি রাখি যাব্যা, সব তেমনি থাকব্যো। বিপদ-আপদ কখন কী হয়, তাই এট্টু টিপসই রাখলাম। হিসাবপাতি রাহা আর কি! অ নিয়্যা চিন্তা কইর না।’ কোনখানে যুদ্ধ হচ্ছে, কী করে হচ্ছে, নিখিল কি আর জানে, নিখিল কি আর বোঝে অত ভালোভাবে; বাপ-মায়ে যা বোঝে, সেই বুঝে সেও চলে এল তারপর এই পাড়ে। পেছনে পড়ে থাকল অত অত সব গোলপাতা, অত অত সব তিতাদুম্বা, অত অত সব নিমের পাতা। গোলপাতা যখন নাই, তখন তো এরকম ঘরেই থাকতে হবে! তাছাড়া তিতাদুম্বা আর নিমপাতা যখন নাই, তখন চুলকানিই বা হবে না কেন! মাঝখানে অবশ্য তালপাকানো এক ভাদ্রের দুপুরে একদল বিদেশি এসে নিখিলদের মতো পোলাপানদের সবাইকে ধরেবেঁধে গোসল করিয়েছিল। ব্যাপারটা মনে হয়, এই তো সেদিনের ঘটনা―কিন্তু আসলে ওই ঘটনার পরও তো দিনরাত কমপক্ষে ১০-১৫টা চলে গেছে কোন উজানে। তা যাক, তাদের নিজেদেরই কি আর গোসল করার অত খায়েশ ছিল ? এই তল্লাটে যত পুকুর আছে, সব পুকুরেরই একই দশা। অমল কাকা বলে, এখানে যে পুকুর যত ভদ্রপাড়ায়, সেই পুকুরে তত বেশি স্যুয়ারেজের প্রস্রাব-পায়খানা এসে পড়ে। তা যাই হোক, কোনও একটা জায়গায় স্নান তো সারতে হবে! সেদিন লাভের মধ্যে এটুকুই ঘটে যে, স্নান করে উঠে চুলটুল আঁচড়িয়ে খোসপাঁচড়ার মলম লাগানোর লাইনে দাঁড়ালে আর মলম লাগালে পাঁঠার মাংস আর মুগের ডাল দেয়া খিচুড়ি খেতে দেওয়া হলো তাদের। তা ওই নাকি পেটভরে পাঁঠার মাংস খাওয়ানো! অথচ তিন-চার দিন ধরে কী ঢাকটাই না পেটালো মানুষগুলো―১৬ বছরের নিচে যারা আছে, স্নান করিয়ে চুলকানির ওষুধ দিয়ে তাদের সবাইকে পেট ভরে পাঁঠার মাংস খাওয়ানো হবে! তা শুনে পারলে নৃপেনের ৭৩ বছরের দাদা পর্যন্ত বাচ্চা-কাচ্চা হয়ে যায় আর কি। কিন্তু একটাও দাঁত নাই আজ এক যুগ হয় আর পেটও ভীষণ জ্বলে ওসব খেতে গেলে, তাই চোখ দিয়ে দরদরিয়ে জল যতই গড়াক, খানিকটা দুধ খেয়েই বেচারাকে শান্ত থাকতে হয়েছিল সারা দিন। তবে হ্যাঁ, টুকরা দুয়েক হলেও, হাড়হাড্ডি আর রাবারের মতো পাঁঠার মাংস হলেও কিছু একটা তো জুটেছিল সেই দিন! আর গোসলটাও হয়েছিল বেশ মনের মতো। এখন এসব মনে করতে করতে একটু আবেগও এসে যায় নিখিলের। আহ্, সাবান-টাবান না হোক খানিকটা খৈল পেলেও হয় তো। চুলটা আবারও পরিপাটি করা যায় ঘষাঘষি করে!

অবশ্য পাওয়া গেলেই বা কী আর না গেলেই বা কী! বাঁচা-মরার কীইবা বোঝে নিখিল। তারপরও মনে হয় বেঁচে যে আছে, এই তো অনেক! এখন মুশকিল তার একটাই, মায়ের সঙ্গে দৈনিক বেশ দাবড়াদাবড়ি হচ্ছে আর তাতে মুশকিল হয়েছে যে, বাপে-কাকায় কখনও ধাওয়া দিলে বাঁচার কোনও উপায়ই থাকছে না। মা আর এগিয়েই আসছে না হাতের ডানার নিচে তাকে টান মেরে লুকাতে লুকাতে তারস্বরে বলে উঠতে, ‘কী হচ্যে ? কী হচ্যে ? এইটুক এ্যাকখান পোলা, তার সাতে অত হাঁচোড়পাঁচোড় করছো ক্যানে ?’ বাপ-কাকার ব্যাপারটা বোঝা যায় কিন্তু মা যে কেন তাকে দাবড়া-দাবড়ির ওপর রাখছে সেটাই ধরতে পারছে না নিখিল। এমন নয়, সে খুব বেশি বকর-বকর করে আর তাই এমন কোনও কথা লোকজনের কাছে বলে ফেলেছে, যেটা বাবা-কাকাদের খুব ঝামেলায় ফেলে দিয়েছে। এমনিতেই নানারকম অশান্তিতে আছে নিখিল―আসার সময় লাটিমটা আনতে পারে নাই, ট্যামটেমিটাও না, আর গোল চাকাটা বগলের নিচে নিয়ে দৌড়াচ্ছে দেখে কাকা তো রীতিমতো অশান্তিই বাঁধিয়ে ফেলেছিল। এত কিছু ফেলে এইভাবে চলে আসাটা কি আদৌ ভালো হয়েছে খ্যাগড়াঘাট থেকে ? তার চেয়ে তার তো মনে হয় থেকে গেলেই ভালো হতো! কিন্তু কাকা যে কী ভয়ানক অস্থির হয়ে উঠেছিল! প্রতিদিন ফিসফিস করত বাপের কাছে এসে, ‘এভাবে এখানে আর কয়দিন থাকবা ? এভাবে থাকা যায় ? কুনু ভরসা আছে ? কে যে কোনখান দিয়ে কোন শত্রুতা বাঁধায়ে বসবে আর ওই জব্বার খানের কাছে আরও কত কানকথা লাগাবে, তার নিশ্চয়তা আছে ?’ কাকা এমনভাবে এসব বলত, মনে হতো ইনডিয়ায় চলে আসলে রাজার হালে থাকা যাবে। মনে হয়, পুরা ভারতবর্ষ কাকার চেনাজানা মানুষজনে ভরা, পূর্ববাংলার পদ্মা নদী থেকে শুরু করে ওই হিমালয় পর্যন্ত সবাই তাদের আত্মীয়-স্বজন।

এক দিন যায়, দুই দিন যায়, তিন দিন যায়… কয়দিন আর এসব কথা হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায় ? কয়দিন আর শুনতে শুনতে চুপচাপ থাকা যায় ? কয়দিন আর ভ্রƒ-কপাল কুঁচকে উপেক্ষা করা যায়। তার ওপর কানে এসে দৈনিক ঢুকে পড়ছে হরেক রকম খবর। ভার্সিটির জগন্নাথ হলের কেউই নাকি আর বেঁচে নাই, যশোরের যশোধারা দিদিদের মাসতুতো ভাইও মারা গেছে। নাই হয়ে গেছে সেগুনবাগিচায় কোনও এক আত্মীয়র বাসা থেকে পড়াশোনা করা যুথিকা দিদি। এরকম কত ঘটনা! কোনটা রেখে কোনটা আর মনে করবে নিখিল! তারপর এক দিন কী হলো, বাপ তার নদী পেরিয়ে হাটে গিয়েছিল। হঠাৎ করেই বেলা গড়ানোর অনেক আগেই আবার ফিরে এল সে। কাকাকে ডেকে নিল যতদূর সম্ভব গলাটা নামিয়ে।

বাপের গলা সেই যে নামল আর কখনওই উঠল না। অবশ্য এ কথাও পুরোপুরি ঠিক না―ওঠে, নিখিলকে দেখলেই তার গলা কেমন সাড়ম্বরে ওপরের দিকে উঠতে থাকতে।

মন ভালো করার জন্যে নিখিল এখন এই ক্যাম্পের একমাত্র কাঞ্চন গাছটার নিচে বসে পড়ে। দূরে শ্যামসুন্দর কাকার টুঙ্গি দোকানের রেডিওটায় গান হচ্ছে, ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে…’। শুনতে শুনতে মনটা একটু ভালো হয়ে উঠতে থাকে নিখিলের, শরীরটা দুলে দুলে ওঠে, সাগর না হোক―হজিরগাঙ, বিষ্ণোনদী, মংলা নদী, মাদারতলী নদী, এরকম বারো নদী তের খাল আর চৌদ্দ ঘাট পাড়ি দিয়ে তারা যে এল এই মানা ক্যাম্পে, তাও কি কম নাকি। গলা যতই নামিয়ে কথা বলুক বাপে, তার ঠোঁটের ওঠানামা দেখলেই তো বোঝা হয়ে যায় নিখিলের, আসলে কী বলছে বাবা। বাপে বলছিল, খানরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠার আগেই কথাবার্তা বলে জমিজমা বাড়িঘর সব মেদি দিয়ে ফেলতে। তা বুদ্ধিটা কাকার পছন্দ হয়েছিল বটে, জমিজমা বাড়িঘর বিক্রিও হলো না, আবার রক্ষণাবেক্ষণের দায়ও আর নিজেদের হাতে থাকল না। এখন তোরা খানসেনা হ আর রাজাকার হ, মুজাহিদ হ আর শান্তি কমিটির হ―কুনু সমস্যা নাই যা নিজেরা নিজেরা মাথা ফাটাফাটি কর।

কিন্তু খানের ব্যাটা খান জব্বার কি আর অত কম বুদ্ধির মানুষ! দরদ দেখাল, চোখমুখ দেখে মনেও হলো এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে কিন্তু কাঁদল না একটুও। মাছির গোয়ায় কাছি লাগিয়ে খায় এমন ধুরন্ধর মানুষ খান জব্বার। তার সঙ্গে পারা কি আর অত সহজ। কাঁদল না বটে কিন্তু কী করে যেন ভাসিয়ে ফেলল সে ঘরদোর থেকে শুরু করে মন পর্যন্ত সমস্ত কিছু, ‘কী আর কব রে ভাই, হিন্দু-মুসলমান, তাতে কী ? প্রতিবেশী আমরা। সুখেদুখে একসাথে আছি। তোমাগের জমিজমা বাড়িঘর আমি কেমনে কিনি, কও ? আর বেচবা ক্যান ? থাক, সবুর করো। আল্লায় নিশ্চয়ই মুখ তুলে চাইব। অবশ্য হিন্দু মানুষ তোমরা, তার উপুর আবার মূর্তিপূজা কর, তোমাগের দিকে ক্যান মুখ তুলে চাইব। তাও আমার মাতায় ঢোকে না। কিন্তু তোমাগের বাড়িঘর জমিজমা আমি কিনি কী কইরা ? আমার আত্মা ফাইটা যায় না ?’

তার ওই বুক থাপড়ানি দেখে কে বিশ্বাস করবে কয়েক দিন আগে এই খানের ব্যাটা খান জব্বারই তাদের গাঁয়ের প্রতিটা বাড়ির মরাই খুলে মাটির ওপর তালাই পেতে ধান মেপে নিয়ে গেছে আর বলে গেছে, কোনও চিন্তা করিও না, পাঞ্জাবিরা আর যেহানেই যাইক তোমাগের গাঁয়ে পাও ফেলবে না। তা এই জব্বার খানেরই যখন তাদের জায়গাজমি কিনতে আত্মা ফেটে যায় তখন আর কেউই যে তা কিনতে চেয়ে কপাল ফাটাবে না, তা বুঝতে কি আর সমস্যা হয় ? অতএব কী আর করা, বাবা-কাকা আবারও ফিসফিসাতে লাগল একজন আরেকজনের সঙ্গে। পরে শুনেছে নিখিল, তারপর দুজনেই নাকি গিয়েছিল ফের খান জব্বারের কাছে, ‘না কেনেন, মেদি রাহেন। আমরা যা পাই তা নিয়া বর্ডার পাড়ি দেই। কপাল ভালো থাকলি দেশ স্বাধীন হব্যে, ফিরা আইসা নিয়া নিমু আর কি।’ এই মেদিই তো প্রথমে দিতে চেয়েছিল বাবা আর কাকা কিন্তু অবস্থা দেখে বুঝতে পেরেছিল, ভিটা থেকে পা নামালে চিরদিনের জন্যেই নামাতে হবে। কিন্তু যে জমিজমা বাড়িঘর দুই দিন বাদে এমনিতেই পাওয়া যাবে সেসব কেনার আর মেদি রাখার মতো বোকা তো আর খান জব্বার না। তারপরও উৎসাহ সে কম দেখাল না, ‘এইটা তোমরা ভালো বুদ্ধি বের করছো। তোমাগেরও সম্মান থাকল, আমারও দুঃখ থাকল না। আমার থাকল আশা―আশা―, প্রতিবেশী কিছু দিনের জন্যে বিদায় নিছে। যাওয়ার আগে আমানত রাইখা গেছে। নিশ্চয়ই ফির‌্যা আইসব কুনু না কুনু সময়।’

যুদ্ধ শুরু হলো বসন্তে। তারপর কোনও মতে গ্রীষ্ম পেরিয়ে বর্ষা এসে গেছে। আর কিছু দিন গেলে, শ্রাবণ পেরিয়ে ভাদ্র এলেই মনসাপূজার কাল। কিন্তু চুলোয় গেল মনসাপূজা। তাদের এই গ্রামজুড়ে উঠানে উঠানে পোলাপান, হাঁটতে গেলে বেধে যায় হাতে পায়ে। অতএব মনসাপূজা না হলে চলে ? আর সেজন্যেই তো উঠোনের ওই কোণে কোনওমতে টিন দিয়ে তোলা একটা ছাপড়ামতো মন্দিরে প্রতি বছরই সন্ধেবাতি জ্বালানো হতো। বাপ-কাকারা মাটির মনসামূর্তি কিনে আনত বাজার থেকে। যত দিন না বিয়ে হয়েছিল তত দিন ঝর্নাদিই ওই মূর্তি বানাতো। যদিও তারপরও বাবা আরেকটা মূর্তি ঠিকই কিনত। কিন্তু এখন অন্যরকম সময়, একদিকে সাপের ভয়, অন্যদিকে আবার সাপের মতোই পাকিস্তানিদের। দুইয়ের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছে খানের বাচ্চা খান জব্বার―পুরাই রাজাকার। কাগজপত্রে সই-সাক্ষর করে রাখল সে। সেই কাগজে কী না কী লেখা ছিল কে জানে! নগদ টাকা দিল কয়েকশ। বাবা অবাক হয়ে তাকালে আর তার হাতের আঙুলগুলো টাকা কয়টাকে স্থবির হয়ে আটকে রাখলে খান জব্বারের মুখজুড়ে আন্ধার নেমে এল। বলল, ‘টাকাপয়সা আর কোনে পামু কও ? অ্যাহন কারও হাতে টাকা-পয়সা আছে ? চিন্তা কইরো না, তোমার বাড়িঘর জায়গাজমি সব দেইখা-শুইনা রাখা হব্যি। এ টাকা তো আর মেদির জন্যে না, বন্ধকির জন্যেও না। বিপদে আছো, আপনজনগারে কাছে যাইতেছো, ফাঁড়া কাইটা গেলিই চলে আসবা আর সব বুঝে নিবা।’ আবার ঘর থেকে বেরিয়ে নাওয়ে উঠতে পারল না, তার আগেই সোনার গয়না-টয়না যেসব ছিল সেসবও হাতড়ে নিল খানের ব্যাটা খান, ‘এসব এহন কেউ সাতে কইরা  নেয় ? রাস্তাঘাটে কত বিপদ-আপদ, তার মইধ্যে এসব দামি জিনিসপাতি নিয়া যাওয়া কি ঠিক ? আমার কাছে রাইখা যাতি সমস্যা কি ? চিন্তা কইরো না, সব যত্ন কইরা রাইখা দিমু।’

কারও মুখে কোনও কথা নাই। পা যেন আর এগোয় না। ঠিক তখনই কোনখানে কোন আকাশে কড়ড় কড়ড় করে উপচে ওঠা গুলির শব্দ তাদের পায়ে গতি এনে দিল। কণ্ঠে ভাষা এনে দিল। হাতে এনে দিল রমরমা শক্তি। নৌকায় উঠবে কী, দৌড় লাগাল সবাই―পলাও পলাও পলাও… আসতিছে। খানসেনারা আইসতেছে―

তখন শুরু হলো পড়িমরি দৌড়। খানের ব্যাটা খান যেটুক অবশিষ্ট রেখেছিল বাক্সপেটরা আর বোচকার মধ্যে সেটুকুও আর নেওয়া হলো না। নিঃস্ব, নিঃস্ব হয়ে গেছে তারা―এরকমই শুনেছে নিখিল বাবার মুখে। সন্ধ্যা নামবে তখন কিন্তু তার আগেই নামতে শুরু করল জীবনের সন্ধ্যা। রাস্তায় ছুটতে ছুটতে কেবলই মনে হলো নিখিলের। এই ঝিম মেরে থাকা ছোট্ট একটা গ্রাম তাদের। এখানে এত লোকজন এল কী করে। দৌড়াচ্ছে আর ধাক্কা খাচ্ছে। ধাক্কা খাচ্ছে মানুষের সঙ্গে। মানুষের পায়ের সঙ্গে। রাস্তার ধারের গাছগাছড়া এমনকি ভাটগাছের মূলের সঙ্গে। ধাক্কা লাগছে পায়ের তলে পড়ে থাকা রাস্তার ঘাসদূর্বা আর মাটির সঙ্গে। কানের মধ্যে এসে ঢুকছে কেবল চিৎকার আর ক্যাড়ড়ড়ড় ক্যাড়ড়ড়ড় আওয়াজ। সাইকেলের গ্যারেজের কাছটায় কারা যেন পড়ে গেল মাটির ওপর। টলে পড়ল। মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাতে শুরু করল। কিন্তু কে শোনে কার কাতরানি। তাদের ওপর দিয়েই ছুটে যেতে লাগল ভীত মানুষের দল। তবু ওরই মধ্যে কার যেন চিৎকারও শোনা যেতে লাগল, ‘মারিস না লো। জানে মারিস না…’

ওরে বাপ রে বাপ, সেসব কথা চিন্তা করতে গেলেই নিখিলের মাথা ঘোরে। কে যেন কোনখানে ছিটকে পড়ল। নাকি ছিটকে পড়তে পড়তে পরপারেই চলে গেল, কে তা জানে! কী ফাঁড়াটাই না গেছে ওই কয়দিন। তা শরীরটা এখন খোঁচপাচড়া আর চুলকানিতে ভরে গেলেও আর খুসকিতে ভরা মাথাটায় সবসময় অশান্তি লাগলেও সেই তুলনায় কী আরামেই না আছে এই ক্যাম্পে। তা খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট তো থাকবেই। মা যে বলে, ‘এই দ্যাশ কি আমাগের যে কষ্ট থাকবি না ?’ ঠিকই তো বলে। নাহ্, খুব অন্যায়ই হয়ে গেছে, মাকে ওই কথা বলা। সুযোগমতো মাফ চেয়ে নিতে হবে। ভাবে আর এলোমেলো এদিক ওদিক করে সে সারাটা ক্যাম্পজুড়ে। বড় অস্থির কয়দিন হয় ক্যাম্প। যেখানে যায়  সেখানেই লোকজন, সেখানেই কথাবার্তা কিন্তু তার কোনও আগামাথা নাই। যুদ্ধ নাকি এখন পাকিস্তানের সঙ্গেও ইনডিয়ারও লেগে গেছে। নিখিল দাঁড়ায় আর লোকজনের কথাবার্তা বোঝার চেষ্টা করে। টুঙ্গি দোকানের রেডিওর কাছে রাজ্যের ভিড়। মানুষজন কী যে শোনে, আর কী যে বোঝে, সেকেন্ডে সেকেন্ডে হই দিয়ে ওঠে।

সাধনকে পেয়েই ওর হাতের ডানা ধরে হ্যাঁচকা টান মারে নিখিল, ‘কী হইছে রে ?’

উফ্―মনে হয় ইচ্ছে করেই আরও জোরে কাঁতরে ওঠে সাধন। এই ক্যাম্পের সবচেয়ে ঝানু পাজি হলো সে, তাকে নিখিল পর্যন্ত মনে মনে গুরু মানে। অবশ্য ওদের বাড়ি আবার বরিশালে। তা বরিশালের হোক আর ফরিদপুরের হোক, শরীরের গাঁটে গাঁটে কী যেন আছে ওর। মা অবশ্য বলে, ‘বরিশাল থাইকে দূরে থাকবি’ কিন্তু তা আর সে থাকতে পারল কই! এখন যেমন, প্রথমেই তার মনে হলো আর কেউ না হোক, সাধনই ব্যাপারটা ভালো করে বুঝিয়ে বলতে পারবে তাকে। বলতে পারবে, মানুষজন কেন এত ভিড় জমাচ্ছে, মাঝেমধ্যে আবার স্লোগানও দিয়ে উঠছে, তাও এত জোরে যে মনে হচ্ছে, শালার বাঘ মার্কার মিছিল তাদের নাও মার্কার মিছিলের কাছে চলে এসেছে।

‘কী আবার হইব! আমার তো মনে কয় না, এই দফায় হিমালয় যাওয়া হইব রে নিখিল! খালি হিমালয় ক্যান, মনে কয় ওই ত্রিপুরায়ই যাওয়া হবি ন্যে।’

এক দিন পেটে কোনও ভাত ছিল না, বসে বসে সারা ভারত ঘুরে বেড়ানোর প্ল্যান করেছিল তারা। সাধন এখন সে কথা মনে করিয়ে দিলে খেপে ওঠে নিখিল, ‘চাপা মারিস কেনে ? তোর তিরিপুরা যাওয়া থামনের লাইগ্যা এত লোক ভিড় জমায়া রেডিও শুনতেছে! ঢপ মারার আর জায়গা পাস না, না ? হোন, বাগেরহাটের পোলাপাইনের সাতে কথাবার্তা মাইপে কবি, বুঝলি ?’

‘রাখ তোর বাগেরহাট। জানিস, যুদ্দু থাইমা যাত্যেছে ?’

থমকে যায় নিখিল। যুদ্ধ ব্যাপারটা খুবই জটিল, এইটা লাগে কেমন করে, থামেই বা কেমন করে, তার পক্ষে বোঝা মুশকিল। তার কাছে যুদ্ধ মানে কাশিমপুরের ওই খানের ব্যাটা খানের জোর করে কী সব কাগজপত্রের ওপর বাপ-কাকার টিপসই নিয়ে রাখা। ধামা ভরে মণকে মণ ধান দেওয়ার পরও রুস্তম আলীর তাফালিং শোনা। তা যা হোক, তারপরও ব্যাপারটা তো বোঝা দরকার!

‘যুদ্দু থামি যাইছে মানে ?’

‘ইনডিয়ার উপুরও পাকিস্তান গুলি চালাইছে, সিটা তো জানিস ?’

‘তা শুনিছি, তা শুনিছি।’

‘তালি ব্যাপারটা বুঝ। পাকিস্তান এহন ইনডিয়ার শান্টিংও খাইতেছে আর মুক্তিফৌজের শান্টিংও খাইতেছে! শান্টিং খায়্যা ম্যা ম্যা কইরতেছে। নিজেরাই কইতেছে, যুদ্দু থামাও, খ্যামা দ্যাও―’

তাহলে ঘটনা এই! রক্তের মধ্যে হঠাৎ করেই কেমন দুলুনি ওঠে নিখিলের। তা যুদ্ধ যদি থামে, ভালোই তো হয়, মাথা খুসকিতে ভরে গেছে, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে তিতাদুম্বা না পাক বিষ্ণো নদীর পাড়ের এঁটেল মাটির খানিকটা তুলে মাথায় ঘষলেও তো শান্তি পায় সে। ওই বিদেশিরা তাদের ধরেবেঁধে সাবান দিয়ে ঘষে ঘসে স্নান করাল। কী দিয়ে কী মাথায় ঘসে দিয়ে গেল। খালি ফ্যানাই উঠল তাতে কিন্তু ওতে কি আর পুরো কাজ হয় ? তার ওপর এই ক্যাম্পের বালিশগুলো এমন! বিদেশিরা চলে গেল সাবান মাখিয়ে দিয়ে আর সে রাতে ওই বিখ্যাত বালিশ মাথায় দিয়ে শোয়ার পর সকালে উঠতে না উঠতেই দেখল আবারও মাথাটা কেমন বারোয়ারি হয়ে গেছে! তাহলে যুদ্ধ থামার মানে হচ্ছে মাথাটা ভালো করে আগের মতো নদীর জলে পরিষ্কার করে নিতে পারা! আর যুদ্ধের মানে হলো দাবড়ানি খেয়ে বারো নদী তের খাল আর চৌদ্দ ঘাট পাড়ি দিয়ে এই দিকে চলে আসা! বোঝো ঠ্যালা। কী দিয়ে কী যে হয়, কে জানে! না হলে নাওয়ে ভোট দেওয়ার পরও এইভাবে দাবাড় খেতে হয়! অথচ নাওয়ে ভোট দিলে তো, কথা ছিল, তাদের দিনদুনিয়া পাল্টে যাবে। তা পালটাচ্ছে বটে। নইলে কি আর এখন খানসেনারা এমন দাবাড় খায়! উত্তেজনায় হাতের ডানা চুলকাতে চুলকাতে নিখিলও গলা মিলিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে দিতে দৌড়াতে থাকে মিছিলের দিকে।

স্লোগান দিতে দিতেই তার হঠাৎ চোখে পড়ে ক্যাম্পের কোণে উল্টে পড়ে থাকা ভ্যানের পাশে মা দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলছে আর কলকলিয়ে হাসছে পুটির মায়ের সঙ্গে। ‘হাসো, যত খুশি হাসো―আমি আর যাইতেছি না তোর ধারেকাছে,’ মনে মনে এই কথা বলতে না বলতেই ফের চোখে পড়ে নিখিলের, তার দিকেই দৌড়ে আসছে মায়ে। নাহ্, দুনিয়াটা নিশ্চয়ই আজ উল্টেপাল্টে গেছে! নইলে যেসব লোকজন এই গতকালও ক্ষিধের চোটে ভালো করে ‘জয় বাংলা’ বলতে পারত না, তারা আজ ক্ষিধে নিয়েও এত জোরে স্লোগান দিচ্ছে কেমন করে। আবার স্লোগান দিতে দিতে দেখ কেমন বলকে বলকে উঠছে ওই একঝাঁক দইনাচা উড়ে চলা আকাশের দিকে। আবার যে মা তাকে এই কয়দিন হলো ভাতের কথা বলতেই দাবড়ে বেড়াত সে আজ তাকে দেখেই ওভাবে খুশির ঝিলিক ছড়িয়ে দৌড়ে আসবে কেন! একটানে মিছিলটার মধ্যে থেকে নিখিলকে টেনে বের করে ফেলে মালতী দেবী। মিছিল থামে না, মালতী দেবীও থামে না। চোখমুখ ভরা রমরমা খুশি নিয়ে সেও হাঁটতে থাকে তবে উল্টো দিকে। এরকম রমরমা খুশি দেখে ভালো লাগে নিখিলের আবার দোমনাও লাগে।

‘ক্যা―অ্যাতো টানো ক্যা ? খাড়াও না―’

‘আয়―আয়―ভাত খাবি না ? খালি উধারকুধার থাকস… মাঝরাইতে আইসা ঝপাৎ কইরা খ্যাতার নিচে নুকি দ্যাস। ক্যা ? খাওয়ার সোময় আসোস না ক্যা ?’

‘তা বালোই তো। না খালিই তো বালো। তরা একমুঠ বেশি খাব্যার পারস। আমি মরলিই কী আর বাঁচলিই কী!―বলতে বলতে রাগে অভিমানে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে থাকে নিখিল।’

মালতী দেবীও কেঁদে ওঠে। জন্মের কান্না কাঁদতে থাকে। অক্ষমতা যে ক্রোধ জ্বালিয়ে তোলে তা যখন মিইয়ে যায় কিংবা আনন্দ এসে যখন অক্ষমতাকেও তলিয়ে দেয় কোন অতলে, মানুষকে তখন যে কান্না পেয়ে বসে মালতী দেবী এখন হাত-পা ছড়িয়ে ছেলেকে জড়িয়ে তেমনই কান্না কাঁদতে থাকে। দুঃখ, আনন্দ সবকিছু এখন একাকার তার হৃদয়ের গভীরে। জমে থাকা সব ক্রোধ আর বেদনা মিলেমিশে বার বার ধাক্কা দিচ্ছে আশার তরঙ্গ ছোঁয়া দিগন্তরেখাতে। আর সেই ধাক্কায় আশার তরঙ্গরাশি খান খান হয়ে ভেঙে পড়লেও ফের ছড়িয়ে দিচ্ছে রাজ্যের আশা। এসব তার ভালোবাসার মানুষ, প্রাণের মানুষ―এই নিখিল, এই স্বামী, এসব আত্মীয়-পরিজন―তাদের জন্যে কী-ইনা করতে পারে সে! এইবার তো এও দেখিয়ে দিল, দেহও বিকিয়ে দিতে পারে সে এদের মুখের খাবার জোটাতে। কিন্তু তারপরও―তারপরও কেন সে এদের ওপরেই রেগে ওঠে চোখের সামনে হঠাৎ করে দেখতে পেলে ? দেখতে ইচ্ছা হয় না। ইচ্ছা হয় লাত্থি মেরে মাটিতে ফেলে দুই পায়ে সমানে খচতে। মনে হয়, জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু এসে সামনে দাঁড়িয়েছে। খুন করে না ফেলা পর্যন্ত শান্তি নাই তার জীবনে। এত জঘন্য ঘৃণা আর এত সুতীব্র ভালোবাসা মিলিয়ে ধুকে ধুকে বেঁচে থাকা―এই এত সুন্দর পৃথিবীতে এই কি তার প্রাপ্য ছিল ? দীর্ঘ পথ মাড়িয়ে মানুষ নাকি সুখের দেখা পায় কিন্তু জীবনের এত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিল সে কেবল দুঃখকেই ফের স্পর্শ করবে বলে ?

‘বাড়ি যাব রে, এবার আমরা বাড়ি যাব রে―আর এমুন কষ্ট পাবি না রে বাপ।’―মালতী দেবী কাঁদে আর দুলে দুলে ওঠে নিখিলকে ঘিরে।

তাহলে যুদ্ধ মানে এই―কোনও দিন হুট করে ফের বাড়ির দিকে রওনা হওয়ার জন্যে ধাওয়া খেতে খেতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়া ? আর স্বাধীনতা মানে এই―গা-ভর্তি চুলকানি-পাঁচড়া, মাথাভর্তি খুসকি, শিশ্নভর্তি লালচে দাদের ক্ষত আর পেটভরা ক্ষুধা নিয়ে উদাম আকাশের নিচে নির্ঘুম রাত কাটাতে কাটাতে এক দিন আবারও ফের বাড়ির দিকে রওনা হওয়া ? ছোট্ট, অসহায়, কেবলই ডিম ফুটে বেরোনো একটা কর্কশ শালিক ছানার মতো নিখিল তার মায়ের দুই হাতের মধ্যে কাঁপতে থাকে এসব ভেবে ভেবে। ফিরে আসছে, এইবার ধীরে ধীরে সব স্মৃতি ফিরে আসছে তার চোখের সামনে। যেন রক্তের নদী সাঁতরে সাঁতরে ডাঙায় উঠে সে এবার ফিরে পেয়েছে সব কিছু মনে করবার প্রশান্তি আর স্থিরতা। এখন তার চোখের সামনে আবারও নাচানাচি করছে তাদের খ্যাগড়াঘাট গ্রাম। একপাশে তার হজিরগাঙ নদী, অন্যপাশে বিষ্ণোনদী। বাবা আর কাকা দূরে রাখার চেষ্টা করছে তাদের মতো ছোট ছোট পোলাপানদের। কিন্তু তারপরও তারা ঠিকই জেনে যাচ্ছে, কাশেমের ব্যাটা ক্যাশেম কেন এসেছিল। শালার খানের ব্যাটা খান জব্বার, মাথার মধ্যে কত কুবুদ্ধি তার। কাশেমের ব্যাটাকে দিয়ে ওই তো খবর পাঠিয়েছিল, ‘দিনকাল কত খারাপ, তা তো চোখির পারই দেখতি পারতেছো। তোমাগের শেলটার দিতি গেলি তো আমাগের জীবনও শেষ হয়্যা যাবে মনে কয়। নেতাগারে তো চেনোই। ক্যান অসহযোগের সোময় নুন আটকায়া রাইখা দাম বাড়াইছিল কেডা ? চেনো না ? চেনোই তো। শহরের লিডারগুলা তো খ্যাপা কুত্তা হয়্যা গেছে। কইতেছে, হিন্দুগের লোটো, চোদো আর পরান ভইরা খাও। এহন তোমাগের বাঁচানো কি মুহের কতা ?’ এমনভাবে কথা বলে কাশেম যে, মনে হয়, খুবই ধীরে ধীরে বলছে কিন্তু আসলে তার ভার এত বেশি যে, চুলার পাড়ে ঘসির ঘরে জড়োসড়ো হয়ে সিধিয়ে যাওয়া মেয়েরাও স্পষ্ট শুনতে পায়, ‘হোনো, খানের ব্যাটা কইছে। জান হাতে নিয়ে শেলটার দিবি। মেয়েগারে ইজ্জত সামলাবি; তে তোমরা তো একটা কিছু দিবা, না কি ?’ তারপর একটু থেমেছিল সে আর তার পরেই বলেছিল, ‘আমাগের তিন মণ করে ধান দিতি হবি।’

কিন্তু তাতেও কি কাজ হয়েছিল ? হয় নাই তো। হয় নাই বলেই তো এই ক্যাম্পে এসে ওঠা। কতজনের যে বহর ছিল সেটা, বাউলি নৌকাই তো ছিল ছয়-সাতটা, তাছাড়াও কত যে নাও, মনে হয় একশ-দেড়শ হবেই। আর কত গাঁয়ের লোকজনই না ছিল ছড়ায়ে ছিটায়ে―পেড়িখালি, ডাকরা, সন্ন্যাসী, সায়েড়া, খানপুর, সাড়ে চারআনি, মহিষঘাটা আরও কত যে গ্রাম। আর দুনিয়ায় নৌকাও যে কত! এত নৌকা আছে, তা কি কখনও চিন্তাও করতে পেরেছিল নিখিল ? বিষ্ণোনদী, মংলা নদী, মাদারতলী নদী আরও কত যে নদী―নদীর ধারে ধারে সব নৌকা। আর এসব নৌকাই তখন রাজ্যের সব হিন্দুর ঘরবাড়ি। নৌকার মাঝি-মাল্লারা আশ্রয় তো দিচ্ছে না, যেন গলা কাটছে। আট আনার জায়গায় নিচ্ছে তিন আষ্টা চব্বিশ টাকা। আর নদীতে কখনও ভাটা, কখনও জোয়ার। ওভাবেই কবে কোন মধ্যরাতে যেন জেগে উঠে নিখিল দেখেছিল ভোর হচ্ছে মইদাঁড়াতে। দেখেছিল, ময়লা ধুলিধূসর পায়জামা-পাঞ্জাবিপরা কাঁচাপাকা গোঁফওয়ালা এক লোক হাতজোড় করে তাদের বলেছিল, ‘মাফ করি দিও ভাইবোনেরা, দাদা-দিদিরা; তোমাগের রাখবার পারলাম না। আমরাও কত দিন থাকপের পারব জানি না। অ্যার বেশি কিছু করার সাধ্যি আর আমাগের নাই বাবারা। এই অনাচার, খুনোখুনির মধ্যে কী আর কব কও। তোমাগের জায়গায় তোমাগের রাইখপের পারলাম না। মাফ করি দিও বাবারা।’

লোকটা দরদর করে কাঁদছিল। যেতে যেতে মায়ের কোলে শুয়ে তাই দেখছিল নিখিল। আর দেখতে দেখতে লোকটা একসময় মিলিয়ে গিয়েছিল। নৌকা বহর গিয়ে ঢুকেছিল পশর নদীতে। এভাবে যেতে যেতে, এখানে ওখানে থামতে থামতে এক দিন দেখা মেলেছিল ইছামতির। নিখিল শুনেছিল, মাকে বলছে বাবা, ‘আর ডর নাই নিখিলের মা। ওপারে গেলিই পশ্চিমবঙ্গের টাকি। সেখানি গেলিই আর চিন্তা নাই নিখিলের মা। হেদায়েত ভাই কই দিছে, বডার সিলিপ দেয়, হেই সিলিপ নিয়া ওইখানে থাকতি। না অয় ট্রেনে কইরে মানা ক্যাম্প―হেনেও যাওয়া যায়।’ তাই করেছিল তারা, টাকি থেকে নিয়েছিল মানা ক্যাম্পের কার্ড। তা সঙ্গে বেশ চিঁড়া আর গুড়ও মিলেছিল। আহ্, কী যে সোয়াদ! চিড়া-গুড় খেয়ে এত সোয়াদ নিখিল জীবনেও পায় নাই। সব গুছিয়ে মাদুর গুটিয়ে রওনা হয়েছিল তারা টাকি থেকে আর রায়গঞ্জ স্টেশনে নেমে চড়ে বসেছিল সরকারি লরিতে।

আবারও কি সেই একই পথে ফিরতে হবে তাদের ? এত লোক ফিরবে কেমন করে! বাবা এক দিন কথায় কথায় বলেছিল, ৮০ হাজার মানুষ নাকি আছে এই মানা ক্যাম্পে। ‘আরে বাপ রে, এত মানুষ আলো কুত্থিকে! আর ফিরবিই বা ক্যামনে।’ এই চিন্তা নিখিলের কান্না থামিয়ে দেয়। এই প্রথম তার এই চিন্তাও মাথায় আসে। কামকাজ কোনও কিছু নাই। এই যে ৮০ হাজার মানুষ বসে বসে এত দিন খাওয়াদাওয়া করল তা ঘণ্টই খাক আর ফেন্টুই খাক, এই যে এত দিন থাকল তা তোষকের ওপর না থাকুক মাদুরের ওপর তো থেকেছে। বালিশগুলোয় খইল জমে থাকুক আর তেল জমে থাকুক, বালিশ তো দিয়েছে―বেকার এতগুলো লোকের খাইদাইয়ের খরচ এল কোত্থেকে। খ্যাগড়াঘাটে তাদের গোলাভরা ধান, জমির পর জমি―হোক তা একফসলি, তাতেও তো সোনা ফলে। কিন্তু এইখানে ? এইখানে তো তারা বেকার! নাহ, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে। দৈনিক মুজিব আর ইন্দিরার ফেস্টুন নিয়ে মিছিল করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে তারা সবাই।

তা দিন পনেরো বাদে জানা গেল, এইবার তারা ফিরতে পারে। ফিরতে পারে নিজেদের ভিটাভুঁইয়ে। কিন্তু তারপরও তো আরও দিন পনেরো কাটল। শেখের ব্যাটা যেদিন ফিরে এল, সেই দিন মালতী গালভরা হাসি হেসে নিখিলকে জানাল, ‘এইবার তর বাপেক কেউ আর ধরিবান্ধিউ রাখতে পারব না রে নিখিল। কিন্তু ফিরে যাওয়ার উপায় মিলছে না, রাস্তা মিলছে না―তাই তারপরও থাকতে হলো আরও অনেক-অনেক দিন।’

তারপর শীত পেরিয়ে বসন্ত চলে আসার পর এক দিন উদভ্রান্তের মতো ক্যাম্পে এল বাবা, খুঁজে পেতে বের করল ভারত সরকারের দেওয়া কার্ড―যা মহামূল্যবান, যে কার্ড থাকার মানে এই যে তারা শরণার্থী হতে পারে কিন্তু অবৈধ কেউ না। তাবুর পর তাঁবু, সেসব তাবু এখন শূন্য হতে চলেছে, যারা পেরেছে তারা ফাঁকফোকর দিয়ে অনেক আগেই চলে গেছে আর তাদের মতো যারা এখনও যায়নি, তাদের জন্যে এবার এসেছে সরকারের লরিগাড়ি। ময়লা বর্জ্য রোদে শুকাতে শুরু করেছে কিন্তু শীতের রেখে যাওয়া আর্দ্রতায় ভেজা বসন্তের সূর্য পারছে না তাদের পুরোপুরি গ্রাস করতে, তাই মানুষ কমলেও গন্ধ যেন-বা আরও বেড়েছে। সেই গন্ধ নিতে নিতে নিখিল ভাবে, এবার বাড়িতে ফিরে পাঠার পাকস্থলি দিয়ে একটা ট্যামটেমি বানাবে। প্রথমেই যাবে সতীশের মিষ্টির দোকানে। বাকিতে হলেও পেট ভরে জিলাপি খাবে। সঙ্গে গরম জিলাপির একজগ সিরা খাবে চুমুক দিয়ে। নিশ্চয়ই এই ক্যাম্পে এসে যে আমাশা হয়েছে তা সেরে যাবে এক দিনের মধ্যেই। বাবা কার্ড জমা দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে গেছে দেশে ফিরে দুই মাস চলার মতো চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ এসব। রিলিফ পাওয়া হাড়িপাতিল, জামা-কাপড়, কম্বল―সেসবও গুছিয়ে ফেলেছে মা। তারা আছে, কাকারা আছে―আপাতত এতেই কেমন স্বস্তি লাগে আর কে যে কোথায় কোন অবস্থায় আছে, কোন ক্যাম্পে আছে, নাকি ক্যাম্প থেকে বাড়ি ফিরেছে, নাকি শ্মশানে ছাই হয়ে গেছে, নাকি মাটির ওপর অথবা নদীর পানিতে মিলিয়ে গেছে, কে তা জানে! এই শোক, এই দুঃখ, তবু তো তর সয় না। রায়গঞ্জ স্টেশন থেকে রেলে ওঠার আগে হঠাৎ কী হয় মালতী দেবী বলে ওঠে, ‘আশ্রয় দিছিল এই মাটি, আয় রে নিখিল, যাওয়ার আগে পেন্নাম করি যাই…’

বলে উবু হয়ে প্রণাম করে সে মৃত্তিকাকে। দেখাদেখি নিখিল আর বাবা, কাকারাও করে। ট্রেনে কী ভীষণ ভিড়, উঠতে উঠতে নিখিল তার মাকে বলতে থাকে, ‘আসুম, বড় হয়্যা আমি মাঝেমধ্যে আসুম মা এইহানে। চিন্তা কইর না’ কিন্তু অজস্র মানুষের কণ্ঠস্বর, চেঁচামেচি তার কণ্ঠ ঢেকে দেয়।

তবে বড় হতে হলো না নিখিলকে।

খুলনা রেলস্টেশনে নামার পর রূপসার ধারে এসে নৌকায় নদী পেরিয়ে নিখিলরা ট্রেন ধরেছিল বাগেরহাটের। তারপর টাবুরে নৌকায় করে দড়াটানা নদী হয়ে এসে নেমেছিল খ্যাগড়াঘাটে। টাকা-পয়সা নিয়েছে নিক, গোলার ধান নিয়েছে নিক, জোর করে সই নিয়ে রেখেছিল―তাতেই বা কী! শেখের রাজত্ব এখন, এটা কি আর জোর যার মুল্লুক তার নাকি! মালতী দেবীরা জিনিসপত্র নিয়ে এগোচ্ছিল ধীরে ধীরে হেঁটে হেঁটে। অত তাড়াহুড়োর কী আছে ? স্বাধীন দেশ, কী ক্ষতি হয়ে গেল, কত ঘর পুড়ল, কত মানুষের লাশ পড়ে আছে, দেখতে দেখতে এর ওর সঙ্গে কথাবার্তা বলতে বলতে এগোচ্ছিল তারা। সারা রাত ঘুম হয় নাই। তবু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে ঘুম দেওয়ার ইচ্ছা জাগে না। শুধু নিখিল আর সাধনই দৌড় দিল, তর আর সইছে না, মরণপণ দৌড় দিল বাড়ির দিকে। কতক্ষণ আর লাগে নদীর ঘাট থেকে বাড়ি পৌঁছতে!

তবে বাড়িতে পৌঁছেই অবাক হয়ে গেল! মনেই হচ্ছে না সেই রাতে তাদের এই বাড়িঘর পুড়ে গিয়েছিল। সবকিছু নতুন―একেবারে নতুন বলতে উঠোনের এই বাইরের দিকে একটা ছোট চারদিক খোলা গোলপাতার ঘর। খানের ব্যাটা খান জব্বার তা হলে একেবারে খারাপ না! সেদিন রাতে যত যাই করুক, বাড়িঘর আর মালপত্র তো ভালোভাবেই রেখেছে। প্রচণ্ড উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে নিখিল।

‘ওই-ওই-তুই ক্যাডা রে ? বলা নাই, কওয়া নাই বাহির ভিতরে―’ তারস্বরে চিৎকার করতে করতে ধেয়ে আসে এক নারী।

‘তো কী হইছে ? বাড়ি তো আমাগেরই!’

‘ইহ্, বাড়ি তো আমাগেরই―পাগল নাহি! যুদ্দু শ্যাষ হইয়া দেখা যাতিছে। পাগল-ছাগল বাড়ি গেছে! কেডা রে তুই ? তোর বাপের নাম কী ?’

‘আমি নিখিল সরকার। পিতা বিমল সরকার। সাং―খ্যাগড়াঘাট…’

বলতে বলতে নিখিল এদিক সেদিক তাকায় আর বাবা-মাকে খোঁজে। দেখে বাবা-কাকারাও বাড়ির আঙিনায় এসে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। পাশেই অমল কাকার ভিটা। কিন্তু সেটাও ফাঁকা নেই, পোড়ানো বাড়ি ভেঙে নতুন করে ঘর তুলছে কয়েকজন।

‘কেডারে―কতা কয় কারা রে ?’―বলতে বলতে বাড়ির ভেতর থেকে খানের ব্যাটা খান জব্বার বেরিয়ে আসে, আর তাদের দেখে একটু থমকে যায়। কিন্তু তার আর কতক্ষণ। মুহূর্তেই চোখেমুখে হাসি ফুটিয়ে বলে, ‘ও―তোমরা! আসছো, ভালোই কইরছো। আমরাও তো ভাবতিছিলাম, সেই যে গণ্ডোগোল শুরু হইল। বাড়িঘর সব বেচাবিক্রি দিয়া চইলা গেলা; তা এহন তো দ্যাশ স্বাধীন। এহন তো আইসা বাড়িঘর এট্টু দেখি যাতি পারো!’

দম আটকে আসে নিখিলের। দম আটকে আসে অন্য সবারও! বলে কী এরা! বাড়িঘর তারা বেচল কখন! বাবা আর কাকার মুখে কথা জোগাচ্ছে না। কিন্তু মালতী দেবী থামে না, ‘ইসব আপনি কী কতিছেন! বাড়িঘর বেইচলাম কহন ? জোরজবরদস্তি কইরা সই নিয়া রাইখলেন, মুহেও তো কইলেন, দেইখাশুইনা রাখবেন। এইডা দেইখাশুইনা রাহার নমুনা ?’

‘হ, হ,―বিপদের দিনে সাহায্য করছিলাম। এহন তো কইবাই। আমি তহনই বুঝবার পারছিলাম স্বাধীন হলি দ্যাশে ফিরা ঝামেলা পাকাইবা। এত লোভ ক্যান তোমাগের ? ভিটাবাড়ি বিক্রি কইরা চইলা গ্যাছ―যেহানে গ্যাছ সেহানেই থাহো। এইহানে ফির‌্যা আইসা পুরান জাল দলিলদস্তাবেজ দেখায়া ভ্যাজাল পাকানের কুনু মানে হয়?’

‘হ―আছিলেন রাজাকার, খানসেনাগারে দালাল। আর এহন বড় বড় কতা―’

‘চুপ কর মালুর বাচ্চা―এহনও ত্যাজ কমে নাই, না ? তগারে উপকার করাই হারাম। রাজাকার আছিলাম, না ? কত মুক্তিযোদ্ধাক আশ্রয় দিছি, জানিস ? কতজনেক রাইতের বেলা খাইবার দিছি জানিস ? কতজনের জান বাঁচাইছি, জানিস ?’―পাশের বাড়ির দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বলতে থাকে সে, ‘এই শামসুল, আয় তো―দেখ, হারামজাদায় কী কয়। তুই তো মুক্তিযোদ্ধা আছিলি, তুই-ই ক, মুক্তিযোদ্ধাগারে আশ্রয় দেই নাই?’

‘হ, দিছো। মাথা বরাবর বন্দুক রাখলি রাজাকারও আশ্রয় দেয়। রাজাকারও রাইন্ধা খাওয়ায়। অ আমাগের জানা আছে।’―দারুণ রোষে বলে মালতী―‘একবার রাজাকার হইয়া লুট কইরছ, এহন আবার করতেছ মুক্তিযুদ্দা সাইজা! ওই শামসুল, তুই জানস না ও রাজাকার ? ও-ও-ও, তোক বাড়িঘরের ভাগ দিছে, না? তোক ভাগ দিয়া হে মুক্তিযোদ্ধা হয়্যা গ্যাছে ? দুই দিনেই―দুই দিনেই তোমাগের এই দশা?’

‘আপনেরা চুপ করেন তো। বাড়িঘর আপনেগারে, এই তো কইবার চান? ঠিক আছে যান, থানায় যান, ওসি দারোগাগারে সাতে কথা বলেন। মুক্তিযোদ্ধাগারে কমান্ডার আছে, তাগরে সাতে কতা বলেন। হেরা আসুক, হের পর দেখা যাবি নে, ঘরবাড়ি কাগের।’―বলতে বলতে শামসুল একটা বড় বাঁশ নিয়ে বুক বরাবর সোজা করে ধরে তাদের সবাইকে ঠেলতে ঠেলতে বের করে দেয় বাড়ির আঙিনা থেকে।

নিখিলও পড়ে থাকা একটা বোচকা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এগোয় তাদের দিকে। বসন্তের হাওয়া চারপাশে, প্রচুর শিমুলও ফুটেছে এবার। কোথাও কোনও চিৎকার নেই, থমথমে ভাবটাও নেই। কিন্তু তারপরও সে বুঝতে পারে না, যুদ্ধটা ঠিক শেষ হয়েছে কি না। নদীর ধারে বোচকাবাক্স রেখে চুপচাপ বসে থাকে তারা সবাই।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত