| 29 মার্চ 2024
Categories
শারদ সংখ্যা’২২

শারদ সংখ্যা গল্প: শেষ দেখা । মোহিত কামাল

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

আনন্দ সিনেমা হলের পাশে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে একটা সাইনবোর্ড পড়তে লাগল নিপুণ―আর ব্যর্থতা নয়, সফলতার জন্য আসুন, তাত্ত্বিক গুরুসম্রাট জমির উদ্দিন শাহ’র সঙ্গে ‘শেষ দেখা’ করুন।

শেষ দেখা মানে কী?

গুরুর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর কি চোখের আলো নিভে যাবে? আর কিছুই দেখা যাবে না? নাকি সফলতার জন্য জীবনে আর কিছু দেখার প্রয়োজন নেই, বোঝার দরকার নেই! একবার গুরুর ‘দর্শন’ পেলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?

ইন্টারেস্টিং!

‘শেষ দেখা’শব্দ দুটোর ওপর থেকে নিপুণের চোখ সরল না। চুম্বকের মতো সেঁটে রইল চোখ। মাথায় সব প্রশ্ন নিয়ে ও মনোযোগ দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সাইনবোর্ড দেখতে লাগল।

এ সময় এক কিশোর এসে সামনে দাঁড়াল। তার হাতে নিউজপ্রিন্ট কাগজে ছাপা এক বান্ডিল লিফলেট। গায়ে ছেঁড়া-ময়লা শার্ট। পরনের হাফপ্যান্টের নিচের অংশ ছেঁড়া, ঝুলে আছে ছেঁড়া অংশ। মুখের ত্বকে বসে আছে ময়লার ছোপ। একটা লিফলেট নিপুণের দিকে বাড়িয়ে ছেলেটি বলল, নেন আফা, এইডা নেন। এইডা পইড়লে বেবাক জাইনতে পাইরবেন।

নিপুণ লিফলেটটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখতে লাগল।

এ সময় একটা রিকশা বেল বাজিয়ে দ্রুত চলে গেল উত্তর দিকে। প্রায় গায়ের ওপর চলে এসেছিল রিকশাটা। নিপুণ দ্রুত সরে দাঁড়ায়, ছেলেটিও। দ্রুত সরতে গিয়ে একজন বয়স্ক পথচারীর সঙ্গে ধাক্কা লাগায় বয়স্ক ভদ্রলোক বোকার মতো তাকিয়ে বললেন, সরি!সরি!

নিপুণ অবাক হয়ে গেল। দোষ ওর। ভদ্রলোক নির্দোষ। তার পরও সরি বলেছেন। এত সজ্জন হয়ে উঠছি আমরা!

একটা বিরক্তিকর পরিস্থিতিতেও মন খারাপ হলো না। সফলতার খোঁজ পেয়েছে ও। আর ব্যর্থতা নয়। সব জঞ্জাল দূর করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ পাওয়া যাবে এখানে। ভেতর থেকে বিশ্বাস না-এলেও কৌতূহল জাগল। নানা দুশ্চিন্তায় দুর্বিষহ অবস্থা পার করতে হচ্ছে, একবার গিয়ে পরখ করে দেখা যেতে পারে। মনে মনে ভাবতে গিয়ে ভয়ও পেল নিপুণ।

ছেলেটিকে প্রশ্ন করল, এই, এখানে কি মেয়েরা যায়?

হ আফা, যায়।

জায়গাটা নিরাপদ তো?

হ, হ, নিরাপদ। ভয় নাই। যাইবেন? আমি আফনারে লইয়া যামু?

ছেলেটির কৌতূহল দেখে হাতে ধরা লিফলেট পড়তে শুরু করল নিপুণ।

এটাও তো গুরু জমির উদ্দিন শাহ্’র প্রচারপত্র।

প্রচারপত্রে চোখ বোলাল ও। লেখা আছে―মুখ দেখেই বলে দেওয়া হয় বর্তমান পরিস্থিতি, অতীতের ইতিহাস ও ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ঘটনা। আপনিও পরামর্শের জন্য আসতে পারেন। আধ্যাত্মিক শক্তি ও রত্ন পাথরের মাধ্যমে আর্থিক, ব্যবসায়িক, মানসিক, সামাজিক, পারিবারিক, জিন-সংক্রান্ত সমস্যা, বান ফেরানোসহ নানা রকম ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানে পরামর্শ দেওয়া হয়। ভবিষ্যৎ জীবনসঙ্গী সম্পর্কে জেনে নিন। প্রেসিডিয়াম জেম টেস্টার মেশিনে পাথর পরীক্ষা করা হয়। আপনার হাতের পাথর পরীক্ষা করিয়ে নিন।

লিফলেট পড়া শেষ করে ছেলেটির দিকে তাকাল নিপুণ।

তোমার নাম কী?

পল্টু। সব্বাই কয় পল্টুইয়া।

পল্টুইয়া, তোমার এ অবস্থা কেন?

কী অবস্থা, আফা?

এই যে, দুর্দশা! দরিদ্র অবস্থা। গুরু কি তোমার ভাগ্য ফিরিয়ে দিতে পারেন না?

পল্টুইয়া এমন কথা শোনেনি কখনও। অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর মাথা দুলিয়ে বলল, ঠিক কইছেন আফা। একদিন কমু গুরুরে ভাগ্য ফিরাইয়া দিতে।

কী মনে হয়, ভাগ্য বদলে দেবেন তিনি?

চিন্তিত মুখে পল্টুইয়া বলল, দিইব না মনে অয়।

কেন দেবে না? কী মনে হয় তোমার?

আমাগো ভাইগ্য বদলাইয়া দিলে হেগোর কাম কইরব কে?

ওহ্। থেমে গেল নিপুণ। টোকাই হলেও বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর শুনে কিছুটা গলে গেল।

তোমার পরামর্শ কী? আমি যাব ভেতরে?

বহুত মাইনষেই তো যায়। মনের মইধ্যে অশান্তি থাইকলে আফনেও যাইতে পারেন।

মনে তো অশান্তি আছে। দুশ্চিন্তা আছে। সমস্যার ভারে ডুবে আছে নিপুণ। সমস্যার চাপে আত্মবিশ্বাস কমে গেছে। দুর্বল মন বলছে ভেতরে যেতে। পল্টুইয়ার সঙ্গে কথা বলতে খারাপ লাগছে না। ওর কাছে পরামর্শ চেয়ে প্রশ্ন করল, কী বলো, গেলে উপকার হবে?

হেইডা কইতে পারুম না।

গুরুর প্রচারপত্র বিলি করো, ওনার কাজের ভালোমন্দ না-জেনেই করো?

হ। না-জাইন্নাই করি। এক হাজার বিলি করবার পারলে বিশ টেহা দেয়। হেইডাই আমার লাভ।

আর কোনো লাভ নাই?

আছে। আফনারে ভিতরে নিতে পাইরলে দশ টেহা পামু।

স্পষ্টবাদী, সত্যবাদী পল্টুইয়ার কথায় মুগ্ধ হয়ে গেল নিপুণ। মুগ্ধ চোখে কিছুক্ষণ নোংরা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বুঝল দারিদ্র্যই ওকে নোংরা করেছে। ওর নোংরা চেহারা খারাপ লাগছে না এখন। নিজে অনেক বিষয়ে মিথ্যা বলে। মিথ্যা বলতে বলতে জীবন জড়িয়ে গেছে মিথ্যার জালে। টের পায় ও। জাল বিন্যস্ত হচ্ছে। জালের গিঁট জটিল হচ্ছে। জটিল জাল ছিঁড়ে বেরোনোর পথ ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছে। এ মুহূর্তে ছেলেটির কথা শুনে নড়ে উঠল মন। বলল, পল্টুইয়া, নাও তোমাকে অতিরিক্ত বিশ টাকা দিলাম। তোমার আসল ভাগ গুরু থেকে নিয়ে নিয়ো। আমাকে ভেতরে নিয়ে চলো।


আরো পড়ুন: কবিতা: পটচিত্র । তন্ময় ভট্টাচার্য


পল্টুইয়ার চোখ খুশিতে চিকচিক করে উঠল। নিপুণকে চেম্বারে নিয়ে গেল সে।

গুরুসম্রাটের চেম্বারের দোতলার বসারঘর চমৎকার। ছোট হলেও গোছানো, নানা ধরনের পেইন্টিং দিয়ে সাজানো। দেয়ালে কিছু বাঁধানো ছবি ঝুলছে―মহাকাশের ছবি, জ্যোতিষবিদ্যার ছবি।

পল্টুইয়ার ভেতরে ঢোকার নিয়ম নেই। বাইরের রিসিপশনিস্টের কাছে নিপুণকে গছিয়ে দিয়ে হাসিমুখে বেরিয়ে আসে।

নিপুণের ভয় করছে না। এত সুন্দর ব্যবস্থা অথচ বাইরে একটা নোংরা ছেলে প্রচারপত্র বিলি করছে, কিছুটা বেমানান মনে হলো।

ভালো লাগছে এই ভেবে যে, রিসিপশনিস্ট একজন মহিলা। বেশ স্মার্ট। শাড়ি পরনে। বুকের সামনে একটা নেমপ্লেটে লেখা, মৌরিতা।

মৌরিতা বিনয়ের সঙ্গে বলল, গুরুজি লাঞ্চ করছেন। আপনাকে একটু বসতে হবে, প্লিজ।

এত সুন্দর টোনের কথা শুনে আরেক দফা মুগ্ধ হয়ে গেল নিপুণ। হেসে বলল, না অসুবিধে নেই, আমি অপেক্ষা করছি।

কথা শেষ হওয়ার আগেই নিজের সেলফোন বেজে ওঠে।

ডিসপ্লেতে চোখ বুলিয়ে দেখে, রিপন―ওর হাজব্যান্ডের নাম ভেসে আছে।

কিছুক্ষণ রিং বাজতে দেয়। তারপর কল অ্যাটেন্ড করে বলল, কী বলবে, বলো।

কোথায় তুমি? অফিস থেকে বেরিয়েছ?

হ্যাঁ। বেরিয়েছি। এক ডাক্তারের চেম্বারে আছি।

ডাক্তারের চেম্বারে? এ অসময়ে?

উনি সকাল-বিকাল রোগী দেখেন। এ সময়টা ফ্রি থাকেন। তাই অ্যাপয়েনমেন্ট নিয়েছি। সহজ ঢঙে মিথ্যা বলল নিপুণ।

বড় সমস্যা?

না। বড় না। সমস্যা সমস্যাই। ছোট-বড় বলে কিছু নেই।

আমাকে বলতে, আমিসহ যেতাম।

তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আমি ভালো আছি। বলেই লাইন কেটে দেয় নিপুণ। চোখ তুলে সামনে তাকাল ও। সঙ্গে সঙ্গে বিব্রত বোধ করল। মৌরিতা তাকিয়ে আছে, ওর সব কথা নিশ্চয় শুনেছে। কথা বলার ঘোরে খেয়াল করেনি মৌরিতার উপস্থিতি। কিছুটা সংকোচ নিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে পল্টুইয়ার কথা মনে হলো। ছেলেটা সহজে সত্য কথা বলেছে। আর সে শিক্ষিত ভদ্র মহিলা হয়েও সহজে মিথ্যা বলেছে। কে বেশি ভালো? নিজেকে প্রশ্ন করেই মনে মনে হেসে উঠল নিপুণ। হাসতে গিয়ে মনে পড়ে গেল ঈদের দিনের কথা :

সকালে উঠে বাসা গুছিয়েছে ও। রাতেই ঈদের রকমারি খাবার রেঁধে রেখেছিল। সকালে ওভেনে গরম করে কয়েকটা আইটেম সাজিয়ে রেখেছে টেবিলে। তারপর গোসল করে একটা নতুন শাড়ি পরে নেয়। সব কাজ নিজের হাতে করছে। বুয়া নেই। বুয়া ঈদ করতে বাড়িতে গেছে। ডাইনিং টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে পানি খাচ্ছে রিপন। এক পলক দেখল নিপুণকে। নতুন শাড়িটাও দেখল। রিপন গত চার বছর ধরে এ বিষয়টা খেয়াল করে আসছে। ঈদের দিন সকালে নিপুণ পরে নতুন শাড়ি। সে যে শাড়িটা গিফট করেছে সেটা পরে পরবে, জানে রিপন। তবু প্রশ্ন করে এ শাড়িটা কে দিয়েছে?

নিপুণ চট করে নড়ে ওঠে। নিজের ভেতরে ঝাঁকি টের পায়। মুখের ভাষা বদলে যায়। সহজ-সচল মুখের পেশি শক্ত হয়ে যায়। মাটির দিকে তাকিয়ে বলে, মা পাঠিয়েছেন।

মায়ের পাঠানো শাড়ি তো দেখিয়েছিলে। এটা তো সেটা নয়। এটা তো আগে দেখাওনি।

বললাম তো, মা পাঠিয়েছেন।

রিপন আর কথা বাড়াল না। জানে সে, কথা বাড়ালে বিপদ। ঝগড়া বেধে যেতে পারে। জানে সে, প্রতিবছর ঈদের উৎসব এভাবে শুরু হয় নিপুণের। বিশেষ শাড়িটার পেছনে বিশেষ ইতিহাস আছে, সঠিক ইতিহাস জানা নেই ওর। এটুকু বোঝে, বিশেষ কেউ শাড়িটা তাকে গিফট করে, অতীতেও করেছে। বিশেষ শাড়িটার আলাদা গুরুত্ব আছে নিপুণের কাছে। সেই গুরুত্বের সীমানায় রিপনের স্থান নেই। এও জানে, এ শাড়িটা আর পরবে না নিপুণ। সুন্দর করে সাজিয়ে রেখে দেবে। কাউকে দেবে না। রিপন প্রস্তুত হয়ে বের হয়। ঈদের জামাতে যাবে। পাশের বাসার পারভেজের সঙ্গে ঈদগাহে যাবে।

নিপুণ স্বস্তি পায়। ডাহা মিথ্যা বলে অস্বস্তিতে পড়েছিল। রিপনের সহজ জিজ্ঞাসার ভেতর কঠিন সন্দেহের আভাস দেখা গেছে। সন্দেহ পাত্তা দেয়নি। মিথ্যা বলেছিল, কারণ শাড়িটা দিয়েছে শামীম, ওর পুরোনো প্রেমিক। এ কথা বলা যাবে না। বাস্তবতার কারণে ও মিথ্যা বলেছিল। জানে, সব সত্য সবাই মেনে নিতে পারে না। বিয়ে করার জন্য, বিয়ে টিকিয়ে রাখার জন্য মিথ্যা বলা যেতে পারে। সত্য বললে ক্ষতি হয়ে যেত, ঈদের সকালে রিপনের বুকে বসিয়ে দেওয়া হতো ধারালো ছোরা। ওই মুহূর্তে মিথ্যা বলা ঠিক ছিল। যে-মিথ্যা অন্যের মনে শান্তি দেবে, অন্যের ক্ষতির কারণ হবে না, সে মিথ্যা তো জায়েজ। মিথ্যার আড়ালের সত্য কি ওকে ডুবিয়ে দিবে না? মিথ্যার জালে জড়াতে জড়াতে জীবন কি দুর্বিষহ হয়ে উঠবে না? উঠবে, উঠছে। হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারল নিপুণ।

মৌরিতা এসে বলল, ম্যাডাম গুরুজি প্রস্তুত আছেন। আপনি ভেতরে যান।

মৌরিতার সাড়া পেয়ে চমকে উঠল নিপুণ। বাস্তবে ফিরে সহজ হয়ে ভেতরের দিকে এগিয়ে গেল।

ভেতরে ঢুকে আবারও চমকে উঠল।

বাইরে সোফা থাকলেও ভেতরে শুধু একটা কার্পেট। কার্পেটের ওপর বসে আছেন এক জ্যোতির্ময় পুরুষ। গায়ের রং টকটকে লাল। চুল সাদা। দাড়ি-মোচ নেই। ক্লিন-শেভ করা। স্মার্ট তাত্ত্বিক পুরুষ। পেছনে একটা উঁচু বালিশ, সামনেও একটা বালিশ।

স্যান্ডেল খুলে গুরুসম্রাটের সামনে গিয়ে বসল নিপুণ।

পল্টুইয়া বলেছিল ভয়ের কিছু নেই। সেই সাহসে চলে এসেছে। এতক্ষণ ভয় পায়নি। এখন ভয় পাচ্ছে।

আপনি ভয় পাচ্ছেন, গুরুজির ভারী কণ্ঠস্বরে গমগম করে ওঠে ঘরটা।

নিপুণ যন্ত্রচালিতের মতো জবাব দিল, পাচ্ছি। ভয় পাচ্ছি।

আবার ভারী গলায় গুরুজি বললেন, আপনি শান্ত হোন। ভয়ের কিছু নেই। এখানে আপনি নিরাপদ। পৃথিবীর সর্বোচ্চ নিরাপদ স্থানে এখন আপনি অবস্থান করছেন।

নিপুণের কথায় এখনও জড়তা রয়েছে। জড়ো হয়েই বলল, শান্ত আছি।

বাইরে শান্ত থাকলে হবে না। ভেতরেও শান্ত হোন।

নিপুণ কেঁপে ওঠে। প্রচারপত্রের কথা মনে পড়ে। মুখমণ্ডল দেখেই গুরু সব বলে দিতে পারেন, পড়েছিল। এখন দেখছে সত্য। মিলে যাচ্ছে। গুরু তার মনের খবর টের পেয়ে যাচ্ছেন। বাইরে শান্ত থাকলেও ভেতরের অশান্ত অবস্থা ধরে ফেলেছেন তিনি!

নিপুণ গলে যেতে লাগল।

গুরুজি বললেন, আপনি উদ্বিগ্ন।

নিপুণ মনে মনে ভাবে, হ্যাঁ সে উদ্বিগ্ন। টেনশনে ভুগছে। গুরু ধরে ফেলেছেন। মনে মনে ভাবলেও মুখে কিছুই বলল না। মুগ্ধ চোখে গুরুর দিকে তাকাল।

কতদিন ধরে উদ্বেগে ভুগছেন?

একি! গুরুজি চিকিৎসকদের মতো প্রশ্ন করছেন কেন? তিনি তো সব জানেন, জেনেও প্রশ্ন করছেন কেন? মনে প্রশ্ন এলেও মুখে এবার জবাব দেয় নিপুণ, প্রায় এক মাস।

হুঁ। ঠিকই বুঝেছি।

বুঝবেনই তো। এজন্যই এসেছি আপনার কাছে। মনে মনে ভাবতে ভাবতে  আরও গলে গেল, ধসে গেল, ঘোরের মধ্যে ডুবে যেতে লাগল নিপুণ।

এই এক মাসে আপনার পিরিয়ডের অবস্থা কী? গুরু আরও গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।

নিপুণ বলল, জি। আপনি ঠিকই বুঝেছেন। পিরিয়ড বন্ধ।

পিরিয়ড বন্ধ। তথ্যটা গুরুজি বলে দেননি। ঘোরের মধ্যে নিপুণই বলে দিয়েছে। বুঝতে পারল না ও। ‘পিরিয়ড’ নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন শুনে নিপুণের ধারণা হয়েছে, গুরুজি সব জেনে গেছেন। এটাই তো মূল সমস্যা।

গুরুজি চোখ বন্ধ করে আছেন। দু হাত সামনে বালিশের ওপর রেখেছেন। নিপুণ মুগ্ধ চোখে দেখছে গুরুজির বন্ধ চোখ। অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছে আসল কথা শোনার জন্য।

অনেকক্ষণ পর গুরুজি চোখ খোলেন।

হ্যাঁ। আপনি মা হতে যাচ্ছেন।

জি। মা হতে যাচ্ছি। এটুকু জানে নিপুণ। তবু প্রশ্ন ভরা চোখে তাকিয়ে থাকে গুরুর মুখের দিকে।

আপনার আরও কিছু জানার আছে?

জি। জানার আছে।

হুঁ। গুরুজি আবার চোখ বন্ধ করেন। ধ্যানে বসেন। প্রচারপত্রে লেখা আছে মুখমণ্ডল দেখেই তিনি বলে দিতে পারেন অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের কথা। ধ্যানে বসতে হয় কেন? নিপুণের মনে প্রশ্ন এলেও প্রশ্নটা জোরালো নয়।

এবার গুরু বললেন, আপনি মাতৃত্ব নিয়ে চিন্তিত।

জি। জি। চিন্তিত।

হাজব্যান্ডের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক ভালো না?

না। ভালো না। জটিলতা চলছে। গুরুজি প্রশ্ন করছে, উত্তরটা সে নিজেই দিচ্ছে বুঝতে পারছ না।

হুঁ। আপনার হাজব্যান্ড জানে না অনাগত সন্তানের কথা?

জি। জি। জানে না। আপনি সব বলতে পারছেন।

আপনার আর কোনো ছেলেবন্ধু আছে?

জি। জি। আছে।

তাকে নিয়ে আপনি চিন্তিত?

জি। জি। ঠিকই ধরেছেন?

আপনি হাজব্যান্ডকে ভালোবাসেন?

জি। জি। বাসি।

ছেলেবন্ধুটাকে ভালোবাসেন?

জি। জি। বাসি।

ছেলেটার সঙ্গে গোপনে ডেটিং করেন?

জি। জি। করি।

হুঁ। চোখ বন্ধ করেন গুরুসম্রাট জমির উদ্দিন।

অনেকক্ষণ পর চোখ খুলে নিপুণের দিকে স্থির চোখ মেলে তাকিয়ে বললেন, অনাগত সন্তান নিয়ে দ্বন্দ্বে ভুগছেন?

জি। গুরুজি। আপনি ঠিকই ধরেছেন।

সন্তানের পিতা কে? বুঝতে পারছেন না?

না, বুঝতে পারছি না। আপনি মূল পয়েন্টটা ধরে ফেলেছেন। বলতে বলতে একদম গলে গেল নিপুণ। আরও এগিয়ে এসে গুরুর মুখোমুখি বসল। গুরুজি স্থির চোখে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন নিপুণকে। অসাধারণ রূপবতী নিপুণের দৈহিক গড়ন দেখলেন। ওর মুখ থেকে চোখ গেল বুকের দিকে। এক পলক দেখেই চোখ বুজে ফেললেন। গুরুজির চোখ  পুড়ে যাচ্ছিল। অনেকক্ষণ পর বন্ধ চোখ খোলেন।

নিপুণ আরও এগিয়ে এসে গুরুজির পা ছুঁয়ে বলল, কী করব আমি, বলে দেন। কী করা উচিত?

আপনি কি সন্তান রাখতে চান?

চাই। সন্তান চাই। বিয়ের চার বছর পর সন্তান আসছে। আমি মা হতে চাই।

আপনার সন্তান নিরাপদে আসবে পৃথিবীতে। গুরুজি ভরাট গলায় আশ্বাস দেন।

মনের দ্বন্দ্ব কেটে যাবে? কেবল সন্তান এলে তো হবে না, মনের সন্দেহও তো কাটতে হবে।

কাটবে। কাটবে। সন্দেহ কাটবে। বলতে বলতে হ্যাঁ-বোধক মাথা নাড়ান তিনি।

কীভাবে কাটবে?

আধ্যাত্মিক শক্তি ও রত্ন পাথরের মাধ্যমে কাটবে।

কোথায় পাব পাথর?

আমিই দেব। প্রেসিডিয়াম জেমটেস্টার মেশিনে পরীক্ষিত ওই পাথর আপনার মনের দ্বন্দ্ব কাটিয়ে দেবে।

কার ভ্রুণ আমার পেটে বড় হচ্ছে, সেটা না-জানলে তো দ্বন্দ্ব কাটবে না।

গুরুজি হালকা হেসে বললেন, আপনার ভ্রুণ আপনার জরায়ুতে বড় হচ্ছে। জরায়ু তো মাতৃত্বের পবিত্রতম জায়গা। আপনার ভ্রুণও পবিত্র। সন্তানও পবিত্র।

মুগ্ধ হয়ে আরও ঢলে পড়ল নিপুণ। এত সুন্দর কথা শুনে মন হালকা হলেও দ্বন্দ্ব সমূলে উপড়ে গেল না।

তবু জানতে চাই, কার শুক্রকীট আমি ধারণ করেছি? বয়ফ্রেন্ড, না আমার স্বামীর?

গুরুজি উত্তর না-দিয়ে প্রশ্ন করেন, মনে মনে কার ঔরসজাত সন্তান আপনি কামনা করছেন?

নিপুণ এবার মুখ তুলে তাকাল। গুরুর চোখ হাসছে। মুখ হাসছে। গুরুর মুখের টকটকে লাল রং আরও উজ্জ্বল হয়েছে। অসাধারণ গুণী, অসাধারণ পবিত্র মনে হচ্ছে গুরুসম্রাটকে। মুগ্ধতার অনেক ভেতর থেকে উত্তর বেরিয়ে এল, আমি আমার স্বামীর ঔরসজাত সন্তান চাই। বলেই উত্তরের আশায় চোখ বন্ধ করে থাকল নিপুণ।

কোনো উত্তর দিচ্ছেন না গুরুজি। আর চোখও খুলছে না নিপুণ। যেন উত্তর না-পেলে চোখ খুলবে না। কঠিন পণ করে বসে আছে। ঘোরের মধ্যে ডুবে যেতে লাগল ও। নিপুণের বর্তমান নেই, ভবিষ্যৎ নেই, সে যেন এখন অন্য গ্রহের নারী।

গুরুজিও অসাধারণ রূপবতীর মেয়েটির সামনে গলে যেতে লাগলেন। ঘোরের গভীর তলে নিপুণকে টেনে নেওয়ার জন্য বললেন, উত্তর জানতে হলে আপনার দু হাত রাখুন আমার হাতের ওপর।

চোখ বন্ধ রেখেই নিপুণ দু হাত বাড়িয়ে দিল সামনে।

দু হাতে তালুর মধ্যে গুরুজি লুফে নিল নিপুণের হাত। হাতের নরম ছোঁয়ায় গুরুজির দেহে উষ্ণতা ছড়িয়ে যেতে লাগল। নিপুণের দেহে শান্তি ছড়িয়ে যাচ্ছে। এ শান্তি ঘোরের আরও অতল সাম্রাজ্যে টেনে নিয়ে গেল নিপুণকে।

নিপুণের মনে হতে থাকে, চারপাশে আলো নেই, অন্ধকার নেই। চারপাশের জগৎ তার কাছে অচেনা। চারপাশে আছে ফুল আর ফুল। সবুজ আর সবুজ। পানি আর পানি। ঢেউ, সমুদ্র। সমুদ্রের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে। ভাসতে ভাসতে সে বলছে, বলুন গুরুজি, বলুন আমার পেটের সন্তান আমার স্বামী রিপনের, বলুন প্লিজ, বলুন।

গুরুজি আরও ভরাট গলায় বললেন, এ মুহূর্তে প্রশ্নটির উত্তর দেওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ একটা বাধা আছে। বাধাটা দূর করা প্রয়োজন।

বাধাটা কী? বলুন। বাধাটা দূর করুন। ঘোরের মধ্যেই বলতে লাগল নিপুণ।

তোমার জরায়ুতে এখন একটা তৃতীয় শুক্রকীট ধারণ করতে হবে। তৃতীয় শুক্রকীট না-থাকার কারণে বলা যাচ্ছে না, ভ্রুণের পিতা কে?

কোথায় পাব তৃতীয় শুক্রকীট?

তুমি অনুমতি দিলে আমিই সেটা তোমাকে উপহার দিতে পারি।

নিপুণ অনেক দূর থেকে, অচেনা জগৎ থেকে অস্পষ্ট গলায় বলল, দিন, আপনি উপহার দিন।

অনুমতি পেলে তোমাকে নিরাভরণ করতে পারি।

খুলুন। কাপড় খুলে নিন। তৃতীয় শুক্রকীট দিন। বলে দিন আমার সন্তানের পিতা কে? বলতে বলতে নিজেই খুলতে লাগল ব্লাউজ, শাড়ি, পেটিকোট। এ যেন আসল নিপুণ নয়। অন্য লোকের এক রমণী এসে ভর করেছে আসল নিপুণের দেহে, দখল করে নিয়েছে শুদ্ধ মাতৃত্বলোভী নিপুণের মন।

ঘরের আলো নিভে গেল। দরজার লক আটকিয়ে দেন গুরুজি।

গুরুজি স্পর্শ করছেন নিপুণের দেহ।

নিপুণের মনে হলো, সে এক শান্ত পুকুর। মনে হলো পুকুরে কেউ ঢিল ছুড়ছে। ঢেউ উঠছে পুুকুরে। মনে হচ্ছে হালকা ঢেউ গোলাকারে ছড়িয়ে যাচ্ছে চারপাশে। পুকুরে ছড়ানো ঢেউ দু হাতে ধরতে চাইছে, পারছে না ধরতে।  মৃদু স্বরে ও প্রশ্ন করল, গুরুজি বলুন, আমার সন্তানের পিতা কে?

গুরুজি তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, তোমার সন্তানের পিতা রিপন, তোমার স্বামী।

ঘোরের মধ্যেই উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে নিপুণ। উঠতে চায়। উঠতে পারল না। মনে হচ্ছে অক্টোপাস জড়িয়ে ধরেছে। আসল নিপুণ জেগে উঠছে। জেগে উঠেও চোখ খুলতে পারছে না। লিফলেটে পড়েছিল ‘শেষ দেখা’র কথা। সে কি রিপনকে আর দেখতে পাবে না? অনাগত সন্তানকেও  না? নৈতিক শক্তি ফিরে পাবে না?

মাতৃত্বের হাহাকার জেগে উঠছে। শিশুর ক্রন্দন শুনতে পাচ্ছে, চোখ খুলতে চাচ্ছে, পারছে না। কিছুই দেখতে পাচ্ছে না সে, কেবলই দেখছে অন্ধকার, গাঢ় আঁধার।

একসময় চোখ খুলে তাকাল নিপুণ। বিস্ময়ের ঘোর কেটে গেল। অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, আমি কোথায়? উদোম কেন আমার দেহ?

গুরুজি বললেন, সন্তানের পিতৃত্ব জানার জন্য আপনাকে নিরাভরণ করা হয়েছিল।

আমি টের পাইনি কেন? আমাকে কি অজ্ঞান করেছিলেন? প্রশ্ন করতে করতে কাপড় জড়িয়ে নিল গায়ে।

গুরুজি আবার বললেন, না, অজ্ঞান করা হয়নি। আপনার চেতনস্তরটা সামান্য নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল, প্রাকচেতনে চলে গিয়েছিলেন আপনি। এটা এক ধরনের হিপনোসিস, মনস্তাত্ত্বিক কৌশল। কোনো ওষুধ ব্যবহার করা হয়নি, কথার মাধ্যমে প্রথমে ‘হিপনোটিক’ অবস্থা তৈরি করা হয়। পরে ‘হিপনোটিক সাজেশন’ দিয়ে আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

কী লাভ হলো আমার?

আপনার সন্তানের পিতৃত্ব জানা গেছে। এটাই জানতে চেয়েছিলেন।

কে আমার অনাগত সন্তানের পিতা? লজ্জার খোলস ঝেড়ে স্পষ্ট প্রশ্ন করল নিপুণ।

আপনার স্বামী, রিপন। গুরুজি সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন তাকে।

ঝলমল করে উঠল নিপুণের মুখ। পুরো দেহে বয়ে গেল আনন্দধারা। দেহের প্রতিটি কোষ স্পন্দিত হয়ে উঠল শুদ্ধ মাতৃত্বের সুধারসে। গুরুজিকে পা ছুঁয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে বেরিয়ে এল কক্ষ থেকে।

বেরোতেই দেখে মৌরিতাকে। অবাক হয়ে সে তাকিয়ে আছে নিপুণের দিকে।

এত অবাক হয়ে কী দেখছেন?

দেখছি আপনাকে। খুশিতে ভরে গেছেন। সমস্যার সমাধান হয়েছে?

হুঁ। হাসিমুখে নিপুণ বলল, মা হতে যাচ্ছি আমি। আনন্দ সংবাদ না!

মৌরিতা আবারও অবাক হয়। মাতৃত্বের বিষয়ে জানতে গুরুজির কাছে এসেছেন! কী জবাব দিয়েছেন গুরুজি!

এ প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে ভিজিট দিয়ে হাসিমুখে বেরিয়ে গেল নিপুণ।

দুই

বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে রিপন। অনেকদিন নিপুণকে এত উচ্ছ্বল দেখেনি। এত খুশি কেন সে? প্রশ্ন জাগলেও মুখ ফুটে কিছুই জিজ্ঞাসা করল না। নিপুণ ঘর গোছাচ্ছে। ফুল নিয়ে এসেছে বাইরে থেকে, ফ্লাওয়ারভাসে রেখেছে ড্রয়িংরুমে। ঘর ফুলে ফুলে আর ভালোবাসায় ভরে গেছে। ঘরের শূন্যতা পূর্ণ হয়ে গেছে একদিনের আনন্দসুখে।

নিপুণ জানতে চায়, কোনো প্রশ্ন আছে তোমার মনে?

রিপন বলল, আছে।

সহজ গলায় নিপুণ আবার বলল, এখন জানতে চেয়ো না। কাল আনুষ্ঠানিকভাবে বলব তোমাকে সব খবর।

বিছানায় শুতে গিয়ে নিপুণ বলল, পানি খাইনি। এক গ্লাস পানি দেবে?

বিছানা থেকে ওঠে রিপন। গ্লাসে ভরে পানি এনে তুলে দেয় ওর হাতে। পরম তৃপ্তি নিয়ে পানি খেয়ে মৃদু হাসল নিপুণ। রিপনের মনও খুশিতে ভরে উঠল।

ঘুমের ঘোরে রিপনকে জড়িয়ে ধরেছে, কোলবালিশের মতো পেঁচিয়ে শুয়েছে নিপুণ। ঘুমের ঘোরেই ও চলে গেছে স্বপ্নের দেশে। ছোট্ট বাবুটা ডাকছে ওকে:

মামণি, আমি আসছি। জানালা খুলে রাখো মামণি।

আচমকা ঘুম ভেঙে গেল নিপুণের। ডিমলাইটের আলোয় দেখল ঘরের জানালা বন্ধ। বিছানা থেকে নেমে জানালা খুলে দিয়ে খোলা বাতাস টেনে নিল বুকে। আবার বিছানায় শুতে গিয়েই চমকে উঠল। রক্তের দাগ! দুম করে বুকটা কেঁপে উঠল। তবে কি ও প্রেগন্যান্ট হয়নি? গুরুজি কি ভুল কথা বলেছেন? ভালো করে নিজেকে যাচাই করে বুঝল, হ্যাঁ। ভুল নয়। সত্যিই শুরু হয়েছে মাসিকচক্র। বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। রিপনের প্রশ্নের কী জবাব দেবে? মনে হচ্ছে দূরদেশ থেকে ভেসে আসছে শব্দ। শিশুর কান্না ভেসে আসছে, কান্না বুকে নিয়ে রিপনের পায়ের কাছে বসে থাকে ও। মনে মনে ভাবে, তবে কি গুরুজির কাছে আবার যেতে হবে? বার বার দেখা করতে হবে? বার বার আশায় আবার কি বুক বাঁধতে হবে, ‘শেষ দেখা’র?

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত