ইরাবতী ধারাবাহিক: ফুটবল (শেষ পর্ব) । দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়
অষ্টম শ্রেণির দুই বন্ধু রাজ আর নির্ঝর। রাজ আর অনাথ নির্ঝরের সাথে এইগল্প এগিয়েছে ফুটবলকে কেন্দ্র করে। রাজের স্নেহময়ী মা ক্রীড়াবিদ ইরার অদম্য চেষ্টার পরও অনাদরে বড় হতে থাকা নির্ঝর বারবার ফুটবল থেকে ছিটকে যায় আবার ফিরে আসে কিন্তু নির্ঝরের সেই ফুটবল থেকে ছিটকে যাবার পেছনে কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নির্ঝরের জেঠু বঙ্কু। কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় বঙ্কু ও তার ফুটবলার বন্ধু তীর্থঙ্করের বন্ধুবিচ্ছেদ। কিন্তু কেন? সবশেষে নির্ঝর কি ফুটবলে ফিরতে পারবে? রাজ আর নির্ঝর কি একসাথে খেলতে পারবে স্কুল টিমে? এমন অনেক প্রশ্ন ও কিশোর জীবনে বড়দের উদাসীনতা ও মান অভিমানের এক অন্য রকম গল্প নিয়ে বীজমন্ত্রের জনপ্রিয়তার পরে দেবাশিস_গঙ্গোপাধ্যায়ের নতুন কিশোর উপন্যাস ফুটবল আজ থাকছে শেষ পর্ব।
ঠিক চারটের সময় খেলা শুরু হল। নির্ঝর একদম সেন্টারে দাঁড়িয়ে আছে। স্যার প্রথমে একটু রাগারাগি করলেও ওকে দলে নিয়েছেন। তারপর বলেছেন, “অনেক কষ্টে ফাইনালে উঠেছি। আজ কিন্তু জেতা চাই। কিরে পারবি তো?”
“চেষ্টা করব।“
“চেষ্টা না। বল পারবি তো?”
“হ্যাঁ।“
তিন গোলে জিতল রাজরা। রামলাল স্কুল তাদের সামনে দাঁড়াতেই পারল না। তারমধ্যে দুটো গোল নির্ঝরের, আর একটা রাজের। পাঁচটা ম্যাচের মধ্যে এই প্রথম রাজ গোল করল! তবে ইমনকেও স্যার খেলার সুযোগ দিয়েছেন। জেতা নিশ্চিত থাকতে শেষ দশ মিনিট থাকতে স্যার ওকে নামিয়েছিলেন।
স্যাররা আত্মহারা জেতার জন্য। সদাগম্ভীর সরোজ স্যারও জেতার আনন্দে লাফাচ্ছেন। তিনি সবার সামনেই ঘোষনা করলেন চ্যাম্পিয়ন টিমকে তিনি একদিন পেটপুরে খাওয়াবেন।স্যাররা মৈনাকস্যারকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। ছাত্ররা সবাই চিৎকারে ভরিয়ে দিচ্ছে। মোবাইলে একটার পর একটা ছবি তুলছে।ছোটোমামার হাতেও মোবাইল। রাজ আর নির্ঝরের একটা ছবি তুললেন তিনি।
একটু পরে প্রাইজ দেওয়া শুরু হল।ফুটবলার শুভাশিস মুখার্জী কিছুক্ষন কথা বললেন। তিনি নির্ঝরের খেলা দেখে মুগ্ধ। বারবার বলতে লাগলেন ওর কথা। ইন্দ্রদারও তিনি আলাদাভাবে প্রশংসা করলেন। আজ ইন্দ্রদা দুটো চমৎকার সেভ করেছে।
নির্ঝর পেল ম্যান অফ দ্যা সিরিজ। আর রাজ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না সে নাকি ম্যান অব দ্যা ম্যাচ! আজ সে একটা গোল করেছে বলে নয় নবারুনকে সে মার্ক করে নড়তে দেয় নি!
ইন্দ্রদার হাতে বিজয়ীর শিলড তুলে দিলেন শুভাশিস মুখার্জী। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে সবাই মিলে চিৎকার করে উঠল,” থ্রি চিয়ার্স ফর সুর্যনাথ হাই স্কুল। হিপ হিপ হুররে।“
প্রাইজ দেওয়া হয়ে গেল। সবাই ধীরে ধীরে ফিরতে শুরু করল। রাজ ব্যাগপত্র গুছিয়ে রেডী। নির্ঝর বলল,“কাকিমাকে দেখলাম। কোথায় রে?”
“ওই তো চ!” বলে রাজ হাঁটা শুরু করল।
মা বাবা, ছোটোমামা দাঁড়িয়ে রয়েছেন মাঠের শেষ কোনে। দুজনে পৌছে গেল মায়ের কাছে। নির্ঝর ও রাজ নিজেদের মেডেল দেখাল । মা উচ্ছাসে ভেসে বললেন,- দারুন।দুই বন্ধুই দারুন খেলেছিস। নির্ঝর।এই রবিবার তোর নেমতন্ন রইল। আসবি।
নির্ঝর মাথা নাড়াল।
মা জিজ্ঞেস করলেন, “তীর্থদা কবে তোদের বাড়ি গেছিল রে?”
“গতকাল!”
“আমি তো ভাবলাম যাবেই না। তুই আর খেলতে পারবি না।“
“হ্যাঁ। জেঠুরা তোমার কথা বলছিল। তুমি গেছিলে।“
“যাবো না। বা! তুই না খেললে হবে? তা হ্যাঁরে ?তীর্থদার সাথে কি কথা হল বঙ্কুদার?”
নির্ঝর বলল, “সে অনেক কথা।আমি ভয়ে অস্থির। কি জানি ওরা না আবার ঝগড়া করে!”
“তা কি হল?”
“দুজনে মিলে অনেকক্ষন কথা বলল। ওই পুরোন খেলা নিয়ে।একবার চেঁচায়, একবার হাসে। একবার তীর্থজেঠু বলে আমার ভুল। একবার বঙ্কু জেঠু বলে, আমার। দুজন মিলে ভুল স্বীকার করার পর মিলমিশ হয়ে গেল। আর আমাকেও খেলার পারমিশন দিল জেঠু।“
“কি ভুল বলল?”
“আরে। দুজন এখন একই কথা বলছে জানো। বলছে আমরা কি বোকা ছিলাম বল দেখি।সেদিন যদি দুজনেই খেলতাম। আর দুজনেই যদি গোল করার চেষ্টা করতাম তাহলে কি এমন গোলমাল হত? গোল করলে দত্তসাহেবকে তো ধরতে পারতাম।“
আরো পড়ুন: ফুটবল (পর্ব-২৭) । দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়
রাজ ভাবল, ‘তাই তো। এটা সেদিন দুজনে ভাবল না কেন? আজ তো খেলায় তারা দুজনেই গোল করেছে।দুজনে গোল করলে দুজনেই হয়ত পার্মানেন্ট হয়ে যেত। কিন্তু ঠিক সময়ে বুদ্ধি খোলে না। তাই বোধহয় হয়েছিল দুজনের। বোকার মত তীর্থজেঠু খ্যালেন নি আর পার্টনারসিপ হারিয়ে বঙ্কুজেঠুর খেলাও খারাপ হয়ে গেছিল।‘রাজ বলল,“আমাদের মতো বল মা। আজ আমি আর নির্ঝর দুজনেই কেমন গোল করলাম।“
মা হেসে বললেন,“ তাই তো। তা তারা দুজন কোথায়?”
নির্ঝর বলল,“ ওই যে।“
রাজ খেয়াল করল দুইবন্ধু মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন।
নির্ঝর বলল, “চ রাজ। দেখা করে আসি।“
মা বারন করলেন, বললেন,“এখন যাস না। তীর্থদাদের গল্প এখনো শেষ হয় নি।ওদের কথা বলতে দে।“
রাজরা তাকিয়ে থাকল। দুই বন্ধু আবছায়া আলোয় কথা বলছেন, হাত নাড়ছে্ন, পা ঝাঁকাচ্ছেন । তাদের যেন মনে পড়ছে পুরানো খেলার কথা। যেন এখুনি ওরা দৌড়াতে শুরু করবেন গোল করার জন্য। যে গোলটা তারা করে উঠতে পারেন নি।এ সময়ে তাদের কাছে না যাওয়াই ভাল। নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে রাজ হাসল।

দেড় দশক ধরে সাহিত্যচর্চা করছেন। পেশা শিক্ষকতা। নিয়মিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখেন। ‘কাঠবেড়ালি’ নামে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয়তে। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস : ‘চার অঙ্গ’, ‘তিথির মেয়ে’, গল্পগ্রন্থ : ‘গল্প পঁচিশ’, ‘পুরনো ব্রিজ ও অন্যান্য গল্প’। ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘বীজমন্ত্র’ নামে একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখেছেন।