নির্মলা পুতুল’র একগুচ্ছ অনুবাদ কবিতা । স্বপন নাগ
বাবা সিরিল মুর্মু, মা কান্দিনী হাঁসদা। ভারতের সাঁওতাল পরগনার দুমকার দুধানী কুরুয়া গাঁয়ের এক গরিব আদিবাসী পরিবারের সন্তান কবি নির্মলা পুতুল। জন্ম ১৯৭২ সালের ৬ই মার্চ। রাজনীতিশাস্ত্রে স্নাতক নার্সিং-এ ডিপ্লোমা কবি নির্মলা পুতুলের কবিতায় গভীর মমতায় চিত্রিত হয় আদিবাসী জীবনের বঞ্চনা কুসংস্কার দারিদ্র্য জীবনযুদ্ধের প্রসঙ্গ। হিন্দি ছাড়া সাঁওতালি ভাষাতেও কবিতা লেখেন তিনি। মুকুট বিহারী সরোজ স্মৃতি সম্মান, ভারত আদিবাসী সম্মান, রাষ্ট্রীয় যুবা পুরস্কারে তাঁকে সম্মানিত করা হয়েছে। কবিতাচর্চার পাশাপাশি নির্মলা পুতুল মানবাধিকার ও আদিবাসী মহিলা উন্নয়ন কর্মযজ্ঞেও নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। সহজ সরল ভাষায় লেখা তাঁর কবিতার আবেদন ভাষার সীমানা পেরিয়ে সমাদৃত হয়েছে ভারতের অন্যান বিভিন্ন প্রান্তেও। ইংরেজি ছাড়াও তাঁর কবিতা অনূদিত হয়েছে মরাঠি ওড়িয়া প্রমুখ ভাষায়। ‘নগাড়ে কী তরহ বজতে শব্দ’, ‘অপনে ঘর কী তালাশ মে’ তাঁর উল্লেখযোগ্য দুটি হিন্দি কাব্যগ্রন্থের নাম।
অত দূরে বিয়ে দিও না বাবা
বাবা, অত দূরে আমার বিয়ে দিও না –
আমার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে
ঘরের ছাগলই না বেচে দিতে হয় !
সে দেশেও বিয়ে দিও না আমার
যেখানে মানুষেরও আগে থাকে ঈশ্বর ,
জঙ্গল নেই নদী নেই পাহাড় নেই
তেমন জায়গায় আমার বিয়ে ঠিক ক’রো না।
যেখানে রাস্তায় মোটরগাড়ি ছোটে
মনের গতির চেয়েও দ্রুত
সেখানে তো একেবারেই নয় !
উঁচু উঁচু বাড়ি আর বড় বড় দোকান যেখানে
সেইখানে আমার সম্বন্ধ ক’রো না বাবা।
বড় খোলা একটা উঠোন নেই যেখানে,
সকাল হয় না যেখানে মোরগের ডাকে,
আর বাড়ির পেছনে সন্ধেবেলায় যেখানে
পাহাড়ের মধ্যে ডুবতে দেখা যায় না সূর্যকে
সেখানে আমায় বিয়ে দিও না।
তেমন বর বেছো না বাবা
যে পচাই আর হাড়িয়াতে ডুবে থাকে রাতদিন,
অলস নিষ্কর্মা যে ছেলে
মেলা থেকে মেয়ে ফুঁসলিয়ে নিতে ওস্তাদ যে,
আমার জন্যে তেমন বর ঠিক ক’রো না বাবা।
এ তো কোন থালা-বাটি নয় যে
ইচ্ছে হলেই পরে কখনো বদলে নিতে পারব !
কথায় কথায় যে লাঠি-ডান্ডার কথা বলে
বের করে আনে তির-ধনুক কুড়ুল
যখন ইচ্ছে চলে যায় বাংলায় আসামে কাশ্মীরে
তেমন বর আমার চাই না,
তেমন কারোর হাতে তুলে দিও না আমার হাত।
যে হাত কোনদিন কোন গাছ লাগায়নি,
যে হাতে কোনদিন ফলেনি কোন ফসল,
যে হাত কাওকে কোনদিন মদত করেনি,
কোনদিন কোন বোঝাও তোলেনি যে হাত,
এমনকি, যে হাত লিখতে জানে না হ-এ হাত
তার হাতে তুলে দিও না আমায়।
বিয়ে যদি দিতেই হয়, সেখানে দিও –
সকালে গিয়ে সন্ধের আগেই যেন
পায়ে হেঁটে ফিরে আসতে পারো।
এপারে, এই ঘাটে কখনো দুঃখে কাঁদি যদি
স্নান করতে এসে ওই ঘাটে যেন
শুনতে পাও আমার কান্না।
তোমার জন্যে যেন পাঠাতে পারি খেজুরের গুড়,
পাঠাতে পারি লাউ কুমড়ো বরবটি
মেলায় হাটে বাজারে যেতে আসতে যেন
দেখা হয়ে যায় নিজেদের লোক –
যারা শোনাতে পারে গাঁ-ঘরের গল্প,
দিতে পারে সাদাকালো গাইটির বিয়নোর খবর।
ওদিকে যাওয়া আসার পথে খবর দিতে পারে
এমন জায়গায়ই আমার বিয়ে দিও বাবা।
সেই দেশ, যেখানে ঈশ্বর কম, মানুষ থাকে বেশি
বাঘে হরিণে একঘাটে জল খায় যেখানে
সেখানেই বিয়ে দিও আমায়।
তার সঙ্গেই বিয়ে দিও
যেন জোড়া কবুতরের মত থাকতে পারি সবসময়,
ঘরে-বাইরে-ক্ষেতের কাজ করা থেকে
রাত্তিরের সুখদুঃখের গল্প পর্যন্ত শুনবে যে –
তেমন বরই বেছো বাবা।
এমন বর এনো, যে বাঁশিতে তুলতে পারে সুর,
আবার, ঢোল মাদল বাজানোতেও যে তুখোড় ;
বসন্তের দিনে রোজ আমাদের জন্যে যে
আনতে পারে টুকটুকে লাল পলাশ।
আমার খিদের কথা জেনে যে খেতে পারে না
তার সঙ্গেই আমার বিয়ে দিও বাবা।

কোনো সম্পর্ক ছাড়াই তোমার ভালো লাগুক
বা না-লাগুক, সে তোমার ব্যাপার ;
আমার কাছ থেকে সাজানোগোছানো ভাষা
একেবারেই প্রত্যাশা ক’রো না।
জীবনের এবড়োখেবড়ো রাস্তায় চলতে চলতে
আমার ভাষাও হয়ে গেছে কাঠখোট্টা।
আমি কবিতার পরিভাষা বুঝি না
জ্ঞান নেই কবিতার ছন্দ-মাত্রার,
শব্দ ও ভাষার ওপরেও নেই কোন দখল।
ঘর-গেরস্থালি সামলাতে সামলাতে
নিজের হকের লড়াই করতে করতে
যা কিছু দেখেছি শুনেছি ভোগ করেছি
আশপাশের সঙ্গীসাথীদের বলেছি অকপট ;
যেমনতেমন করে ভাঙাচোরা অক্ষরে
সে সবই লিখে দিয়েছি সময়ের স্লেটে –
পড়ো অথবা না-পড়ো, তোমার মর্জি !
কিংবা মুছে দাও, ভেঙে ফেলো স্লেটখানি।
তবে মনে রেখো, আবার কেউ আসবে
তোমার সঙ্গে থেকে যা-কিছু দেখবে শুনবে
আবার লিখবে কেউ, বলবে সে সবই !
তোমার কাছে শব্দ আছে তর্ক আছে বুদ্ধি আছে
সমস্ত শাসন-ক্ষমতাও তোমারই হাতে,
বারবার বলে বলে তুমি সত্যিকে মিথ্যে বানাতে পারো
একটিমাত্র বাক্যে খারিজ করতে পারো আমার সবকিছু
চোখেদেখাকেও প্রমাণ করতে পারো ভুল…
জানি, আমি সব জানি –
তবে ভুলে যেও না, সমস্ত জীবন দিয়ে
সত্যকে সত্য আর মিথ্যেকে মিথ্যে বলার মত লোক
এখনও কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি।

এই তো লেগেছে আগুন
আগুন লেগেছে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত
আমি জ্বলছি তোমার শাসনব্যবস্থায়
জ্বলছি আর থেকে থেকেই ফুঁসে উঠছে আগুন…
এ কারণেই নীরব থাকব না আর
তোমার বিরুদ্ধে উসকে দেব আরো আরো আগুন
যত নিষেধ করবে, ততই চিৎকার করব
জানি, মাথায় পাথর তুলে মারবে আমায়
তবে মনে রেখো, আর ভাঙছি না আমরা
তোমার ভয়ের আঁধিতে ভেসে যাব খরকুটোর মত
তা আর হবে না।
মাথা ফাটবে না বরং চূর্ণ হবে তুমি
গুঁড়িয়ে যাবে তোমার ওই হাতের পাথর।
আর যদি কোনভাবে হেরেও যাই এ বার
তোমার মগজের ডায়েরিতে
আজকের তারিখ দিয়ে লিখে নাও –
এ মাটিতে যত ঝরবে রক্তবিন্দু
শূন্যে মুষ্টিবদ্ধ হাত ছুঁড়তে ছুঁড়তে
ততই জন্ম নেবে নির্মলা পুতুল !
আরো পড়ুন: একগুচ্ছ হিন্দি কবিতা । রতি সক্সেনা
আদিবাসী মেয়েদের সম্পর্কে
ওপর ওপর দেখতে কালো
ভিতরে কিন্তু ঝকঝকে দাঁতের মত শান্ত শুভ্র
ফেনিল দুধের মত হাসে যখন ওরা
ছলনাহীন হাসি –
যেন পাহাড়ের কোল থেকে
ঝরঝর ঝরে পড়ছে মিষ্টি জলের ধারা
মাদলের দ্রিমি দ্রিমি তালে
মাথায় গুঁজে হলুদ-সবুজ পাতা
যখন ওরা নাচতে থাকে সারিবদ্ধ
অকাল বসন্ত আসে যেন !
ফসল রোয়া আর কাটার কাজে যখন
মাঠে মাঠে গান গায় ওরা
বলা হয়, ভুলে যায় নাকি জীবনের কষ্ট !
ওদের নিয়ে কে বলেছে এতবড় মিথ্যে? কে?
নিশ্চয়ই আমাদের মধ্যে কোন পেটমোটা মাতব্বর
সত্যিকে ধাঁধিয়ে দেবার নির্লজ্জ সওদাগর কোনো
অথবা শব্দের সঙ্গে মিথ্যাচার করা কোন কবি
আসলে সে মস্তিষ্কেই বিকলাঙ্গ !

আরও এক বার
ভাড়াকরা ভিড়েঠাসা সভাঘরে
আমরা জমায়েত হব
আরও এক বার
আমাদের মিছিলে নেতৃত্ব দেবেন
আধকাটা ব্লাউজ়পরা উন্নাসিক মহিলা
প্রতিনিধিত্বের নামে
আমাদের সামনে মঞ্চাসীন হবেন তিনি
আরও এক বার
বিশাল ব্যানারের সামনে
ক্ষমতার বিরুদ্ধে মঞ্চের মাইকে তুলবেন আওয়াজ
আর আমাদের লক্ষ করতালিতে
হাত তুলে মিথ্যে সঙ্গে থাকার বার্তা দেবেন
আরও এক বার
আমাদের সভাকে সম্বোধিত করবেন
মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী
সভায় তাঁর উপস্থিতি নিয়ে
আমরা গৌরবান্বিত বোধ করব
আরও এক বার
তর্কের উত্তাপে পুড়বে নপুংসক বিচার
এবং পণ হত্যা বলাৎকার যৌন নিপীড়ন
আর বেশ্যাবৃত্তির বিরুদ্ধে
নেওয়া হবে অনেক অনেক শপথ
আরও এক বার
আমাদের শক্তি প্রদর্শন করে শহরের অলিগলিতে
মিছিল করব পুরুষ শাসনের বিরুদ্ধে
শূন্যে তোলা মুষ্টিবদ্ধ হাত
আর শ্লোগানের উত্তাপে
গরম হয়ে উঠবে শহরের হাওয়া
আরও এক বার
পথের দু’পাশ জুড়ে নির্ভয়ে তাকিয়ে দেখবে
সবকিছু আমাদের দুই চোখ
রোমাঞ্চিত হয়ে বলাবলি করব –
বসন্ত এসে গেছে
আরও এক বার
শহরের ব্যস্ততম চৌরাস্তায়
একত্রিত হয়ে উত্তেজক শ্লোগান তুলব
আর সেখানেই
দেওয়ালে সাঁটানো পোস্টারে দেখব
নায়কের দু’বাহু ধরে ঝুলছে
ব্রা-প্যান্টি পরা নির্লজ্জ সিনে-নায়িকা
দেখাবে বুড়ো আঙুল আমাদের
ভেতরের আগুনও নিভে আসবে ধীরে ধীরে
আর, আরও এক বার
আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাব চৌরাস্তার চার ধার
ঘরের লোক আর বাচ্চাদের
অফিস আর স্কুল থেকে ফেরার চিন্তায়

খবরের কাগজ বেচে মেয়ে
খবরকাগজ বেচছে
নাকি খবর বেচছে –
জানে না সে
আমি কিন্তু জানি
রুটির তাগিদে সে
বেচছে তার আওয়াজ
ছবি ছাপা হয়েছে খবরকাগজে –
তারই মত দুর্দশাগ্রস্ত কিছু মেয়ের
তার মুখের সাথে মিলও আছে কিছু
কখনো সে ছবি দেখে
কখনো নিজেকে
আবার কখনো তার খদ্দেরদের
সে জানে না
আজকের তাজা খবর কী
শুধু এটুকুই জানে –
কাল নোংরা মজা করে
তাকে ধমকেছিল পুলিশ
সে জানে না যে, খবরকাগজ নয়
নিজেকেই সে বেচছে
কেননা খবরকাগজে ছাপা হয়েছিল
যে মেয়েগুলোর ছবি
তাদের মুখের সাথে
তার মুখের অনেক মিল

(সাঁওতাল আদিবাসী সমাজের বিশ্বাস সৃষ্টির প্রথম নারী পিলচু বুড়ি এবং প্রথম পুরুষ পিলচু বুড়ো) পিলচু বুড়ি, সত্যি সত্যি বলো তো
সত্যিই তোমার অঙ্গুলিহেলনে নাচত
তোমার সখা পিলচু হাড়াম ?
শোনা যায়, একটিমাত্র চুম্বনের আকাঙ্ক্ষায়
সবসময় সে তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত !
মালা গাঁথত নিজের হাতে
তোমার অঙ্গে, তোমার বেণীতে পরিয়ে দিত ?
পলাশের লাল লাগিয়ে দিত তোমার গালে ?
তোমাকে খুশি করার জন্য
ঘন্টার পর ঘন্টা নাচ করত সে ?
আমার দিদা বলত –
তখন তুমি ছিলে এই ধরিত্রীর অধিষ্ঠাত্রী,
আর তোমার মুখ দেখার জন্যে
সে ছিল মুগ্ধ ভৃত্য !
দিদা সত্যি বলত, পিলচু বুড়ি ?
যদি হ্যাঁ হয়,
তাহলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে
এই মগজহীন মানুষগুলোই তোমার বংশজ –
যারা একে ছেড়ে ওকে
ওকে ছেড়ে অন্য আরো কাউকে তুলে আনে,
তুলে এনে ঘর বসায় !
খিদে শুধু মন জুড়োবার।
সত্যি সত্যি বিশ্বাস হয় না, পিলচু বুড়ি
এরাই তোমার বংশজ ?
কিছুতেই বিশ্বাস হয় না !

যা-কিছু চোখের সামনে
ততটুকুতেই সীমিত ওদের দুনিয়া
এই দুনিয়ার মধ্যে আছে আরো অনেক দুনিয়া
জানে না ওরা
ওরা জানে না ওদের সামগ্রী
কীভাবে পৌঁছে যায় সুদূর দিল্লিতে
রাজপথ অব্দি পৌঁছতেই যদিও
পাকদন্ডীতে হারিয়ে যায় ওদের দুনিয়া
ওরা জানে না
ওদের দুনিয়া পর্যন্ত আসতে আসতে
কীভাবে শুকিয়ে যায় নদী
কীভাবে পৌঁছে যায় ওদের ছবি
মহানগরে
ওরা জানে না ! জানে না !!

অনুবাদক