| 13 ডিসেম্বর 2024
Categories
উপন্যাস পুনঃপাঠ সাহিত্য

পুনঃপাঠ উপন্যাস: শেষ দৃশ্য । অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 178 মিনিট

 

হরিদ্বার থেকে কোনো একদিন ওরা রওনা হয়েছিল—ওরা অন্তত তাই বলে। প্রয়াগ বারাণসীর পথ ধরে গঙ্গার ধারে ধারে ওরা ডেরা বেঁধেছিল। রাজা হরিশ্চন্দ্রের নাম ওরা জানে—তিনি গঙ্গাপুত্র। সে নাম স্মরণ করার সময় ওরা মাটি ছুঁয়ে প্রণাম করে। তার চেয়ে বেশি ওদের জানা নেই। এরা বলবে তখন, না জানে বাবু কাঁহাসে আয়া, লেকিন জানে, হামরা সব আছে গঙ্গা—পুত্তুর। বলবে হরিদ্বারসে কোলকত্তা—তেমন হাজার চটান খুঁজে পাবেন। চটানে হামরা ঘাটের কাঁথা কাপড়ে ডেরা বেঁধেছি। ঘাটের দুচার পয়সায় হামলোগ নসিবকে ঢুঁড়েছি।

চটানে পাশাপাশি কুঁড়েঘর অনেকগুলো। কুঁড়েঘরগুলোর কোনোটায় চাল আছে, বেড়া আছে, দরজা আছে। চাল—ঘাটের ছেঁড়া তোষক এবং কাঁথার, বেড়া—ফালি বাঁশের। কিছু কিছু ঘরের চাল আছে, কিছু ঘরের বেড়া নেই, দরজা নেই। শুধু মেঝের ওপর ফালি বাঁশের মাচান। মাচানের নিচে রাজ্যের হাঁড়ি—কলসি। দরজার বদলে কোনো ঘরে ছেঁড়া কাঁথা ঝুলছে। ছেঁড়া কাঁথাটাই দরজার মতো কাজ করছে। ছেঁড়া কাঁথাটা তেলচিটে নোংরা। কোথাও পোড়া—চিতার আগুনের দাগ। তবু এটাই ওদের দরজার আব্রু, মনের আব্রু, চটানের ভালোবাসার আব্রু। চটানের উঠোনে শুয়োরের খোঁয়াড়, মোরগের ঘর, কুকুরের আস্তানা। ঘরে ঘরে অভাব অনটন মারধোর। আবার ভাব ভালোবাসার কথা। ঘরে ঘরে হল্লা চিৎকার—নাচন কোঁদন। তখন আসেন ঘাটোয়ারিবাবু। তিনি সালিসি সাজেন, বিচার করেন। চটানের মা—বাপ তিনি।

চটানের সঙ্গেই ঘাট—অফিস। এখানে মড়ার নামধাম লেখানো হয়। একটা কাউন্টার আছে—ঘাটোয়ারিবাবু সেখানে একটা কালো চেয়ারে বসে থাকেন সারাদিন। রাতে পাশের তক্তপোশে চুপচাপ শুয়ে থাকেন। ঘরে কতকগুলি ছবি টাঙানো আছে। এই শহরের বনেদি লোকগুলোর ছবি। তারা মরল—তিনি তাদের ছবি রাখলেন। এই ছবিগুলো দেখে কোনোদিন রাত কাটিয়ে দেন অথবা কোনোদিন ঘুমিয়ে পড়েন। ঘাট—অফিস পার হলে বারান্দা। ঘাটের কিছু কাঁথা—কাপড় ইতস্তত ছড়ানো। দুটো কুকুর শীতে কাতরাচ্ছে পাশে। ডোমেদের ছেলেপিলেরা কুকুর দুটোকে সরিয়ে দিয়ে নিজেরা দিব্যি আরামে ঘুমোচ্ছে।

তখন চটানে শীতের রোদ নেমেছে। শীতের ভোরে কাকের শব্দ, কুকুরের শব্দ, মোরগের শব্দ পাশাপাশি কোথাও। পাশাপাশি দুটো ঘরের ফাঁকে একটা শুয়োর পড়ে আছে। ঘোঁৎঘোঁৎ আওয়াজ করছে শুয়োরটা। দুটো বাচ্চা শুয়োর শীতে কাঁদছে।

হরীতকী দরজায় বসে সব দেখছিল। অন্য ঘরে গোমানি ডোম খকখক কাশছে। হরীতকীর কোমরে ব্যথা, তবু বসে বসে সব দেখছিল। কাশির জন্য গোমানি ডোমের গোঁফ কাঁপছে। চোখ দুটো জ্বলছে—জবাফুলের মতো লাগছে। কাঁপতে কাঁপতে মুখ থুবড়ে পড়ছে মাচানের ওপর। হরীতকীর কোমরে ব্যথা, তবু এসব দেখছিল।

গোমানি এদিকে ওদিকে তাকাল। বেলা দেখল। শীতের বেলা—রোদে তাপ নেই, তাপ থাকলে ঘাটের তোষক বালিশ ছেড়ে চটানের উঠোনে কিংবা ঘাট—অফিসের বারান্দায় গিয়ে বসতে পারত। হরীতকী দরজায় বসে এমন সব কিছুই অনুমান করছে। হরীতকী দরজায় বসে রয়েছে এক মালসা গরম জলের জন্যে। দুখিয়ার বৌ ঘাটের পোড়া কাঠে গরম জল করতে গেছে। একটু দেরি হবে—সে ভাবল এত সাধারণ কথা। গোমানির চোখ দুটো কাশির জন্য চোখ থেকে বার হয়ে আসতে চাইল। আবার ভিতরের দিকে পালাতে চাইল। সে দেখল বসে বসে। কোমরে ভীষণ ব্যথা। কোমরটা ধরে টিপল হরীতকী। ব্যথার উপশম খুঁজল। কোমরে চাপ ধরে আছে। সে দাঁড়াল, বাঁশে হেলান দিয়ে উঁকি দিল বাইরে। দুখিয়ার বৌ মংলি আসছে, হাতে গরম জলের মালসা। হরীতকী এত খুশি যে কিছু বলতে পারল না। মালসাটা টেনে নিয়ে পর্দার মতো কাঁথার আব্রু ফেলে দিয়ে গা ধুতে লাগল।

গোমানি মুখ তুলে হরীতকীর খুশি—খুশি ভাবটুকু লক্ষ্য করে বিরক্ত হল। সঙ্গে সঙ্গে শরীরে চটানের নেমকহারাম উত্তাপ জমতে থাকল। রাগ হল ওর। খিস্তি করতে ইচ্ছা হল—মাগি জাত একটা জাত! ওয়ার আবার, ধম্ম ওয়ার আবার স্বভাব! মাগির বাচ্চাটা হয়েছে শ্মশানে—হবে না! মাগির নেই জাতের ঠিক, নেই ধম্মের ভয়—চতুরাকে মদ খাইয়ে খুন করেছে—ও শ্মশানে বাচ্চা বিয়োবে না তো কী হাসপাতালে বিয়োবে! কিন্তু বলতে পারল না। শরীর দুর্বল—শীতের ব্যামোতে ওকে জব্দ করেছে। তা ছাড়া কাল না খেয়ে থাকার জন্য শরীরটা বেজান হয়ে আছে। ভুখা শরীর হল্লা করতে দিচ্ছে না। সেজন্য শরীরে আরও কাঁথা—কাপড় জড়িয়ে পাশের কিছু পোঁটলা—পুঁটলি ঠেলতে থাকল। বলল, উঠ নেলি, সকাল হো গিয়া।

কিছু কাঁথা—কাপড়ের ভিতর থেকে নেলি ধড়ফড় করে উঠে বসল। নেলির মুখটা শুকনো থাকত—যদি না রাতে এত গভীর ঘুমোত। শ্যামলা রঙের শরীর, এক মাথা চুল। চুলগুলো মুখ ঢেকে রেখেছে। চোখ অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চোখে বিরক্তির চিহ্ন। আরও ঘুমোনোর ইচ্ছে। অথচ সে কিছু বলছে না, আড়মোড়া ভাঙছে শরীরের। চোখ রগড়াচ্ছে। চুলগুলো জড়ো করে তালুতে খোঁপা বাঁধছে এবং মাচান থেকে নামার সময় বলছে, ক্যান ডাকলি বাপ? খোয়াব এয়েছিল, তু ডাকলি ক্যান!

গোমানি কাশল ক’বার। ওর উত্তর দিতে সেজন্য দেরি হচ্ছে, অথচ মেয়েটা নেমে যাচ্ছে—চলে যাচ্ছে। সে দম নিতে পারছে না। কথা বলতে পারছে না। ওর জ্বলন্ত চোখ একবার ভিতরে, একবার বাইরে দেখছে। কোনোরকমে লেপ—তোষকের ভিতর থেকে কচ্ছপের মতো গলাটাকে বার করছে। তবু যেন কোনোরকমে—ভুখ লাগিছে।

নেলি চলে যাচ্ছে। চলে যেতে যেতে থামল। আঁচলটা টেনে কাঁধে ফেলল। চোখ টান করে, ঘাড় কাত করে তাকাল বাপের দিকে। তারপর ফের চলতে চলতে উঠোনে নেমে গেল। নিচে নেমে শুয়োরের বাচ্চা দুটোকে ছেড়ে দিল—টঙ—এ কবুতর ছিল, তাও উড়িয়ে দিল। শেষে বসুমতীকে প্রণাম করল দুহাত ঠেকিয়ে।

এমন অবস্থায় গোমানির রাগ না বেড়ে যায় না। নেলি কথা বলছে না, খেতে দেবে কী দেবে না—তাও কিছু বলছে না। বড় বাড় বাড়ছে মেয়েটা। সে ডাকল, হে শুয়োরের ছা, তুকে কী বলিছে হাম? যেছিস কুথা।

যেছি—মরতে। নেলি সাফ জবাব দিল। সাফ সাফ কথা বলল। সে ফের মাচানে উঠে গেল এবং একটা কাঁথা শরীরে জড়িয়ে নিল। রোদের তাপ বাড়ছে একটু একটু করে। উঠোনের ওপর দাঁড়িয়ে সে তা ধরতে পারছে। কবুতরগুলো উড়ে উড়ে চালে, মাঠে ময়দানের ঝাউগাছটায় বসল। সে দেখল কবুতরগুলো পরস্পর ঠোঁট কামড়াচ্ছে—। ঝাউগাছের ডাল ধরে রোদ নিচে নামছে—সে দেখল। একটা পোয়াতি মাদি শুয়োর কাঠগোলায় শুয়ে আছে—সে দেখল। সে এখন ওর গঙ্গা যমুনাকে খুঁজছে! এই ভোরে ওরা কোথায় গেল! সে গলা ছেড়ে ডাকল, গ….ঙ্গা….যমু…..না, কুথা গেলি এবেনে তুরা।

গোমানি কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল মাচানে। বুকটা ওর ভেঙে যাচ্ছে উঠতে। নেলির ভাবসাবগুলো ওকে উন্মাদ করে দেবার মতো। সে কাশতে কাশতে বলল, দেখ নেলি, তুর এ ভাবসাব হামার ভালো লাগে না। যা বুলবি সাফ সাফ বুলবি—লয়তো ঘাটের মড়া মুখে ঠেসে ধরবে।

নেলি তখন ওর কুকুর দুটোকে আদর করছিল। ওরা ওর গায়ের ওপর লাফিয়ে উঠছে। সে শুনতে পাচ্ছে—বাপের গলায় গরল। সেও গরল তুলল গলায়—কিয়া বাত তুম বলেহ! ঘাটের মড়া ঠেসে ধরবে! ধর, ধরে যদি খানা মিলেত জরুর ধরবে।

হরীতকী শরীর পরিষ্কার করে ফেল দরজায় বসে সব দেখছে। শ্মশানে বিয়ানো বাচ্চাটা কাঁদছে ওর কোলে। সে এই সব দেখতে দেখতে ষাট সোহাগ করল, নেলি ওর ঘরের দিকেই আসছে। কুকুর দুটো তখন উঠোনের মাটি শুঁকছে। হরীতকী বাচ্চাটাকে রোদে রেখে দিল। তখন ঝাড়ো ডোমের ঘরে কী নিয়ে বচসা হচ্ছে। শিবমন্দিরের পথ ধরে শহর থেকে যাত্রী নামছে তখন। ওদের কোলাহল এই চটানে ভেসে আসছে। নেলি সেই সব কোলাহল শুনতে শুনতে হরীতকীর দরজায় এসে হাজির হল। পিসির বেটি রয়েছে—বেটির পাশে বসল। নাক নেড়ে আদর করল।

হরীতকী বলল, কিরে ভোর না হতেই বাপের সাথ ঝগড়া বাঁধালি?

হেঁ বাঁধিয়েছি ত। নেলি জবাব দিতে গিয়ে ঘাড়টা কাত করে দিল। হরীতকী ধমক দিল নেলিকে। ওকে শাসন করারও ইচ্ছা। —যা যা ঘরে যা। বাপকে দুটো রেঁধে দেগা। হাসপাতাল থেকে পুলিশ এলে ওকে ফের ভুখা যেতে হবে।

নেলি চুপচাপ ঘাড় গুঁজে পিসির বেটির পাশে কিছুক্ষণ বসে থাকল। তারপর কী ভেবে পিসিকে জবাব দিতে গিয়ে ভেঙে পড়ল—তু বল পিসি, হামি ওয়াকে কী রেঁধে দি। ঘরে কিছু না আছে। গিল রাতে ভুখা থাকতে হল। বুললাম তু যা, এক আধ রুপেয়া ধার লিয়ে চাল দাল কিছু লিয়ে আয়। গিল ঠিক, টাকায় আট আনা সুদে ধার ভি লিল, কিন্তুক কিছু চাল দাল লিল না। পারে সব কুচ রেখে দিল। পিসি, হামি ওয়াকে কী রেঁধে দি বুল।

এই সব কথা শুনে হরীতকী নেলিকে এড়িয়ে যেতে চাইল। এই সাত সকালে গোমানি ডোমের জন্য দরদ উত্থলে ওঠায় নিজের উপরই সে বিরক্ত হল। সেজন্য হরীতকী কোনো জবাব দিল না। পিসির বেটির পাশে বসে মাটিতে নেলি আঁচড় কাটছে। ঘাটের কাঠ এসেছে গরুর গাড়িতে। দূরে কুকুরের আওয়াজ, মোরগ, শুয়োর, কবুতরের শব্দ নেলির দেহমনকে কেমন মাতাল করে রেখেছে যেন। সে নড়তে পারছে না পর্যন্ত। গোমানি কাশছে! বসে বসে নেলি গোমানির গালাগাল খাচ্ছে। সে তখন মাতালের মতো উঠে দাঁড়াল। কুকুর দুটোকে নিয়ে গঙ্গায় নেমে গেল। কিন্তু ভুখা শরীর নিয়ে ওর চলতে খুব কষ্ট হচ্ছে।

শীতের গঙ্গা। জল নেই—হুহু করে বাতাস আসছে উত্তর থেকে। নেলির একমাথা চুলের খোঁপা খসে গেছে। ওর পাঁশুটে চুল বাতাসে উড়ছে। ঘাটে মড়া আসেনি। শ্মশানটা সেজন্য খাঁ খাঁ করছে। শ্মশানের চালাঘর ফাঁকা। কুকুরগুলো সেখানে জটলা পাকাচ্ছে। নেলির উপোসী শরীরটা চলছে না। ও ক্রমশ নিচে নেমে যাচ্ছে। যাত্রীদের ঘাট থেকে সে একটু দূরে দাঁড়াল। কুকুর দুটো ওর দুপাশে। কুকুর দুটোর মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে আকাশ দেখল, উত্তরের হাওয়া গায়ে মাখাল এবং হিসেব রাখল যাত্রীরা কটা তামার পয়সা জলে ফেলছে।

চটান থেকে নামছে গেরু, সোনাচাঁদের ছেলে টুনুয়া, ঝাড়ো ডোমের বেটা লখি। গেরু নেলির পাশে এসে দাঁড়াল। নেলির গঙ্গা যমুনাকে আদর করল। ওরা যাত্রীদের অপেক্ষায় আছে। যাত্রীরা উঠবে ওরা নামবে। যাত্রীদের পয়সা, সোনাদানা, ডুবে ডুবে তুলবে।

গেরু বলল, নেলি তু এত সকাল সকাল!

তুভি ত এসেছিস রে। সকাল সকাল হামি একলা না আছি।

লেকিন তুর বাপ চিল্লাতে শুরু করেছে। বুলছে ও মাগি কাঁহা গ্যাল!

বুলছে ত বুলছে। লেকিন তুর নসিব ত ভাঙেনি।

লখি, টুনুয়া ততক্ষণ সবুর করতে পারল না। ওরা সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সন্তর্পণে নেমে পড়েছে। যাত্রীদের চোখেও ওরা ধরা পড়ছে না। টুনুয়া একটা ডুব দিল। টুনুয়া, লখি একসঙ্গে ডুব দিল। ওরা ডুব দিয়ে যাত্রীদের ভিতরেই ভেসে উঠছে। ওরাও যাত্রী হয়ে গেছে। নেলি গেরু এই সব দেখতে পেয়ে লাফিয়ে জলে পড়ল। শীতের জলে ডুব দিয়ে যাত্রীদের ভিতর হারিয়ে গেল।

যাত্রীরা সব উঠে যাচ্ছে। ওরা ডুব দিয়ে সাঁতার কাটছে এবং গঙ্গার বুক থেকে মাটি, কাঁকর, বালি খড়কুটো সব তুলে আনছে। গেরু অনেকক্ষণ ডুব দিয়ে থাকতে পারে। বালির ওপর মাছের মতো খুঁটে খুঁটে চলতে পারে—নেলি জলের ভিতর থেকে সব দেখতে পাচ্ছে। জলের ভিতর দিয়ে গেরুর পেশী বড় মজবুত লাগছে। কোমরটা সরু লাগছে। বুকের পেশীগুলো শক্ত মনে হচ্ছে। গেরু অনেকক্ষণ জলের নিচে ডুব দিয়ে থাকতে পারে। মাছ হয়ে ভাসতে পারে। গেরুর নসিব ভালো—সে একটা একটা দুটো পয়সা পেল। তামার পয়সা। সে এক আনা পেল। নেলিও ডুব দিয়ে দিয়ে জল কাটছে। আঁচলটা বুক থেকে নেমে মাছের পাখার মতো কাঁপছে। নেলি জলের নিচে দেখল গেরু পয়সা খুঁজছে আর ওর দিকে যেন তাকাচ্ছে। নেলি এসময় এক আনা পেল, গেরু রে, তু আরও দেখ, যত পারিস দেখ। নেলি ডুব দিয়ে দিয়ে চোখ লাল করছে যদি নসিব খোলে। যদি সোনাদানা উঠে আসে আবর্জনার সঙ্গে। দাঁতে দাঁতে ঠেকল। সে ডুব দিল। এত করেও সে যখন পাচ্ছে না, যখন লখি, টুনুয়া সোনাদানা পেল যখন সকলে খুশি হয়ে উঠে যাচ্ছে, তখন নেলি গাল দিল—ডাক ঠাকুর তোর মুখে আগুন।

জল থেকে নেলি উঠে এল। গেরু উঠে এল। উত্তরের হাওয়া আরও বাড়ছে। নেলি শরীর সামলে নিল এবং বলতে ইচ্ছা হল, গিল কাল হামি ভুখা থাকলে গেরু। তুর চারঠো পয়সা হামারে দিয়ে দে। দু আনায় মুড়ি পিঁয়াজি কিনেলি। দুটো হামি খাই, দুটো বাপ ভি খাক। কিন্তু নেলি বলতে পারল না—জলের নিচে যে ইচ্ছার রঙে ডুবেছিল, উপরে উঠে সেই ইচ্ছাই ওকে বলতে দিল না। গেরুর দিকে তাকাল এবং নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে দৌড়ে উপরে উঠতে থাকল। বলতে থাকল যেন—গেরুরে, তু বহুত জোয়ান হয়ে উঠেছিস। উপরে উঠে টুনুয়াকে ডাকাল, এ টুনুয়া শোন। টুনুয়া কাছে এলে বলল, চারঠো পয়সা ধার দিবি। কাল হামি ভুখা থাকল, বাপ ভুখা থাকল।

টুনুয়ার কাছ থেকে চারটা পয়সা নিয়ে ফের ছুটতে থাকল নেলি। কাপড়ের আঁচলে পয়সা দু আনা শক্ত করে বেঁধে শিবমন্দিরের পথে উঠতে থাকল। আকাশটা পরিষ্কার। প্রচণ্ড শীত যেন আকাশ থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামছে। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কাপড় নিংড়াল নেলি। দুপুর হচ্ছে অথচ রোদের উত্তাপ বাড়ছে না। নেলি গায়েপিঠে উত্তাপ নিয়ে শরীরে উত্তাপ জমাতে পারল না। সে বিরক্ত হয়ে চটানের দিকে নেমে গেল। ঝাড়ো ডোম গাওয়াল করতে বের হচ্ছে—লাঠির দুপাশে ডালা—কুলো ঝুলছে। সোনাচাঁদ শহরের কুকুর বেড়াল ফেলতে মিউনিসিপাল অফিসে যাচ্ছে। দুখিয়া হল্লা করছে চটানে। নেলি চটানে না ঢুকে পুরোনো অশ্বত্থের নিচে দাঁড়িয়ে শুনল সব। দুখিয়া নালিশ দিচ্ছে গোমানিকে—তেরে বেটি চোর গোমানি। তেরে বেটি চোর। সাবধান করে দিস বেটিকে।

পুরোনো অশ্বত্থের নিচে দাঁড়িয়ে নেলি বুঝল বাপ উত্তর করছে না। এখানে দাঁড়িয়ে অন্তত কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। বাপের চেহারা এ সময় কেমন দেখাচ্ছে এই ভেবে নেলি মুষড়ে পড়ল। ভাবল, এখন চটানে উঠে গেলে বাপ হয়তো চেলা কাঠ নিয়ে তেড়ে আসবে। বলবে, হারাম তু চটানসে নিকাল। নেলি সুতরাং নড়ল না। আরও কিছু কথাবার্তা না শুনে সে নড়তে পারছে না। বাপের আওয়াজ কানে আসার আশায় পুরোনো অশ্বত্থের নিচে দাঁড়িয়ে থাকল। শীতে কাঁপল। কারণ আওয়াজ শুনলেই সে বুঝতে পারবে বাপের রাগ চেলাকাঠের না দু দণ্ড গালমন্দের। নেলি শুনল তখন বাপ বলছে—চোর! মেরে বেটি চোর!

হা জরুর চোর। তেরে বেটি চুরি করে লিছে ঘাটের কাপড়। বে হুদা হামার ডাক হল। তু কিছু করে না লিস ত পাঁচ জনকো হাম জরুর সালিসি মানে।

তু সালিসি না মানে দুখিয়া। ও আর ঘাটসে কিছু লেবে না। আমি ওয়াকে বারণ করে দেব।

নেলি বাপের এইসব কথাগুলো শুনে নিশ্চিন্ত হল। চটানে উঠে গিয়ে মাচান থেকে কাঁথা—বালিশের ভিতর থেকে একটা শাড়ি বের করল। ভিজে শাড়িটা এবং কাঁথাটা চালের ওপর ফেলে দিল। এ সময় হরীতকী দরজা থেকে মুখ বের করে দেখল দুখিয়া নেই—চলে গেছে। নেলি কাপড় ছাড়ছে, কাপড়ে বুক ঢাকতে চায় না। হাঁটু ঢাকতে চায় না। তবু নেলি কাপড়টা টেনেটুনে সব শরীরে পেঁচিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এই সব দেখে হরীতকীর কষ্ট হল এবং হাতমুখ নেড়ে ভিতরের কষ্টটাকে উগরে দিল—চামার! চামার! ছোটলোক!

গোমানি কাঁথা—কাপড়ের ভিতর থেকে সম্মতি জানাল, ছোটলোক—হা ছোটলোক বটে।

হরিতকির মনের ঝাল যেন মিটছে না।—ঘাটের কাপড় না বুলে লিয়েছে ত ওয়ার জান গেছে!

হা তাই বটে।

চুরি করে লিছে ঘাটের কাপড়! এর নাম চুরি! আর বুলি গোমানি বেটিকে কাপড় দেওয়ার মুরদও নাই তোমার। ঘাট থেকে চুরি করে তবে ওয়ার পিনতে হয়।

নেলি পুরোনো অশ্বত্থের নিচে দাঁড়িয়ে বাপের শেষ জবাবটাও শুনে গেল। —নাই আমার, হা নাই যা বুলছ।

নেলি চটান পার হয়ে শিবমন্দিরের পথ ধরল। সে শরীর ঢেকে গা বাঁচিয়ে হাঁটছে। সে জানে কেউ ওকে ছোঁবে না। সে জানে ছুঁয়ে দিলে ওরা স্নান করবে গঙ্গায় এবং নেলির চোদ্দপুরুষকে উদ্ধার করবে। নেলি রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটল। বাবুদের দেখে আলগা হয়ে দাঁড়াল। নর্দমার পাশে দাঁড়িয়ে শরীর আলগা করে দিল। জড়োসড়ো হয়ে সকলকে পথ খুলে দিল।

নেলি রামকান্তর দোকানে এসেও আলগা হয়ে দাঁড়াল।

রামকান্ত বলল—তোর বাপ চটানে আছে না হাসপাতালে গেছে?

চটানেই আছে। মাচানে পড়ে গোঙাচ্ছে।

ধারে টাকা নিল, টাকাও দিল না, সুদের নামও করল না।

করবে। হাতে টাকা হলে বাপ দিয়ে দিবে।

এবার গলা খাটো করল রামকান্ত। জোঁকের মতো গলা লম্বা করে দিল। এবং ফিসফিস করে বলল, হরীতকীর বাচ্চাটা মেয়ে না ছেলেরে?

মেয়ে বাচ্চা দি লিছে পিসি।

তুই বাচ্চা দিবিনে? তোর বাচ্চা দিতে শখ যায় না?

নেলি বাবুর মুখ দেখে অর্থ ধরতে পারল। সে চোখ ঢাকল। মুখ কুঁচকাল। কিন্তু কিছু প্রকাশ করল না। রামকান্ত সুদের মহাজন—নেলি রামকান্তকে ঘাঁটাতে সাহস করল না। অথচ চোখে—মুখে অস্বাভাবিক ভাব নেলির। বিরক্তিতে চোখ দুটো জ্বলছে। তবু সে এতটুকু রাগ দেখাল না। নরম গলায় ঢুলে ঢুলে বলল, কী যে বুলছে বাবু!

এমন কথা শুনে অনেক দিন পর রামকান্ত প্রাণ খুলে হাসল। কী যে বুলছে বাবু! নেলির মা ফুলনও এ—গলায় এমনি করে বলত। এমনি করেই চোখমুখে অস্বাভাবিক ভাব ফুটিয়ে তুলত। তখন ফুলনের মুখটা আরও মিষ্টি লাগত। তখন ফুলনের ভরা কোটালের যৌবন। নেলিকে প্রশ্ন করার মতো সেদিন ফুলনকেও প্রশ্ন করেছিল—ঝাড়ো ডোমের বাচ্চাটা মেয়ে না ছেলে? ডোমের বৌ বাচ্চা কেমন দিলে। তুই বাচ্চা দিবিনে, তোর মা হতে শখ হয় না?

তারপর একদিন চটানে শুনতে পেয়েছিল গোমানির পোয়াতি বৌর কান্না। মাচানের নিচে ফুলন উপুড় হয়ে পড়ে আছে। মেটে হাঁড়ি—কলসিগুলো নিচে থেকে সরিয়ে রেখেছে গোমানি। ঘাটের কাঁথায়—কাপড়ে মাচানের চারদিক ঢেকে দেওয়া হয়েছে। মাচানের ওপর গোমানি নিশ্চিন্তে বিড়ি টানছে। সুদের মহাজন রামকান্ত চটানে এসে অপেক্ষা করছে। এ সময় গোমানির টাকার দরকার হতে পারে। টাকা দেওয়ার জন্য বসে রয়েছে সে। গোমানি তখন মাচানের ওপর ফকির দরবেশের মতো। গোমানি তখন ঈশ্বরকে ডেকে বলছে, দুনিয়া আজব জায়গা। এখানের জনম—মরণ রহস্য আমরা ছোট মানুষ হয়ে কী করে জানব। ওর আসমান ওর জমিন—ও ঠিক টেনেটুনে খালাস করবেই। মাঝে মাঝে গোমানি মাচানের নিচে উঁকি মারছিল আর দেখছিল—খালাস পাচ্ছে কী পাচ্ছে না, এবং ঝাড়ো ডোমের বৌকে বলছিল—ভাবি, টেনে নামাস না। ওকে আপনি নামতে দে।

সেই মেয়ে এখন এত বড় হয়েছে, সেই মেয়ে এখন কাপড় সামলে হাঁটে। সেই মেয়েকে সে অযথা এখানে দাঁড় করিয়ে রাখতে চায়।

নেলি কিছু মুড়ি কিনল। কিছু পেঁয়াজি কিনল।

নেলি চটানে ফিরে এসে দেখল মাচানে তেমনি উপুড় হয়ে পড়ে আছে বাপ। বালিশের ভিতর মুখগুঁজে পড়ে আছে। হাত পা কুঁকড়ে রেখেছে। শরীরটা শুকনো লাউডগার মতো। গোমানি নেতিয়ে আছে মাচানে। মানুষটার পেটে রাজ্যের খিদে। নড়তে পারছে না—এ—পাশ ও—পাশ হতে কষ্ট।

নেলি সন্তর্পণে উঠোন পার হয়ে উঠল। মাচানে বসল। ধীরে ধীরে বাপের শরীর থেকে কাঁথা—কাপড় সরিয়ে ডাকল—বাপ, উঠরে বাপ। খা। দুটো দানা মুখে দেনেসে তাগদ হবে শরীরে। হাসপাতাল সে আজ জরুর সিপাই আওগে। তু খা লে।

গোমানি উঠে বসল। ওর পাতলা আমশি ঠোঁটে হাসি ফুটল। শেষে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে মুড়ির ঠোঙাটা জোর করেই যেন নেলির হাত থেকে কেড়ে নিল। তারপর মুঠো মুঠো মুড়ি কুমিরের মতো হাঁ করে মুখটায় ঠেলে দিতে থাকল এবং মুড়ি খেতে খেতেই গোমানি বলল—খুব তাল মুড়ি আছে। দুটো মুড়কি লিলে ভালো হত রে। লয় তো কিছু বেগুনি, ফুলরি।

লিয়েছি। এক আনার পিঁয়াজি ভি লিয়েছি। দ্যাখ কেমন গরম গরম আছে।

বাপের এই খুশি—খুশি ভাবটুকু নেলির ভালো লাগছে। নেলি আঁচলে গিঁট খুলে পেঁয়াজির ঠোঁঙাটা ওর হাতে দিল। —দেখ কেমন গরম গরম লিয়েছি। তুর চারঠো হামার চারঠো। মুড়ি সবটা খেয়ে লিস না আবার। হামার লাগি রাখিস। ভুখ হামর ভি লাগিছে।

নেলিকে খুশি—খুশি দেখে বিড়ি খাওয়ার জন্য গোমানি চারটা পয়সা চাইল। —চরঠো পয়সা জায়দা হবে?

নেলি ঘাড় নাড়ল। তারপর বাপের দিকে চেয়ে বলল—না।

গোমানির দাঁত না থাকায় কথা খুব অস্পষ্ট। মুখভর্তি মুড়ি থাকার জন্য কথা আরও অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মুড়িগুলো মাড়ি দিয়ে চিবুচ্ছে আর বলছে, চারঠো পয়সা জায়দা হোবে না বুলছিস। তবে চার পয়সার বিড়ি কিনে লিতাম।

নেলি দেখছে বাপ মুড়ি প্রায় শেষ করে এনেছে। একবার ওর কথা ভাবছে না। যেন সব মুড়ি, সবকটা পেঁয়াজি শেষ করে দেবে। যেন গোমানি একাই খাবে সব। বাপের এই অবিবেচনার জন্য নেলি বিরক্তিতে ভেঙে পড়ল। না হবে না। পয়সা হামার নেই। পয়সা পাব কুথা? দুচার পয়সা তু হামারে দিস?

তব তু এ—পয়সা কাঁহা পেলি? বুল শুয়োরের ছা, তু কুথা পেলি। গোমানি গলাটাকে ওঠাতে নামাতে থাকল।

পয়সা হামি কামিয়েছি। এ—মুড়ির পিণ্ডি যে তু গিললি সে হামার রোজগারের। লজ্জা না লাগে তোর মেয়েমানুষের রোজগার খেতে। পোড়া কাঠ খেতে পারিস না ঘাটের। পোড়া মানুষ চিবিয়ে খেতে পারিস না! নেলির মুখে গরল উঠল।

খুন! খুন করে দেব। গোমানি কাঁথা—কাপড় ছেড়ে উঠে পড়ল। কোমর থেকে লুঙ্গিটা খুলে যাচ্ছিল, সেটা কোনোরকমে ধরে ফেলল। এক হাতে কোমরের লুঙ্গিটা চেপে ধরে মাচান থেকে লাফ দিয়ে নামল। সে মুখ থুবড়ে পড়তে পড়তে বেঁচে গেল। মাচানের নিচে গলা বাড়িয়ে সে খুঁজছে দা—টা। মুড়ির ঠোঙা এক হাতে—সেটা ছাড়ছে না। মাচানের নিচে থেকে গলাটা ফের কচ্ছপের মতো বের করে ধরল। কচ্ছপের মতো চোখ করে সে নেলিকে দেখছে—খুন করে দেব বেইমানের ছা! আমি না তোর বাপ!

নেলি ভেংচে উঠল। হাত পা নেড়ে বলল, বাপরে! হামার বাপ! বাপের মুরদ দেখলে বাঁচিনে!

গোমানি ওর ভোঁতা দা—টাকে মাচানের নিচে খুঁজে বেড়াচ্ছে। হাঁড়ি টেনে কলসি টেনে দা—টা খুঁজছে। দা—টা ওর এ—মুহূর্তে চাই—ই। খুন সে যেন করবেই। নেলিকে খুন না করে জলগ্রহণ করবে না—এমন ভাব চোখে—মুখে। নেলি কিন্তু নড়ছে না। মেঝেতে দাঁড়িয়ে বাপের কাণ্ড দেখছে। আর যখন দা পেয়ে গোমানি ওর সামনে দা—টাকে ঘোরাতে ঘোরাতে চিৎকার করল—খুন, খুন, আজ খুন হবে লিশ্চয়, তখন নেলি গলার স্বরটা শক্ত করল এবং পরে কোমল করে বলল, চুপ কর, চুপ কর। অমন করে ছোটলোকের মতো চিল্লাস না। যা খাচ্ছিস তাই খা, পয়সা না থাকলে দি কোত্থেকে!

গোমানি দেখল ঠোঙায় মুড়ি প্রায় নেই। সুতরাং সে নেলির মুখে ঠোঙাটা ছুঁড়ে দিল। —আর খাব না। তুর গতরের রোজগার হামার লাগে না।

গোমানি ফের মাচানে উঠে কাঁথা—কাপড় গায়ে দিয়ে বসে থাকল। যেন সে এ—মাচান থেকে আর উঠবে না, নড়বে না। অনড় হয়ে বসে থাকবে। হাসপাতালে যাবে না। কোথাও যাবে না। কোথাও না। নেলি হাঁটু গেড়ে মাটি থেকে একটা করে মুড়ি কোঁচড়ে তুলছিল তখন। একটা দুটো করে মুখে মুড়ি ফেলছিল। এই দুঃসহ দুঃখে বাপের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না। ক্ষোভে চোখ থেকে জল বের হচ্ছে। ওর কান্না পাচ্ছে। এবং এ—সময়ই নেলির গেরুর মুখ মনে পড়ছে। জোয়ান শরীরটার কথা মনে পড়ছে। কৈলাস ডোমের বেটা দিন দিন চটানে মরদ হয়ে উঠছে। বাপের মতো কসরত দেখাতে শিখেছে। বল্লম ছুঁড়ে গাছ এফোঁড়—ওফোঁড় করে দিচ্ছে। আকাশ ফুটো করে দেওয়ারও ইচ্ছা যেন গেরুর।

মাচানে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল গোমানি। রাগ পড়তে শুরু করেছে। কিন্তু নেলির হাবভাব দেখে মনটা ওর ফের বিগড়ে গেল। নেলি পিঁয়াজি খাচ্ছে—আহা পিঁয়াজি খাচ্ছে—যেন কিছু খায় না। যেন গোমানিকে দেখিয়ে দেখিয়ে খাওয়া হচ্ছে। যেন বলছে খেতে খেতে তোর কামাই খাচ্ছি নারে, আমার মুরদের কামাই খাচ্ছি। তবে এত ডর কীসের।

থুঃ থুঃ! গোমানি থুথু ছিটাল। —না আর খাব না। তোর গতরের রোজগার হামার লাগে না। যেন পারলে এক্ষুনি উগরে দেয় সব। বাপের এইসব কাণ্ড দেখে নেলি খিলখিল করে হেসে উঠল। না হেসে পারল না। না হাসতে পারলে খালি পেটে খিল ধরে যাবে যেন। উঠোনে নেমেও সে হাসল। পাগলের মতো হাসতে থাকল। মুখে বাপের থুথু লেগে আছে, মুড়ির কুচি লেগে আছে—সব মিলে ভীষণ একটা দুর্গন্ধ। নেলি হাতমুখ ধুল মালসার জলে। ফের হাসতে গিয়ে দেখল সামনে দাঁড়িয়ে সিপাহি। নেলি ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল। ছুটে এসে ঘরে ঢুকল সে।

হরীতকী গোমানির এই সব কাণ্ড দেখে বলেছিল—তুমি একটা বাপই বটে গোমানি।

হে বাপই বটে! গোমানি মাচানে বসে জবাব দিয়েছিল।

এটা বহুত আচ্ছা কাজ হল না। মেয়েটা ভি না খেয়ে রয়েছে, ওয়াকে তুমি খেতে দিলা না।

গোমানি একটা কোঁত গিলল।

গোমানির সওয়াল শুনল নেলি। সিপাহি উঠোন পার হয়ে গোমানির খোলা ঘরটার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর জুতোর শব্দে মুখ তুলল গোমানি। সিপাহিকে দেখে খুব ভালোমানুষ হয়ে গেল। যেন এতক্ষণ চটানে কিছুই হয়নি। সে হাসল পুলিশ দেখে।

নেলি সিপাহিকে একটা পিঁড়ি দিল বসতে।

সিপাহি বলল—হে গোমানি চলেহ।

হা জি চলতে রহেহ। গোমানি কাঁথা বালিশের নিচে এখন গামছাটা খুঁজছে। —কাঁহাসে লাশ এল?

মধুপুরসে। সিপাহি পিঁড়ি টেনে বসল উঠোনে।

গোমানি কাঁথার ভিতর থেকে গামছা টেনে বের করল। —খুনের লাশ না গলায় দড়ির লাশ। মাথায় কাপড় দিয়ে ফেট্টি বাঁধার সময় এই ধরনের একটা প্রশ্ন করল সিপাহিকে।

সিপাহি দেখে গোমানির শরীরের সব জড়তা ভেঙে যাচ্ছে।

নেহি, পানীসে ডুবল জোয়ান মেয়ে।

পেটে বাচ্চা আছে জরুর।

সে বাত ত গোমানি তুম জানবে।

গোমানি গামছা কোমরে বেঁধে উঠোনে নামল। চালাঘরে দুটো মোরগ ডাকছে। একদল কাক হল্লা করছে পুরোনো অশ্বত্থ গাছে। চটান ছাড়িয়ে একটা দেওয়াল অতিক্রম করে বড় বাড়ির দোতলায় রেডিয়ো বাজছে। উড়োজাহাজের শব্দ আকাশে। ঝাড়ো ডোমের বৌ চেলাকাঠ ভাঙছে ওর মেজোবেটার পিঠে। গোরুর গাড়িগুলো চটান থেকে নেমে যাচ্ছে! ঘাটোয়ারিবাবু চেয়ারে বসে কাগজ পড়ছেন। ঘাটে মড়া আসেনি। কাউন্টারের সামনে কোনো লোক দাঁড়িয়ে নেই। আকন্দ গাছের ডাল বেয়ে রোদ উঠে যাচ্ছে। গোমানি চটান ছেড়ে শিবমন্দিরের পথে পড়ল।

গোমানিকে চলে যেতে দেখে নেলি ডাকল—বাপ!

ফের পিছু ডাকলি!

ঘরে কিছু লেই বাপ! ও বেলায় খাবি কী? তু জলদি আওগে ত।

আওগে। আওগে। খাব, ঠিক খেয়ে লিব। লেকিন তু কোথাও যাস না। দিনকাল বহুত খারাপ। গোমানি শিবমন্দিরের পথ ছাড়িয়ে বড় রাস্তায় পড়ল।

নেলি চলতে থাকল। সঙ্গে গঙ্গা যমুনা চলছে। চটানে নেলিকে ধমক দেওয়ার মতো আর কেউ নেই। সে এখন একটু ঘুরবে ফিরবে। সে এখন পাশাপাশি সব চালাঘরগুলোতে উঁকি দেবে। ওদের রান্নার কথা শুনবে, ঘরে ঘরে শুধাবে ওরা বিকেলে কী খাবে। সে—সব শুনে সে বিষণ্ণ হবে। পেটের যন্ত্রণাটা তখন আরও বাড়বে।

নিজের কথা ভাববার সময় গঙ্গা যমুনার কথা মনে হল। গঙ্গা যমুনাকে এখনও পর্যন্ত কিছু খাওয়াতে পারল না। গঙ্গা যমুনা পায়ে পায়ে ঘুরছে, খেতে চাইছে। আজ এখনও ঘাটে মড়া আসেনি। রাতের বুড়ো মানুষটার নাভিটা নিশ্চয়ই কচ্ছপেরা শেষ করে দিয়েছে। গঙ্গা যমুনা বিরক্ত করছে ত করছেই। নেলি অগত্যা বলল, লে—লে—খেয়ে লে। হামার গতরটা খেয়ে লে। এই শুনে কুকুর দুটো কী বুঝে ছুটতে থাকল। নেলিও ছুটল কুকুর দুটোর পিছনে। গঙ্গার পাড় ধরে ওরা ছুটছে। নেলির ইচ্ছা, এ—সময় গেরু আসুক, ওরা একসঙ্গে ঘাটবন্দরে উঠুক। তারপর আরও দূরে আরও দূরে। সেখানে বুড়ো মানুষটার জন্যে আতপ চাউল সিদ্ধ হচ্ছে, কিছু তন্ত্র—মন্ত্র হচ্ছে তারপর ডেলা ভাতগুলোতে কিছু কালো তিল মিশিয়ে বুড়ো মানুষটার বেটারা গঙ্গার জলে ভাসাবে। নেলি সব খবর রাখে। নেলি সেই উদ্দেশ্যেই আপাতত হাঁটতে থাকল।

নেলি লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে। কুকুর দুটোও লাফাচ্ছে। নেলির চুল উড়ল উত্তুরে হাওয়ায়। কাপড় উড়ল। এখানে সেখানে ঝোপ, ঝাড়, জঙ্গল। এখানে সেখানে উঁচুনিচু মাটি। নেলি লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে।

কতবার ঘুরে গেছে এ—অঞ্চলে নেলি। কতবার লখি এল, টুনুয়া এল। গেরু, গঙ্গা, যমুনা এল। কতবার সে একা এসেছে। কুকুর দুটো ওকে পাহারা দিয়েছে। জলকলের সেই অদ্ভুত শব্দটা সে কতবার শুনল। কতবার শুনেছে। আজও নেলি কান পেতে শুনল। মাটি এখানে কুমিরের পিঠের মতো অমসৃণ। ঝোপ—ঝাপ সবুজ কাঁটার জঙ্গল দুধারে, দু মানুষ সমান উঁচু বনফুলের ঝোপ। দু—একটা গিরগিটি লাফিয়ে পড়ল ওদের উপর। দু—একজন মানুষ শহর থেকে ফিরছে। আকাশে চিল উড়ছে—দূরে দূরে আসশ্যাওড়ার জঙ্গল। সোনা—ব্যাঙের ঢিবি মাঝে মাঝে। দুটো একটা খরগোশের গর্ত—গঙ্গা যমুনা নাক দিয়ে গর্তগুলো শুঁকছে।

নেলি পথের মোড়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল। সে জানে বুড়ো মানুষের বেটারা ওই পথে গঙ্গায় নেমে আসবে। হাতে ওদের নতুন মালসা থাকবে। মালসায় আতপ চালের ভাতগুলো ডেলা ডেলা থাকবে। বুনো ঘাস থাকবে উপরে। নেলি এখানে দাঁড়িয়ে ঝোপ—জঙ্গল অতিক্রম করে দূরে পুরোনো বড় বাড়িটা দেখতে পাচ্ছে—বুড়ো মানুষটা গত রাতে এ—বাড়ি থেকেই ঘাটে গেছে। যমুনাকে দিয়ে বুড়োর খাটো কাপড়টা সে রাতে চুরি করিয়েছে। দুখিয়া বলছে, নেলি চোর। বলেছে, নেলি বেইমানি কিয়া। হাম জরুর সালিসি মানে,—তু বলিছে, হাম শুন লিছে। চামার! চামার!

নেলি এই পথের ওপর দাঁড়িয়ে দুখিয়াকে গাল দিতে থাকল। ….ঘাটের ডাক লিয়েছিস বুলে মাথা কিনে লিয়েছিস! একটা খাটো কাপড় লিয়েছি, ওয়ার লাগি জান গেছে। হাম সালিসি মানে! সালিসি! কে শুনে লিবে রে তুর সালিসি। কোন শুনে লিবে। হামি বলবে না কিছু তু ভেবে লিছিস। নেমকহারাম! বেইমান! নেলি এখন সেই কাপড়টাই পরে আছে বলে ওর যেন যন্ত্রণা হতে থাকল এবং গলায় গরল উঠতে থাকল।

কুকুর দুটো ওর পায়ে পায়ে ঘুরছে। সে এ—সময় কুকুর দুটোকে সালিস দিল—শুনে লে দুধিয়া কী বাত বুলছে। হামি চোর, তু চোর—এ বাত বুলছে। তুরা হামার সালিসি থাকল।

নেলি এবার কুকুর দুটোকে হাত জড়িয়ে আদর করল। জলের নিচে দেখা গেরুর শরীরটা ওর মনে পড়ল। —গেরু, তু বহুত আচ্ছা আছে। তু একদফে বড় হয়ে ঘাটের ডাক লিবি। ঘাটের কাঁথা—তোষক সব লিবি। দুখিয়ার মাথায় লাঠি ভাঙবি। হামি বহুত খুশি হবে। তু আওর হামি, হামি আওর তু। নেলি এই নিঃসঙ্গ পথে দাঁড়িয়ে অভুক্ত শরীরে স্বপ্ন দেখল। এখন চিলের ছায়াটা জলের ওপর ভাসছে। জলের ওপর নিজের ছায়া দেখল, গেরুর ছায়া এবং বুঝল নেলি এখন বড় হয়েছে। হঠাৎ এই ভরদুপুরে শরীরটার দিকে চেয়ে ওর কেমন ভয় করল। ও ছুটতে থাকল। ও ছুটছে ফের। হঠাৎ কী এক রহস্যকে ধরতে পেরে নেলি ভয়ে ভয়ে চটানে উঠে এল। চটানে উঠেই শুনল শিবমন্দিরের পথে হরিধ্বনি দিচ্ছে। ঘাটে মড়া নামানো হচ্ছে।

নেলি বুঝতে পারছে মড়াটা বড়ঘরের। বাবু মানুষদের কাঁধে খাটুলী। নেলি এই বাবু মানুষদের গঙ্গার পারে কতদিন দেখেছে। কতদিন দেখেছে। কতদিন সে দিদিমণিদের আলগা হয়ে পথ করে দিয়েছে। কতদিন এই সব বাবুভাইদের ধমক খেয়ে চটানে ফিরে এসেছে! ওরা এখন সিঁড়ি ধরে নেমে ঘাটের দিকে যাচ্ছে। দুখিয়া ছুটছে চটান থেকে। —আহারে মরদ হামার। ছুটছে ত ছুটছেই। তুর বৌটা কুথারে? বৌটাকে সাথে লিয়ে লে! একা ছুটলে আছাড় পড়বি। নেলি রসিকতা করতে চাইল দুখিয়াকে।

এখন চটানের মাগি মরদরা অফিসের বারান্দায় সব জমা হয়েছে। ওরা এখন কাঠ বইবে ঘাটে। ঘাটোয়ারিবাবু কাউন্টারে বসে পত্রিকা পড়ছেন। চোখ তুলছেন না অথচ বুঝতে পারছেন কোথায় কী হচ্ছে। তিনি জানেন দুখিয়া ঘাটে ছুটে গেছে। মড়ার কাঁথা—কাপড় আগলাচ্ছে। মড়ার নাকে কানে গহনা আছে কিনা দেখছে। তিনি জানেন হরীতকী আজ কাঠ বইতে আসবে না, সোনাচাঁদ আসবে না। কৈলাস আসবে না। গোমানি চটানে থাকলে আসত। নেলি আসবে, গেরু, লখি, টুনুয়া, ঝাড়ো ডোমের সব বেটারা, পারলে বৌটা পর্যন্ত। মণ পিছু দু আনা পাবে—চার মণে আট আনা। আনা আনা ভাগ বসাবে—না পেলে মারধোর করবে। চাটনে নাচন—কোঁদন শুরু হবে ফের।

এ—ছাড়া তিনি কাউন্টারে মুখ না তুলেই বুঝতেই পারেন কে সেখানে দাঁড়াল। কার ছায়া পড়ল। তিনি সব বুঝতে পারেন।

তিনি প্রশ্ন করলেন, কোত্থেকে মড়া এল? কার মড়া?

মড়া সেনবাবুদের।

কী হয়ে মরল?

দু দিনের জ্বরে।

বেশ, বেশ। কী নাম? মেয়েছেলে না বেটাছেলে?

ঘাটোয়ারিবাবু এবার মুখ তোলেন। রেজিস্ট্রিখাতা বের করে লাল কালিতে প্রথমে নখে নিব ঘষলেন। রেজিস্ট্রিখাতা থেকে কয়েকটা নাম উচ্চারণ করলেন। ওটা ওঁর স্বভাব। তিনি বললেন, কৃষ্ণপক্ষে যশোদানন্দন গেল, আহা যশোদানন্দন! তুমি তবে মরেছ। বেশ করেছ। কাজের কাজ করেছ। হীরামতি গেল নিতাই পাঠক গেল—এবারের নামটি কী যেন বললেন?

সুচিত্রা গুপ্তা।

বেশ, বেশ সুচিত্রা গুপ্তা। বয়স?

আঠারো।

কাঁচা গেল দেখছি। কী হয়ে মরল যেন?

দু দিনের জ্বরে।

তা হলে দু দিনের জ্বরে লোক এখনও মরছে। বেশ, বেশ। হরি ওঁ। ঘাটোয়ারিবাবু রসিদ লেখার আগে বললেন, হাসপাতাল থেকে এল?

না।

ডেথ—সার্টিফিকেট থাকলে দেখাতে পারতেন।

নেই।

তবে থাক। বেশ, বেশ। পরম ব্রহ্মনারায়ণ। রসিদটা কাউন্টারে ফেলে দিয়ে এই সব কথাগুলো বললেন।

তারপর ঘাটোয়ারিবাবু বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। শীতের নদী বালিয়াড়িতে নেমে গেছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে শ্মশান দেখা যাচ্ছে না। শ্মশান বালিয়াড়িতে নেমে গেছে, সুতরাং শ্মশান দেখতে হলে ঘাটে নামতে হবে। নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। ঘাটোয়ারিবাবু কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। ঘাট থেকে মানুষের কান্না ভেসে আসছে। তিনি তাড়াতাড়ি ইচ্ছা করেই যেন ডাকলেন এ গেরু, তোর বাপকে ডাক। কৈলাসকে কাঠ দিতে বল। তোরা ঘাটে কাঠ দিয়ে আয়। মড়াটা তাড়াতাড়ি জ্বলে যাক।

সেই সময় নেলি শুনতে পেল মড়াটার নাকে কানে গহনা আছে। গলায় গহনা আছে। দুখিয়া লাঠি নিয়ে পাহারা দিচ্ছে। মংলি চিতা সাজানোর আট আনা পয়সা নিয়ে বচসা করছে। চিতা সাজানোর কাজ হরীতকীর। না থাকলে মংলি। মংলি বচসা করছে, আওর জায়দা লাগবে।

নেলি চটান থেকে ঘাটে গিয়ে দাঁড়াল। এখানে অনেক মানুষের ভিড়। চারপাশের লোকগুলো খুব কাঁদছে। নেলি ভিড়ের ভিতর গলাটা বাড়িয়ে দিল। মড়াটা দেখল। ওর হাতের কানের গহনা দেখল। গলার গহনা দেখল। গহনা সহ পুড়িয়ে দেওয়া হবে বলে দুখিয়া পাহারায় আছে; কয়লা ধুয়ে কেউ গহনা চুরি করে না নেয়, অথবা ওর নসিবে কেউ যেন ভাগ না বসায়। নেলি মনে মনে বাপের ওপর রাগ করল। বাপ এক দফে ডাক নিল না ঘাটের। নসিব খুলার চেষ্টা কভি না করল। নেলির বলতে ইচ্ছে হল, তু বুড়বক আছে বাপ। দুখিয়ার নসিব দেখে নেলির পেটের যন্ত্রণা আরও বাড়ছে।

যেমন বেঁটেখাটো দুখিয়া, তেমন জংলি মরদ। মরদ মাগি সমান—কথায়, বচসায় নাচনে কোঁদনে সব কিছুতে। নেলি হাতের কানের গহনা দেখে দুখিয়া—মংলিকে দেখল চেয়ে। নেলি মংলিকে দেখে গাল দিল। কী লুকঝুক নতুন চাদরের লাগি! মংলির কদর্য মুখটা নেলিকে যেন ঘাটে বিব্রত করে মারছে। বিরক্ত করে মারছে। এবং সঙ্গে সঙ্গে বদলা নেওয়ার ইচ্ছায় গঙ্গা যমুনাকে লেলিয়ে দেবার এক তীব্র হিংসায় জ্বলে পুড়ে সে খাক হতে থাকল। মংলির চোখ তুলে নেওয়ার জন্য গঙ্গা যমুনা ওর একমাত্র ভরসা—ওয়ার মরদ বুলে কিনা হামি চোর! হামি চোর আছে। চোর আছে ত ঠিক আছে। চোর যখন আছে তখন ঘাটের গহনা ভি চুরি করে লিব। হেঁ লিব। জরুর লিব। নেলি মনে মনে এই সব বলে যেন শপথ নিল। —লিব। লিব। লিব। এ—ঘাট এখন ভালো লাগছে না। চটান ভালো লাগছে না। শ্মশানটার চারপাশে ঘুরে ঘুরে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। নিজের বাপের কথা মনে হল। বাপ হয়তো এখন হাসপাতালে লাশটার পেট চিরছে। নেলি ঘুরে ঘুরে উপরে উঠে এল। উপরে কাঠ বইতে হবে। কাঠ ফেলতে হবে ঘাটে। সুতরাং নেলি চটানে উঠে গেল। চটানে যাকে দেখল বলল—দুখিয়ার নসিব খুলে গেল। মংলির ভি নসিব। বহুত সোনাদানা ঘাটে এয়েছে। কয়লা ধুয়ে দুখিয়া সব গহনা লিয়ে লিবে। ডোমের কোনো বেটা—বেটিকে দুখিয়া ঘাটে কিছু ঢুঁড়তে দেবে না।

নেলি চটানে উঠে কয়েকটা কাঠ নিল কাঁধে। হরীতকীর দরজার পাশ দিয়ে ঘাটে নামার সময় ডাকল—পিসি!

হরীতকী দরজা থেকে মুখ বার করে জবাব দিল—বুল।

তু ঘাটে যাবি না পিসি? বহুত পয়সায়ালা ঘরের জোয়ান বেটি ঘাটে এয়েছে। বেটি কী খুবসুরৎ, তু যাবিনে ঘাটে?

না, যাব না।

ক্যানে যাবি না তু পিসি?

শরীর দিচ্ছে না। দুখিয়ার জবরদস্তি হামার ভালো লাগে না। ওয়ার ঘাটে হামি থুথু ফেলি। ভোরে তু ত চোর বনে গেলি। ও নালিশ দিল গোমানিকে, তু চোর। তু ওয়ার কাঁথা—কাপড় চুরি করে লিচ্ছিস।

এইসব শুনে নেলির কোমরটা দুলে উঠতে শুরু করেছে। মংলিকে বিদ্রুপ করার জন্য সাপের মতো জিভটা লকলকিয়ে উঠল। —মংলিটা বুলে কী পিসি! বুলে যা ঘাট অফিসে যা, ঘাটোয়ারিবাবুকে বুলে ভালো ভালো কাঠ লে। বিছানার চাদরটার লাগি কী লুকঝুক! লতুন চাদর, আহা মাটার কী সর্বনাশ পিসি! মংলি বুলছে চাদর, তোশক, বালিশে আগুন ধরাতে দেবে না। হাতের কানের গহনা ভি লেবে। অত ভালো লয় পিসি। তু কী বলিস?

হরীতকী জবাব দিল না বলে ফের বলল—পিসি!

বুল।

একজোড়া গহনা হলে হামি কতদিন খেয়ে লিব দেখে লিস। বাপকে কত বুললাম তু ঘাটের ডাক লে এক দফে। দেখে লিবি তখন কত সুখ হামাদের। কত গহনা! এক দফে যদি লিত পিসি!

তুর বাপ পচাই খাবে না ও কাম করবে? দুরোজ আগে দেখলাম মাচানের নিচে বসে ওত ইসপিরিট খাচ্ছে। হাসপাতালসে চুরি করে ইসপিরিট লিচ্ছে। তুর বাপ মরবে। জলদি ও পার পাবে দেখে লিবি। খাবে না, দাবে না—পেট ওয়ার জরুর পচবে।

খড়ম পায়ে তখন ঘাটোয়ারিবাবু ঢুকছেন চটানে। খড়মের শব্দ শোনা যাচ্ছে। হরীতকী তাড়াতাড়ি কাপড় সামলে বসল। বাচ্চাটাকে কোলে নিল। আদর করল। নেলি তখন চটান থেকে সরে পড়ার চেষ্টা করছে। ঘাটোয়ারিবাবু ওকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে বকবে। কাজে ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে এ—কথা বলবে। কিন্তু নেলি দু কদম সরে না যেতেই তিনি ডাকলেন—কাজে খুব ফাঁকি দিচ্ছিসরে।

না বাবু। বাবু, ওরা গহনা পুড়িয়ে দেবে না লিয়ে যাবে? নেলির ইচ্ছা গহনা ওরা নিয়ে যাক। গহনা না পুড়িয়ে শুধু মানুষটা পুড়িয়ে দিক। দুখিয়ার নসিবে আগুন লাগুক।

ঘাটোয়ারিবাবু ধমক দিলেন নেলিকে—তার আমি কী জানিরে ডোমের মেয়ে! আমি কী মড়ার মালিক! কী কথা বলেগো মেয়েটা! কাজে যা কাজে যা। যা করছিস তাই কর। গহনা গহনা করিস না। গহনা দিয়ে কিছু হয় না। তারপর ঘাটোয়ারিবাবু চারদিকে চাইলেন—তখন নেলি গঙ্গায় নেমে যাচ্ছে। কাঠ সাজাচ্ছে ঝাড়ো। সোনাচাঁদ অফিস থেকে ফিরে এসেছে। ঝাড়ো ডোমের বৌ বাঁশের পাতি তুলছে বঁটিতে। কৈলাসের শেষ বৌটা মানুষের কঙ্কাল সিদ্ধ করছে সোডার জলে। ঘাটোয়ারিবাবু এইসব দেখতে দেখতে হরীতকীর দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। দরজার ওপর ঝুঁকে বললেন, বাচ্চাটাকে দেখা। একবার দেখা। বাচ্চাটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, শেষ পর্যন্ত শ্মশানেই বাচ্চা বিয়োলি! বাচ্চাটা বাঁচবে অনেকদিন।

ঘাটোয়ারিবাবুর কথা শুনে হরীতকীর চোখ দুটো ভার হয়ে উঠল। ওঁর বসার জন্যে পিঁড়ি বের করল, পেতে দিল। তিনি বসলেন। হরীতকী বলল, কী আর করব বাবু। ঘাটে কাঠ দিতে গিয়ে গিল রাতে বেটি হামার হয়ে গেল। তারপর কী ভেবে হরীতকী, বাবুর সামনে ওকে শুইয়ে দিল। কুঁকড়ে আছে বাচ্চাটা। রোদের উত্তাপে আর কাঁদছে না। চোখ দুটো ঠিক মেলতে পারছে না। বুড়ো বয়সের এই বাচ্চা হরীতকীর খুব দরদের। হরীতকী খুব খুশি হয়েছে। হরীতকী অপলক চেয়ে থাকল।

ষাটোয়ারিবাবু ভাবলেন চতুরা বেঁচে থাকলে দু হাঁড়ি পচাই গিলত আজ। খুশিতে ডগমগ করত। হরীতকীর দিকে চেয়ে বললেন, কাল কাঠ না বইলেই পারতিস। চিতা না সাজালেই হত। তারপর তিনি ফিসফিস করে বললেন, যাক সবই ঈশ্বরের ইচ্ছা। এবার তাহলে তুই সং সাজলি হরীতকী! তিনি এই বলে উঠে পড়লেন।

হরীতকী ডাকল—বাবু—

কিছু বলবি আমাকে?

হরীতকীর চোখ দুটো লজ্জায় ভারী হয়ে উঠছে। তবু সে না বলে যেন থাকতে পারল না—বাবু বাচ্চাটা কেমন দেখলি?

ঘাটোয়ারিবাবু নিস্পৃহ জবাব দিলেন—ভালো।

কার মতো হবে বুলত?

তোর মতো।

না তোর মতো হবে দেখে লিস। হরীতকী ঘাটোয়ারিবাবুর দিকে চেয়ে হাসল। তিনি কিন্তু হাসলেন না। তিনি হরীতকীর মুখ দেখলেন। চোখ, মুখ, শরীর, দেখলেন হরীতকীর। চোখে এক ধরনের ইচ্ছার প্রকাশ—যা ঘাটোয়ারিবাবুকে কিছু কিছু ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। যেন বলতে চাইছে—আ যা বাবু কাঁহা ভি চল যাই। যেন বলতে চায়—এ—চটান ছোড় দে।

তিনি মুখের ভাবটুকু উদাস করতে চাইলেন। অথবা কেমন অসহায় মনে হল ঘাটোয়ারিবাবুকে। তিনি বললেন, আমার মতো হলে তুই খুশি হবি, কিন্তু লোকে তা হবে না। চতুরার মতো হলেও ভালো হয়। লোকে চতুরার ছা বলেই জানুক। চতুরার মতোই ও দেখতে হোক। সংসারের সং সাজতে আমার আর ইচ্ছে নেই।

হরীতকীর চোখেমুখে গরল উঠতে চাইল!—সংসারের সং সাজতে তুকে বুলেছি! আর বুলব না। পেটটাকে লিয়ে এতদিন ভয় ছিল। পেটটা খালাস হয়ে হামাকে খালাস দিল। হামাকে লিয়ে তোকে আর কোথাও যেতে হোবে না। কোথাও আর পালাতে বুলব না। হামার নসিব লিয়ে হামি বেটি কে সাথ এ—চটানেই পড়ে থাকবে। লেকিন তুকে বুলবে না—আ যা বাবু—কাঁহা ভি চল যাই। কভি বুলবে না এ—চটান ছোড় দে।

যে রোদটা অশ্বত্থ গাছের ডাল ধরে নিচে নেমেছিল সেই রোদ এখন অশ্বত্থ গাছের ডাল বেয়ে উপরে উঠছে। ঝাড়ো ডোম দাওয়ায় বসে তামাক টানছে। হরীতকী বাচ্চা দিয়েছে বলে ঝাড়ো ডোমের ঘর থেকে ঘাটোয়ারিবাবুর খাবার গেছে। অফিসঘরের কোনায় টিনের থালায় কিছু ভাত, ডাল, শাকসবজি। ঘাটোয়ারিবাবু কিছুক্ষণ গীতা পাঠ করেন এই সময়, জানালায় বসে কিছু সময় মা গঙ্গা দর্শন করেন। তারপর তিনি কিছু আহার করেন। এই সময় ডোমেদের ছোট ছোট ছেলেরা অফিসঘরটার চারপাশে ঘুর ঘুর করবে—কখন তিনি ডাকবেন সেই আশায় অপেক্ষা করবে—যেদিন ডাকবেন না জানালা দিয়ে ওরা উঁকি মারবে অথবা হাত পাতবে। তিনি বলবেন—এখন হবে না। যা।

কৈলাস ওর ঘরে শুয়ে আছে। মাচানে ঠ্যাং ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। ওর শেষ পক্ষের বৌ ঠান্ডাভাত খাচ্ছে। সঙ্গে দুটো কাঁচা পেঁয়াজ নিয়েছে, দুটো কাঁচা লংকা নিয়েছে। পিঠে রোদ দিয়ে খাচ্ছে। সে পিঠ চুলকাল। চোখ কোঁচকাল। কাঁচা লংকার জন্য জল পড়ছে চোখ থেকে। নেলি ঘরের ভিতর থেকে বেড়ার ফাঁক দিয়ে সব দেখছে। সেও শুয়ে আছে মাচানে। শরীরে কাঁথা—কাপড় টেনে উপুড় হয়ে দুটো হাতের ওপর চিবুক রেখে গেরুর সৎমার খাওয়া দেখছে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে গঙ্গা যমুনাও নেলির মতো চোখ মুখ নিয়ে বসে আছে। নেলির কষ্ট হতে থাকল। নিজে খেতে পারল না, গঙ্গা যমুনাকে খেতে দিতে পারল না। এ সময় ঘাটোয়ারিবাবু খেতে বসবেন। সে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল এবং ধীরে ধীরে অফিসঘরের দিকে হাঁটতে থাকল। জানলার পাশে এবং সিঁড়ির ওপর সে দেখল লখি, টুনুয়ার ছোট দুটো ভাই ঝাড়ো ডোমের ছোট দুটো বেটি বসে আছে। নেলিও ওদের পাশে বসল। গঙ্গা যমুনাও বসল। সিঁড়ির ওপর বসে ওরা সকলে খাওয়ার গল্প করল।

আজ কিন্তু ঘাটোয়ারিবাবু কাউকে ডেকে ভাতের দলা দিলেন না। তিনি নিজেই সবটুকু চেটেপুটে খেয়ে নিলেন। ঝাড়োর বৌ ভাত যতটা পেরেছে কম দিয়েছে। জল খাওয়ার সময় তিনি হাসলেন। ভাবলেন, পেটে কিল মেরে কথা বের করে শুনেছি, কিন্তু ঝাড়োর বৌ যে দেখছি পেটে কিল মেরে ভাত বের করবে। ঘরের ভিতর কুলকুচা করার সময় তিনি বললেন, তোরা যা। দাঁড়িয়ে থাকিস না। আজ আমারই পেট ভরল না। তোরা যা। অথচ তিনি জল খেয়ে ঢেকুর তোলার চেষ্টা করলেন।

নেলি ভাবছে ফের গঙ্গায় গিয়ে নামে। ফের সেই হাতের গলার গহনা দেখে! মংলির চোখটা গঙ্গা যমুনাকে দিয়ে উপড়ে আনে। কিংবা ইচ্ছা হচ্ছে হাতের গলার গহনা আগুনে কেমন গলছে সেই দেখার। সোনা গলে গলে যেন ছাই হয়ে যায়। কিন্তু ছাই হবে না ভেবেই ওর যত দুঃখ এখন। সেজন্য গঙ্গায় নামতে পর্যন্ত ইচ্ছা হল না। রাগে দুঃখে, ভয়ে এবং পেটের যন্ত্রণায় দুটো চোখ ক্রমশ বসে যাচ্ছে। ক্রমশ নেলি দুর্বল হয়ে পড়ছে। শরীরটা নিয়ে আর চটানে ঘুরতে ফিরতে পারছে না। নেলি সেজন্য মাচানেই ফিরে এল। মাচানে শুয়ে শুয়ে বাপের জন্যে অপেক্ষা করবে। বাপ যদি ধারদেনা করে কিছু চাল ডাল নিয়ে আসে, যদি বাপ রাতের মতো কিছু ব্যবস্থা করে ফেরে এই ভেবে দুর্বল শরীর নিয়ে কোনোরকমে মাচানের কাছে এল। মালসায় কিছু জল ঢালল এবং ঢকঢক করে এক মালসা জল খেল। তারপর মাচানে উঠে বালিশ টেনে কাঁথা—কাপড়ের ভিতর শরীর গলিয়ে দিল। কাঁথার নিচে নেলি এখন কিছু যেন ভাবছে অথবা যেন ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে।

বেলা পড়ে আসছে। শীতের বেলা। ঝাউগাছের ও পাশে সূর্য ক্রমশ বাঁশবনের অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। ঘাটে আগুন উঠছে না। চিতার আগুন যত নিভে আসছে দুখিয়া তত বেশি উত্তেজনা অনুভব করছে। মংলি ঘাট থেকে ফিরছে—ওর মাথায় নতুন তোশক চাদর। হরীতকীর ঘরের পাশ দিয়ে একটু ঘুরেই সে গেল। যেন সকলকে দেখিয়ে যেতে চায়। নেলি ইচ্ছা করেই কাঁথার নিচে মুখ লুকিয়ে ফেলল। কাঁথা কাপড়ের ভিতর থেকে উঁকি মেরে তোশক চাদর দেখল না। ঝিম মেরে কাঁথা—কাপড়ের নিচে পড়ে থাকল।

আর এ—অসময় লাফাতে লাফাতে এল গেরু। গলায় কালো কারে তাবিজ। পুরুষ্টু মরদের মতো গজাতে আরম্ভ করেছে গোঁফ। কালো গেঞ্জি গায়ে—হাতে বল্লম—ওকে দুর্ধর্ষ মনে হচ্ছিল। বল্লমটা কাঁথা—কাপড়ের উপরেই যেন ছুঁড়ে দেবে। নেলির চুল মাচানের পাশে ঝুলছে। গেরু বুঝতে পারছে নেলি মাচানে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। নেলিকে সে ডাকল—এই নেলি,—নে—লি, নেলি—বা তু ত আচ্ছা আছে। অবেলায় এক ঘুম দিয়ে লিচ্ছিস।

নেলি কাঁথা—কাপড় ছেড়ে উঠল না অথবা ওঠার ইচ্ছা প্রকাশ করল না, কিংবা ইচ্ছা থাকলেও উঠতে পারল না, শুয়ে থাকার ইচ্ছা কেবল—ঘুম ঘুম ভাব শরীরে। অথচ ঘুম আসছে না। রাজ্যের চিন্তা এসে নেলিকে জড়িয়ে ধরেছে—গেরু কবে চটানে সত্যি মরদ হয়ে উঠবে, গেরু কবে বুলবে আ যা নেলি, কাঁহা ভি চল যাই, কবে অন্য চটানে উঠে গিয়ে ওরা ঘর বাঁধতে পারবে। দু হাতের ওপর চিবুক রেখে গেরুর দিকে নেলি শুধু চেয়ে থাকল। কাঁথা—কাপড় ছেড়ে কিছুতেই উঠছে না কিংবা কথার জবাব দিচ্ছে না।

গেরু নেলিকে বলল, হামি ফরাসডাঙায় যাচ্ছি! বাপ হামাকে আজ থেকে লিয়ে লিল।

তুর বাপ হামাকে লিবে? তবে হামিও সঙ্গে যাই।

গেরু প্রচণ্ডভাবে হেসে উঠল। বল্লমটা শক্ত করে ধরল। কোমর থেকে গামছা খুলে মুখ মুছে বলল, কী যে বুলছিস তু নেলি। তু যাবি ফরাসডাঙায়। তু যাবি মুর্দার কঙ্কাল তুলতে! তু যে ডরে মরে ভূত হো যাবিরে নেলি, ভূত হো যাবি!

নেলির গলার স্বরটা সহজ এবং সুরেলা হল—হামি বুঝি পারে না ভাবছিস!

গেরুর এখন কথায় ঢিলেঢালা চাল—কেইসে তু পারে? এ তো কাঠ বইয়ে দেয়ার কাজ না আছে। এ বহুত তন্তর—মন্তরের কাজ আছে, বহুত তন্তর—মন্তর লাগে।

নেলি গেরুর মুখের কাছে হাতটা ঘুরিয়ে আনল। হে রে, রাখ তোর তন্তর—মন্তর। হামি ভি বহুত তন্তর—মন্তর জানে।

লেকিন তাবিজ—ওবিজ লাগে নেলি। বাপ মেরে তিন তিনটা তাবিজ দিল। পুনঃপদের মাদুলি, মহাশক্তি কবচ বাণ, আউর মহাশক্তি কোমর বাণ। এ ঝাড়ফুক লয়, জাদুমন্তর লয়—এ আছে জড়িবুটির কারবার। দ্রব্যগুণ। ডান পুকুসে টান মেরে তোষক করে, পির পরিতে নজর দেয়, বাণ মোর এ—মাদুলি দেহে লিলে আসন পাবে দেহ। এ—তু কাঁহাসে লিবি আর কাঁহাসে দিবি।

গেরু কথাগুলো নেচে নেচে বলল—অনেকটা বাপ কৈলাসের মতো। কৈলাস যেমন করে কোর্ট—কাছারির ময়দানে একদা হেকিমি দানরির ব্যবসার সময় সকল মক্কেলদের তাবিজের গুণাগুণ ব্যাখ্যা করত, তেমনি গেরু আজ নেলিকে তাবিজের দ্রব্যগুণ ব্যাখ্যা করল।

নেলি এবার কাঁথা—কাপড় ছেড়ে উঠে বসল মাচানে। দু হাতের ওপর ভর করে বসল। চুলগুলো মুখের ওপর এসে পড়েছে। শরীরটা যেন ঝুঁকছে মাচারে বাইরে। যেন এখুনি টলে পড়বে শরীরটা। নেলি তবু বলল, হামারা কোনো জড়িবুটি লাগে না গেরু। লেকিন হামি মেয়েমানুষ লয় ত হাম ভি যেতরে মুর্দার কঙ্কাল তুলতে। চটানে ভুখা থেকে হামি নেহি মরগে। নেলি এ—সময় মুখটা ক্রমশ নিচের দিকে নুইয়ে দিচ্ছে।

তু ভুখা আছে নেলি! গেরু বল্লামটা নিচে রাখল। পাশাপাশি বসল সে। কিছুক্ষণ সে চুপ করে বসে থাকল। নেলিকে সে এ—চটানে আরও অনেকদিন ভুখা থাকতে দেখেছে, কিন্তু আজ যেন অন্যভাবে নেলির উপোসি শরীরটা দেখল। নেলি ভুখা আছে চটানে, এই ভেবে ওর খুব কষ্ট হতে থাকল। অথচ নেলিকে কিছু বলতে পারছে না এ—সময়ে। অন্য দিনের মতো নেলিকে জড়িয়ে ধরে কথা বলতে পারল না। কিংবা জড়িয়ে ধরতে ভয় হচ্ছে। সে সংশয়ের চোখে চারিদিকে একবার চেয়ে সহসা নেলির মুখটা তুলে ধরতেই দেখল, নেলি কাঁদছে! ভুখা থেকে নেলি আজ চটানে গেরুর সামনে কেঁদে দিল। —নেলি তু ভুখা আছে! পুনরাবৃত্তি করল গেরু। তারপর বল্লামটা তুলে চলে যাওয়ার সময় বলল হামার কাছে একটা পয়সা ভি নেই। থাকলে তুকে দিয়ে দিতাম। সাত সতের খেলে লখির কাছে সব পয়সা কটা হেরে গেছি।

গেরুর এসব কথা শুনে নেলি বিরক্তিতে ফেটে পড়ল। মনে মনে বলল, হেরে গেরু তু হামার বুঝি বাপ। তু পয়সা দিবি, সে পয়সায় হামি খেয়ে লিব! এই সব ভেবে নেলির নিজের মনেই সরম এল। গেরু ওর কে! গেরু ওর পাশে একটু বসতে পারল না! গেরু এ—সময় পয়সা নেই বলে, অথবা নেলি আরও কষ্টের কথা শুনাবে বলে চলে গেল! ছিঃ মরণ হামার? তু হামার কে! তু হামার বাপ আছে না বেটা আছে। তু হামার কোন আছে, তুর কাছে কেন্দে ভিখ লিব!

নেলি ফের শুয়ে পড়ল। এই ঘরে শুয়ে পুরোনো অশ্বত্থ ডালে কাকের শব্দ পেল। সে বুঝতে পারছে চোখ বুজে—সন্ধ্যা হতে দেরি নেই। এই সময়ে সব কাকেরা এই পুরোনো অশ্বত্থে ফিরে আসে। সে চোখ না খুলে বসুন্ধরার সব সুখ দুঃখকে বোঝবার চেষ্টা করল। তখন এল গেরু। সন্তর্পণে ফিরে এল। মরদের মতো সে ওর পাশে দাঁড়াল। বলল, দু—চারমাস তু সবুর কর। ফরাসডাঙার কায়দা—কানুন শিখেলি, তারপর তু আর হামি অন্য চটানে উঠে যাব। হয় কাটোয়ায় লয়তো নবাবগঞ্জে। তু আর তখন ভুখা থাকবিনে।

কাঁথা—কাপড়ের নিচে থেকে নেলি জবাব দিচ্ছে, দুদিন ভি হামার তর সইবে না। চটানে ভুখা থেকে হাম নেই মরেগে। কাঁথা—কাপড়ের আঁধারে নেলির বাঁচার ইচ্ছা একান্ত।

লেকিন হাম কিছু শিখলাম না, না দানরি, না হেকিমি। রাহুচণ্ডালের হাড় ভি নেই যে হেকিমি দানরি ব্যবসা করে খাব। বাপ লিয়ে যাচ্ছে আজ, এই পয়লা ফরাসডাঙায় মুর্দার কঙ্কাল তুলতে যাচ্ছি—বাপের ব্যবসা শিখে লিচ্ছি।

নেলির কপালে কতকগুলো রেখা ফুটে উঠল তখন। রেখাগুলো কপালের উপরেই নাচছে। মনে মনে সে যেন কোনো বাঁচার কৌশলকে আয়ত্ত করছে। সে কাঁথা—কাপড়ের ভিতর থেকে মুখ বার করে বলল, হাম ভি কিছু শিখে লিব, হাম ভি কিছু জরুর কামাব।

কাঁহাসে কামাবি?

ঘাটসে। ঘাটের ডাক দুখিয়ার। সেখানে বড় লোকের বেটির শরীর আগুনে খাচ্ছে। গহনা পুড়ছে। দুখিয়ার ডাক যখন, সব গহনা ও জরুর কয়লা ধুয়ে লেবে। যদি কিছু পড়ে থাকে, পহর রাতে হামি লিব।

নেলির কথা শুনে গেরু চোখ টান টান করল। বলল, তু একলা ভয় পাবিনে যেতে? তখন মড়া জ্বলবে না ঘাটে।

নেলি পাশ ফিরে শুল। বলল, কীসের ভয়! কিসকো ভয়!

লেকিন দশ লোক যদি দশ কথা বুলে?

বুলে বলবে। দশ লোক ত দশ কথা বুলছেই। বাপকে ওরা বুলছে রাতে নেলি কাঁহা ভাগে, তু নজর না রাখে গোমানি! মেয়েটা তুর দিন দিন ডাইনি বনে যাচ্ছে। তু বাপ হয়ে নজর না রাখে। খাটো কাপড়টা নেলির বুক থেকে সরে যাচ্ছিল—নেলি অন্যমনস্কভাবে কাপড়টা দিয়ে শরীরটা ঢেকে দিল। —দু রাত ধরে বাপ নজর রাখছে, হামি যেতে পেছি না কোথাও খেতে পেছি না কিছু। রোজ ভুখা থেকে মর গিলাম গেরু।

গেরু সেই কষ্ট ভাবটা মনে মনে অনুভব করতে পারছে। সে বলল, ফরাসডাঙায় যাবার সময় হয়ে গিল। কাল সবেরে আওগে। কাল সবেরে তু আর হাম জরুর খাওগে। এই বলে গেরু বল্লমটা তুলে নেলির ঘর থেকে নেমে চটানে অদৃশ্য হয়ে গেল।

নেলির কিছু করার নেই এখন। শুধু মাচানে বসে থাকা, বাপের জন্য অপেক্ষা করা। মাচানে বসেই সে হরিধ্বনি শুনতে পেল। বড়লোকের বেটারা মেয়েমানুষটাকে ঘাটে রেখে ঘরে ফিরে যাচ্ছে। পোড়া কয়লায় মেয়েটার শরীর পুড়ে ছাই হয়েছে। গহনাগুলো ছাই হয়নি। গহনাগুলো কয়লার সঙ্গে লেগে আছে। দুখিয়া হয়তো এখন নদী থেকে কলসি কলসি জল তুলছে। জল ঢালছে শ্মশানে। বালতিতে সব পোড়া কয়লা তুলে জলে ধুয়ে নিচ্ছে। সোনাদানা সংগ্রহ করছে। নেলির ইচ্ছা—অনেক ইচ্ছা এখন। বালতি থেকে কী করে সোনাদানা দুখিয়া তুলছে—সে দেখার ইচ্ছা। কিংবা গহনার দু—এক অণু চুরি করার ইচ্ছা। চুরি করে গহনা বেচে কিছু খাওয়ার ইচ্ছা। এতগুলো ইচ্ছার তাড়নায় সে জড়বৎ হয়ে বসে থাকল মাচানে। অথবা সে জানে ঘাটে গেলে দুখিয়া এবং ওর বৌ ওকে এ—সময় তেড়ে মারতে আসবে। ডোমের কোনো মেয়ে মরদকে সে এ—সময় ঘাটে নামতে দেবে না। সেজন্য মাচানে বসে থাকা ছাড়া কোনো গত্যন্তর থাকল না নেলির।

রাত নামছে চটানে। অশ্বত্থ গাছটার কাকগুলো শেষবারের মতো হইচই করে ডালে ডালে বসে গেল। গঙ্গার ঢাল থেকে শুয়োরের পাল নিয়ে ফিরে এসেছে বাবুচাঁদ। খোঁয়াড়ে শুয়োরগুলো ঢুকিয়ে দিয়ে সে ওর ছোট কুঠরিটায় ঢুকে গেল। ঘাটোয়ারিবাবু এ—সময় জপতপ নিয়ে বসেছেন অফিসঘরে। ঝাড়ো ডোমের ঘরে এখন সকলে পচাই খাচ্ছে। কৈলাসের ঘরে শেষ পক্ষের বৌটা পচাই গিলছে। গেরু এবং কৈলাস চলেছে—কাঁধে মদের ভাঁড়, হাতে বল্লম। ওরা চটান থেকে নেমে যাচ্ছে। ওরা ফরাসডাঙায় যাচ্ছে বেওয়ারিশ মড়ার তল্লাসে। অন্ধকার মাচানে শুয়ে নেলি সব ধরতে পারছে। নেলি জানে এ—সময়টাই একমাত্র সময় যখন চটানে পচাইর ঝাঁজ ওঠে। সে জানে চটানে এখন হৈ—হল্লা হবে। নাচনকোঁদন হবে। লখি, টুনুয়া পচাই গিলে মাতলামি করবে চটানে। ওরা এসে নেলির ঘরেও করতে পারে। কিংবা কৈলাসের শেষ পক্ষের বৌটার কাছে। লখি, টুনুয়া এখন হল্লা রসিকতা করবে। সিনেমার হালকা গান গাইবে। তখন কৈলাসের বৌটা পর্যন্ত মাতলামি করবে এইসব ভেবে নেলির ইচ্ছে হচ্ছে একটু পচাই গিলতে। বাপ এলে বাপের সঙ্গে একটু মাতলামি করতে। চটানের এমন পরিবেশে নেলির মনেও মাতলামির শখ জাগল।

প্রচণ্ড শীতের হাওয়া চটানের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। গায়ে শীত লাগতেই নেলির মনে হল কিছু পোড়াকাঠ এনে মাচানের নিচে রাখতে হবে এবং ভোররাতে যখন বাপ আর বেটিতে ঠান্ডায় কাঁথা—কাপড়ের নিচে ঘুম যেতে পারবে না, এবং বাপ খকখক করে কেবল কাশবে, তখন নেলি মাচানের পাশে পোড়াকাঠের আগুন জ্বালবে। সেজন্য নেলি ঘাট থেকে পোড়াকাঠ এনে উঠোনে রোজ তুলে রাখে, পোড়াকাঠে ভাত হয়, পোড়াকাঠের উত্তাপ নেয়। নেলি কিছু কাঠ তুলে আনার জন্যে মাচান থেকে উঠোনে নামল এবং পোড়াকাঠের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কাঠ কম কম মনে হচ্ছে। নেলির চোখ মুখ দুটোই জ্বলে উঠল, নেলির উপোসি দেহ থেকে গরল উঠতে থাকল, মর, মর—ঘাটে গিয়ে মর। হামার কাঠ ছুরি করে মরছিস ক্যানে! নেলি দুটো হাত উপরে তুলে সমস্ত দুনিয়াকে শাপ—শাপান্ত করতে থাকল—ডাক ঠাকুর, তু দেখে লে সব। তোর দুনিয়ায় হামি ভুখা আছি। হামার কাঠ চুরি করে লিছে। তুর কাছে নালিশ থাকল বাপ! তারপর নেলি কয়েকটা কাঠ ঘরে তুলল এবং মাচানের নিচে রেখে দিল। বলল, ভোর রাতে আগুন জ্বালব, ও ভি মানুষের সহ্য লয়।

নেলি শুয়োরের বাচ্চা দুটোকে খেদিয়ে খেদিয়ে ঘরে তুলল। পলো দিয়ে ওদের ঢেকে রাখল। টঙের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়ার আগে উঁকি মেরে দেখল সবগুলো ঢুকেছে কিনা। কাজগুলো সব শেষ করে নেলি লম্ফ জ্বালাল ঘরে। বাপ আভি তক এল না—মনে মনে এ কথাগুলো আওড়াল। বাপ এলে দুটো চাল দাল লিশ্চয়ই লিয়ে আসবে আজ—নেলি বাপের জন্য অপেক্ষা করতে থাকল। বাপ এলে দুটো ভাত ফুটিয়ে দেবে বাপকে, নিজেও দুটো খাবে। গঙ্গা যমুনাকেও ভাগ দেবে। শিবমন্দিরের পথটায় এসে নেলি এমন সবই ভাবছে তখন। গঙ্গা যমুনাও দু পাশে দাঁড়িয়ে গোমানি ডোমের অপেক্ষায় থাকল।

শিবমন্দিরের পথ ধরে বাবুদের মেয়েরা শরীরে ঠান্ডা মেখে ফিরছে। ওরা লাফাল। ওরা লাফিয়ে লাফিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। নেলি দেখল—দেখছে। সুখ, সুখ—সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। নেলিও এমন সুখের ইচ্ছায় লাফাতে চাইল। শরীর দিচ্ছে না। শরীর দিলে সে সত্যি যেন লাফাত। গঙ্গা যমুনাকে নিয়ে অন্যত্র চলে যেত। সুখের রাজত্বে কিংবা গেরুর জগতে। নেলি গঙ্গা যমুনাকে শুনিয়ে যেন বলল, গেরু হামার মরদ হবে। তখন তুরা ভুখা থাকবিনে। তুরা পেট ভরে খেতে পেলে নাচন—কোঁদন করতে পারবি বাবুদের বেটা—বেটির মতো। তুগো কোনো দুখ হাম রাখবে না। তুরা হামার বেটা—বেটির লাখান। সে কুকুর দুটোকে জড়িয়ে ধরল। আদর করল। সুখ জানাল।

তখন গোমানি ডোম ফিরছে। শিবমন্দিরের পথেই ফিরছে। আঁধার ঘন হয়ে উঠেছে এ পথটায়। গ্যাসপোস্টে আলো জ্বলছে। কোনো কোনো ঘরে হারমোনিয়াম বাজছে। ঘুঙুর বাজছে—নাচ গান হচ্ছে। হাসি—মস্করা, হালকা গান হচ্ছে। দু—একটা ঘাটের কুকুর নর্দমার ময়লা খাচ্ছে। তখন কিছু কিছু লোক গলি পথে হারিয়ে যাচ্ছে। ওদের পরনে, ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি। দুটো একটা মানুষ প্যান্ট পরে আলো আঁধারের দিকে হাঁটছে। তখন গোমানি ফিরছে টলতে টলতে। গালাগাল দিচ্ছে এই পথের বাসিন্দাদের। মুখে যা এল তাই বলে খিস্তি করল। শেষে একটা হালকা গানের সুর গলা বেয়ে উঠতে থাকল। নেলি বুঝল, গঙ্গা যমুনা বুঝল—বাপ চটানে ফিরছে।

গোমানি বলল, কোনরে? গঙ্গা যমুনা? নেলি?

নেলি বাপকে দেখে দাঁড়াল। গঙ্গা যমুনাও দাঁড়াল। গোমানি টলতে টলতে ফিরছে। —তুরা ইখানে বসে?

নেলি দেখল বাপের হাত খালি—কাঁধ খালি। গামছায় একটা ছোট্ট পুঁটলি ঝুলছে। নেলির জানতে বাকি নেই পুঁটলিতে কী আছে। রাগে দুঃখে নেলি কোনো কথা বলতে পারল না। বাপ খালি পেটে আজও মদ গিলে এসেছে। এই সব দেখে নেলি অত্যন্ত ক্লান্ত গলায় বলল, আ যা বাপ!

হরীতকীর ঘরের সামনে আসতেই গোমানি দাঁড়িয়ে পড়ল। ভোরের সব কথাগুলো ওর মনে পড়ছে—হরীতকী ভোরে ওকে গালমন্দ দিয়েছে। বলেছে, গোমানি, তুমি একটা বাপই বটে! গোমানি হরীতকীর বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে খিস্তি করার আগে সামান্য হাঁটু দুটো একটু সামনের দিকে, কোমরটা একটু পিছনের দিকে দিয়ে দু পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়াল। সে দাঁড়াতে পারছে না, তবু জোর করে দাঁড়াল। মাঝে মাঝে বড় বড় হাই তুলছে। সে যেন কী ভাবল—যেন কী বলতে হবে। যেন—তার মনে পড়ছে না। বিরক্তিতে সে পা দুটোকে বেতো রুগির মতো কয়েক বার কাঁপাল। কয়েক বার ভাঁটা ভাঁটা চোখ দিয়ে আশেপাশে কিছু খুঁজল যেন। তারপরই সব ঘটনাটা মনে পড়ায় বলল, মাগি জাত একটা জাত—ওয়ার আবার স্বভাব, ওয়ার আবার ধম্ম! মাগির বাচ্চা হয়েছে শ্মশানে—হবে না! মাগির নেই জাতের ভয়, নেই ধম্মের ভয়—চতুরাকে মদ খাইয়ে খুন করলে। ও শ্মশানে বাচ্চা বিয়োবে না ত হাসপাতালে বিয়োবে। যে খিস্তিটা ভোর থেকে মনে মনে গোমানি ডোম আওড়াচ্ছিল—মদ খেতে পেয়ে সে সবটা এবার উগরে দিল! —থু! এতেও শান্তি নেই, গোমানি হরীতকীর দরজার ওপর থুথু ছিটাল।

এই সব দেখে নেলি বাপের কাছে ছুটে গেল। সে বাপের হাত ধরে টানছে। এমনি হয়তো পিসি দরজা খুলে বের হয়ে অনর্থ বাধাবে। বাপের চুল ধরে টানবে। বাপের শুকনো দেহটা নিয়ে টানা—হ্যাঁচড়া করবে। বাপ হয়তো না পেরে পিসির পা কামড়ে ধরবে। বাপকে তাই টেনে নিয়ে যেতে যেতে ধমক দিল, বাপ, ফের তু ভুখা থেকে মদ গিলেছিস! ইসপিরিট খাচ্ছিস!

হে মদ গিলেছি ত! ইসপিরিট খাচ্ছি ত! গোমানি এবার জোর করে হাতটা নেলির হাত থেকে টেনে নিল!

ভুখা থেকে ইসপিরিট খেলে যে মরবি বাপ!

হাম মরোগে তু বুলছিস? হাম বাঁচোগে নেই!

হে তু মরোগে বাপ!

হাম নেহি মরোগে, নেহি মরোগে। তু মরবে নেলি। রাগে চোখ দুটো চিংড়ি মাছের মতো বাইরে বের হয়ে পড়তে চাইল। —গোমানি মরোগে! কোন বুলবে এ কথা। গোমানি নেলির পেটে লাথি বসিয়ে দিল। তারপর বলল, কোন শালে বুলবে একথা গোমানি মরোগে!

নেলির ইচ্ছা হল এই মুহূর্তে ঘাটের পোড়া কাঠ তুলে বাপের মাথায় বাড়ি মারে। ইচ্ছে হল বাপকে চেপে ধরে মাটিতে। কিন্তু বাপ তখন এত বড় বড় হাই তুলছে এবং বাপের পেটটা এত বেশি নিচে নেমে গেছে যে সে সব দেখে ওর ইচ্ছাগুলোর রঙ অন্যরকম হয়ে যেতে বাধ্য হল। সে অন্যরকম জবাব দিল, হাসপাতালে খুনের লাশ কেটে তু ভি নরক হলি বাপ। খালি পেটে তু হামারে লাথি মারলি? এ আচ্ছা কাজ হল তুর!

গোমানি টলতে টলতে নেলির সাপের মতো বাঁকানো শরীরটা দেখল। যেন ফুলন আবার চটানে ফিরে এয়েছে। যেন নেলি ফুলনের মতোই শাসন করছে বাপকে। গোমানি এবার কাছে এগিয়ে ধরতে চাইল নেলিকে, কিন্তু পা দুটো টলছে বলে এগোতে পারছে না। সে এবার দু পায়ের ওপর শক্ত হয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করল। এবং নেলিকে দেখে দেখে সে তার স্ত্রীর কথা ভাবল। স্ত্রীর কথা রোজ এইসময় তার মনে হওয়া মাত্র সে ঝিমিয়ে আসে। নেলি আজ ওর মার মতোই যেন বললে, হাসপাতালের লাশ কেটে তু ভি মরক হলি। গোমানি এইসব ভেবে দাঁড়াতে পারছে না। সে ঘরের মেঝেতে বসে পড়ল। সেই ফুলনের চোখ দুটো নেলির চোখে, নাক, সেই মুখ, সেই গড়ন। নেলির পেটে লাথি মেরে সে এখন খুব দুঃখ পাচ্ছে। গলার গামছা নিচে রাখল। পুঁটলি খুলল। গামছার পুঁটলিতে স্পিরিটের বোতল, কিছু চালভাজা, কিছু পেঁয়াজি।

গোমানি কাঁপা হাতে চাল ভাজা এবং পেঁয়াজিগুলো নাড়তে থাকল। নেলির দিকে চেয়ে বলল, নেলি তুর মায়ী কী বুলত, তু তখন ছোট, খুব ছোট। বুলত খুনের লাশ কেটে তু ভি নরক হলি। বুলত কত কথা, কত তরাস তখন তুর মায়ীর।

গোমানির মাথার ভিতর ঘোরদৌড় হচ্ছে। সে জন্য সে বেশিক্ষণ ফুলনকে মনে রাখতে পারল না। সে এসময়ে নেলিকে পেঁয়াজি এবং চালভাজার সঙ্গে বোতলটা এগিয়ে দিল। —দ্যাখ, তুর লাগি কী লিয়ে এয়েছি। খা, খা। দুটো খেয়ে লে। কিন্তু নেলি খেল না বলে গোমানি বিরক্ত হয়ে চড়া গলায় হেঁকে উঠল, লে আও, লে আও বুলছি মাটির গেলাস। মদ খানেসে দুনিয়া ঠান্ডা হোতা হ্যায়, আওর তু ত নেলি।

নেলি বাপের কথায় জবাব দিল না। এমনকি বাপের দিকে মুখ তুলে তাকাল না পর্যন্ত। একমুঠো চালভাজা, দুটো পেঁয়াজি তুলে নিল। ওগুলো খেয়ে এক মালসা জল খেয়ে বাপের কাছে এল ফের। বলল, মাচানে চল, ঘুমোবি।

নেলির মিষ্টি কথায় গোমানি খুব খুশি হল। মাথার ভিতর ঘোরদৌড়টা এখনও টগবগ করে ফুটছে। সে বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে উঠল—নেলি, তু বেড়ে কথা বুলেছিস। হামি বাঁচোগে নেই। তুর মাভি বুলত হামি বাঁচোগে নেই। লেকিন মা শীতলার কৃপায় তুর মায়ী জলদি জলদি পার পেল। তুকেও কৃপা করেছিল, লেকিন তু বেঁচে গেলি। একটু হেসে গোমানি কিছু মনে করার যেন চেষ্টা করল। তারপর বলতে থাকল—তা তু বুলতে পারিস হামি ইসপিরিট খাই ক্যানে, তুকে ভুখা রাখি ক্যানে, হামি থাকি ক্যানে, সব বুলতে পারিস। লেকিন বাত কী আছে তু জানে, খুনের লাশ, গলায় দড়ির লাশ, সকল লাশের পেট মাথা চিরে হামার মাথা ঠিক থাকে নারে, মাথাটা হামার গরম হয়ে উঠে। হামি পাগল বনে যাই। মদ খানেসে দেমাক ঠান্ডা হয়ে যায়। মদ পিনেসে দুনিয়া ঠান্ডা হোতা হ্যায়, আওর তু ত নেলি। খা, খা লে। স্পিরিটের বোতলটা গোমানি নেলির মুখের সামনে তুলে ধরল।

বাপ, বাপ, আর পারিনে! নেলি কান্না—কান্না গলায় চিৎকার করে উঠল। —তু আর বাপ জ্বালাসনে। নেলি গোমানির হাত ধরে টানতে থাকল। চটানের সব লোক তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। একমাত্র ঝাড়োর বৌ জেগে। বাঁশের পাতি তুলছে বসে বসে। ঘরে একটা লম্ফ জ্বলছে। নেলি এসময় বাপকে কোলে তুলে নিল। বলল, আ যা বাপ, তু আর জ্বালাসনে, হামার বহুত নিদ আতা বাপ। নেলি বাপকে তুলে মাচানে শুইয়ে দিল, এবং কাঁথা—কাপড় দিয়ে ঢেকে জোরে চেপে রাখল বাপের শরীরটাকে। ঠান্ডায় গোমানির শরীরটা বরফ হয়ে ছিল, এখন উত্তাপ সঞ্চার হচ্ছে।

রাত ঘন হচ্ছে। গভীর হচ্ছে।

বাপের পাশে শুয়ে রয়েছে নেলি। ওর ঘুম আসছে না।

আসবে না। শ্মশানের সব ছবিটা সে দেখতে পাচ্ছে। কটা কুকুর কয়েকটা কচ্ছপ ঘোরাফেরা করছে সেখানে। কয়েকটা শেয়ালের আর্তনাদ অথবা ইতস্তত জোনাকির আলো। রাত যত ঘন হবে জোনাকির আলো তত বেশি ভূতুড়ে মনে হবে, তত বেশি শরীরটা ছমছম করবে। অথচ নেলি ভয় পাওয়ার মতো করে হাঁটবে না। কিংবা ওকে দেখে মনে হবে না যে সে কোনো ভয় পাচ্ছে। বরং ওকে দেখলেই ভয় পাওয়ার কথা। কুকুর দুটোর জ্বলন্ত চোখ দেখে ভয় পাওয়ার কথা!

প্রথম দিকে দু একবার গোমানি জোর করে উঠে বসবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু নেলি উঠতে দেয়নি। জোর করে চেপে রেখেছে। কাঁথা চেপে গোমানির ওপর বসে রয়েছে। এখন গোমানি হাঁ করে ঘুমোচ্ছে। নেলি লম্ফর আলোটা তুলে আনল। বাপের মুখ দেখল। মুখ ভয়ানক কুৎসিত—মুখে কূট গন্ধ। ভিতরের দুটো কষ্টি কালো দাঁত শ্বাসের সঙ্গে নড়ছে। আরও ভিতরের আলজিবটা সে দেখতে পেল। আলজিবটা নড়ছে না—সুতরাং বাপ প্রচণ্ড ঘুমোচ্ছে। মুখের ভিতরটা স্পিরিট খেয়ে খেয়ে কালো হয়ে গেছে। যেন ভোঁতা হয়ে গেছে। বাপের জন্য নেলির অদ্ভুত রকমের কষ্ট হতে থাকল।

মাচান থেকে নেলি সন্তর্পণে নামল। মেঝেতে গঙ্গা যমুনা মুখ গুঁজে পড়েছিল। জ্বলজ্বলে দুটো চোখ দিয়ে ওরা ওকে দেখল। নেলি ইশারা করলে চুপি চুপি ওরা উঠে এল। চুপি চুপি ওরা উঠোনে নামল। উঠোনে দুটো মালসা—কবুতরগুলো মালসায় জল খায় বিকেলে। সে মালসা দুটো হাতে নিল। একটা পোড়া হাঁড়ি নিল। নেলির চোখে দুঃসহ সংশয়। ভয়, দুখিয়া বেড়ার ফাঁক দিয়ে ওকে দেখে চিৎকার করে না ওঠে। চিৎকার করে না বলে—ডাইনি মাগি কাঁহা যাচ্ছে দ্যাখ। সে উঠোনের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ভালোভাবে সব দেখে নিল। কেউ জেগে নেই। কেউ না। এমনকি ঝাড়োর বৌ পর্যন্ত ঘুমিয়ে পড়েছে। একমাত্র ঘাটোয়ারিবাবুর ঘরে আলো জ্বলছে। এত রাতেও ঘাটোয়ারিবাবু জানালার ধারে বসে রয়েছেন, চেয়ারে বসে কিছু যেন করছেন না—অথচ বসে আছেন। নেলি কুকুর দুটোকে ফের ইশারা করলে! শিবমন্দিরের এবং বাবলার ঘন বন পার হয়ে সে ধীরে ধীরে শ্মশানের চালা ঘরটায় হাজির হল! এখানে সারারাত লন্ঠন জ্বলে। ঘাটোয়ারিবাবু জ্বালিয়ে দেন। বৃষ্টি—বাদলার রাতে আলো নিভে যায়। শীতের রাতে হাওয়া খুব না থাকলে নিবু—নিবু করে সারারাত জ্বলে। শ্মশানকে আরও ভয়াবহ করে তোলে। নেলি সেই হারিকেনটা খুলে নিল এবং পলতেটা বাড়িয়ে গঙ্গার ঢালে নেমে গেল।

দুখিয়ার বৌ ঘরে ধড়ফড় করে উঠে বসল। ওর ঘরটা চটানের শেষ মাথায়। শিবমন্দিরের পথে নামতে সে দেখল যেন, স্পষ্ট দেখল যেন, নেলি চটান থেকে নেমে গেল। নেলির কুকুর দুটোও। মংলি তাড়াতাড়ি দুখিয়াকে ঠেলে তুলে দিল। বলল, দ্যাখ, দ্যাখ ডাইনি মাগি আঁধার রেতে পালাচ্ছে।

দুখিয়া উঠে প্রথমেই হারিকেনের আলোটা উসকে দিল। হারিকেনটা নিয়ে ধীরে ধীরে বাইরে এসে দাঁড়াল। হারিকেনটা উপরে তুলে নেলি কাছে কোথাও আছে কিনা দেখল। না দেখে সে হাজির হল গোমানির ঘরে। গোমানি নাক ডাকিয়ে ঘুমচ্ছে—বেটা হাড় হাভাতে! দুখিয়া গাল দিল মনে মনে। —বেটা ইসপিরিট খোর। প্রথমে সে মাচানের কাছে গিয়ে নাড়া দিল—গোমানি গোমানি, অঃ গোমানি! হারে উঠ। উঠে তামাশা দেখে লে। জোয়ান বেটির তামাশা। বেটি ত তর ভাগলবারে। তুর বেটির ঘাড়ে ভূত সোয়ার হো গিয়ারে গোমানি! বেটি তুর ডাইনি বন গিয়া।

গোমানি কাঁথা—কাপড় ঠেলে উঠে বসল। কিন্তু ব্যাপারটা ধরতে পারছে না। মাথাটা এখনও ঝিমঝিম করছে। এখনও শরীরটা ক্লান্ত, ভারী—ভারী। কে কী বলছে ঠিকমতো শুনতে পাচ্ছে না—বুঝতে পারছে না। সুতরাং সে ফ্যালফ্যাল করে দুখিয়ার দিকে চেয়ে থাকল।

হামারে দেখে তুর হবেটা কী? নেলি আঁধার রাতে কাঁহা গ্যাল দ্যাখ। দু চারঠো আখেরের কাজ কাম কর।

কাঁহা গ্যাল।

কাঁহা ভি গ্যাল।

তু না জানিস?

হাম না জানে?

চটানের কৈ না জানে?

দুখিয়া ঠোঁট উলটে বিদ্রূপ করল, কোন জানে!

গোমানি এবার মরিয়া হয়ে ডাকতে থাকল, হরীতকী, হরীতকী!

হরীতকী শুয়েছিল। ঘুমিয়েছিল। গোমানির চিৎকারে সে জাগল। বসল এবং দুয়ার খুলে বের হয়ে দেখল দুখিয়া, ওর বৌ মংলি এবং গোমানি চটানে হইচই বাধিয়ে দিয়েছে। হরীতকীকে দেখে গোমানি ওর কাছে ছুটে গেল। বলল, তু জানে নেলি এ—আঁধার রাতে কাঁহা গ্যাল? জানে তু?

হাম না জানে গোমানি।

তু না জানে, দুখিয়া না জানে, কৈ না জানে, তব কোন জানে? কোন!

গোমানির মাথায় এখন আর তেমন ঘোড়দৌড় হচ্ছে না। এতক্ষণে শরীরটা হালকা বোধ হচ্ছে যেন। তবু সে জোরে কথা বলতে পারল না। শরীর দুর্বল। সে বুঝতে পারল—সে কত অসহায়। এজন্য দুখিয়া, হরীতকীর দিকে চেয়ে নেলির অনুসন্ধানের প্রত্যাশা করল। যদি ওরা কিছু বলতে পারে, অথবা ঢুঁড়ে এসে খবর দেয় নেলিকে পাওয়া গেছে, নেলি মালসা করে ডাল, ভাত, মাছ, মাংস আনতে যায়নি। যদি ওরা বলে নেলির ভিতর ডাইনি হওয়ার মতো লক্ষণ আপাতত প্রকাশ হচ্ছে না। যদি বলে নেলিকে পাওয়া গেছে—তু চিন্তা না করে গোমানি। কিন্তু ওরা নড়ল না, কিছু বলল না। ওরা দাঁড়িয়ে থেকে গোমানির অথর্ব শরীরটা দেখল শুধু।

এতটা অথর্ব বুঝেই দুখিয়া বলতে বুঝি সাহস করল, হামি ত তুর বেটির জন্য পাহারাদার না আছে। তুর বেটি কাঁহা গ্যাল ও হামাদের বুলতেই হবে। বেটি তুর আচ্ছা লয় গোমানি। ওকে থোড়া সমজে রাখ।

উঠোনের অন্যপাশ থেকে মংলি বলল, তু দুখি, চলে আয়। গোমানির বেটি আঁধার রেতে কাঁহা গেছে ও গোমানি বুঝবে। তু ওকে ভালাই করিস ত ও বুঝবে মন্দ। লয়ত ওয়ার বেটি রাতে কাঁহাসে ভাত দাল মাছ মাংস লিয়ে আসে। —এক দফে ও বুলবে না ওয়াকে। হাপুস হাপুস শুধু গিলবে।

ও বাত ঠিক লয় বৌ, গোমানির বেটি মন্দ কাজ করে বেড়াবে, পহর রাতে ডাইনি সেজে ঘোরাঘোরি করবে, ও কথা ঠিক লয়। চটানে ঝাড়ো ডোম আছে, সর্দার আছে, ঘাটোয়ারিবাবু আছে, পাঁচজনার পাশ জরুর নালিশ দিতে হবে। হয় গোমানি থাকবে চটানে, লয় তো হামি থাকবে। চটানে দিন দিন বেজাত অজাত হয়ে উঠছে। বহুত বেইমানি আচ্ছা লয় গোমানি।

গোমানির মন পাথরের মতো ভারী হয়ে উঠছে। হাসপাতালের খুনের লাশ কাটার সময় যেমন সে ক্রমশ নিষ্ঠুর হয়ে উঠত, সে এখন সেরকম নৃশংস। চোখ দুটো ফের চিংড়ি মাছের মতো ঝুলে পড়তে চাইল মুখ থেকে। সে দুখিয়ার মুখের ওপর গিয়ে ফেটে পড়ল, বেইমানি কোন কিয়া? হাম!

না, তেরে বেটি। হারামি আছে ও। হামার বেটি হোত তু।

জবাই করতি।

জরুর।

হাম ভি করে জবাই। যেন নেলিকে জবাই করে চটানে সসম্মানে বেঁচে থাকা গোমানির একমাত্র পথ। নেলির জন্যই যেন সে এত ছোট হয়ে গেছে। এত দুর্বল হয়ে আছে চটানে। এবং নেলিকে জবাই করলে চটানের সকলে যদি খুশি হয়—তবে আজ সে তাই করবে। তাই করে সকলকে খুশি করবে। এই ধরনের কিছু ভাব গোমানির মনে বারবার চাপ দিচ্ছে। সে মাচানের নিচে থেকে দা—টা খুঁজে বের করল এবং দুখিয়ার সামনে গিয়ে জবাই—এর কসরত দেখাল। তারপর চিৎকার করে উঠল—নেলিরে, তু আজ চটানে জবাই হ যাবি।

ঘাটোয়ারিবাবুর ঘুম আসছিল না। তিনি ঘুমোতে পারছিলেন না, শরীরে কম্বল জড়িয়ে চেয়ারে বসে ছিলেন। বসে থাকতে থাকতে কখন একটু ঘুম লেগে এসেছিল টের পান নি। গোমানির উৎকট চিৎকারে তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। তিনি ঘুমোলেন না। তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। গঙ্গাপুত্তুরের দল ঘোর হামলা বাধিয়েছে। ফের চটানে খুনোখুনি আরম্ভ হয়েছে। তিনি জানেন এইসব লোকেরা সমস্ত রাত আর তাকে ঘুমোতে দেবে না। গালমন্দ, খিস্তি, হামলা, মারধোর তিনি না গেলে সারারাত ধরে চলতে থাকবে। সেজন্য কম্বল গায়ে খড়ম পায়ে তিনি চটানে নেমে গেলেন।

ঘাটোয়ারিবাবু চটানে ঢুকেই ধমকে উঠলেন গোমানিকে, এই শুয়োরের বাচ্চা হারামজাদা গঙ্গাপুত্তুরের দল, তোদের জন্যে রাতে ঘুম যেতে পারব না পর্যন্ত। তোদের দিনরাত খুনোখুনি লেগেই আছে। এ কিরে বাবা! এ যেন হনুমানের রাজত্ব। বেটারা সব হনুমানের দালাল দেখছি। কী হচ্ছে এইসব। হৈ—হল্লা চিৎকার! এই শুয়োরের বাচ্চা গোমানি, কাকে খুন করবি—তোর কোন শত্রুকে?

ঘাটোয়ারিবাবুকে দেখেই গোমানি কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়ল। খুন হো যাবি, জবাই হো যাবি বলে আর চিৎকার করল না। এখন সে যথেষ্ট ভালো মানুষ। এখন সে চটানের কোনো ঘটনারই সাক্ষী হিসাবে থাকতে যেন নারাজ। কিছু ঘটেছে যেন এও মিথ্যা। কিন্তু ঘাটোয়ারিবাবু ঘরে উঠে এলে খুব বিষণ্ণ গলায় বলল, বাবু, নেলি চটানসে ভেগে গেল আঁধার রেতে। বাবু, হামি কী করব? মেয়েটা হামাকে ফাঁকি দিল বাবু।

গোমানির শরীরটার দিকে চেয়ে ঘাটোয়ারিবাবুর মনটা ভিজে উঠল। তিনি বললেন, ও তো প্রায় রাতেই যায় রে! আজ প্রথম গেল ভাবছিস!

গোমানি দা—টা মাচানের নিচে রেখে দিল। —লেকিন কাঁহা যায় হাম ত না জানে বাবু!

ঘাটোয়ারিবাবু এখন উপদেশ দেওয়ার মতো করে কথা বলছেন। —তবে চুপ করে থাক। চুপ করে শুয়ে থাক। খুনোখুনি করবি কাকে? খুন ত বেটা তুই নিজেই হয়ে আছিস। মদ খেয়ে দিনরাত পড়ে থাকবি, মেয়েটাকে খেতে দিবিনে। মা—মরা মেয়েটা সারা দিন রাত খেতে না পেয়ে এঘর—ওঘর করবে, না খেতে পেয়ে মেয়েটা কাঁদবে—আর আঁধার রাতে ভেগে গেল ত হুঁশ হল—মেয়েটা কাঁহা যায় হাম ত না জানে বাবু। শালা শুয়োর—হারামজাদা গঙ্গাপুত্তুর! শুয়ে থাক হনুমানের দালাল কোথাকার! শেষে তিনি দুখিয়ার দিকে চেয়ে বললেন, এই দুখিয়া, বেটা সুদখোর, তুই আবার এখানে কেন?

ভয়ে ভয়ে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল মংলি। দুখিয়া আমতা আমতা করতে থাকল প্রথমে, পরে কিছু বলার চেষ্টা করল। কিন্তু ঘাটোয়ারিবাবুর চোখের দিকে চেয়ে কিছু বলতে সাহস করল না। হরীতকী তখন দুখিয়ার দিকে আড়ে ঠারে চাইল। ব্যঙ্গ করল। রসিকতা করতে চাইল—জানে না বাবু উইত উবকার করতে এল নেলির।

হো উবকার করতে চেয়েছে। একটা তির্যক গলা ভেসে আসছে দুখিয়ার ঘর থেকে। মংলি ঘরে বসে হরীতকীকে উপলক্ষ্য করে কথাগুলো বলছে। ঘরে বসে বসেই হাত—পা নাড়ছে এবং চোখমুখ টেনে হরীতকীর জবাব দিচ্ছে।

দুখিয়া ভালোমানুষের মতো কথা বলল এবার। —শুয়ে পড় গোমানি। কী আর করবি—সব নসিব। কাঁহাতক আর বসে থাকবি বেটির লাগি—শুয়ে পড়। বেটি তুর কামাই করে ফিরতে বহুত রাত হবে। যেন দুখিয়া এখন কত ভালোমানুষ হয়ে গেছে, যেন গোমানির দুঃখে সে খুব কষ্ট পাচ্ছে। গোমানির মেয়েটা ফিরতে রাত হবে বলে যেন ওরও ঘুমোবার অসুবিধা। সে এবার ঘাটোয়ারিবাবুর দিকে চেয়ে বলল, কী বাবু, হামি ঠিক বুলছি না, ও এখন শুয়ে পড়ুক।

ঘাটোয়ারিবাবু কোনো জবাব দিতে পারলেন না দুখিয়াকে। নেলির কামাই করে ফিরতে রাত হবে কথাটা দুখিয়ার গলায় নষ্ট ঠেকল। তিনি হরীতকীর দিকে চাইলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে অন্য মানুষ হয়ে কী এক অন্য ভাবনার ভিতর ডুবে চটান থেকে উঠে গেলেন। দুখিয়া এ—সব দেখে হাসল। হরীতকীর দিকে চেয়ে চোখ টানল। তারপর বেশ বড় বড় পা ফেলে নিজের ঘরের দিকে যাওয়ার সময় বলল—তুর মেয়েটা চটানে দিন দিন ডাইনি বনে যাচ্ছে। ও কী হরীতকীর লাখান একটা বাচ্চা দিয়ে লিবে চটানে। গোমানিকে উদ্দেশ করে কথাগুলো বলল দুখিয়া। গোমানি শুনল। চোখ তুলে হরীতকীকে দেখে বড় বড় পা ফেলে সেও ঘরে ঢুকে গেল। যেন হরীতকীকেই ওরা সবাই শাসন করে গেল—নেলিকে নয়।

হরীতকীর তখন ইচ্ছে হল বলতে, হে দিয়েছি ত, হে দি লিছি বাচ্চা। তেরে বহুকা মাফিক হামি কী পোড়াকাঠ যে আগুন দিলে ভি জ্বলবে না। তাজা কাঠ আছি—আগুন গিলেছি, বাচ্চা দে লিছি। এ—লাজ না খোঁটার কথা আছে। হরীতকী, মংলিকে উদ্দেশ করে সারারাত ধরে গালমন্দ দেওয়ার কথা ভাবল। কিন্তু কিছু বলল না। এই নিশুতি রাতে চিল্লাতে শুরু করলে ফের ঘাটোয়ারিবাবু ছুটে আসবেন এবং তিনি দুখিয়া—মংলির এমন সব ইশারাতে সরম পাবেন। সেইজন্যই আঁধার রাতে কোনো গরল না ঢেলে হরীতকী নিজের ঘরে গিয়ে বাচ্চাকে চেপে ধরল এবং সমস্ত দুঃখ ভুলে আদর করল, শনিয়া, তু মেরে লাল।

কাঁথা—কাপড়ে শরীর ঢেকে গোমানি বেশিক্ষণ মাচানে বসে থাকতে পারল না। লম্ফটা দুবার দপদপ করে জ্বলে শেষে নিভে গেল। ঘরটা অন্ধকার হয়ে উঠল। গলা বেয়ে ফের কাশি উঠছে। খকখক করে ক’বার কেশে সে উপুড় হয়ে শুল। হেঁপো রুগির মতো কিছু কাঁথা বালিশ এনে বুকের নিচে ঠেসে দিল। কাশি দম বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করল। মাঝে মাঝে কোনো শব্দ হলেই কাঁথা—কাপড় থেকে মুখ বের করে দেখল—নেলি এসেছে কিনা! এল না! নিচে বাচ্চা শুয়োর দুটোর শব্দ। ফের মুখ বের করল—নেলি আসেনি। নিচে অথবা টং—এ কবুতরের শব্দ। এ—আঁধার রাতে নেলি কোথায় গেল! কাঁহা গেল মেয়েটা। ওর কষ্ট হতে থাকল। এ—সময় ওর ফুলনের ওপর রাগ হল। ফুলনের মৃত্যুর উপর। ফুলন মরে খুব অপরাধ করেছে এমন একটা ভাব কাজ করছে ওর মনে। ফুলন বেঁচে থাকলে এসব হাঙ্গামা ওকে পোয়াতে হত না। এইজন্য সে মাঝে মাঝে মেয়ে এবং মার ওপর খুব রেগে উঠছিল। তখন গোমানির চোখে মুখে কেমন বেপরোয়া ভাব। চোখ দুটো আঁধারেও কেমন ঘোলা ঘোলা। নেলি ফিরছে না—বড় কষ্ট হচ্ছে ওর। চটানে নিশুতি রাত নেমেছে। বরফের মতো ঠান্ডা নেমেছে। নেলি এই ঠান্ডায়, এই শীতে কিনা জানি করছে! চটানে এখন আর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। শ্যাওড়া গাছে ঝিঁঝিপোকা ডাকছে। ঘাটে মড়া নেই। দূরে কয়েকটা কুকুর আর্তনাদ করছে। সে অনেকগুলো শেয়ালের ডাক শুনল বাবলার ঘন বনে। শীতের ঠান্ডায় মুরগিগুলো ডিমে তা দিতে দিতে চিৎকার করছে কৈলাসের ঘরে। কৈলাসের ঘরে ওর তৃতীয় পক্ষের বৌটা একা। বৌটা মদ খেয়ে পেট ঢাক করে চিত হয়ে ঘুমোচ্ছে। শুয়ে শুয়ে এটা সে আন্দাজ করল। এ—সময়ই উঠে পড়ে নেলিকে ঢুঁড়তে যাওয়ার ইচ্ছা হল গোমানির। এক ফাঁকে একটা নজর দিয়ে আসবে কৈলাসের ঘরে এই ওর বাসনা। অথচ উঠতে গিয়ে দেখছে শরীরটা ওর যেন পাথর হয়ে গেছে।

ঘাটোয়ারিবাবু যখন চটানে নেমেছিলেন, নেলি তখন গঙ্গার ঢালু বেয়ে নামছিল। গঙ্গা যমুনা আগে আগে যাচ্ছিল। ওরা ঘেউঘেউ করছে। বাবলার ঘন বনে কটা শেয়াল ডাকছে সেজন্য। গঙ্গা যমুনা মাটির গন্ধ নিতে নিতে নিচে গিয়ে নামল।

নেলি সেই তাজা চিতাটা খুঁজছে। খুঁজে বের করবার চেষ্টা করছে। এখানে ইতস্তত কাঠ, কয়লা, ভাঙা কলসি, ছেঁড়া তোশক, বালিশের তুলো মাটির সঙ্গে মিলেমিশে আছে। নেলি ওগুলোর ওপর দিয়েই হেঁটে গেল। হারিকেনের আলোয় সে ঠিক ধরতে পারছে না কোথায় তাজা চিতাটাকে সে রেখে এল। সে খুঁজছে। খুঁজছে। নদীর বালিয়াড়িতে সে এসে নামল। একটা কাঁচা বাঁশ দেখল। নদীর চরে বাঁশটা এখনও পোঁতা আছে। সে বুঝল কচ্ছপেরা এখনও এসে এখানে ভেড়েনি। সে তাড়াতাড়ি বাঁশটা তুলে আনল জল থেকে এবং বাঁশের ডগায় মাংসপিণ্ডটাকে দু’ভাগ করে গঙ্গা যমুনাকে খাওয়াল। তারপর ফের গঙ্গার ঢালু বেয়ে উপরে উঠে সেই তাজা চিতাটাকে খোঁজা—যেখানে দুখিয়ার নসিব খুলেছে।

এই ভর নিশুতি রাতে প্রেতের মতো দুটো কুকুরকে নিয়ে নেলি তাজা চিতাটা খুঁজছে। নেলির মনে হল তখন কে যেন দূরে শহরের দিকে ছুটছে। নেলি হাসল—ভয় পেয়ে এমন হয়। নেলি তারপরই চিতাটা খুঁজে পেল। এ—সময় নেলির মনটা আনন্দে ভরে গেল। ভয়ানক আনন্দে সে পুলকিত হল। আঁধার রাতে আকাশটায় কত নক্ষত্র, আর এই নিচের পৃথিবীতে কত সুখ—দুঃখ। কত বেদনা। নেলি এমন করে ভাবতে জানে না—কিন্তু মনের ভিতর গহনা পাওয়ার আশা এবং এই সুখানুভূতি ওর অনুভবে ঘা দিচ্ছে এবং তারই প্রকাশ যেন আকাশটায় অনেক নক্ষত্রের নিচে পৃথিবীর অনেক সুখ—দুঃখের মতো।

সে আশার ডিমে তা দিচ্ছে। আহা কাল সে খাবে, কাল সে পেট ভরে ভাত দিয়ে লিবে বাপকে। আহা গঙ্গা যমুনারে! নেলি এখন এই ‘আহা’র জগৎ ধরে দুখিয়ার ধোওয়া কয়লাগুলো হাঁড়িতে ভরছে, জলে ধুয়ে নিচ্ছে—এই ‘আহা’র জগৎ ধরে জল ফেলে দিয়ে কয়লার তলানি খুঁজছে। লন্ঠনের আলোয় তলানি দেখার আগে উত্তেজনায় অধীর হচ্ছে। চোখে মুখে কত সুখের উত্তেজনা। গহনা পেলে কাল গেরুকে খেতে বলবে। গহনা বেচে চাল, ডাল, একটু মাছ নেবে। বাপ মাছ খেতে ভালোবাসে। গেরুর জন্য একটু শুয়োরের মাংস অথবা চর্বি। গেরু শুয়োরের চর্বি খেতে ভালোবাসে।

নেলি তলানি খুঁজল। একটা আঙুল দিয়ে তলানির ছোট ছোট অণুর মতো টুকরোগুলোকে ঘষল। সব জলের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। কিছুই শক্ত ঠেকছে না। পিতল কাঁসা কিংবা লোহার মতো সোনার মতো ঠেকছে না। অণুর মতো ঠেকছে না। দুখিয়া কয়লা ধুয়ে কালি পর্যন্ত তুলে নিয়ে গেছে। নেলি সব কয়লাগুলো জলে ধুলো এবং মালসাতে জলের তলানি খুঁজল—কিচ্ছু নেই। সে নিরাশ হচ্ছে। ওর চোখ দুটোতে ফের দুঃসহ যন্ত্রণা। ফের সে ইচ্ছে করে মাতাল হয়ে উঠেছে। সে ডাক দিল—দোহাই ডাক ঠাকুর, দোহাই তুর।

সে এবার কয়লা ফেলে শ্মশানের ভিজা মাটিগুলো তুলল হাঁড়িতে। যদি কিছু গয়না গলে মাটির সঙ্গে মিশে থাকে।

নেলি আবার আশার ডিমে তা দিতে দিতে জলে মাটি গুলল। জল ফেলে তলানি ঢালল মালসাতে। দু মালসায় তলানি জল ঢেলে জলটা আরও কমাল।

তারপর! এগুলো সে কী দেখছে—এত গহনা! এত টুকরো গহনা! চোখ ওর উজ্জল হয়ে উঠল। চোখ ওর আনন্দে জলে ভরে উঠল। এত! এত সোনার সব টুকরো! সব অণু। নেলি হারিকেনটা আরও কাছে নিয়ে গেল। টুকরোগুলো সব ঝিকমিক করছে। মালসাটি বুকের কাছে চেপে ধরল। —দোহাই ডাক ঠাকুর, দোহাই তুর। হামারে থোড়া শক্তি দে। সে একটা আঙুল দিয়ে নেড়ে নেড়ে দেখতে চাইল। আঙুলটা পর্যন্ত কাঁপছে। তবু যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করে একটা অণুর স্পর্শ আঙুলে পেতে গিয়ে দেখল সেগুলো জলের সঙ্গে গুলে যেতে চাইছে।

নেলি আর পারছে না। সে আঙুল দিয়ে ফের চাপ দিল। ওরা ভেঙে যাচ্ছে। জলের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। নেলি আর পারছে না। আর পারছে না। ডাক ঠাকুর তু হামার সাথ বেইমানি মত কর। পেটের দুঃসহ যন্ত্রণা, শরীরটার দুঃসহ যন্ত্রণা, এইসব যুবতী মেয়ের পোড়া অণুবৎ হাড়ের টুকরো ওকে পাগল করে দিচ্ছে।

নেলি পাগলের মতো প্রেতের মতো সমস্ত রাত এইখানে পড়ে থাকল। এবং ভোর রাতের দিকে নেলি পাগলের মতোই অর্থাৎ ডাইনির মতো হয়ে—চোখ দুটো ফোলা ফোলা চুলগুলো খাড়া খাড়া করে চটানে উঠে গেল। গোমানি রাগে দুঃখে ওর কোমরে কয়েকটা লাথি মেরেছিল—অথচ নেলি কিছু বলেনি, চুপচাপ মাচানে গিয়ে হাত—পা ছড়িয়ে চোখ দুটো স্থির করে—কাঁথা—বালিশের নিচে আশ্রয় খুঁজেছিল এবং ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

দুই

তখন সূর্য পাটে বসেছিল। তখন খেয়াঘাটের মাঝিদের সঙ্গে গোমানি ডোম ঢকঢক করে স্পিরিট গিলছিল এবং তখনই নদীর পার ধরে নামছিল কৈলাস এবং ওর সঙ্গে ওর মরদ বাচ্চা গেরু ডোম। ওরা অনেক খানা—খন্দ পার হয়ে, অনেক ডহর—ডোবা পার হয়ে নদীর পাড় ধরে চলছিল।

ওরা ক্রমশ উত্তরের দিকে নেমে যাচ্ছে। গেরু মাঝে মাঝে পিছন ফিরে তাকাচ্ছিল—শ্মশান পেছনে, শ্মশানটা হারিয়ে যাচ্ছে। চটানটা আর দেখা যাচ্ছে না। সুতরাং সামনে ফরাসডাঙা, সুতরাং সামনের দিকে ওরা চলতে থাকল। ফরাসডাঙার জঙ্গলে মৃত মানুষের কবরে, অথবা সে ভাবল নতুন কবরে, যত তন্তর—মন্তর শিখল বাপের কাছে সব উগরে দেবে। তারপর তন্তর—মন্তরের গুণাগুণ দেখে সাহস সঞ্চয় করে নেবে।

গেরুর শরীর মজবুত এবং কষ্টিপাথরের মতো রঙ। একহাতে মদের ভাঁড় এবং অন্যহাতে বল্লম। সঙ্গে একটা হারিকেন আছে। গায়ে জড়ানো শ্মশানের কাঁথাকাপড়। কোমরে গামছা বেঁধেছে শক্ত করে। গেরুর শীত শীত করছে। উত্তুরে বাতাসে প্রচণ্ড ঠান্ডা। এই ঠান্ডায় ওর মুর্দা তোলার শখ অথবা খোঁজার শখ এখন আর থাকছে না। সে ভাবল, এই শীতে বরং চটানে মদ টেনে নেলির সঙ্গে মাতলামি করা ভালো। সুতরাং সে বল্লম দিয়ে একটা গাছকে ফুঁড়ে দিল।

কৈলাস তখন শীতের পোকা হয়ে বেশ গুটিগুটি চলছে। বেশ এক—পা দু’পা করে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। অনেক দূর চলে যেতেই ওর হুঁশ হল—গেরুর কথা মনে হল, মরদ বাচ্চা আর কতদূরে! মরদ বাচ্চা এ—কাজ করে খেতে পারবে কী পারবে না—সব কিছু মরদের চলার ঢং দেখে বুঝে নেবার চেষ্টা করল। কৈলাস এই অন্ধকারে, এই নদীর পারে পারে যেন বলতে চাইছে—হামার শরীরটা কঙ্কাল আছে, হামার কঙ্কাল দোসরা কঙ্কাল খুঁজতে যাচ্ছে। সে এইসব ভেবে হাত—পা শক্ত করার ভঙ্গিতে শরীর টানা দিল, তারপর চোখ দুটোকে জোনাকি পোকার মতো ছোট করে সে আঁধারে গেরুর পায়ের শব্দ শোনার চেষ্টা করল। গেরু আসছে এবং ওর পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। সে ফের হাঁটতে থাকল। আঁধারে চলতে কষ্ট—তবু সে হাঁটছে। সে হারিকেনের আলো ধরালে না। তেল—খরচের কথা ভেবে সে অন্তত বাবুঘাটের ডহর পর্যন্ত এই আঁধারে চলার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। সে আলো জ্বালাল না অথবা গেরুকে আলো জ্বালাতে বলল না।

সে হাঁটল। সে হাঁটছে। গেরু পিছনে—গেরু ওর ইচ্ছামতো আসুক এই ভাবনা এখন কৈলাসের অন্তরে।

কৈলাস যেতে যেতে কোঁচড়ের চালভাজাগুলো আঙুলে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখল এবং টিপে টিপে দেখল। কোঁচড়ের ভিতরে ইতস্তত কাঁচা লংকার টুকরো ছড়ানো—কিছু কাঁচা পেঁয়াজের কুচি। একটা মাটির ভাঁড় কোমরের অন্য পাশটায় ঝুলছে। হাঁটবার সময় ভাঁড়টা দুলছে।

কৈলাস এই আঁধারে ধুকুস—ধুকুস করে চলছিল। জোনাকির চোখ নিয়ে সে এ—আঁধারেও চলতে পারে। অন্তত চলার চেষ্টা করে। এ—সময় ওরা বাবুঘাটের পারে এসে দাঁড়িয়েছে। চটানের আলো এখান থেকে আর দেখা যাচ্ছে না। শ্মশানের হারিকেনের আলোটা ওরা দেখতে পাচ্ছে না। বাঁকের মুখে মাঝিদের পুরোনো আস্তানা হারিয়ে গেছে। নদী এখানে বাঁক নিয়েছে। নদী এখানে বাঁক নিয়ে প্রচণ্ড গতিতে পদ্মার দিকে উজানে উঠে গেছে। দুপাশে সেই ঘন ঝোপ—সেই বনকুলের অন্ধকার, সেই সোনাব্যাঙের ঢিবি, খরগোশের গর্ত।

ওরা আঁধারের ভিতর সব টের করতে পারছে। ওরা এখানে মুহূর্তের জন্য দাঁড়াল। প্রকাণ্ড ডহরটা ওরা পার হবে। আঁধারে পার হতে গেলে হুমড়ি খেয়ে পড়ার ভয় থাকে। সেজন্য বাপের কথামতো গেরু মদের ভাঁড় মাটিতে রাখল। বল্লমটা নিচে রাখল। এবং হারিকেনটা নিচে রেখে দেশলাই জ্বেলে আলো জ্বালাল। কাঠিটা খস করে জ্বললে গেরু বাপের মুখ দেখল। বাপ গেরুর মুখ। গেরু বাপকে এখন চিনতে পারছে না। মুখটা ওর কেমন ভয়ানক হয়ে উঠেছে। কেমন ভয়াবহ। সে বাপের দুটো বেড়ালের মতো চোখে শিকারের এক ভয়ংকর ইচ্ছাকে দেখতে পেল। সে ডাকল, বাপ! চল বাপ! সে কেমন ভয়ে ভয়ে বাপকে কথাগুলো বলল।

কৈলাস গেরুর কথা শুনল না অথবা শোনার ইচ্ছে ছিল না। গেরু হারিকেন জ্বাললে হারিকেনটা সে তুলে নিল এবং হারিকেনটা ঘুরিয়ে—ফিরিয়ে দেখল। সেই পুরানো জং—ধরা ঢাকনা, সেই ফাটা চিমনি—কোনো পরিবর্তন নেই, অথচ ওর দেখার অভ্যাস। রোজ জ্বেলে একবার ঘুরিয়ে—ফিরিয়ে দেখবে হারিকেনটা। অনেক কালের এবং অনেক পুরোনো বলে কৈলাসের মমতা হারিকেনটার ওপর খুব বেশি। এখনও সে ওর শরীরের মতো এটাকে কোনোরকমে জিইয়ে রেখেছে। জিইয়ে রেখে পুরোনো স্মৃতির ঘরে সে অনেকক্ষণ কদম দিতে পারে।

কৈলাস তখন হেকিমি করত শহরের ফৌজদারি আর দেওয়ানি কোর্টে। দাওয়াই বিক্রির সময় চেঁচাত, পুন্ন—পদের মাদুলি! এ ঝাড়ফুঁক লয়, এ জাদুমন্তর লয়—এ আছে জুড়িবুটির কারবার—দব্যগুণ। ডানপুকুসে টান মারে, তোষক করে, পির—পরিতে নজর দেয়, বাণ মারে, এ—মাদুলি দেহে লিয়ে লিলে আসান পাবেন বাবুলোক—বহুত সামান্য দাম, লিয়ে যান, বিবি—বুঢঢার লাগি লিয়ে যান। এইসব মাদুলি বিক্রি করে সে যখন চটানে ফিরত তখন রাত হত গভীর। কৈলাস সাপখোপের ভয়ের জন্য বিপদে পড়ে এই হারিকেনটা কিনেছিল। আর হারিকেনটা যত পুরোনো হল, যত দিন গেল চটানে, সে অক্ষম হয়ে পড়ছে, তত হারিকেনটার ওপর ওর মমতা বাড়ছে।

এ—সময় গেরু দুটো বিড়ি বের করে বাপকে একটা দিল, নিজে ধরাল একটা। ওরা দুজন বিড়ি খেতে খেতে ফের পথ চলতে থাকল।

অনেকগুলো পরিচিত ঝোপ পার হয়ে কৈলাস অন্য একটা ডহরের পারে এসে থামল। শহরের নালা নর্দমার জল এই ডহর ধরে গঙ্গায় গিয়ে নামে। কৈলাস ডহরের পারে অন্য দিনের মতো আজও উঁকি মারল। লাফ দিয়ে পার হতে পারবে কিনা দেখল। শেষে গেরুর হাতে হারিকেন দিয়ে ব্যাঙের মতো হাতে—পায়ে লাফ দিয়ে ওপারে পড়তে চাইল। পড়ল, হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ভিজে ঘাসের জলে ওর শরীর ভিজে উঠল। শীত—শীত রাতে শীতের ভারে সে তখন কুঁকড়ে উঠেছে। সে যেন নড়তে পারছে না। শীতের কুকুরের মতো সে আর্তনাদ করতে চাইছে। বাপের এইসব ভাব দেখে গেরু হেসে বাঁচে না। রাগে দুঃখে কৈলাস গালমন্দ দিল গেরুকে। নীরস মাটিকেও সে ছেড়ে কথা বলল না। খিস্তি করল। সব আক্রোশ ওর এই মাটির উপর, এই ডহরের উপর। —শালী হামার! শালীর বুক—পিঠ গেন—গম্যি না হল। বুড়া জান—হুট করে পড়লে খুট করে মরবে। মরা কৈলাস বিচে খালাস পাবে গেরু।

গেরুর দিকে কৈলাস কড়া নজরে চাইল—যেন গেরুকে সে এখন বিশ্বাস করতে পারছে না, যেন গেরু এখুনি কৈলাসের কঙ্কাল নিয়ে জগুবাজারে হিল্টন কোম্পানির বড়বাবুর কাছে ছুটবে। সে ফের গাল দিল—শালা হামার বাচ্চা কোন বলিছে! বেতরী শালার মুখে দানা খামোকা দিলাম।

ততক্ষণে গেরু লাফ দিয়ে ডহর পার হয়েছে। বাপকে মাটি থেকে তুলেছে এবং বলেছে, তু গিরে গেলি তো হাম কিয়া করে! হামার হাসি ভি পেল, লেকিন হাম কিয়া করে! হামার কী কসুর আছে তু বুল।

নদীর পাড় ধরে চলার সময় গেরু বলল, চোট লাগল না তো রে বাপ!

কৈলাস উত্তর না করে হাঁটছে। সে যেন অন্যমনস্কভাবে হাঁটল। কিন্তু কিছু দূর এসে কী ভেবে বলল, লাগেনি। লাগবে ক্যানে! ঝাড়ফুঁক জুড়িবুটির পুন্নপদের মাদুলি হামার দেহে কতকাল ধরিয়ে বেঁইধে দিয়েছি। দশকুড়ি দশটা দব্যগুণ আছে ওয়াতে। তুরে ভি বেঁইধে দিয়েছি। পির—পরির নজর, ভূত—পেঁতের শ্বাসে তুরে ভি খাবে না। এইসব কথা বলতে গিয়ে ওর গলা শুকিয়ে উঠছে। সে ঢোঁক গিলল। সে এই শীতে পারলে জল খেত। সে এই শীতে পারলে এখুনি বসে ভাঁড়ের সবটুকু মদ টেনে নেয়।

সে কোঁচড়টা টিপে টিপে দেখল। আছাড় পড়ে সব আবার পড়ে গেছে কিনা দেখল। কোমরের ভাঁড়টা ভেঙেছে কিনা দেখল। ভাঁড়, কোঁচড়ের চালভাজা, কাঁচালংকা, পেঁয়াজকুচি সব ঠিক আছে দেখে সে খুশি হল। এই সব ভাবতে গিয়ে দেখল কৈলাসের গলাটা নিজে থেকেই ভিজে উঠছে। জিভে লাল জমছে। সে তার ডানহাতের সড়কিটা বাঁ হাতে নিয়ে বলল, এ বছরে জাড় যেয়েও যেছে না রে!

চলতে চলতে কৈলাস ভাবল—কঙ্কাল টেনে তুলতে আরও কিছুদিন বাকি। সে ভাবল—ফরাসডাঙার কোন জঙ্গলে মড়াটা পুঁতল। বেওয়ারিশ মড়ার হদিস নিতে কত সময় নেবে, কত সময় ওরা সেখানে পৌঁছবে এই চিন্তায় কৈলাসকে খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছে।

সহসা আঙুলের ওপর কৈলাস কড় গুনল। সে খুশি হল। গেরুকে হাত নাচিয়ে বলল, বাঁচোয়া। দু দফে পানি ঢাললে জায়দা লাগে তো দশ রোজ।

গেরু সকল কথায় কান দিতে পারছে না। ভয়ে কিছুটা সে আড়ষ্ট। সে এখন আগে আগে চলেছে। জীবনে প্রথম কঙ্কাল খুঁজতে এসে ওর ভয় ধরেছে। ভয়ের কথা বাপকে বলতে পারছে না। বাপ এখুনি তবে গোসা করবে, গালমন্দ দেবে। এতদিন বাপ একা এসেছে। আজ ওরা দুজন। এতদিন বাপ কঙ্কাল কুড়িয়ে চটানে শুধু গেরুকে গল্প করেছে, ওর ভয়—ডর ভাঙানোর চেষ্টা করছে—আজ ওরা দুজন। এতদিন বাপ কসরত দেখিয়েছে তাবিজের, শরীরের—আজ ওরা দুজন! সুতরাং ভয়—বিস্ময়ের কিছু নেই। এখন কিছু নেই। এখন কিছু বললেই বাপ চেঁচিয়ে জঙ্গল মাথায় করবে—বলবে, বেইমান, গোলামের বাচ্চা, তু ভাগ হিঁয়াসে!

কৈলাস বলল, তুকে লিয়ে এলাম গেরু! বলা তো যায় না বাপজী ঠাকুরের কখন কী মরজি! হামি মরে গেলে তুকে কোন দেখবে। সে যেন এই বলে গেরুকে অজুহাত দেখাল।

গেরু আগে আগে হাঁটছে। বাপকে ভূতের মতো মনে হচ্ছে। এখন মদের ভাঁড়ের ভিতর সড়কি—কাঁধের ওপর ভাঁড়। ওরা আঁধার ভেঙে, ঝোপ—ঝাড় ভেঙে চলছে তো চলছেই। রাতে এ পথ গেরুর ভয়ানক দীর্ঘ মনে হচ্ছে। পথ দীর্ঘ বলে এবং ভয়াবহ বলে সে নেলিকে ভাববার চেষ্টা করছে। নেলিকে ভেবে ভয়ের কথা ভুলতে চাইছে, অথবা নেলিকে গভীরভাবে ভালোবাসতে চাইছে।

কৈলাস আর গেরুর ব্যবধান এখন বেশ ফারাক। গেরু রয়েছে সামনের পিঠুলি গাছের নিচে, আর বুড়োটা রয়েছে নিজের হারিকেনের আলোয়—শিরীষ গাছের নিচে। বাচ্চাটা এখন বড় হয়েছে, জোয়ান হয়েছে। বড় বড় পা ফেলে সে এখন হাঁটে। বুড়ো কৈলাসের জোয়ানকি গেছে, হেকিমি জীবনের জয়—জয়কার গেছে, সুতরাং সে হাঁটে আস্তে। যত সে বুড়ো হয়েছে—পা দুটো, কোমরটা, বুকটা তত সরু হয়েছে। তত সে চলতে পারছে না, তত ওর নিজের উপর, কবচ—ওবচের ওপর বিশ্বাস ভাঙছে। তত সে গেরুকে কাছে টানতে চাইছে এবং ব্যবসা শেখাবার সব রকমের ফন্দি—ফিকির আঁটছে। এইজন্যই সে বেওয়ারিশ মড়াটার জন্য এতটা পথ ছুটে এসেছে। সে যেন আর এই শরীরের ওপর ভরসা পাচ্ছে না।

শরীরের দিকে চাইলে এখন ওর নিজেরই কেমন সরম আসে। ভাঙা আরশিতে মুখ দেখার স্বভাব কৈলাসের এখনও আছে। যখন শেষ পক্ষের বৌটা বেশি উতলা হয়, বেশি ঘর—বার হয়, তখন কৈলাস আরশি নিয়ে দাওয়ায় বসে, আর গোঁফ টেনে টেনে বড় করে। তখন সে তার হাজা—মজা মুখটার দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটে। বলে, বাহবাঃ, কৈলাস তুর, জোয়ানকি তবে গিল রে! তোর বহু এখন ঘর—বার হল রে। বাহবাঃ, বাহবাঃ, কৈলাস! আরশির মুখটা তখন ওকেও ভেংচি কাটে, যেন বলতে চায়—মর, মর, মরে চটান খালাস কর।

কৈলাস বড় করে মাথায় পাগড়ি বেঁধেছে। মাথার টাক ঢেকেছে। তবু চলতে চলতে ওর মনে হচ্ছিল পাগড়ির ভিতর দিয়ে টাকে ঠান্ডা হাওয়া ধাওয়া করছে। সে মাথার পাগড়িটা কষে বেঁধে নিল কতকাল আগের মতো। তখনও সে কোর্টে হেকিমি করত। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাতের সরু লাঠিটা চটের ওপর পড়ে থাকা জুড়িবুটির ওপর ছুঁইয়ে দিয়ে বলত, রাজধনেশের ঠোঁট, কাকধনেশের পালক, আওর ময়না—ধনেশের তেল শিরমে দু’দফে দিয়ে লিন বাবুলোক—মাথায় রোঁয়া একগাছা উঠে তো হামার ওস্তাদের কসম। তখন কৈলাস মাথায় টুপি দিয়ে টাকটা ঢেকে রাখত।

কিছু সাহস সঞ্চয় করে দূরে গেরু হাতের ওপর বল্লম উঁচিয়ে হাঁকরাল, কী রে বাপ, তু হাঁটতে লারছিস?

কৈলাস ধমকে উঠল, লারছি, লারছি। লারছি তো তুর বাপ এত পথ চলিছে কী করে! রোজল জঙ্গলে গিল কী করে?

গেরু আরও এক কদম হেঁটে পথের মোড়ে এসে দাঁড়াল! বাপ এগিয়ে আসছে। আলোটা দুলছে হাতে। বাপ জমি ভেঙে উপরে উঠল। যে পথ নদীর পাড়ে পাড়ে নবাবের রাজধানী পার হয়ে আরও উত্তরে গিয়ে পদ্মায় মিশেছে, সে পথ না ধরে ফরাসডাঙার পথে পড়ল। অন্য পথটা ডানদিকের জল—কল ঘেঁষে প্রাচীন ইংরেজ—কুঠির দিকে রওনা হয়েছে। গেরু এই পথের মোড়ে দাঁড়িয়ে বাপকে উঠে আসতে দেখল, জল—কলের আলো দেখল, দূরের ফরাসডাঙার ছায়াছায়া অস্পষ্ট জঙ্গল দেখল।

কচ্ছপের মতো কৈলাস গুড়িগুড়ি হাঁটছে। সে হারিকেনের আলো এবং তেল বাঁচিয়ে হাঁটছে। জোরে সে হাঁটতে পারে না। ইচ্ছা করলেও না। অথচ গেরুকে বলবে, জলদি হাঁটলে হারিকেনের তেল উপরে উঠে আসবে। আলো নিভবে। অন্ধকার পথে চলতে কষ্ট হবে অথবা আর একটা দেশলাইর কাঠি জ্বালতে হবে।

বাবুঘাট থেকে এই পথের মোড় পর্যন্ত রাস্তা অত্যন্ত খারাপ। পথ উঁচুনীচু, ভাঙা। গোরুর গাড়ির চাকার দাগগুলো রাতে সাপের খোলসের মতো মনে হয়। মনে হচ্ছে। যত আঁধার হয়, যত আলোর জোর কমে, তত সাপের খোলসগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তত কৈলাস হোঁচট খায় বেশি, তত ওর খিস্তি করার শখ বাড়ে। সুতরাং এই পথটুকুই কৈলাস অত্যন্ত সন্তর্পণে হাঁটে। কারণ অধিকাংশ সময় সে বেসামাল হয়ে পড়ে।

এবার ওরা পুবদিকে চলল। এই পথও গেছে নবাবের রাজধানীতে। এ—পথ যেমন উঁচু তেমনি কুমিরের পিঠের মতো অমসৃণ। জল—কল ডাইনে ফেলে পথ কেবল জাফরিকাটা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ছুটেছে। পথের দুপাশে রয়েছে রাজ্যের অনাবাদি জমি। ছোট ছোট বাচ্চা ছেলের কবর। নারকেল গাছ, হিজলির বন, কাশফুলের জঙ্গল। নীলকুঠি সাহেবদের ভাঙা বাড়ি। জায়গায় জায়গায় পথ ভেঙে গেছে। ওরা এই পথ ধরে হাঁটছে। রাত ঘন বলে কোনো জনপ্রাণীর সাড়া ওরা পাচ্ছে না। শুধু জল—কলে ইতস্তত দুটো—একটা আলো জ্বলছে। ভটভট শব্দ হচ্ছে ইঞ্জিনের। সদর দরজায় দারোয়ান কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। ভসভস করে তার নাক ডাকছে।

এ—সময় কৈলাস কাশল। জল—কলে শব্দ হচ্ছে। কাশির আওয়াজে জল—কলের দালানগুলো যেন নড়ছে। এত নিঃশব্দ, নিঃসঙ্গ এইসব মাঠ, ঝোপ, জঙ্গল যে কৈলাস জোরে কাশতে পারল না পর্যন্ত। সে যতটা পারল কাশিকে প্রশমিত করে ঢোঁক গিলে হাঁটতে থাকল।

ওদের এখন আর সামান্য পথ হাঁটতে হবে। এই সামান্য পথটুকুই খুব ভয়াবহ। এখানে ঝোপ—জঙ্গলগুলো পথের উপরে হুমড়ি খেয়ে আছে। সাপখোপের এক্তিয়ার এটা। দক্ষিণে প্রকাণ্ড ঝিল, জগৎশেঠের বিখ্যাত সিঁড়ি। শেঠ পরিবারের ভাঙা পুরোনো পাঁচিল। ঝিলের ভিতর সব পুরোনো কেউটে সাপ। কেউ বলে জগৎশেঠের আমলের ওরা। যক্ষের ধন আগলাচ্ছে ফরাসডাঙায়। উত্তরে প্রকাণ্ড খাল। খালে জলো ঘাস দেখে চটান বলে মনে হয়। আঁধারে সাপখোপ, শেয়াল—খটাশ জলো ঘাসের ভিতর দিয়ে শেঠদের ভাঙা পাঁচিলের অন্যপাশে উঠে রাতের কান্না কাঁদে। হঠাৎ শুনলে মনে হবে অনেকগুলো পুরোনো আমলের প্রেতাত্মা হাল আমলের নসিব দেখে কেঁদে তামাশা দেখাচ্ছে। অথবা কেঁদে—কেটে অস্থির হচ্ছে।

খালের পাড় ধরে পায়ে—চলা সংকীর্ণ পথ। ফণীমনসার কাঁটা পথের দুপাশে। রাতের শিশিরে ওরা ভিজছে। এবং এটাই ফরাসডাঙার পশ্চিম সীমানা। দক্ষিণে শহর, উত্তরপ্রান্তে ঝিল। পুবে রেল লাইন। ইতস্তত আম—কাঁঠালের গাছ সব—অন্ধকারে তারা আচ্ছন্ন, ঝিমুচ্ছে।

নিচে নামার আগে হারিকেনের পলতেটা একটু উসকে দিল। এখানে হারিকেনের আলোটা যত জোরেই জ্বলুক না কেন—কৈলাস পরিতৃপ্ত হয় না। সে যতটা পারল আলোটা বাড়িয়ে দিল। এখানে ওর কেবলই মনে হয়—সে কালকেউটে কিংবা পদ্মনাগিনীর ওপর এই বুঝি পা—টা চাপা দিল। মনে হয় এই বুঝি ওরা কামড়ে দিল।

দূরে জল—কলের আলোটা ঝোপের আড়ালে এখনও যেন দাঁত বের করে হাসছে। ঝোপঝাড়ের ভিতর থেকে ভাঙা কাঁসরের শব্দ উঠছে ঝিঁঝি পোকার। ঝোপে—জঙ্গলে জোনাকি উড়ছে। ওরা ঝোপ থেকে অন্য ঝোপে ছিটকে পড়ছে এবং এই ফরাসডাঙার জঙ্গলকে যেন চিতার আগুন করে রেখেছে। কৈলাস সেই সময় হেঁকে উঠল, ওস্তাদ গুরুর দোহাই, মা মনসার দোহাই, শিবরাজের দোহাই—দোহাই ধন্বন্তরি ওঝার!

পিছনে গেরু হাতের বল্লম উঁচিয়ে বলল, কী হল রে বাপ?

গেরুর মুখের কাছে হারিকেন তুলে বলল কৈলাস, মা মনসার বাহন। গন্ধ পেইছিস না? ঢেঁকুর তুলে গন্ধ দিল। ঝোপে—ঝাড়ে কোথাও লুকিয়ে রইল লিশ্চয়।

ওরা দুধারে নজর রেখে চলেছে তখন। ঝোপ—ঝাড়ের নিচে বল্লম ঢুকিয়ে খুঁজে খুঁজে দেখছে—মরা মানুষটাকে কোথায় মাটি চাপা দিয়েছে। মাঝে মাঝে কৈলাস শ্বাস টানছে জোরে। গন্ধ নিচ্ছে এবং পরীক্ষা করছে শরীরটা মাটির নিচে পচে কোনো গন্ধ তুলছে কিনা!

শালারা। কৈলাস বিড়বিড় করে খিস্তি করল। —কোথায় রেখে গেল মড়াটা! পুঁতল কোন মাটির নিচে? ক্যাবলারা!

গেরু কাঁধের ভাঁড় হাতে নামাল। তারপর সেও বাপের অনুকরণ করে হাতের বল্লমটা জঙ্গলে ঢুকিয়ে দিল। দেখলে বেওয়ারিশ মড়াটাকে কোথায় কোন জঙ্গলে ফেলে গেছে।

রেললাইনের ওপাশ থেকে কতক জাফরানি রঙের আলো পাতার অন্ধকার চিরে ওদের শরীরের ওপর পড়ছে সেই সময়। চাঁদের মরা মুখটা দেখার জন্য কৈলাস ঝোপের ভিতর থেকে উঁকি মারল। গেরু তখন বলল, কী দেখছিস বাপ? কৈলাস গেরুর কথার জবাব দিল না। সে ঘন ঝোপের ভিতর দিয়ে উঁকি মারছে আর ফোঁসফোঁস করে উঠছে। বলছে—শালারা! কোন তেপান্তরে পুঁতে গেলি রে শালারা! খটাশ—শেয়ালের খাবার করে দিলি!

রেল—সীমানার শেষে আকাশ, চাঁদ এবং গ্রহ—নক্ষত্রের ছবিটা সহসা ভালো লাগল গেরুর। বুঝি নেলির মুখ মনে পড়ল। নেলির মুখটা দেখতে দেখতে পাঁশুটে হয়ে গেল। মরা মানুষের মুখের রঙের মতো। সুতরাং গোমানির মেয়েটাও মরবে একদিন। তখন পুঁতে পচাবে কী ঘাটের আগুন জ্বালাবে, আজ যেন ঠিক করতে পারছে না। মেয়েটা হয়তো বাপের সঙ্গে এখন মাচানে ঘুমাচ্ছে। অথবা ভাঙা চালের ফাঁকে আকাশ দেখছে। নেলির এ সময় এ মুখ বড় অদ্ভুত। ভয়ানক বিস্ময়ের। গেরুর মনে এ—সময় সুখ জাগে। নেলিকে নিয়ে ঘাটের আঁধারে নামার শখ হয় তখন। বেয়াড়া রকমের একটা ইচ্ছা ওকে কেবল তাড়না করে মারে।

কৈলাস তখন হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে বেঁচে গেল। সে শুনল—সে শুনতে পাচ্ছে। শেয়াল—খটাশের শব্দ সে শুনতে পাচ্ছে। ওরা কোথাও যেন মড়ার শরীরটা চুষে খাওয়ার জন্য নিজেরা ফাটাফাটি করছে। কৈলাস ছুটল। সে পাগলের মতো ছুটছে। ওর ভয়ে দুটো শেয়াল ঝোপ থেকে অন্য ঝোপে চলে গেল। গেরু বাপের পিছনে ধাওয়া করছে। কিন্তু খালে নামতে গিয়ে গেরু আর নামতে পারছে না। কারা যেন ওর আশেপাশে গোঙাচ্ছে। কারা যেন ওর আশেপাশে ফিসফিস করে কথা বলছে। শেঠদের ভাঙা পাঁচিলের ওপাশে কারা যেন দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। অথবা দূরে ভাঙা কুঠিবাড়িতে কেউ গলা টিপে মানুষ হত্যা করছে। গেরুর চুলগুলো ভয়ে শক্ত হয়ে গেল। সে থামল। সে দাঁড়াল। সে চলতে পারছে না। আর সেই দেখে কৈলাস খিস্তি করল, হ্যাঁ রে বেটা, তুরে তো হাম বহুত দফে বলিয়েছে, জীনপুরী, সাপখোপ, ভূত—পেঁত কেহো তুর গা ছুঁতে লারবে। তুর দেহবন্ধন করে দিছি যোগ। তারপর কাছে গিয়ে ওর শরীর ঝাঁকিয়ে বলল, ওগুলো মানুষের ডাক লয়, ভূত হয়, ওগুলো পেঁচার, শেয়াল—খটাশের জাত। তু হেঁটে আয়। জলদি আয়।

গেরু কিছু বললে না। বাপ যেন ওর ওপর তন্তর—মন্তর করল। বাপ যেন ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সে সামনে এগিয়ে যেতে থাকল। হারিকেনের ফ্যাকাশে আলোতে শেঠদের ভাঙা পাঁচিল, ভাঙা কুঠি সব এখান থেকে সে দেখতে পাচ্ছে। সে ভয়ে ভয়ে কৈলাসকে বলল লক্ষ্মীপেঁচা না কালপেঁচা বাপ?

হবে একটা। তু চল। পথ চল। শেষে কী ভেবে সে নিজেই হারিকেনটা নিয়ে ছুটতে থাকল এবং বলতে থাকল, গেরু ছুটে আয় বাপ, জলদি আয়। জলদি পা চালা। সর্বনাশ করে লিল রে, সর্বনাশ করে লিল। —শালারা! ভয়ে গেরুর হাত থেকে বল্লমটা খসে পড়ল। কোনোরকমে গোঙাতে গোঙাতে সে বলল, কী হল রে বাপ! কিছু দেখে লিলি রে? জীনপরী, সাপখোপ কিছু? হায়, হায়, কিছু দেখে লিলি রে? কিন্তু কৈলাসকে দূরে চলে যেতে দেখে ওর ভয় আরও বাড়ল। বাপের কোনো জবাব না পেয়ে ওর পা দুটো যেন খালের কাদায় ডুবে যাচ্ছে। সে যেন ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে। সে চিৎকার করে বলল, বাপ, হামার পা চলতে লারছে।

না চলুক। মর শালা। বেটা কেবল ভয়ে মরে গ। কৈলাস এই সব কথা বলতে বলতে পোড়োবাড়িটার দিকে ছুটছে। হাতে ওর হারিকেনটা তেমনি দুলচে। মদের ভাঁড়াটা টলছে। বল্লমটা ঢেউ খেলিয়ে চলছে বাতাসের ভেতর। একটা ঝোপের পাশে দাঁড়িয়ে বলল, হে—রে, শুনতে লারছিল, শেয়াল—খটাশগুলো বনকাঁঠালের ঝোপে কেমন দুশমনি করছে। লিশ্চয় মানুষটাকে ওখানে পুঁতল। তু আয়, পা চালিয়ে আয়, লয়তো শেয়াল—খটাশ ভাগ বসাবে।

শেয়াল—খটাশ ভাগ বসাব এ ঠিক নয় গেরু বোঝে। আর এও বুঝতে শিখেছে কঙ্কালটা ঘরে অক্ষত নিতে পারলে দাম ওর অনেক হবে। সে তাই মাটি থেকে বল্লমটা কুড়িয়ে পোড়োবাড়িটার দিকে ছুটছে। খালের মাটি ওর আর পা টেনে ধরছে না। সে পোড়োবাড়ির পাঁচিল ঘেঁষে চলছে। জাফরিকাটা সব বন—লতার জঙ্গল ডিঙিয়ে কৈলাসকে অনুসরণ করছে। কিন্তু পোড়োবাড়িটার কাছে আসতেই এবং কবরের নিচে মরা মানুষটার ছবি ভাবতেই শরীরটা শিউরে উঠল। মাথার চুলগুলো শজারু—কাঁটার মতো আকাশমুখো হয়ে দাঁড়াল। ভয়ে বিস্ময়ে হাতের বল্লমটা বাতাসে উঁচিয়ে চিৎকার করে বাপের মতো বলে উঠল, ওস্তাদ গুরুর দোহাই! এবং সঙ্গে সঙ্গে মনে হল সব ভয়টা ওর কেটে গেছে। সে এই জঙ্গলের মানুষ হয়ে গেছে। অথবা মড়া খোঁজার মানুষ হয়ে গেছে। সে নির্ভয় হতে পেরে বলে উঠল, বাপ হাম তো তুর মতো হ গেলাম। কোনো ভয়—ডর আওর না থাকল।

শেয়াল—খটাশগুলো মানুষের শব্দ পেয়ে সরে গেছে। এইবার গেরু আর কৈলাস কবরের ঝুরঝুরে মাটির বুকে উপুড় হয়ে পড়ল এবং অনেকগুলো আঁচড় দেখল। শেয়াল—খটাশের এইমাত্র দুশমনি করে সরে যাওয়ার চিহ্ন দেখল। আর কিছু সময় মাটি সরাতে পারলে মরা মানুষটার দুটো পা উপরে উঠে আসতে পারত। তার আগেই চটানের মানুষ হাজির। কৈলাস লোভে পড়ে গিয়ে বলল, মাটি তুলে দেখবি নাকি রে তু, লাশটার বত্তিশটা দাঁত থাকল কী থাকল না। খুঁড়ে একবার দেখলে হয়।

বনকাঁঠালের ঝোপে দাঁড়িয়ে সুখী কৈলাস হিহি করে হেসে ছিল। হাসবার সময় দুটো দাঁতের ফাঁক দিয়ে লালা ঝরল। সে ঢুলতে ঢুলতে বলল, শেয়াল—খটাশ লাগাল পেল না রে মড়াটার। মড়ার খবর ওরা জানতি না জানতি হামি তু দো শেয়াল হাজির হ গেলাম। সে হাসতে হাসতে কথাগুলো বলল। যখন সে কথা বন্ধ করল তখন শুনল গেরু, পোড়োবাড়িতেও কারা যেন কৈলাসের মতো হিহি করে হাসছে। হেসে তামাশা করছে ওদের সঙ্গে। কৈলাস ব্যাপারটা বুঝতে পেরে গেরুকে বুকের কাছে টেনে আনল। এবং বলল, ডর কীসের রে বাপ! তু আর হামি আছে, বাপ—বেটে আছে, তবে আর ডর কীসের? ভূত—পেঁত, পির—পরির নজর, মড়ার হজমি সব আছে তোর বাপের কাছে। তারপর গেরুকে আরও বুকের কাছে চেপে বলল, তুর কোনো ডর থাকার কথা লয়।

কৈলাস গেরুকে কবরের পাশে বসিয়ে বলল, এ কাম করে খেতে পারলে চটানে তুকে ভুখা থাকতে হবে না। জগুবাজারের হিল্টন কোম্পানির বাবু থাকলেন, আর থাকল মুর্দার হদিস। এমনকি বাপ তুর মর যায় তো বাপের কঙ্কাল ভি বিচতে পারবি। বিচে পয়সা কামাতে পারবি।

কোমর থেকে পুঁটুলি খুলে কবরের পাশে রাখল কৈলাস। মদ খাওয়ার ছোট ভাঁড়টা পাশে রাখল। মুখ ঘুরিয়ে গেরুকে দেখে নিজের চোখ দুটোকে ফের টান টান করল।

গেরু মদের ভাঁড়টা বাপের কাছে এগিয়ে দিল। কৈলাস দু গেলাস মদ ঢেলে দিল। প্রথমে নিজে খেল, পরে গেরুকে এক গেলাস মদ ঢেলে দিল। পুঁটলিটা খুলে কিছু চালভাজা খেল, কিছু কাঁচা পেঁয়াজের কুচি, কিছু কাঁচা লংকার কুচি খেল। ফের মদ খেল। মদ খেয়ে শরীরে রস জমাতে চাইল। শরীরে আসক আনতে চাইল মুর্দা পাহারা দেওয়ার জন্য। দুহাতের ওপর শরীরে ভর দিয়ে কৈলাস বলল, খুদে দেখবি লাকি রে তু, লাশটার বত্তিশটা দাঁত থাকল কী থাকল না। খুদে একবার দেখলে চলত।

কৈলাস বল্লমটা হাতে নিয়ে তিনবার পাক খেল কবরটার চারপাশে। সে মড়াটাকে মন্তর—তন্তর দিয়ে বাঁধল। মড়াটার ভিতর আর শয়তান ঢুকতে পারবে না। সে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়তে থাকল এবং থুতু ছিটাতে থাকল কবরটার ওপর। শেষে নিজের বুকের ওপর একদলা থুতু দিয়ে বুকটা মালিশ করে দিল। গেরুর মুখেও মালিশ দিয়ে সে বল্লমটা নিয়ে মাটিতে খুঁড়তে বসল। কবর খুঁড়ে মড়ার মুখ দেখার ইচ্ছে। মড়ার বত্রিশটা দাঁত দেখার ইচ্ছে!

এই আঁধারে, ঝোপ—জঙ্গলের নিঃসঙ্গতায়, হারিকেনের অস্বচ্ছ আলোয় কৈলাসকে পৃথিবীর মানুষ বলে মনে হচ্ছে না। বাপের শয়তানের মস্ত মুখটা দেখে গেরুর ফের ভয় ধরেছে। শয়তানটা মড়ার ওপর ভর না করে বাপের ওপর যেন ভর করেছে। কিংবা এতক্ষণ তন্ত্র—মন্ত্র পড়ে শয়তানকে নিজের কাঁধেই ভর করিয়েছে যেন।

গেরুর এ সময় ইচ্ছে ঝোপ—জঙ্গল ভেঙে চটানের দিকে ছুটতে। ইচ্ছে হচ্ছে বাপকে একা ফেলে অন্য কোথাও চলে যায়। সে এতদিন শুনে শুনে ভেবেছিল খুব সহজ, ভেবেছিল বাপের মতো সে—ও মরদের বাচ্চা, তখন ভয় থাকার কথা নয়। কিন্তু এইসব দেখে ওর মনে হল, শয়তানের রাজত্বে চলে এসেছে! বাপ এখানে শয়তানের বান্দা সেজেছে। যেন বাপ ষড়যন্ত্র করে ওকেও খুন করতে এনেছে এ জঙ্গলে। সে উঠে ছুটতে যাবে এমন সময় দেখল কৈলাস পিছন থেকে ওকে ধরে রেখেছে। —ভয় না পাস বাপ, ভয় না মান। কৈলাস গেরুকে টেনে বসাল। গেরু বাপের হাতে কলে—পড়া ইঁদুরের মতো হয়ে বাপের পাশে বসে পড়ল।

কবরের ওপর মাটির ডেলা ডেলা চাঙড়। সুতরাং আপাতত সেগুলো না খুঁড়লেও চলে। গেরু একটা একটা করে মাটির ডেলা তুলতে থাকল। কৈলাসের ধমকে গেরুর হুঁশ হল। —হে রে বেটা, বুকের মাটি ফেলছিস ক্যানে? তু কী লাশটার বুক দেখবি?

অনেকক্ষণ পর কৈলাস হাত দুই নীচে মড়ার মাথাটা পেল। কৈলাস নীচে হাত বাড়িয়ে দিল। এবং বলল, শালার সময় অসময় লাইক! ঢুকুস—ঢুকুস কেবল মদ গিলছে।

ঘাড় কাত করে গেরু জবাব দিল, খবরদার বাপ, তু হামারে শালা শালা বুলবি না। সড়কির ঘায় তর পেট ফুঁসে দেব।

অন্য সময় হলে দক্ষযজ্ঞ শুরু হয়ে যেত—কিন্তু এখন কৈলাসের সে সব হচ্ছে না। এখন কৈলাসের দক্ষযজ্ঞ করার মতো ফুরসত কম—হে রে বেটা দেখ, আলোটা লিয়ে এসে দেখ, মানুষটা মেয়েমানুষ রে! লাকে ওয়ার লাকছাঁবি আছে।

গর্তের ভিতর কৈলাসের হাতটা তখনও ঢোকানোই আছে। তখনও কৈলাস আন্দাজে ভারী ভারী ঠোঁটের ভিতর দাঁত গুণছে। দাঁত বত্রিশটা থাকল কী থাকল না দেখছে। যখন দেখল বত্রিশটা দাঁতই আছে তখন খুশি খুশি হয়ে বলল, দাঁতগুলো সবই ঠিক আছে রে বেটা।

কৈলাস হাতটা তুলে আনলে গেরু হারিকেনের আলো গর্তের ভিতর নামিয়ে দিল। অনেকক্ষণ ধরে মড়াটা দেখল। দেখে গম্ভীর হয়ে গেল। মেয়েমানুষটার মুখে মাটি পড়ে ঠোঁট দুটোর রঙ ধূসর। ঠোঁটগুলো পটলের মতো ফুলে উঠেছে। ডাইনে নাকটা ঝুলে আছে। চোখ দুটো ফেটে গেছে। দাঁতগুলো অত্যন্ত উঁচু উঁচু দেখাচ্ছে। যেন জীবন্ত কঙ্কাল হয়ে আছে মেয়েমানুষটা। গেরু ভয়ে শেষ পর্যন্ত মুখটা তুলে আনলে। সেই সঙ্গে একটা মুখের রঙও উঠে এল। সে মুখ নেলির। গেরুর ভয়ানক কষ্ট হতে থাকল।

মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে গেরুর। ওর ভালো লাগছে না, ভালো লাগছে না এসব। বাপ দু হাতের ওপর ভর দিয়ে দুলছে তো দুলছেই। একটা রাতের পোকা কৈলাসের ঠোঁট বেয়ে ক্রমশ ওপরে উঠছে। সে মুখের ওপর হাত লপটাচ্ছে অথচ পোকাটাকে ধরতে পারছে না। পোকাটা ছুটছে। কৈলাসের হাত কাঁপছে। সে তবু ধরতে পারল না। পোকাটা কানের পাশ দিয়ে পিঠে নেমে যাচ্ছে। সে এবার উঠে দাঁড়াল। ধেইধেই করে ঘুরপাক খাচ্ছে। পিঠের পোকা তাড়াতে চাইছে। তখন চোখের ওপর আকাশের তারাগুলো নাচছে মনে হল অথবা নাচের আগে তাল ঠুকছে মনে হল। নেশায় বুঁদ হয়ে বললে, হে রে, অমন না হলে তেমন হয়। বঙ্গালী বাবুরা কেমন কথা বুলে দেখতে লারিস? তবে হা, মেয়েমানুষটা কম বয়সের হলে কেমন হত রে গেরু বেটা শালা হামার! কৈলাস এই সব বলে উপুড় হয়ে পড়ল কবরটার ওপর। দুহাতে পাশের মাটিগুলো টেনে কবরের মুখটা ভরে দিয়ে চালভাজার পুঁটলিটা টেনে নিল। হাঁফ ছাড়ল আবার। হাঁফের টান তুলল আগের মতো। এবং কিছুক্ষণ দু ঠ্যাঙের ভিতর মুখ গুঁজে পড়ে থেকে বললে, খা, খেয়ে লে। খেয়ে খেয়ে পেট ভার কর শালা। জেরাসে ঘুমিয়ে লে। তুর বাপ কৈলাস পাহারায় থাক।

প্রায় বেশি রাতটুকু পাহারা দেবে কৈলাস। শেষরাতে গেরু। বন—কাঁঠালের শেকড়ের মাথাটা এলিয়ে দিল গেরু। ঘুমোতে চাইল। জোনাকিরা জ্বলছে। মশার কামড়ে ঘুম আসছে না। পাশে কবরটা। মেয়েমানুষটা সেখানে পচছে। মুখটা মনে পড়ছে গেরুর। যত মনে পড়ছে তত বিরক্তি বাড়ছে ওর? এককালে মেয়েমানুষটা বেঁচে ছিল। এককালে নেলির মতো হয়তো বা খুবসুরত ছিল। সব ছিল, সব ছিল মেয়েটার। নেলির মতো লাফিয়ে লাফিয়ে চলত, কাপড় খসে পড়ত বুক থেকে—পাড়া—পড়শীরা দেখত ঢিকঢিক করে। যেমন করে রামকান্ত নেলিকে দেখে বেড়াচ্ছে।

গেরু চটানের কথা ভাবল বনকাঁঠালের শেকড়ে মাথা রেখে। ঘাটোয়ারিবাবুর কথা মনে হল। সেই যে কবে কালো বার্নিশ চেয়ারে বসেছেন, আজও বসে আছেন। মড়ার হিসাব রাখছেন কেবল—রসিদ দিচ্ছেন মরা মানুষের। দুখিয়া আর ওর বৌ চিরদিন ঘাটের ডাক নিয়ে কেবল মারধোর করেই গেল।

বে—ইজ্জতি লোক রামকান্ত। বড় বে—সরম। সুদে টাকা দেয় চটানে। বদলে সে চটান থেকে সুদ সহ অনেক কিছু নেয়। সে ইজ্জত নিয়ে টানাটানি করছে চটানের। সর্দার একবার চোখ খুলে পর্যন্ত দেখে না। সর্দার পর্যন্ত বে—এক্তিয়ার হয়ে পড়ল। একমাত্র নেলিকেই বুঝি এতদিন পাহারা দিয়ে সে ঠিক রাখতে পেরেছে। এ—ব্যাপারে গোমানি খুব হুঁশিয়ার—কিন্তু লোকটা মদ গিলে যেভাবে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকে, আর—ঘরে খাবার না রেখে রেখে মেয়েটার ওপর যে অত্যাচার করে, তাতে মনে হয় নেলিকেও বুঝি চটানের বে—ইজ্জতি জীবনটা ধীরে ধীরে নিচে টানবে।

গেরু ভালো করে চোখ বুজল। ঘুমনোর জন্য চোখ বুজল। কবরের নিচে মেয়েমানুষটার মতো শক্ত হয়ে শুলো না, একটু ঘাড় কাত করে, কিছুটা ডানপাশ হয়ে শুতে চাইল। কিন্তু সেই চোখে নেলি কেবল উঁকি মারছে। নেলির মাচান, ওর ভাঙা ঘর, এ শয়তানের রাজত্বে ওকে বিব্রত করে মারছে।

কৈলাসও শুয়ে আছে। গোসাপের মতো হাত—পায়ের ওপর ভর করে শুয়ে আছে। মাঝে মাঝে গোসাপের মতো মাথাটাকে একবার পূর্ব, একবার পশ্চিম করছে। মাঝে মাঝে পচাই ঢেলে পচাই খাচ্ছে। কতকগুলো রাতের পোকা উড়ছে ওর মুখের চারধারে। ভাঁড় থেকে কিছু পচাই গড়িয়ে কবর ভিজছে। কৈলাস ভাবল মাটির নিচে মেয়েটার পচাই খেতে শখ জাগছে, সেজন্য এক গেলাস মদ মাটির ওপর ঢেলে দিল। এবং এক সময় যখন বুঝতে পারল শরীরটা মদের নেশায় খুবই টলছে, খুবই অসহায় হয়ে উঠেছে তখন বল্লমটা সে আরও শক্ত করে ধরল। দু আঙুলে একটা চোখ ফাঁক করে রেখে জেগে থাকার চেষ্টা করল, জেগে থেকে শেয়াল—খটাশ পাহারা দিল।

রাত যত বাড়ছে, হারিকেনের আলো তত কমে আসছে। শেষ পর্যন্ত হারিকেনটা নিভে গেল। অন্ধকারে কৈলাস চোখ পরিষ্কার করল। চোখ মুখ ঘষল। অন্ধকারকে ভালো করে দেখার ইচ্ছা। এবং শয়তানের রাজত্বে এই অন্ধকারটাকেই কৈলাসের যত অবিশ্বাস। বাধ্য হয়েই চোখ দুটো এ সময় যেন স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। অন্ধকারে সে ঠিক চিনতে পারে—কোন ঝোপে কোনো শেয়াল উঁকি মেরে আছে।

কিছু দূরে কৈলাস কোনো জন্তুর আওয়াজ শুনতে পেল। গোসাপের মতো শরীরটাকে তুলে দিল কৈলাস। কিছু দূরে পাতা খস—খস করছে। গোসাপের মতো শরীরটা টেনে চলতে চাইল সে। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে কীসের আওয়াজ, কোনদিক থেকে আওয়াজটা আসছে, কতদূর পর্যন্ত যাবে।

আওয়াজটা ক্রমশ এগিয়ে আসছে। বনবেড়ালটা শুকনো পাতার ওপর পা ফেলে ক্রমশ কবরটার দিকে এগিয়ে আসছে। ঝোপের আড়ালে কৈলাসের চোখ দুটো জ্বলছে। বল্লমটা হাতে শক্ত হয়ে উঠছে। সে বল্লম টেনে বলল আ যাও মিঞা, আ যাও। আ যাও বেটা, খুশিসে আ যাও। তুমকো হাম তো পিয়ার করেঙ্গে দোস্ত, জরুর করেঙ্গে। তারপর একসময় বল্লমটা ছুঁড়ে দিয়ে খিস্তি করল—শালাসকল! কৈলাস জন্মেছে ডোমের চটানে, তুই বেটা বনবাদাড়ে—তফাত কত বুঝলি না! আঁধার রাতে চুপি—চুপি হাতসাফাই চালাতে এলি!

মাটির বুক হেঁচড়ে দু কদম সামনে এগিয়ে গেল কৈলাস। বলল, সামনের ঝোপটাকে উদ্দেশ করে, হে রে বেটা থামলি কেনে? কৈলাসকে ডরে ধরেছে? ও কিছু লয়, কিছু লয়। ওয়ার বুড়ো জান, লুট করে পড়লে খুট করে মরবে। ওয়ার ডর কীসের! আ যাও মিঞা!

এই সব বলতে বলতে নেশার ঘোরে কিছুক্ষণ কাঁদল কৈলাস। চটানের যত শোকের কথা মনে করে সে কাঁদতে থাকল। আবার নেশার ঘোরে সে খিলখিল করে হাসল। তখন চটানের যত সুখের কথা ওর মনে হল। জঙ্গলের জানোয়ারগুলো তখন পোড়োবাড়িটার পাঁচিল ঘেঁষে শিমুল গাছটার নিচে এসে থেমে গেছে। কৈলাস যতই শোক করুক কিংবা আনন্দ করুক, ওর চোখ সেখানে। সেজন্য অনেকগুলো চোখ শয়তানের রাজত্বে চারপাশে জ্বলছে।

হাঁটুর ওপর হামাগুড়ি দিয়ে সে সামনের ঝোপটায় ঢুকে পড়ল। সে বল্লমটা খুঁজছে। বল্লমটা খুঁজতে গিয়ে সে ঝোপের আরও ভিতরে ঢুকে গেল। সে অনেকক্ষণ খুঁজে, হাতড়িয়ে বল্লমটা বের করল। তারপর শিমুলের নীচে সেই সব চোখকে উদ্দেশ করে বলতে থাকল, রাজাবালা পাহাড়ে রাত কাটালাম, মুনমুন কাঠের লাগি ঘুরে মরেছি গারো পাহাড়ে, তুলোর পাহাড় দেখে লিয়েছি শ্বেত—শিমুলের গাছ, আর তু হামারে কী ভয় দেখাবি রে বেটা! লক্ষ্মীর মতো চুপ চুপ চলে যা। সরমকী বাত কী আছে এতে? গেরু কী দেখতে পেল—না তুদের দশটা জাতভাই দেখে ফেলেছে?

তা যাবি না, না যাস ভালো। তুকে হাম কিছু বুলবে না, তু ভি হামারে কিছু বুলবি না। বেশ দুজনে ভাব করে লিব। তুর সীমানায় তু, হামার সীমানায় হামি আছে, কোনো হামলা—মামলার কারবার নেই। লেকিন জায়দা বাত হবে তো হেকড় খাবি সড়কির। এই সব বলতে বলতে ক—কদম পিছনে সরে বসল। সে এই সব বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে কিছুটা। সে ঘুমে ঢুলছে। তবু কবরের ওপর জেগে বসে থাকল। কবরের ওপর জেগে পাহারা দিচ্ছে। শেয়াল—খটাশের সঙ্গে টানাটানি করতে হবে মড়া নিয়ে। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়লে তো সব গেল। তখন মড়ার সঙ্গে ওর পা ধরেও টানবে বনবাদাড়ের জানোয়ারগুলো। সেজন্য কেবল সে বকছে। বকে বকে জেগে থাকছে।

সে তার অতীত জীবনকে এখন মনে করতে পারছে আর তাকে কেন্দ্র করেই বকে চলেছে। সে বকল—ডিহিবড়া সাপের চেয়ালগা। সুন্দরবইনা বাঘ—বাবুরা বুলেন রুয়েল বেঙ্গল টাইগার, নীলবানরের মাথা, বুনমানুষের হাড়, কুলকুহলীর গাছ, মরদরাজের মূল—এ ছ—দফের রেণু মিলে কবচ দিলে তার নাম মহাশক্তি কবচবাণ। গুণ আছে বহুত পেকারের—যে আদমি বিছানা খারাপ করে, যার গিটা বাত আছে, আস্বপ্ন—কুস্বপ্ন দেখে, যার বাদী—দুশমন—শত্রু আছে—বাণ মারে, বন্ধন করে, তার লাগি এই কবচবাণ। বড় সামান্য দাম আছে—মাত্তর সওয়া পাঁচ আনা দাম। খুব বেশি দাম লয়, ঘাটে পথে, দোকানে দুশমনে কত পয়সা যায়—মাত্তর সওয়া পাঁচ আনা। এর শক্তি বাবু লোকদের সব আপদ—বিপদে আসান দেবে। কিন্তু তবু ঘুম পায় কৈলাসের। সড়কির ওপর ভর করে দাঁড়াল।

সে জঙ্গলের ভিতর শব্দ শুনতে পাচ্ছে আবার। জঙ্গলের ভিতর জানোয়ারগুলো ঝগড়া বাধিয়েছে। কৈলাস পোড়ো বাড়িটার দিকে পা বাড়াল। হাতের ওপর বল্লমটা উঁচু করে বলল, খবরদার! মুর্দার পানে তুগো এমন খটাশের মতো নজর ক্যান? যা ভাগ, জঙ্গলের ছা জঙ্গলে পালা।

কৈলাস এ—সময় শুনল কারা যেন ছুটে গিয়ে পোড়োবাড়িটাতে উঠেছে। কারা যেন ছুটে গিয়ে পোড়োবাড়িটার চারপাশে নৃত্য আরম্ভ করেছে। এইসব শুনে এবং ভেবে কৈলাস খুব অসহায় ভেবেছে নিজেকে। এইসব শব্দ এবং চিৎকার যেন সে প্রথম শুনছে। অথচ কৈলাসের এমন হয় না। কৈলাস তো কোনোদিন এমনভাবে ভেঙে পড়েনি। সে এই ফরাসডাঙায় একা এসেছে, এক মুর্দা পাহারা দিয়েছে, জল ঢেলেছে এবং একা লাশটার বত্রিশটা দাঁত গুনে গুনে কঙ্কালের সঙ্গে গামছায় তুলে বেঁধেছে, অথচ সে ওর কবচওবচের জন্য, দ্রব্যগুণের জন্য এইসব পির—পরিদের এতটুকু পাত্তা দেয়নি। ওরা পোড়োবাড়িটাতে একবার হাসলে সে হাসত দুবার। সে ওদের ব্যঙ্গ করত। বিদ্রুপ করত। সেই কৈলাস এখন ডাকছে—গেরু ঘুমিয়ে গেলি?

ঘুমে অবশ গেরু কোনোরকমে উত্তর করল, হামারে ডাকছিস বাপ?

শুনে লে তো কারা যেন হাসি—মস্করা করছে।

কৈ শুনতে লারছি। কেবল তো শিয়াল ডাকছে।

থাক, তু ঘুম যা। শালা কানটাই হামার কম শোনে।

খুঁজে খুঁজে এক সময় বল্লমটা তুলে আনল পাশের জঙ্গল থেকে। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল কবরটার পাশে। কোনো আওয়াজ শুনেই সে আর উঠল না। সে আর উঠবে না, যতক্ষণ না ভোর হয়, যতক্ষণ না জানোয়ারগুলি ফের হামলা করতে আসে। সে বসে থাকল এবং বসে বসেই চিৎকার করল, হে—ই—উ, হে—ই—উ। কবরটায় বল্লমটা দিয়ে জোরে জোরে বাড়ি মারল। ভয়ে জানোয়ারগুলো এদিকে আর আসছে না।

শেষরাতের দিকে উঠে গেরুকে ডেকে বলল, তু এবার উঠে বস। হামি পানি লিয়ে আসি ক হাঁড়ি। পানি ঢালতে হবে কবরে।

ক হাঁড়ি জল এনে কবরে ঢালল কৈলাস। জলে মাটিটা এবং মাটির নীচে লাশটাকে পর্যন্ত ভিজিয়ে দিল। জল পেয়ে এবার লাশটা জলদি ফুলে ফেঁপে উঠবে। যত জলদি ফুলে ফেঁপে উঠবে, তত জলদি সে কঙ্কালটা ঘরে নিয়ে তুলতে পারবে। সে জল ঢেলে বলল, এবার হামি ঘুম যাই, তু জেগে পাহারায় থাক।

গেরুকে পাহারা রাখার সময় কৈলাস স্মরণ করিয়ে দিল, দুনিয়ার ভয়—বিস্ময়ের কিছু নাই। —তু তো রাজা রে, রাজার বেটা রাজা। কেউ তুর সঙ্গে বাদী দুশমনি করতে লারবে। তুর বাপ তুকে তিনটে কবচ দিল কত তন্ত্র করে। এ মন্ত্রের কারবার লয়। এ গাছ—গাছালির গুণ জুড়িবুটির কারবার। আমি মরলে তুকে একলা ফরাসডাঙায় আসতে হবে, তখন তু কেবল তিনটে কবচের স্মরণ লিবি। ভয়—বিস্ময় তুর কিছু থাকতে লারবে।

কৈলাস কয়েকটা ডাল কেটে এনে কবরটা ভালো করে ঢেকে দিল। শেয়াল—খটাশের দুশমনি থেকে দিনের আলোয় কবরটাকে রক্ষা করল।

কৈলাস এক সময় রাস্তায় বলল গেরুকে, কী রে ভয় ধরেছিল রাতে?

গেরু ভোরের দুনিয়ার রঙ মেখে বলল, না, ডরে ধরেনি। ওরা দুজন তখন চটানের দিকে যাচ্ছে।

শীতের উত্তুরে হাওয়া আজ আর নেই। তাজা চিতাটার পাশে একদল লোক একটা মড়া নিয়ে অপেক্ষা করছে। ঘন কুয়াশার ভিতর ওদের স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। ঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে দুখিয়া। ঘাটোয়ারিবাবু গঙ্গায় স্নান সেরে জপতপ করতে করতে ফিরছেন। কতকগুলো কুকুর চালাঘরটার পাশে পড়ে থেকে রোদের উত্তাপ নিচ্ছে। অন্য পারে যুবতী মেয়েরা ঘাটে কাপড় কাচছে, কাপড়—কাচার শব্দ ওপারে ঠুকঠুক করে প্রতিশব্দ তুলছে। দূরে শীতের গঙ্গায় পুল উঠছে। ওপারে ট্রেনের শব্দ। রিকশার ভিড়। যাত্রীরা সব নেমে আসছে। সেসময় গেরু অনর্থক বল্লমটা চালাঘরটায় ছুঁড়ে দিল। কুকুরগুলো ভয়ে চিৎকার করে উঠল। ওরা ভয়ে ছুটছে বল্লমের তাড়া খেয়ে। ওরা নদীর পাড় ধরে ছুটল। অথচ বেশিদূর যেতে পারছে না। তখন গেরু দেখল কিছু দূরে কুকুরগুলো যে—পথ ধরে উঠে গেল—সেখানে নেলি চুপচাপ বসে আছে। নেলির কাছে গিয়ে বলল গেরু, দেব শালা কুকুরকে আর একটা হেঁকড়।

নেলি উত্তর করছে না। কোনো জবাব দিচ্ছে না। অথবা গেরুর দিকে একবার মুখ তুলে তাকাল না।

তখন ঝাড়ো ডোম ঘাটে এসে শ্মশানের বাঁশ সংগ্রহ করছে। গেরু হাতে বল্লম দুলিয়ে এখানে হেঁকড়, সেখানে হেঁকড় দিতে দিতে নেলির চারপাশটায় ঘুরছে। লখি, টুনুয়া ঘাটে নেমে এসেছে। ওরা মড়াটাকে উঁকি মেরে দেখছে। মড়ার তোশক—চাদর দেখছে। ওরা তারপর উঠে গেল! নেলিও উঠল। ওদের সঙ্গে সে—ও কাঠ বইবে। গেরু হাতে বল্লম দুলিয়ে এখানে হেঁকড় সেখানে হেঁকড় মারতে মারতে নেলির পিছু পিছু হাঁটছে। নেলির সঙ্গে সে—ও কাঠ বইবে। যে দু—চার পয়সা হবে—নেলিকে সবটা দিয়ে দেবে এমনও ভাবল গেরু। চটানে ওঠার আগে নেলির কানে কানে বলল, ভয়ডরকে জিতে লিচ্ছি। এই মুহূর্তে নেলিকে ফরাসডাঙায় ঘটনার কথা বলে নেলির যুগ্যি মরদ হওয়ার ইচ্ছা। নেলি শুনে যেন ভাবে—মরদ আছে বটে। মরদের মতো মরদ। কিন্তু নেলির বিষণ্ণ মুখ দেখে এবং দুদিনের অভুক্ত শরীরটার দিকে চেয়ে সে কিছু বলতে পারল না। ওরা দুজন চুপচাপ একসঙ্গে চটানে উঠে এল। ঘাটোয়ারিবাবুর অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকল। কখন বাবু ডাকবে, ওরে বাপ, আমার চোদ্দপুরুষের মনিব, গঙ্গাপুত্তুরের দল, একবার একটু ইদিকে আয়। মড়ার দায়টা আমার খালাস কর। ওরা সকলে অপেক্ষা করছে। বাবু ডাকবেন—ওরা যাবে। কাঠ মাপবে, কাঠ নিয়ে ঘাটে নামবে।

ঘাটোয়ারিবাবু এক সময় ডাকলেন, কৈ রে তোরা?

এই যে বাবু আমরা। নেলি জানালার নিচ থেকে উত্তর করল।

কে রে? নেলি!

জি বাবু।

কাল গহনা পেলি?

নেলি উত্তর করছে না।

ভেবেছিস আমি কিছু টের করতে পারি না।

নেলি তখনও কোনো উত্তর করল না।

এই মাগি, কথা বলছিস না কেন? গহনা পেলি?

নেলির ইচ্ছা হল সহসা চিৎকার করে ওঠে—না, না!

চালাঘর থেকে হারিকেন খুলে নিয়ে রাতে তাজা চিতায় পড়ে থাকলি। কিছু হল?

না বাবু, কিচ্ছু হয়নি।

ফের মিথ্যা কথা বলছিস?

না বাবু, কিচ্ছু হয়নি। গঙ্গা মায়ীকি কসম।

ঘাটের কাঠ বয়ে পেট ভরবে?

নেলি এবারেও কোনো জবাব দিল না।

ঘাটোয়ারিবাবু রেগে উঠলেন,—ভেবে রেখেছিস আজও চটানে উপোস দিবি? ও—সব হবে না। এ—চটানে ও—সব হবে না। জিয়াগঞ্জ চলে যেতে বলবি তোর বাপকে। সেখানে গিয়ে যত খুশি উপোস করগে। কেউ কিচ্ছু বলবে না। যাবি। কাল নির্ঘাত চলে যাবি।

নেলি জানালার নীচে দাঁড়িয়ে হাসল। ঘাটোয়ারিবাবু ফের কষ্ট পেতে শুরু করছেন। এবং এই উপযুক্ত সময় ভেবে সে বলল, বাবু……

বল।

বাবু, একটা টাকা ধার দিবি?

আমি তো একটা গাছ—ঝাড়া দিলেই পড়বে।

নেলি সাহস করে আর বলতে পারল না কিছু। যেখানে কাঠ মাপা হচ্ছে সেখানে চলে গেল। গেরুও নেলির সঙ্গে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই বাবু ডাকলেন—তোর বাপ ফরাসডাঙা থেকে ফিরল?

জি ফিরেছে।

ওকে ডেকে দে। কথা আছে।

গেরু ডাকল, বাপ, তু আয়। তুকে ডাকছে বাপ।

দূর থেকে কৈলাস বলল, হামাকে কিছু বুলছেন বাবু?

জি হুজুর, আপনাকে কিছু বুলছি। ঘাটোয়ারিবাবু রাগে এখন বসে বসে হাত কচলাচ্ছেন। তিনি কৈলাসকে বড় বড় চোখে দেখছেন এখন।

জানালার পাশে এসে কৈলাস দাঁড়াল। রাত জেগে ওর চোখ দুটো লাল। চোখ দুটো খুব বসে গেছে। দাঁড়িয়ে থাকতে ওর কষ্ট হচ্ছে। জানালার ওপর যতটা পারল ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। বলল, বুলেন বাবু।

ভিতরে আর হারামজাদা, ভিতরে আয়।

ভিতরে গিয়ে কৈলাস একই কথা বলল, বুলেন বাবু।

বুলেন বাবু! ব্যঙ্গ করলেন তিনি। কী বলব রে বেটা ডোম! তোকে বলবটা কী শুনি? তোকে বললে ব্যবস্থা করতে পারবি? সামলাতে পারবি সব?

কী সামলাব বাবু?

বৌকে সামলাবি। বৌকে সাবধান করে দিবি। সাবধান না করিস তো পুলিশে খবর দেব।

এতক্ষণে কৈলাসের যেন হুঁশ হল। এতক্ষণ কৈলাস খুব ভাবনায় পড়ল। মুখটা ভয়ে খুব শুকিয়ে গেল।

কী হয়েছে মেহেরবানি করে বুলেন বাবু। না বুললে যে কিছুই বুঝতে লারছি।

পারবি, পারবি। সব পারবি। ঠেকায় পড়লে পারবি।

কৈলাস ঘাটোয়ারিবাবুর পা দুটো জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করল। পুলিশকে ওর ভীষণ ভয়। ঘাটোয়ারিবাবু ইচ্ছে করলে যে—কোনো সময় ওকে জেলে ভরে দিতে পারেন। তাই সে কেনা গোলামের মতো বলল, আপনি কিছু করে লিবেন না বাবু! যা করে লিবেন এখানে করে লেন। পুলিশকে খবর দিবেন না বাবু! চটানের মা—বাপ তু আছে।

তোর বৌর জন্য রাতে ঘুমুতে পারিনি রে বেটা ডোম! গোটা রাত দরজায় এসে হামলা করেছে।

কৈলাস এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হল। জবাব দিল খুশি হয়ে—ওঃ, তার লাগি। তা দেব। এয়াকে সাবধান করে জরুর দেব। ও বেটি হারামি আছে বাবু। কথায় বুলে—পুরুষমানুষের ছ গুণ মেয়েমানুষের ল গুণ। বুড়া হাড়ে হামার আর রস নাই বাবু। শালী হামার কেবল রস চিবাতে চায় গ। পায় না তাই এখানে সেখানে ঢুঁড়ে বেড়ায়।

কিন্তু তিনি আর এক ধমক দিলে কৈলাস সুড়সুড় করে চটানে নেমে গেল। কৈলাসের এ—বৌ শেষ বয়সের। তৃতীয় পক্ষের। গেরুর মা নেই সে অনেক কাল। সে স্ত্রী দ্বিতীয় পক্ষের। কৈলাস তার হেকিমি জীবনে বৌটাকে তিন মাসের গেরুর সহ নিকা করেছিল। কিন্তু বড় দুর্ভাগ্য, দু—বছরও গেল না, বৌটা পালাল। তারপর অনেক কাল কেটেছে কৈলাসের। তখন স্ত্রী ছিল না, ঘর খালি ছিল। গেরু ছিল একা। পরের বাচ্চাটা নিজের বাচ্চার মতো হয়ে যাচ্ছে। সে বাচ্চাকে সে পুষে পুষে এতদিন বড় করেছে। এবং এ—বৌটা এসেছে কিছুদিন। ইদানীং কৈলাস জোগাড় করেছে। কোত্থেকে, কেমন করে জোগাড় করেছে চটানের মানুষগুলো তার খবর রাখে না। শুধু ওরা এক সন্ধ্যায় দেখেছে কৈলাস কাটোয়া গিয়েছে। তারপর আর এক সন্ধ্যায় দেখেছে, কৈলাস চটানে ফিরেছে। নেশায় বুঁদ হয়ে আছে মানুষটা। একটি মেয়ে ওকে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে তুলল। কৈলাসের ঘরে ঢুকল মেয়েটা এবং শেষ পর্যন্ত সেই কৈলাসের বৌ হয়ে চটানে থেকে গেল।

পরদিন ভোরে সকলের দরজায় দরজায় বৌকে নিয়ে ঘুরল কৈলাস। নতুন নিকে—করা বৌকে সকলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। ঘাটোয়ারিবাবুর পায়ে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল এবং বলেছিল—চটানের মা—বাপ আছে। পেরণাম কর বাবুকে।

অফিসঘরের নিচে নেমে দেখল কৈলাস ডানদিকের চালাঘরটায় ঝাড়ো কতকগুলো বাঁশ নিয়ে ঢুকছে। দুখিয়ার ঘরে মংলি তোশক—লেপ থেকে টেনে টেনে তুলো বের করছে। কাটোয়া থেকে লোক আসার কথা। তোশক—লেপের তুলো, বালিশের তুলো, লোকটা মাথায় করে নিয়ে যাবে। নতুন লেপ হলে কাঁচা টাকায় বিক্রি। মংলি এখন যেন সেই লোকটার অপেক্ষাতেই আছে। কৈলাসকে দেখে মুখটা ফিরিয়ে নিল মংলি। তখন ঝাড়ো বলছে, কিরে কৈলাস, কিছু মিলল?

কৈলাস জবাব দিল না। জবাব দিতে ভালো লাগছে না। সারারাত জেগে শরীর দিচ্ছে না। ইচ্ছে হচ্ছে মাটির উপরই শুয়ে পড়তে। তবু সে যতটা পারল হেঁটে হেঁটে গেল। যাচ্ছে নিজের ঘরটার দিকে। পাশে শুয়োরের খাটাল। বাবুচাঁদ শুয়োর নিয়ে বের হয়ে পড়েছে। গোমানির ঘরে গোমানি উঠেছে। সে বসে বসে খিস্তি করছে। মাচানের নিচে বসে নসিবকে গাল দিচ্ছে। কিন্তু কী বলছে বোঝা যাচ্ছে না। কৈলাসবাবুদের বাড়ির রেডিয়োর বাজনা শুনল। পাঁচিল টপকালেই বাবুদের পাড়া। সব কাক উড়ে গেছে বাবুদের পাড়ায়, শুধু দুটো কাক এখন চটানে পড়ে খুদ—কুঁড়ে খাচ্ছে। ঘাটের কাপড় শরীরে পেঁচিয়ে মংলি তখন ভাঙা আরশিতে রূপ দেখছিল আর কাক তাড়াচ্ছিল উঠোনে। কাটোয়া থেকে লোকটার আসার কথা। আরশিতে মুখ দেখার সময় লোকটার পুষ্ট গোঁফ সে আরশিতে দেখল। দুখিয়ার গোঁফ—দাড়িবিহীন মুখটা নেলির মুখকে কুঁচকে দিয়েছে। মাঝে মাঝে সেজন্য মংলি এ—চটান ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে চায়। লোকটা কী যেন ইশারা দেয়, আর মংলি তখন আরশিতে কেবল মুখ দেখে।

কৈলাস ঘরে ঢুকে দেখল বৌটা প্রায় উলঙ্গ। মেঝের ওপর বৌটা পড়ে ঘুমোচ্ছে। সে বৌটার পাশে দাঁড়াল। ঘরটার আনাচে—কানাচে চোখ বুলাল একবার। ঘরে সব কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। হাঁড়ির মুখে ঢাকনা নেই। হাঁড়িতে পান্তাভাত। মালসাটা নিচে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। মাছিরা হাঁড়ির মুখে উড়ছে বসছে। এ—শীতেও ওরা ভনভন করছে। ঘরের চারিদিকটা কদর্য কুৎসিত হয়ে আছে। নোংরা কাঁথা—কাপড়গুলো মাটিতে পড়ে আছে; কিছু বৌর বুকের কাছে উঠে এসেছে। এমনকি পরনের কাপড়টা পর্যন্ত। এইসব দেখে পিঠে লাথি মারার শখ হল। দাঁত ভেঙে দেওয়ার ইচ্ছা কৈলাসের। সে গেরুর মা—র দাঁত ভেঙেছিল লাথি মেরে। এ বৌর দাঁত কোমর দুই—ই। তবে ঘাটোয়ারিবাবুর দরজায় হামলা করতে পারবে না। রসের জন্য দরজায় দরজায় ভিখ মাংতে হবে না। ঘরে পড়ে থেকে কেবল গোঙাবে। এবং পানি খেতে চাইবে সকলের কাছে।

এই পিঠে লাথি মারতে যতটুকু শক্তির দরকার, কৈলাসের এখন যেন তাও নেই। সে ডাকল, উঠ হারামি, উঠ। পা দিয়ে কৈলাস শরীরটাকে ঠেলতে থাকল। উঠলি না, উঠলি না তু! গোটারাত ঘাটোরিবাবুকে জ্বালিয়ে এখন ঘুম দিয়ে লিচ্ছিস! আচ্ছা মানুষের সাথ তু কারবার করতে গেলি! সরম আসে না তুর! মুখে তু হামার চুন দিলি!

কৈলাস ঘরের কোণায় ঠেস দিয়ে রাখল হাতের সড়কিটা! মদের ভাঁড়টা মাচানের নিচে রেখে দিল। হারিকেনটাও। মাচানে বসে সে বিড়ি ধরাল। বৌটা আড়মোড়া ভেঙে উঠছে। অপমানে ফেটে পড়ছে চোখ দুটো। গরল ওঠার আশঙ্কা! গরলে যেন এখুনি ফেটে পড়বে। কিন্তু কৈলাস শক্ত নজরে চাইতেই ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেছে সে। সেজন্য গা ঝাড়া দিয়ে উঠল, অথচ কিছু বললে না। এক কোণায় সে সরে গিয়ে দাঁড়াল।

কৈলাস মাচানে দু ঠ্যাং ছড়িয়ে দিয়ে বলল, দু—ঘটি জল লিয়ে আয় লদী থেকে। হামি চান করে লিব।

মেটে কলসিটা কাঁকে নিয়ে বৌ ফের তাকাল কৈলাসের দিকে। চোখ দুটো দেখে এখন খুব নিরীহ মনে হচ্ছে। মায়া মাখানো মনে হচ্ছে। কে বলবে এ—চোখ দুটোই মাঝে মাঝে আগুন হয়ে ওঠে, সাপের মতো হয়ে ওঠে, কখন ছোবল মারবে কৈলাসকে! তখন কৈলাসকে পর্যন্ত চটান ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়। অথচ সেই বৌ কথার জবাব না দিয়ে ঘাটে জল আনতে চলে গেল। এই সব দেখে কৈলাসের খুব মায়া হল বৌটার জন্য। সে ভাবল, ও ঠিকই করেছে। ওয়ার তো ল গুণ। ওয়ার কোন দোষ আছে? মহাশক্তি কোমরবাণ হিম্মত ওয়ার নেই। সে তার কবচের কথা ভাবল। সবই ধাপ্পাবাজী। কৈলাস কিছুকাল থেকে ওর কবচের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে এই ধরনের কথা বলতে শিখেছে। সে একটু কাত হয়ে শুলো। যতক্ষণ বৌটা ঘাট থেকে না ফিরছে, ততক্ষণ শুয়ে থাকা, ততক্ষণ এইসব ভেবে সুখী হওয়া যাক। অথবা জ্বালা থেকে আসান পাওয়ার জন্য যেন সে চোখ বুজল।

কৈলাসের ইচ্ছা নয় গেরু জানুক মহাশক্তি কবচবাণ, মহাশক্তি কোমরবাণ, পুন্নপদের মাদুলিতে কোনো দ্রব্যগুণ নেই। ইচ্ছা নয় এইসব মাদুলির ওপর গেরুর বিশ্বাস ভেঙে যাক। কারণ এ—চটান বড় বেইমান। সহজে সে দু মুঠো কাউকে খেতে দেয় না। কৈলাস মরে গেলে গেরুকেও দেবে না। গেরু না খেতে পেলে ফের চটানে ভুখা থাকতে শুরু করবে। গোমানির বিটির মতো এ—ঘর সে—ঘর করবে। তাই সে মড়ার হাড় খুঁজতে যাওয়ার সময় ওকে সঙ্গে নিয়েছে; দ্রব্যগুণের কথা বলেছে। বলেছে, এ—মাদুলি দেহে ধারণ করলে, পির—পরি, সাপখোপ, জীন—দৈত্য কিছুতে নাকাল করতে পারবে না। বলেছে, ডানপুকুসে টান মারতে পারবে না। কবচের প্রতি গেরুর বিশ্বাসকে অক্ষয় অমর করার জন্য, চটানে দ্বিতীয় পক্ষের বৌটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এমন অনেক মিথ্যা বলেছে, যা সে একদা ওস্তাদ গুরু হারুন রসিদের কাছ থেকে শিখে ভেবেছিল, দুনিয়ার ঈশ্বর যদি সত্যি হয় তবে আল্লার কসম খেয়ে সে বলতে পারে এ জুড়িবুটির মাদুলিও অক্ষয় সত্য। সেই অক্ষয় সত্যের ওপর নির্ভর করেই সে ফরাসডাঙার ঝুমঝুমখালিতে বসন্ত—কলেরার এবং যত বেওয়ারিশ মড়ার কঙ্কাল সংগ্রহ করে বেড়িয়েছে। কোনোদিন যদি আঁধার রাতে সে হেলে পড়ত ভয়ে, দুহাত উপরে তুলে, আকাশে বল্লম ছুঁড়ে চিৎকার করে উঠত, ওস্তাদ হারুন রসিদের দোহাই! গেরুকেও বারবার সেই দোহাই দিয়ে শক্তি সঞ্চয় করতে বলেছে। কারণ, কৈলাস জানে গেরুকে কঙ্কালের পয়সাতেই চটানে টিকে থাকতে হবে, চটানে বেঁচে থাকতে হবে।

হারুণ রসিদ ওর ওস্তাদ গুরু—মাচানে শুয়ে শুয়ে সে তার হেকিমি জীবনের কথা ভাবল। মানুষটা কালীর সাধনা করত—অদ্ভুত মানুষ। ভোরে ঠিক সূর্য ওঠার আগে তিনি গুহায় ঢুকতেন। গুহার মুখে পাথর চাপা দিয়ে রাখতেন এবং ভিতরে পড়ে ঘুমুতেন। সূর্য—অস্ত যাওয়ার পর পাথর ঠেলে বাইরে আসতেন এবং পাঁচ ওক্তের নামাজ পড়তেন। তখন সব সাগরেদরা আসতে শুরু করত পাহাড়ের ঢালু ধরে। ওরা এসে একে একে জমা হত। সেই জনহীন পাহাড়ঘেরা দরগার ময়দানে এ—চটানের মতো নাচন—কোঁদন হত তখন। ঝাড়ফুঁক, তন্ত্র—মন্ত্র জুড়িবুটির কারবার হত সেখানে। কোথায় শ্বেতশিমুলের ছাল মিলবে, দুই সতীনা গাছ পাওয়া যাবে, কোন গুহায় নীলবানরের মাথা মিলবে—সবকিছুর হদিস দিতেন ওস্তাদ গুরু হারুন রসিদ। আর কৈলাসকে বলতেন, রাহুচণ্ডালের হাড় না হলে কোনো কবচওবচে কাজ দেবে না। তুই তো ডোমের বাচ্চা রে মরদ, রাহুচণ্ডালের হাড় জোগাড় করতে কত আর সময়! জোগাড় কর—মা চণ্ডীর থানে স্পর্শ পাইয়ে দি হাড়টায়, গাছগাছালির নাম করে দিচ্ছি, সব মিলিয়ে পুন্নপদের মাদুলি দে, মহাশক্তি কবচ দে—পারিস তো মহাশক্তির কোমরবাণও দিবি।

কাছাড়ের সেই রসিদের দরগা, সেই পাহাড়ের দরগার ময়দান, সেই গুহার ভেতর মা চণ্ডীর থান, সেবাইত রসিদ, শাগরেদ মিঞাচাঁদ, বুনো ঠাকুর, হরিশ চণ্ডালে—সব এক এক করে ওর চোখের ওপর এসে ভাসতে থাকল। সে এক জীবন গেছে কৈলাসের। মাইলের পর মাইল হেঁটে গিয়ে গঞ্জের হাট করেছে, ব্যাখ্যা করেছে গুরুর দ্রব্যগুণের কথা, জুড়িবুটির কথা। তখন কত মন্ত্র—তন্ত্র করে ভূত—প্রেত ছাড়িয়েছে মানুষের শরীর থেকে। আঁধার রাতে হেঁটে কৈলাস তখন সওদা এনেছে কত। গুরুর পায়ের নীচে বসে মহাশক্তি কোমরবাণের ব্যাখ্যা শুনেছে মন দিয়ে। সে ব্যাখ্যা বসে বসে মুখস্থ করেছে। এবং সে তার হেকিমি জীবনে ওস্তাদের সেই কথাগুলো টেনে টেনে ভেঙে বলেছে—এ বারো প্রকারের তন্ত্র আছে। হাতে সরু একটা ছিপের মতো লাঠি থাকত তখন। গঞ্জের হাটে চাদরের ওপর বিছিয়ে রাখত বনরুইমাছের ছাল, হরিণের সিং হেমতাল কাঠ, গোঁড়ের বাঁশ, কালী ঝাপ, নরসিং ঝাপ, দুর্গা ঝাপ। তলায় রাখত কালনাগিনীর গাছ, শ্বেত—শিমুলের ফল, ময়রুন বিবির ফুল! ময়রুন বিবির ফুলের কাছে এসে ছিপের ডগাটা থামত। চোখ দুটো ওর টাটাত। চোখ দুটো রগড়ে বলত, এ ফুল আরব থেকে লিয়ে আসতে হয়। হজের মানুষ হজে যান, লিয়ে আসেন এ ফুল। প্রসূতির বাচ্চা হয় না, ব্যথাবেদনায় হুম হুম করছে, কথাবার্তা বেমালুম গণ্ডগোল, জল লেন, ময়রুন বিবিয়ে ডুবিয়ে দ্যান—সাদা জলটারে মিঠাই দিয়ে খাওয়ান, বিবি আপনার আসান পাবে জরুর। পোয়াতির বাচ্চা হতে জেরা সময় লেবে।

গঞ্জের হাটে এই সব হেকিমি ব্যাবসা করত কৈলাস। ওস্তাদ গুরুর জীয়নহাড়টা সঙ্গে নিত। সোয়া পাঁচ আনা দাম চাইত তাবিজের জন্য। তাবিজটা দেওয়ার আগে রাহুচণ্ডালের হাড়ে ঠেকিয়ে দিত। বলত লেন—পোয়াতির কোমরে বেঁইধে দ্যান।

কাছাড় দরগা থেকে পালিয়ে এসে একদা কোর্ট—কাছারিতে এই ব্যাবসাই করত কৈলাস। কোর্ট—কাছারির কোনো পুরানো অশ্বত্থের ছায়ায় সে দাঁড়াত। একটা চাদর বিছিয়ে রাখত নীচে। গাছগাছালিগুলো সারি সারি সাজানো থাকত। একটা হারিকেন থাকত। আর থাকত ডোমন সা। শাগরেদ ডোমন সা। সারাদিন চেঁচাত কৈলাস। মুখে থুথু উঠত থুথু ছিটাত চারপাশে এবং দরগার মতোই ব্যাখ্যা করত বিশল্যকরণী গাছের, দুই সতীনা গাছের। তখন কত লোক জমত চারপাশে। কোর্টের লোক, মামলা—মোকদ্দমায় হার—জিতের লোক। ওরা কৈলাসকে দেখত, কৈলাসের খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটা দেখত।

কোনো কোনো সময় ছিপের ডগা ছুঁইয়ে হাঁটু দুটো সামনে এনে কাঁপাত। সরু কোমরটা ভেঙে দিয়ে চোখে—মুখে অমানুষিক ভাব ফুটিয়ে তুলত। বলত, এ হল গিয়া কুম্ভীরের লিঙ্গ। তারপর খুদে খুদে দুটো চোখ নিয়ে সকলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকত। মানুষগুলোর মনে তন্ত্রের নেশা ধরানোর চেষ্টা করত, এবং যখন দেখত নেশা বেশ ধরে এসেছে তখন সে একঝলক হেসে বলত, এবার বেমাফিক দু—চারঠো কথা বলে লিব, নিজ দয়াগুণে বাবুলোকে মাপ করে লিবেন। এই যে ছোট সাদা তন্ত্র দেখলেন, মালোম লিশ্চয়ই আসছে—এ হল গিয়া কুম্ভীরের লিঙ্গ। এ চীজ বহুত লাখোটিয়া চীজ, বহুত দাম। যখন তখন পাবেন না, যেখানে সেখানে মিলবে না। বেনাতি মণিহারি দোকানে যান, কাম কারবার করেন, লেকিন চীজ আপকো নাহি মিলছে। হে আছে, লাখোটিয়া চীজ ভি আছে। লেকিন কাঁহা পাবেন, কাঁহা আছে? বড় বড় পুরানা কবরাজবাবু আছে, উসকা পাশ যান—পাবেন। দাম ভি বহুত আছে, দশ কুড়িতে ভরি হবে।

এ সময় একটু থামত কৈলাস। জোরে জোরে শ্বাস নিত, হাঁপের টানের মতো শব্দ উঠত গলায়। কৈলাস চাদরটার চারপাশে এক পাক হাঁটত। সরু ছিপটা হাতে থাকত—তখন চেঁচাত না, ছিপটার দুটো ডগা দু—হাতের মুঠোতে রেখে একটু বাঁকিয়ে সকলের চোখের সামনে তুলে ধরে বলত, দেখে লেন। বাবুলোগ! খুব ধীরে ধীরে বলত। পারলে ইশারায়। তারপর কৈলাশ পা তুলে নাচতে আরম্ভ করত। চাদরটার চারপাশে সে ঘুরপাক খেত হেঁটে হেঁটে—যেন নেচে নেচে সে হাঁটছে। ওর মুখের কথার সঙ্গে পা দুটোর মাত্রা ঠিক থাকত। সে বলত, আমার দেহ আপনার দেহ এ ছিপের লাখান। খাওয়ান—দাওয়ান বেশ আছে, কিন্তুক ঘুণে ধরলে বোঝবার জোটি লাই। কবে ঘুণে ধরল সেটি টের পাবেন না। তবে বাত আছে এক, ভাঙেন মচকান টের করতে পারবেন অন্দরে ঘুণ ঘুইসে গেছিল। বাবুভাই, আপনারা ফিটফাট থাকেন বাইরে, মাস্তানের মতো চলেন ফেরেন, টের পাওয়া যায় না অন্দরে ঘুণ আছে কি না আছে। তবে বিবির কাছে গেলে সব নজর আসে। তার লাগি বলি বাবু মহাশক্তি কোমরবাণ। সকলের চোখের সামনে কৈলাস তাবিজটা তুলে বলত, দাম মাত্র স পাঁচ আনা।

কোর্ট—কাছারির ময়দানে অশ্বত্থের ছায়ায় অনেকক্ষণ ধরে মহাশক্তি কোমরবাণের ওপর অশ্লীল আলোচনা করত কৈলাস। পাঁচ—সাত টাকার বিক্রি তুলতে সাঁজ নেমে আসতে ময়দানে। শাগরেদ ডোমন সা পাশের একটা কাঠের বাক্সে সব গাছ—গাছালি তুলে সাজিয়ে রাখত। সন্ধ্যার ঘন আঁধারে হারিকেন জ্বালিয়ে চটানের পথ ধরত তারা। শহরের পথ ধরে এলে ঘুরতে হবে ভেবে সে গঙ্গায় নেমে সোজা এসে চটানে উঠত, এবং ঝোপ—জঙ্গল ভেঙে চটানে ফিরতে বেশ রাত হত তার।

গেরুর মা তখন চটানে এসেছে। তিন মাসের বাচ্চাটাকে নিয়ে জিয়াগঞ্জের চটান থেকে কৈলাসের সঙ্গে এ চটানে উঠে এল। হেকিমি—দানরির পয়সায় কৈলাস বৌয়ের মন ভুলাল। বৌটা নতুন শাড়ি পেল, নাকের নথ পেল, সোনার পাতের চুড়ি পরল হাতে। খুব খুশি খুশি মন। জিয়াগঞ্জের চটানে যে না খেতে পেয়ে শুকনা কাঠের মতো রঙ ধরেছিল, এ চটানে এসে সেই বৌ লাউডগার মতো রূপ খুলে ধরল। আহা কী রূপ! কী রূপ! চটানে ফেরার সময় কৈলাস সারাক্ষণ গেরুর মা—র রূপ নিয়ে মনে মনে কোন্দল করত। মনে মনে নিজের বয়েসটার কথা ভেবে মুখ মুষড়ে পড়ত। উত্তর—চল্লিশের কৈলাসকে গেরুর মা—র কাঁচা বয়স সহ্য করবে কিনা ভেবে সারা পথ অন্যমনস্ক হত। তাই প্রথম যৌবনটাকে ফিরে পাবার জন্য অনেক বাছ—বিচার করে, অনেক তন্ত্র—মন্ত্র পড়ে, দেহে ধারণ করেছিল মহাশক্তি কোমরবাণ। বিটি—মানুষের ল গুণ পুরুষমানুষের ছ গুণ। তার ওপর ভাঙা বয়সটা ওকে কেবল বিরক্ত করে মেরেছে। সারাক্ষণ এই সব ভেবে নিজের দেওয়া তাবিজ নিজেই ধারণ করল এবং ভাবল তাবিজের দৌলতে ওর জীবনীশক্তি অনন্ত। ভেবেছিল দেহের আর অপচয় নেই। দেহে ঘুণ ধরবে না, ভাঙবে না, মচকাবে না। মেয়েমানুষের ল গুণকে সে পুষিয়ে নিতে পারবে।

চটানে ফিরতে রাত হয় কোনোদিন। গভীর রাত। গেরুর মা তখনও ঘুমিয়ে পড়ত না। ঘাটের কাঁথাকাপড় গায়ে জড়িয়ে শীতের রাতে কৈলাসের অপেক্ষায় মাচানে বসে থাকত। বসে ওর জন্য অপেক্ষা করত—কখন খাবে, কখন শোবে, কখন ঘুমোবে সেই আশায়। খেতে বসে কৈলাস গেরুর মা—র ভারী ভারী চোখ দুটো দেখে কঠোর উত্তেজনা বোধ করত। তারপর বৌটাকে নিয়ে যেত মাচানে। গেরু যদি কেঁদে উঠত এ—সময়, কৈলাসের মেজাজ বিগড়ে যেত। বলত, সময়—অসময় নাই বেটার! নেমকহারাম শালা হামার! ভোর—রাতে যদি কৈলাস কোনোদিন জাগত, যদি দেখত বৌটা একটু উচ্ছৃঙ্খল ভাব নিয়ে শুয়ে আছে, তখন ফের গেরুর মাকে কাছে টানার চেষ্টা করত। ফের উত্তাপ জমা হত মাচানে। ফের মাচানে গোঙানির শব্দ উঠত। এবং এ—ভাবে গেরুর মাকে কেন্দ্র করে কৈলাস তার অনন্ত জীবনীশক্তির পরীক্ষা দু—দুটো বছর ধরে চালিয়েছিল। দু বছর একসঙ্গে থেকেছে, বসেছে, উঠেছে, একসঙ্গে সাঁঝের আঁধারে মদ খেয়ে হৈ—হল্লা করেছে চটানে, আর রাতের পর রাত তাবিজের দৌলত পরীক্ষা করেছে গেরুর মা—র উপর।

শাগরেদ ডোমন সা বারান্দার এক কোণায় পড়ে থাকত। ওস্তাদের নিকা—করা বৌর কান্না শুনতে পেত মাঝরাতে। ভোরবেলায় ওস্তাদের বৌকে বলত, লিব নাকি কিছু? সে কাঠের বাক্সটা কাঁধে নেওয়ার সময় ডাগর দুটো চোখের দিকে চেয়ে বলত, ওস্তাদের সব ভুলভাল হয়ে যাবে। হামি লিব নাকি কিছু? আপ বুলিয়ে দিন। হামি ঠিক ওস্তাদকে স্মরণ করিয়ে দেবে। হামি লোক ঠিক আছে, আপনি বুলেন।

শাগরেদ ডোমন সা—ই তখন মোটঘাট বইত। চাদর বিছাত। জুড়িবুটিগুলো সাজিয়ে রাখত চাদরে। কোনোদিন সে তন্তর—মন্ত্রর শিখত কৈলাসের কাছে।

কৈলাস বলত, শিখে লে শালা! তোর ওস্তাদ হামি, হামার ওস্তাদ রসিদ। সব ওস্তাদের জয়—জয়কার দিয়ে বুলে ফ্যাল হেকিমি—দানবি দশ—পঁচিশ দফে বেইমান মানুষের কাজে লাগে। আওর এ দফে শুনে রাখ শালা, বেম্ম চণ্ডালের হাড় লাগবে। জীয়ন হাড় যাকে বলিস। সেই রাহুচণ্ডালের হাড় না হলে আর তুর চলছে না। গাছ—গাছালির গুণ, জুড়িবুটির জেরাসে কারবার। দুরোজের বাত আছে ও।

কৈলাসের তৃতীয় পক্ষের বৌ শুয়োরের খাটাল পার হয়ে তখন এক—কলসি জল রাখল উঠোনে। কিন্তু কৈলাস তখনও ঝিম মেরে সামনে শুয়েছিল। সে তার চটানের অতীত কথাগুলো ভাবতে ভাবতে শেষ বয়সের বৌটার দিকে ভালো করে নজর দিয়ে দেখল। এ বৌটাও হয়তো এক রাতে চটানের কোনো মরদের সঙ্গে উধাও হয়ে যাবে। তার চেয়ে বরং ভালো এখন যদি ওর সব ক’টি দাঁত ভেঙে দেওয়া যায়। আর কিছু না হোক, চটানের উঠোনে সারাজীবন তবে পড়ে থেকে গরল তুলতে পারবে। চটান থেকে উধাও হবার ভয় থাকবে না।

কৈলাস উঠে দাঁড়াল। চালার বাইরে এসে খেঁকিয়ে উঠল। খুব জোরে চেঁচালে চোয়ালের লম্বা দাঁত দুটো বাইরে ঝুলতে থাকে। এখন দাঁত দুটো ঝুলছে। সে বলছে, পানি দিয়েই তুর কাম খালাস হল রে ডোমনী! আওর কুচ দিবিনে?

বৌ নাকের নথ দুলিয়ে ঘরে ঢুকল। বিড়বিড় করে কী সব বকল। কিছুক্ষণ পর একটা পিঁড়ি বের করে দিল বাইরে। পিঁড়িটার ওপর বসে কৈলাস স্নান করবে। পিঁড়ি বের করে নিচু গলায় গাল দিল, খেঁকিয়ে উঠছিস ক্যানে? দুদিন বাদ তো চটান খালাস করবি, খেঁকিয়ে উঠছিস ক্যানে?

সে মাথায় জল ঢালল শুধু। কোনো জবাব দিল না। কারণ, এখন যদি সে ফের জবাব দেয়, তবে বৌটার জেদ বাড়বে। নাচন—কোঁদন শুরু হবে। দয়া করে যদি নাচন—কোঁদন একবার এই তৃতীয় পক্ষের বৌর শুরু হয়, তবে সাধ্য কী সমস্ত দিনমানে সে এ নাচন—কোঁদন থামাতে পারে।

স্নান—শেষে কৈলাস ঘরে ঢুকলে একথালা পান্তাভাত বেড়ে দিল বৌটা। তেল—চিটচিটে গামছা দিয়ে কৈলাস শরীর মুছল। তারপর দু ঠ্যাং বিছিয়ে এক কোণায় খেতে বসে গেল। দুটো শুকনো লংকা পাশের পোড়া কাঠে পোড়াবার সময় ডাকল, গেরু, তু কাঁহা রে? খানা—পিনা তু করবি না? এ—সময় কৈলাস একটা পেঁয়াজ চাইল বৌটার কাছে। বৌ কাঁচা পেঁয়াজ দিল। তারপর বলল, খানিক পচাই লিবি? গত রাতে গেরুর সৎমা সবটুকু পচাই শেষ করতে পারেনি বলে এই ধরনের সুখের কথা বলতে পারল। কৈলাস এতক্ষণ পর খুব খুশি—খুশি হয়ে উঠল। বলল, তা আছে লাকি? থাকলে দে দুটো ঢেলে। ভাতের সঙ্গে পচাই খেতে পেয়ে কৈলাস এত খুশি যে বৌটার কানের কাছে মুখ না নিয়ে আর পারল না। ফিসফিস করে বলল, মড়াটা যে মেয়েমানুষ লা। ভারী ঠোঁট দুটো বলতে গিয়ে নিচে ঝুলে পড়ল। মাগিটা মায়ের দয়াতে পার পেল।

এ চটানে খবর দেওয়ার মতো আর একটা খবর আছে কৈলাসের। খবর—মেয়েমানুষটার দাঁত একটাও পড়েনি। খুলিটার দাম জগুবাজারের হিল্টন কোম্পানির বড়বাবু পুরো এক কুড়ি আঠারো টাকা দেবেনই, সব দাঁতগুলো ঠিক থাকলে তিনি খুলির জন্য পুরো আটত্রিশ টাকাই দেন। দাঁত যদি দুটো একটা না থাকে তবে দাম কমবে ফাটকা বাজারের মতো। চড় চড় করে দাম কমে দশ—পাঁচ হতে পারে। সেজন্য কৈলাস ফরাসডাঙার জঙ্গলে মড়া পেলে কবর খুঁড়ে প্রথম দাঁতগুলো দেখে। দাঁত ক’টা থাকল, কটা উঠল দেখে।

 দাঁত কম থাকলে নিজের দাঁতে হাত বুলোয় কৈলাস। বলে, এ—মুর্দা হামার মতো পাপী—তাপী কিছু একটা হয়ে লিবে।

থালায় যখন পচাই ঢালছিল বৌ, তখন সে খবরটা না দিয়ে থাকতে পারল না। এতক্ষণ ধরে এই খবরটা দেওয়ার জন্য ছটফট করছিল সে। মুখের ভেতর এক ঢোঁক পচাই নিয়ে বলল, মড়ার বত্তিসটা দাঁত আছে রে বৌ! ঘরে পয়সা এ টাইমসে জায়দা উঠবে। গেরুটাকে একটু সামলে চলতে বুলবি। ডাইনি মাগিটার সঙ্গে মিশতে বারণ করবি। তাহলে আগামী সালে একটা সাদি—সমন্ধ করে লিব। তু কী বলিছে?

তা লিবি। কিন্তুক ওয়ার গতিক—বিতিক ভালো লয়। বলে উঠে দাঁড়াল সে। সরু কোমরটা নেচে উঠছে। বেশি পয়সার কথা শুনে চোখ দুটো ওর চকচক করে উঠছে। দু—কদম সে পা বাড়াল সামনে, কোণ থেকে মাদুরটা এনে সে মাচানে বিছিয়ে দিল।

কৈলাস নতুন মাদুর দেখে ফিসফিস করে বলল, কাহার মন ভুলালি রে বৌ? দুখিয়ার লয় তো? মরঘাটির ডাক তো এ—সালে ওয়ার।

বৌটার গলায় এবার সোহাগ উথলে উঠছে, তু যে কী বলিছে!

কৈলাস মাচানে গড়াগড়ি দেওয়ার সময় বলল, দেখে লিবি, এবার মড়ক লিশ্চয়ই একটা লাগবে। ঠান্ডা আভিতক পুরোদমে থাকল, লেকিন মায়ের দয়া আরম্ভ হয়ে গেল। লিশ্চয় মড়ক লাগবে। লিশ্চয় লাগবে। বাপজী ঠাকুরের মানত করে লিলুম। সে দুহাত তুলে বাপজী ঠাকুরকে মানসা দিল। কৈলাসের খাপছাড়া বেঢঙের শরীরটার দিকে নজর দিতে দিতে বৌটা যেন আঁতকে উঠল। বলল, তবে!

সে হাসল চোয়ালের সেই নোংরা দাঁত দুটো বের করে। হাসতে হাসতে বলল, ও কিছু লয়, ও কিছু লয়। লেকিন এ সালে তুর গায়ে গহনা উঠবে। হামি কৈলাস ডোম এ—কথা বলিছে। ঝুমঝুমখালি আর ফরাসডাঙার জঙ্গলে মড়া পোঁতার হিড়িক লাগবে, ঠিক গেল চার সালের আগের মতো।

সে মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আজ অনেক টাকার স্বপ্ন দেখল। বৌ পাশে বসে রয়েছে। সে বসে বসে কৈলাসের আশা—আকাঙ্ক্ষার কথা শুনছে। শুনতে শুনতে এক সময় উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তারপর দুটো হাত চোখের সামনে তুলে কেমন যেন কুঁকড়ে গেল মেয়েটা।

আকাশ এবং মাটি লাল এবং এই মাটির কস খেয়ে পাশের নদীটা পর্যন্ত লাল হয়ে উঠেছে। শ্মশানে একসঙ্গে তিনটা চিতা জ্বলছিল। চটানের মেয়ে—মরদেরা শ্মশানের কাঠ বয়ে কিছু পয়সা পেয়েছে। ঘাটোয়ারিবাবু সবাইকে পয়সা দিয়েছেন। নেলিও হাত পেতেছে এবং পয়সা পেয়েছে! তারপর নেলি সন্তর্পণে বের হয়ে যাবার উপক্রম করতেই ঘাটোয়ারিবাবু ডেকেছেন, বলেছেন, এই ধর, টাকা দিলাম। যত জলদি পারিস টাকা শোধ করবি। না করিস ত খাতায় নাম লিখব। হিসাব রাখব।

নেলি জবাব দিল, তা দেব বাবু। জলদি দিয়ে দিব।

এবং এখন দেখলে মনে হবে না যে নেলি দীর্ঘ সময় ধরে না খেয়ে আছে চটানে। মনে হবে না—সে কিছুক্ষণ আগেও ভুখা থাকার দরুন পাগল বনে যাচ্ছিল। মনে হবে না—ভুখা থাকার জন্য সে কিছুক্ষণ আগেও গেরুকে গালমন্দ দিচ্ছিল। গেরু বলেছিল ওকে, তু নিশুতি রেতে একলা ঘাটে গেলি, গহনা খুঁজলি, তু ডাইনি বনে যাবি। তুর ভয় না করল। তখন নেলি গেরুকে গালমন্দ দিচ্ছিল, গেরু তু হামার খবরদারি মত কর। রেতে ঘাটে একা নেমে গিয়েছিল ত হয়েছেটা কি! ঘাটে মড়া ছিল না, লেকিন হামার গঙ্গা যমুনা ত ছিল। তু রামকান্তর ভয় দেখাচ্ছিস, থোড়াই ভয় আছে ওয়ার। বে—সরমের কথা বলে তু গঙ্গা—যমুনাকে দিয়ে ওয়ার চোখ তুলে লেব না! লেকিন তু মরদ না আছে গেরু। কিছুক্ষণ আগে ঘাটে কাঠ নিয়ে যাবার সময় নেলি গেরুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলেছিল, তু মরদ না আছে গেরু। তু ভেড়ি আছে, তু পাঁঠা আছে। তুর বিবিকে লিয়ে ভিন আদমি রঙ্গরস করতে চাইবে, আর তু তখন চোখ মেলে ভেড়ির মতো তাকিয়ে থাকবি। মুরদ থাকে’ত নিয়ে চল অন্য চটানে। দুজনে ঘর বাঁধবি। তখন খবরদারি কর। বেমাফিক চলেছি ত মার—ধোর কর। লেকিন আভি তেরে এক বাত ভি হাম না শোনে। হাম ভুখা আছে। রঙ্গরসের বদলে পয়সা মিলে ত ও ভি হাম লেবে। ভালোমানুষ হয়ে চটানে ভুখা না থাকবে। ডাইনি বনে যাবে ত সে ভি আচ্ছা।

নেলি সিঁড়ি ধরে নিচে নামল। মনে মনে সে এখন গেরুকেই খুঁজছে। হাতে ওর একটা টাকা—অনেক সম্পদ! অনেক আকাঙ্ক্ষা এখন নেলির মনে। এক টাকায় কী কিনবে! কত কিনবে! এক সের চাল, এক পো ডাল, এক পয়সার পেঁয়াজ। দু পয়সার তেল। একটু নুন। সে খাবে, বাপ খাবে। গেরু খাবে কিনা তাও ভাবল। কাঠ বইবার সময় গেরুকে সে অনেক গালমন্দ দিয়েছে। গেরুকে বকে নিজেই কষ্ট পাচ্ছে এখন। চোখ তুলে এ—ঘর সে—ঘর দেখল। কোথাও নেই, কোনো ঘরে কেউ নেই। গেরু কোথাও নেমে গেছে, রেগে গেছে।

নেলি এবার শিবমন্দিরের পথে পড়ল। রামকান্তর দোকানে গিয়ে দাঁড়াল। এ—দোকানে সে দুটো পেঁয়াজ, একমুঠো চাল, একটু নুন বেশি পাবে। সেজন্য সে অন্য দোকানে গেল না, অন্য পথ ধরল না। রামকান্তর দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে হাঁকল, আট আনার চাল দে বাবু। দু আনার ডাল দে বাবু। দু পয়সার তেল, এক পয়সার নুন। এক এক করে নেলি সওদার নাম করে গেল, এক এক করে রামকান্ত সব বেঁধে দিল। তারপর নেলির দিকে চেয়ে বলল, ভোররাতে তোর বাপ চিল্লাচ্ছিল কেনরে?

জবাব দেবার আগে নেলি চটানের অন্য পাশে হল্লার শব্দ শুনল। ক্রমশ এদিকেই যেন আওয়াজটা এগিয়ে আসছে। সে দেখল দুখিয়া ছুটে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। পিছনে গেরু ছুটছে। গেরুর হাতে বল্লম। দুখিয়া নেলির সামনে এসে থেমে গেল। তু হামারে বাঁচা। গেরু হামারে বল্লমের হেকড় দিতে চাইছে।

নেলি দেখল, দুখিয়া ভয়ে কাতরাচ্ছে। দুখিয়ার মুখ দেখে নেলির কষ্ট হল। নেলি তাড়াতাড়ি দুখিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর গেরুর দিকে চেয়ে বলল, আঃ যা তু। গেরুকে ডাকতে থাকল।

আঃ যা, দেখি তুর কত মুরদ।

মুরদ আছে, জরুর মুরদ আছে। বলে গেরু নেলির পিছনে ছুটে গেল এবং দুখিয়ার গলাটা টিপে ধরতে চাইল। বলল, শালে কুত্তা! শালে বেইমান। নেলিকে তু বেশ্যা পেলিরে।

গেরু তু চুপ কর। চুপ কর। কী করেছে বুল! নেলি গেরুর হাত ধরল এবার। চটানের দিকে টেনে নিয়ে যেতে চাইল। —কী হয়েছে বুল?

গেরু কোনো উত্তর দিতে পারল না। শুধু হাঁপাতে থাকল। শুধু এদিক ওদিক তাকিয়ে গজরাতে থাকল। সে নেলির চোখ দেখল, মুখ দেখল। ওর দুঃখ বাড়ছে। অথচ কিছু বলতে পারছে না। বলতে পারল না—ও শালে বুলে কী নেলি, তু বেশ্যা। রামকান্তকে এ—সব কথা বুলেছে, আর মাগনা চপ ভাজা খাচ্ছে। বলতে পারল না, ও শালাকে হাম জরুর খুন করবে। জরুর হেকড় দেবে বল্লমের। শুধু ফ্যালফ্যাল করে নেলির দিকে চেয়ে থাকল। গেরুর আপসোস বাড়ছে—সে বলতে পারছে না, দুখিয়া দিন দিন বাবু হয়ে উঠছে। দিন দিন জায়দা পয়সা কামিয়ে টেরি কাটতে শিখেছে। কোঁচা মারতে শিখেছে। রামকান্তর দলে ভিড়ে নেলিকে অসৎ বানাতে চাইছে। কিছু বলতে না পেরে গেরু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কঠোর উত্তেজনায় ভুগল। চটানের মেয়ে—মরদেরা এইসব দেখে হাসল আর হাসল। কারণ নেলি তখন গেরুকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। গঙ্গা—যমুনার মতো গেরু নেলির বশ মেনেছে।

চটানে মেয়ে—মরদেরা সব ফিরে এল। উঠোনে মাদুর বিছিয়ে বিকেলের রোদ শরীরে মাখাল। লাশ—কাটা ঘরে গোমানি আজ যায়নি। হাসপাতাল থেকে পুলিশ আসেনি। সে মাচানে পড়ে পড়ে সারাদিন গালমন্দ দিয়েছে। এখন নেলি দুটো রেঁধে খাওয়াবে জেনে নিশ্চিন্ত মনে চটানে ল্যাং খাচ্ছে। শীতের আমেজ আকাশ দেখে চিনতে পারছে। না খেতে পেয়ে মনটা এতক্ষণ কাঠের মতো হয়ে ছিল। ওর দুঃখ হচ্ছিল হাসপাতালে আজ যেতে পারল না, লাশ—কাটা ঘরে পেট চিরতে পারল না মানুষের এবং চুরি করে ইসপিরিট খেতে পারল না। বিকেলের মেজাজটা সে পাচ্ছিল না। ওর দুঃখ সেজন্যও। কিন্তু ঝাড়ো ডোমের ঘরে চর্বির গন্ধ। কিছুদিন থেকেই চর্বি খাওয়ার শখ হয়েছে গোমানির। কিছুদিন থেকেই বলবে ভাবছিল নেলিকে, শুয়োরের চর্বি দিয়ে ভাত দে নেলি। চর্বির গন্ধটা বার বার পেটের যন্ত্রণাকে প্রকট করে তুলছে। নেলি ফিরছে না এখনও, নেলি ঝগড়া করছে গেরুর সঙ্গে। কখন ফিরবে, কখন রান্না চড়াবে? কখন দুটো ভাত, একটু নুন, একটুকরো পেঁয়াজ ওর পাশে রাখবে! সে এইসব ভাবতে ভাবতে একটু এগিয়ে গেল।

তখন ঘাটোয়ারিবাবু তাঁর নিজের চেয়ারে—সেই চোখ, সেই মুখ নিয়ে বসে আছেন। জানলার গরাদে চোখ রেখেছেন। গরাদের ফাঁক দিয়ে কত আগুন দেখলেন, কত শকুন উড়ল আকাশে, কত জল এই নদী ধরে সমুদ্রে নেমে গেল—অথচ তিনি তাঁর নিজের চেয়ারে। কত ধনী এল, কত গরিব এল ঘাটে, অথচ তিনি তাঁর নিজের চেয়ারে। এইসব দেখে এবং ভেবে তিনি স্থির করেছিলেন—মৃত্যু, মৃত্যুই সব, মৃত্যুই শেষ। মৃত্যুর জন্যে দুঃখ অথবা মৃত্যুকে কেন্দ্র করে দুঃখ—উভয়ই পরিহাসজনক। উভয়কেই তিনি ঘৃণা করে এসেছেন এতদিন। উভয়ের জন্যই তিনি গরাদের ফাঁকে কঠোর দৃষ্টি হেনেছেন। শিবের মতো ত্রিনয়ন খুলে বলেছেন—পরম ব্রহ্ম নারায়ণ। ব্রহ্মই সত্য, জগৎ মিথ্যা। বলেছেন, কেঁদে কেটে কী হবে, জীবনে এটাই ত নির্দিষ্ট ছিল। তবে কান্না কেন? আনন্দ করো, আনন্দ করো। অথচ তিনি যত মৃত্যুর মুখোমুখি হাজির হচ্ছেন, যত বয়স বাড়ছে, ততই বিষণ্ণ হয়ে পড়ছেন। ততই তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠছেন না। ততই তিনি কম কথা বলছেন। ততই তিনি যেন জগতের এই মিথ্যা মায়ায় জড়িয়ে পড়ছেন। তিনি চোখ ফিরিয়ে দেখলেন চটানে কৈলাস মাচানে ঘুম যাচ্ছে, আর ওর বৌটা মনু ডোমের সঙ্গে একখিলি পান খাওয়ার জন্য বায়না ধরেছে। মনু ডোমের সঙ্গে বৌটা পান খেতে চলে গেল। অশ্বত্থের ডালে সব কাকেরা ফিরে আসছে। ভোরে যে মরা কাকের বাচ্চাটার জন্য ওরা কেঁদেছিল এখন আর কাঁদছে না। ডালে বসে ওরা বিশ্রাম নিচ্ছে। ঘাটোয়ারিবাবুর মনে হল তিনি যেন সারা জীবন বিশ্রামই করে এসেছেন। তিনি যেন মরে বেঁচে ছিলেন। তিনি দেখলেন এখন চটানে ঘরে ঘরে পোড়াকাঠের আগুন জ্বলে উঠছে। হাঁড়ি হাঁড়ি পচাই জড়ো হয়েছে চটানে। দুখিয়ার বউ মংলি পাঁঠার নাড়িভুঁড়ি দিয়ে চাট বানাচ্ছে। ঝাঁঝালো গন্ধ চটানে। চাটের ঝাঁজ, মনের ঝাঁঝ। বাবুদের বাড়িতে রেডিয়ো বাজছে। তখন নেলি চটানে ফিরছে। গঙ্গা—যমুনা এধার ওধার খেয়ে ঢেকুর তুলছে। গেরু ঘরে ঢুকে বাপের পাশে শুয়ে পড়ল। বুঝি ঘুমোল। বুঝি রাতে ফের পাহারা দেবে। ঘাটোয়ারিবাবু অফিসঘরে বসে সব দেখে এ—সব ভাবলেন।

নেলির ঘরেও পোড়া কাঠ জ্বলে উঠছে। নেলি রান্না চড়াল, অন্য দশটা ডোমের মতোই ওর রান্না। ঘাটের পোড়া কাঠে পুরোনো হাঁড়িতে ভাত হবে। ফ্যানটুকু গেলে প্রথমেই নেলি চুমুক দিয়ে খেয়ে নেবে। একটু নুন দেবে মুখে।

নেলির ফ্যান খাওয়া গোমানি মাচানে বসে দেখল। ওর ইচ্ছা এ—সময় নুন মিশিয়ে সেও একটু ফ্যান খায়। তা নেলি যখন দিল না, গোমানি তখন বায়না ধরতে থাকল—হামারে এটা দে, ওটা দে। হামি ফ্যান খাব। হামারে আর ভুখা রাখিস না। পেট হামার হারমাদ হয়ে উঠল।

নেলি একটু ডাল সিদ্ধ করে নিল মালসায়। অন্য একটা মালসাতে বাপের জন্য ভাত বাড়ল, তারপর বাপকে খেতে দিল। নিজেও খেল এক সময়। ওরা জল খেয়ে দুজনেই বড় রকমের ঢেকুর তুলল।

এখন ইচ্ছা করছে গোমানির নেলির সঙ্গে দু চারটা ভালোমন্দ কথা বলে। ইচ্ছা হচ্ছে নেলিকে পাশে বসিয়ে আদর করতে। কিন্তু এ—সময়ে কেন জানি ফুলনের স্মৃতি ওকে বড় কাতর করছে। বাপ বাঙালি ডোমকে স্মরণ করে সে হাতজোড় করল। বাপের জন্যই হাসপাতালের চাকরি। বাপের জন্যই সে মাস গেলে আশিটা টাকা পায়। কিন্তু মাসের পনেরো দিন যেতে না যেতেই টাকাগুলো নিঃশেষ হয়—এজন্য ওর এখন খুব দুঃখ। নেলির কথা ভেবে দুঃখ আরও গভীর। মাসের শেষে ধার—দেনা, তারপর সুদ গোনা। মাসের প্রথম তারিখে কিছু দেনা শোধ করা। মাসের শেষ দিকে নেলিকে খুন জখম করা। আর এও নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে মাসের শেষ দিকে দু তিনটে রোজ উপোস দেওয়া। চুপচাপ পড়ে থাকা মাচানে এবং নসিবকে গালমন্দ দিয়ে চোখ বুজে থাকা। এ—সময়ে চটানটা ওর কাছে হারাম। মানুষগুলো সব অজাত—কুজাত। দুনিয়াটা রসাতলে যাচ্ছে।

বাপ বঙ্গালী ডোমও এ—কথা বলত ঘরে ফিরে—দুনিয়াটা রসাতলে যাচ্ছে। তখন গোমানি চটানে পড়ে থাকত না। সদর জেলের পাশে একটা কুঠরি ছিল বাপ বঙ্গালী ডোমের, মা সিঁদুরী সেখানে থাকত। গোমানি থাকত মা—বাপের সেই কুঠরিটায়। বাপ সদর জেলে গলায় দড়ি পরাত। ফাঁসি দিত হারমাদ লোকদের। এবং ঘরে ফিরে মা সিঁদুরীকে বলত, দুনিয়াটা ডুবে গেল রে বুড়ি। বাপ বঙ্গালী ডোমের মতো গোমানিও আজকাল এসব কথা বলতে শিখেছে। মেয়েটা দিন দিন ডাইনি বনে যাচ্ছে—এ—কথা ভাবতেও ওর কষ্ট হয়। রাতের আঁধারে মেয়েটা কখন যে বের হয়, আর কখন যে ফিরে আসে! রাতের আঁধার থেকে কী করে যে মালসা মালসা ভাত নিয়ে আসে! কী করে যে কখন সখন এত সব খাবার জোগাড় করে নেলি! আশ্চর্য! আশ্চর্য! সব নসিব, নসিবের খেলা, নসিবের ভাঁওতা। নেলি ডাইনি বনে যাচ্ছে। যাক! যাবে। গোমানির নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছা হল। শরীর কামড়াতে ইচ্ছা হল গোমানির, ভালো লাগে না এ—সব! ভালো লাগে না। রাতে এমন সজাগ পাহারা রেখেও মেয়েটাকে ধরে রাখতে পারছে না। মেয়েটা ভোর রাতে ভাত আনে, ডাল, তরকারি ভাজা আনে—কিছু বলতে গেলে খেঁকিয়ে ওঠে। কিছু বলতে গেলে খটাশের মতো মুখ করে কামড়াতে আসে। ঘাটে মড়া এলে নেলি অফিসে ঘুরঘুর করবে। মড়ার নাম ধাম, মড়ার হদিস নেবে। শেষে নেলি রাতের আঁধারে গঙ্গা যমুনাকে নিয়ে বের হয়ে পড়বে। বাড়িটা খুঁজবে। খুঁজে বের করার পর রাতের জন্য অপেক্ষা করতে থাকবে। কোনোদিন পাবে কিছু, কোনোদিন পাবে না। বাপকে ভালোমন্দ খাওয়াবার এবং নিজে ভালোমন্দ খাবার লোভ কিছুতেই সামলাতে পারবে না। তখন চটানের কোণে মরদদের চোখ টাটায়। তখন ওরা হাজার রকমের ঠাট্টা—তামাশা করে। তখন গোমানি মাচানে বসে গজরাতে থাকে, মেয়েটার গলাটিপে ধরতে ইচ্ছা হয়, অথচ যখন মালসা থেকে নেলি খাবারগুলো আলগা করে বাপকে দেয়, তখন বাপ খুশি হয়ে বলবে, দুটো রেখে দিস। অথচ গোমানি খেতে আরম্ভ করলে সে—সব কথা মনে থাকে না। এতটুকু পেটে মালসা—মালসা খাবার গিলে বলবে হামি ব্যারামী নাচারী লোক আছি। দুটো জায়দা খেয়েই লিবে।

শীতের রোদ যত চটান থেকে নেমে যেতে থাকবে, তত চটানটা নিজের স্বভাব খুলে ধরবে। তত চটানটা মাতাল হতে শুরু করবে। পচাই খাবার জন্য প্রায় ঘরেই এখন চাট হচ্ছে। গোমানির ঘরে চাট হচ্ছে না। কিন্তু গোমানি ঝাড়ো ডোমের সঙ্গে এখন কথাবার্তা বলছে। একটু পচাই গিলবার জন্য ভাব জমাচ্ছে। এমন শীতের সন্ধ্যাটা মাটি হোক, সে তা মনে মনে চায় না। ঝাড়োর সঙ্গে ভাব জমুক, দু ঢোক পচাই গিলতে পারুক, তেমনি ইচ্ছা ওর। ল্যাং খেতে খেতে এবার সে ঝাড়োর দাওয়ায় গিয়ে বসল। ঝাড়ো ডোমের বিবিকে ডাকল। দুটো মিঠা বাত বলে বিবির মন ভিজাতে চাইল। তারপর লাশ—কাটা ঘরের গল্প জমিয়ে সেই দাওয়ায় জাঁকিয়ে বসল। আর কে আছে তাকে দাওয়া থেকে তোলে। এখন কে আর আছে এ ঘরে, ওকে এক চুমুক না দিয়ে খায়। এখন এমন কার হিম্মত আছে, শীতের সন্ধ্যাটা মাটি করতে পারে। সেজন্য গোমানির দুনিয়া এখন মজাদার দুনিয়া। খুব খুবসুরত দুনিয়া। এ দুনিয়াতেই বেঁচে সুখ। ঘাটে তিন তিনটে চিতা জ্বলছে—আহা এ দুনিয়াতেই বেঁচে সুখ। তিন তিনটে চিতা জ্বলছে, আকাশ লাল হচ্ছে মাটি লাল হচ্ছে। নদীর জল লাল—চটানের ঘরে ঘরে বিবিরা লাল নীল হচ্ছে। রঙিন কথা বলছে। জোয়ান মরদেরা শরীর রাখবার জায়গা পাচ্ছে না। জোয়ান বৌ—ঝিরা বেসামাল হয়ে পড়ছে। দুখিয়ার বৌ মংলি দুলতে দুলতে অন্য ঘরে যাচ্ছে। দুখিয়া ওর হাত টেনে রাখতে পারছে না। —ছোড় দে তু, মুঝে ছোড় দে। হাম চল যাও কাহাভি। তুর সাথ আর ঘর না করে। ভোরের আরশি দেখা, ঘাটের দামি কাপড়টায় রং, এক খিলি পানের রস ঠোঁটে, পচাই খাওয়ার পর উগ্র হয়ে উঠেছে। হে হে করে ঢোল বাজাচ্ছে মনু ডোম। মংলি দরজায় কার গানের শব্দ পেল। লোকটা এসেছে। মংলি উধাও হতে চাইল।

ঘাটোয়ারিবাবুও দরজায় কার পায়ের শব্দ পেলেন। —কে দরজায়? ঘাটোয়ারিবাবু প্রশ্ন করলেন।

হামি কৈলাস আছে বাবু!

এ—অবেলায় কেন আবার?

ফরাসডাঙায় যাচ্ছি।

ফরাসডাঙার যাচ্ছিস ত এখানে কী?

একটা কথা বুলতে এলাম বাবু। যদি মেহেরবানি করে শোনেন। যদি থোরা দয়া হয়।

দয়া বুঝিনে। যা বলবার বলে ফেল।

হামি ত বাবু বেশি দিন বাঁচবে না। গেরুর লাগি বহুত চিন্তায় আছি। হামি মর যানেসে গেরু কী করবে কেনা জানে বাবু। দু চারঠো বাত আপনার পাশ বুলে লিব। দু চারঠো আর্জি আপনার কাছে পেশ করব। এই সব বলে কৈলাস দরজার ওপর বসে পড়ল। ফের বলতে থাকল, ওকে একটু দেখে লিবেন বাবু। আমি মর যায় তো ওয়ার কৈ না থাকল। দু চারঠো ঘাটের মরা দিয়ে গেরুকে বাঁচিয়ে দিবেন। আপ ওয়ার মা—বাপ!

ঘাটোয়ারিবাবু কোনো জবাব দিলেন না। কৈলাস কোনো জবাবের প্রতীক্ষা না করে চলে গেল। অনেকদিন থেকেই সে ভেবেছিল ঘাটোয়ারিবাবুকে গেরুর ভার দিয়ে নিজে খালাস পাবে। নিজের দায় থেকে মুক্তি পাবে, অথবা নিজের মৃত্যুর পর গেরুর সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে।

ঘাটোয়ারিবাবু কৈলাসের কথা ভেবে একটু অন্যমনস্ক হলেন। একটু বিচলিত হলেন। লোকটা সারা জীবন মড়ার পিছনে ছুটে শেষ বয়সে অন্যের বাচ্চার জন্য হাউহাউ করে কাঁদতে চাইল। তিনি কৈলাসের চোখ দেখে যেন সব ধরতে পেরেছেন।

কৈলাস অফিসের বারান্দা থেকে নেমে এল। তাবিজের উপর দিন দিন যত বিশ্বাসটা ভেঙে যাচ্ছে, তত সে নিজেকে খুব অসহায় মনে করছে। তত গেরুর জন্য চিন্তা বাড়ছে। ঘুম থেকে উঠে সে দেখল গেরুটা ওর পাশে শুয়ে আছে। বেড়ালের বাচ্চার মতো ঘুম যাচ্ছে। ওর কেমন মায়া হল। কেমন করে গেরুর মার কথা মনে পড়ে গেল। সেই সুখের দিনগুলোর কথা এক এক করে মনে করতে পারল। যত মনে হল তত দুঃখ পেল। তত গেরুর জন্য মমতাবোধ বাড়তে থাকল। তত বাচ্চাটার জন্য ওর বেশি চিন্তা হল। ঘাটোয়ারিবাবুকে বলতে পেরে সে এখন যেন খুব হালকা বোধ করছে।

কৈলাস ঘরে ঢুকে এক ছিলিম তামাক খেল। গেরু ঘুমোচ্ছে—ঘুমোক! আজ আর গেরুকে ফরাসডাঙায় নিয়ে গিয়ে কাজ নেই। পর পর দু রাত জেগে থাকলে শরীরটা ওর খারাপ হয়ে যাবে। সেজন্য কৈলাস হারিকেন জ্বালিয়ে এক ভাঁড় পচাই হাতে, বল্লম নিয়ে নদীর পথে নেমে পড়ার আগে বৌকে বলল, আজ ফের হামলা বাধাবি না ঘাটোয়ারিবাবুর দরজায়। তবে খুন করব বুলে দিলাম।

ঘাটের তিনটে চিতা তখন নিভে আসছে। কৈলাস নদীর পাড় ধরে ফরাসডাঙায় চলে গেল। খেয়াঘাটে আলো জ্বলছে। ওপারে গোরুর গাড়ির নিচে হারিকেন দুলছে। দুটো একটা শীতের ব্যাঙ গর্তে মুখ লুকিয়ে ক্লপ ক্লপ করল। নদীর ধারে লোক চলাচল কমে আসছে, শীতের রাত বলে পথ ঘন আঁধার না হতেই নিঃসঙ্গ হয়ে উঠছে। শুধু নদীর ঢালুতে দু—চারজন লোক কাঁচা কয়লার আগুন ধরিয়ে ছইয়ের নিচে তুলসীদাসী রামায়ণ পড়ছে। ছইয়ের নিচে হারিকেন ঝুলছে। লণ্ঠনের আলোয় ওদের মুখ শীতের রাতে গর্তের ভিতর ক্লপ ক্লপ শব্দ করা ব্যাঙের মতো। গঙ্গা—যমুনা মাটি শুঁকতে শুঁকতে সেদিক দিয়ে গেল। ওরা ব্যাঙের মতো মুখগুলো দেখে আর দাঁড়াল না। এখানে খাবার নেই এ—সব মুখ দেখে ওরা বুঝতে পারল।

গেরু ঘুম থেকে উঠে দেখল চালাঘরটায় সে একা। ঘরটায় কোনো লম্ফ জ্বলছে না। সে উঠে চারপাশের মাচানটা হাতড়াল। বাইরে একটা লম্ফ জ্বলছে। সৎমা ঘরে নেই গেরুর। সে তার শরীরের জড়তা নিয়ে মাচান থেকে নামল। সে বাপকে খুঁজল। বাপ চটানে নেই। ঘরে হারিকেন নেই, বল্লম নেই—বাপ আজ একাই ফরাসডাঙায় গেছে। বাপ ওকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেনি। বিরক্ত করেনি তাকে। বরং এক ভাঁড় পচাই মাচানের নিচে পড়ে আছে। সে বুঝল ওটা ওর জন্য রেখে গেছে বাপ। বাপের বৌটা এখন অন্য কোনো ঘরে হয়তো চাট দিয়ে পচাই গিলছে। চালাঘরে সে তার নিজের ভাঁড়টা দিয়ে মাংসের চাট খুঁজতে থাকল। এবং ভাবল নেলিকে ডেকে একটু পচাই খাওয়াবে। বাপ যখন ঘরে নেই, বাপের বৌটাও যখন নেই তখন তারা দুজনে নিশ্চিন্তে বসে এ—ঘরে পচাই গিলতে পারবে।

আগুনের পাশে চুপচাপ বসে আছে নেলি। উনুন থেকে আগুনের উত্তাপ নিচ্ছে। দুদিন পর বাপ দুটো অবেলায় খেয়ে, ঝাড়োর ঘরে একটু পচাই টেনে সকাল সকাল মাচানে ঘুমিয়ে পড়েছে। ইচ্ছা করেই নেলি লম্ফ জ্বালল না। আঁধারটা ওর ভালো লাগছে। ওর ইচ্ছে এ—সময় গেরু এসে ওর পাশে বসুক একটু পোড়া কাঠের উত্তাপ নিক। মনু ডোমের ঢোল বাজানোর শব্দ আসছে না আর। ঝাড়ো ডোমের ঘরে সবাই ঝিমিয়ে পড়েছে। হরীতকীর ঘরে আলো জ্বলছে এখনও। বাচ্চাটা দুবার ট্যাঁট্যাঁ করে কাঁদল। কান্না শুনে নেলির ভারী আদর করতে ইচ্ছে হচ্ছে বাচ্চাটাকে। পোড়া কাঠের আগুনে নেলির মুখ লাল। মনের ভিতর এখন আগুনের রঙ। বুকের ভিতর ইতর শখগুলো গেরুর মতো একটা ছোট কাঠের পুতুল বানাতে চাইছে। সেজন্য সমস্ত শরীরে আগুনের রঙটা গলে পড়ছে যেন। নেলি বসে থাকতে পারছে না। গেরু হয়তো ফরাসডাঙায় গেছে। নতুবা সে এখন গেরুর ঘরে গিয়ে আর কিছু না হোক কাঠের পুতুলটার জন্য রঙ গুলতে পারত। নেলি দুদিন পর পেট ভরে খেতে পেয়ে চটানটাকে ফের ভালোবেসে ফেলল। সেজন্য মুখোমুখী বসে রঙ গুলতে চাইল সারারাত।

গেরু সন্তর্পণে এসে উনুনের ওপর মুখ বাড়াল তখন। —হামার ঘরে চল নেলি। গেরু ফিসফিস করে বলল যেন গোমানি না শুনতে পায়। —এক ভাঁড় পচাই আছে। তু আর হাম খাবে। ঘরে বাপ নেই, মায়ি ভি নেই। তু চল।

নেলি বলল, না যাবে না। তুর পচাই তু খা।

যাবি না ক্যানে? গেরু নেলির হাতটা চেপে ধরল।

হাত ছাড় গেরু। হাত না ছাড়বি ত বাপকে ডাকব।

তু চল নেলি।

নেলি উঠে পড়ল উনুনের পাশ থেকে। ওখানে বেশি কথাবার্তা বললে বাপ জেগে যাবে। বাপ তবে অনর্থ ঘটাবে। ওরা এসে শুয়োরের খাটালটার পাশে দাঁড়াল। কাঠগোলা বাঁদিকে রয়েছে। ওখানে ঘন আঁধার। ওখানে কোনো লোকজনের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। ওখানে বড় নির্জন, বড় নিঃসঙ্গ। সুতরাং নেলি জোরে কথা বলতে পারল। —তু যে বল্লমের হেকড় দিতে চাইলি দুখিয়াকে, যদি তোর জেল হয়, যদি তোর গলাটা যায় তখন কেমন হবে!

ও তুকে বেশ্যা বানাতে চাইছে।

বেশ্যা বানাতে চেয়েছে ত হয়েছেটা কী।

রামকান্ত খুব খুশি হচ্ছিল এ—সব বাতচিত শুনে।

তোর সাথ গেলে তুভি ত খুশি হবি। তু পচাই খেতে বুলে হামারে লোভ দেখাতে চাস।

গেরু জবাব দিতে পারল না। ওর এমনই যেন একটা ইচ্ছা শরীরে এতক্ষণ ধরে কাজ করছে। আঁধারে সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল। নিজেকে অপরাধী ভাবল। আঁধারে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারছে শরীরের যন্ত্রণায় গেরু কথা বলতে পারছে না, থরথর করে কাঁপছে। অনেক আশা নিয়ে গেরু উনুনের ওপর মুখ বাড়িয়েছিল। অনেক আশা নিয়ে এসেছিল সে দুদণ্ড নেলিকে কাছে পাবে বলে। নেলি হাসল। গেরুর হাত ধরে বলল, চল গেরু, পচাই লিয়ে নদীর ঢালুতে চল। লেকিন তু হামার গায়ে হাত না দিবি কথা থাকল। তু হামারে ঢালুতে বেশ্যা না বানাবি কথা থাকল।

সেই নির্জন আঁধারে গেরু প্রতিজ্ঞা করল যেন মাথা নেড়ে—সে কখনও হবে না। জান যাবে লেকিন বাত ঠিক থাকবে, গেরুর চোখেমুখে নেলির জন্য এমনই একটি আশ্বাস। গঙ্গা—যমুনা সঙ্গে থাকল। দরকার হলে গঙ্গা—যমুনা পাহারা দেবে।

সরীসৃপের মতো ঘন আঁধারের শরীর ভেঙে গেরু, নেলি মদের ভাঁড় নিয়ে নদীর ঢালুতে নেমে গেল। আঁধারে সাদা বালিয়াড়িটা বাসি দুধের মতো পড়ে আছে। ঝিঁঝিপোকা ডাকছে। বাবলার ঘন বনে জোনাকি জ্বলছে। দূরে শহরের বাড়ি ঘরে আলো, আঁধারে ওরা নদীর পাড়ে বসে। মানুষের সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। বড় ঘন এ—আঁধার! বড় গভীর এ—আঁধার—অথচ গঙ্গা—যমুনার চোখের মতো স্বচ্ছ। নেলি গেরুর মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। সারা আকাশ জুড়ে কত নক্ষত্র। নেলি ভালোবাসার জন্য বড় আকুল বোধ করছিল।

গাং শালিকের সেই শব্দটা কুনুয়া, কুনুয়া, কাকের সেই কাঠ কাঠ শব্দ—ক্ক ক্ক আর শালিকের শব্দ ঘেররো ঘেররো—মাটির সঙ্গে মিশে গিয়ে ভোরের কথা বলছে। ঘাসে ঘাসে শিশিরের জল। নালা ডোবায় মরা ইঁদুরের পচা গন্ধ। ঝোপে জঙ্গলে পাতারা সব শুকোচ্ছে, পাতারা সব পচে, ফসিল হতে চাইছে। বেশ্যা পট্টিতে মেয়েরা বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছে না। হাতে পায়ে ব্যথা, কোমরে ব্যথা। সমস্ত রাত ওদের শরীরে বড় ধকল গেছে। ওরা আশা করছে বিছানাতেই যদি এক কাপ চা হত।

গঙ্গা থেকে স্নান সেরে ওঠার সময় ঘাটোয়ারিবাবু স্তোত্র পাঠ করেন। তারপর গীতার প্রথম পর্ব থেকে শেষ পর্ব। শিবমন্দিরের পথ ধরে উঠে আসার সময় কেমন চঞ্চল হয়ে ওঠেন মাঝে মাঝে। কারণ এক সময় ডানদিকের পথটা ধরে তিনিও সে অঞ্চলে ধাওয়া করতেন। আজ তারা আর নেই। সময় বড় তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যাচ্ছে। তিনি যখন চেয়ারে বসে থাকেন, অথবা শূন্য দৃষ্টিতে যখন ঘাটটা পর্যন্ত শূন্য ঠেকে, তখন এইসব স্মৃতি মনে করতে পারেন, তখন তাদের ভালোবাসার কথা মনে হয়। তাদের অনেক সুখ দুঃখের কথা মনে হয়। তিনি পথের পাশে সেজন্য রোজ একটু থামেন। যারা একে একে এই পথ ধরে বের হয়ে আসে তাদের তিনি দেখেন। কোনো পরিচিত ভদ্রলোককে দেখলে মুখ টিপে হাসেন। তখন আকন্দ গাছটার নিচে তোলা ছবিগুলোর কথা মনে হয়। আকন্দ গাছটার নিচে আবার যখন ছবি উঠবে তখন ছবিতে তারাও জায়গা পেয়ে যাবে।

তিনি অফিসঘরে ঢোকার সময় শুনলেন গোমানি ডোম মাচানে পড়ে পড়ে কাশছে। তিনি বিরক্ত হয়ে দেওয়ালের ছবিগুলোয় গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিলেন। —বেটা শালা মরবে। কেশে কেশে মরবে। সেজন্য বেটা তুই ভাবিসনে, আকন্দ গাছটার নিচে তোর ছবি উঠবে। ভাবিস না বাবুদের মতো তোর ছবিও আমি ঘরে রাখব। গোমানিকে তিনি মনে মনে যতটা পারলেন গালমন্দ দিলেন। তা ভাবিস না বাপু তা ভাবিস না। যারা ইতর, বদমাইস তাদের ছবি আমি রাখি না। তাদের ধূপধুনো আমি দিই না।

ঘাটোয়ারিবাবু ঘরে ঢুকে প্রতিদিন যা করেন, আজও সেইসব কাজগুলো করলেন। ভিজা গামছা দিয়ে দেওয়ালের ছবিগুলোকে মুছে দিলেন। সামনের আকন্দ গাছটার নিচে এক ঘটি জল ঢেলে দিলেন। যতবার এই গাছটার নিচে ছবি উঠেছে, ততবার তিনি একখানা ছবি পাবার আশা রেখেছেন। কেউ দিয়েছে, কেউ কেউ দেয়নি। যারা দিল তাদেরগুলো তিনি সযত্নে দেয়ালে টাঙালেন। ধূপধুনো দিলেন। বললেন, হরিবোল। বললেন, পরমব্রহ্ম নারায়ণ। প্রত্যেক কাজগুলো এখনও তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে করেন। তারপর ভিজা কাপড় ছেড়ে শরীরে চাদর জড়িয়ে জানালায় উঁকি দিলেন—কেউ উঠেছে কিনা চটানে, কেউ এদিকে আসছে কিনা দেখলেন। এ সময় একটু মহাদেবকে, বাবা ব্যোম ভোলানাথকে স্মরণ করার দরকার হয়। তার পায়ের তলায় বসে প্রসাদ পেতে ইচ্ছে হয়। এখন কৈলাসের আসার কথা, গোমানির আসার কথা, শীতের ভেতর ওরা ল্যাং খেতে খেতে আসবে।

সামনের বারান্দায় ঝাড়ো ডোমের বেটারা কাঁথা—কাপড়ের নিচে থেকে উঁকি মারছে। এ ভোরে মনুডোম পায়রা ওড়াচ্ছে আকাশে। নেলির বাঘের মতো কুকুর দুটো চোখ মেলে আকাশ দেখছে। আর এ—সময়ই ছোট চাকুটার দরকার হয় ঘাটোয়ারিবাবুর। এক ছিলিম গাঁজা, হলদে একটা নেকড়ার দরকার হয়। যত ভোরের সূর্য উপরে উঠবে ততই নেশার জন্য মনটা আঁকুপাঁকু করবে। ততই তিনি গোমানি ডোমের প্রতীক্ষায় ঘরময় পায়চারি করবেন। ততই তিনি এই চটানের ওপর অধীর হবেন।

তিনি ফের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে যখন দেখবেন, কেউ উঠছে না, কেউ এদিকে আসছে না, তখন অগত্যা ডাকতেই হল, ওরে শালা গঙ্গাপুত্তুরের দল, ওরে শালা গোমানি, তোরা ঘুম থেকে উঠবিনে।

বাবুর ডাক শুনে গোমানি ডোম চালা ঘরটার মাচানে ধড়ফড় করে উঠে বসল। বাবু ডাক দিয়েছেন।

পড়ি কী মরি করে এখন ছোটার ইচ্ছা ওর। সে এই ডাকের জন্যই মাচানে এতক্ষণ প্রতীক্ষা করছিল। ঘাটোয়ারিবাবু ডাকবেন—তবে সে উঠবে, তবে সে যাবে। ভোরে দরজায় বসে থাকলে বাবু খেঁকিয়ে উঠেন।—মাগনা গ্যাঁজা টানতে এয়েছেন। ভাগ বেটা ভাগ। গোমানি সেজন্য মাচানে শুয়ে প্রতীক্ষা করছিল এতক্ষণ।

গোমানি ধীরে মাচান থেকে নামল। নেলি টের পাচ্ছে না। সে যাচ্ছে। যাবে। শীতে পা ফেটে গেছে। জায়গায় জায়গায় গোড়ালিটা হাঁ করে আছে। মাটিতে পা ফেলতে বড্ড কষ্ট। মাটিতে পায়ের চাপ যত বাড়ছে মুখটা ততই কাতর হয়ে উঠছে।

ধীরে ধীরে পা মাটিতে চেপে চেপে গোমানি চলার মতো করে নিজেকে রপ্ত করে নিল। সামান্য আমের আঠাটুকু উনানে তাড়াতাড়ি গরম করে গোড়ালির ফাঁকে ফাঁকে লাগিয়ে নিল। তারপর খুঁড়িয়ে হাঁটতে থাকল এবং কোনোরকমে ঘাটোয়ারিবাবুর ঘুরে ঢুকে গেল। বলল, আমি যে বাবু উঠেই আছিগ! কাশিতে আর ঘুম আসে কৈ। গোমানি গায়ের কাঁথাটা শরীরে ভালোভাবে জড়িয়ে ফের খকখক করে কাশল। কাশতে কাশতে নুয়ে পড়ল। কাশির গমক কমে এলে বাবুর দিকে মুখ বাড়িয়ে বলল, মন চিন্তা করল বাবুর কাশি না শুনলে আর উঠছিনে। লেকিন বাবু আজ আপুনি ত কাশলেন না।

ঘাটোয়ারিবাবু জবাব দিলেন—চোখ দুটো লাল। তিনি জবাব দিলেন—চোখ দুটো গোলকের মতো হয়ে উঠছে। —আমার ন্যাজোরের ছাও! আমার কাশি না শুনলে বাবু উঠবেন নি! শালা ডোম আমি কী তোর মতো। কাশি আমার লেগেই থাকবে। আমি কী শালা ইসপিরিট খোর! তোর মতো কাশি না থাকলে ভোরে আমার ঘুম ভাঙবে না!

গোমানি জানে এ—সময় কোনো উত্তর দিতে নেই। ভালো কী মন্দ—যে—কোনো জবাবে বাবু চটবেন। বাবু গালমন্দ করবেন। এক ছিলিম গাঁজার জগৎ থেকে ওকে তাড়িয়ে দেবেন। সেজন্য গোমানি কোনো জবাব দিল না। ছোট চাকুটা কাঠের ওপর শুধু ঘষতে থাকল।

শীতে বাবুর হাত দুটো বরফ হয়ে গেছে। তিনি দুটো হাত চকমকি কাঠের মতো ঘষলেন। গোমানি এখন নিচে বসে প্রসাদ তৈরি করছে। গোমানিকে দেখলে গহনির কথা মনে হয়, ঘাটোয়ারিবাবুর। কোনো এক বর্ষার কথা মনে হয়, কোনো এক বীভৎস মৃত্যুর কথা মনে হয়। মৃত্যুর পর গহনির মুখটা যেমন বীভৎস ছিল, এখন এই ঘরে গোমানির মুখ যেন তেমন। যেন সেই গহনির মৃত্যুর পর ওর মাথার লক্ষ লক্ষ উকুনের গৃহত্যাগের পরিণামের মতো। বড় কষ্টে মৃত্যু, বড় শোকে মৃত্যু।

কলকেতে আগুন দিয়ে গোমানি বাবুকে বাড়িয়ে ধরল,—নেন বাবু।

বাবু এ—সময় একটু অন্যরকম হয়ে পড়েন। গাঁজা ফোঁকার আগে তিনি পৃথিবীর পরিণাম ভেবে বড় বিষণ্ণ হয়ে পড়েন। তিনি কলকেতে হলদে নেকড়াটা জড়িয়ে নেবার সময় বললেন, গোমানিরে! —একটা বড় রকমের দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ফুসফুসের সমস্ত শ্বাসটা খালি করে কলকেটা এবার মুখে চেপে ধরলেন।

গোমানি আসনপিঁড়ি বসে নন্দীভৃঙ্গি সেজে আছে। বাবু এখন কী কী কথা বলবেন এবং কী জবাব দিতে হবে সব গোমানির ঠিক করা আছে।

বাবু ধোঁয়া টেনে ফের ডাকলেন—গোমানিরে!

বুলেন বাবু!

লাশ—কাটা ঘরে তুই হাজার কিসিমের মড়া চিরেছিস নারে?

তা অনেক বাবু। বহুত। হাজার হয়ে যাবে বাবু। জোয়ান মেয়ের পেট চিরেছি। পেট চিরে বাচ্চা বের করেছি কত।

নেশার জগতে ঘাটোয়ারিবাবু লাশ—কাটা ঘরে চলে যান! টেবিলের সেই সব যুবতী মেয়ের পাশে তিনি বিচরণ করতে থাকেন। লাশ—কাটা ঘরের গল্প শুনে তিনি মনে মনে অস্থির হয়ে ওঠেন। সেইসব টেবিলের পাশে বিচরণ করতে করতে মনে হয় তিনি পাগল হয়ে গেছেন অথবা মাতাল। লাশ—কাটা ঘরে তিনি প্রেতের মতো ঘুরে বেড়ান। লাশ—কাটা ঘরের গল্প, নেশার ঘোরে বড় জমজমাট। তিনি বললেন—তারপর গোমানি?

তারপর ওরা কলকেটা আরও দুচারবার হাত বদলাল। কলকেতে যখন কোনো আর অবশিষ্ট থাকবে না, তখন চুপ হয়ে বসবে। কেউ কোনো কথা বলবে না। গোমানি না, বাবু না, কৈলাস থাকলে সেও না। চুপচাপ বসে নেশা হজম করবে। দেখলে মনে হবে, ওরা দু’জন চটানের বাইরেকার মানুষ। ওরা দুজন চটানের বুকে সন্ন্যাসী। বাইরের জানালায় তখন রোদ নামব—নামব করছে। পাশের কলতলায় দুটো একটা মড়া আসতে শুরু করেছে। চটানের মানুষগুলো এক দুই করে যে যার কাজে নেমে যাচ্ছে। খাটালে শুয়োর নেই। ঝাড়ো ডোম লাঠির দুপাশে ডালা কুলো নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। মনু ডোমের কবুতরগুলো নেমে এসে ঝাউগাছটায় বসল। মংলি তোশক—লেপ থেকে তুলা বের করছে। হরীতকী জল রোদে দিয়ে বাচ্চা পাহারা দিচ্ছে। কার বাচ্চা, কে জন্ম দিল, সে সব এখন আর হরীতকীর মনে নেই। সে মা হতে পেরেছে ওর কাছে এটাই বিলকুল সত্য।

গত রাতে নেলিও মা হতে চেয়েছিল নদীর ঢালুতে। খুব শখ জন্মেছিল বালিয়াড়িতে গেরুকে নিয়ে পড়ে থাকতে। কিন্তু গেরু তখন বলেছে—তুকে হাম বেশ্যা বানাবে! তু হামারে ও বাত না বলিস। দোহাই তুর ডাক—ঠাকুরের। কিন্তু নেলি যথেষ্ট পরিমাণে পচাই গিলে মাতাল হয়েছিল। শপথের কথা ভুলে গেছিল। রাতের আঁধার, বালিয়াড়ির বাসি দুধের মতো রঙ ওর মা হওয়ার ইচ্ছাকে প্রকট করে তুলেছিল। সেজন্য প্রথমে গেরুর হাত ধরে টেনেছে নেলি, তারপর গেরুকে জড়িয়ে ধরে পিষে ফেলার উপক্রম। নেলি যেন ডাইনি বনে গেল। গেরু ভয় পেল। নেলির চোখ দুটো কেমন সাপের চোখের মতো হয়ে উঠেছে। আর বলেছে, তু হামারে ছেড়ে দিস না গেরু। শক্ত করে ধর। তু ছেড়ে দিলে হামি বাঁচবে না। শরীরে আগুন জ্বলছে। হামারে তু থোড়া শান্তি দে, শান্তি দে তু।

তবু যখন গেরু হাত দিয়ে ঠেলে দিচ্ছিল নেলিকে, যখন নিজের কাপড়টা সামলাচ্ছিল, শরীর আড়াল দিচ্ছিল এবং ওর নেশা ভাঙাবার জন্য বার বার বলছিল, ও ঠিক না আছে, তখন নেলি বলছিল, তু গেরু মা হতে দিবিনে। হামারে বাঁচতে দিবিনে চটানে! তারপর বালিয়াড়িতে সামান্য ধস্তাধস্তি হয়েছিল। গেরু যত জোর করে শরীরটা সরাতে চেয়েছে, তত নেলি গেরুকে দু হাতে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করেছে। শেষ পর্যন্ত গেরু বাধ্য হয়েছিল নেলিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে এবং চটানে ছুটে আসতে। নেলি সত্যি যেন দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে—ডাইনি বনে যাচ্ছে। দুখিয়া যেন ঠিক বলেছে। অথবা পাগল হয়ে গেল। নেলি মা হওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেল। চটানে উঠে এসে সে হালকা বোধ করেছিল।

সে নিজেকে বাঁচাবার জন্যই হাঁপাতে হাঁপাতে চটানে এসে উঠেছিল। সেজন্য ভোরে নেলির মাচানে নেলি পড়ে থাকল, গেরুর মাচানে গেরু। গত রাতের ঘটনার কথা ভেবে ওরা আবার দেখা করতে লজ্জা পাচ্ছিল। ওরা উঠছিল না সেজন্য মাচান থেকে। ঘুমের ভান করে মাচানে পড়ে আছে। যেন কত ঘুম চোখে। যেন কতকাল ওরা ঘুমায়নি। অথবা ভোরের এই ঘুমটা ওদের ছাড়তে চাইছে না। ওরা যতটা পারছে ঘুমিয়ে নিচ্ছে।

জানালায় রোদের রঙটা আরও ঘন হয়েছে। মেঝেতে রোদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। এখন ঘাটোয়ারিবাবুর শরীরে রোদ, মুখে রোদ। জানালা পার হয়ে একটা লোক নেমে গেল। গিরিশ বুঝি। বাবুচাঁদের বাপ। রেলের ঘুণ্টিম্যান। সে সময়ে ওপারে যায়। বাবুচাঁদ শুয়োরের ব্যবসা করে। পাকা ঘর তুলেছে ব্যবসা করে। চটান থেকে দূরে ঘর করেছে। খাটালের জায়গাটুকু এখনও ছাড়ছে না। বাপ পিতামহের জায়গা ছাড়তে নেই।

ঘাটোয়ারিবাবু এখানে বসে খাটাল দেখতে পাচ্ছেন। কাঠগোলা পার হলে বাবুদের পুরোনো দেয়াল। তারপর ভদ্র পল্লী। তিনি জানেন সেখানে যারা বাঁচে, তারা চটানের মতো বাঁচে না। সেখানে ঘর আছে, গৃহিণী আছে। পুত্রকন্যা আছে। দৈনন্দিন বাজার হিসাব আছে। সুখ আছে, দুঃখ আছে, কিন্তু চটানের মতো আগুন নেই। নাচন—কোঁদন নেই।

ঘাটোয়ারিবাবুর চোখ দুটো জ্বলছে তখন। গোমানি ডোম তখন ঝিমোচ্ছিল। তিনি ডাকলেন, এই শালা ঝিমোচ্ছিস যে। মাগনা প্রসাদ পাও বলে তার দাম দিতে জান না!

আজ্ঞে হামি ত ঢুলছি। ঝিমোচ্ছি না।

রক্তের তেজ এখন নেই নারে?

বাবু ও বাত কেনে বুলছেন?

বলব না! তুই ত পেট চিরেছিস, কিন্তু পেট চিরে বাচ্চা বের করেছিস?

কত! কত!

কত! কত! ঠোঁট উলটে বাবু বিদ্রূপ করলেন, কটা করেছিস?

কত হবে? সে যে অনেক বাবু লেখাজোখা নাই। তা হাজার হবে বাবু ধরে লেন।

তুই বললি আর অমনি আমায় ধরে নিতে হবে।

তবে হামি ত নাচার বাবু। হামার ত লেখাজোখা নাই।

তা থাকবে কেন, শালা মদখোর। নেশা করে ভাঙ খেয়ে জীবনটাকে জাহান্নমে দিচ্ছিস। তুই ত নিজের মেয়েটাকে দেখিস নারে? ভালবাসিস নারে! রাতে কোথায় ভাগে সে খবর তুই নিস!

পাশের দরজায় কে ঠকঠক আওয়াজ করছে। দরজার কড়াটা কে যেন ঠকঠক করে নাড়ল। তিনি বিরক্ত হলেন। তবু পা দুটো নামালেন চেয়ার থেকে। অভ্যাসবশত বললেন—কোত্থেকে মড়া এল। কী নাম মড়ার?

কাউন্টারে একটা মুখ দেখা গেল। কাউন্টারের মুখটি খুব বিনীত। উত্তর আরও বিনীত। লোকটি বিনীত। লোকটি জবাব দিল,—আমি মিউনিসিপ্যালিটি থেকে এসেছি।

ঘাটোয়ারিবাবুর বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। দুনিয়ায় ঐ একটি জায়গাকেই ওঁর যত ভয়। কোনো সমন নেই ত! কোনো নালিশ! কোনো আর্জি অথবা মেয়েদের কথা। তিনি তাড়াতাড়ি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। —আসুন, আসুন, কী সৌভাগ্য! বসুন। চেয়ার টেনে দিয়ে কথাগুলো বললেন। ওরে বেটা মুখ্যু কী দেখছিস? যাঃ দরজা খুলে দে। দ্যাখ কে এসেছেন।

গোমানি ল্যাং খেতে খেতে উঠে দাঁড়াল। দরজা খুলে দিল। শেষে এক কোণায় চুপচাপ বসে বাবুকে দেখতে থাকল।

আপনাকে ত এর আগে দেখিনি! যদি দয়া করে….।

আমি নতুন ঘাটোয়ারিবাবু হয়ে এলাম।

ঘাটোয়ারিবাবু ঠিক যেন ধরতে পারছেন না কথাটা। দেয়ালে ছবি টাঙানো। কোণায় গোমানি বসে, দু—একটা মোরগ খুঁটে খুঁটে পোকামাকড় খাচ্ছে। আকন্দ গাছটার পাতায় প্রজাপতি একটা। নানা রকমের সব রঙ ঝুলছে আশেপাশে। ঘাটোয়ারিবাবু এসব ধরতে পারছেন এবং বুঝতে পারছেন, অথচ এই সাধারণ কথাটা তিনি যেন ধরতে পারছেন না। দুঃখ। দুঃখ। ঘাটোয়ারিবাবু খুব ছেলেমানুষ হয়ে গেছেন এখন। —আপনি কী বললেন ঠিক বুঝতে পারলাম না।

আপনার মতো আমিও এ—ঘাটে থাকব। আমি নতুন ঘাটোয়ারিবাবু। সুপারিশের জোরে কাজটা হল। বাবাকে হয়তো চিনবেন, তিনি ট্যাক্স কালেক্টর। অনেক ধরে কাঠ—খড় পুড়িয়ে তবে চাকরি।

দয়া করে নামটা।

বাবার নাম?

কী তোমার নাম বাপু! কাজ ত আমার শেষ হয়ে এল বুঝতেই পারছি। ট্যাক্স কালেক্টর ত চার পাঁচ জন আছেন। কোন জনের তুমি বাপু।

আপনি তেমন ভাববেন না। বুড়ো হয়েছেন বলে আমাকে ওরা কাজটা দিল।

ওহে ছোকরা, তেমন কথা আমি তোমাকে কী বলছি! চাকরি আমার নেয় কে। কার বাবার সাধ্য আছে নেয়। নামটা শুনি এবার।

নতুন বাবু খুব বিব্রত বোধ করছিলেন। তিনি নামটা বললেন, দুঃখভঞ্জন ভট্টাচার্য।

আপনি বামুনের ছেলে ছিঃ ছিঃ কী ব্যবহারটাই না করে ফেললাম। দয়া করে দোষ ধরবেন না। ব্রাহ্মণ! কুলশ্রেষ্ঠ! উপনিষদ পড়েছেন? কঠোপনিষদ, প্রশ্নোপনিষদ, কেনোপনিষদ? পড়েননি? তবে পড়বেন। এখানে যখন ভিড়ে গেছেন তখন একবার পড়তে হবেই। উপনিষদ বলে—পুরুষ আপাদমস্তক পবিত্র। দৃষ্ট পদার্থের মধ্যে যাহাদের প্রাণ আছে তাহারা শ্রেষ্ঠ। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে আবার মনুষ্য শ্রেষ্ঠ। এবং মনুষ্যগণের মধ্যে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ। এসব কথা আমার নয় দুঃখভঞ্জনবাবু। এ—সব কথা মনুর। বলে, ঘাটোয়ারিবাবু গড় হয়ে প্রণাম করতে উদ্যত হলেন নতুন বাবুকে।

দুঃখবাবু ফের বিব্রতবোধ করতে থাকলেন। বড় অদ্ভুত এ—জায়গা তিনি ভাবলেন। তিনি বললেন, এ কী করছেন। ছিঃ ছিঃ বয়সে কত বড় আপনি। না না এ ঠিক হল না আপনার।

ঠিক হয়নি বলতে চান? যেন ঘাটোয়ারিবাবু নতুন বাবুর অপরিপক্বতা ধরে ফেলেছেন। তিনি হেসে আর বাঁচলেন না।

তিনি সামনের টুলটায় বসে খুব উদাসীনের মতো বললেন, ঠিকেরই বা কী আছে আর বেঠিকেরই বা কী আছে। সবই ঠিক সবই বেঠিক। দেখুন না আমাকে? অর্থাৎ আমার এই শিবরাম ঘোষকে। কতকাল এখানে আছি, কত ঠিকও দেখলাম, কত বেঠিকও দেখলাম, কত ঠিকবেঠিক হল—অথচ রেহাই কারও থাকল না। না আমার, না আপনার। মা শ্মশানী সকলকে গিলে খাচ্ছে। খাবে। আমাকে খাবে, আপনাকে খাবে, সকলকে খাবে। সকলকে গিলে খাচ্ছে আর শান্তি দিচ্ছে। কী পাপী কী তাপী! তবু প্রণাম করলাম আপনাকে, আপনি কুলশ্রেষ্ঠ বলে, আপনি জাতসাপের বাচ্চা বলে। ঠিক বেঠিক বুঝিনি, মন চাইল কাজটা হয়ে গেল। এবারে বসুন। চা খান। প্রসাদ পেয়ে সুখী হই।

মাচানে শুয়ে শুয়ে সব শুনতে পাচ্ছে নেলি। কে এমন এসেছেন এই চটানে, যাকে ঘাটোয়ারিবাবু পর্যন্ত সমীহ করে কথা বলছেন। দুনিয়ায় তবে তেমন লোকও আছে, ঘাটোয়ারিবাবু সমীহ করেন! প্রথম ভালো লাগল, পরে খারাপ লাগল ভাবতে। ঘাটোয়ারিবাবুর উপরওয়ালা কেউ থাকুক সেটা ওর ভালো লাগল না। মন চাইল না। সুতরাং খুব ইচ্ছা হচ্ছে উঠে দেখতে—তিনি কে, তিনি কেমন। ইচ্ছা হচ্ছে দেখতে ঘাটোয়ারিবাবুর চোখ—মুখ এখন কেমন দেখতে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘাটোয়ারিবাবুর কথা শোনারও ইচ্ছা। নেলি সেজন্য মাচান থেকে নেমে শরীরে কাঁথা—কাপড় জড়িয়ে ঘাট—অফিসের বারান্দায় উঠে এল। জানালা দিয়ে সে উঁকি দিল। বাবু বসে আছেন, নতুন মানুষটি চা খাচ্ছেন। বাপ খাচ্ছে। ওদের খেতে দেখে তিনি যেন কৃতার্থ হচ্ছেন। রামকান্তের দোকান থেকে চা এসেছে, নেলি বুঝতে পারল। ছোকরা চাকরটা এখনও দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। নেলির এ—সময় ইচ্ছা হল জানতে, মড়া এল না ত! ঘাটোয়ারিবাবুর কোনো পরিচিত জন যদি দূর থেকে মড়া নিয়ে আসে।

নতুন বাবু দেখলেন জানালায় একটি বেশ মিষ্টি মুখ পরম কৌতূহল নিয়ে ওকে দেখছে। নতুন বাবু চোখ তুলতেই মেয়েটা চোখ নামাল। নতুন বাবু বললেন,—মেয়েটা কে?

গোমানি ডোমের বাচ্চা। এই যে গোমানি—বড় মজাদার লোক। এসেছেন যখন নিশ্চয়ই টের পাবেন। বেটা হাসপাতালে লাশ—কাটা ঘরে কাজ করে। বেটা ইসপিরিট খোর। মদ, ভাং, গাঁজ খেয়ে সারাদিন চটানে পড়ে থাকে।

গোমানি নতুন বরের মতো মাথা গুঁজে বসে আছে। এবং মাঝে মাঝে বলছে—কী যে বুলছে বাবু।

নেলি জানালা থেকে প্রশ্ন করল—মানুষটা কে বাবু?

আয়, আয়। ভিতরে আয়। আমাদের নতুন ঘাটোয়ারিবাবু। জাত সাপের বাচ্চা।

নেলি ভিতরে ঢুকল। দূর থেকে গড় হয়ে প্রণাম করল। তারপর জড়োসড়ো হয়ে নতুন বাবুকে এক কোণায় দাঁড়িয়ে দেখতে থাকল। তখন এক এক করে সবাই উঠে এল। সবাই গড় হল। গড় হয়ে সবাই দুঃখবাবুকে চটানের নতুন ঘাটোয়ারিবাবু বলে মেনে নিল।

নতুন বাবু আবার জানতে চাইলেন, এখানে ক’ঘর ডোমের বাস?

হবে ছ’সাত ঘর।

বেশ। বেশ। নেলির দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলেন, তোমার নাম কিগো মেয়ে?

হামার নাম? হামার নাম নেলি। গোমানি ডোম হামার বাপ।

তখন গেরু উঠে এসেছে মাচান থেকে। কৈলাস ফিরেছে ফরাসডাঙা থেকে। দুখিয়া, মনু, বাবুচাঁদ সকলে এসে জড়ো হয়েছে অফিস বারান্দায়। নতুন ঘাটোয়ারিবাবুকে ওরা দেখতে এসেছে। ওদের ভক্তি জানাতে এসেছে। গেরু দেখল বাবুকে—বাবু ওরই মতো সুঠাম, সুপুরুষ। চোখ দুটো বড় বড়। মুখটা ডিমের মতো মসৃণ। সেজন্যই মনে হল সকলের—চটানে মানুষটা বড় বেমানান। অমসৃণ চটানে মসৃণ মানুষটাকে শেষ পর্যন্ত কারও যেন ভালো লাগল না।

নতুন বাবু চলে যাবার পরই এক এক করে সব মনে হতে থাকল ঘাটোয়ারিবাবুর। মনে হতে থাকল আর দুঃখ পেতে থাকলেন। তিনিও একদিন মৃত্যুর ইজারা নিতে এসে দেখেছিলেন পুরানো ঘাটেয়ারিবাবুকে। দেখেছিলেন গহনির স্বামী সোনাচাঁদকে। সোনাচাঁদ তখন ঘাটের ইজারাদার হয়ে বসে আছে, ঘাটোয়ারি হয়ে বসে আছে। মাথায় বড় বড় পাকা চুল। গোঁফ ঝুলে পড়েছে—সাদা। মুখ পাঁচের মতো লম্বা—বনমানুষের মতো চেহারা। শিবরামকে দেখে প্রথম দিন সোনাচাঁদ চটানের এক কোণায় গুম হয়ে বসেছিল। তখন এখানে জলকল ছিল না, গ্যাসপোস্টে আলো ছিল না, বাবু মানুষদের বাড়িগুলো দূর দূর ছিল। ডহর—ডোবায় চারিদিক ভর্তি। চারিদিকে তখন ঘন জঙ্গল। নদী ভেঙে এত এদিকে আসেনি। এ—পারে নদীর কোনো চর ছিল না। এত লোকজন ছিল না, এত মৃত্যু ছিল না। এত মানুষ ছিল না। ক’বছরে শহরটা ভরে গেল যেন। কোত্থেকে সব হুড়হুড় করে লোক এসে এই বেওয়ারিশ জায়গাটাকে পর্যন্ত দখল করে বসল। তখন মিউনিসিপ্যাল অফিসের নজর এল এদিকটায়, জলের কল এল। আলো এল। ট্যাক্স বসল। শিবরাম ঘোষ বুড়ো হলেন।

অশ্বত্থ গাছটা তখন নতুন। সবে সজাগ হয়ে আকাশে ডালপালা মেলে ধরেছে। শিবমন্দিরের পথ ধরে গঙ্গায় নামতে সিঁড়িটা নতুন হচ্ছে। সিঁড়িটা রসকলির মা নিজের নামে গড়িয়ে দিচ্ছে। তোমাদের পদরজ দাও মোরে—নামাঙ্কিত মারবেল পাথরটা গাঁথা হচ্ছে। রসকলির মা নিজের নামে সিঁড়ি বাঁধাতে চাইল। জীবনের সব পাপ ধুয়ে মুছে দেওয়ার জন্য শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করল সে। ঘাটোয়ারিবাবু সব চোখের সামনে দেখেছেন। অন্ধকার গলির মোড়ে সেদিন কত লোক! কত আলো! কত দীন—দরিদ্র! কত ব্রাহ্মণ! কত অলীক ভোজন! কত দান—ধ্যান! রসকলি তখন মাত্র নতুন ব্যবসা ফেঁদেছে। পুরানো বাবুরা চলে যাচ্ছেন ভোজ খেয়ে। তারা আর রসকলির মা সুরবালাকে পাবে না। সুরবালা তীর্থ করতে যাচ্ছে। যাবার আগে এই সব কাজগুলো করে যাচ্ছে।

এই সব ভাবনার ভিতর আরও দূরে চলে যেতে থাকলেন তিনি। অনেক সব কথা মনে হতে থাকল তাঁর। দুঃখবাবু এসে পুরনো দিনের সব স্মৃতিকে ভাসিয়ে দিয়েছেন; যত মনের গভীরে ভেসে উঠছে তত বিষণ্ণ হয়ে পড়ছেন। দুঃখবাবু চটানে যেন আজ ওঁর স্মৃতির ঘরে লুকোচুরি খেলতে এসেছিলেন। গহনির শাপশাপান্ত এতদিন ওঁর জীবনে যথার্থভাবে দেখা দিয়েছে। দুঃখবাবু না এলে এই কথা মনে হওয়ার নয়। তিনিই যে ঘাটের একমাত্র ইজারাদার নন, মৃত্যুর হিসেব—নিকেশের একমাত্র বাবু নন, দুঃখবাবু আজ বড় বেশি হঠাৎ যেন সে কথাটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেল। বড় বেশি—সহসা তিনি বুঝতে পারলেন সোনাচাঁদের হিসেবের মতো দুঃখবাবুও শিবরামের হিসাব রাখবে। সাং—আজিমগঞ্জ, পিতার নাম—হরেরাম ঘোষ। পেশার কথা লিখবে কি? তিনি লিখেছেন কি? তিনি দেয়ালে টাঙানো সব ছবিগুলো দেখলেন। ওরা যেন আজ প্রথম সকলে মিলে হাসল। ঘাটোয়ারিবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, দুধ দিয়ে কাল সাপ পোষা দেখছি। দেওয়ালের ছবিগুলো যত হাসল, তত তিনি ভয় পেতে থাকলেন। তত মৃত্যুর জন্য বেশি চিন্তা করছেন। মৃত্যুর শক্ত মুঠোতে তিনি হাঁসফাঁস করছেন। ভয়ানক! বীভৎস! তিনি ভয়ে শিউরে উঠলেন। নিঃসঙ্গ—নিঃসঙ্গ। সব নিঃসঙ্গ হয়ে যাচ্ছে। বড় একা, বড় বেশি একা তিনি আজ।

স্মৃতির ঘরে অনেক চেষ্টা করেও মাকে মনে করতে পারলেন না, অথবা মাকে দেখতে পেলেন না। তিনি সেই স্মৃতির ঘরে যখন খুব ছুটোছুটি করে মায়ের দেখা পেলেন না, তখন তিনি যেন বাধ্য হয়ে চিৎকার করে উঠলেন—মা! মা! এখন তিনি বুঝতে পারছেন মাকে না মনে হওয়ারই কথা। অথচ তিনি গল্প শুনছেন মার। জানালার গরাদে মুখ রাখার সময় সেই সব শোনা কথা সত্য ঘটনা বলে মনে হয়েছে। তিনি তখন মাকে দেখতে পান। সেই ঘরটা দেখতে পান। পাটকাঠির সেই ঘরটায় ভাঙা জানালা, খড়ের ঢাল—মা মেঝের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছেন, সে মার আশেপাশে দুষ্টুমি করে বেড়াচ্ছে এবং মাকে ঘুম থেকে জাগাবার জন্য নানারকমের ফন্দিফিকির আঁটছে। মা কিন্তু ঘুম থেকে জাগলেন না। মায়ের মৃত্যুটা এমনই নাকি কিছু একটা ঘটনা।

বাবার মুখটা মনে পড়লে ওঁর মুখটা আরও কুৎসিত হয়ে ওঠে। তিনি বড় হয়ে এসব কথা শুনেছেন। তিনি সব মনে করতে পারেন। সেই নিঃসঙ্গ দুঃখদায়ক দিনগুলোর কথা মনে করতে পারেন। তখন বাবা দ্বিতীয় বার বিবাহ করেছেন। বাবা যাকে নিয়ে ঘর করতে চেয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত তাকে ঘরনি পেলেন। ঘাটোয়ারিবাবুর জীবনে দুঃখ বাড়ল। দুঃখ ঘনীভূত হল। তিনি ঘর ছেড়ে পালাতে চাইলেন।

স্মৃতির ঘরে এখন রসকলি হাঁটছে। গলিটার স্মৃতি জাগছে। ছোট ছোট দরজা, ঘিঞ্জি গলি। মুখে সাদা রঙ মেখে, চোখে কাজল টেনে, গ্যাসপোস্টের আলোর নিচে ওরা দাঁড়াত। কেবল রসকলির বাঁধা খদ্দের। ওর ঘরে তখন হারমোনিয়াম বাজাত, ঘুঙুর বাজত। রসকলি ওদের মতো আলোর নিচে দাঁড়াত না, চোখ—মুখ প্রকট করে তুলত না। অথচ ঘাটোয়ারিবাবু মনে করতে পারছেন না সেদিন কী করে এই সব মুখ ঠেলে রসকলির ঘরে গিয়ে উঠেছিলেন। কী করে বাঁধা খদ্দেরের মতো বলেছিলেন—বাহবা অঃ হঃ! বড় সুখের মুখ, সোহাগের মুখ! বড় কমনীয়! কমনীয়? অঃ হঃ!

অভদ্র! শুয়োরকা বাচ্চেচ! দু—চারজন ভদ্রলোক—যারা আসর গরম করছিল তারা এমন সব কথা বলে শিবরামকে তাড়াবার চেষ্টা করেছিল।

শিবরামের চোখ—মুখ জ্বলছিল—প্রথম মাত্রারিক্ত মদ খেলে যা হয়।

শরীরে জড়তা আসছিল, জিভ টানছিল। কথা জড়িয়ে আসছিল। সে কথা বলতে পারছিল না। তবু বলার চেষ্টা করল—অঃ হঃ! সখী আমার! শ্মশানের বীভৎস গ্রাস দেখে সে ভেঙে পড়েছিল সেদিন। সে মদ খেয়েছিল সেদিন। প্রথম মদ খেয়েছিল। প্রচুর মদ।

বদমাস লোকটাকে বাহার নিকালো। আসর গরম—করা লোকগুলো ওকে চ্যাঙদোলা করে বাইরে বের করবার ব্যবস্থা করছিল।

সে চ্যাঙদোলায় দুলতে দুলতে বলল, তোমরা কী করছ! যাচ্ছি। বেশ যাচ্ছি। তারপর ঘাড় কাত করে বলল, সুন্দরী, আমি থাকব না, আমি থাকব না। আমি জল খাব। বুকে হাত রাখার চেষ্টা করল শিবরাম ঘোষ।

রসকলি দেখল। সব দেখল। শিবরাম ঘোষের শরীরের শক্ত বাঁধুনি দেখল। চওড়া কাঁধ দেখল। ডাগর চোখ দেখল। শিবরামের বুকে পিপাসার কথা শুনল। সে একটু দুলে বলল, ওকে ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও। ও গান শুনুক। ওকে বসতে দাও।

সকলে এতটুকু হয়ে গেল। ওরা ওকে ছেড়ে লক্ষ্মী ছেলের মতো যে—যার জায়গায় বসে পড়ল। শিবরাম উপুড় হয়ে পড়ে আছে। হুঁশ নেই, উঠতে পারছে না। যতবার উঠতে যাচ্ছে ততবার পড়ে যাচ্ছে।

রসকলি নিজে সাহায্য করল। ওকে তাকিয়া দিল। পাশে এনে বসাল। তারপর গান ধরল। কিন্তু শিবরামের হুঁশ ছিল না কোনো। সে গান শুনতে পেল না সে শুধু পড়ে থাকল। কতক্ষণ ধরে এইসব গান, মাইফেল হল্লা হয়েছিল তাও সে জানতে পারত না, যদি না রসকলি সবাইকে বিদেয় করে দিয়ে শেষ রাতের দিকে ডাকত, এবার ওঠ নাগর!

শিবরাম যেন ঘুম থেকে জাগল। তাকিয়া থেকে মাথা তুলে বড় বড় চোখে তাকাল—যেন রসকলি কী বলছে সে বুঝতে পারছে না। চোখ দুটো জবাফুলের মতো, চোখ দুটো তবু ঝিমুচ্ছে। নেশা ভালো করে কাটেনি। শরীরে তখনও জড়তা আছে। মাথাটা খুব ভারী ঠেকছে। রসকলিকে এখনও যেন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না, তাছাড়া সে বিশ্বাস করতে পারল না—এ—মেয়েটা ওকে উঠতে বলতে পারে। সে বলল, আমি উঠব না সখি! আমি শোব। ঘুমুব। আর কিচ্ছু করব না। চরিত্র নষ্ট করব না। সখি, আমি ঘুমোব। বলে তাকিয়ার ওপর ফের শরীরটা ঢেলে দিল।

রসকলি চাকরকে ডেকে বলল, ধনুয়া, উসকো বাহার নিকালো। শিবরাম চোখ পর্যন্ত খুলল না। অথবা খুলতে ইচ্ছা হল না। এত জড়তা শরীরে, এত বেশি সে অবসন্ন। চাকরটা তবু যদি ঠেলে বের করে দেয়! ওর কিন্তু উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে না, শিবরাম মনে মনে খুশিই হল।

চাকরটা এসে শিবরামের ঘাড় ধরে বের করতে গেলে রসকলি বলল, থাম। ওকে বিছানাটা ভালো করে পেতে দে। শুইয়ে দে। আর সারারাত এখানে বসে থাকবি। বাতাস করবি।

রসকলি মুখটা শিবরামের মুখের কাছে নিয়ে গিয়ে বলল, হ্যাঁগো নাগর, তোমার কেউ নেই ত?

কেউ নেই।

কেউ নেই! সত্যি বলচ?

সত্যি বলচি। কেউ নেই। এতটুকু বয়সে সব গেছে। এতটুকু বয়সে বাবা ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। আর এতটুকু বয়সে লোকের হয়ে মড়া পোড়াতাম। ক’দিন যাবৎ ঘাটোয়ারিবাবু হয়ে আছি। এতটুকু বলার সময় শিবরাম হাতদুটো বিনীতভাবে ফাঁক করল। রসকলি ঘাটোয়ারিবাবুর এমন সব কথায় না হেসে পারল না।

সেই থেকে শিবরাম রোজ সন্ধ্যায় যেতেন। গহনির স্বামীকে যাবার সময় বলতেন, তুমি দেখবে ঘাট। দিনে আমি। রাতে গিয়ে রসকলির ঘরে পড়ে থাকতেন এবং অন্য সব খদ্দেরদের সঙ্গে মাইফেল করতেন। কিন্তু বেশিদিন শিবরামের ওসব ভালো লাগেনি। রসকলি অন্য খদ্দেরদের সঙ্গে ন্যক্কারজনক কথা বললে তিনি মনে মনে রেগে যেতেন। এবং রসকলি যখন খদ্দের নিয়ে ভিতরে চলে যেত, তখন তিনি রাগে অভিমানে উঠে আসতেন। চটানে হরীতকী তখন বড় হয়ে উঠেছে, ঘাটোয়ারিবাবুর ভাত জল দিতে পারছে। ঘর—দোর দেখাশোনো করছে।

একদিন শিবরাম জানালায় মুখ রেখে বসল। রসকলির ওপর রাগে—দুঃখে কিছু ভালো লাগছে না। গরাদে মুখ রেখে শপথ করল—কোনোদিন সে গলির আঁধারে হারিয়ে যাবে না। রসকলি তার মক্কেলদের নিয়ে থাক, রসকলি দিন দিন চরিত্র নষ্ট করে শরীর নষ্ট করুক, যততত্র ঘুরে বেড়াক—ঘাটোয়ারিবাবুর কোনো আসবে যাবে না। রসকলি নষ্ট মেয়ে, নষ্ট মেয়ের আবার চরিত্র, তার আবার শরীর, তার আবার ভালোমন্দ। নষ্ট মেয়ের আবার ভালোবাসা। তিনি যাবেন না। আর যাবেন না—এমনিই একটা যখন শপথ করছিলেন তখন দরজার কড়া নড়ল। কে যেন দরজার কড়া নাড়ল।

কে দরজায়।

আমি গো আমি।

ঘাটোয়ারিবাবু বুঝতে পেরেছিলেন রসকলি দরজায় দাঁড়িয়ে। তিনি ভেবেছিলেন তিনি উঠবেন না, তিনি দরজা খুলবেন না, জানালা থেকেই বলবেন, শরীর ভালো নেই। কিন্তু তিনি পারলেন না। উঠলেন, দরজা খুললেন। সহসা সবকিছু আবার ভালো লাগল। চটান ভালো লাগল। দরজা খোলার সময় তিনি অদ্ভুত আরাম পেলেন। তবু কিছু একটা অজুহাত দেখাতে হয়! তিনি বললেন, শরীর ভালো যাচ্ছে না।

রসকলি শিবরামের শরীরে হাত দিল। কপালে হাত রাখল এবং উত্তাপ দেখল। তারপর কাছে টেনে নিয়ে বসাল। বলল, আজ তোমার এখানে থাকব। গলিতে ভালো লাগছে না।

শিবরাম শঙ্কিত হল।—না, না, এ চটানে নয়। বড় খারাপ জায়গা। বরং তোমার ঘরে চলো।

আমার ঘরে কত মক্কেল। ওদের থেকে পালিয়ে এলাম।

ওদের আসতে বারণ করে দাও।

তবে আমার সংসার চলবে কী করে? বুড়ো বয়সে আমাকে কে তীর্থ করাবে?—পয়সা পাব কোথায়?

আমি দেব।

তুমি পারবে এত দিতে!

শিবরামের মনে হল তখন—সে বড় নিঃস্ব। মনে হল রসকলির জন্য তার কিছু করার নেই। ভাবল রসকলিকে নিয়ে বরং কোথাও চলে যাওয়া যাক। কিন্তু মায়ের মৃত্যু, বাপের তিরস্কার এবং সৎ—মায়ের অত্যাচার, তারপর মড়া পুড়িয়ে অন্ন সংগ্রহ, সব ওকে বিষণ্ণ করে তুলল। দুঃখ! দুঃখ! শুধু দুঃখই সেখানে। সেই করুণ অতীত ওকে চটান ছাড়তে দিল না। হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলতে দিল না। অফিসের মাসোহারা ওকে চটানে আবদ্ধ করে রাখল। একটা জীবনের জন্য চটানে কোনো অভাব নেই, কোনো দুঃখ নেই। চটানটা শিবরামের সুখের জগৎ। ইচ্ছা করলে সে এখানে বসেই দুটো মানুষের মতো অন্ন সংস্থান করতে পারে। ইচ্ছা করলে সে এখানে বসেই রসকলিকে তীর্থ করাতে পারে। এই চটানে বসে ইচ্ছা করলে সে ওর সব, সব কিছু করতে পারে। শুধু পারে না চটান ছাড়তে—হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলতে।

রসকলি আবার বলল, আছে তোমার এত টাকা?

আছে।

রোজ তুমি আমায় খুশি করতে পারবে!

টাকা দিয়ে?

না সব দিয়ে। পারবে! যদি পার কালই মক্কেলদের ভাগিয়ে দেব। কালকেই ঘরটা একমাত্র তোমার হবে। রসকলি আর কারও না, তোমার। যদি পার, তুমি আমায় কথা দাও।

পারব। ঘাটোয়ারিবাবু কথা দিলেন। আর অক্ষরে অক্ষরে সে কথা তিনি পালন করলেন। সে একদিন গেছে।—টাকা চাই সোনাচাঁদ?—কত টাকা। —লেকিন বাবু থোরা সবুর করতে হবে।

দূর দূর থেকে তখন মড়া আসত। দশ ক্রোশ, বিশ ক্রোশ হবে। গঙ্গা পাইয়ে দিতে আসত তারা। দশ, বিশ ক্রোশ আসতে মড়াগুলো ফুলেফেঁপে উঠত। তারা তিন চার দিনের পথ হেঁটে এসেছে। মড়াটা ওরা চটানে নামাত। দুর্গন্ধ উঠত। চটানের আশেপাশে কেউ দাঁড়াতে পারত না দুর্গন্ধে। সোনাচাঁদ তখন বলত, ওদের ছেড়ে দ্যান বাবু। ওরা চলে যাক। ঘাটোয়ারিবাবু মড়ার নামধাম লিখে নিয়ে বলতেন, তোমরা যাও বাপুরা! মড়া পোড়াতে হবে না। আমি পুড়িয়ে দেব। তারপর ওদের আরও কাছে ডেকে বলতেন, কাঠের দামটা ত তোদের শালা লাগতরে। ওটাও লাগল না। ও দিয়ে তোরা রামকান্তর দোকানে বেশি পচাই খেতে পারবি। যা। যা। তোদের বেশি টাকা হল, সোনাচাঁদেরও বেশি টাকা হল। ঘাটোয়ারিবাবুরও বেশি টাকা। কাঠের টাকা বাঁচল। তিনি কিছু কাঠ চুরি করে বেচে দিতে পারবেন। এবং মড়াটা নিয়ে সোনাচাঁদ আশেপাশের কোনো খানাখন্দের ভিতর পচিয়ে রাখত। গহনির বড় ছেলে কৈলাস তখন নিখোঁজ। কৈলাস তখন কাছাড়ের জঙ্গলে ঢুঁড়ে বেড়াচ্ছে। ওস্তাদ হারুন রসিদের দরগায় মন্ত্র নিচ্ছে হেকিমি—দানরির।

কৈলাস কিন্তু একদিন কঙ্কাল সংগ্রহ করে জীবনধারণ করতে হবে ভেবেই ভয়ে চটান ছেড়ে পালিয়েছিল এবং সেই থেকে অনেক দেশ দেখেছে। আসামের জঙ্গলে ঘুরেছে—হারুন রসিদের দরগা আবিষ্কার করেছে কাছাড় জঙ্গলে। সেখানেই সে বিদ্যা আয়ত্ত করল হেকিমি জীবনের। বেঁচে থাকার কিছু একটা সুরাহা করল। বাপের মতো পচা গন্ধ শুঁকতে পারল না। শেয়াল কটাশের মতো বন—বাদাড়ে ঘুরে ঘুরে শরীর নষ্ট করতে পারল না। অথচ কৈলাস এখন বিশ্বাস করেছে যা নসিবে লেখা আছে, তার খণ্ডন নেই। নতুবা দ্বিতীয় পক্ষের বৌটাই বা পালাবে কেন, ডোমন সা—ই বা সেই ফাঁকে জীয়ন হাড়টা চুরি করবে কেন। নসিব সকলের উপরে। নসিবের হাত থেকে কারও রেহাই নেই। না দরগার রসিদের, না কৈলাসের! না বাবুচাঁদ, না সোনাচাঁদের। পা ফকির দরবেশের, না বেইমান পুরুষের। কারও রেহাই নেই, কারও রেহাই নেই। সব নসিব। নসিবের জন্য রসিদকে খুন করে কৈলাস জীবন হাড়টা চুরি করল। হেকিম ব্যবসা ফাঁদল দেশে ফিরে। শাদি করল। তখন গহনি বেঁচে নেই কৈলাস তখন জোয়ান মরদ। রাহু চণ্ডালের হাড়ের দৌলতে পয়সার শেষ নেই। কিন্তু নসিবের জন্য প্রথম বৌটা গেল। সে ঘরে ফিরে একদিন দেখল ভালো বৌটা বমি করছে। দু—বার পায়খানা। তারপর শেষ। নসিবের ঘরে ফাঁকি নেই। খুনের বদলা নিল।

কিন্তু এখন দেখলে মনে হবে কৈলাস নসিবের ঘরেই বদলা নিচ্ছে। অথবা নসিবের ঘরে চুরি করছে। নসিবের ঘরে গেরুকে কৈলাস জিম্মায় রাখতে পারছে না। ওর যে করে হোক কোনো হিল্লে করতে হয়। চটানে বেঁচে থাকার এলাদ খুঁজতে হয়। একটা পাকা ব্যবস্থা করতে হয়। তিনটে কবচের বিশ্বাসকে দৃঢ় করে, শাদি—সমন্দ করে, গেরুকে নসিবের হাত থেকে দূরে রাখার ইচ্ছা। কিন্তু বেইমান বাচ্চাটা তার কী বুঝবে! ডাইনি মাগির সাথে ঘুরে বেড়াবে শুধু। কৈলাস ফরাসডাঙা থেকে ফিরে আসার পর এমন কিছুই মাচানে বসে ভাবছিল। তৃতীয় পক্ষের বৌটার নালিশ, গেরুটা কাল রাতেভি গেল। নেলির সাথ হল্লা করল। তু কিছু না বুলছিস ত ওটা আরও বাড় বাড়বে।

কৈলাসের চোখ দুটো লাল হচ্ছে। চটানে চোখ দুটো ঘুরছে। মাচান থেকে উঁকি মেরে মেরে গেরুকে খুঁজছে। গেরুকে চটানে না দেখে ওর তেষ্টা পেল। ও জল খেল।

বৌটা কৈলাসকে যখন জল দিল তখন হরীতকী রুটি সেঁকছে। দু’জনের রুটি। হরীতকী এবং ঘাটোয়ারিবাবুর। হরীতকী বাচ্চাটাকে উঠোনে শুইয়ে রেখেছে। সমস্ত শরীর তেল মাখিয়ে রোদে শক্ত করছে। মেয়েটা কাঁদছে না—হাত—পা নেড়ে খেলছে। এই সব দেখে কৈলাস গেরুর কথা ভাবল। ওর ছেলেবেলাকার কথা ভাবল। চটানে শুয়ে শুয়ে ওর হাত—পা নেড়ে খেলার কথা ভাবল। এই সময় কৈলাস পকেট থেকে একটা নাকছাবি তুলে মাটির গেলাসের বাকি জলটুকুতে ফেলে দিল। উঁকি দিল গেলাসটায়। নাকছাবিটা সোনার কী তামার দেখার ইচ্ছা হল। বেওয়ারিশ মড়ার নাকছাবিটা ঘষতেই টের পেল ওটা রুপোর! গেরুর মা—র কথা মনে হল। একটা নাকছাবির কথা মনে হল। নাকছাবিটা রুপোর। ঠিক এইরকম দেখতেই যেন। ঠিক যেন এইরকম। একরকম। একরকমের গহনা, বুঝি হতে নেই! ওর ইচ্ছে এখন এই সব মন্দ ভাবনা থেকে সরে দাঁড়ায়। এই সব ভাবনা ওকে বিষণ্ণ করে তোলে। বারবার রাহু চণ্ডালের হাড়টার কথা মনে হয়। রাগে দুঃখে গেরুর মাকে গাল দিতে ইচ্ছে হয়। লাথি মেরে দাঁত ভাঙতে ইচ্ছে হয়। ফের কষ্ট হয় গেরুর মার জন্য। গেরুর মা ঘরে থাকলে হাড়টা বুঝি চুরি যেত না, রাতের আঁধারে ডোমন সা পালাতে পারত না।

বেশ চলছিল তার সেই হেকিমি জীবনটা। ভোরে উঠে দুটো জল—ভাত মুখে দিয়ে ডাকত গেরুকে। পাশে বসতে বলত। সে বসত। গেরু বসত। জড়িবুটিগুলো সামনে বিছিয়ে রেখে সহসা একটা জড়ি তুলে বলত, বুল তরে বাপ এটা কি?

এটা জীয়ন হাড়।

বুলতে পারিস বেম্ম চণ্ডালের হাড়, লয়তো রাহু চণ্ডালের হাড়।

এ দিয়ে কী হয়?

জড়িবুটির কাজ—কারবারে লাগে।

বেশ। বেশ। তু আচ্ছা বুলে দিচ্ছিস। কৈলাস এ সময় একটা নরসিং ঝাপ তুলে ধরে বলত, এটা কোন ব্যারামে লাগে। কোন ব্যারামের জড়িবুটি। বুলতে লারলি?

গেরু বলত, এটা নরসিং ঝাপ।

এটা কী?

এটা দুর্গা ঝাপ।

কৈলাস বলত, এটা ঈশ্বর ঝাপ, কালী ঝাপ।

গেরু বলত, এটা বন রুই মাছের ছাল, হেমতাল কাঠ।

কৈলাস বলত, কুলকুহলীর গাছ।

গেরু বলত, মরদ রাজের মূল।

কৈলাস গেরুকে তন্ত্র—মন্ত্র শেখাত এবং ভাবত—গেরুটার মনে তন্তর—মন্তরের বিশ্বাসকে দৃঢ় করতে হবে। সেজন্য জড়িবুটির নাম, কী কায়দা আছে জড়িবুটিতে, কোন ব্যারামে কোন জড়িবুটি লাগে—সব সে গেরুকে যত্ন নিয়ে শেখাত। ওর ইচ্ছা গেরু যেন মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে—দানবি বিদ্যার একটি অপার্থিব শক্তি আছে। গেরুও অকৃত্রিম বিশ্বাস নিয়ে সে বিদ্যা আয়ত্ত করছে। কিন্তু কীসে কী হল, কী হয়ে গেল—ভোরে উঠেই কৈলাস দেখল কাঠের বাক্সটা থেকে রাহু চণ্ডালের হাড়টা এবং দামি গাছগাছড়াগুলো চুরি গেছে। বাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে সেদিন কৈলাস হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেছিল!

সে কেঁদেছিল ওর অকৃত্রিম দ্রব্যগুণের জন্য নয়। কেঁদেছিল ওর ব্যবসা মাটি হল বলে। গেরুর দিকে চেয়ে ওর দুঃখ বাড়ছিল,—চটানে বাচ্চাটা দু—মুঠো খাবে কী করে! চটানে যারা কাঠ বয়ে খায়, তাদের প্রায় উপোস দিতে হয়। অন্যদল শহরের বেড়াল—কুকুর তাড়িয়ে অথবা ফেলে পয়সা রোজগার করে। তাদেরও সে উপোস করতে দেখেছে। একমাত্র রয়েছে হাসপাতাল। কিন্তু ইসপিরিট—খোর গোমানি বেঁচে থাকতে গেরু সে কাজ পাবে না। মরলেও না। চটানের সে দিকটা হাঁ করে আছে!

সেদিন কৈলাস প্রথম গালমন্দ দিল গেরুর মাকে। গেরুর মা ঘরে থাকলে ডোমন সা রাহু চণ্ডালের হাড় এবং দামি গাছগাছালি চুরি করে উধাও হতে পারত না। গেরুর মার ঘুম ছিল পাতলা। মাচান নড়েছে ত বৌটা জেগে উঠেছে। মাচানের নিচে শব্দ হয়েছে ত বৌটা জেগে উঠেছে। মাচানের নিচে শব্দ হয়েছে ত বৌটা কুপি জ্বেলেছে। কৈলাস ঘুমের ভিতর হেসে উঠেছে ত বৌটা মাচানে উঠে বসেছে। লম্ফ জ্বালিয়ে বলেছে, কিরে মরদ, খুব যে হেসে লিচ্ছিস বড়।

কৈলাস সেই শব্দে মাচানে উঠে বসল। চোখ দুটো রগড়াল। কুপির আলোতে বৌটাকে ঝাপসা মনে হল। নজর আসছে না ঠিকমতো। সে বুক হেঁচড়ে বৌটার কাছে গেল। বৌটা তখন হাসছে। হাসিতে বত্রিশটা সরু দাঁত উপচে পড়ছে যেন। বৌকে হাসতে দেখে সেও হাসল। হাসির জোয়ারে ওরা ভাসল। বর্ষার চিতা ঘাট—অফিসের কাছে এসে গেছে। চিতার আগুনে সে বৌটার মুখ পরিষ্কার দেখল। বৌটার কাছে ঘন হয়ে বসল। এবং চিতার আলোতে ওরা ভালোবাসার গল্প করল। কিন্তু সেই কৈলাস ভোরে গেরুর মার উঠতে দেরি দেখে, সকাল সকাল এক সানকি ভাত দিতে দেরি হল বলে কপালে লাথি মারল। কপাল ভালো বলে, কপালের লাথি মুখে লেগেছে। কৈলাস বলেছিল, শালীর হামার ঘুমে পোষায় লাগ।

লাথির জন্য গেরুর মার দাঁত ভাঙল। ঠোঁট কেটে গেল। চারিদিক অন্ধকার দেখল মেয়েটা! তিন চারদিন ধরে সে চিৎকার করল চটানে। তিন চারদিন ধরে নাচন—কোঁদন হল। তিন চারদিন ধরে ওরা দুজন এক মাচানে শুল না। ভাত রাঁধল না। গেরুটা নিচে পড়ে কাঁদল, একবার কৈলাস ধরে কোলে নিল না। অথচ পাঁচ দিনের দিন রাতের কী শলাপরামর্শতে ভোরবেলা কৈলাস ডাকল, চলেহ গেরুর মা।

ডাক্তারখানায় গিয়ে কৈলাস বলল, ডাগদারবাবু আছাড় পড়ে দাঁত টুটে গেল। বহুত কষ্ট পেয়ে লিচ্ছে বহুটা। দুটা দাঁত ওয়ার টুটে গেল।

কৈলাস পয়সা খরচ করে টাকা দিয়ে দাঁত বাঁধিয়ে দিয়েছে। এবং সেই তামার বাঁধানো দাঁত নিয়ে যখন গেরুর মা হাসত কুপির আলোতে, কৈলাস তখন ভাবত—ওর বৌর মতো রূপের বৌ চটান জুড়ে কেন, শহর জুড়েও বুঝি নেই। সে হেসে বলত খুশি হয়ে—দাঁত টুটে তুর রূপ যে বাড়লরে বৌ। হাসলে তুর রূপের জৌলস আরও খুলে পড়ছে।

তখন মাচান থেকে নেমে আসত গেরুর মা। তখন চুপ করে দাঁড়াত কৈলাসের সামনে। চোখ দুটো ডাগর করে তুলত। উনুনের পাশ থেকে নোড়াটা নিয়ে বলল, রূপের বাহার যখন খুললই হামার দু দাঁত বাঁধিয়ে তখন বত্তিশটা দাঁত টুটে ফের না হয় বাঁধিয়ে দে। বলে খিলখিল করে হাসত গেরুর মা। চটানের মেয়ে মরদেরা বলত, মাগির ঢং দেখ।

সেই গেরুর মা শেষ পর্যন্ত চটান ছেড়ে পালাল। এখন কৈলাসের আপশোশ হয়। আপশোশ, কেন সে গেরুর মার বত্তিশটা দাঁতই ভেঙে দিল না। কেন সে দুটো দাঁত বাঁধিয়ে দিতে গেল। বত্তিশটা দাঁত ভাঙলে ওর রূপ ডুবত, জৌলুস কমত! চটানে পড়ে থেকে চিল্লাত শুধু। অন্তত শেষ বয়সে তবে কাটোয়া থেকে আর একটাকে ধরে নিয়ে আসতে হত না। বাপ—নানার ব্যবসা কাঁধে চাপিয়ে ঘোড়দৌড় করতে হত না।

গেরু ঘরে ঢুকতেই মাচানে উঠে বসল কৈলাস। বলল, তু কাঁহা যাস, কাঁহা ঢুঁড়ে বেড়াস? এ ঠিক না আছে গেরু। আভি ত তু বড় হো গেলি। থোড়া সমজে না চললে তুর শাদি—সমন্দ হাম কেইসে করে।

হাম ত আভি শাদি না করে বাপ।

কাহে তু শাদি করবি না।

গেরু চুপ করে থাকল। মাচানের পাশে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে রাখল। গেরুকে দেখে কৈলাসের জেদ বাড়ছে। পুষে বড় করা বাচ্চাটা বলছে কী!—তুকে জরুর শাদি করতে হোবে। কৈলাস এ—সময় নিজের ওজনটা মেপে দেখতে চাইল।

না করি ত…।

তু শাদি করবি না!

না করি ত!

না করিস ত চটানে ভুখা থেকে মরবি। পেটে ভুখা থাকবি, মনে ভুখা থাকবি। এ—আচ্ছা বাত লয় গেরু। হাম মর জানসে তুকে কোন দেখবে? কোন তুকে পিয়ার করবে? বুল? বুল! চুপ করে থাকলি ক্যানে? চুপ করে থাকলি চলবে? হামি মর যানেসে তুকে কোন দিক ভালো করবে? তুকে জরুর শাদি করতে হবে। ডাইনি মাগির সাথ তু ঘুরবি ত হাম জরুর চটানে সালিসি মানাবে। তু কি ভাবিস হামি কৈলাস মরে গেছি?

গেরু এবারেও কোনো জবাব না দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। কৈলাস মাচানে বসে দু—তিনবার ফোঁসফোঁস করল। তারপর নিচে নেমে ডাকল বৌকে, তু খেতে দে। হামি আজ জিয়াগঞ্জ যাবে। ঢাউস ডোমের বিটির খোঁজ করবে। গেরুর শাদি—সমন্দ হামি জরুর করে লিবে। কৈলাস খেতে বসে বিড়বিড় করে বকল, তুর মাই হামারে জাদা সুখ দিয়াছে আর তুত গেরু। পুষে বড় করা বাচ্চা। মা মনসার বাহনের লাখান লিকলিক করছিস। ফাঁক পেলেই ছোবালা বসাবি। ও বাত হামার না জানা আছে ভাবিস তু।

খেতে বসে কৈলাসের চোখ দিয়ে জল পড়ল। পুষে বড় করা বাচ্চাটাও বেইমানি করতে শিখেছে। বাচ্চাটা বুলে কিনা—না করি ত! হামার মরদরে তু!

গেরুই প্রথম খবরটা দিয়েছিল নেলিকে। —জানিস বাপ জিয়াগঞ্জ গেল।

নেলি গঙ্গা—যমুনাকে আদর করছিল। গঙ্গা—যমুনাকে ধরে গালে লেপ্টে দিচ্ছিল। গেরু পাশে দাঁড়িয়ে ফের বলল, জানিস বাপ জিয়াগঞ্জ গেছে।

ঝাউগাছটা থেকে একটা ডাল ভেঙে পড়ল। কাকের পুরনো বাসা থেকে খড়কুটো উড়ল। দুটো প্রজাপতি উড়ছে আকন্দ গাছে। মুরগিরা সব ডিম পাড়ছে। নতুন ঘাটোয়ারিবাবু এসে অফিসঘরে বসেছেন। পুরনো বাবু গল্প করছেন নতুন বাবুর সঙ্গে। দুঃখবাবু মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে নেলিকে দেখছেন। ওর কুকুর দুটোকে আদর করা দেখছেন। বাঘের মতো কুকুর দুটোকে দেখে বাবুর ভয় বাড়ল। তিনি চোখ তুলে ফের পুরনো বাবুকে দেখলেন এবং ফের গল্প আরম্ভ করলেন।

নেলি কুকুর দুটোকে আদর করতে করতে চোখ তুলে একবার বাবুকে দেখল। একবার গেরুকে দেখল।

গেরু ফের বলল, বাপ জিয়াগঞ্জ গেছে। বাপ জিয়াগঞ্জ শাদি সমন্দ দেখতে গেল।

কার শাদি সমন্দ?

তু বুঝি জানিস না! হামার শাদি সমন্দ।

তুর বাপ গেল আর যেতে দিলি?

হামি বারণ করলাম। লেকিন শুনল না।

তু বুলতে লারলি নেলি হামার বিবি হবে। বুলতে লারলি নেলির সাথ হামার বাতচিত হয়ে গেছে। বুলতে লারলি অন্য চটানে উঠে যাব এক রোজ। তুর বাপ বুলল আর ভেড়ির মতো সব বাতচিত শুনলি।

তু বুলতে পারতিস তুর বাপকে গেরুকা সাথ হামার শাদি হবে। বুলতে পারতিস গেরু হামার মরদ হবে।

ওরা দুজনই দুজনের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল। দুজনেই গোপনীয় কথা বলছিল। কেউ দেখতে পাচ্ছে না; একমাত্র দুঃখবাবু ওদের দেখতে পাচ্ছেন। মুখ ফেরালে ঘাটোয়ারিবাবুও ওদের দেখতে পাবেন। ওরা কাঠগোলার পাশে, শুয়োরের খাটালের গলিতে দাঁড়িয়ে বচসা করছে না, ওরা ফিসফিস করে কথা বলছে। দুঃখবাবু ওদের দুজনকে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন। কিছু তিনি শুনতে পাচ্ছেন না অথবা ওরা আরও ঘন হল না। ওরা আরও ঘন হলে তিনি হয়তো চোখ নামাবেন।

নেলি বলল, জরুর পারি বুলতে। আভি বুলতে পারি বাপকে। বাপ গেরু হামার মরদ হবে। দেখবি? দেখবি তু? নেলি গঙ্গা—যমুনাকে নিয়ে এই মুহূর্তে বাপের কাছে ছুটতে চাইল। যেন এই মুহূর্তে বলা চাই বাপকে।

—বাপ গেরু হামার মরদ হবে। বাপ হামার আর গেরুর বাতচিত ঠিক হয়ে আছে। তু মানা না করে।

গেরু বলল, থাক, আভি তুকে বুলতে হবে না। বাপকে জিয়াগঞ্জ থেকে ফিরতে দে। হাম বাপকে জরুর বুলবে।

নেলি বলল, অঃ। হামার মরদরে! তুর মতো মরদ হামার লাগে না। বলে একটা বিদঘুটে শিস দিল নেলি, কুকুর দুটোকে নিয়ে গঙ্গার ঢালুতে ছুটল। এখন যেন কোনো দুঃখ নেই নেলির। যেন কোনো আপশোশ নেই গেরুর শাদি—সমন্দের জন্য। মরদের জন্য কষ্ট হয়। মেয়ে মানুষের জন্য কীসের আবার কষ্ট! জিয়াগঞ্জের মেয়ে গেরু ধরে আনুক, শাদি করুক, সুখে থাক—ওর কোনো আপশোশ নেই।

নেলি কুকুর দুটোকে নিয়ে বালির চরে নামল। তারপর কুকুর দুটোকে ছেড়ে দিল। কুকুর দুটো ছাড়া পেয়ে মাটির গন্ধ নিতে নিতে উপরে উঠে গেল। এই বালির চরে নেলি এখন একা। নিঃসঙ্গ। শীতের নদীতে কোনো শব্দ নেই। জলে ঘূর্ণি নেই। জল কাচের মতো অথবা আয়নার মতো। দুটো একটা করে পাখি উড়ে যাচ্ছে। নদীর জলে তাদের ছায়া পড়ল। নেলি জলের আয়নায় মুখ দেখল। চোখ দেখল। জিয়াগঞ্জের মেয়ে ওর চেয়ে খুবসুরত কিনা জলের আয়নায় যাচাই করল। একটু জল তুলে নেলি মুখে দিল। মুখ ধুল। দুটো—একটা মাছ নড়ল জলে। জলের আয়নায় নেলির মুখটা হারিয়ে যাচ্ছে অথবা কাঁপছে। অথবা মুখটা ঝাডোü ডোমের বৌয়ের মতো হয়ে গেল। মুখটা জলে কাঁপছে, কুৎসিত হয়ে উঠছে। যখন শ্যাওলার আঁধারে মাছদুটো হারিয়ে গেল নেলি তখন বালিয়াড়িতে উঠে এল এবং বালির ওপর বসে পড়ল। দু—হাঁটুর ভিতর মুখ গুঁজে দিল। বুকের ভিতর কেমন যেন কষ্ট হচ্ছে। নেলি বুকে হাত রাখল। গেরুর শাদি হবে, সমন্দ হবে। ঠোঁটে অনেকবার শব্দগুলো ভেঙে পড়ল। ওর কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট। এই কষ্টটুকু গেরুর কাছ থেকে আড়াল দেওয়ার জন্যে সে যেন এখানে এসে বসেছে। মুখ ধুয়েছে জলে। গেরুর সামনে শিস দিয়ে নিজের কষ্টকে আত্মগোপন করেছে। যেন কিছুই হয়নি। যেন এমন হামেশাই ঘটে থাকে। মরদের কথা ঠিক থাকে না, থাকবার নয়। গেরু অন্যত্র শাদি করবে এটা যেন জানাই ছিল নেলির।

বালির চরে নেলি অনেকক্ষণ বসে থাকল। বাপ হয়তো এখন লাশ—কাটা ঘর থেক বের হয়েছে। গাছের নিচে বসে ইসপিরিট খাচ্ছে। মাসের পয়লা। বাপ মাইনে পাবে। আজ দুটো ভালোমন্দ খাবে নেলি। বাপ ভালো ভালো সওদা করবে। এ—দিনটাতেই নেলির সুখ। এ—দিনে বাপ নিজে বেশি খেতে চাইবে না। নেলিকে সব খাওয়াতে চাইবে। এখন কিন্তু নেলির উঠতে ইচ্ছা হচ্ছে না। গতরাতে গেরু এবং সে এখানেই বসেই হল্লা করেছে। নেলির সব মনে পড়ছে এখন। নেলির যত মনে পড়ছে তত কষ্ট বাড়ছে তত এই চরে বসে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে। বসে গত রাতে গেরুকে ধরে মরদ বানাতে চেয়েছে। মা হতে চেয়েছে। সেই গেরুর শাদি হবে। সমন্দ হবে। কৈলাস যখন বের হয়েছে তখন সে ঠিক না করে ফিরছে না। জিয়াগঞ্জের সব কটি মেয়ের মুখ সে মনে করার চেষ্টা করল। ওরা ওর চেয়ে কত খুবসুরত তা নিয়ে মনে মনে ফয়সালা করল। সে বসে বসে ভূতি, শনিয়া এবং আঁধারীর কথা ভাবল। জিয়াগঞ্জের সবকটি মেয়ে ওর দুশমন হয়ে গেছে। আঁধারীকে ধরে গেনু একবার একটা কেচ্ছা করেছিল। গঙ্গা পুজোর রাতে সেই কেচ্ছার কথা ভেবে সে হাসল। সেদিন ডোমেদের সব মেয়ে—মরদেরা পয়সা নিচ্ছে যাত্রীদের কাছ থেকে। জিয়াগঞ্জ থেকে সে তিনটে মেয়েও এসেছিল। আঁধারী এসেছে, ভূতি এসেছে। আঁধারী এবং গেরু রাতে কোথায় হারিয়ে গেল। লখি, ধুনুয়া তদারক করল। খুঁজল। নেলি ওদের খুঁজে বার করল। সেই নিয়ে কত কথা। কত কেচ্ছা। হয়তো সেই আঁধারীই গেরুর বিবি হয়ে আসছে।

এই বালিয়াড়িতে বসে নেলি ভেঙে পড়েছে। যন্ত্রণাটা বুকের ভিতর অসহ্য ঠেকছে। যে—গেরুকে মরদ বানাবার এত শখ সেই গেরু হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। গেরুকে নিয়ে আঁধারীর কত শখ, কত সুখ পাবে। যে পুতুলের জন্য নেলি রং গুলতে চেয়েছিল, সে পুতুলটা শেষ পর্যন্ত আঁধারীই পাবে! সব কিছু অসহ্য লাগছে নেলির সেজন্য। চারিদিকে সে চাইতে থাকল। যেন সে গেরুকেই খুঁজছে। কুকুর দুটো তখন অনেক উপরে। অনেক দূরে। মাটির গন্ধ নিতে নিতে বাবলার ঘন বনে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। ওদেরও সুখ আছে, ওদেরও শখ আছে। বাবলার ঘন বনে হয়তো ওরা সে সুখ এবং শখকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু নেলির কিছু নেই। না সুখ, না শখ। না গেরু, না দুঃখবাবু। আজ দুঃখবাবুকে নেলির খুব আপন জন বলে মনে হল।

মনে হল এ—বাবু তার দুঃখ বুঝবে। এ—বাবু তাকে একটু আশ্রয় দেবে। আঁধারী এবং গেরুর মতো কোনো সুখের রঙ গুলতে গিয়ে হয়তো আর একটা কেচ্ছা হবে চটানে, লেকিন রসের ঘরে এ—কেচ্ছার দাম থোড়াই আছে। গেরুর মতো পুতুলের রঙ না হয়ে অথবা গেরুর মতো পুতুলের মুখ না হয়ে দুঃখবাবুর মতো হবে। সেই চোখ, সেই রঙ, সেই গড়ন।—গেরুরে, তুর মতো মরদ হামার হামেশাই আসবে। রাগে দুঃখে নেলি এখন গেরুকে গালমন্দ দিচ্ছে। বদলা নিয়ে মনে মনে সুখ পাচ্ছে।—তুর আঁধারী, হামার দুঃখবাবু। কম কীসে! তু এক কাঠি বাজাবি, হামি দু কাঠি। তু আঁধারীর পেটে বাচ্চা বানাবি, হামি দুঃখবাবুকে লিয়ে কেচ্ছা বানাব।

নেলি বালিয়াড়িতে হয়তো আরও কিছুক্ষণ বসে থাকত, আরও কিছুক্ষণ গালাগাল করত গেরুকে কিন্তু মনে হল বাপ ফিরছে নদীর পাড় ধরে। ঢুলতে ঢুলতে আসছে। দু একজন বাবুমানুষের ছেলেরা ঢিল ছুঁড়ছে যেন বাপকে। বাপ কিছু বলছে না। ওদের হাত দিয়ে ইশারা করছে। ওদের ঢিল ছুঁড়তে বারণ করছে ইশারা করে। ওরা শুনছে না। ওরা তবু ঢিল ছুঁড়ল। বাপ যখন ওদের দিকে দৌড়োবার জন্য ঝুঁকি সামলাল, তখন ছেলেগুলো দৌড়ে পালাল। তাই দেখে বাপ হাসছে। মদের নেশায় বাপ হাসছে।

—বাপ…। বালিয়াড়ি থেকেই নেলি ডাকতে থাকল।

—আয় আয়। তু ওখানটায় কী করছিস? তু আয়। গোমানি নেলিকে পাড় থেকে ডাকতে থাকল।

নেলি ছুটল। চর ভেঙে উপরে ছুটল। নেলির খোলা চুল উড়ছে। কাপড় খসে পড়ছে শরীর থেকে। চর ভেঙে তবু নেলি উপরে ছুটল। নয়তো বাবুমানুষদের ছেলেগুলো বাপকে আরও বেশি ঢিল ছুঁড়বে। নেশার শরীর বাপের। ওদের ধমক দিতে পারছে না।

উপরে উঠে সে প্রথম বাবুমানুষদের ছেলেগুলোকে তাড়াল। শেষে বাপের হাত ধরল। বাপের কোমরে হাত দিয়ে দেখল মাসের মাইনেটা ঠিক রেখেছে কিনা।

গোমানি বলল, গঙ্গা—যমুনা কোথারে নেলি?

—ওরা জঙ্গলে ঢুকল বাপ।

—ওদের থোড়া গোস্তর ঝোলে ভাত খাওয়াবি। হলুদ মেখে ভাত খাওয়াবি। হাসপাতালের সাব ওয়ার কুকুরটাকে গোস্ত দেয়। তু গঙ্গা—যমুনাকে গোস্ত দিবি। ভুলবি না।

—ভালো সওদা করলি বাপ?

—তু করে লিয়ে আয়। পয়সা দিচ্ছি। বলে কোমর থেকে টাকা খুলতে চাইল গোমানি। গঙ্গা—যমুনার লাগি বোয়াল মাছ লিবি। ওভি ডাগদারবাবু ওয়ার কুকুরকে খাওয়ায়। এক পোয়া গোস্ত লিবি তুর লাগি। খাসির গোস্ত। হাম রাতে কুছ খাবে না। গোমানি পর পর দুটো ঢেঁকুর তুলল। সে হাঁটছে। কোমরের কাছে হাতটা ঝুলছে। অথচ সে ট্যাঁক থেকে টাকা বের করল না। সব বেমালুম ভুলে গেছে। বেমালুম ভুল বকছে। কী কথা বলতে অন্য কথা বলছে। সে বলল, তুর মায়ীর লাগি ভি গোস্ত লিবি। আজ ফুলন ভি গোস্ত খাবে।

নেলি বলল, তু রূপেয়া দিলি না, হাম গোস্ত লিব কোত্থেকে।

—রূপেয়া! লে দিচ্ছি। কত লাগবে বল? দশ, বিশ, পঁচিশ, শ রূপেয়া? কেতনা রূপেয়া আওর তু মাঙে? গোমানি এবার কোমর থেকে কাপড়ের ভাঁজটা খুলল। ছোট লাল শালুর খুঁট থেকে গুণে একটা টাকা বের করল। লে রূপেয়া। আচ্ছা সওদা কবে লিবি। গঙ্গা—যমুনার লাগি দুটো শাড়ি লিবি। জায়দা হোত ফুলনের।

নেলি বলল, তাই লিব। লেকিন তু যেতে পারবি একা একা! না হামি যাব তুর সাথ।

গোমানি চোখ দুটো ছোট করল। মুখ কুঁচকাল। কপাল কুঁচকাল। যেন নেলির জায়দা সাহস হয়ে গেছে। সে বলল, তু যা! তু যা!

নেলি দাঁড়াল না। বাপকে একটু এগিয়ে দিয়ে সে বাবলার ঘন বনে ঢুকে গেল। ডাকল—গ…ঙ্গা, য…মু…না! তুরা আয়। হামার সাথ বাজারে যাবি।

ঘন বনের ভিতর থেকে নেলি দেখল কুকুর দুটো বাঘের মতো ছুটে আসছে। নেলির এখন খুব আনন্দ হচ্ছে। কুকুর দুটো ওর বেটার মতো। ঘন জঙ্গলের ভিতর কুকুর দুটোর চেহারা ভয়াবহ লাগছে। যত ছুটছে তত বেশি ভয়াবহ হয়ে উঠছে। কাছে এলে নেলির কুকুর দুটোকে কিছুক্ষণ চাপড়াল। শেষে ওরা একসঙ্গে হাঁটতে থাকল।

গোমানি হাঁটছে অন্য দিকে। নেলি অদৃশ্য হয়ে গেল। গোমানি চটান পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারল না। তার আগেই, চটানে ওঠার মুখে সে মাটিতে পড়ে গেল। সে দুবার ওঠার চেষ্টা করেও উঠতে পারল না। গোমানি মাটিতে পড়ে ভাবল যেন নেশাটা বেশিই হয়েছে। এমতাবস্থায় সে মাটিতে পড়ে থাকল। যখন উঠতে পারছে না, হাতে—পায়ে শক্তি পাচ্ছে না, তখন নেশাটা জমেছে বটে। তা জমবে না। লাশ—কাটা ঘরে এত লাশ! এত লাশের দুর্গন্ধ একসঙ্গে! অসংখ্য, অসংখ্য! গলায় দড়ির দাগ, ঠোঁটে বিষের দাগ! দুটো খুনের লাশ। লাশগুলোর মাথায় নম্বর দেওয়া। জোয়ান মেয়েটা কাপড় সামলাতে পারেনি—ওয়াক! নষ্ট! নষ্ট! মেয়েটা শরীরে আগুন দিল। শরীরটা আগুনে সিদ্ধ হল। ওয়াক তুলল। এই নচ্ছার দুনিয়ায় বেঁচে সুখ নেই—শুধু দুঃখ। দুঃখ। দুনিয়াটা শুয়োরের চোখ নিয়ে বেঁচে আছে। সব নেমকহারাম। সব বেইমান। ওর চোখ দুটো বুজে আসছে। তবু এই নচ্ছার পৃথিবীকে দেখবার জন্যে সে দুবার চোখ মেলে তাকাল। যদি নেলি আসে এখন, যদি হাত ধরে বলে, বাপ উঠ। তুর সাথ মা বসুন্ধরা ঠাট্টা করছে! তু উঠ। তামাশা করছে।

কোথাও কোনো মানুষের সাড়া না পেয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ মাটিতে পড়ে থাকল। শরীরে যত শীত লাগছে, নেশাটা যেন ওর তত জমে আসছে। সে মাটিতে পড়ে থেকেই বলল—অহ!

কিছুক্ষণ পর গোমানি উঠে বসল, কিন্তু দাঁড়াতে পারল না। দাঁড়াতে গিয়ে ফের পড়ে গেল। মা বসুন্ধরা বড় বেশি দুলতে শুরু করেছে। সে ক্ষেপে গেল। শুয়ে শুয়েই সে বসুন্ধরার কপালে লাথি মারতে লাগল।—আপদ!

সে শুয়ে শুয়ে আবার বলে, মা বসুন্ধরা, তু একটু থামবিনে? মেয়েটা হামার বাজারে গেছে মা। তু যা দুলছিস, নেলি হামার নিগঘাত আছাড় পড়বে। তু দুলবি না মা। দোহাই তুর গোমানি বাপের। গোমানি এবারেও একটা ওয়াক তুলল।

ঘরে চাল ছিল বলে নেলি ভালো সওদা করতে পারল। খাসির গোস্ত, তেল মসলা সব নিল হিসাব করে। রাত করে ঘরে ফিরল। চটানে আঁধার নেমেছে বলে ঘরে ঘরে লম্ফ জ্বলছে। কৈলাস ডোম এখনও চটানে ফেরেনি। ফেরার পথে ফরাসডাঙায় হয়তো রাত কাটিয়ে আসবে। কাল ভোরে সঠিক খবরটা পাবে নেলি। ঝাড়ো ডোমের বৌ, বারান্দায় পাঁতি তুলছে। ঝাড়ো পাঁতি দিয়ে ডালা কুলো তৈয়ার করছে। অন্য ঘরে কিছু নেশা জমেছে। হরীতকী ক—রোজ নেশা করতে পারল না। বিকেল থেকে বাচ্চাটা অনবরত ট্যাঁ—ট্যাঁ করে কাঁদছে। ওর বিশ্বাস কৈলাস ঝাড়ফুঁক দিলে বাচ্চাটা ভালো হয়ে যাবে।

নেলি ঘরে ঢুকে দেখল বাপ চটানে ফেরেনি এখনও। নেলি বিরক্ত হয়ে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াল। বাপ নিশ্চয়ই এখনও কোথাও পড়ে আছে। গঙ্গা—যমুনাকে নিয়ে সে আঁধারে বাপকে খুঁজতে বের হয়ে গেল। এবং চটান থেকে নেমেই দেখল, চটানে উঠবার মুখে গোমানি শুয়ে শুয়ে কেবল ওগলাচ্ছে। দুর্গন্ধে কাছে যাওয়া যাচ্ছে না। নেলি নাকে কাপড় দিয়ে বাপকে টেনে তুলল এবং বাপকে ধরে শীতের গঙ্গায় চুবিয়ে আনল। শেষে ধরে এনে মাচানে শুইয়ে দিয়ে বলল, বকবক করবি ত এখন মাথায় পোড়াকাঠের বাড়ি মারব বলে দিলাম। চটানে পড়ে হয় ঘুমোবি, লয় মাচানে আগুন ধরিয়ে দেব।

নেলি উনুনে কাঠ গুঁজে দিল। লম্ফ থেকে আগুন দিল কাঠে। আগুনটা বাড়িয়ে দিল। মাচানে বাপ শীতে হিহি করে কাঁপছে। আগুন পেয়ে বাপ কিছুটা যেন তাজা হল। নেলি আগুনটা বারবার উসকে দিচ্ছে যাতে বাপ তাড়াতাড়ি গরম হয়, যেন বাপ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে পারে। বাপের বকবক আর ভালো লাগছে না। মনটা ভালো নেই। দুঃখবাবু হয়তো এতক্ষণে চলে গেছেন। অফিসঘরে এখন সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। গেরু নিশ্চয়ই মাচানে শুয়ে আছে, নিশ্চয়ই ঘুমোতে পারছে না। শরীরে যন্ত্রণায় ছটফট করছে।

অফিসঘরে দুঃখবাবু নেই। তিনি চলে গেছেন। কাল থেকেই পাশের ঘরটাতে থাকবেন এ ঠিক হল। তবে রোজ রাতে থাকবেন না, মাঝে মাঝে থাকবেন। ঘটোয়ারিবাবুর সুবিধে—অসুবিধে দেখে তিনি এখানে রাত কাটাবেন। ঘরে বৌ আছে, বাচ্চা আছে, রাতে এখানে থাকার অসুবিধা আছে। দুঃখবাবুর দুঃখ বুঝেই যেন তিনি বলেছিলেন, রাতে এখানে না থাকলেও চলবে আপনার। যতদিন আমি আছি মাঝে মাঝে হাজিরা দিলেই চলবে।

দুঃখবাবু বলেছেন তখন, না আপনি বুড়ো মানুষ। মাঝে মাঝে রাতে আমি থাকব বৈকি! তবে বুঝতেই পারছেন বৌ বাচ্চা নিয়ে ঘর। পুরো সংসার।

ঘাটোয়ারিবাবুর ইচ্ছা হল জানতে দুঃখবাবুর ছেলে কটি। ওরা কত বড়। ওরা কী করে, দুঃখবাবু চটানে আসবার সময় ওরা কাঁদে কিনা। ওরা কদমা খেতে চায়, কমলা খেতে চায় হয়তো। না দিলে তারা কেমন করে—সে জানারও ইচ্ছে ঘাটোয়ারিবাবুর। না দিলে ওরা হয়তো কাঁদে, তখন দুঃখবাবুর কষ্ট হয়। দুঃখ হয়, মনে হয় ওরা মরবে একদিন। এই চটানে বয়ে আনতে হবে। আপনি, নয় আমি, নয় অন্য কোনো ঘাটবাবু ওদের হিসাব রাখবে। আপনার মনে হয় না—আপনিও মরবেন একদিন। তবে সংসার সংসার করে লাভ কী! অত সুখ—দুঃখ ভেবে কী হবে! বরং চলে আসুন চটানে। সারাদিন সারা রাত এখানে পড়ে থাকুন। ডোমেদের নিয়ে ঘরকন্না করুন। যথার্থ ঘাটোয়ারিবাবু এ—সব বলতে পারেননি। প্রথম কিংবা নতুন বলেই হয়তো। কিংবা সংসারী মানুষকে ঘেঁটে লাভ কী!

তা ছাড়া তিনি নিজেও রসকলিকে নিয়ে কম ডুবে ছিলেন না। রসকলির ঘর বাঁধার শখকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন।

রসকলি বলত, আমি এ—চটানেই ঘর বাঁধব!

ঘাটবাবু বলতেন, তা হয় না।

অর্থের অভাবের জন্যেই তিনি অন্যত্র যেতে পারেননি।

রসকলি বলেছে অন্যত্র যাব!

না, তা হয় না। অর্থের অভাবকে আমার বড় ভয়।

তবে এ—চটানেই। ঝাড়ো, গিরিশ ঘর করতে পেরেছে যখন।

ওরা পারে। ওরা গঙ্গাপুত্তুর। ওরা সব পারে। ওরা শিবের মতো। ওদের ঘর করা এখানেই সাজে অন্যত্র সাজে না।

রসকলির বাসনা তিনি পূরণ করতে পারলেন না। শেষ দিকে রসকলিকে তেমন মধুর মনে হত না। রসকলির মৃত্যুর কিছু পূর্বে তার প্রতি ওঁর কেমন বিরক্তবোধ জন্মেছিল। রসকলিকে শেষ দিকে বলেছেন, সংসারের সং সাজতে ইচ্ছে নেই। তিনি মনুষ্য চরিত্রকে ব্যাঙের মতো লাফ দিতে দেখে নিজের মনেই হেসেছেন। রসকলির প্রতি ভালোবাসা এবং বিরক্তবোধ উভয়েই ব্যাঙের মতো উল্লম্ফন মনে হয়েছিল।

হরীতকীকেও তিনি সেদিন বলেছেন, সংসারের সং সাজতে ইচ্ছা নেই।

হরীতকী বলেছে সংসারের সং সাজতে তুকে বুলেছি। আর বুলবে না। পেটটাকে লিয়ে এতদিন ভয় ছিল। পেটটা খালাস হয়ে হামাকে খালাস করে দিল। হামাকে লিয়ে তুকে আর কোথাও যেতে হবে না। কোথাও আর পালাতে বুলব না। হামার নসিব লিয়ে হামি বাচ্চাকে সাথ চটানেই পড়ে থাকব। লেকিন তুকে বুলবে না, আঃ যাঃ বাবু কাহাভি চল যাই। কভি বুলবে না চটান ছোড় দে।

ঘাটোয়ারিবাবু সব কথাগুলো স্মরণ করে না হেসে পারলেন না। তিনি নিজেও জানেন না, হরীতকীর বাচ্চাটা ওঁর না চতুরার। এ—কথা হরীতকী, নিজেও জানে না। চতুরাকে নিয়ে ঘর করতে করতে মাঝে মাঝে যে উদবৃত্ত সময়টুকু ঘাটবাবুকে সে দিত, সে বড় অল্প। বড় কম সময়। অথচ হরীতকীও চতুরার মৃত্যুর পর বুঝল ঘাটবাবুরও এ—চটান ভিন্ন গত্যন্তর নেই। এ—চটান ভিন্ন তিনি অন্যত্র বাঁচতে পারবেন না। সে শুধু যেন অর্থের জন্য অথবা অভাবের জন্য নয়। কারণ এও যেন জীবনের অন্য সত্য। আপনার মনে হয় না আপনিও মরবেন একদিন? তবে আর সংসার—সংসার করে লাভ কী? অত সুখ দুঃখ ভেবে কী হবে! বরং চলে আসুন না এই চটানে, সারারাত সারাদিন এখানে পড়ে থাকুন। ডোমেদের নিয়ে ঘরকন্না করুন। যথার্থ ঘাটোয়ারিবাবু হয়ে দুনিয়ার সব সুখ, সব শখকে তফাত রাখুন।

আবার যখন রাত হয়, চটানে কেউ জেগে থাকে না, যখন ঘাটে কোনো মড়া জ্বলে না, তিনি সন্তর্পণে উঠে কাঠের বাক্সটা খুলে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকেন। বাক্সর ভিতর অনেক গহনা। রসকলির গহনা। এই দুই করে গহনাগুলো গুণবেন, এক দুই করে গহনাগুলো সাজিয়ে রাখবেন। রসকলি মৃত্যুর আগে ঘাটবাবুকে ডেকে সব গহনা দিয়ে বলেছিল, আমি চলেছি, তুমি এবার ঘর কর। রসকলির তীর্থে যাওয়া হল না। গলির আঁধারেই রসকলির ভয়ানক রোগে মৃত্যু হল। অথচ এখন মনে হবে—এই চটানে এই কাঠের বাক্সর জন্য তিনি বেঁচে আছেন। সেজন্য চটান ছেড়ে তিনি অন্যত্র গেলেন না। নিঃসঙ্গ জীবনে রাতের কোনো নির্জন সময় ওঁর জীবনে বৈচিত্র্য বয়ে আনে। তিনি বাক্স খুলে গহনা দেখেন, গহনার সঙ্গে রসকলির মুখ দেখেন। রসকলির হাসি—মস্করা শুনতে পান। ভালোবাসার কথা শুনতে পান। এই সব কথা ভেবে তিনি একটু দুঃখ পেতে চান। আপনজনের দুঃখ। আপনজনের বিয়োগ—বেদনা। জীবনে তিনি এই দুঃখটুকুর স্পর্শের জন্যই রাতের আঁধারে কাঠের বাক্সটা খুলে বসেন এবং পৃথিবীকে ভালোবাসতে চান। আবার এমনও হয়—কাঠের বাক্সটা খুলে বসে আছেন, অথচ রসকলির মুখ স্মরণে আসছে না। কোথায় যেন হারিয়ে গেছে মুখটা, কোথায় যেন পালিয়ে আছে রসকলি। যতবার তিনি মুখটা স্মরণ করতে চান, ততবার মুখটা কাছে এসে মাকড়সার জালের মতো কাঁপতে থাকে। যত দিন যাচ্ছে ততই যেন একটা ঘটনা বেশি ঘটছে। ততই তিনি রসকলিকে ভুলতে বসেছেন। একটু ব্যথা এবং বেদনার স্মৃতিতে তিনি এখন বাঁচতে চান। কিন্তু মনের এই নিষ্ঠুর গণ্ডি অতিক্রম করে কিছুতেই তিনি সেখানে পৌঁছাতে পারেন না। শুধু মৃত্যু, মৃত্যু। এই মৃত্যুর নিষ্ঠুর পরিণতিই ঘাটবাবুকে দিন দিন অচল করে তুলছে, অনড় করে তুলছে। ঘাটের মতো নির্দয়—নিষ্ঠুর করে তুলছে। কোনো কোনো দিন ঘাটোয়ারিবাবু এই সব ভাবতে ভাবতে চোখ ঢেকে চেয়ারে বসে থাকতেন। কাঠের বাক্সটা খোলাই থাকত।

কোনো দিন দরজায় শব্দ হত। দরজাটা ঠকঠক করে কাঁপত। তিনি ভাবতেন রসকলি এল। ভাবতেন, রসকলির প্রেতাত্মা এসে ওঁকে ডাকছে। অথবা মনে হত রসকলির প্রেতাত্মা সব গহনা ফেরত নিতে এসেছে। তিনি তখন ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে চেয়ারটাতে বসে থাকতেন। এবং চেয়ার থেকেই জবাব দিতেন—কে, কে দরজায়?

আমরা মড়ার লোক বাবু। বহুদূর থেকে এসেছি বাবু। আমরা সাতকান্দির মড়া পোড়ার দল বাবু।

ঘাটোয়ারিবাবুর দরজা খুলতেন না। ওদের বলতেন, কাউন্টারে এসো। তিনি ভয় পেতেন। হয়তো রসকলির প্রেতাত্মা সকল মানুষকে বলে বেড়িয়েছে—ঘাটবাবুর কাঠের বাক্সে কী আছে জান না? অথবা ঘাটবাবুর ধারণা—হয়তো চটানের সবলোক জেনে ফেলেছে—বাক্সটাতে জড়োয়া গহনা আছে। তিনি কখনোই রাতে দরজা খুলে বসে থাকতেন না। তিনি বলতেন, কাউন্টারে এসো। তিনি বলতেন, যা হয় কাউন্টার থেকে বল।

লোকটা কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়াল।

যে চটানটা এতক্ষণ ঝিমিয়ে ছিল যে চটানটা নেশা ভাঙ করে এতক্ষণ ঝিমুচ্ছিল, মড়া আসছে শব্দে সেই চটানটাই আবার জেগে উঠল। আবার সোজা হয়ে বসল।—ওরে ওঠ ওঠ। ও নেলি, দেখ মড়া এসেছে। ঘরে ঘরে তখন লম্ফ জ্বলল। ঘরে ঘরে তখন ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি। ঘরে ঘরে কথাবার্তার শব্দ। দুখিয়া উঠল। মংলি উঠল, দুখিয়া পাগড়ি বাঁধল মাথায়। হাতে লাঠি নিল। মংলি এত ঘুম যে উঠতে পারছিল না, তবু উঠল। কাঠের দরজা খোলার শব্দ হচ্ছে। কাঠ মাপছে ঝাড়ো। ডোমেদের মেয়েমরদেরা কাঠ বয়ে নিচ্ছে। একমাত্র হরীতকী ওঠেনি। বাচ্চাটার শরীর ভালো যাচ্ছে না। টোকায় ধরেছে। বাচ্চাটা কাঁদতে কাঁদতে নীল হচ্ছে, লাল হচ্ছে। কৈলাসের জন্য রাত জেগে বসে আছে হরীতকী। বাচ্চাটাকে হাঁটুর ওপর রেখে পেটে গরম তেল মাখিয়ে দিচ্ছে। মুখটা দেখে কষ্ট হচ্ছে—হরীতকী কাঁদছে। নিঃশব্দে। কৈলাস যদি থাকত এ—সময়! ওর ঝাড়ফুঁক, জাদু মন্তরে বড় বিশ্বাস হরীতকীর।

ঘাটে চিতা সাজানোর ভার হরীতকীর। শরীর ভালো নয় বলে সে যাচ্ছে না। সে নেলিকে ডেকে বলল, তু আজ চিতার কাঠটা সাজিয়ে দে নেলি। পয়সা যা হবে তু লিবি।

নেলি যখন গেরুর পাশ কেটে নদীতে নামল, তখন একটা ছোট—রকমের খেউড় দিল গেরুকে। নেলির মাথায় কাঠ। গেরুর মাথায় কাঠ। নেলি ঠেস দিয়ে বলল, তুর বহু আসছেরে গেরু, তুর বহু হামার মরদ হবেরে, মরদ হবে। ঠেস দিয়ে গেরুকে এই ধরনের কথা বলে খুশি হল নেলি।

ঘন আঁধারে চটানের আলোগুলো যেন ভূতুড়ে চোখ। ভূতুড়ে গন্ধ যেন চারিদিকে। আসশ্যাওড়ার জঙ্গল পুরোনো অশত্থগাছটার পাশে। সেখানে ঝিঁঝিপোকা ডাকছে। সেখানে আকন্দ গাছে ফুল ফুটেছে। শিশির পড়েছে। শীতের কীট, শীতের পতঙ্গ—শিশিরে ভিজে ঘুমোচ্ছে। দূরে আলো, শহরের আলো। ওপারে ট্রেনের শব্দ। নদীর ঢালুতে মড়াটা পড়ে আছে। শিয়রে লণ্ঠন জ্বলছে। মড়াটার পাশে দুটো লোক বসে। ওরা শীতে কষ্ট পাচ্ছে। ওরা হরিধ্বনি দিয়ে মড়াটা চিতায় তুলে দিল। আগুনটা ধীরে ধীরে সব কাঠগুলোকে, মড়াটাকে গ্রাস করার জন্য উপরের দিকে ধেয়ে উঠছে। যেন স্বর্গের সিঁড়ি তৈরি করছে। মানুষগুলোর মুখ লাল হচ্ছে ওরাও সিঁড়িতে পা রাখার জন্য যেন প্রস্তুত হল। ওরা ফের হরিধ্বনি দিল। চটানে তখন যে যার মতো ঘুমিয়ে পড়েছে। আবার রাতটা বোবা হয়ে গেল, ঘন হয়ে গেল। মনেই হবে না এই সব দেখে—মড়া জ্বলছে। মনেই হবে না পৃথিবী থেকে একটা মানুষ চলে গেল। তার সুখ—দুঃখ চলে গেল। তার অনুভূতি—আবেগ চলে গেল। যেন কিছুই হয়নি—অথবা এমন হওয়াই স্বাভাবিক। হামেশা এটাই হচ্ছে। আগুন জ্বলছে আর স্বর্গের সিঁড়ি তৈরি হচ্ছে অথচ এ—মানুষটারও জন্ম হয়েছে। ছ’দিনে ষষ্ঠী, শেষে বিয়ে। ঘর—সংসার। ঘর, সুখ, শখ—সব! শুধু ঘাটের সুখটা জানা ছিল না। আজ সে তাও পেল। স্বর্গের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দুনিয়াকে শেষবারের মতো আদাব দিল আজ।

ভোরবেলায় খবর শুনে চটানের সকলে আশ্চর্য হল। নেলি রোদে পিঠ দিয়ে বসে সব শুনছে। কৈলাস ডোম সকলকে ডেকে ডেকে বলছে, গেরুর শাদি ঠিক হো গিলরে গোমানি। ও ঝাড়ো, বাত শুনলি ত? গেল রাতে ঠিক করে লিলাম গেরুর শাদি। তু ত চিনিস নন্দুয়াকে। নন্দুয়ার বিটি।

গেরু চটানের অন্য পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনছে। ঘরে ঢুকে নেলিকে দুবার দেখবার চেষ্টা করেছিল কিন্তু দেখতে পায়নি। রোদে পিঠ দিয়ে বসে আছে নেলি। একটা কাঠি দিয়ে মাটিতে একটা একটা করে আঁক দিচ্ছে এবং এক দুই করে গুনছে। কৈলাসের খবরকে যেন পাত্তাই দিল না। খবরটা শুনে চটান থেকে মুখ তুলল না পর্যন্ত। গেরুর ইচ্ছা এখন ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ওর মুখটা দেখে। মুখে কোন কোন ইচ্ছার রং ধরছে—সে দেখারও ইচ্ছা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেতে পারল না। যেতে সাহস হল না। কিছুদূর হেঁটে গিয়ে আবার ফিরে এল। বাপ তখন চটানের ঘরে ঘরে খবর দিয়ে বেড়াচ্ছে, পুষে বড় করা বাচ্চাকে চটানে বেঁধে দিয়ে গেলাম। বাঁচি মরি গেরুকে দেখার একটা লোক থাকল। কৈলাস, এমন সব কথা বলছিল, আর ঘরে ঘরে খবর দিয়ে বেড়াচ্ছিল।

ঝাড়োর বিবি বলল, কী দেবে বেটাকে?

একটা শুয়োর দেবে বুলছে।

দুখিয়া বলল, খুব খরচপত্তর করবি ত?

জরুর। করব না ত টাকা হামার খাবে কে? এক বেটার শাদি হামার—কম শখের কথা! কী বুলিসরে গোমানি?

তা বটেক। হাম ভি এক দফে কাহা ভি চলে যাবে। বিটির শাদি ঠিক করে লিব। হাম ভি খরচ—পত্তর করবে ভাবছে। হামার ভি এক ভি বিটির শাদি। খরচ—পত্তর না করবে ক্যানে।

মংলি তখন মুখে কাপড় চাপা দিয়ে খুকখুক করে হেসে দিল। কৈলাস বলল, তা দিবি। দেবার ত সময় হয়েছে বটেক। গোমানি মাচানে বসে সকলকে জোরে বলল, দিব, দিব। ঠিক শাদি দিয়ে লিব। হামি কী কৈ আদমিসে কম রোজগার করি! তবে—তবে—তামাশা ক্যানে? মস্করা ক্যানে? তবু চটানের সকলে নেলির শাদি—সমন্দকে তামাশা বলে ভেবে নিল।

কৈলাস ঘাটোয়ারিবাবুর ঘরে ঢুকল। বাবুর পায়ে গড় হল। বলল, আপনার—আওর—ডাক ঠাকুরের কিরপায় গেরুর শাদি—সমন্দটা হয়ে গেল। চার রোজ বাদ নন্দুয়ার বিটিকে লিয়ে আসছি। বেটার লাগি ইবার ভিন্ন ঘর করে লিব। আপ বুলেন ত আজই করে লিচ্ছি।

ঘাটবাবু বললেন, বলিস কিরে! শাদি—সমন্দ তবে লাগালি!

হে বাবু করে লিলাম। জান আওর দিচ্ছে না, এক রোজ ত মর যাওগে বাবু। টাইম ভি ত হয়ে গেল। লেকিন বেটার হিল্লে করে না দিলে ওকে কোন দেখবে?

বেটাকে ওরা দেবে কী?

একটা শুয়োর দেবে। শুয়োর না দিলে শুয়োরটার দাম দেবে বাবু। লেকিন হামি বুলে দিয়েছি হামি শুয়োর লিব। বুলছে খাসি শুয়োর দেবে। বিয়ের দিন ভোরে শুয়োরটাকে লিয়ে আসবে। শুয়োরটা চটানে জবাই হবে। শুয়োরের গোস্ত হবে। পচাই আসবে। বিকালে হামরা সব গোস্ত, পচাই লিয়ে জিয়াগঞ্জ যাবে। বাবু আপ ভি চলিয়ে না। খুব খুশিকী বাত হবে।

নেলি তখনও রোদে পিঠ দিয়ে বসে আছে। ওর শীত আজ শরীর থেকে যাচ্ছে না। যেন সে নড়বে না এমনই একটা শপথ করেছে। গেরু দূরে দাঁড়িয়ে সকলের আড়ালে অনেকক্ষণ নেলিকে দেখল। তারপর চটান থেকে নেমে গেল। বাপের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারল না, হাম শাদি না করবে বাপ। তু এ শাদি তুলে দে।

নেলি কিন্তু রোদ থেকে উঠল না। নেলি এই রোদে বসেই বুঝতে পারছে গেরু চটান থেকে নেমে গেল। গেরুর মনের ইচ্ছা যেন নেলি ওর সঙ্গে চটান ছেড়ে নামুক। এই বোধের জন্য নেলির বিরক্তবোধ গেরুর ওপর আরও বাড়ল। সে ভাবল, কী দরকার? বরং এই রোদ ভালো, রোদের এই উত্তাপ ভালো, গেরুর কাছে গিয়ে সে কী শুনবে! যে মরদ সকলের সামনে কিছু বলতে পারল না, চটান থেকে নেমে সে আর কী বলবে? কী আর অন্তরের কথা শোনাবে?

নেলি সেজন্যে উঠল না। যে—ভাবে বসেছিল ঠিক সেইভাবেই বসে থাকল। রোদে বসে গেরুর ওপর অভিমানে ফেটে পড়ছে। —ছিঃ ছিঃ তা কিছু বলতে লারলি! সকলের সামনে তুর বাপ হল্লা করে বলল, গেরুর শাদি ঠিক হো গিল। তু তখন বোবা বনে গেলি! কোনো জবাব দিতে লারলি। লেকিন তু হামারে লিয়ে চটানের নিচে নেমে যেতে চাস। সেখানে তু কী বুলবিরে মরদ, কী বুলবি! হামি জানি তু কিছু বুলতে লারবি। রাগে, দুঃখে, নেলির ভেতরটা ফুলে ফেঁপে উঠছে। চটানের চারিদিকে হল্লা। গেরুর শাদি হবে বলে, সকলে হল্লা করছে। গেরুর শাদি হবে বলে, সকলে ভোজ পাবে বলে, ঘরে ঘরে খুশির কথা। গোমানি পর্যন্ত কৈলাসকে ডেকে বলেছে, হামার লাগি তু থোড়া বিলিতি মাল লিবি। লয়তো হামার জমবে না। হাঁড়ি হাঁড়ি পচাই গিলে শাদি—সমন্দে সুখ নেই। তুর ত এক বেটার শাদি।

নেলির কাছে এখন চটানের সব মানুষগুলো বেইমান। সব মানুষগুলো শুধু ভোজের কথা ভাবল। নেলির দুঃখ কষ্ট কেউ দেখল না। বাপ পর্যন্ত মাচানে শুয়ে বিড়ি টানছে। ভোজের খোয়াব দেখছে, অথবা অন্য কিছু। নেলির কিছুই ভালো লাগছে না। না এই রোদ, না রোদের উত্তাপ। না এই চটান, না চটানের মানুষগুলোকে। ঘাটোয়ারিবাবু পর্যন্ত বলছেন না, এ শাদি—সমন্দ করে তুই ঠিক করলি না কৈলাস। নেলির কথা তোদের জানা উচিত ছিল। অথচ কেউ কিছু বলছে না। নেলির অভিমানে কান্না পেতে থাকল।

দুঃখবাবু চটানে ঢুকে দেখলেন নেলি রোদে পিঠ দিয়ে বসে আছে। তিনি ডাকলেন, কিরে নেলি, রোদ মাখাচ্ছিস গায়ে?

নেলি তখন মাথা গুঁজে বসে কাঁদছিল বলে উত্তর করতে পারল না। দুঃখবাবু ফের বললেন, খুব বুঝি শীত লাগছে গায়ে!

নেলি কোনোরকমে জবাব দিল, হে বাবু।

আমার ঘরটা একটু পরিষ্কার করে দিবি। আজ বিছানাপত্র নিয়ে আসব। কোনো কাজ নেই ত তোর এখন।

না বাবু কোনো কাজ নেই। আপনি যান বাবু হামি যাচ্ছি।

সে রোদ থেকে উঠে পড়ল। মাচানের নিচে থেকে একটা ঝাঁটা নিয়ে দুঃখবাবুর ঘরে ঢুকে গেল। ঘরটা কত কাল থেকে নোংরা হয়ে আছে! কবে ঝড়ের রাতে একটা মড়া এ ঘরে রাখা হয়েছিল—তার কাঁথা বালিশগুলো পর্যন্ত এখনও পড়ে আছে। ঘরটার চুনবালি খসে দিন দিন খুব নোংরা হয়ে উঠছে। দেওয়ালের ইট সব খসে পড়ছে। ঝুল ঝালড়ে ঘরটা ভর্তি। নেলি ভালো করে কাজগুলো করতে থাকল এবং ভেতরের কষ্টটাকে ভুলতে চাইল।

ঘাটোয়ারিবাবুর ঘরে দুঃখবাবু বসে আছেন। দুজনে গল্প করছেন। ঘরের গল্প। স্ত্রীর গল্প। পরিবার—পরিজনের অভাব—অনটনের গল্প। এতসব গল্প বলে দুঃখবাবু কত সুখী—এমন ধারণা করলেন ঘাটবাবু। গল্প শুনিয়ে দুঃখবাবু যেন বলতে চাইলেন, বেশ আছি মশাই। বাচ্চাদুটো ভালোমন্দ খাবার জন্য কাঁদে, বৌ—এর হরেক রকমের বায়না—যতটা পারি দেওয়ার চেষ্টা করি। না দিতে পারলে গিন্নি অভিমান করে, রাগ করে। বেশ লাগে মশাই—আছি বেশ। ছেলেটাকে ভালোমন্দ দিতে না পারলে কষ্ট হয়, কিন্তু যখন দিতে পারি, ছেলেটা ভালোমন্দ হাতে নিয়ে যখন কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে, বড় ভালো লাগে, বড় আনন্দ। দুঃখবাবু চোখ বড় করে আনন্দ প্রকাশ করছিলেন। —এবার মাইনে পেলে প্রথমেই বৌকে কিছু কিনে দেব। দুঃখবাবু এবার উঠলেন।—দেখি কতটা হল! দেখি গোমানির বেটি কতটা সাফ করল।

কিরে কতটা সাফ করলি? দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দুঃখবাবু প্রশ্ন করলেন।

হয়ে এল বাবু। ঘর ত লয় বাবু, ভাটিখানার মজলিস। এখানে কাঁথা, ওধারে বালিশ, দেওয়ালে নোনা, চিতার কাঠের মতো সব দাঁত—বের—করা ইঁট—ঘরে ঢুকলেই ত ভয় ধরে।

দুঃখবাবু ঘরে ঢুকে ভীষণ দুর্গন্ধে নাকে কাপড় দিলেন। বললেন, কীসের গন্ধরে নেলি! ঘরে থাকা যাচ্ছে না।

আর কীসের গন্ধ! পচা ইঁদুরের গন্ধ বাবু, ঐ দেখুন না বাবু, কেমন ফুলে—ফেঁপে আছে! আপনি আভি যান! হলে ডাকব। তখন আর কোনো গন্ধ পাবেন না। যখন নেলির হাত লেগেছে, তখন সব ঠিক হয়ে যাবে। নেলি আশ্বাস দিল দুঃখবাবুকে।

বস্তুত এ কাজগুলো করতে করতে নেলি নিজের দুঃখটা বেমালুম ভুলে গেল। গেরুর শাদি হবে, শনিয়া চটানে বৌ হয়ে আসবে, শুয়োরের গোস্ত হবে, মজলিস বসবে—রোজকার ঘটনার মতো এগুলো ওকে আর দুঃখ দিচ্ছে না। সে ঝুল ঝাড়ল, ঘরের মেঝেটা ভালো করে পরিষ্কার করে দিল, পচা ইঁদুরগুলোকে সামনের একটা ডোবায় ফেলে এল, মড়ার কাঁথা—কাপড়গুলোকে বাইরে বের করে আগুন ধরিয়ে দিল। তারপর একটু বিশ্রাম নেবার সময় নেলি দুঃখবাবুকে বলল, বাবু চটানে ত ভোজ লেগে গেল। গেরুর শাদি হবে জিয়াগঞ্জে। আপনি যাবেন না ভোজ খেতে জিয়াগঞ্জে।

গেরুর শাদি হবে তুই যাবি না?

হামাকে কে লেবে বাবু?

কেন নেবে না? ঘাটোয়ারিবাবু বললেন, সবাই যাচ্ছে। তিনি পর্যন্ত যাবেন।

লেকিন হামি যাবে না বাবু। হামাকে ওরা লেবে না। নেলি এইটুকু বলে আর দাঁড়াল না। হয়তো দাঁড়াতে পারল না। ফের সেই দুঃখটা বুক বেয়ে গলা ধরে উপরে উঠছে।

যে দুঃখটা নেলির গলা বেয়ে উপরে উঠে আসছে সে দুঃখটাই ওর চোখ দুটোকে সর্পিল করে তুলল। সে মনে মনে সাপের মতো হিসহিস করছে। সে চোখ তুলে চারিদিকে চাইল এবং হাঁটতে থাকল। দুটো ষাঁড় শিং নিচে নামিয়ে তেড়ে আসছে। দুটো গোরু চরছে অন্যত্র। ওরই বয়সি দুজন মেয়ে গঙ্গায় স্নান করতে যাচ্ছে। ওরা হাসছে। ওদের পিঠে রোদ। শাড়ির আঁচলে ওদের হাসির কৌটা যেন বাঁধা। সমস্ত লজ্জার মাথা খেয়ে এ সময় বিশ কাটালির ঝোপে একটা মানুষ বসে পড়ল। নেলি নিজের শরীরের ওপর এ সময় বিরক্ত হয়ে পড়ছে। মানুষটা বিশ কাটালির ঝোপে, দুটো ষাঁড় লড়ছে, আঁচলে হাসির কৌটো বাঁধা, আর পেটে ওর যে দুঃসহ ব্যথা—সব মিলে দুঃসহ ভাব সর্বত্র। তলপেটে পরিচিত ফিক ব্যথাটা ক্রমশ নিচে নামছে। যত নামছে তত অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে পৃথিবীটাকে। শরীরটা এই শরীরটা এই মুহূর্তে নোংরা হবে জেনে সে আর নিচে নামল না। বড় অস্বস্তি এ—সময় ওর। শরীরটাকে নিজের বলে ভাবতে কষ্ট হয়। কিছু ভালো লাগে না। ইচ্ছা করে মাচানে সারাদিন পড়ে থাকতে, মাচানে পড়ে ঘুমোতে, শরীর কাঁথা—কাপড়ে আড়াল রেখে একটা গোপন গভীর কষ্টকে ঢেকে রাখতে। একটা দুঃসহ লজ্জাকে ঢেকে রাখতে। সেজন্য সে ঘাটের দিকে নেমে গেল না, গেরুকে খুঁজে দুটো কথা বলবার সময় হল না। যতটা সত্বর সম্ভব সে চটানে উঠে গেল।

ঘরে ঢুকেই সে মাচানের নিচে থেকে কিছু ছেঁড়া কাঁথা—কাপড় ছুঁড়ে দিল। বাপ মাচানে নেই—কোথাও বের হয়েছে। অন্য কাঁথা—কাপড় দিয়ে সে দেয়ালের ফাঁক—ফোকর বন্ধ করে দিল। তারপর শরীরের সব দুঃখ অপমান লজ্জা আক্রোশ ঝেড়ে ফেলে সব কাঁথা—কাপড় বেড়া থেকে টেনে মাচানে এনে ফেলল। কৈলাস তখন ঝাড়ফুঁক দিচ্ছে হরীতকীর বাচ্চাটাকে। কৈলাস অদ্ভুত সব মন্ত্র উচ্চারণ করছে। নেলি মাচানে শুয়ে না হেসে পারল না। কৈলাসের মন্ত্রগুলো সে নিজে নিজে আওড়াল—ইটমের বিবি চিটম খায়, পাহাড়ে পাহাড়ে ছুটে বেড়ায়! মা মনসার বাহন হবি, পীরের ভূত পয়গম্বরে খাবি—ফুঁঃ। মাচানে শুয়ে কৈলাসের মতো একটা জোরে ফুঁ দিল। কৈলাসের মতো চারিদিকে থুথু ছিটাল নেলি।

কিন্তু নেলি মাচানে শুয়ে থাকতে পারল না। পিসির মেয়েটা কাঁদছে। পিসি গেল রাতে উজাগর থাকল। নেলি উঠে হরীতকীর ঘরে ঢুকে গেল। কৈলাস ঝাড়ফুঁক দিয়ে বের হয়ে গেলে, সে বলল, দে পিসি হামার কোলে দে। তু এক দফে ঘুম দিয়ে লে। সারারাত না ঘুমিয়ে তুর শরীর আর শরীর নাই।

তু কোলে লিবি?

হে পিসি লিব। হামার হাতে কোনো কাজ না আছে। লতুন ঘাটবাবুর ঘর ঝেড়ে দিলাম। বাপ কাহা ভি চল গেল। বাসি ভাত আছে। বাপ বাসি ভাত খেয়ে লিবে।

তু খাবি না?

বাপ খেলে যদি দুটো থাকে খেয়ে লিব।

নেলি হরীতকীর কোল থেকে বাচ্চাটাকে নিল। কাঁথা—কাপড়ে পেঁচিয়ে কোলে রাখল। —পিসি ওয়ার নাম হবে চঞ্চলা। হামি চঞ্চলা বলে ডেকে লিব।

নেলি চঞ্চলাকে দু—হাঁটুর ওপর শুইয়ে আদর করল। মুখ দেখল, ছোট ছোট চোখ, ছোট ছোট হাত—পা। এখন আর কাঁদছে না যেন। চোখমুখ নীল হচ্ছে না। কৈলাসের ঝাড়ফুঁয়ে যেন ভালো হয়ে যাচ্ছে। পিসি পাশে শুয়ে পড়ল। নেলির এ—সময় কুকুর দুটোর কথা মনে হল। ওরাও পিসির বাচ্চাটার মতো ছোট ছিল একদিন। শীতে কষ্ট পেত খুব। ওদের মা—টা মরে গেল। তখন কে দেখবে ওদের! কে আগলাবে! অফিসঘরের বারান্দায় শীতে কাঁদত রাতে। কুকুর দুটোর জন্য নেলির ভারী কষ্ট হত। একরাতে সে মাচান থেকে উঠে পড়ল এবং সন্তর্পণে বারান্দা থেকে বাচ্চা দুটোকে এনে বুকের কাছে কাঁথার নিচে রেখে ঘুম পাড়াল। বাচ্চা দুটো এতটুকু নড়ল না। এতটুকু কাঁদল না। ভোরে শুয়োরের দুধ বাচ্চা দুটোকে খাওয়াল। পুষে পুষে বড় করল। এখন ওরা গঙ্গা—যমুনা। এখন ওরা নেলির বেটার মতো। গেরু শনিয়ার মরদ হচ্ছে, বাপ দিন দিন অমানুষ হয়ে উঠছে, কৈলাস, দুখিয়া ডাইনি বলে ওকে গাল—মন্দ দিচ্ছে—সব কিছুই সে দু—বেটার মুখের দিকে চেয়ে সহ্য করে আছে। অথবা দু—বেটার জন্য এ—সবকে সে এতটুকু গ্রাহ্য করে না। কৈলাস কিংবা দুখিয়া যদি বেশি হারামি হয়ে ওঠে, রামকান্ত যদি বেশি বেইমানি করতে চায়, গেরু যদি ফের ফিরে আসে কোনো দিন, তবে সে কাউকে সালিসি মানবে না। একমাত্র গঙ্গা—যমুনাকে বলবে তুরা দেখে লে ব্যাপারটা। যা করতে হয় তুরা করে লে। হামার মা বাপ আছে তুরা।

হরীতকী এখন নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোতে পারছে। কাপড়ে মুখ ঢেকে মেঝেকে শুয়ে আছে। মাছিগুলো তবু যন্ত্রণা করছে পিসিকে। নেলি হাত বাড়িয়ে মাছি তাড়াল। পিসি শুয়েছে ত ঘুমিয়েছে। পিসির বিশ্বাস কৈলাসের ঝাড়ফুঁকে বাচ্চাটা ভালো হয়ে উঠবেই। নেলিরও বিশ্বাস। ওর দ্রব্যগুণের কথা, তন্ত্র—মন্ত্রের কথা নেলি এতদিন এই চটানে অনেকবার শুনেছে। অনেকবার দেখেছে। ওর দ্রব্যগুণের জন্যে শহরের বাবুরা পর্যন্ত আসেন। কতদিন দেখেছে নেলি—পুরানো অশ্বত্থের নিচে কৈলাস দাঁড়িয়ে আছে, বাবুরা এসেছেন শহর থেকে—কৈলাস মেয়েমানুষের শরীর থেকে ভূত ছাড়াচ্ছে। কতদিন যে কত পোয়াতির বাচ্চা হতে সাহায্য করেছে। সেজন্য নেলিও যেন জেনে গেছে বাচ্চাটা ভালো হয়ে উঠবেই। পিসির মতো সেও নিশ্চিন্ত হয়ে খুব হালকা বোধ করল।

কৈলাস নিজের চালাঘরটায় ঢুকে শুয়ে পড়ল মাচানে। সেই দ্রব্যগুণ, সেই জড়িবুটি, সেই ওস্তাদের দেওয়া মন্ত্র ওকে ছেড়েও যেন ছাড়ছে না। সেই ঝাড়ফুঁক, সেই জাদুমন্ত্র, সেই মিথ্যা ফেরববাজি—যার কোনো দাম নেই, কোনো গুরুত্ব নেই ভালো হয়ে ওঠার জন্য। তবু সে কেউ এলে দ্রব্যগুণের কথা আওড়ায়, জাদুমন্ত্র করে মানুষের বিশ্বাসকে মজবুত করে তোলে, হারুন রসিদের দোহাই দেয়, গেরুকে ডেকে বলে—বুঝলি, এ—বারো পেকারের তন্ত্র আছে। শুধু পুষে বড় করা বাচ্চাটার জন্যই—কেউ জড়িবুটির জন্য হাজির হলে চিৎকার করে বলতে পারে না, সব মিথ্যা, সব ফেরববাজি। গেরুটা যে তবে সব জেনে ফেলবে—একা ফরাসডাঙার কঙ্কাল তুলতে সাহস পাবে না।

যখন বাবুদের গলি থেকে সূর্য ওঠার চেষ্টা করছে, যখন রামকান্ত দোকান সাজিয়ে বসেছে—অন্ধকারের খেয়া পার হয়ে সূর্য যখন নদীর পাড়ে এসে হাজির, তখন চটানের একদিকে ভিড় জমতে শুরু করেছে। ছেলে, বুড়ো, মেয়ে, মরদ, মংলি, দুখিয়া সকলে একে একে ভিড় বাড়াচ্ছে। ছেলে, বুড়ো, মেয়ে, মরদ গোল হয়ে দাঁড়াল। জন আষ্টেক জিয়াগঞ্জের মরদ বাঁশে বেঁধে শুয়োর এনে ফেলেছে। ওরা মাঝরাতে লণ্ঠন হাতে রওনা হয়েছিল। ওরা চটানে পৌঁছল আর ভোর হল। ওরা এই শীতের ভোরেও ঘেমে গেছে। ওরা এখন কৈলাসের ঘরে বসে বিড়ি টানছে আর বকবক করছে।

খাসি শুয়োরটা ঘোঁতঘোঁত করছে মাটিতে। চারটে পা বাঁধা বাঁশটার সঙ্গে। তবু পড়ে পড়ে দাঁত দিয়ে মাটি তুলছে। এইসব দেখে পাশের খাটালে বাবুচাঁদের শুয়োরগুলো লাফাল, ছুটতে চাইল।

বাবুচাঁদ শুয়োর নিয়ে আজ বের হবে না। বিকেলে জিয়াগঞ্জ যাবে গেরুর সঙ্গে। সে ঘরে বসে লাঠিতে তেল খাওয়াচ্ছে। সেজন্য শুয়োরগুলো খাটালেই পড়ে থাকল কাদার মধ্যে—নাক—মুখ ডুবিয়ে পড়ে থাকল। মাঝে মাঝে খাসি শুয়োরটার চিৎকারে ওরা যেন অন্যমনস্ক হচ্ছিল। যেন দেখছিল—আহারে!

নেলি ওর ঘরে বসে বলছিল—আহারে!

মংলি হাই তুলতে তুলতে বলছিল, আহা শুয়োর বটে একখানা। যেমন চর্বি তেমন গোস্ত।

ঝাড়োর বৌ বলছিল, খেয়ে সুখ হবে।

চটানের উপরেই শুয়োরটা খুন হবে। বাপ গোমানি খুন করবে। বাপ ক্রমে লাশ কাটা ঘরের মতো চেহারা ধরবে। বাপ দা দিয়ে বসে বসে এখন বাঁশ সরু করছে—চাঁচছে। আঙুল টিপে টিপে খুঁটির ধার দেখছে। এ—সময় ওর জিভটা মুখ থেকে বের হয়ে আসবে। কাজ করবে আর, জিভ কামড়াবে গোমানি। বেশ মিহি; বেশ সরু করে খুঁটির মুখে ধার দিচ্ছে। গোটা চারেক হলে চলবে আপাতত। কোমরের দু পাশে দুটো, গলার দু পাশে দুটো বসিয়ে দেবে। এবং লোহার শিকটা গরম করে লেজের নিচে দিয়ে ঢুকিয়ে দিলেই হবে। একটা খাসি শুয়োর খুন হবার পক্ষে এই যথেষ্ট। গোমানি বাঁশ চাঁচবার সময় এমন সব ভাবছিল এবং জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটছিল।

গিরিশও বসে নেই। সে বড় বড় সব কলাপাতা কাটছে। কলাপাতা এনে চটানে জড় করছে। শুয়োরটার চারপাশের বাচ্চাগুলো এখন ঢিল ছুঁড়ছে—শুয়োরটার মুখে ঢিল ছুঁড়ে ওরা পরিতৃপ্ত হচ্ছে। ঘাটোয়ারিবাবু জানলা দিয়ে দেখছেন। হ্যাঁ মৃত্যু বটে শুয়োরের মৃত্যু। তিনি জানলার গরাদে হাত রেখে এ সব ভাবলেন। নেলি ঘরে বসে দেখল। সে বের হল না, বের হয়ে শুয়োরের মৃত্যু দেখল না। নতুন বাবু চটানে নেই, তিনি বিকেলে আসবেন। মাচানে শুয়ে শুয়ে নেলি নতুন বাবুর কথা ভাবল। গেরুর বিয়েতে সে যাবে না, পিসিও যাবে না, তিনি যাবেন না। যখন সকলে দল বেঁধে জিয়াগঞ্জে যাবে তখন তিনি ঘাটের পাহারায় থাকবেন।

অথচ আজ নিয়ে চার রাত নেলি মাচানে ঘুমাতে পারল না। সে নিজেও বুঝতে পারেনি যে গেরুর শাদিতে সে এতটা ভেঙে পড়বে। অথচ যত দিন গেল আপশোশটা তত বাড়ল। গেরুর সঙ্গে যতবার দেখা হল, ততবার সে নিজেকে আড়াল দিল। আগের মতো উচ্ছল হল না। হাসি—মস্করা করল না। গেল কাল থেকে নেলি নিজের ঘর থেকেই বের হল না। বের হতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কতবার সে গেরুর গলার আওয়াজ পেল, কতবার গেরু এ—ঘরে ঢুকে ডেকেছে। নেলিকে, কতবার বলেছে, নেলি তুর বাপ কুথিরে? নেলি সবই আন্দাজ করতে পারল। আন্দাজ করল—গেরু বাপের নাম করে এ—ঘরে সে তার দুঃখ জানাতে এল। আপশোশ জানাতে এল। তখন নেলি কোনো জবাব দেয়নি, চুপ করে থেকে গেরুকে ফিরিয়ে দিয়েছে। অথবা বড় বড় চোখে দেখেছে গেরুকে এবং ভেবেছে গেরু তু সব ভুলে গেলি!

ভেবেছে মরদ এত বেইমান হয়, মরদ এত আহম্মক হয়। মরদ এমন পাগল বনে যায় মেয়েমানুষের জন্য। মেয়েমানুষের শরীরের জন্য এত লুকলুক! এত হয়রানি! এত খানাপিনা! এত গোস্তের ঝালঝুল শনিয়ার শরীরটাকে চটানে তোলার জন্য। নেলি গেরুকে ফিরিয়ে দিয়ে এমন সবই ভাবল কেবল।

শুয়োরটা যত চিৎকার করছে, যত দাঁত দিয়ে মাটি তুলছে, যত মুখে গাঁজলা তুলছে, তত যেন নেলি ভেঙে পড়ছে। তত নেলি মাচানে শুয়ে শুয়োরের কষ্টটুকু নিঃশেষে ধরতে পারছে। বাপ শুয়োরটার কোমরের দু পাশে গলার দু পাশে বাঁশের শলা পুঁতে দিচ্ছে। লেজের নিচে লোহার শিক—ভয়ানক বীভৎস! গোমানি শুয়োরটাকে যেন লাশ—কাটা ঘরে এনে ফেলেছে—শুয়োরটা শুয়ে আছে, গোমানি শুয়োরটার কপালে হাতুড়ি ঠুকছে। গোমানি লোহার শিকটা কাঠের আগুনে লাল করেছিল। এই বাড়তি দয়াটুকু বাপের কেন যে হল, নেলি বুঝতে পারছে না! আহা! শুয়োরটা মরবে এখন। বড় কষ্ট পেয়ে মরছে। বাপ গুণে গুণে যত শলা পুঁতল তত লোক জমল চটানে। রামকান্ত পর্যন্ত ছুটে এল। বলল, দেখি, দেখি, কী করে পুঁতলি। দেখি, দেখি, কতটা পুঁতলি। আঃ হাঃ ওতেই হবে, বড় দাঁতাল দেখছি।

গোমানি বলল, না বাবু, ও মরবে না। ওয়ার ত কচ্ছপের জান। দাঁড়িয়ে দেখে লেন, আউর ভেবে লেন, কেতনা হারামি আছে ও। সহজে শালা মরছে না বাবু।

গোমানি আর একটা শলা চেঁচে শুয়োরটার পেটে পুঁতে দিল। মোটা এবং গোরুর খোঁটার মতো শলাটা চড়চড় করে ভিতরে ঢুকে গেল। তার ওপর গোমানি মুগুর দিয়ে ওটায় তিন চারটে বাড়ি মারল। শুয়োরটা মুখ দিয়ে কতক রক্ত উগলে দিল। শুয়োরটা কুঁকড়ে যাচ্ছে মুখটা হাঁ করে বীভৎস করে তুলছে। ডোমেদের ছোট ছোট বাচ্চাগুলো তবু ঢিল ছুঁড়ল। দুটো কাক ডাকল ঝাউ গাছটায়। ওরা ঘুরে ঘুরে উড়ল শুয়োরটার উপর। মংলি ঝাঁটা নিয়ে কাক তাড়াল।

গিরিশ পাতাগুলো জড়ো করে বিছিয়ে রাখবে—পাশাপাশি সাজিয়ে রাখছে। গোমানি আগুন জ্বালাল। সকলকে ডেকে শুয়োরটাকে আগুনে তুলে সেঁকে নিল। আগুনের উপরও শুয়োরটা রক্ত উগলে দিল। শেষবারের মতো শরীর থেকে রক্ত বের করে শুয়োরটা এবার সোজা হয়ে শক্ত হয়ে গেল। গোমানি খুশি হল—শালে এতক্ষণে গেল।

নেলি শুয়ে শুয়ে বেড়ার ফাঁক দিয়ে সব দেখল। সব চেঁচামেচি শুনল। বাপের কাণ্ডকারখানায় বিরক্তবোধ করল। যেন সাত জন্মে শুয়োর খায়নি বাপ। যেন সাতজন্মে এমন ভোজের আয়োজন বাপ চটানে দেখেনি। নেলি বিরক্ত হয়ে কাঁথা—কাপড় ফেলে উনুনের একপাশে বসে পড়ল। শুয়োরটার কষ্ট শেষ হওয়াতে সে হালকাবোধ করল।

হাঁড়িটা বেশ বড়। গঙ্গা থেকে কৈলাসের বৌ হাঁড়িটা ধুয়ে এনেছে। ওরা কয়েকজন মিলে শুয়োরটাকে এখন পাতার ওপর রেখেছে। শুয়োরটার শরীরে পোড়া ঘায়ের মতো রঙ। কৈলাসের বৌ হাঁড়িটা শুয়োরের পাশে রাখল। গোমানি শুয়োরের পেট চিরল। লাশকাটা ঘরে ছুরি চালিয়ে হাত ওর পাকা। ছুরির প্যাঁচে পেটটাকে দু ভাগ করল। অদ্ভুত কায়দায় ভিতর থেকে সব ময়লাগুলো তুলে নিল গোমানি। তারপর হাত ঢুকিয়ে পেটের ভিতর থেকে কাদার মতো জমাটবাঁধা রক্ত মালসা মালসা তুলে আনল এবং হাঁড়িতে রাখল। কৈলাসের বৌর দুটো লোভী চোখ, হাঁড়ির ঢাকনা খুলে দেখছে। দুখিয়া মংলি পরস্পর তাকিয়ে চোখ টান করল। হরীতকী দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে। বাচ্চাটা এখন কাঁদছে না, নীল হচ্ছে না। সে এ—শরীর নিয়ে জিয়াগঞ্জ যেতে পারবে না ভেবে দুঃখ পাচ্ছে। এমন একটা খানাপিনা থেকে বাদ গেল সে। এমন একটা মাইফেলে সে থাকতে পারল না। ওর চোখে সে আপশোশ ধরা পড়েছে।

চর্বিগুলো গোমানি ভাগ করে রাখল। মাংসগুলো কেটে কেটে কলাপাতার স্তূপ করল। শুয়োরটার গায়ে মাংসের চর্বি বেশি। শুয়োরটা বড় জবরদস্ত, শুয়োরের মতো শুয়োর বটে। কৈলাস দাওয়ায় বসে এমন সব কথা বলছে। এখন কৈলাসের মুখে ও মনে বেশ একটা আমিরী চাল। রাজা—বাদশার মতো বসে ওজর বানাচ্ছে। আদেশ দিচ্ছে চটানের সকলের কাছে। সে হুজুর বনে গেছে। সকলে এসে ওর পাশে দাঁড়িয়েছে—কী করতে হবে, কোথায় যেতে হবে হুকুম নিচ্ছে। সে গেরুকে বাজারে পাঠাল। লখি, টুনুয়াকে নদীর ওপারে। ঝাড়োকে জিয়াগঞ্জ থেকে কাটোয়া পর্যন্ত গঙ্গার ধারে ধারে যত চটান আছে—সেখানে। ঢুঁড়ে ঢুঁড়ে বেড়াচ্ছে। বলছে সকলকে, তুমরা যাবেক কিন্তুক বাপুরা। কৈলাসের পুষে বড় করা বাচ্চাটার শাদি। মেয়েরবানি করে তুমরা সব চলোগে। লয়তো কৈলাসের খুব দুঃখ হবে। তুমরা যাবেক সকলে। ঝাড়ো সকলকে দাওয়াত দেবার জন্য চটান ছেড়ে দুদিন আগে চলে গেছে।

আজ এই ভোরে, এই আমিরী ভাবটুকু কৈলাসকে খুব সুখ দিচ্ছে। সকলের সঙ্গে সে কথা বলল। আজ বৌটারও খুব সুখ। এত বড় একটা শুয়োর এ চটানে কোতল হল, সে ত ওরই বেটার জন্য। চটানের মানুষেরা এত বড় শুয়োর কোতল হতে দেখেছে চটানে—না আর দেখবে! সে ঘরে গেল তখন। কৈলাসের কানে কানে বলল, একটা মাইক লাগা না! বাবুদের বাড়ি গমগম করে উঠুক। বলুক, কৈলাস ডোমের বেটার শাদি। শহরের লোক যদি না জানল তবে শাদিতে কী সুখ!

কৈলাস ভাবল, তা বটে তা বটে। এক বেটার শাদি।

সে ডাকল দুখিয়াকে—দুখিয়ারে, অঃ দুখিয়া!

হা জী বলেহ।

তু একবার লখনবাবুর কাছে যা। ওয়াকে বলবি একটা মাইক লিতে হবে। একটা কলের গান ভি লিতে হবে। দশ রুপায়া কাল দে লিব। তু যা।

দুপুরে একটা চাঁদোয়া টাঙানো হল উঠোনে। একটা ঘট বসানো হল। চটানের সকল মেয়ে—মরদ মিলে নদী থেকে জল তুলে ঘটে একটু একটু জল ঢালল। মাইক বাজল উঠোনে। বাবুদের বাড়িমুখো মাইকটা বসানো হয়েছে। খাটালের গলিতে দুটো বড় কড়াইয়ে শুয়োরের গোস্ত জ্বাল হচ্ছে। বড় মাছের ঝোল হচ্ছে। বড় কড়াইয়ে দু কড়াই মিষ্টি আনিয়েছে কৈলাস। দুখিয়া রান্নার তদারক করছে। মাঝে মাঝে ঘাটোয়ারিবাবু অফিস থেকে নেমে আসছেন। হেঁটে হেঁটে সব দেখাশোনা করছেন এবং সকলকে তাড়া দিচ্ছেন—এবার রওনা হতে হয়।

নেলি উনুনটার পাশে বসে সব দেখল। বাপ ছুটোছুটি করে মরছে একবার রামকান্তের কাছে, একবার কলের গানের কাছে। লাশ—কাটা ঘরের দুজন লোক এসেছিল, বাপ এক ঘণ্টার ভিতর সে—কাজগুলো সেরে চলে এল। বাপের মুখের ঘাম জমেছে। এতদিন পর বাপ যেন একটা কাজের মতো কাজ পেল। কৈলাস ওকে দিয়ে পয়লা নম্বর কাজগুলো করাচ্ছে বলে—সে কৃতার্থ হচ্ছে। বড় অনুগত আজ গোমানি ডোম। বড় ভালোমানুষ আজ সে।

লখি—টুনুয়া নদীর পার থেকে ফিরছে। ওদের সঙ্গে আরও চারজন মরদ। ওদের কাঁধে বড় বড় ভাঁড়। ওরা পচাই নিয়ে ফিরছে।

ঘাটোয়ারিবাবু ফের অফিস থেকে নেমে এলেন। বললেন, কিরে তোদের এখনও হল না। জিয়াগঞ্জ পৌঁছতে দেখছি তোরা খুব রাত করবি।

ঘাটোয়ারিবাবুকে চটানে দেখে সকলে এসে জড়ো হল। ওরা খুব ভালো মানুষের মতো বাবুর কথা শুনল। তারপর সকলে সকলকে তাড়া দিল। বলল, জলদি, জলদি করো। আর দেরি চলবে না।

ঘরে ঘরে সকলে সাজল। মংলি দাওয়ার নিচে পানের পিক ফেলে আকাশি রঙের শাড়ি পরল এবং ভাবল যদি কাটোয়া থেকে লোকটা আসে, যদি মংলির সঙ্গে জিয়াগঞ্জে যায়! কাঠের বাক্স থেকে সে ভাঙা আরশি নিল। নিজের মুখ দেখল এবং পাশাপাশি অন্য মুখটা দেখারও ইচ্ছা। কপালে টিপ দিল কাগজের। চোখে কাজল, পায়ে রুপোর খাড়ু, হাতে রুপোর চুড়ি, নাকে পিতলের নথ পরল, চোখ টানটান করে সকলের সঙ্গে কথা বলছে। দুখিয়াকে ধমক দিচ্ছে। মংলির ধমক খেয়ে দুখিয়া ফেটি বাঁধল মাথায়, কাঁধে গামছা, গায়ে হাফশার্ট, হাতে লাঠি নিল। হাতে লাঠি নিয়ে দুখিয়া এ—ঘর সে—ঘর করতে থাকল। দুটো গোরুর গাড়ি ভাড়া করা হয়েছে। দুখিয়া গোস্ত, পচাই, মিষ্টি, মাছ—গোরুর গাড়িতে বোঝাই করছে। অন্য গোরুর গাড়িতে গেরু বসেছে টোপর মাথায় দিয়ে। চারপাশে বসেছে চটানের সব বাচ্চাকাচ্চার দল।

বেড়ার ফাঁকে নেলি দেখছে। হরীতকী তবু বাচ্চাটা কোলে নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াতে পারল। নেলি সেটুকু পর্যন্ত পারল না। লজ্জায়, দুঃখে সে চালাঘরটার একপাশে চুপচাপ বসে থাকল এবং বেড়ার ফাঁক দিয়ে গোরুর গাড়ির ওপর গেরুকে দেখে তার চোখ ফেটে জল বেরোতে লাগল। গেরু শাদি করতে যাচ্ছে। সে আজ থেকে শনিয়ার মরদ হবে। অন্য চটানে উঠে যাওয়ার জন্য অন্য কোনো মরদ থাকল না নেলির। সে এ চটানে বড় একা, বড় নিঃসঙ্গ। বাপ গোমানি পর্যন্ত চুল পাট করেছে, তেল মেখে গোঁফ মোটা করেছে। শক্ত করেছে। বাপ গোমানিকে বড় খুবসুরত লাগছে। গেরুকে আজ বাবুমানুষের মতো লাগছে। লতুন কাপড় পরনে, লতুন জামা গায়ে। মাথায় টোপর পরছে গেরু। সেও কেমন চুপচাপ, কেমন ভেঙে পড়েছে যেন। গেরুকে দেখে নেলির কষ্ট হতে থাকল। যেন ওর কিছু বলবার নেই। সে বাপ কৈলাসের হাতে বাঁধা। যেন তার নালিশ—নেলি তু না কাঁদিস। হামাকে তু ভুলে যা। আজ থেকে তুর গেরু মর গিল।

গোরুর গাড়ি দুটো চটান থেকে নেমে গেলে নেলি হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল উনুনের পাশে। চটানে কেউ নেই, হরীতকী গোরুর গাড়ির সঙ্গে কিছুদূর নেমে গেছে। একমাত্র মংলি তাদের কাঠের দরজায় তালা দিয়েছে। অন্য সকলের দরজা নেই, তালাও পড়েনি। নেলি ঘর থেকে বের হয়ে চটানের চারপাশটায় হাঁটতে থাকল। সহসা একটা দুরন্ত ইচ্ছা নেলিকে পাগল করে তুলেছে। নেলিকে উত্তেজিত করে তুলেছে। এ—চটানে ওর জন্য কেউ ভাববার নেই, কী হবে এ—চটান দিয়ে কী হবে বাপ গোমানি, অন্য মেয়ের মরদ গেরুকে দিয়ে, কী হবে এ চটানে বেঁচে থেকে। তার চেয়ে সে অন্য কোথাও উঠে যাবে, অন্য কোথাও গিয়ে ঘর বাঁধবে। সেইজন্যই দুরন্ত ইচ্ছাটা ওকে ঘোড়দৌড়ের মতো ছুটাল। ঘরে ঘরে আগুন ধরানোর জন্য নানারকম ফন্দি—ফিকির খুঁজতে থাকল। দরকার হলে সে—আগুনে পুড়ে মরবে। চটানে আগুন দেবার আগে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল, কিছুক্ষণ আকাশ দেখল। দু—একবার প্রকট হাসিতে ফেটে পড়তে চাইল। অথচ আত্মহত্যার প্রবল ইচ্ছা নেলিকে হাসতে দিচ্ছে না। ক্রমশ বিষণ্ণ হয়ে পড়ছে, ক্রমশ হাতে পায়ে শক্তি পাচ্ছে না, এমনকি দেশলাইটা হাতে নিয়ে একটা কাঠি ধরাবার শক্তিটুকু পর্যন্ত নেই। এত ভারী হয়ে গেছে শরীরটা, এত সে ভেঙে পড়েছে।

তখন দুঃখবাবু চটানে উঠে এলেন। চটানটা একেবারে ফাঁকা। কেউ নেই। এমনকি হরীতকীকে দেখতে পাচ্ছেন না। নেলিকে দেখতে পাচ্ছেন না। তিনি চটান অতিক্রম করার সময় ডাকলেন, নেলি আছিস নাকি রে ঘরে? নেলি, ও নেলি! চটান যে একেবারে ফাঁকা। হরীতকীও বুঝি গেছে! নেলি, ও নেলি, সাড়া দিচ্ছিস না কেন?

নেলি তাড়াতাড়ি দেশলাইটা লুকিয়ে ফেলল। ভেতর থেকে উত্তর করল এই যে বাবু আমি ঘরে। শরীর ভালো নেই বলে শুয়ে আছি বাবু।

কিছু করছিস না ত?

না বাবু, কিছু করছি না।

শরীর কী খুব খারাপ যাচ্ছে?

না বাবু।

ওরা তবে সব চলে গেল?

জী বাবু। নেলি আর শুয়ে থাকতে পারল না? খারাপ দেখাচ্ছে ভেবে নেলি তাড়াতাড়ি উঠে বসল। বাইরে বের হয়ে এল। হাতে পায়ের জড়তা ভাঙবার মতো শরীর টান টান করল। গেরুর বিয়েতে সে এতটুকু ভেঙে পড়েনি, শরীর টানা দিয়ে এ—মত ভাব প্রকাশ করার ইচ্ছা—যেন ভাবটা—গেরু শাদি করতে গেছে, নেলি, পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে।

তা হলে তুই গেলি না?

না বাবু! যেতে ইচ্ছে হল না।

বসে থাকলি একা একা?

জী বাবু।

তবে আমার ঘরে আয়, কাজও করবি, গল্পও করবি।

দুঃখবাবু এবার অফিসঘরের দিকে হাঁটতে থাকলেন। বেলা পড়ে আসছে। দুঃখবাবু ঘরে ঢুকে জানলা খুলে দিলেন। শীতের পাখিরা জানালার আকাশে উড়ছে। পলাশগাছে ফুল ফুটছে। গাঙ শালিকেরা মধু খাচ্ছে পলাশ ফুলের। ওরা উড়ল। ওরা বসল। দুঃখবাবু জানালা খুলে সব দেখতে পেলেন। বাবলার ঘন বনে দুটো মেয়ে কাঠ সংগ্রহ করছে, দুটো কাঠঠোকরা পাখি, দুটো ইষ্টিকুটুম ওর মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। আকাশ ঘন নীল। চালা ঘরটায় ইতস্তত কুকুরের আর্তনাদ। বালিয়াড়িতে পায়ের ছাপ। হরীতকীর ঘরে বাচ্চাটা হাত—পা নেড়ে খেলছে। হরীতকী ফিরে এসেছে নদীর ঢালু থেকে। হরীতকী কত রকমের কথা বলল বাচ্চাটার সঙ্গে। দুঃখবাবু নিজের ঘরের কথা ভাবলেন। বৌ বাচ্চার কথা ভাবলেন। ভাবলেন অভাবের সংসার। সুখ—দুঃখের ঘর। ওদের মুখে দুটো অন্ন দেওয়ার জন্যই তিনি এখানে মরা মানুষের হিসাব আগলাচ্ছেন। কিন্তু এখানে এলেই মনটা ভারী হয়ে ওঠে। বুকে নিঃসঙ্গ যন্ত্রণা—মৃত্যু, মৃত্যু। এই ভাব শুধু মনে। তবু আসতে হবে, বসতে হবে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এখানে পড়ে থেকে মড়ার হিসাব আগলাতে হবে। এইসব ভেবে দুঃখবাবু কেমন মুষড়ে পড়লেন কেমন বিষণ্ণ হয়ে পড়লেন। তখন পাশে কেউ নেই যে দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলে সাহস দেবে অথবা দুটো ভিন্ন রকমের কথা বলে মনের অস্বস্তি দূর করবে। তিনি ফের ডাকলেন, নেলি, ও নেলি। একবার আয়না বাপু। ঘরে একা বসে করছিসটা কী শুনি। এইসব বলে, ডেকে—হেঁকে নিজেই মনটাকে অন্যমনস্ক করতে চাইলেন।

নেলি ঘরে গিয়ে মাচানে বসে পড়েছিল। উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে না। গল্প করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। তবু বাবু ফের ডাকলেন। বাবুর কথা অগেরাহ্যিতে আনতে নেই। বাবু যখন ডেকেছেন, যখন এ—দুঃখ যাবার নয়, তখন দুটো ভিন্ন রকমের কথাই বলা যাক লতুন বাবুর সঙ্গে। সে মাচান থেকে উঠল—যেন আর কোনো দুঃখ নেই। কিছুক্ষণ আগেও আত্মহত্যার যে প্রবল ইচ্ছা ওকে তাড়না করছিল, নতুন বাবুর ডাকে সে ইচ্ছা আর সাড়া দিচ্ছে না। সেই দুরন্ত ইচ্ছাটাও নেই। বাবু ডাকছে। বাবুর ইচ্ছা ওর পাশে বসে সে গল্প করুক। নেলি নিজের শরীরটার দিকে চাইল। কদিনে শরীরটা আরও যেন বেশি ভারী হয়ে উঠেছে। কোমরের নিচটা ক্রমশ মোটা হচ্ছে। শরীরে মাংস লাগছে। ছোট কাপড়ে শরীর ঢাকছে না। সে নিজেই লজ্জা পেল শরীর ঢাকতে গিয়ে। তবু শরীর কোনোরকমে ঢেকে সে বাবুর ঘরে গিয়ে উঠল। দরজার ভিতরে উঁকি মেরে বলল—আমায় ডেকেছেন বাবু! কী কাজ করে দিব বুলে দ্যান।

দেখ না ঘরটা কেমন নোংরা হয়ে আছে। সেদিন ত ঘরটা পরিষ্কার করে দিলি। দ্যাখ আজই কী নোংরা হয়ে গেছে। দ্যাখ তক্তপোশে দেওয়ালের কেমন চুনবালি। মেঝেতে পা রাখা যাচ্ছে না। দে দে পরিষ্কার করে দে। ঘরটাতে বসতে পারছিনে।

আপনি টুলটার ওপর উঠে বসেন, হামি ঝাড় দিয়ে লিচ্ছি।

ইতিমধ্যে ঘাটোয়ারিবাবু দুঃখবাবুর জন্য একটা ছোট পুরনো তক্তপোশ জোগাড় করে দিয়েছেন। ঘরের একপাশে সেটা পাতা আছে। নেলি নুয়ে প্রথম তক্তপোশের নিচটা পরিষ্কারের জন্য গলা বাড়ালো। নেলি তক্তপোশের নিচেটা ঝাঁট দিচ্ছে—দুঃখবাবু দেখতে গিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। নিজের স্ত্রীর কথা মনে হল। ঘরে ওর স্ত্রী আছে। সতীসাধ্বী স্ত্রী। সুতরাং মনের দুর্বিনীত ইচ্ছাটাকে দমন করতে চাইলেন। বিবাহিত পুরুষের এমন ইচ্ছা ভালো নয়। তিনি টুলে বসে আহ্নিকের মতো জপ—তপ করতে থাকলেন—বিবাহিত পুরুষের এমন ইচ্ছা ভালো নয়। ভালো নয়। শেষে কেন জানি তিনি নেলির ওপর বিরক্ত হয়ে উঠলেন। তিনি বললেন, নেলি, তুই একটা ব্লাউজ পরতে পারিস না? তোর বাপকে বলবি তুই বড় হয়েছিস। একটা জামা যেন তোকে কিনে দেয়। কথাগুলো দুঃখবাবু ধমকের সুরেই বললেন।

নেলি লজ্জায় মাথা তুলতে পারল না।

তখন সূর্য পুরনো অশ্বত্থের ডাল বেয়ে নদীর ওপারে নামছে। যে রোদ জানলা বেয়ে মেঝেতে নেমেছিল সে আবার দেয়াল বেয়ে উপরে উঠছে। লাল রঙ ধরেছে। পৃথিবীর সর্বত্র আলো। আলোর রঙ। লাল নীল হলুদ আলো। আকাশ নীল। সাদা মেঘ। টুকরো টুকরো সাদা মেঘের রঙ আকাশে কুর্চি ফুল ফুটিয়েছে। বিকেলের সাদা মেঘ সোনালি রঙে জ্বলছে। নেলি জানালায় মুখ রাখতে পারল না। একটা ব্লাউজের অভাব এই ধরণির সব সুখকে বিষময় করে তুলল। ঘরটা পরিষ্কার করে সে কোনোরকমে বাইরে এসে দাঁড়াল। সূর্যের সোনালি আলো ওর শরীরে এসে নেমেছে। দুঃখবাবু দেখলেন—নেলি সে আলোয় জ্বলছে। নেলির মুখ, চোখ, শরীর এই আলোর অসামান্য লাবণ্যে বড় মনোরম হয়ে উঠছে।

দুঃখবাবু ডাকলেন, কিরে রাগ করলি?

নেলি জবাব দিল না।

সহজ হবার জন্য দুঃখবাবু বললেন, তোর বিয়েতে আমাকে নিমন্ত্রণ করবি না? তোর বিয়েতে কিন্তু দেখিস যেন বাদ পড়ি না। কিরে, কথা বলছিস না কেন? মনে থাকবে তো আমার কথা?

মনে থাকবে। লেকিন শাদি আমার হবে না বাবু।

কে বললে হবে না? জরুর হবে। আমি দেখে শুনে তোর শাদি দেব!

কাঁহা দিবি বাবু? কোন হামারে শাদি করবে?

সবাই করবে। কাটোয়ার চটান থেকে তোর জন্যে মরদ ধরে আনব।

লেকিন হবে না।

কেন হবে না।

চটানের লোকেরা বুলবে হামি ডাইনি আছি। দিন দিন ডাইনি বনে যাচ্ছি। আপনি তু লতুনবাবু আছেন। দুরোজ থাকেন, সব টের পাবেন।

নেলি নেমে যেতে থাকল অফিসঘরের বারান্দা থেকে। দুঃখবাবু ফের ডাকলেন। নেলি দাঁড়াল না। বাবুর কথাগুলো ওর শরীরের আগুনটাকে আরও খুঁচিয়ে দিয়েছে। সে যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকল। নিচে নেমে সে কাউকে না দেখে গঙ্গা—যমুনাকে ডাকল। শেষে চটানে উঠে হরীতকীকে বলল, রাতে তু কিছু না রাঁধবি পিসি। হামি আজ রাতে বুড়াবাবার ঘরে যাবে। আজ তু, হামি—দুটো ভালো মন্দ খেয়ে লিবে।

সন্ধ্যা নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে নেলি গঙ্গা—যমুনাকে নিয়ে নদীর পাড় ধরে ছুটতে থাকল। নদীর পাড়ে রাত ঘন হয়ে নামছে। ঘন অন্ধকারে জোনাকি জ্বলচে। নিচে বালিয়াড়িতে কাঁচা কয়লা পুড়ছে। নেলি ছুটতে থাকল কেবল। কুকুর দুটো ছুটছে। শিমুল পলাশের অন্ধকার অতিক্রম করে নেলি সেই বুড়োর বাড়িটার পাশে একটা ঝোপের ভিতর কুকুর দুটোকে নিয়ে লুকিয়ে থাকল। বুড়োর ছেলে দুটো আসছে। কিছু মেয়ে—পুরুষ সঙ্গে। পুকুর পাড়ে পেয়ারা গাছের নিচে ওরা প্রদীপ রাখল। ওরা পেয়ারা গাছটার নিচে বুড়োর আত্মাকে খেতে দিল। নেলি ঝোপের ভিতরে বসে সব দেখছে। গঙ্গা—যমুনাও দেখছে। পেয়ারা গাছটার নিচে মালসাতে খেতে দিয়ে বুড়োর ছেলেরা কাঁদল। মেয়েরা কাঁদল। তারপর ওরা চলে গেল। বুড়োর আত্মাকে শেষবারের মতো খেতে দিয়ে ওরা বাড়ির ভিতর ঢুকে সদর বন্ধ করে দিল। শুধু যারা বাড়ির জানালা দিয়ে উঁকি দিয়েছিল তারা দেখেছিল প্রথম একটি মেয়ের রূপ ধরে আত্মাটা খাবারগুলো খেল পরে দুটো কুকুরের শরীর নিয়ে আত্মাটা খাবারগুলোর আশেপাশে ঘুরে বেড়াল। এক সময় পেয়ারা গাছের নিচে প্রদীপটা নিভে গেল।

নেলি সে রাতে ঘরে ফিরে বলেছিল, পিসি তু আর হামি খাবে। খাওয়ার পর ঢেকুর তুলে বলেছিল, বেশ খেলাম নারে পিসি। তু ভি খেলি হাম ভি খেলাম। গঙ্গা—যমুনা ভি খেল। বুড়োটার খুব চিংড়ি মাছের মুড়ো ভাজা খাওয়ার শখ। সব দে লিছে পিসি। ওর বিটিরা কাঁদছে কী পিসি! বুলছে—বাবাগো তুমি চিংড়ি মাছ খেতে ভালোবাসতে গো। বাবাগো তোমাকে দেখতে নারলেম গো। কী কাঁদছে পিসি। ওয়ার বেটারা পিসি আচ্ছা নকরি করে।

নেলি খেয়ে উঠে বলল, হামরাও একটা ভোজ খেয়ে লিলাম পিসি। আচ্ছা ভোজ।

হরীতকী বলল, ভাত, দাল, মিষ্টি, রসগোল্লা। মাছের কালিয়া। কত হরেকরকম খাবার খেয়ে লিলুমরে। গেরুর ভোজের চেয়ে এটা কম হল না। কী বলিস তু?

অথচ ঘুরে ফিরে সেই এই আপশোশ নেলির। যত জিয়াগঞ্জের চটানের কথা মনে পড়ছে তত কষ্ট বাড়ছে। এখন হয়তো শনিয়ার শরীরটা গেরুর শরীরের সঙ্গে মিলে আছে। বাপ গোমানি মদ খেয়ে হয়তো হল্লা করছে। কৈলাসের হাঁক—ডাকে হয়তো গোটা চটানটা কাঁপছে। মংলি মরদের সঙ্গে হয়তো বালিয়ারিতে নেমে গেছে। যতরকমভাবে হতে পারে—সব রকমের ফুর্তি করছে। নেলি নিজের ঘরে ঢোকার সময় এমন সব ভাবল। এমন সব ভাবায় চোখে—মুখে জ্বালা ধরছে। সে বিছানায় শুয়ে শরীরটাকে শক্ত করে দিল। গায়ে কাঁথা—কাপড় টেনে পায়ে পা ঘষতে থাকল। উপুড় হয়ে পড়ে চাপ দিতে চাইল শরীরে। শরীরে তার গরম ধরে গেছে। ইচ্ছার আধারগুলোতে দুঃখবাবু অথবা গেরুর প্রতিবিম্বকে দেখতে চাইল। গেরুর চেয়ে দুঃখবাবুর প্রতিবিম্ব ওকে বেশি তাড়না করছে। অথবা নেলি সেই প্রতিবিম্বকে ভালোবাসতে চাইছে। গেরুর ওপর বদলা নিতে চাইছে। সুতরাং নেলিও সেই প্রতিবিম্ব নিয়ে যতরকমভাবে হতে পারে শরীরের ওপর লুফতে থাকল কিন্তু এই করে গতরে উত্তেজনা শুধু জমছে। গরম বাড়ছে। গভীর রাতে দুঃখবাবুর ঘরের দিকে নিয়ে যেতে চাইছে। নেলি শক্ত হয়ে শুয়ে থাকল মাচানে। মাচান ধরে পড়ে থাকল। শরীরের চাপ মাচানে সেজন্য বাড়ছে। কাঁথা—কাপড়ের ভিতর মাচানের শব্দ উঠছে। সে কিছুতেই শুয়ে থাকতে পারছে না। কিছুতেই নিজেকে আর যেন ধরে রাখতে পারছে না। আর পারছে না। পারছে না। সে উঠে বসল। উত্তেজনায় শরীর কাঁপছে। মনে হচ্ছে শরীরে ভীষণ জ্বর এসেছে। অথবা বেতো রুগির মতো কেমন এক অলস যন্ত্রণায় ভুগছে। মাচানের ওপর বসে সে যেন বুঝল শুধু প্রতিবিম্বকে নিয়ে শরীরের গরম মেটে না। এতে শরীরের যন্ত্রণা আরও বাড়ে। নেলি নিজের কাছেই খুব অসহায় হয়ে পড়ল। যত ভাবছে উঠবে না, দুঃখবাবুর ঘরের দিকে যাবে না, ততই উত্তেজনায় অধীর হয়ে পড়ছে। অসহ্য মনে হচ্ছে এই মাচান। কপালে ঘাম জমেছে। শরীরের সব রক্তমাংস যেন জল হয়ে এক্ষুনি গলে পড়বে। নেলি মাচানে বসে অন্ধকারে দু—হাত উপরে তুলে ডাকল, ডাকঠাকুর, তু হামারে ভরসা দে।

এমন সময় হরীতকীর ঘরের বাচ্চাটা কেঁদে উঠল। দূরে রাত পেঁচা ডাকল। ঝাউগাছটার মরা ডালে শকুনেরা পাখা ঝাপটাল। শ্মশানে মড়া নেই। সুতরাং আগুন জ্বলছে না। পিসি ঘুমের ভিতরই বাচ্চাটাকে ষাট সোহাগ করছে।

নেলি ফের ডাকল তার ঈশ্বরকে, ডাকঠাকুর, তু হামারে ভরসা দে লয়তো হামি মরে যাবে, হামি বাঁচবে না।

তারপর নেলি বুঝল তার নিজস্ব কোনো ইচ্ছা—অনিচ্ছার কথা নেই এখন। এটা তার শরীরের ইচ্ছা, সে ইচ্ছার দুঃসহ যন্ত্রণায় মাচান থেকে নেমে দুঃখবাবুর ঘরের দিকে হাঁটছে। তখন হরীতকীর ঘরে আঁধার। নেলির ঘরে কোনো লম্ফ জ্বলছে না। চটানে আঁধার। চটানে কোনো মরদের সাড়া নেই। মেয়ে মরদ বিহীন এই চটানে নেলি যেন ভূতের মতো হাঁটছে। কুকুর দুটো পিছনে আসছে। নেলি ওদের ইশারা করল চলে যাওয়ার জন্য। কুকুর দুটো আঁধারে নেমে গেল। শ্মশানের চালাঘরটায় হারিকেন জ্বলছে। কুকুর দুটো নিচে নেমে চিৎকার করল। বাবলার ঘন বনের দিকে ওরা যেন ছুটে গেল তারপর আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। শুধু রাতের শব্দ, রাত—পোকার শব্দ। কিছু ঝিঁঝিপোকার শব্দ অথবা যন্ত্রণার শব্দ। কাঠগোলায় কারা যেন হুড়মুড় করে সব কাঠ ফেলে দিল। নেলি দাঁড়িয়ে পড়ল। সন্তর্পণে কাঠগোলার দিকে তাকাল—কেউ সে—ঘর থেকে নেমে আসছে কিনা দেখল। কেউ আসছে না। শুধু একটা কুকুর কাঠগোলা থেকে ছুটে পালাচ্ছে। কুকুরটা কাঠগোলায় যেন ভূত দেখেছে। তখন নেলির পায়ের ওপর আলো। দুঃখবাবুর ঘরের জানালা দিয়ে আলো এসে নিচে নেমেছে। সে দুঃখবাবুর ঘরের খুব কাছাকাছি এসে গেল। আলোটা ওর পা থেকে বেয়ে কোমরে উঠল। নেলি ওপরে উঠে জানালাটা একটু ঠেলে ঘরের ভিতরটা দেখল। লতুনবাবু লেপ দিয়ে শরীর মুখ ঢেকে রেখেছেন। আলোটা পাশের একটা তাকে জ্বলছে। নেলি এবার দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। এবং ধীরে ধীরে ঠেলে দিতেই দেখল দরজাটা খুলে যাচ্ছে। অথচ নেলি দরজাটা বেশি দূরে ঠেলে দিতে পারল না। সে উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে দরজার পাশে বসে পড়ল। মনে হল দুঃখবাবু এক্ষুনি হাজার লোককে ডেকে বলবেন ডাইনি মাগি আমাকেও খেতে চাইছে।

দুঃখবাবু ঘরে ঘুমোতে পারছিলেন না। চটানের প্রথম রাতযাপন তাঁকে মনের দিক থেকে বিব্রত করে মারছে। তিনি শুয়ে শুয়ে নেলির কথাই ভাবছিলেন। নেলির অসহ্য চোখ দুটো শরীরে দুরন্ত যন্ত্রণার জন্ম দিচ্ছে। বাসি কাপড়ের মতো স্ত্রীর শরীরটা মনের দড়িতে ঝুলছে। তিনি চোখ বুজে পড়েছিলেন শুধু। নেলি এই চটানে আছে। মাচানে নেলি, নেলি, এই ভাবনা শুধু মনে। বিকেলে এ—ঘরে নেলি না এলেই যেন ভালো করত। কিন্তু মনে হচ্ছে দরজাটা কে যেন ঠেলে দিল। মনে হচ্ছে দরজার ও পিঠে কে বসে হাঁপাচ্ছে। চোখ বুজেই তিনি যেন সব টের করতে পারছেন। তিনি ডাকলেন, কে বাইরে? কে দরজাটা ঠেলছিস?

তিনি দরজার ও—পিঠ থেকে কোনো জবাব পেলেন না বলে উঠে বসলেন। চোখ মুখ ঘষলেন। ভাবলেন মনের বিভ্রম হয়তো। তিনি শুয়ে পড়তে যাচ্ছিলেন ফের। কিন্তু শুয়ে পড়ার সময় দেখলেন দরজাটা সত্যি একটু খোলা। ভাবলেন হয়তো বাতাসে। তিনি উঠে দরজা বন্ধ করতে গিয়েই দেখলেন বাইরে নেলি চুপচাপ বসে আছে। বসে বসে যেন শীতে কাঁপছে।

তিনি বললেন, কিরে ভয়ে চটানে ঘুমোতে পারলি না বুঝি? আয়, আয়, ভিতরে আয়। ভিতরে বসবি। বাইরে খুব ঠান্ডা।

নেলি উঠে দাঁড়াল। বাবুর কথা শুনতে হয়, সুতরাং সে ঘরে ঢুকে গেল। এখন আর যেন নেলির কিছু করণীয় নেই। আবার বাবু যদি কিছু বলে, যদি বলে বোস, তবে বসবে। যদি বলে দাঁড়া তবে দাঁড়াবে। যদি বলে অন্য কিছু—তবে, তাই হবে। দুঃখবাবুর কাছে এখন নেলি কাঠের পুতুলের মতো হয়ে বাঁচতে চাইল।

সে সময় সহসা বিদ্যুৎ চমকাল আকাশে। জানালায় বিদ্যুতের ছটা এসে নামল। ওদের মুখ উজ্জ্বল হল। শীতের শেষে ঝড়বৃষ্টি হবে। দুঃখবাবু জানালা বন্ধ করে দিলেন। সহসা মনে হল আকাশ কেঁপে উঠছে। অন্ধকারে বাইরের আকাশটা যেন ছাদের মাথায় ভেঙে পড়ল। দুঃখবাবু ভয় পাওয়ার মতো করে বললেন, কোথাও বাজ পড়ল নেলি। নেলি কাঠের পুতুল বলে জবাব দিতে পারছে না। আবার তেমনি আকাশ ভেঙে পড়ার শব্দ। জোর হাওয়া দিচ্ছে। দরজা জানলা কাঁপছে। বৃষ্টির ভয়ানক ছাট আসছে। জানালার ফাঁক দিয়ে দেয়াল বেয়ে জল মেঝেতে নামল। মেঝেতে জমল। তারপর মনে হল জানালায় কারা যেন ধাক্কা মারছে। যেন লাঠি পিটছে। অথবা কারা যেন জানালায় হাত দিয়ে শব্দ করছে এবং ভয়ানক কিছু ঘটে গেছে এমন ভাব দেখাচ্ছে। দুঃখবাবু জানালা খুলে বাইরের পৃথিবীতে কী ঘটছে দেখার জন্য ফাঁক করতেই এক পশলা শিলাবৃষ্টি হল ভিতরে। তিনি বুঝলেন বাইরে ভয়ানক শিলাবৃষ্টি হচ্ছে। নেলিকে বললেন, তুই তক্তপোশে উঠে আয়। জলে দাঁড়িয়ে কষ্ট পাচ্ছিস কেন? তক্তপোশে বসে থাক, জল ছাড়লে ঘরে যাবি।

নেলি শীতে কাঁপছিল অথচ কিছু বলছিল না। দুঃখবাবু চাদরটা দিলেন ওকে। নেলি চাদরটা গায়ে দিল না, জবুথবু হয়ে তক্তপোশের এক কোণায় খুব আলগা হয়ে বসে থাকল। মেঝেতে জল ক্রমশ উপচে পড়ছে। শীতে কনকন করছে পাটা। নেলি তবু পা তুলে বসল না।

দুঃখবাবু ভাবলেন ধমক দেবেন। শাসন করবেন। নেলি এটা ভালো হচ্ছে না। আমার কথা অমান্য করতে নেই। তক্তপোশে পা তুলে বোস। চাদরটা গায়ে দে। শীতের ঠান্ডা কাউকে রেহাই দেয় না। তোকেও দেবে না, তুই শীতের ঠান্ডায় মরবি। অথচ তিনি কিছুই বলতে পারলেন না। গলাটা কেমন কাঠ—কাঠ। গলাটা শুকনো। নেলি সেই যে পুতুলের মতো বসে রয়েছে, সেই যে ঘরে ঢুকে চুপ করে গেল—সেই যে ভাব, যদি বলে দাঁড়া, —তবে দাঁড়াবে, সে ভাব কিছুতেই যেন কাটিয়ে উঠতে পারছে না। দুঃখবাবুর শীত করতে থাকল। তিনি একটা কাঁথা জড়িয়ে বসলেন। এমন সময় প্রচণ্ড হাওয়ায় জানালায় একটা পাট খুলে গেল। আলোটা নিভে গেল। দুঃখবাবু জানালার পাশে ছুটে গেলেন। জানালাটা বন্ধ করার সময় শিলাবৃষ্টিতে ওর চোখ—মুখ ভিজে গেল। শরীরটা ভিজে গেল। অন্ধকারে তিনি কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। তক্তপোশ ধরে ধরে চলছেন। তবু আন্দাজে নেলির পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন।—চাদরটা দিবি? মুখ মুছব। চাদরটা নেওয়ার সময় তিনি নেলিকেও টেনে তুললেন।

নেলি চিৎকার করে উঠল, তু হামারে ব্যাশ্যা না বানাবি বাবু।

আবার সহসা আকাশ ভেঙে পড়ল ছাদে। দুঃখবাবু নেলির কথা শুনতে পেলেন না। নেলি এখন নিজেই পাগলের মতো দুঃখবাবুকে পেঁচিয়ে ধরেছে। দুঃখবাবুর শরীরের সঙ্গে নেলি এখন মিশে যেতে চাইছে। আর দুঃখবাবু যেন বুঝলেন, ওটা সত্যি নেলির শরীর মাত্র।

ভোরবেলায় সকলে মিলে একটা বাজপড়া মরা মানুষকে চটানে এনে তুলেছিল। সকলে দেখল সেটা গোমানির। জিয়াগঞ্জে ভোজ খেতে খেতে মেয়েটার কথা মনে পড়ে গেল। রাতেই সে মেয়েটার জন্য ছুটল। রাতের জল—ঝড় ওকে আটকাতে পারেনি। হঠাৎ বাজ পড়ে চটানে উঠে আসতে সে মরল।

গোমানিকে ঘাটে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘাটোয়ারিবাবু সামনে দাঁড়িয়ে সব কাজগুলো করলেন। কৈলাস কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে। ওকে রাত করে ছেড়ে না দিলেই হত। অনেক দিন পর চটানের সকলে বড় রকমের একটা শোক পেল। ওরা সকলেই প্রায় কেঁদেছে। জোরে জোরে। শুধু নেলি অপলক চেয়ে ছিল। ব্যাপারটাকে সে যেন বুঝতে উঠতে পারেনি অথবা বাপ মরেছে এ—কথা সে এখনও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। কেমন হতভম্ব, কেমন পাথর বনে গেছে নেলি। তবু সন্ধ্যার সময় শুয়োরের বাচ্চা দুটোকে ঘরে তুলতে ভুলল না, কবুতরের টঙ বন্ধ করতে ভুলল না। যন্ত্রের মতো কাজগুলো করল। ঘরের লম্ফটা জ্বেলে বসতেই কৈলাসের বৌ এল, হরীতকী এল, মংলি এল। ওরা সকলে ওকে ঘিরে বসল। নানারকমের কথা বলে ওকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল। নেলি কথা বলল না, শুধু চুপচাপ শুনল। দরজার দিকে চেয়ে ভাবল—বাপ আর এখানটায় বসবে না। বাপ আর গালমন্দ দেবে না। বাপের আশায় সে আর শিবমন্দিরের পথে বসে থাকবে না। এইসব ভেবে নেলির কান্না আসছে। নেলি কাঁদতে থাকল।

যত বাপের কথা মনে হচ্ছে তত নিজেকে শাপ—শাপান্ত করতে ইচ্ছে হচ্ছে নেলির। মনে হল রাতের আঁধারে দুঃখবাবুর ঘরে না গেলেই হত। এমন করে শরীরের গরমে না ভুগলেই হত। নিজের শরীরটাকে বসে বসে এখন কামড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে। বারবারই মনে হচ্ছে ডাকঠাকুর নেলির পাপের বোঝা বাপের মাথায় ফেলেছে। বাজ হয়ে ডাকঠাকুর বাপের মাথায় পড়ল। মেলিকে সমঝে দিল—ওটা ভালো কাজ লয়। অমন কাজ করতে নেই। করলে ফের ভুগতে হবে।

হরীতকী বলল, হামার ঘরে আয় তু। দুটো খাবি। সারাদিন কিছু খাসনি। এখন তুকে দুটো খানা মুখে দিতে হবে।

পিসি হামার ভালো লাগছে না।

এটা কী ভালো লাগার কথা! বকা—ঝকা করত, লেকিন এ চটানের আদমি ত ও। তার লাগি তু না খাবি, শরীর মন্দ করবি ও আচ্ছা বাত লয়। একা একা থাকবি ত মন আওর জায়দা খারাপ হোবে। হরীতকী নেলির হাত ধরে টানতে থাকল।

নেলি হরীতকীর ঘরে চলে গেল।

কৈলাস দাওয়ায় বসে তামাক টানতে টানতে গোমানির কথা ভাবল। কৈলাসের কাছে দুনিয়াটা খুব ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে। গোমানি এ—চটানে আর চিল্লাবে না ভাবতে বড় কষ্ট হয়। তবু উঠতে হবে ভাবল কৈলাস। ফরাসডাঙায় যেতে হবে। কঙ্কালটার নসিবে শেয়াল—খটাশের অত্যাচার কতটা বেড়েছে তা দেখতে হবে। সে উঠে পড়ল।

শনিয়া চুপচাপ মাচানে বসে আছে। গেরু বাঁশে হেলান দিয়ে অন্যমনস্ক হয়েছে। এ—শাদির সঙ্গে গোমানির মাথায় বাজ পড়ার কোনো অদৃশ্য হাত আছে যেন। গেরু, শনিয়া মনে মনে এমনই কিছু আন্দাজ করছে।

কৈলাস ডাকল, হে রে গেরু একবার যে ফরাসডাঙায় যানে লাগে!

গেরু বুঝল বাপ তাকেও ফরাসডাঙায় যেতে বলছে। সে উঠল। শনিয়ার দিকে চেয়ে বলল, তু অমন না ভাবিস। সে বলল, হাম ফরাসডাঙায় যাচ্ছে।

কৈলাস এবং গেরু সেইমতো হাতে বল্লম নিয়ে কাঁধে মদের ভাঁড় নিয়ে বের হয়ে পড়ল। কৈলাস সঙ্গে একটা কোদাল নিল এবং একটা গামছা নিল। কঙ্কালটা তুলে আজই লিয়ে আসতে হবে। সাবান—সোডাতে সেদ্ধ করতে হবে। দুধের মতো রঙ ধরাতে হবে কঙ্কালের গায়ে। দেরি হলে কঙ্কালের গায়ে দাগ পড়বে।

নদীর পারে নেমে শ্মশানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ফের কৈলাস, গোমানিকে মনে করতে পারল। ওর উপকারের কথা মনে হল। বহু দেশ—বিদেশ ঘুরে প্রথম যেদিন সে এ—চটানে এসেছিল থাকবার জন্য বাঁচবার জন্য তখন গোমানিই তাকে থাকবার এবং বাঁচবার সব রকমের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। গোমানি তখন বড় রকমের জোয়ান দু—দশ চটানের। গলায় মোটা কালো কারে সাদা তাবিজ। পালোয়ানের মতো দেখতে। অথচ সে চেহারা বড় বেশি জলদি নেতিয়ে পড়ল চটানে। গোমানির সেই পয়মাল চেহারা বড় জলদি ভেঙে গেল।

কৈলাস হাঁটতে থাকল।

গেরু হারিকেন হাতে আগে আগে ছুটছে, ওকে ছুটতে দেখে কৈলাস ভাবল—গেরু গোমানির মতো পয়মাল হয়ে উঠছে দিন দিন। সে ভেবে খুশি হল যে পুষে বড় করা বাচ্চাটাকে পয়মাল করে তুলতে পেরেছে। শাদি—সমন্দ হয়ে গেল; শনিয়া বিবি চটানে এল। বাচ্চাটাকে দেখাশোনা করার একটা মানুষ থাকল। অথচ গেরুকে বড় করার জন্য কৈলাসের একদিন কিনা মেহনত। একদা এই গেরুর জন্য ওকে সব কিছু করতে হয়েছে। গেরুর মা নিজে চলে গিয়ে গেরুর হিসাব ওকে দিয়ে গেল। গেরুর মা বেইমানি করেছে, কিন্তু সে করেনি।

চলতে চলতে মনে হল গেরুর মাকে সে বড় বেশি পিয়ার করত। বড় বেশি সুখ দেওয়ার চেষ্টা করত। অথচ বৌটা বুঝল না, ভালোবাসার দাম দিল না। জোয়ান মরদের লোভে পড়ে চটান ছেড়ে পালাল। গাছগাছালিও চুরি গেল। ওর অভাব বাড়ল। হেকিমি—দানরির ব্যবসা গেল, সঙ্গে সঙ্গে উপোস আরম্ভ হল চটানে। গেরুটাও টাঁও টাঁও করে কাঁদে। ঘরে ঘরে উঁকি মারে—ওর মুখে দুবেলা দুমুঠো খাবার দিতে পারছে না কৈলাস।

যখন কৈলাস গেরুর মায়ের মুখ গেরুর মুখে দেখতে পেত, তখন কষ্টটা আরও বাড়ত। সারাদিন—সারা মাস চেষ্টা করে বেঁচে থাকার কোনো এলাদ ঠিক করতে পারছে না কৈলাস। সে ভেঙে পড়েছে। একবার ইচ্ছা হয়েছিল ফের এখান থেকে বের হয়ে পড়ে। কোনো দরগায় অথবা কোনো আখড়ায় হেকিমি দানরির বিদ্যা আরম্ভ করে, অথবা পকেটমারের বিদ্যা। ইচ্ছা হয়েছিল চটানে অনেক ডোমের মতো চুরি, ডাকাতি রাহাজানি করে বাঁচতে। ইচ্ছা হয়েছিল একদিন গেরুর গলা টিপে সব চুকিয়ে দিতে। কিন্তু কিছুই করতে পারেনি। সে তখন সারাদিন সারা মাস নদীর পাড় ধরে হাঁটত এবং কোন আকাশে শকুন উড়ল দেখত। হাতে কৈলাসের লাঠি থাকত, কোমরে একটা চাকু। মরা গোরু—পাঁঠার ছাল তুলে ঘরে ফিরে গেরুর মুখে দুটো দানা দেবার ব্যবস্থা করত।

তখন গেরুটা কত ছোট, কত সরু! সে চুপচাপ বারান্দায় পড়ে থাকত। ঘাটে মরা মানুষ কখন আসবে, কখন বড়মানুষের মড়ার পিছনে খৈ—পয়সা ছিটানো হবে তার অপেক্ষায় সে বারান্দায় পড়ে থাকত। যখন ওরা আসত, গেরু বারান্দা থেকে নেমে শিবমন্দিরের পথে গিয়ে দাঁড়াত। অন্য ডোমের বাচ্চাদের সঙ্গে সে খৈগুলো মাটি থেকে খুঁটে খুঁটে তুলত। তারপর একটা একটা করে বারান্দায় বসে খেত।

গেরুর একমুঠো ভাত চাই। কৈলাস এবং গেরুর জীবনে একমুঠো ভাতের দাম চড়ে গেছে। সারাদিন—সারামাস ঘুরেও চটানের অভাবকে দূর করতে পারছে না। কৈলাস মাঝে মাঝে ক্লান্ত এবং বিষণ্ণ হয়ে যেত। সে চটানে ফিরে গেরুকে কাঁদতে দেখলে রাগে দুঃখে ওকে লাথি মারত। যেন লাথি মেরেই খুন করবে এমন একটা ভাব থাকত চোখেমুখে।

সেই সব দিনে এইসব পথ ধরে কৈলাস হাঁটত। এইসব পথে ঝোপে—জঙ্গলে ছাগল, ভেড়া, গোরু, বাছুর খুঁজে বেড়াত। অথবা আকাশ দেখত। আকাশে শকুন উড়ছে, শকুনেরা জটলা করছে—সে ছুটল। শকুনগুলো যতদূর উড়ল সে ততদূর ছুটল। সে ছুটছে আকাশ দেখছে। শকুন উড়ছে। শকুনগুলো কোনো কোনো সময় হাজার হারুন রসিদের মুখ হয়ে আকাশের নিচে ভাসত। ওকে এভাবে ছুটতে দেখে হাসত। যেন বলতে চাইত নসিবের ঘরে কারও রেহাই নেই। যেন বলতে চাইত, নসিব খুনের বদলা নিল। তারপর সে দেখত আকাশ ফুসমন্তরে যেন খালি হয়ে গেল। সেখানে হারুন রসিদের মুখ নেই, শকুন নেই, কিচ্ছু নেই। হারুন রসিদ যেন জাদুমন্তর করে এতদূর কৈলাসকে ছুটিয়ে মেরেছে। তারপর আকাশের সেইসব মুখ একসঙ্গে মেঘ হয়ে আকাশকে ঢেকে দিত। সে তখন চিৎকার করে বলত, শালা রসিদ, তুর সব সহ্য হয়, লেকিন ভণ্ডামি সহ্য হয় না। সে পথের ওপর বসে হাঁপাতে থাকত। ভাবত নসিবের ঘরে বদলা নেই।

সারাদিন ঘুরে একদিন নদীর পার থেকে চটানে ফিরছে কৈলাস। তখন বর্ষাকাল। তখন রাস্তাটা পাকা ছিল না। বাজারের মুখে একহাঁটু কাদা। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। গোরুর গাড়িগুলো গাছের নিচে পড়ে আছে। গোরুগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে। একটা গোরুকে ওর বিষ দিতে ইচ্ছা হল। সে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে সব লক্ষ্য করল। গাড়োয়ানরা সব বচসা করছে। সে গাছের নিচে থেকে বিষের পুঁটলিটা কলাপাতায় পেঁচিয়ে বড় গোরুটার সামনে ছুঁড়ে আঁধার থেকে সরে দাঁড়াল।

এমন দিন আরও সব গেছে কৈলাসের। সেদিনও সাঁজ নেমেছিল পারের বাজারে। সেও বর্ষাকাল। রাস্তাটা তখনও পাকা হয়নি। বাজারের মুখে একহাঁটু কাদা। সে মাথায় একটি মোষের চামড়া নিয়ে খেয়াঘাটের পাশে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ আগে মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে গেছে। গোরুর গাড়িগুলো বাড়িমুখো হয়েছে। গাড়ির নিচে লণ্ঠন দুলছে। প্রচণ্ডবেগে গঙ্গার খোলা জল নিচে নামছে। কৈলাস মাথায় ছাল নিয়ে পৃথক হয়ে দাঁড়াল। ছালটার টাকা মিললে তাঁর পাঁচটা ভাগ হবে। বড় সামান্য বড় সামান্য, ওর অংশ। খেয়াতে উঠে খুব আপশোশ হচ্ছে কৈলাসের।

সেদিনই ঘটনাটা ঘটল।

সে রাতেই সে বেঁচে থাকার এলাদ খুঁজে পেল।

খেয়া থেকে নেমে সে হাঁটছিল। নদীর পাড় ধরে, বাবলার ঘন বনের পাশ দিয়ে হাঁটছিল। সে তখন গন্ধ পাচ্ছে, কীসের যেন গন্ধ পাচ্ছে। দুর্গন্ধ। পচা গন্ধ। সে খুব খুশি হল। সে দেখল বর্ষার নদী ধরে আর একটা ছাগল অথবা গোরু স্রোতের সঙ্গে নিচে নামছে। স্রোতের সঙ্গে ভেসে যাচ্ছে। সে লোভ সামলাতে পারল না। আকাশের মরা আলো, নদীর ঘোলা জলের উত্তাপ ওকে টেনে নিল। সে জয় ওস্তাদ গুরু বলে লাফ দিয়ে জলে পড়ল। স্রোতের সঙ্গে সেও ভেসে চলেছে। বাবলার ঘন বনের আড়ালে মোষের চামড়াটা রেখে এসেছে কৈলাস। তারপর দুধারে গ্রাম, মাঠ কাশবন। দু—তীরে ঘন সবুজের জঙ্গল, নৌকায় ইতস্তত লণ্ঠন জ্বলছে। কৈলাস সব কাটিয়ে স্রোতের সঙ্গে ভেসে চলল। স্রোতে মরা জন্তুটা ওর সঙ্গে যেন পাল্লা দিচ্ছে।

শেষ পর্যন্ত কৈলাস অস্পষ্ট অন্ধকারে ডুব দিয়ে মরা জন্তুটার একটা পা ধরে ফেলল। সে এত ক্লান্ত, এত উন্মত্ত এবং উত্তেজিত যে ধরেই বলে উঠল—শালা কাঁহা যাওগে তুম! লোভ ওকে এমন মাতাল করে তুলেছে যে সে ওটাকে টানতে টানতে পাড়ে এনে তুলল অথচ দেখল না এত মেহনতে ওর হাতে কী ধরা পড়েছে!

জল থেকে টেনে তুলতেই কৈলাসের মাতাল ভাবটুকু থাকল না। সে ভয়ে শিউরে উঠল। ঘৃণায় মুখ কুঁচকে উঠল। ওর ওয়াক উঠতে চাইল। সে দেখল, টেনে তোলা জন্তুটা গোরু ছাগল অথবা ভেড়া নয়। একটা মানুষের শরীর ফুলে ফেঁপে ঢাক হয়েছে। সে আর স্থির থাকতে পারল না, সে ভয়ে চিৎকার করে উঠল, ওস্তাদ গুরুর দোহাই। দোহাই হারুন রসিদের। দোহাই কাছাড় দরগার। সঙ্গে সঙ্গে কৈলাস তাজা হল। সঙ্গে সঙ্গে সে সোজা হয়ে দাঁড়াল। মনে পড়ল ওর বাচ্চা বয়সের কথা। বাপ—পিতামহের কথা। বাপকে দেখেছে, পিতামহকে দেখেছে। এমন কত কঙ্কাল কুড়িয়ে এনেছে মানুষের। চুপি চুপি কলকাতায় যে—সব কঙ্কাল বিক্রি করেছে। বড় হয়ে সে শুনেছিল হিল্টন কোম্পানির কথা। জগুবাজারে সে কোম্পানির অফিস আছে। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল এতদিনে বেঁচে থাকার এলাদ সে পেয়েছে। গেরু আর উপোস করবে না। ওকে আর শকুন দেখে বেড়াতে হবে না। এবার সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে। ফের একটা শাদি ধরতে পারবে। ফের চটানে বুক ফুলিয়ে চলতে পারবে।

তারপর যখন সে মড়াটাকে বাবলার ঘন জঙ্গলে কাদার ভিতর পুঁতে দিচ্ছিল তখন ভাবল, নসিবের ঘরে বদলা নেই। ওকে ফের বাপ—পিতামহের ব্যবসাতেই নেমে যেতে হল।

সে প্রায় দেড় যুগ। হিসাব করলে যেন আরও বেশি হবে। সেই গেরু এখন সময়ের পথ হেঁটে এসে জোয়ান হয়েছে। সেই গেরু এখন ইংরেজ কুঠির পথ ধরেছে। হাতে লণ্ঠন। কাঁধে বল্লম। জোয়ান গেরু ছুটে ছুটে চলেছে। কৈলাস গেরুর নাগাল পাচ্ছে না। পথ থেকে নিচে নেমে ডহর পার হবার সময় কৈলাস ডাকল, গেরু হামার বাপরে পথ দেখে হাঁট। হারিকেনের আলো ঠিকসে পথে ফ্যাল।

গেরু থামল। হাতে হ্যারিকেন এবং মদের ভাঁড় নিয়ে সে বাপের জন্য অপেক্ষা করল।

শীতের ভিতরও কৈলাসের শরীরটা ভিজে উঠেছে যেন। সে থেমে গেছে যেন। গেরু কাছে এসে একটু দম নিয়ে দাঁড়াল।

গেরু বলল, তু আজ না এলে পারতি বাপ। তু চলতে লারছিস।

চলতে লারছি! কৈলাস ধমকে উঠল—কোন বলিছে চলতে লারছি!

হামি গেরু এ—কথা বলিছে বাপ। তু চলতে লারছিস। ফরাসডাঙায় পথে আসতে তু তিন দফে হাঁফ ছাড়লি।

তিন দফে হাঁফ ছেড়েছি ত বেশ করেছি। বলে, গেরুর হাতের হারিকেনটা জোর করেই টেনে নিল। তারপর এক ধমক, দ্রুত হেঁটে গেরুর মুখে হারিকেন উঁচিয়ে বলল, কোন বলিছে হাম হাঁটতে লারছি? তু দেখেলে! তু নিজের আঁখোসে দেখে লিলি ত! গেরু হামার বাপরে, শালা হামার পুতরে, হামি সব পারি। হামি লড়তে পারি, হামি বসতে পারি। হামি সব পারি।

ওরা পোড়ো বাড়িটা পার হয়ে কাঁঠাল গাছটার নিচে এসে দাঁড়াল। রাতের আঁধারে ঝিঁঝিরা তেমনি ডাকছে। তেমনি জোনাকি উড়ছে। জোনাকি জ্বলছে। রাতের আঁধারে তেমনি চাপা কান্নার আওয়াজ। ঘাসের ভিতর ছোট ছোট পোকা—মাকড়েরা তেমনি হামাগুড়ি খাচ্ছে।

মদের হাঁড়িটা কবরের পাশে রাখল গেরু। আজ সে ঝোপ—জঙ্গলের বীভৎসতাকে দেখল না, অথবা লক্ষ্য করল না। প্রতিদিনের মতো ওরা মদ খেল। এবং উঠে দাঁড়াল। কোদাল মেরে চাপ চাপ মাটি সরাচ্ছে গেরু। দু—হাতে কৈলাস মাটি সাফ করছে।

অনেকক্ষণ কোদাল মেরে যখন গেরু ক্লান্ত, যখন কপালের ঘাম মুছে বলল, তু দু—চারঠো কোপ দে ত বাপ, তখন কৈলাস কোদাল টেনে বলল, হয়রান হয়ে পড়লি জোয়ান! তু মরদ হামারে বলিছে হাম হাঁটতে লারি!

বাপ বেশ কায়দার সঙ্গে ছোট ছোট কোপ মারছে কবরে। অবসর বুঝে গেরু সরে গেছে কাঁঠাল গাছটার নিচে। অবসর বুঝে কিছুটা মদ টেনে নিল। সে ঝিমোচ্ছে। সে দেখছে—বাপ বেশ কায়দার সঙ্গে মাটি সরাচ্ছে। ওর নেশা পাচ্ছে দেখে সে যেন না বলে পারল না তুর ভালোর জন্যই হামি এ কথা বলিছে। বুড়া হলি। চটানে থাকলে তুর দেহের ভি ভালো, মনের ভি ভালো। হামার ত আঁধার রাতে ভর থাকার কথা লয়! তু তিন তিনটে কবচ পড়ে দেহে হামার বেঁধে দিলি—ভূত পেত, পির, পরি সাপখোপ, বাদী দুশমন কেউ হামার অনিষ্ট করতে লারছে। আঁধার রেতে হামার ডর থাকার কথা লয়। ভূত বলিছে হামি রাজারে!

কৈলাসের মনে তখন ভীষণ দ্বন্দ্ব চলছে। কবরের নিচে থেকে কঙ্কাল টেনে তোলার সময় সে যেন বুঝতে পারছে তিনটি কবচই বেইমান, ইবলিশ। তবু সে সব ভুলে গিয়ে বলল, হে তু রাজার বেটা রাজা। একহাতে হারিকেন লিয়ে গর্তের নিচে বসল গেরু। মাটির ভিতর থেকে খুঁজে খুঁজে হাতের হাড় আঙুলের হাড়—হিসাব করে গোটা কঙ্কালটাই তুলল। তারপর সে উপরে উঠে ফের বসে গেল। গামছাটা সে বিছিয়ে দিল। হাড়গুলো বিছিয়ে দিল। ওস্তাদ কৈলাস এখন হাড়গুলো গামছার ওপর একটা গোটা মানুষের মতো করে সাজাচ্ছে। দুহাতের পাঁচটা পাঁচটা দশটা আঙুল সাজাল। গোড়ালি থেকে মাথা পর্যন্ত সাজিয়ে দেখল ঠিক আছে। গুণে গুণে সব হাড় গেরু তুলতে পেরেছে।

কৈলাস বলল, দাঁতগুলো কাঁহারে?

হামার হাতে আছে বাপ।

দে—ত, গুণে দেখি ঠিক আছে কিনা।

কৈলাস দাঁতগুলো গুণল। এক দুই করে বত্রিশটা দাঁত। দুর্গন্ধে কৈলাসের মুখটা কুঁচকে উঠেছে। মাঝে মাঝে থুথু ছিটাল। পোড়ো বাড়িটাকে ব্যঙ্গ করল। এবং গোটা কঙ্কালটা মাটির ওপর বিছিয়ে দিয়ে যখন দেখল কবরের নিচে কিছু পড়ে নেই, তখন কৈলাস ব্যস্ত হয়ে খুলিটাকে পরখ করল। চোয়ালের হাড়টা দেখল এবং আলগা দাঁতগুলো গুণে হিসাব করে বুঝল—সাবাস বেটা গেরু, খুঁজে খুঁজে মেয়েমানুষটার সব কটি দাঁত সংগ্রহ করেছে।

সামনে দুটো দাঁত কষ্টিপাথরের মতো কালো। পান—দোক্তার জন্য দাঁতগুলোতে কালো রঙ ধরেছে। গেরুর মা—র কথা মনে আসছে। পান—দোক্তা খেত বৌটা। মুকের একটা দিক সব সময়ের জন্য ফুলে থাকত। ঘাসের নিচে থেকে কিছু বালি নিয়ে কৈলাস সামনের একটা দাঁত ঘষল। বালিতে ঘষে পরিষ্কার করল। পান—দোক্তার পাথর পড়া দাঁতগুলো সাফ হল না, অথচ একটি দাঁত বালির ঘষা খেতে খেতে তামার রঙ ধরল। কৈলাস দাঁতটাকে হাতের সমস্ত জোর দিয়ে পরিষ্কার করল। দেখল তামার বাঁধানো একটা দাঁত। দাঁতটা দেখে ওর শরীর হাত পা সব কাঁপছে। খুঁজলে যেন সে আরও একটা তামার বাঁধানো দাঁত পাবে। সে ভয়ে দাঁতটা খুঁজল না। শুধু গেরুর মার বাঁধানো দাঁত দুটোর কথা ভাবতে গিয়ে কঙ্কালটাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা হল। কঙ্কালটার বুকের ওপর লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে ইচ্ছা হল। সহসা সে প্রায় ডুকরে উঠেছিল—গেরুর মা তু ভাগ গিলিরে!

কৈলাস তবু গোপনে কাঁদছে। পাশের গেরু পর্যন্ত টের পায়নি—কৈলাস কাঁদছে। কৈলাস হাড়গুলোকে খুব ধীরে ধীরে নাড়াচাড়া করল। খুব ধীরে ধীরে বুকের পাঁজরগুলো চোখের সামনে এনে দেখল। তারপর কোনোরকমে কঙ্কালটা গামছায় বেঁধে পথ চলতে থাকল। গেরু খুব অবাক হয়ে বাপকে অনুসরণ করছে। বাপ যেন ঝোপ—জঙ্গলের ভিতর দিয়ে অন্ধের মতো ছুটে চলছে। বাপের সঙ্গে সে ছুটে নিজেকে সামলাতে পারছে না।

কিছুদূর এসে কৈলাস মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। পিছনে ঢিবি, নিচে জ্বলো, ঘাস ওবোৎল্যাংড়ায় জঙ্গল ধারে ধারে। ঘন জঙ্গল দুপাশে। জঙ্গলের ভিতর কৈলাসের শরীরটা পড়ে রয়েছে। পড়ে থেকে বিলাপ করছে—হামি গেলামরে, হামারে খেয়ে লিলরে।

গেরু আলো উপরে তুলেও বাপকে দেখতে পাচ্ছে না। দূরে শুধু চিৎকার শুনছে—গিলামরে, খেয়ে লিলরে। আলোতে ওর নিজের ছায়াটা নড়ছে। পোড়ো বাড়িটাতে কারা যেন কথা বলতে শুরু করেছে, কারা যেন সব দরজা জানালাগুলো খুলছে, বন্ধ করছে। ঘাসের ভিতর থেকে গন্ধ উঠছে। গেরু আলোটা নিয়ে আশেপাশের জঙ্গলে খুঁজতে থাকল বাপকে। ঢিবির নিচে নামল গেরু। বাপকে দেখতে পেয়ে বলল, উবুড় হয়ে পড়ে আছিস ক্যানে। কী হয়েছে তুর।

গেরুর উপস্থিতিটা কৈলাসের এ—সময় ভালো লাগল না। মনে হল বেইমানটা সব গোলমাল করে দেবে! এতদিনের গড়ে তোলা সমস্ত বিশ্বাসকে এক মুহূর্তে ভেঙে দেবে। সেজন্য কৈলাস উঠে দাঁড়াল। জামা—কাপড় ঝাড়ল এবং নিজেকে সামলে পায়ের যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করতে চাইল। গেরুর হাত ধরে বললে, জলদি চটানে নিয়ে চল। হামি হাঁটতে লারছি। বুক হামার শুকিয়ে উঠছে!

বাপকে ধরে তোলার সময় গেরু দেখল, বাপের পা থেকে কালো রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। ঝোপের ভিতর থেকে কিসে যেন বাপকে কামড়েছে।

সে চিৎকার করে উঠল—বাপ।

তু জলদি চল! বাপ বাপ বলে চিৎকার হাকরালস না।

তুকে বাপ মা মনসার বাহন ছোবল দিছে। তু বস পাটা জলদি বেঁইধে দি।

কৈলাস খেঁকিয়ে উঠল, চুপ কর তু শালা শুয়োরের ছা, লটকনের বাচ্চা। মা মনসার বাহন কামড় দিছে! বুললি আর অমনি হয়ে গেল! সাহস কিরে লটকনের ছা, কাণি হামারে ছোবল মারবে! হাতে লাগেশ্বর কবচ তুর মুখ দেখার লাগি। শেষে কৈলাস পাগলের মতো হাসল। এবং এ—সময় ওর মুখ দেখলে দুনিয়ার সব মানুষের দয়া হত। নসিবের ঘরে বদলা নেই, বদলা নেই—এ—ভাবটুকু শুধু মুখে। সে চলতে চলতে বলল, ও কিছু লয় ও কিছু লয়। হুঁ চট খেয়ে পাটা ছিঁড়ে গেল। তু আর বাপ, হামারে একটু ধরে চল।

চাটনে ফিরে কোনোরকমে দুটো চোখ টেনে বলল কৈলাস, বারান্দায় শুইয়ে দে বাপ! দোহাই তুর ওস্তাদের কাউকে ডেকে লিস না। বেশ আছি। আচ্ছাই তবিয়ত আছে। তু থোড়া পানি হামার শিয়রে রেখে যা বাপ। দোহাই তোর ওস্তাদের কাউকে ডেকে লিস না।

চালাঘরের বারান্দায় বাপকে শুইয়ে দিয়ে ভিতরে ঢুকল গেরু। ঘরটা অন্ধকার। সে পকেট থেকে দেশলাই তুলে লম্ফ জ্বালল। হাতের পুঁটলিটা নিচে ঠেলে দিল। মাচানের ওপর শনিয়া শুয়ে আছে। অঘোরে ঘুমুচ্ছে। কিন্তু এ—শরীর নিয়ে বৌর কাছে যেতে সংকোচ হল। অথবা মনে সংশয়ের জন্ম হচ্ছে। সে বাইরে বের হয়ে হাত—পা ধুলো ভালো করে। চারপাশে আঁধার। অফিসঘরের বারান্দায় ও—পাশে কারা যেন নেমে যাচ্ছে। শুধু দুখিয়ার ঘরে লম্ফ জ্বলছে। অন্য চালাঘরগুলোতে কোনো লম্ফ জ্বলছে না। নেলির ঘর থেকে গঙ্গা—যমুনা চটানে বের হয়ে এল। ওরা শুয়োরের খাটাল পার হয়ে আঁধারে নেমে গেল।

ঘাটে দুটো চিতা জ্বলছে। কিছু মানুষ দুটো মানুষকে পোড়াচ্ছে। বাতাসের সঙ্গে পোড়া গন্ধ উঠে আসছে। বুক ভরে গন্ধটা নিতে খুব ভালো লাগল। কঙ্কালের গন্ধের চেয়ে ওর এ গন্ধটা ভালো লাগছে।

উঠোনে দাঁড়িয়ে ভাবল গেরু, দুখিয়াকে ডেকে বাপের কালো রক্তের কথা বললে হয়। সে দু—কদম দুখিয়ার ঘরের দিকে পা বাড়াল। ডানদিকের বেড়াটা ঘেঁষে সে দুখিয়ার ঘরে ঢুকল। মদ খেয়ে ওরা দুজনে সন্ধ্যায় উন্মত্ত হয়েছিল, রাতে ঘরে আলো জ্বেলে সুখ সুখ খেলা খেলেছিল। তারপর কখন আলো না নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সে ঘরে ঢুকে দেখল ওরা উলঙ্গ হয়ে শুয়ে আছে। খাটের কাঁথাকাপড়ের ওপর ওরা দুজন মা—বসুন্ধরার মতোই শান্ত। হাঁড়ির মতো দুটো পেট মদে ঢাক। এইসব দেখে গেরুর যন্ত্রণা বাড়ছে। সে উত্তেজিত হয়ে পড়ছে। সে মুখ বাড়াল। সে উঁকি দিল। মংলির শরীরে মা—বসুন্ধরাকে দেখতে পাচ্ছে। সে যেন চিনতে পারছে এরা ভূমি। বীজ দুখিয়া। ভূমি মংলি। মংলির আবাদের ক্ষেত্রটি দুখিয়ার বীজে ভেসে আছে।

দুখিয়াকে ডাকতে পারল না গেরু। শরীরে ওর ভয়ানক উত্তেজনা। চোখ দুটোতে ভয়ানক জ্বালা। শরীরের যন্ত্রণা কমছে না। উঠোনের ওপর নেমে এসেও ওর শরীর ঠান্ডা হচ্ছে না। সে তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে ঢুকে গেল। তাড়াতাড়ি মাচানে শুয়ে শনিয়াকে জাগাল।

তারপর আবার রাত কাটানোর পালা। চটানে সকলে ঘুমিয়ে পড়েছে। চিতার আগুনে আকাশ আর লাল হচ্ছে না। বোধ হয় এতক্ষণে মানুষ দুটোর পোড়া শেষ হয়ে গেছে। শনিয়া, গেরু অনেকক্ষণ ধরে ফিসফিস করে কথা বলল। এবং এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়ল। অথচ ঘুম ভাঙতে দেরি হল না। মাচানের নিচে কীসের যেন শব্দ। কারা যেন মাচানের নিচে নাচছে। অথবা গোটা কঙ্কালটা প্রাণ পেয়েছে যেন। মাচানের নিচে কঙ্কালটা নাচছে। অথবা কঙ্কালটা হেঁটে বেড়াচ্ছে মাচানের নিচে। সে মাথা তুলে সব শুনল। সে ডাকল—বাপ! বাপ! কিন্তু বারান্দা থেকে কোনো জবাব এল না। সে ভয়ে ভয়ে ফের ডাকল বাপ! বাপ দ্যাখ কঙ্কালটা মাচানের নিচে নেচেকুঁদে লিচ্ছে। তবু বারান্দায় কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। বাপের কথা মনে হল। তাবিজের কথা মনে হল সঙ্গে সঙ্গে ভয়টা কেটে গেল। তখন লম্ফটা জ্বালল এবং সে আলোতে দেখতে পেল ঘাটের একটি অভুক্ত কুকুর কঙ্কালের রস চুষে খাচ্ছে।

শালে তু। গেরু লাফ দিয়ে কোণ থেকে সড়কিটা টেনে নিতেই কুকুটা ভয়ে ছুটে পালাল। গেরু কুকুরটাকে তাড়াবার জন্য উঠোন পর্যন্ত নামল এবং বারান্দায় বাপকে কিছু বলতে গিয়ে দেখল বাপের শরীরটা শক্ত হয়ে আছে।

কৈলাস ডোম মারা গেছে।

একদিন গেল, দুদিন গেল। একমাস, দু—মাস গেল। চটানে গোমানি নেই, কৈলাস নেই। তেমন নাচন—কোঁদন নেই, হৈ—হল্লা নেই। শীত কমে গেছে। শিমুল গাছে ফুল থেকে ফল ধরেছে। ফল কেটে এখন তুলা উড়ছে শ্মশানে, চটানে। হাওয়া উঠছে দুপুরের দিকে। ঝাড়ো ডোম ওর ঘরটার ওপর বেশি কাঁথা—কাপড় চাপাচ্ছে। দুখিয়া একটা মাটির ঘর তুলছে।

গেরু এখন ফরাসডাঙায় মাঝে মাঝে যায়। শনিয়া সেজেগুজে রাতে শুয়ে থাকে। সে—দিন ওরা সিনেমায় গিয়েছিল, শনিয়া প্রায়ই গুনগুন করে হিন্দি গান গায়। শনিয়া নেলিকে গানটা একদিন শুনিয়েছে। এতদিন শনিয়ার ওপর যে রাগ ছিল গান শোনানোর পর থেকে সে রাগ আর থাকল না। রাগটা কেমন করে যেন জল হয়ে গেল। এবং সেদিন থেকেই শনিয়ার সঙ্গে দু—চারটা সুখ—দুঃখের কথা বলে নেলি সুখ পাচ্ছে।

আর সেইদিনই নেলির একবার বমি করার প্রবৃত্তি হল। সেদিনই শরীরটা ভারী মনে হল। মনে হল মা—বসুন্ধরা কেমন মাতাল হয়েছেন। মনে হল রাতে কিছু খেলে আবার বমি হবে। কিছু খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। শুধু শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে। সমস্ত মুখে কেমন বিশ্রী থুতু উঠছে কেবল। সে একবার উঠে থুতু ফেলল, দু—বার ফেলল, তিনবার ফেলল—শেষে পারল না। মাচানে শুয়ে শুয়েই থুতু ছিটাতে থাকল। ঘরে আলো জ্বালল না নেলি। আঁধারের ভিতর চুপচাপ শুয়ে রইল। এবং এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল।

ভোরবেলায় ঘুম থেকে ওঠার সময় যে চোখে—মুখে অন্ধকার দেখল। মনে হল পিসির কথা। ঝাড়োর বৌর কথা মনে হল। ওরা চটানে বাচ্চা দেবার আগে যে সব উপসর্গে কাতর হত নেলিও সেই রকম উপসর্গে কাতর হয়ে পড়ছে। নেলি তাড়াতাড়ি মাচানে শুয়ে পড়ল। মনে হল তেষ্টা পেয়েছে খুব। সে ডাকল—শনিয়া শনিয়ারে থোড়া পানি দে। থোড়া পানি দে শনিয়া।

তখন দুঃখবাবু উঠে গেল অফিসারের বারান্দায়। নেলি বেড়ার ফাঁক দিয়ে দুঃখবাবুকে দেখল। সে হাসল। দুঃখবাবুর চোখে—মুখে এখনও লজ্জা। এখনও সংশয়, সংকোচ। দুঃখবাবুর চোখেমুখে সংশয় দেখলে নেলির খুব ভালো লাগে। ওর ইচ্ছা হল ফের সে দুঃখবাবুর পায়ের কাছে গিয়ে বসে। দুঃখবাবুকে ভালোবাসে। বাবুর সব কাজগুলো করে দেয়। দুঃখবাবুর শরীরটা ওর নিজের শরীরে এসে বাসা বেঁধেছে। এই সুখানুভূতিতে নেলি লজ্জায় এবং আনন্দে মুখ গুঁজে দিল। বাপ আবার ফিরে আসছে চটানে, বাপ আবার ওকে আশ্রয় দেবে। বাপ নাচবে—কুঁদবে। নেলি এই সব ভেবে ফের ডাকল, শনিয়া, শনিয়ারে থোড়া পানি দে। থোড়া পানি দে শনিয়া।

শনিয়া ঘরে এসে জল দিল নেলিকে। বলল, আভি তক শুয়ে থাকলি মাচানে। উঠবিনে? তবিয়ত বুঝি আচ্ছা না আছে?

নেলি শুয়ে থেকেই জবাব দিল, আচ্ছা না আছে।

কিছু খাবি—দাবি? রুটি করে লিচ্ছি।

নেলি বলল, দুটো আম দিয়ে অম্বল করে লিবি?

লিব। লেকিন তুর তবিয়ত আচ্ছা না আছে। খাটা খানেসে ভোগান্তি হোবে।

কিছু হোবে না। তু দে লিবি, হামি খেয়ে লিব। হামার কিচ্ছু হোবে না।

শনিয়া চলে যেতে চাইলে নেলির বলতে ইচ্ছা হল, তুকে একটা বাত বুলবে, লেকিন কাউকে বুলবি না। শনিয়া ততক্ষণে চলে গেছে। সুতরাং নেলির বলা হল না। নেলি পাশ ফিরে শুল।

নেলির সুঠাম শক্ত শরীরটা দু—একদিনের মধ্যেই কেমন ভেঙে যেতে লাগল। চটানে সকলেই ধরে ফেলেছে। শনিয়া চুপি চুপি বলেছে গেরুকে। হরীতকী এসে নেলির ঘরে বসে বলেছে—এ আচ্ছা কাজ হল না নেলি। তু ভি হামার মতো হলি। জ্বলে পুড়ে থাক হবি। যেন বলতে চাইল হরীতকী, তুকে নতুন বাবু থোড়াই কেয়ার করবে।

নেলি কোনো কথারই জবাব দিচ্ছিল না। সে চুপচাপ মাচানে পড়ে পাশের একটা মালসাতে থুতু ফেলছে। চোখ দুটো জ্বলছে। যেন বলতে চায়, ডাইনি মাগির আবার ভালো মন্দ। একটা বাচ্চা হবে তার আবার নতুন বাবু, পুরানা বাবু! তার আবার গেরু, টুনুয়া। গেরুর বিবি শনিয়া না হয়ে নেলি হতে পারত, চটানের যে—কোনো মেয়ে হতে পারত। এসব ভেবেও নেলি জবাব দিল না। এইসব ভেবে ভেবেই যেন চোখ দুটো ওর নিচে বসে যাচ্ছে। কেমন করুণ দেখাচ্ছে। গিরিশ কিছু বলছে না গেরু বলছে না কিছু। মংলি ঘরে ঘরে ঢিঢি দিয়ে বেড়াচ্ছে। গোমানি মরল—তার মেয়েটাও মরদ ধরল। এমন সব কথা বলে মংলি সুখ বাড়াচ্ছে, মনের ঝাল ঝাড়ছে নেলি মাচানে শুয়ে সব শুনেও কোনো জবাব দিত না। অথবা জবাব দেওয়ার ইচ্ছা থাকত না।

নেলির এ বমি—বমি ভাবটা কিন্তু বেশিদিন থাকল না। থুতু ফেলাটাও কখন কমে গেল। তখন বৈশাখ—জ্যৈষ্ঠ মাস। গরমে ঘর—বার হওয়া দায়। নেলি এমন দিনেই আবার ঘর—বার হতে থাকল। ফলন্ত শরীর নিয়ে নেলি ঝাড়ো ডোমের সঙ্গে ব্যবসা আরম্ভ করল। ঝাড়োর কাছ থেকে ডালাকুলো নিয়ে সে চটান থেকে বের হয়ে যেত। দুপুর রোদে গাওয়াল করে বেড়াত। গেরস্ত বাড়ি ঢুকে বলত, মা মাসিরা আছেন লাকি! ডালাকুলো লেন।

গেরস্ত বৌরা বলত, তোর ডালা—কুলোর দাম বড় বেশি নেলি।

তা যে হবেই মা মাসি। হামার যে আর কেউ লেইগ মা মাসি। থাকলে কমে দিতে পারতাম। এ পয়সায় হামি খাব, কিছু সঞ্চয় করে লিব। হামার ফলন্ত শরীরটা আর কদিন একা থাকবে মা মাসি।

এ সব শুনে গেরস্ত বৌদের দয়া হত যেন। করুণা হত। এমন নাক চোখ মেয়েটার। এমন শরীর মেয়েটার। কেউ বলে নেই ওর! ওরা সেজন্য চাল দিত, ধান দিত বেশি। পয়সা দিত। নেলি সব মাথায় করে চটানে ফিরত, ঝাড়োর সঙ্গে হিসাব করতে বসত। ঝাড়োর পাওনা মিটিয়ে সে ঘরে ফিরত। ঘরে ফিরতে রাত হত কোনোদিন। দূর গাঁয়ে গাওয়াল করতে গেলেই এমন হত। পেটের বাচ্চাটার জন্য নেলি গঙ্গা—যমুনাকে নিয়ে গাওয়াল করতে করতে কতদিন কোথায় চলে গেছে! কতদিন সূর্য মাথার উপরে উঠে কখন হেলতে আরম্ভ করেছে, কখন বিকেল হয়েছে খেয়াল থাকত না নেলির, সে হাঁটত। হাঁটত। সে ঘরে ঘরে গাওয়াল করত ফলন্ত শরীরের জন্য মায়া হত। বাচ্চাটার জন্য মায়া হত। গঙ্গা—যমুনা পাশে পাশে থাকত। পাশে পাশে হাঁটত। চাল, ধান, পয়সা কত হল, দু—চার বাড়ি গাওয়াল করে নিতে পারলে, দু—চারটা গ্রাম ঘুরতে পারলে আর কত হতে পারে—সেই হিসাব শুধু মনে। বাপ ফের ওর ঘরে ফিরে আসছে, বাপ আবার ওকে শাসন করতে আসছে—এই ভাবনায় সে শুধু পথ চলত। মাঝে মাঝে গঙ্গা—যমুনাকে বলত, তুগো একটা ভাই হবে। হামার মতোই কিন্তুক ওয়াকে ভালোবেসে লিবি, হামি তো একা একা তুদের জন্য কুথা চলে যাব, তখন তুরা উয়াকে পাহারা দিবি।

প্রতিদিনের মতো আজও চটানে সূর্য উঠছে। প্রতিদিনের মতো আজও চটান থেকে নামছে নেলি। সঙ্গে গঙ্গা—যমুনা। নেলির মাথায় ডালা, কুলো, ঝুড়ি। দিন রাত বসে ঝাড়ো আর ওর বৌ—ছেলেরা এসব তৈরি করেছে। নেলি ওদের থেকে কিনে নিচ্ছে। দূর গাঁয়ে ডালা—কুলো সব বিক্রি করছে। সে এখন নদী পার হবে। গ্রীষ্মের নদী শুকনো। মরা নদী। কোথাও কোথাও জল জমে আছে। কোথাও কোথাও বালি চিকচিক করছে। জল আয়নার মতো। নেলি নদীর জল ভেঙে পার হওয়ার আগে দু—আঁজলা জল খেল। বলল, মায়ী গঙ্গা তুর দুধ খেয়ে লিলাম।

নেলি নদী পার হয়ে তিলতলা, গোয়ালজান, রসরাজপুর, হলদিচক, পদ্মনাভপুর হয়ে কান্দি, বাসন্তী বলরামপুরে ঘুরে যখন কোনো বাড়ির ভিতর ঢুকে দুটো কথা বলে বিশ্রাম করত, তখন কেউ প্রশ্ন করত—মুখটা ত শুকিয়ে গেছে রে। কিছু খেয়ে বুঝি বের হসনি।

কি যে বুলেন মা! না খেয়ে ফলন্ত শরীর নিয়ে বের হতে আছে। মায়ীর দুধ খেয়ে লিছি, সারা দিনমানে ভুখ আর না লাগবে মা মাসি। তবু যদি ওরা পীড়াপীড়ি করত নেলি তখন দুটো খেয়ে বলত মা ঠাকরুণ, বড় দয়া আপনাগ। হামার গঙ্গা—যমুনাকে দুটো দিলাম—কিছু মনে করে লিবেন না।

সকলে কুকুর দুটোকে তখন দেখত। কুকুর দুটোকে দেখে ওরা ভয় পেত। কুকুর দুটোর দিকে চেয়ে ওরা বলত, এ দুটোকে সামলে চলিস বাপু। কুকুর পুষিসনি তো যম পুষেছিস। কখন কার সর্বনাশ করবে—তখন বুঝবি ঠেলা।

মা—মাসিরা অমন কথা বুলবেন না। ওরা হামার বেটা আছে। ওরা হামার সাত জনমের মেহমান। নেলি কুকুর দুটোকে ধরে চুকচুক করত। ওর আদর করার ঢং দেখে গেরস্ত বৌরা হাসত।

সেদিনও নদী পার হয়ে চটানে ফিরতে রাত হয়ে গেল। অন্ধকার পথ—কিছু দেখা যায় না। কুকুর দুটো ওকে পথ দেখিয়ে চলেছে। নেলি হাঁটছে পা চালিয়ে। মাথায় চালধানের বোঝা। শরীর ভারী বলে পা চালাতে পারছে না। বালিয়াড়ি অতিক্রম করতে খুব কষ্ট হচ্ছে। নদীর পারে ওঠার সময় সে খুব হাঁপিয়ে পড়ল। এখানে একটু বসল নেলি। সারাটা দিন স্যাঁকা রুটির মতো গরমে সে পুড়েছে। নদীর ঠান্ডা হাওয়ায় বসে থাকতে ওর খুব ভালো লাগল। এখানে বসে চটানের আলো দেখতে পেল সে। দুঃখবাবু হয়তো এতক্ষণে ঘরে ফিরে গেছেন। শনিয়া, গেরু হয়তো মাচানে ঘুমিয়ে পড়েছে। শ্মশানে আগুন জ্বলছে না। এখানে বসে বাবলার ঘন বনে কুকুর দুটোর আওয়াজ পেল। ওরা বুঝি শেয়াল তাড়াচ্ছে ভেতরে। নেলি কী ভেবে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ল। যেন শরীরটাকে ঘাসের ওপর বিছিয়ে দিয়ে একটু ঠান্ডা হতে দিল। শুয়ে শুয়ে নেলি এক, দুই করে তারা গুণল। এক, দুই করে ঘণ্টা পেটার আওয়াজ শুনল। এক, দুই করে এতদিনের সঞ্চয়ের কড়ি হিসাব করল।—বাপ, বাপরে। পেটের নিচে হাত বুলিয়ে যেন বলতে চাইল, তু আচ্ছা আছে ত বাপ! নেলি আরও নিচে হাত নামিয়ে বাচ্চাটাকে আদর করবার সময় লক্ষ্য করল, কে যেন সন্তর্পণে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

নেলি ভয় পাওয়ার মতন করে বলল, কৌন? কৌন ওখানটায়? সে ডেকে উঠল, গঙ্গা! যমুনা!

দুঃখবাবু বললেন, আমি নেলি, তোর দুঃখবাবু!

বাবু! হামার খুব ভয়ে ধরেছিল বাবু।

খুব গরম পড়েছে। শরীরে ঠান্ডা হাওয়া লাগাচ্ছিস।

আজ রাতে তু বাবু ঘাটে থাকবি বুঝি?

ঘাটোয়ারিবাবুর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না বলে আজ রাতে থেকে গেলাম।

তবে বস না এখানে। বেশ ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। তবুও শরীরটা ঠান্ডা হবে। হামার ভি শরীর ঠান্ডা হবে।

আকাশে তেমনি নক্ষত্র জ্বলছে। দুটো পাশাপাশি নক্ষত্রের মতো ওরা দুজনে পাশাপাশি বসে থাকল। দুঃখবাবু বললেন, তোর শরীর ভালো যাচ্ছে ত?

নেলি ভাবল, এতদিনে বাবু সময় পেল জানার শরীর ভালো যাচ্ছে কী মন্দ যাচ্ছে। নেলি হাসল। সে এতদিন দেখে এসেছে—বাবু রোজ ঘাটে এসেছেন, রোজ ঘাটোয়ারিবাবুর সাথে বসে গল্প করছেন। অথচ চটানে নেমে একবারও বলেননি নেলি ঘরে আছিস নাকি? তোর শরীর শুনছি ভালো যাচ্ছে না। বাবু রোজ আসতেন ভয়ে ভয়ে, রোজ বের হয়ে যেতেন ভয়ে ভয়ে, অথচ একদিনও ডেকে বললেন না, আমি এসেছি। অথবা বললেন না, সব জানি। এই সব দেখে অনেকদিন নেলির বলতে ইচ্ছে হয়েছে, বাবু হামি কাউকে বুলবে না তু হামার বাচ্চার বাপ আচ্ছিস। বুলবে না তু একরাতের মরদ হয়েছিলি হামার।

দুঃখবাবু নেলির খুব ঘনিষ্ঠ হলেন। প্রকৃতই দুঃখবাবু এঘটনায় খুব অনুতপ্ত হয়েছেন। চটানে যত দেখেছেন নেলিকে, তত বেশি তিনি অনুশোচনায় দগ্ধ হয়েছেন। তত তিনি ভেবেছেন বাপ—মা মরা মেয়েটার প্রতি তিনি এমন লোভী না হলেই পারতেন। যত তিনি এই সব ঘটনা নিয়ে ভেবেছেন, তত তিনি মেয়েটার ভালো—মন্দের জন্য নিজেকে দায়ী করেছেন। দায়ী করতে গিয়ে এক সময় দেখলেন ভালোও বেসে ফেলেছেন। দুঃখবাবু বললেন, আমার খুব ইচ্ছা তোকে কিছু একটা করেদি। কিন্তু কিছুই পেরে উঠছি না রে। কথাটা চটানে কতদিন বলব ভাবলাম, কিন্তু হয়ে উঠল না। তোদের অন্য মরদেরা যদি কিছু ভাবে। এই যখন মাচানে পড়ে থাকতিস, তখনও বারবার ইচ্ছে হয়েছে তোর কাছে যেতে, একটু বসতে, একটু ভালোবাসতে—কিন্তু পারিনি।

এই সব কথা শুনে নেলি খুব খুশি হল। মা—বসুন্ধরা এখনও তবে ওর জন্যে একটি মরদ রেখেছে যে নেলিকে ভালোবাসে, যে নেলিকে পিয়ার করে। এই সব কথা শুনে নেলির পুরনো ভালোবাসাটা ফের মাথা চাড়া দিয়ে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে পুরনো ইচ্ছাটাও। নেলি দুঃখবাবুর মুখের সামনে মুখ নিয়ে বলল, বাবু তু হামারে পিয়ার করিস? এ বাত সাচ বাত বাবু?

সাচ বাত নেলি। তোকে আমি পিয়ার করি। তোকে আমি ভালোবাসি। আঁধার রাতে নতুনবাবু ভালোবাসার জন্য মাতাল হয়ে উঠলেন।

আমি তুকে ভালোবাসি বাবু।

নেলি!

হা বাবু।

তোকে আমি কিছু দিতে পারছি না। ঘরে বৌ আছে, ছেলেপুলে আছে। ওদের পুষিয়ে আর কিছু বাঁচে না। তোকে কিছু দিতে পারি না।

সেজন্য কিছু ভাবিস না বাবু, হামি হামার বাচ্চার জন্য ঠিক সঞ্চয় করে লিচ্ছি।

তারপর ওরা দু—জন বসে আরও অনেক কথা বলল। পুরানো ইচ্ছাটা দুজনকেই মাঝে মাঝে বিব্রত করে মেরেছে। দুজনই পরস্পর ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছে। দুজনে দুজনকে সুখী করতে চেয়েছিল—কিন্তু দুজনেই পারেনি! ওরা যেন শপথ করেছে মনে মনে সুখ—দুঃখের দুনিয়ায় ছল—চাতুরী থাকতে নেই।

ওরা দুজনেই শেষে উঠে দাঁড়াল। নেলি আগে আগে চটানে উঠে গেল। দুঃখবাবু একটু ঘুরে চটানে উঠলেন। ঘরে ঢুকে আলো জ্বাললেন। জানালাটা খুলে দিলেন। জানালায় দাঁড়িয়ে আঁধারেও নেলির মুখটা দেখতে পেলেন। যেন আঁধারের গর্ভে নেলি ছুটছে। উদ্দাম, উন্মত্ত হয়ে ছুটেছে। অথবা ঋতুমতী ঘোড়ার মতো ছুটেছে। নেলি দুঃখবাবুকে দেখে যেন থামল। যেন বলল, পথ ছেড়ে দে। হামি ছুটবে।

দুঃখবাবু খুব শক্ত হাতে যেন ওকে ধরে রেখেছেন। যেন বলছেন এভাবে ছুটে তুই মরে যাবি। তোকে আমি মরতে দেব না। তোকে বাঁচতে হবে।

সে যেন বললে—কার জন্য বাঁচব বাবু?

আমার জন্য। দুঃখবাবু জানালায় দাঁড়িয়ে আঁধারের গর্ভে এ সব দেখে চলেছেন।

তখন যেন দুঃখবাবু দেখল নেলি ওর পায়ের নিচে পড়ে কাঁদছে। যেন বলছে, বাবু এ শরীরের বড় যন্ত্রণা। এ শরীরের দুঃখ কাউকে দিতে পারছি না বাবু। তু—যদি এ যন্ত্রণা দুহাত পেতে নিস!

জানালায় দাঁড়িয়ে দুঃখবাবুর মনে হল তিনি প্রকৃতই নেলিকে গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলেছেন। মনে হল তাঁর স্ত্রীর প্রতি যে গভীর ভালোবাসা, নেলির প্রতিও সেই গভীর ভালোবাসা। তিনি জানালায় দাঁড়িয়ে আবেগে গলে গলে পড়ছেন। তিনি ভাবছেন—বাপ—মা—মরা এই মেয়েটার সুখ—দুঃখকে অস্বীকার করলে ভগবানের পৃথিবীতে বেইমানি করা হবে। রাতের আঁধারে তিনি ভাবলেন, কালই বলবে নেলিকে—বাচ্চাটার বাপ হতে সে রাজি আছে। বলবে, এজন্যে আমার নসিবে যা আছে তাই থাকল নেলি, তবু তোর নসিবকে নষ্ট হতে দেব না। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দুঃখবাবু মনের অনুশোচনায় বড় কাতর হয়ে পড়লেন।

পরদিন ভোরে নেলি যথারীতি এল। দুঃখবাবুর ঘরদোর অনেকদিন পর পরিষ্কার করল। দুঃখবাবু কাঠগোলায় কাঠ মেপে তখন ঘরে ফিরছিলেন। নেলিকে দেখে বললেন, তুই আমার ঘরে বোস। একটা কথা আছে।

দুঃখবাবু ঘাটোয়ারিবাবুর ঘরে ঢুকে বললেন, ইমতাজ আলী ষাট মণ কাঠ দিয়ে গেল। টাকাটা কী আজই মিটিয়ে দেবেন, না ওদের কাল আসতে বলব?

ঘাটোয়ারিবাবু চাদর ঠেলে উঠে বসলে ফের দুঃখবাবু প্রশ্ন করলেন, শরীরটা আজ কেমন আছে আপনার?

ভালো আছি, বেশ আছি, কাল আদার কুঁচি, গরম জল খাওয়ায় বেশ কাজ দিয়েছে। একটু হেসে বললেন, ওদের বলে দিন টাকাটা কালই দেব। আপনি আজ এক ফাঁকে অফিস থেকে টাকাটা নিয়ে আসবেন। আপনার একটু অসুবিধে হবে বুঝতে পারছি।

কী আর অসুবিধে হবে! আসবার সময় বাড়ি হয়ে আসতে পারব। ওদের একটু বাজার করে দিয়ে আসতে পারব। এই বলে দুঃখবাবু ঘরে গিয়ে দেখলেন নেলি তখনও কোনায় চুপচাপ বসে আছে। বাবুকে ঢুকতে দেখে সে উঠে দাঁড়াল। বলল, কী বুলবি বাবু?

বোস বলছি। দুঃখবাবু বলতে ইতস্তত করছেন। আঁধার রাতের পৃথিবীটা যেন এ পৃথিবী নয়। যেন এটা অন্য পৃথিবী। এই নিদারুণ পৃথিবীতে যেন আবেগধর্মিতার কোনো স্থান নেই। এই নিদারুণ পৃথিবীতে সমাজ আছে, সংসার আছে। বাপ হব বললেই হওয়া যায় না। ভালোবাসব বললেই ভালোবাসা যায় না। বরং তিনি যেন এখন সংসারের চোখে দেখছেন নেলিকে। নেলি হয়তো সকলকে একদিন বলে বেড়াবে এটা দুঃখবাবুর বেটা আছে। অথবা এতদিনে বলে দিয়েছে। তিনি নেলিকে আরও কাছে এসে বসতে বললেন। তারপর নেলির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, লোককে কিছু বলেছিস?

কি বুলব বাবু?

লোকে তোকে বলে না বাচ্চাটা পেটে কী করে এল?

বুলে!

তুই কী বলিস?

বুলি বাচ্চাটা ভগমান দিল। ও হামার ভগমান আছে।

দুঃখবাবু এবার কাঁদো—কাঁদো হয়ে বললেন, আমার কথা বলিস—নি তো?

পাগল। তা হামি বুলি! কভি বুলবে না। বাবু হাম তেরে সাধ বেইমানি না করবে। লেকিন বাবু ওরা ত মরদ আছে। ওরা কী জানে না। ওরা কী টের পায় না বলছিস? লেকিন হামি কিছু বুলবে না বাবু। হামি বেইমানি করবে না। তু হামার ভগমান আছে।

দুঃখবাবু এবার বললেন, তাহলে তুই যা। এই কথা থাকল।

তখন গেরু নিজের ঘরে বসে হল্লা করচে। কৈলাস মরে যাওয়ার পর থেকেই ওর ঘরে ফের অভাব ঢুকল। অভাবের জন্য সে কৈলাসকে ফরাসডাঙায় টেনে নিয়ে গেছিল। সেখান পুঁতে কঙ্কালটা সংগ্রহ করেছিল এবং অল্প দামে বিক্রি করেছিল হিল্টন কোম্পানির বড়বাবুর কাছে।

বড়বাবু ওকে শুধিয়েছিলেন, তোর নাম কী রে?

গেরু ডোম।

বাপের নাম কী?

কৈলাস ডোম।

হ্যাঁরে তুই কৈলাসের ছা। কৈলাস মরদ ছিল বটে।

জী বাবু।

কটা কঙ্কাল এনেছিস?

দুটো।

একটা পুরুষমানুষের বাবু। একটা মেয়েমানুষের। একটা বাপের, অন্যটা ফরাসডাঙায় পোঁতা।

বড়বাবু বিদ্রূপ করে বললেন, বল মায়ের। বাপেরটা দিয়েছিস, মায়েরটা দিতে ক্ষতি কি!

গেরু দাওয়ায় বসে হল্লা করছে। বলছিল, আসুক টিকায়ালা মাগিরা। ওয়াদের গঙ্গার পানিতে চুবিয়ে না লিচ্ছিতো হামার নাম গেরু লয়। দ্যাশে আর মড়ক লাইক। নেলি দেখল কৈলাস মরতে না মরতে গেরু বাপের মতো হয়ে উঠল। বাপের মতো টেনে টেনে কথা বলছে। বাপের মতো আপশোশ করতে শিখছে। শনিয়া পাশে বসে গেরুর গালমন্দ শুনছে। ঝাড়োর ঘরে বচসা হচ্ছে তখন। লখি, টুনুয়া, চাকু নিয়ে মারামারি করছে। লখির হাত থেকে এখন ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে। ঝাড়োর বৌ এবং ঝাড়ো মিলে দুজনকে দুঘরে আটকে রাখল। নতুবা যেন তক্ষুনি চটানে একটা খুনোখুনি হত।

নেলি ভাত রাঁধছিল। ওদের হৈ—হল্লায়, নাচন—কোঁদনে সে সেখান থেকে নড়ল না। লখি, টুনুয়া তো চোর। ছিঃ চুরি করে পয়সা কামাচ্ছিস! মুখে তুদের পোকা পড়ুক। উনুনে পোড়া কাঠ গুঁজে দেবার সময় সে শুনল, গেরু বলছে, শালারা ঘড়ি চুরি করে লিছে। ঘড়ি চুরি করে আভি খুনোখুনি করছে, ভাগের পয়সা টুনুয়ার কম হল। মর শালারা খুনোখুনি করে।

শনিয়া বলল, ঘরে বসে ওদের গাল দিলি তুর চলবেক?

ক্যানে চলবেক না!

দু’টো দানা মুখে দিবি না!

কি করি বুল। নেলিকে যেন শুনিয়ে শুনিয়ে কথাগুলো বলল গেরু। গোমানি চাচার নোকরিটা ভি হামার জুটল না। ডাকদারবাবুকে ঘুষ দিয়ে নোকরিটা দুখিয়া নিল। সেই কবে ফরাসডাঙায়—তখন ফাল্গুন মাস,—একটা যাও ভি মিলল, তার দাম বড়বাবু ঠিক দিল না। বুলছে—এখন কী আর দাম আছে কঙ্কালের। কত আসছে, আমরা কিনতেই পারছি না ঠিক দাম দিয়ে। কঙ্কালের দাম কমছে তো কমছেই।

গেরুর রাগ এখন যেন সব শনিয়ার উপর—শনিয়া তু দানা দানা করবি না। তু মরবি, হাম ভি মরে। গেরু দুটো হাত নাচিয়ে শনিয়াকে যেন এক্ষুনি গলা টিপে ধরবে এমন ভাব করল।

অভাব—অনটনে গেরু মাথা ঠিক রাখতে পারছে না। নেলি ঘরে বসে সব ধরতে পারল। নেলি ঘর থেকেই বলল, গেরু তু আয়। তুর বহু হামার ঘরে চারটো খাবে। তোরা আজ আমার মেহমান থাকলি।

কাটোয়া থেকে সেই লোকটা এসেছে। মংলির ঘরে বসে দর—দস্তুর করছে ছেঁড়া তোশক—বালিশের। ঘরে বসে ওরা যেন কী সব শলা—পরামর্শ করল। দুখিয়া নেই। পুলিশ এসে ডেকে নিয়ে গেছে। হরীতকীর ঘরে ওর মেয়েটা হাত—পা নেড়ে খেলছে। নেলি ভাত রান্না করতে করতে একবার পিসির ঘরে উঠে গেল। চঞ্চলাকে আদর করল। পিসি ঘরে নেই—নদীতে নাইতে গেছে। নেলি ভাবল, পিসিকেও আজ ওর ঘরে দুটো খেতে বলবে।

বিকেলের দিকে গুমট ভাব। আকাশের নীল রঙটা ক্রমশ কালো হচ্ছে। গরমে চটানের মেয়ে—মরদেরা হাঁসফাঁস করছে। নেলির শরীরটা ক্রমশ মোটা হয়ে উঠেছিল বলে সে দুটো পা বিছিয়ে চালা ঘরটার মেঝেতে বসেছিল। আকাশ দেখছিল মাঝে মাঝে। হয় বৃষ্টি হবে, নয় ঝড়। চালা ঘরটার ওপরে তোশক—কাঁথা নেই বললেই হয়। ঝড় হলে যা আছে সব উড়ে যাবে, আর জল হলে ঘরে থাকা দায় হবে। বাইরে জল হওয়ার আগে ঘরে জল পড়বে। নেলি এই সব ভেবে ভেবে খুব মুষড়ে পড়ছিল। একবার গেরুকে ডাকলে হয়। বললে হয়, হামার চালে দুচারটা ছেঁড়া তোশক—কাঁথা ফেলে দে। দড়ি দিয়ে বেঁধে দে। লয়তো এ ঘরে থাকা হামার বড় দায় হবে।

কাটোয়া থেকে যে লোকটা এসেছিল, ঝড়—জলের আভাস পেয়ে চটানে থাকতে চাইল সে। লোকটা এখন চটানটা ঘুরে ফিরে দেখছে। দুখিয়া এলে বারান্দায় বসবে সে। দুজনে মিলে এক ছিলিম গাঁজা খাবে। চটান দেখার সময় সে আকাশও দেখল। খুব জল ঝড় হবে। আকাশ দেখার সময় সে এ কথা বলল।

গেরু নেলির চালে বসে বলল, খুব জল ঝড়ে হোয়ে লিবে। দে দেখি আর কী আছে। ঘরের সব কাঁথা—বালিশ দিয়ে লে। সব বিছিয়ে দি। রশি দে, পুরানা যা আছে সব দে, বেঁইধে দি।

নেলি শীতের সব কাঁথা—কাপড় টেনে বের করল ঘর থেকে। বাপের কাঁথা—কাপড়, ওর নিজের কাঁথা—কাপড়—সব কাঁথা—কাপড় বের করল। শীত আসতে আসতে আবার সব ঘাট থেকে জোগাড় করে নিতে পারবে। শনিয়া এবং নেলি দুজনে মিলে তোশক—কাঁথা সব উপরে তুলে দিল। গেরু চালার ওপর বসে রশি দিয়ে বাতার সঙ্গে সব কাঁথা—কাপড় বেঁধে দিল।

গেরু চাল থেকে নামার আগেই ঝড় উঠেছে। উত্তর—পশ্চিম কোণের মেঘটা সারা আকাশে ছড়িয়ে পড়ল। গঙ্গার বালিয়াড়ি থেকে অজস্র বালির ঝড় উপরে উঠে আসছে। নেলি এই ঝড়ের ভেতরেই কয়েকটা পোড়া কাঠ ঘরে নিয়ে তুলল। শুয়োরের বাচ্চা দুটো এখন বড় হয়েছে। ওদের ডেকে সাড়া পেল না সে। কবুতরগুলো ঝড়ের ভিতর কোথায় হারিয়ে গেছে যেন। সে গঙ্গা—যমুনাকে ডাকল—কিন্তু কেউ সাড়া দিল না। বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামছে। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটায় চটানের কঠিন মাটি ভিজতে থাকে। তারপর এক দুই করে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ে। বৃষ্টির ধারা নেমেছে। বৃষ্টির জলে মা—বসুন্ধরা ঠান্ডা হচ্ছে।

শরীরের গুমোট ভাবটা কাটাবার জন্য নেলি উঠোনের বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ভিজল। মা—বসুন্ধরার মতো বৃষ্টির জলে সেও ঠান্ডা হচ্ছে। নেলি দেখল, বৃষ্টির ভিতর দু—একটা কাক উড়ে যাচ্ছে। দুটো শালিক বৃষ্টির জলে স্নান করছে। বিচিত্র শব্দ উঠছে আশেপাশে। ব্যাঙ ডাকছে। কচুর ঝোপে বৃষ্টি পড়ার টুপটাপ শব্দ। এই সব দেখে নেলিও ব্যাঙের মতো বৃষ্টির জলে লাফাল, নাচল। আনন্দে ছুটে ছুটে বেড়াল। পোড়া মাটিতে প্রথম বৃষ্টি পড়ার গন্ধ নেলিকে সব রাগ অভিমান ভুলিয়ে দিল। সে চিৎকার করে উঠোন থেকে বলছে, শনিয়া গতরে পানি ঢেলে লে। পানিতে ভিজে পোড়া শরীর ঠান্ডা করে লে!

মংলি নিজের দাওয়ায় বসে বলল, মাগির ঢং দেখ।

দুখিয়া এখনও ফেরেনি। কাটোয়ার লোকটা ঘরে বসে তখন মংলিকে ডাকছে। ভিতরে যেতে বলছে। মংলি যেন নেলির জন্যেই ঘরের ভিতর গিয়ে বসতে পারছে না। উঠোনে দাঁড়িয়ে জলে ভিজছে আর মংলির ইতর ইচ্ছার সাক্ষী থাকার চেষ্টা করছে।—ওলো মাগি তু মরবি—তু মরবি। তু ফুলে ফেঁপে মরবি। মংলি দাওয়ায় বসে যেন শাপ—শাপান্তর করল নেলিকে।

হরীতকী ঘর থেকে ডাকছে, নেলি তু আচ্ছা কাজ করে লিচ্ছিস না। দিনকাল বহুত খারাপ যাচ্ছে। জলে ভিজে তবিয়ত খারাপ হবে। ঘরে যা, ঘরে যা।

নেলির তখন মনে পড়ল বাপের কথা। ওর ভগবানের কথা—ভগবান যে ওর পেটে। সে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে গেল। কাপড় ছাড়ল। শুয়োরের বাচ্চা দুটো জলে ভিজে ঘরে ঢুকছে। কবুতরের বাচ্চাগুলো টঙ—এর ভিতর এসে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। বৃষ্টি তেমনি জোর হচ্ছে। বেলা থাকতে চটানে রাত নেমে গেল। উঠোনের জল নালা—নর্দমায় নামছে। ঘাটোয়ারিবাবুর জানালা বন্ধ। দুঃখবাবু চটানে নেই। নেলি কুপিটা ধরাল। কুপির আলো দেখে শুয়োরের বাচ্চা দুটো ওর পাশে এসে বসল। নেলি আদর করল ওদের। গঙ্গা—যমুনা পাশে না থাকায় যে নিঃসঙ্গতা বোধ ছিল, ওরা পাশে এসে বসায় সে অভাব বোধটুকু কেটে গেল নেলির। বাইরে জল পড়ার শব্দ হচ্ছে—টিপটাপ—টুপটাপ।

ভোর রাতের দিকেই আজকাল যা একটু ঘুম হয় ঘাটোয়ারিবাবুর। সারা রাত তিনি গরমে ছটফট করেন। শেষরাতের দিকে ঠান্ডা পড়লে শতরঞ্জটা পেতে শুয়ে পড়েন। এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘুমটা চলে আসে তখন। তারপর ভোরে ঘুমটা ভেঙে গেলে তুড়ি দেন এবং হাই তোলেন। বলেন পরম ব্রহ্ম নারায়ণ। তোমারই ইচ্ছা ঠাকুর। এই সব বলে শরীরের সব জড়তা ভেঙে উঠে পড়েন।

কাউন্টারে একটা মুখ ভেসে উঠল। মুখটা উঁকি দিয়ে বলছে, একটু এদিকে আসবেন?

ঘাটোয়ারিবাবু শতরঞ্জতে বসে দুটো স্তোত্র পাঠ করলেন। কাউন্টারের কথা তিনি ইচ্ছা করেই শুনলেন না। এখন তিনি স্তোত্র পাঠ করবেন। হাতমুখ ধোবেন। গঙ্গায় স্নান করবেন। এখন অনেক কাজ। তিনি জোরে জোরে মন্ত্র উচ্চারণ করতে থাকলেন।

কাউন্টার থেকে আবার গলাটা ভেসে এল।

তিনি যথারীতি দাঁড়ালেন—যথারীতি দড়ি থেকে গামছা টেনে দরজা খোলার সময় বললেন—একটু বসতে হবে। স্নানটা সেরে আসি। মড়া নিয়ে যখন তখন এলেই ত চলবে না! ঘাটে গিয়ে বসুন। হনহন করে তিনি শিবমন্দিরের পথ ধরে গঙ্গায় নেমে গেলেন।

কাউন্টারে লোকটা পায়চারি করতে থাকল। রাগে—দুঃখে তার ইচ্ছা হল ঘাটোয়ারিবাবুর গলা টিপে ধরতে। মৃত্যুর জন্য মানুষটার এতটুকু দুঃখ নেই। এতটুকু সহানুভূতি নেই। চামার যেন। লোকটা মৃত্যুর খবর শুনে একবার চমকাল না। একবার আহা পর্যন্ত করল না। মৃত্যুর জন্য কোনো কষ্ট নেই, মৃত্যুর জন্য যেন লোকটা হাঁ করে বসে থাকে। যেন এই মৃত্যুই স্বাভাবিক, বেঁচে থাকা অস্বাভাবিক। বেঁচে থাকার কোনো দাম নেই, শুধু দাম আছে জন্ম এবং মৃত্যুর। ভিতরের এই এত কাণ্ড সব যেন ওর কাছে জন্ম—মৃত্যুর বিকার। ওর মুখটা দেখে লোকটা পায়চারি করতে করতে এই সব ভাবল।

ঘাটোয়ারিবাবু নদীতে নামার সময় দেখলেন দশ—বারো বছরের একটি হৃষ্টপুষ্ট ছেলেকে দুজন লোক কাঁধে করে ঘাটে নামাচ্ছে। বাপ পিছনে। তিনি বুক চাপড়ে কাঁদছেন। কাউন্টারে তবে এই মড়ার লোকটাই ওকে এতক্ষণ জ্বালাচ্ছিল। ঘাটোয়ারিবাবু একবার দেখে আর দেখলেন না। ঘাটের অন্য লোকগুলো স্নান সেরে দূরে দাঁড়াল। তারা বলল—আহা কী সর্বনাশ! এই ধরনের সব শোক প্রকাশ করল। ঘাটবাবু দাঁড়ালেন না। তিনি নেমে যাচ্ছেন। তিনি এই ধরনের কোনো শোকই প্রকাশ করলেন না। তিনি শুধু বললেন, হরিবোল। হরিবোল। যারা শোক প্রকাশ করছিল তারা উপরে উঠেই বচসা আরম্ভ করে দিল। কে ছুঁয়ে কাকে অস্পৃশ্য করল সেই নিয়ে বচসা।

ঘাটোয়ারিবাবু ডুব দেবার আগে কানে আঙুল দিলেন। গঙ্গার জলে শান্তি আছে কোথাও। সহস্র ডুব দিয়ে তিনি যেন তাই প্রত্যক্ষ করতে চাইছেন।

স্নান সেরে উঠে আসার সময় ঘাটবাবু দেখলেন লাঠি নিয়ে হাঁটছে দুখিয়া। মংলি মনে মনে হিসাব কষছে—কত দাম হবে, কত বিক্রি হবে। মংলির চোখ দুটো, দুখিয়ার লাঠি এবং চটানের মেয়ে—মরদের লোভী ইচ্ছাগুলো ঘাটোয়ারিবাবুর মনে বিরক্তির জন্ম দিচ্ছে।…দু দণ্ড সবুর কর। একটা ছোট মানুষ তোদের এই পৃথিবী থেকে চলে গেছে, পৃথিবীর হের—ফেরটাই জানতে পারেনি। সুখ—দুঃখের অর্থটাই ধরতে পারেনি—তার জন্য তোদের একটু কষ্ট হওয়া উচিত। একটু দূরে সরে দাঁড়া। ওভাবে ঝুঁকে দাঁড়াস না মড়ার ওপর। তোদের নজর বড় খারাপ নজর।

নিজের এই চিন্তার জন্য তিনি আশ্চর্য হলেন। যত বয়স বাড়ছে তত পৃথিবীর জন্য দরদ বাড়ছে। তিনি নিজেকেই বললেন, ঘাটবাবু, তোমার অমন চিন্তা ভালো নয়। মৃত্যুই তোমার জীবনের বড় সত্য—তাকে অস্বীকার কোর না।

অফিসঘরে ঢুকে তিনি কাপড় ছাড়লেন। ধূপ—ধুনো জ্বেলে টাঙানো ছবিগুলোর সামনে ধরলেন। তারপর রেজিস্ট্রি খাতায় কাঠের বাক্সে। তিনি ছবিগুলোর কাছে গিয়ে সকলকে এক, দুই করে প্রণাম করলেন। উপনিষদের দুটো পরিচিত শ্লোক উচ্চারণ করে সকলকে শুনালেন। লোকটা তখনও কাউন্টারের ওপিঠে পায়চারি করছে। বিরক্ত হচ্ছে, ঘাটোয়ারিবাবুর বেয়াড়া কাজগুলো দেখছে। শুধু একবার কাউন্টারে উঁকি দিয়ে বলেছে, কী হল আপনার?

হবে, হবে। সময় হলে হয়ে যাবে। তখন আপনাকে বলতে হবে না। আর আমি ইচ্ছা করলেও দু দণ্ড দেরি করতে পারব না।

তিনি এ সময়ে দরজা, জানালা বন্ধ করে দিলেন। কাউন্টারে ঝাঁপ ফেলে দিলেন এবং মহাভারতের আদি পর্ব থেকে পাঠ করতে থাকলেন: নারদ কহিলা তবে দেব নারায়ণে। অদিতি কহিল যত কুণ্ডল করনে।। নরক আনিল বলে অদিতি কুণ্ডল। লুটিয়া অমরাবতী অমরী সকল।। পৃথিবীর পুত্র হয় নরক দুর্মতি। তারে না মারিলে যায় স্বর্গের বসতি।।

লোকটা কাউন্টারের ওপাশ থেকে চিৎকার করে উঠল, অ মশাই। মহাভারতটা দয়া করে পরে পড়বেন। দয়া করে নাম ধাম লিখে অধমকে বিদায় করুন।

ভিতর থেকে কোনো জবাব এল না। অথবা কোনো সাড়া। রোদ বাড়ছে। রোদ ঘন হচ্ছে। ওরা মড়া আগলে ওর অপেক্ষায় বসে আছে। এখন শুধু ঘাটবাবু ছেড়ে দিলেই হয়। তারপর কাঠ নিয়ে যাওয়া আছে। চিতা সাজানো আছে। গঙ্গার জলে দেহটাকে শুদ্ধ করার কাজ আছে। অনেক বেলা হবে আগুন দিতে। সে এই সব ভেবে ফের ডাকল, অ মশাই!

কোনো জবাব নেই। কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না ভিতরে। ভিতর থেকে ধোঁয়াটে ভাব এবং গন্ধ। তিনি গঞ্জিকা সেবন করছেন তবে! ভারী বদ লোক ত দেখছি। লোকটা পায়চারি করতে করতে উত্তেজিত হয়ে উঠল।

তিনি ধোঁয়ার জগতে অনেকক্ষণ বসে জগতের অনিত্যতাকে উপলব্ধি করে কাউন্টারের পাল্লা খুলে দিলেন। কী নাম, কোথায় থাকে, বয়স কত, হাসপাতালে মরল—ডেথ সার্টিফিকেট আছে কিনা, এসব কথাগুলোও জিজ্ঞাসা করলেন।

এই সময় দুঃখবাবু এল। হরীতকী এল। লোকটা অফিস থেকে ঘাটে নেমে যাচ্ছে। কাঠ মাপছে ঝাড়ো। ডোমের মেয়ে—মরদেরা কাঠ নামাচ্ছে গঙ্গায়। কিছুদিন থেকে নেলি চিতা সাজানোর কাজটা পেয়েছে। নেলি চিতার কাঠ সাজাবে। সেজন্য সে গঙ্গায় নেমে যাচ্ছে।

দুঃখবাবু হঠাৎ বললেন, বড় করুণ, বড় করুণ!

ঘাটবাবু জবাব দিলেন না। তিনি যেন কথাটার যথার্থ অর্থই ধরতে পারেননি এমন ভাব দেখালেন।

দুঃখবাবু হরীতকীকে উদ্দেশ করে বললেন, দেখলি হরীতকী, লোকটার কী সর্বনাশ! জলজ্যান্ত কাঁচা ছেলেটা গেল। আমাদের পাড়ার অরুণবাবুর ছেলে।

আপনার ছেলেটা কত বড় হয়েছে দুঃখবাবু? ঘাটবাবু এতক্ষণে সব ধরতে পেরে প্রশ্ন করলেন নতুন বাবুকে।

আর ছেলেপুলে! যমের ঘর নিয়ে সংসার মশাই। কখন যে কোনটা খসবে…! নতুন বাবুকে খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছে এখন।—ওরা আমার ছেলেপুলে নয়, সব ওঁর, সব ঈশ্বরের। বড়টার বয়স আশ্বিন এলে পাঁচ বছর পূর্ণ হবে।

একদিন ছেলেটাকে নিয়ে আসুন না দেখি। বড় ইচ্ছা হয় দেখতে। কী বলব, আপনার সংসারের কথা শুনে আমার বড় আপশোশ হয়। ইচ্ছা হয় নিজেও একটা সংসার করি। ঘর বাঁধি। ঘাটোয়ারিবাবু এইসব বলে কেমন লজ্জা পেলেন। তিনি আবার আগের কথায় এলেন। আমাদের কথা ওদের আপনি বলেছেন।

বলিনি! কী যে বলেন, সব! বলেছি। আপনার কথা বলেছি, হরীতকীর কথা বলেছি। নেলি, গোমানি, কৈলাস, গেরু—সবার কথা বলেছি। ওরা তো লেগেই আছে এখানে আসবে বলে। আমি নিয়ে আসি না। মনটা আমার খুঁতখুঁত করে।

হরীতকী বিরক্ত করছিল তখন ঘাটবাবুকে—তুর জন্য কী রাঁধি বুলে দে। বেলা তো বাড়ছে। তুর সে খেয়াল আছে বাবু!

যা হয় কিছু রেঁধে দে বাপু। এখন জ্বালাস নে। দেখছিস তো দুঃখবাবুর সঙ্গে গল্প করছি।

হরীতকী উঠে দাঁড়াল। একটা ঝাঁটা এনে ঘরটা ভালো করে পরিষ্কার করে দিল। তারপর আকাশের বেলা দেখতে বের হয়ে গেল।

দুঃখবাবুর সঙ্গে গল্প করে ঘাটোয়ারিবাবুর মনটা কোমল হয়ে উঠেছে। একটি ঘর, একটি সংসার ছোট সব সুখ—দুঃখ, ছোট ছোট কথার জন্য মনটা মাঝে মাঝে অবুঝ হয়ে ওঠে। তখন মনে হয় ঘাটের নিষ্ঠুরতা—ওঁর মন এবং হৃদয়ের ওপর পাশবিক অত্যাচার চালাচ্ছে। তখন মনে হয় এ চটান ছেড়ে পৃথিবীর অন্য কোথাও গিয়ে বাঁচতে। ঘর বাঁধতে। ভাবতে ভাবতে আবার বলেন, একদিন নিয়ে আসুন না আপনার ছেলেকে আপনার মেয়েকে। একটু আদর করি। আমি ওদের কোনো অনিষ্ট করব না। দুঃখবাবু আমার আদর করার মতো কেউ নেই। কথাগুলো বলে তিনি চোখ বুজলেন। একটু সামান্য সুখের ইচ্ছায় তিনি চোখ বুজে আছেন। চোখ খুললেই যেন সামান্য সুখের ইচ্ছাটাকে চটানের নিষ্ঠুরতা গ্রাস করবে। চোখ বুজেই বললেন, কী আনবেন তো, কথা দিচ্ছেন তো? কথা বলছেন না কেন?

নিশ্চয় আনব। নিশ্চয়।

আপনার স্ত্রী আছে, বাবা মা আছেন, ভাবতে বড় ভালো লাগে। স্ত্রী স্বামীকে কত ভালোবাসে তা জানার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তবু বুড়ো বয়সে—বলতে লজ্জা কি—রসকলিকে দিয়ে সে স্বাদ এককালে মেটাবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কথা কী জানেন, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে না মশাই, মেটে না। কোনো স্বাদ নেই। কোনো স্বাদ নেই। তিনি চোখ খুলেও খুলতে পারছেন না। সামান্য সুখটা আর একটু থাক—এই তাঁর ইচ্ছা।

এক নতুন ইচ্ছায় ঘাটোয়ারিবাবু ডুবে যাচ্ছেন। জীবনের অনেকগুলো ক্ষুদ্র অনুভূতি অন্য এক মনোরম ধরিত্রীর অনুসন্ধানে ওঁকে উদগ্র করে তুলল। চোখ বুজেই তিনি সেই সুখকে ধরতে পারলেন। দুঃখবাবু যেন ছোট ফুল দিয়ে সংসার সাজাচ্ছেন। হরীতকীর বাচ্চা হয়েছে। নেলিরও বাচ্চা হবে। ওরা ওদের ঘর নিয়ে বাঁচল। ওরা ওদের সুখ নিয়ে বাঁচল। শুধু এই ঘাটবাবু কড়ির হিসাবের মতো মৃত্যুর হিসাব রাখছেন। এই সব ভেবে ভেবে গভীর জলধিতে ডুবে গেলেন তিনি। শুধু আঁধার—আঁধার। জীবনের কোনো চিহ্ন দেখতে পাচ্ছেন না। তিনি চোখ বুজেই চেয়ারের হাতল দুটো জোরে চেপে ধরলেন। তিনি মৃত্যুর বীভৎসতায় শিউরে উঠলেন।

সহসা চোখ খুলে চেয়ারের হাতল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। ইতস্তত কিছুক্ষণ পায়চারি করে দুঃখবাবুর মুখের ওপর ঝুঁকে পড়লেন। বললেন, ভোরে যখন আসেন গিন্নি কিছু বলে না? বলে না, ঘাটের চাকরি ছেড়ে দাও? বলে না, অন্য চাকরি দেখ?

ওসব বলে না, তবে বলে, তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। আমি ফিরে গেলে তবে ওর সব কাজ শেষ হবে। ফিরে গেলে নাইবার জল দেবে। সে জলে আমি স্নান করব। আমি খেতে বসব। ছেলেমেয়ে দুটো কোত্থেকে এসে জুটবে। যতই খাক, আমার সঙ্গে না খেলে ওদের পেট ভরবে না। ও আমাকে খাইয়ে দিয়ে দিবা নিদ্রার ব্যবস্থা করে তবে নিজে স্নান করবে। খাবে।

খুব ভালো মেয়ে।

হ্যাঁ, তুলনা হয় না।

স্ত্রী, পুত্র, পরিবার নিয়ে তবে সুখেই আছেন।

তা মোটামুটি আছি। সুখে—দুঃখে চলে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে টাকা—পয়সার জন্য খুব বিব্রত বোধ করি। অভাব অনটনের সংসার। বুঝতেই ত পাচ্ছেন।

তা হলে বলছেন দুঃখও আছে।

তা আছে।

তিনি বুঝলেন নিরবচ্ছিন্ন সুখ অথবা নিরবচ্ছিন্ন দুঃখ মানুষের থাকতে নেই। তিনি বুঝলেন এই সুখ দুঃখের জন্যই দুঃখবাবুর সংসার—সংসার হয়েছে। একটু সুখ দুঃখের জন্যই দুঃখবাবু এমন সুখের কথা বলতে পারছেন। এই সুখ—দুঃখ না থাকলে তিনিও যেন বলতেন, আর ভালো লাগে না মশাই, সংসারের ওপর বীতরাগ হয়ে পড়েছি।

রোদের তাপ বাড়ছে। বেলা বাড়ছে। শ্মশানের আগুনটা দাউ—দাউ করে জ্বলছে। ওরা দুজনেই আগুনটা দেখে চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ। রোদের উত্তাপে আগুনটা খুব নিষ্প্রভ মনে হচ্ছে। ঘাট থেকে উঠে আসছে নেলি। ওর কাজ হয়ে গেল বলে উঠে এল। কিন্তু ওরা দেখল একটি ডোমের মেয়ে ওকে উঠে আসতে সাহায্য করছে। হরীতকী ছুটে চটান থেকে নামল। শনিয়া সকলকে বলছে চটানের—নেলির বাচ্চা হবে।

দুঃখবাবু জানালায় দাঁড়ালেন। তিনি জানালা থেকে শনিয়ার কথা শুনতে পাচ্ছেন। তিনি আড়াল থেকে নেলিকে উঠে আসতে দেখছেন। নেলির দীর্ঘ শরীরটা ব্যথায়, বেদনায় নুয়ে পড়েছে। চুলগুলো কপালে, মুখে ছড়িয়ে আছে। হরীতকী নেলিকে দাঁড় করিয়ে খোঁপা বেঁধে দিল। হরীতকী কপাল থেকে চুলগুলোকে সরিয়ে দিল, নেলির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। চোখ দুটো কোমল, সাদা—সাদা, ধীর। ওর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। শরীরের অসহ্য যন্ত্রণা ওকে সুখ এবং দুঃখ দুই—ই দিচ্ছে যেন। জানালার কাছে এসে নেলি চোখ তুলে দুঃখবাবুকে দেখল। চোখ নামাল। নেলি যেন বলছে, হামার ভগমান আসছে বাবু। হামি হামার মাচানে ভগমানকে নামাতে যাচ্ছি।

বড় করুণ! বড় করুণ! দুঃখবাবু জানালায় মুখ রেখে ফের উচ্চারণ করলেন। জানালা থেকেই দেখতে পাচ্ছেন—অরুণবাবু এই রোদের উত্তাপে বসে নিজের বাচ্চাটাকে ভস্ম হতে দেখছেন। তিনি তাঁর একমাত্র পুত্রকে আগুনের জঠরে ঠেলে দিলেন। শ্মশানের শেষ ধোঁয়ার সিঁড়ি উপরে উঠে যাচ্ছে। ওর একমাত্র আত্মা স্বর্গের সিঁড়ি তৈরি করছে। নেলি এই পথ ধরে উঠে গেল। সে তার ভগবানকে মাচানে নামাতে যাচ্ছে। দুটো মোষ নেমে গেল গঙ্গায়। ওরা লড়াই করতে নেমে গেল। একটা লোক নানারকমের খেলনা শরীরে ঝুলিয়ে বিক্রির আশায় উঠে যাচ্ছে। সে শিবমন্দিরের পথ থেকেই নাচতে আরম্ভ করল, বলতে আরম্ভ করল, লে যানা বাবু। সাড়ে ছ আনা। দেখে শুনে মন দেওয়ানা। আহা মন দেওয়ানা। দেওয়ানা।

চটানে নেলির গোঙানি। গোঙানি থামছে, না। অহরহ সেই আওয়াজ দুঃখবাবুকে বিব্রত করছে। নেলির বুঝি খুব কষ্ট। জানালায় দাঁড়িয়ে নেলির কষ্ট তিনি বুঝি ধরতে পারছেন। এখন এই জানালায় দাঁড়াতে ইচ্ছা হচ্ছে না। চটানে নামার ইচ্ছা। নেলির মাচানে বসার ইচ্ছা। একটু আদর করার ইচ্ছা। কিংবা তিনি যেন ওকে সাহস দিতে চাইছেন। কিন্তু দুঃখবাবু নড়তে পারছেন না। নেলি মাচানে পড়ে পড়ে কাঁদছে—আর তিনি নড়তে পারছেন না।

হরীতকী জল গরম করছে ঘরে।

মংলি নিজের ঘরে বসে শাপ—শাপান্ত করছে। চটানে এত বিটির পেটে বাচ্চা আসছে, ওর পেট কেবল খালিই যাচ্ছে। দুখিয়ার সঙ্গে ঘর করতে এসে কত বছর ঘুরে গেল। চটানে কত লোক এল গেল। অথচ ওর পেটে একটা বাচ্চা এল না। চোখখাগী ডাকঠাকুর। নিজের গতরটা দেখল—নিজেকে, দুখিয়াকে শেষে চটানের সকল মেয়ে—মরদকে শাপ—শাপান্ত করল।

দুঃখবাবু জানালায় দাঁড়িয়ে এ সবও শুনলেন।

জল গরম করে হরীতকী নেলির ঘরে ঢুকল।

একটা শুকনো কাঠের গুঁড়ি গেরু এবং শনিয়া দুজনে মিলে ঘরের ভেতর ঠেলে দিয়ে গেল।

নেলি মাচানে এ—পাশ ও—পাশ করছে। উঠছে—বসছে, গাভীন গোরুর মতো হামলাচ্ছে। মুখ, শরীর শক্ত করে দিচ্ছে।

হরীতকী বুঝল খুব কষ্ট হচ্ছে নেলির। বাচ্চাটা হতে কষ্ট দিচ্ছে নেলিকে। হরীতকী সহ্য করতে না পেরে বাইরে এসে দাঁড়াল। গেরুকে ডেকে বলল, তুর বাপ তো দানরি—ফানরি করত। খুঁজে দেখ না দুচারঠো চিজ মিলে কিনা! তুর বাপ তো পোয়াতির বাচ্চা আনতে জেরা সময় লিত। খুঁজে দেখ না ময়রুন বিবির ফল তুর ঘরে আছে কিনা। নেলি বহুত কষ্ট পেয়ে লিচ্ছে। পেলে ওয়াকে ডুবায়ে দিতাম পানিতে। পানি খাইয়ে দিলে ও—মেয়েটা আসান পেত।

চটানে দাঁড়িয়ে গেরু হঠাৎ বাপের হেকিমি জীবনটার কথা মনে করতে পারল। মনে হল ওর—এইত সময়। কঙ্কালের দাম কমে যাচ্ছে। মড়ক আর লাগছে না। হিল্টন কোম্পানির বড়বাবু কঙ্কাল কিনছেন না। এই ঠিক সময় বাপের ব্যবসাটা জোড়াতালি দিয়ে ফের আরম্ভ করে দেওয়া যায়। সে তাড়াতাড়ি বাপের মাচানের নিচে ঢুকে গেল। হাতড়ে হাতড়ে ছোট বড় অনেক মেটে কলসি, হাঁড়ি বের করল। বেড়ার পাশ থেকে বেতের ঝুড়িটা টেনে বের করল। ঝুড়িটা ইঁদুরে খেয়েছে। উইপোকরা কেটেছে। মাকড়সার জাল ঝুল কালিতে ভরে আছে। সে ঝুড়িটা তুলে বাইরে নিয়ে এল।

এখনও দুটো একটা প্রায় সব রকমের গাছগাছড়াই আছে যেন। হেমতাল কাঠ আছে, নরসিং ঝাঁপ আছে। বন রুই মাছের ছাল আছে। শ্বেতশিমুলের ছাল, গোঁড়ের ছাল আছে দুটো। নীল বানরের মাথা আছে। গেরু তন্ন তন্ন করে করে খুঁজছে। আছে, আছে, যেন সব আছে। সে নিচে ময়রুন বিবির ফুল পেয়ে চিৎকার করে ডাকল, পিসি আছে রে আছে। পেয়ে লিছিরে ময়রুন বিবিরে। দে দে জল খাইয়ে দে। ওরে শনিয়া, জলদি পানি লিয়ে যায়। ময়রুন বিবিরে ডুবায়ে দে। পানিটা খাইয়ে দে পোয়াতিরে, বাচ্চা হতে জেরা সময় লেবে। ঠিক বাপের মতো গেরু সুর করে কথাগুলো বলতে থাকল।

পরদিন ভোরবেলায় গেরু দাওয়ায় একটা চাদর বিছিয়ে সব গাছগাছালিগুলো রাখল। ফুঁ দিয়ে ধুলো সাফ করল। সরু একটা কঞ্চি কেটে, বাপের মতো কঞ্চিটা হাতে নিয়ে চাদরের চারপাশে ঘুরতে থাকল। গেরু চাদরটার চারপাশে নাচল কুঁদল। লাফাল। বাপের মতো ঘুরে ফিরে নেচে—কুঁদে রসল্লা দিচ্ছে। যেন কোনো ভুল না হয়। যেন আনাড়ি বলে লোকে ধরতে না পারে। সে ঘুরে ঘুরে বাপের কথাগুলো মুখস্থ করল। কোর্ট—কাছারিতে হেকেমি করার সময় বাপ যেমন চেঁচাত, সেও তেমনি চেঁচাতে থাকল। এ পুন্ন—পদের মাদুলি। এ ঝাড়ফুঁক লয়, এ জাদু মন্তর লয়, এ আছে জড়িবুটির কারবার—দ্রব্যগুণ। ডান পুকুস টান মারে, তোষক করে, পির পরিতে নজর দেয় বাণ মারে, এ মাদুলি দেহে লিলে আসান পাবে দেহ। বহুত সামান্য দাম আছে লিয়ে যান। বিবি বুঢঢার লাগি লিয়ে যান। গেরু বাপের মতোই সুর করে কথা বলল।

শনিয়া বলল, এবেনে এটা কী হচ্ছে?

গেরু বিরক্ত হয়ে বলল, এবেনে এটা কাম হচ্ছে। এবেনে তু কাজিয়া না করবি। খাওয়ান থাওয়ান মাত করবি। হামি হাড়—গোড়ের ব্যবসা করবে না। হাকিমি ব্যবসা করবে। দু চারঠো গাছগাছালি জোগাড় করে লিলেই হবে। তু থাম।

শনিয়া গেরুর চোখ দুটো দেখে ভয় পেল। সে কিছু বলল না। চুপচাপ দরজার পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। গেরুর লাফ ঝাঁপ দেখল, এবং ফিক করে হেসে দিল এক সময়। গেরু এখন অজগর সাপের মতো হয়ে যাচ্ছে। সে বলছে—ডিহিবড়া সাপের চোয়াল গা। গেরু ডিহিবড়া সাপের মতো মুখ করে হাই তুলছে। শনিয়া ওর হাই তোলা মুখের ঢঙ দেখেই হাসল।

গেরু রুখে উঠল, তু হাসলি কেনে?

হামি হাসলাম কুথি আবার?

তু হাসলি না, ফিক করে হাসলি না তু?

তু অমন করছিস ক্যানে? মুখটাকে সাপের মতো করে হাই তুলছিস।

হাই তুলবো না। সাপের কথা তুললে সাপের মতো হতে হয়। বানরের কথা তুললে বানরের মতো হতে হয়। তবে দানরি—ফানরি হবে। কাজ কারবার হবে। এটা তামাশা ভেবে লিস না শনিয়া। এ বহুত তন্তর মন্তরের কারবার আছে। তু মত হাসবি। ঠিক এখানটাতে বসেই বাপ হামাকে গাছগাছালির নাম শেখাত। বাপ বুলত। শিখে লে বেটা। এ কাম করে খেতে পারলে চটানে ভুখা থাকতে হবে না। শনিয়ার দিকে মুখ তুলে ফের বলল, তু—হাসবি না।

হাসব না।

গেরু বাপের মতো রসল্লা দিতে লাগল আবার। সে ঘুরে ঘুরে লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে। যেখানে যেমন যে বলছে, সেখানে সে তেমনটি হওয়ার চেষ্টা করছে। বাঘের কথা বলছে বলে বাঘের মতো হাঁটছে। সে বলছে—সুন্দরবইনা বাঘ। বাবুরা বলেন রুয়েল বেঙ্গল টাইগর। নীল বানরের মাথা, বনমানুষের হাড়, কুল কুহলীর গাছ। মরদ রাজের মূলে ছ দফের রেণু মিলে কবচ দিলে নাম তার মহাশক্তি কবচ বাণ। গুণ বহুত পেকারের। যে আদমী বিছানা খারাপ করে, আস্বপ্ন—কুস্বপ্ন দেখে, যার বাদী দুশমন শত্রু আছে—বাণ মারে, বন্ধন করে—তার লাগি এই কবচ বাণ। বড় সামান্য দাম আছে। —মাত্তর স পাঁচ আনা। খুব বেশি দাম লয়। ঘাটে পথে দোকানে দুশমনে কত পয়সা যায়—মাত্তর স পাঁচ আনা। একসঙ্গে এতগুলো কথা বলে এবং লাফালাফি করে গেরু অবসন্ন হয়ে পড়ল যেন। সে বসল কালো চাদরটার পাশে। তারপর শনিয়ার দিকে চেয়ে বলল, কেমন শুনলি বল।

বহুত আচ্ছা।

তুর একটা মাদলি কিনতে শখ গেল না?

জরুর শখ গেল।

ও হামি আচ্ছা বলিয়ে লিচ্ছি। পয়সা, পয়সা, কত পয়সা হবেক দেখবি।

একদিন, দুদিন, তিনদিন রসল্লা দিল গেরু। তিনদিনই দরজায় দাঁড়িয়ে শনিয়া দেখল সব। তিন দিন শাগরেদের মতো গেরুকে সাহায্য করেছে। গাছগাছালি বিছিয়েছে। গাছগাছালি চাদর থেকে তুলে ধরে রেখেছে। তিনদিনই মনে হয়েছে—গেরু অন্য মানুষ। গেরু দানরি হয়ে গেছে কিংবা হাকিমদার।

পরদিন ভোরে মাথায় কাঠের বাক্স নিয়ে হাতে হারিকেন নিয়ে চটান থেকে নেমে গেল গেরু। শিবমন্দিরের পথ ধরে সে শহরের রাস্তায় পড়ল। রাস্তায় প্রচণ্ড ভিড়। সে লোক ঠেলে যেতে লাগল। কোর্ট—কাছারি করতে যাচ্ছে। সুতরাং বাপের কথাগুলো আওড়াচ্ছে মনে মনে। সে রাস্তার একপাশ ধরে হাঁটে। মোটর রিকশা বাঁচিয়ে হাঁটে। একদিন, দুদিন এবং অনেকদিন হাঁটল। কোর্ট—কাছারিতে বসল। অনেকদিন। বাপের মতো জোর গলায় কথা বলেছে অনেকদিন। বাপের মতো অশ্বত্থ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে চাদরের ওপর জড়িবুটি বিছিয়ে নেচেছে, কুঁদেছে। অথচ বিক্রি ভালো হয়নি। এত করেও বাপের মতো বিক্রি তুলতে পারছে না, মাদুলি বিক্রি হয়েছে, কিন্তু কোনো কাজ আসেনি। মামলা—মোকদ্দমায় হেরে গিয়ে ওকে এসে ধরেছে। বলেছে, জুয়াচোর। কেউ কেউ গালমন্দ করেছে। মারধোর করেছে। ওর তখন ভয়ানক আপশোশ। জিয়ন হাড় বাদে সব তাবিজ—ওবিজ বে ফয়দা। সে নিজেই যেন নিজের নসিবকে ঠকাচ্ছে। রাহু চণ্ডালের হাড় না হলে গাছগাছালির দ্রব্যগুণ ফাঁকা মাঠে ঘোড়দৌড়ের মতো। সবই হবে—শুধু কাজ দেবে না। শুধু গালমন্দ জুটবে। সে এখন যেন মনে মনে বাপকে খুঁজছে। ডোমন সাকে খুঁজছে। মনে মনে বাপের কথা আওড়াচ্ছে। হাকিমি বলিস, দানরি বলিস, এ চীজ বেইমান মানুষের দু—দশ দফে কাজে লাগে। আউর শালা শুনে লে, রাহু চণ্ডালের হাড় লাগে, তুরা যাকে বলিস জীয়ন হাড় কিংবা ব্রেহ্ম চণ্ডালের হাড়। দানরি—ফানরিতে হাড়টাই সব।

নেলির বাচ্চা এতদিনে হামাগুড়ি দিচ্ছে চটানে। হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে পড়ে যাচ্ছে। অঃ…অঃ…করে কথা বলছে। কাক তাড়াচ্ছে। মাছি, ব্যাঙ তাড়াচ্ছে। হেঁটে হেঁটে ঘাটোয়ারিবাবুর ঘরে চলে যাচ্ছে। ঘাটোয়ারিবাবুর পায়ের কাছে বসে সারাদিন খেলছে। ঘাটোয়ারিবাবুও কথা বলছেন ওর সঙ্গে। ঘাটোয়ারিবাবুও অঃ অঃ করছেন। হাত নেড়ে, চোখ বড় করে, পু পু করে কথা বলছেন, খেলছেন সারাদিন। তিনি এখন বাচ্চাটাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বাচ্চাটাকে নিয়ে মন্দ কাটছে না।

গঙ্গা—যমুনা সঙ্গে এখন যাচ্ছে না। ওরা চটানে বাচ্চাটার পাহারায় থাকছে।

অশ্বত্থ গাছের শেষ পাতাটা থেকে যখন সূর্যের রঙ সরে যায়, গেরু ওর পুঁটুলি বেঁধে কাঠের বাক্স মাথায় নিয়ে পাশের দোকানিকে বলে, দাও ত দেখি, এবার তবে উঠতে পারি।

দোকানি এক পয়সার একটা বিস্কুট দিল। গেরু বিস্কুটটা একটুকরো কাগজে মুড়ে সযত্নে পকেটে রাখে, তারপর হারিকেন জ্বালিয়ে শহর ধরে গঙ্গায় নেমে যায়। চটানটা দেখলেই নেলির বাচ্চার কথা মনে হয়। বাচ্চাটাকে একটা বিস্কুট খাওয়াতে পারলে খুশি হয় সে। চটানে উঠে গেরু ডাকল, চাচা হামার কাঁহারে? চাচা।

নেলি যেদিন সকাল সকাল গাওয়াল করে ফেরে, সেদিন বাচ্চাটা ওর কোল থেকেই অঃ…অঃ….করে উঠবে। দুহাত নাড়বে। কল—কল করে উঠবে। যেদিন ফিরবে না, সেদিন হয় দুঃখবাবুর ঘরে, নয় ঘাটোয়ারিবাবুর ঘরে থাকবে। গেরুর গলার আওয়াজ পেলেই জানালা দিয়ে উঁকি দেবে। শব্দ পেয়ে গেরু জানালায় দাঁড়াবে। আলোটা তুলে ধরে বলবে, চাচা খা লে।

তখন ঘাটোয়ারিবাবু চেয়ারে বসে চোখ বুজে থাকেন। চোখ বুজেই বলেন, গেরু এলি?

হে বাবু, এলাম।

ব্যবসা তোর চলছে কেমন?

আচ্ছা না বাবু। আচ্ছা না চলছে। তারপর ধীরে ধীরে গেরু জানালা থেকে মুখটা নামিয়ে নেয়। ব্যবসা জমে উঠছে না। মন ভারী হয়ে উঠেছে দিন দিন। দিন দিন কেবল বাপকে মনে পড়ছে আর রাহু চণ্ডালের হাড়ের কথা ভাবছে সে। এ সব ভেবে চটানে উঠে যেতে থাকে। এ সময় শনিয়া আসে। গেরুর মাথা থেকে কাঠের বাক্স নামাতে সাহায্য করে। হাত—মুখ ধোয়ার জল রাখে দাওয়ায়। ঘরে ঢুকে মাচানে বসে গেরু বলে, রাহু চণ্ডালের হাড় না হলে আর চলছে না বৌ। বাদী—বিবাদীরা রোজ বচসা করছে। মাদুলি কেউ লিচ্ছে না। সবাই বলছে আমি ধোঁকা দিয়ে পয়সা লিচ্ছে।

তু খেয়ে লে ত। তা হবেক পরে হবে।

খেতে খেতে গেরু বলল, নেলি ফেরেনি?

না।

নেলির ব্যবসাও আচ্ছা যাচ্ছে না বুল।

হামি কী করে বলব?

শনিয়া একটু পচাই ঢেলে বলল, লে, খা লে। শনিয়া জানে এই পচাইটুকুর বিনিময়ে গেরু চটানের সব দুঃখের কথা ভুলে যাবে। তখন ওর মনে হবে দুনিয়ায় বেঁচে সুখ আছে! দুনিয়াকে ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট।

সব পচাইটুকু শেষ করে গেরু ঝিম মেরে বসে রইল। শনিয়া ওর হাত মুখ ধুয়ে দিয়ে মাচানে তুলে দিল। গেরু মাচানে বসে ঝিমায়। চার্চের ঘড়িতে তখন কে ঘণ্টা পেটাচ্ছে। তখন নেলি নিজের ঘরে বসে আদর করছে বাচ্চাটাকে। ঘাটোয়ারিবাবু সুর করে মহাভারত পড়ছেন। কেউ বচসা করছে ঝাড়োর সঙ্গে। ওদের উনুনে আজ হাঁড়ি চড়েনি। বচসাতে সে সব ধরতে পারছে। দু’চারদিন পরে এ ঘরেও হাঁড়ি চড়বে না। বিক্রি খুবই কমেছে। নেই বললেই চলে। দুটো পেটের দায় ওকে পীড়িত করতে থাকল। হাড় সংগ্রহের জন্য নানাভাবে চিন্তায় ডুবে যেতে থাকে। গেরু নিষ্ঠুর হতে চাইছে, বীভৎস হতে চাইছে। সে বাপকে মনে করতে পারছে। রসিদের দরগা, কালীর থান এবং অনেক বীভৎস গল্প যা বাপের কাছে শুনেছে—সব মনে করতে পারছে। গেরু একটা মদের ঢেকুর তুলল। পাশের ঘরে এখনও পু পু করছে….বাচ্চাটা। ওর লোভ বাড়ছে। গেরু নিষ্ঠুর হতে চাইল। বীভৎস হতে চাইল। বাচ্চাটা কখন ঘুমোবে! নেলি কখন ঘুমোবে। গঙ্গা—যমুনা কখন নদীর ঢালুতে নামবে। কখন নেমে যায়? কখন ঘাটোয়ারিবাবু জেগে থাকবেন না—কখন, কখন এমন সব ঘটবে। সে মাচানে বসে অধীর হয়ে উঠল। মনে মনে সে ভারী নিষ্ঠুর। মায়া দয়া নেই এবং মমতাহীন। নেলির বাচ্চাটাকে সে রাতের আঁধারে চুরি করে খুন করতে চায়। খুন করে হাড় সংগ্রহ করতে চায়।

অথচ ভোর হলে রাতের ভাবনাটা আর থাকে না। শরীরটা হালকা লাগে। মন মেজাজ দুই—ই তখন প্রসন্ন। তখন মনে হয় কী দরকার এভাবে বেঁচে। এবং ফের ফরাসডাঙায় যাবে অথবা ঝুমঝুমখালিতে—কঙ্কাল খুঁজে খুঁজে বেড়াবে। দুটো পেটের দায়ে একটা খুনখারাপির দিকে টেনে নিয়ে যাবে? মনে মনে সে সত্যি তা চাইল না।

সে ভোরে উঠল। গামছাটা কাঁধে ফেললে। বাবুচাঁদ শুয়োর নিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। এখন ভরা গাঙ। চটান থেকে বর্ষার জলে নৌকা দেখা যাচ্ছে। পাল দেখা যাচ্ছে। মাস্তুলের ডগায় দু—একটা পাখি বসে আছে। সূর্যের গাঢ় রঙ নদীতে—শ্মশান চটানের খুব কাছাকাছি এখন। এ ভোরে এই সব দেখে বাচ্চাটাকে দেখার ইচ্ছা গেরুর প্রকট হয়ে উঠল। সে বাইরে থেকে ডাকে, চাচা ঘুম থেকে উঠলি? ভিতরে ঢুকে গেল সে। বাচ্চাটা নেলির পাশে বসে খেলছে। নেলি ঘুমোচ্ছে। গেরুকে দেখেই ওঠার জন্য দু হাত বাড়িয়ে দিল। গেরু তখন কথা বলছে, ভয় দেখাচ্ছে কোলে নেবে না। রাগে দুঃখে অভিমানে নেলির চুল ধরে টানে বাচ্চাটা। নেলি ঘুমের ভিতরই বলল, বাপ, তু হামারে জ্বালাসনে। থোড়া ঘুম যেতে দে। এই ঘুমের ভিতর নেলি যেন কত বছর আগে চলে গেছে। গেরু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। ভারী মজা পায়।….শনিয়া যদি এমন একটা বাচ্চা দে লিত চটানে।

গেরু বলল, চল হারুয়া, গঙ্গার ধারে চল। নেলির দিকে চেয়ে বলল, হামি হারুয়াকে লিলামরে নেলি।

আজ গেরু কোর্ট—কাছারি করতে গেল না। যা আছে তাতে ওরা দু—পাঁচ দিন খেতে পারবে। কাছারিতে গেলেই এখন শমনের মতো লোকগুলো ওর চারপাশে জড়ো হতে থাকে। অপমান করার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। গেরু দুটো কথা বলতে উঠলে ওরা বলে ধোঁকাবাজ। গেরু বাপের মতো কসরত দেখিয়ে যখন সমস্ত জনতাকে বশ করে আনে তখন হয়তো একটিমাত্র লোক বলে ওঠে, এ সব মাদুলি—ফাদুলিতে কোনো কাজ হয় না। সোয়া পাঁচ আনা পয়সাই জলে। গেরু তবু থামে না। লোকটার কথা পরোয়া করছে না। এমনি ভাব ওর চোখে—মুখে। সে নাচে, লাফায়। সে বলে বিশ্বাসে আশ্বাস বাবু। দশজনের কথায় কান দেবেন না। নিজের শরীরে ধারণ করে লেন। পরখ করেন। বিশ্বাসে আশ্বাস বাবু। বিশ্বাসে আশ্বাস।

কিন্তু ঐ একটিমাত্র লোকই ওর ব্যবসায় ক্ষতির পক্ষে যথেষ্ট। লোকগুলো ওর নাচন—কোঁদন দেখে মাত্র। তামাশা দেখে মাত্র। নাচন—কোঁদন থেমে গেলেই ওরা ধীরে ধীরে সরে পড়ে। মনে হয় এতক্ষণ ওরা ওর কেরামতি দেখার জন্যই দাঁড়িয়ে ছিল। সে বিরক্ত হয়ে বলে, শালারা! একটা জীয়ন হাড় লাইরে! তবে তুগো সমঝে দিতে পারতাম হাকিমি দানরি বুলে কাকে!

গেরু গঙ্গার ধারে হারুকে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে এমনি সব কথা ভাবে।

বর্ষার গঙ্গা বলে সে নিচে নামতে পারল না। এক মাল্লা, দু মাল্লা—সব নৌকাগুলো ঘাটে ঘাটে ভিড়ছে। ফজলি আমের নৌকা। কাঁঠালের নৌকা। গেরু হারুকে নিয়ে নৌকার আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। আম কাঁঠালের গন্ধ নাকে আসে। দুটো একটা পাখি ওড়ে নদীর জলে। ওদের ছায়া পড়ে না। জল ঘোলা। জলে ঘূর্ণি। ঘূর্ণিতে একটা গোবরে পোকা ডুবছে। পোকাটাকে ডুবতে দেখে গেরুর কেমন কষ্ট হতে থাকে।

হারুর দিকে চেয়ে বললে গেরু, কিরে সাঁতার দিয়ে লিবি? তুর মায়ী ত সাঁতারে গঙ্গা পার হত।

হারু দুটো হাত একসঙ্গে করে নাড়তে লাগল। পু…পু করতে থাকল। যেন গেরুর কথা সে কত বুঝতে পেরেছে।

গেরু খুশি হয়ে হারুকে দু হাতের ওপর নাচাল। মাথার ওপর ঘোরাল। তারপর গালটা গালে ঘষে দিয়ে খুব জোরে দু’টো চুমু খেল। —আঃ। অদ্ভুত সে একটি শব্দ তুলল গলায়।

জল নামছে নিচে। ঘূর্ণি উঠছে। ঘোলা জল। অন্যপারে একটা ধস পড়ার শব্দ হয়। গেরু দেখে ধসটা একটা অতিকার কচ্ছপের মতো যেন নদীর গর্তে নেমে গেল। হারু ওর কোলে। হারু নিচে নামতে চাইছে। নিচে নেমে দুষ্টুমি করতে চাইছে। গেরু ওকে দুষ্টুমি করার সুযোগ দেওয়ার জন্যই যেন নিচে নামিয়ে দিল। হারু তখন হামাগুড়ি দিচ্ছে, হারু তখন ছুটছে। গেরু যত ওকে ধরার জন্য ছুটছে, সেও তত চুটছে এবং হামাগুড়ি দিচ্ছে। হেসে গড়িয়ে পড়ছে। গেরু অনেকক্ষণ ওর সঙ্গে ছুটাছুটি করল। অনেকক্ষণ হাসল। অনেকক্ষণ ওরা দুজনে নদীর পাড়ে, নদীর হাওয়ায় নদীর জলে পুলকিত হল। তারপর একসময় ওরা নদীর পাড়ে চুপচাপ বসে থাকে। নদীর জল দেখে, ঘূর্ণি দেখে। ধস নামা দেখে। গুণ টানা নৌকায় ছইয়ের ওপর মাঝিদের গান শোনে। গেরু এবং সে এই সব দেখে আপাতত মশগুল হয়ে থাকে।

গেরু হারুকে নিয়ে বেশ মশগুল হয়েছিল। অনেকদিন হারুকে কাঁধে করে নদীর পাড়ে পাড়ে অনেক দূরে চলে গেছে। বর্ষার ভরা গাঙে দু—পা ডুবিয়ে বসেছে। এখন দুটো একটা কথা বলতে পারছে হারু। গেরুর হাতে পায়ে ভর করে ধরে কাঁধে উঠবার চেষ্টা করত হারু। কত রকমের কথা বলত। সে পাখি দেখলে বলত, গেউ….চাচা….পাখ….ই….। গেউ চাচা ফস—দাঙ্গা যাবে। গে…উ চা…চা…ল…দি…য় পা…নি…খাব…অ…।

গেরু চুপচাপ বসে থাকে। জলের ধারে ওর ছায়া পড়ে তখন। হারু কথা বলে—রাজ্যের কথা। গেরুর খুব ভালো লাগে। অভাবের যন্ত্রণা ভুলে থাকতে পারছে। নদীর অন্য পারে সানাই বাজে। বাবুদের বাড়ি বিয়ে। বাপ ওর বিয়ে দিয়েছিল! বিবি ওর এখনও চটানে আছে। কোনদিন চটানে ছেড়ে ভাগবে। কোনদিন বলবে, তুর লাখান মরদ হামার লাগে না। আমি অন্য চটানে উঠে যাবে। গেরু যেন সেই ভয়ে চটানে বেশিক্ষণ থাকে না। যতক্ষণ পারে চটানের বাইরে কাটিয়ে সাঁঝ লাগলে চটানে উঠে যায়। কখন জানি বলবে মেয়েটা, চললাম রে মরদ। কখন জানি বলবে মেয়েটা—হামার মরদ বটে তু। দুটো পেটের দানা চটানে তুলতে লারিস। সাঁঝ লাগলে চটানে উঠত গেরু, কিন্তু শনিয়ার সঙ্গে কথা না বলে মাচানে উঠে শুয়ে পড়ত।

কোথায় যেন চলে যায় নেলি—ফিরতে গভীর রাত করে। মালসা মালসা খাবার আনে। হারুকে পেট ভরে খেতে দিয়ে সকলকে মুঠো মুঠো দেয়। নিজে খায় পেট ভরে।

ঠিকমতো খেতে না পেয়ে শনিয়া দিন দিন শুকনো কাঠ হয়ে যাচ্ছে। চুরি—চামারি করে গেরু আজকাল যা হচ্ছে—শনিয়াকে সে কথা জানতে দিচ্ছে না। পয়সায় সে কেবল মদ গিলছে। মদ গিলে আজকাল কেমন চেহারা হয়ে উঠেছে, কেমন বেলেল্লাপনা করতে শিখেছে। দুনিয়াতে কিছুই তার আর ভালো লাগছে না। শুধু হারুকে নিয়ে কোথাও চলে যেতে ভালো লাগছে। কোথাও বসতে অথবা ওকে ভালোবাসতে ভালো লাগছে। যত এমন হয় তত ওর একটা বাচ্চার শখ জাগে। ওর বাপ হতে ইচ্ছা হয়। হারুর মতো রাজ্যের পাখি টিকটিকিদের সঙ্গে কথা বলুক ওর বাচ্চাটা এই শখ মনে মনে। যত এই সব মনে হয়, তত হারুকে কোলে নিয়ে ঘুরতে ইচ্ছা করে। তত সে হারুকে কাঁধে করে মাঠ, নদী, বন পার হয়ে যায়।

গেরু কোনো কোনোদিন হারুকে কাঁধে নিয়ে নদীর পারে সূর্য ওঠা দেখে। সূর‍্যাস্ত দেখে, নক্ষত্র দেখে! পৃথিবী, আকাশ, গাছপালা পাখি দেখে। ওরা এই ধরণিকে ভালোবাসতে চায়। এই ধরণিকে ভালোবেসে বাঁচতে চায়।

বর্ষার রাতে চটানে ফিরে গেরু দেখল, শনিয়া মাচানে পড়ে আছে। শনিয়ার চোখ দুটো ছলছল করছে। গেরুকে অপলক দেখছে শনিয়া। ভুখা থেকে শনিয়া বুঝি কথা বলতে পারছে না।

শনিয়ার চোখ দুটো দেখে গেরুর খুব কষ্ট হতে থাকে। ভুখা থেকে মেয়েটা বুঝি মরে যাবে—তবু চটান ছেড়ে যাবে না। চোখ দুটো শনিয়ার এমন ভাবই প্রকাশ করে। গেরু শনিয়ার পাশে বসে। অথচ কিছু বলতে পারে না। আদর অথবা কোনো সোহাগের কথা বলতে পারল না। এ সময় শনিয়াকে কী বলা যায়। কী বললে শনিয়া সুখ পাবে—সে ভেবে পেল না। অথচ শনিয়া গেরুর হাত টেনে বুকের কাছে রাখল এবং ইশারা করে একটু ঘন হয়ে বসতে বলল। গেরু ঘন হয়ে বসল এবং শনিয়ার ঠোঁট নড়তে দেখে বলল, তু কিছু বুলবি?

শনিয়া হাসল। ঠোঁট দুটো বেত পাতার মতো কাঁপছে। পাতলা ঠোঁটে অল্প হাসিটুকু গেরুর খুব ভালো লাগছে।

শনিয়া বলল, তু কেবল বাইরে বাইরে থাকিস। তু হামারে দেখবি না?

গেরু বলল, জরুর দেখব। লেকিন তুকে কিছু খেতে দিতে পারছি না, বহুত কষ্ট হামার।

কোনো কষ্ট না আছে। তু আয়, কথা শোন।

গেরু নিজের মুখটা শনিয়ার ওপর নামিয়ে দিল।

শনিয়া ফিসফিস করে বলল, হামার পেটে তুর একটা বাচ্চা এয়েছে গেরু। বহুত সুখের কথা বাচ্চাটা তুকে বাপ ডাকবে, হামারে মায়ী ডাকবে। বলতে বলতে শনিয়ার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। গেরুরে গেরু, তু আচ্ছা হো যা। হামি ভালো হয়ে উঠব। হামি কাজ করবে তু কাজ করবে। একটা বাচ্চার কৈ দুখ না থাকবে।

গেরু আনন্দে অধীর। ইচ্ছা হয় সকলকে ডেকে বলে, হামভি চটানে মরদ বনে গিলাম। কিন্তু রাত বলে, সকলে ঘুমিয়ে পড়েছে বলে, সে শনিয়াকে কাঁধে ফেলে ঘুরতে থাকল। কয়েকটা পাক খেল ঘরে, শনিয়া চিৎকার করছে গেরু হেরে তু করছিস কি! খুশির চোটে তু কী হামারে মেরে ফেলবি!

গেরু শনিয়াকে মাচানে শুইয়ে দিল। দু দণ্ড পাশে শুয়ে থাকল। তারপর সে শনিয়াকে মাচানে রেখে শহরের দিকে চলে যাওয়ার আগে বলল, তু ঘুম যাস না। হামি আ—ভি ফিরে আসবে।

সারা রাত ঘুরে শহরের কোনো ঘরে, কোথাও সে চুরি করতে পারল না। ভোর রাতের দিকে সে ফিরে এল। সে দেখল মাচানে তখন শনিয়া জেগে আছে। সে বললে, না—রে কিছু হল না।

শনিয়া মাচানের নিচে থেকে একটা থালা বের করে দেয়। তু খা লে। নেলি হামারে একথাল, তুরে একথাল দিয়ে গেল।

গেরু খেতে খেতে বলল হামার ভি একটা বাচ্চা হবে। হামার ভি ঘর হবে। লেকিন অভাব হামার যাবে না শনিয়া। একটা জীয়ন হাড় না হলে তু মরবি, হামি মরবে, বাচ্চাটা ভি মরবে। একটা বেহ্ম চণ্ডালের হাড় হামার জরুর লাগে। গেরু এ সময় হারুর বিবর্ণ মুখটা দেখতে গেল।

তখন ঘাটোয়ারিবাবু কালো রঙের চেয়ারে বসে জানালার গরাদে নিরবধিকালের মুহূর্তকে প্রত্যক্ষ করলেন। দূরে কে যেন কালের ঘণ্টা বাজায়! সবই প্রত্যক্ষ করলেন এবং ভাবলেন—বিস্বাদ, বিস্বাদ শুধু। শুধু যন্ত্রণা, শুধু মৃত্যু, শুধু বিষণ্ণতা। ভিন্ন ভিন্ন সব যন্ত্রণার প্রহসন। বরং কোথাও চলে যাওয়া ভালো। মৃত্যুর প্রহসনে, যন্ত্রণার রাজ্যে বেঁচে সুখ নেই। যত নেলির ছেলে বড় হচ্ছে, যত দুঃখবাবু চটানে এসে ছেলের দুষ্টুমির গল্প করছেন তত ঘাটোয়ারিবাবু এই সব ভেবে অধীর হচ্ছেন। আর ভাবছেন দূরে কালের ঘণ্টা কে যেন বাজায়!

পাখিরা আকাশে নেই। পুরোনো অশ্বত্থের নিচে দুটো কাক মরে পড়ে আছে। দুটো দোয়েল আকন্দ গাছটার ছায়ায় বসে জানালার গরাদে ঘাটোয়ারিবাবুকে দেখছে। ওর চোখ, মুখ দেখছে। ঘাটোয়ারিবাবু জানালায় কেমন পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছেন। বর্ষার নদী দেখছেন। নদীটা চটানের পোয়াতী বৌদের মতো কলকল করছে। দোয়েল দুটো এখন শিস দিচ্ছে। নেলির ছেলেটার বয়স বাড়ছে। অফিস বারান্দায় হাতে লাঠি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে জানালায় উঁকি দিচ্ছে। হাত—পা নেড়ে কত রকমের কথা বলছে। বড় বড় চোখ হয়েছে বাচ্চাটার। নাক, চোখ, মুখ নেলির মতো। মুখের গড়নটা, শরীরটা, দুঃখবাবুর মতো। ঘাটোয়ারিবাবু এ সময় কিঞ্চিৎ হাসলেন। ব্রাহ্মণের ঔরসে চণ্ডালিনীর গর্ভে সন্তান—কৈলাস হলে বলত, বেম্ম চণ্ডালের ছা। তিনি কিঞ্চিৎ হাসলেন। তেমন ছা থেকেই রাহু চণ্ডালের হাড় হয়। শুধু হাড়টার ওপর এক রোজের পুজো আর্চা কালীর থানে মানত। বাচ্চাটাকে জলের নিচে চুবিয়ে মারা এবং রাতে শ্মশানকালীর পুজো। যখন কৈলাস প্রথম এল চটানে, যখন সে হেকিমি করত কোর্টে, তখন সে বলত, বাবু ও বড় লাখোটিয়া চীজ আছে। এ সহজে মিলবে না বাবু। ওস্তাদ রসিদ বহুত কসরত করে পেরাগের থেকে একটা বেম্ম চণ্ডালের ছা চুরি করেছিল। তারপর বহুত তন্তর—মন্তর তারপর বাচ্চাটাকে জলে শ্বাস বন্ধ করে মারা। বলতে বলতে কৈলাস কেমন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ত। ঘাটোয়ারিবাবু এখনও যেন তার কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন। যেন কৈলাস ওর পিছনে দাঁড়িয়ে এইমাত্র কথাগুলো বলে গেল। হাড়টা চুরি যাবার পরও কৈলাস কতবার এসেছে বাবুর কাছে। বসেছে, বলেছে, একটা হাড় লাগে বাবু। লেকিন কাঁহা মিলে! কাঁহা মিলে! নেলির বাচ্চাটাকে দেখে বাবুর মনে হল কৈলাসের প্রেতাত্মা যেন ওর চারপাশে ঘুরছে। ওর শরীর থেকে হাড় বের করে নেওয়ার জন্য দিনরাত সেই প্রেতাত্মার চোখে ঘুম আসছে না। প্রেতাত্মা চটানের চার পাশটায় ঘুরছে ফিরছে। ফাঁক খুঁজছে চুরি করবার জন্য।

ঘাটোয়ারিবাবু ধমক দিলেন, এই তুই এখানে কেন? তোর মা কোথায়?

হারু বড় বড় চোখে তাকাল। বাবু যে ওকে ধমক দিচ্ছে ও বুঝতে পারল। বুঝতে পেরে সে কাঁদল।

ওঃ কাঁদা হচ্ছে। আমি তোর ভালোর জন্যই বলছি। একা একা কোথাও যাবি না। তোর মা কোথায়? মাকে ডাক, কথাটা বলে দি। দিনকাল খুব খারাপ।

হারু কিছু বুঝতে পারল না। সে একটা থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। লাঠি দিয়ে মেঝেতে বারবার আঘাত করল। সে বাবুর মতো আকাশ কিংবা পাখি দেখলে না। দেয়াল ধরে টিকটিকি নামছে। সে লাঠি দিয়ে টিকটিকিটা মারতে গেল। হাত দিয়ে ধরতে গেল। ভয়ে উপরে উঠে গেল টিকটিকিটা। নাগালের বাইরে গিয়ে লেজ নাড়তে লাগল। হারু টিকটিকিটা ধরতে না পেরে রাগে বাইরে ফেলে দিল। তারপর ভিতরে ঢুকে বাবুর পায়ের কাছে বসল। বাবুর পায়ের চুল ধরে টানতে থাকল।

এই শালা ব্যথা পাচ্ছি। ব্যাটা তো দিন দিন খুব পাজি হয়ে উঠছে। তুই যে লোম ধরে টানছিস আমি ব্যথা পাই না রে?

হারু বলল, বাউ…ত…ত।

ঘাটোয়ারিবাবু সোহাগ করলেন, বাউ—ত—ত—। আমি বুঝি তত বাবু?

টিকটিকিটা দেয়ালে ক্লপ ক্লপ করল। ক্লপ ক্লপ করে টিকটিকিটা একটা মাছিকে আক্রমণ করছে। ঘাটোয়ারিবাবু ক্লপ ক্লপ শব্দ শুনলেন। তিনি বাইরে এসে টিকটিকি দেখলেন। দেখছেন। মাছিটা দূরে গিয়ে বসেছে। টিকটিকিটা উপরে উঠে গেল। কোনো আক্রমণের ইচ্ছা এখন আর নেই। বড় শান্তশিষ্ট জীব। তিনি দেখলেন টিকটিকির চোখ, মুখ গেরুর মতো এবং হারু মাছি হয়ে দেয়ালে উড়ছে। টিকটিকিটা আনন্দে দেয়ালে লেজ নাড়ে। এইসব দেখে, কৈলাসের প্রেতাত্মা গেরুর চোখে ঘুম নেই—ঘাটোয়ারিবাবু যেন টের করতে পারছেন। গেরুর হাকিমি ব্যবসাটা তিনি ভালো চোখে দেখছেন না। গেরু ফের কোর্ট—কাছারি যেতে আরম্ভ করেছে। ফের রসল্লা দিচ্ছে ঘরে।

যতদিন যাচ্ছে গেরুর অভাব তত বাড়ছে। নেলি রোজ রাতে কিংবা দিনে বের হতে পারছে না। চটানের ওপর দিয়ে আশ্বিন মাস গেছে কার্তিক মাস যাচ্ছে। গেরু শুধু রসল্লা দিয়েই যাচ্ছে। দুঃখবাবু এসে শুধু গল্প করছেন, কোনো কাজের নাম নেই। এবার একটু চাপ দিতে হবে। খড়ি কাঠ নেই। কাঠ সংগ্রহের জন্য ওকে যেতে বলতে হবে। অনেক কাঠের দরকার হয়ে পড়েছে। কিছুদিন থেকে খুব মড়া আসতে শুরু করেছে ঘাটে। কার্তিক মাসের টানে বুড়োরা মরছে খুব। রোজ তিনটে চারটে করে আসছে। জ্বলছে। খুব দূর থেকে আসছে সব—দশ ক্রোশ, বিশ ক্রোশ হবে। তখনই মনে হল তার, কালের ঘণ্টা কে বাজায়!

হারু হেঁটে হেঁটে বেড়াচ্ছে বারান্দায়। কোনো ভয়ডর নেই। নেলি চটানে পড়ে আছে ক’দিন থেকে। ঝাড়োর ঘরে পাতি তুলছে। হারুকে দেখে বুড়ো মানুষেরা মরছে খুব এ—কথাটা কেন যে মনে হল তাঁর। তিনি তাঁর শরীরের সব গ্রন্থিগুলো দেখে বিষণ্ণ হলেন। মৃত্যুর ইচ্ছা এ শরীরে যেন প্রকট হচ্ছে। মৃত্যু—মৃত্যু—মৃত্যু। তিনি বারান্দায় পায়চারি করার সময় উচ্চারণ করলেন। তিনবার তিনি ঈশ্বরের স্মরণ নিলেন। তিনবার তিনি সকলের অলক্ষ্যে হারুকে প্রদক্ষিণ করলেন। যেন হারু ওঁর সন্তান। অথবা হারু তাঁর এক অন্য জীবনের প্রতীক। হারুকে দেখলে ওঁর মন অযথা খুশির ইচ্ছায় উদার হতে থাকে। তখন বাঁচার ইচ্ছা তীব্র হয়। তখন পৃথিবীর কুটোগাছটা পর্যন্ত অর্থবহ মনে হয়। তখন চটান ছেড়ে চলে গিয়ে অন্য পৃথিবীর মানুষ হয়ে বাঁচতে ইচ্ছা হয়। মৃত্যু—নরক এবং যন্ত্রণার প্রতীক।

যে ভোরে তিনি এমনসব ভাবছিলেন, সে রাতেই ঘটনাটা ঘটল। দুঃখবাবু ঘরে ফিরে গেছেন। কাকপক্ষীর কোনো সাড়া নেই চটানে। মদ খেয়ে হল্লা করছে কেউ। রাত না নামতেই চটানটা নিঝুম হয়ে গেছে, কেমন ফাঁকা ফাঁকা কেমন নিঃসঙ্গ। নেলি সকাল সকাল শুয়ে পড়েছে মাচানে। গঙ্গা—যমুনা, নিচে ঘুমিয়ে আছে। হারু অন্য পাশটায় উপুড় হয়ে ঘুমোচ্ছে। ঘাটোয়ারিবাবুর শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না বলে তিনি সকাল সকাল শুয়ে পড়েছেন। ঘাটে কোনো মড়া জ্বলছে না। ওপারে রেলের শব্দ পর্যন্ত সে রাতে ওঠেনি। ট্রেনটা যেন কোথাও আটকে আছে। অথবা কোথাও আটকে গর্জাচ্ছে, ফুঁসছে। রাতের ঘন আঁধারে লক্ষ লক্ষ মৃত্যুর দূত যেন পায়চারি করে বেড়াচ্ছে চটানে। লক্ষ লক্ষ প্রেতাত্মা যেন উড়ছে চটানের উপর।

গেরু দরজা দিয়ে বের হবার সময় শনিয়া হাত টেনে ধরল—তু না যাস গেরু। হামার কীরা। তু না যাস। ও কাম করতে হবে না। হামি উপুস করবে, মরবে লেকিন তু এ কাম না করবি।

গেরুর চোখ দুটো জ্বলছে! হিংস্র এবং অমানুষের মতো লাগছে গেরুকে দেখতে। সে বলল, তু হাত ছেড়ে কথা বুল মাগি। তু জায়দা ঢঙ মাত দেখা আভি। হামি এক রাতে জরুর ফিরে আওগে। তু হাম কাঁহা ভি চল যাউগে। বলে গেরু জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিল! কৈ আদমি তুকে কিছু বুলে তো তু বুলবি হামি না জানে ও কাঁহা গেছে! এ বাত তু মনে রাখিব। লয়তো তু ভি খুন হো যাবি চটানে—বুলে দিলাম।

তারপরই গেরু চটানে নেমে কেমন হিহি করে কাঁপতে থাকল। বড় শীত করছে। হাত পা শিথিল। চটানে নেমে ওর মনে হচ্ছে মাথাটা ঝিমঝিম করছে। প্রথম রাতে মড়া তুলতে গিয়ে ফরাসডাঙায় যেমন তার হয়েছিল চোখে—মুখে, মনে সে ভাবটা হুবহু কাজ করছে এখন। মনে হচ্ছে দূরে কেউ যেন শোকের কান্না কাঁদছে। গলা টিপে ধরলে যে শব্দটা গলা থেকে বের হয়—সে শব্দটা কাছাকাছি কোথাও উঠেছে। অথবা কোনো মানুষকে জলের নিচে শ্বাস বন্ধ করে মারলে ফুসফুসের রংটা যা হয়, ওর চোখে সেই রং। সে নিশ্বাস নিতে পারছে না। সে যেন মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। তবু তবু সে যাচ্ছে। তবু তবু সে হাঁটছে। কোমরে চাদর বাঁধল গেরু, গামছা দিয়ে মাথাটা পেঁচিয়ে নিল। তারপর কিম্ভূতকিমাকার মানুষ হয়ে একটা ভয়ংকর শ্বাপদের মতো চটানে হামাগুড়ি দিতে থাকল। আঁধারে গেরুকে আর দেখা যাচ্ছে না। গেরু হাঁটছে—হাঁটছে।

দরজায় জবুথবু হয়ে শনিয়া দাঁড়িয়ে আছে। ওর ইচ্ছা হল চিৎকার করতে। ইচ্ছা হল বলতে, গেরু তু না যাস। গেরু তু খুন মতো কর। হামি তুর সাথে যাবে, তুর সুবিধা অসুবিধা দেখবে। কিন্তু গেরুকে তখন দেখা যাচ্ছে না। নেলির ঘরেও কোনো চিৎকার উঠছে না। সে দরজায় দাঁড়িয়ে হারু কিংবা নেলির চিৎকার শোনার অপেক্ষায় রইল।

নেলি যদি মাচানে জেগে থাকত, সে দেখতে পেত, দুটো ভয়ংকর হিংস্র হাত ওর মাচানের ওপর এগিয়ে আসছে। সে দেখতে পেত, গঙ্গা—যমুনা চোখ তুলে তাকিয়ে পরিচিত জন বলে কিছু বলছে না। গেরু প্রথমে গঙ্গা—যমুনাকে আদর করল। দুটো মুড়ি দিল খেতে। শেষ মাচানের ওপর ঝুঁকে ঘুমন্ত হারুকে কাঁধে নিয়ে ধীরে ধীরে চটান থেকে ভালোমানুষের মতো নেমে গেল। হারুকে নিয়ে যেন বেড়াতে যাচ্ছে এমন ভাব গেরুর।

সকলে তখন ঘুমোচ্ছে চটানে। কেবল শনিয়া ঘটনার সাক্ষী হয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে। অথচ বাচ্চাটা একবারও কেঁদে উঠল না। সে বিস্মিত হয়ে কেবল দরজায় দাঁড়িয়ে থাকল। গেরু কোনো পথ ধরে চটান থেকে নেমে যাচ্ছে দরজায় দাঁড়িয়ে সে তা ধরতে পারছে।

গেরু চটান থেকে ছুটতে থাকল। কার্তিক মাস শেষ হয়ে আসছে। কার্তিক মাসের রাত্রি। নদী এখন অনেক নিচে নেমে গেছে। সে নদীর পাড় ধরে ছুটল। হারু ভয়ে এখন চিৎকার করলেও চটানের কেউ শুনতে পাবে না। ঘাসের ওপর শিশির পড়েছে। সে শিশির মাড়িয়ে চলল। রাতের কোনো পাখি ঝোপে জঙ্গলে ডাকছে না। ওপারে ট্রেনের শব্দ নেই অথবা আলো এসে পড়ছে না। সুতরাং সে ছুটতে থাকল। চোরের মতো নদীর পাড়ের দিকে ছুটছে।

সহসা কোনো প্রবল ঝাঁকুনিতে হারুর ঘুম ভেঙে গেল! সে ভয় পেল। সে দেখল আঁধারে কে যেন ওকে মাটি থেকে তুলে নিচ্ছে। কে যেন ফের ওকে নিয়ে ছুটছে। সে এবার কেঁদে উঠল। সে জোরে কাঁদতে থাকল।

গেরু ওর কান্না শুনে থামল। মুখের কাছে মুখ এনে বলল, তু চিনতে লারছিস। হামি তুর গেউ চাচা। তুকে নিয়ে হাম মেমান বাড়ি যাচ্ছে। তু রোনেসে আদমি লোক আচ্ছা না বুলবে হারুয়া।

গেরুকে চিনতে পেয়ে হারু নির্ভয় হতে পারছে। কার্তিক মাসের রাত। শীত শীত করছে হারুর। সে গেরুর শরীর জড়িয়ে থাকল। শরীরের উত্তাপ নিতে চাইল। বলল, গেউ চাচা মায়ী যাব। তু—উ মায়ী যাবি না? টু…প…লে…না।

হে, যাবে। জরুর যাবে। তুর মাইকা পাশ জরুর যাবে। লেকিন আভি কথা বুলে না। বাপ ত আচ্ছা আছে। গেরু যত হারুর সাথে কথা বলছে তত যেন ওর ভয় বাড়ছে। সে চলতে চলতে ভাবল ফরাসডাঙায় জঙ্গলে পোড়া বাড়িটাতে রাত কাটাবে। হারুর শরীরটা চাদরে পেঁচিয়ে ভাঙা পাঁচিলের আঁধারে ফেলে রাখবে। ভোররাতের দিকে কাঁঠাল গাছটার নিচে পুঁতে দেবে। তারপর সে কিছুদিন এধার ওধার করে বেড়াবে। কিছুদিন জল ঢালবে হারুর শরীরটার উপর। হারুর শরীর পচিয়ে বাঁ হাতের হাড় সংগ্রহ করবে। হাড়টা গঙ্গা জলে শুদ্ধ করে শ্মশানে কালীর পুজো দেবে একটা। শেষে সে বের হয়ে পড়বে। গাছগাছালি নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবে। সঙ্গে শনিয়া থাকবে, বাচ্চাটা থাকবে। বাচ্চাটা বাপ বলে ডাকবে। গেরু বলবে, শিখে লে শালা, এর নাম জীবন হাড়। এ হাড় দু—শ পচিশ দফে বেইমান মানুষের কাজে লাগে। জড়িবুটি, দ্রব্যগুণ, মন্তর—তন্তর এ সবের জেরাছে কারবার।

হারু গেরুর কাঁধে হাত—পা নেড়ে এখন খেলছে। অজস্র কথা বলছে। গেরু চাচার সঙ্গে ঘুরতে পেরে হারুর এ আঁধার খুব ভালো লাগছে। অন্য দিনের মতো বুকের ওপর হারু পা দুটো নাচাল। দোলাল। হাত তুলে আকাশের ছোট চাঁদকে ডাকল। গেরুর কপালে টিপ দিল। হাসল। সে অজস্র রকমের কথা বলে গেরুকে অন্যমনস্ক করতে চাইছে। সে ডাকল, গেউ চাচা…উ….উ….আ….আ। দূরে শেয়াল ডাকে। সে বলে বা…যা…জি…ভি। ..জু…জু। গে…উ চা…চা। পু….পু। হারু যেন এই কাক জ্যোৎস্নায় মেমান বাড়িই যাচ্ছে। কোনো ভয়ডর অথবা শঙ্কা জাগছে না। কোনো সংশয় জন্মাচ্ছে না। গেরু চলতে চলতে দেখল রাজ্যের সব ভয় ওকে এসে জড়িয়ে ধরেছে। হারুই যেন গেরুকে নিয়ে যাচ্ছে জলে ডুবিয়ে মারার জন্যে। গেরুর হাত কাঁপছে। পা কাঁপছে। হারু যত ঘাড়ে বসে রাজ্যের কথা বলে যাচ্ছে, তত গেরু বিষণ্ণ হয়ে পড়ছে। বিরক্ত হয়ে পড়ছে। হারুর সরল কথাবার্তায় গলা শুকিয়ে উঠছে গেরুর। সে এগোতে পারছে না। এগোতে কষ্ট হচ্ছে। ইচ্ছা হচ্ছে এক্ষুনি হারুকে মাটিতে আছড়ে অথবা গলা টিপে মেরে ফেলতে, কিন্তু সেই শরীর থেকে জীয়ন হাড় পাবে না ভেবে সে বিরক্তিতে চিৎকার করে ওঠে, হারু তু থাম, তু থাম। সে চোখ মুখ ঢেকে মাটিতে বসে পড়ে। হারু পাশে দাঁড়িয়ে আছে। গেরুকে এভাবে বসে থাকতে দেখে সে চুল ধরে টানতে থাকে। গেরুর মুখ দেখতে চায়। মুখ দেখে বলতে চায় গে…উ…চা…চা…তু…ভা…ল। হামি…ভা…ল। না…গে…উ….চা…চা।

হারুর মুখের দিকে চেয়ে গেরু ফের চিৎকার করে উঠল, তু থাম! তু থাম? গেরু কী ভেবে হারুকে কোলে তুলে নদীর দিকে নেমে যেতে থাকে। বেশি দেরি করলে সে যেন ধরা পড়বে। বেশি দেরি করলে সে নিজেই খুন হয়ে যাবে। সে ছুটে ছুটে নদীর দিকে নেমে যেতে থাকে, আর বলতে থাকে, তু থাম।

গেরু জোরে ধমক দেওয়ায় হারুর কেমন অভিমান হল। গেউ চাচা ওকে বকছে। হারুর অভিমান বাড়ছে। সে মুখ ফিরিয়ে রাখে। সে কথা বলে না। ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে চায়। গেরু অন্যদিনের মতো বলতে পারছে না, আয় বাপ তুকে কিছু না বুলবে। সে বলতে পারল না, অথচ ওর কষ্ট হতে থাকল। জলের দিকে সে যত নেমে যাচ্ছে কষ্টটা যেন তত বাড়ছে। তত আগেকার কথা নদীর ভরা বর্ষার কথা, একটি বিস্কুটের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। যত এই সব মনে হয় ততই সে জোরে ছুটতে থাকে। সত্বর সে ওকে জলে চুবিয়ে নিশ্বাসটা বন্ধ করে দিতে চায়।

গেরু কোমর জলে গিয়ে নামল। সে বুঝতে পারছে হারু তেমনি ওর কোলে অভিমান ভরে মুখ ফিরিয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে সোহাগ না করলে, ভালোবেসে কথা না বললে সে মুখ ফেরাবে না। সে যে কী করে! সে বুকের ওপর থেকে হারুকে জলের কাছে কাছে নামিয়ে আনল। ধীরে ধীরে জলে ডুবিয়ে দিচ্ছে। হারুর পা দুটো জলে নেমে যাচ্ছে। হারু কিছু বলছে না। প্রচণ্ড অভিমানে সে এখনও মুখ ঘুরিয়ে আছে। অভিমানে হারুর মুখ থমথম করছে। দু চোখে জলের ধারা নামছে। জ্যোৎস্নায় চকচক করছে কিন্তু কোনো ভয় নেই শঙ্কা নেই। অভিমানে চোখ ফেটে হারুর জল বের হয়ে আসছে। ঠোঁট বেঁকে যাচ্ছে অথচ কাঁদছে না। দুজনের ছায়া গেরু জলে দেখতে পায়। আর তখনই গেরুর মধ্যে কী যে হয়ে যায়। জগৎ সংসার এবং পৃথিবী বড়ই ভালোবাসার। ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। আকাশের আলো, বালিয়াড়ির সাদা রঙ, একটি বিস্কুটের স্মৃতি এবং হারুর এই অবোধ অভিমান গেরুর মনে প্রচণ্ড ঝড় তুলেছে। সে যত ওকে জলে ডুবিয়ে দিতে চাইছে, তত যেন সে ওকে প্রচণ্ডভাবে ভালোবেসে ফেলছে। সে যেন দেখছে—নেলির দুটো ভিজে চোখ বলছে, হামার সাত রাজার ধনকে তু খুন না করিস। এবং তখনই দেখল হারু ওর দিকে চেয়ে হাসছে। ফের হাজার রকমের কথা বলছে, গেরু—চা—চা—তু—হামারে চু—উ—না—দিবি।

গেরু নিজেকে আর কঠিন কঠোর করে রাখতে পারে না। সে আর নৃশংস হতে চায় না। সে বরফের মতো গলে গলে পড়ে। কোমর জলে হারুকে বুকে নিয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকে। ওর পায়ের কাছে দুটো মাছ নড়ছে। জল কাঁপছে, ওদের ছায়া দুটো কাঁপছে। আকাশের একটুকরো চাঁদ তখন নদীর পাড়ে গাছের ছায়ায় নেমে যাচ্ছে। ধরণি শান্ত। কোথাও কোনো ভয়—ভীতির চিহ্ন নেই। কোথাও কোনো সংশয় নেই। সন্দেহ নেই। গেরুর হাত—পা এখন কাঁপছে না। সে ধীরে ধীরে বালিয়াড়ি ভেঙে ওপর উঠল।

হারু ফের বলে, তু—চু—উ—দে চাচা।

জরুর দেবে। হামি তুরে চুমু না দেবে ত কোনো দেবে? হারুর কপালে গেরু চুমু খেল। যেমন করে রোজ গালটা মুখটা ওর নরম গালে ঘষে দিত আজও তেমনি ঘষে দিল। গেরু সুখ পেল, আনন্দ পেল। হাকিমি দানরির কথা ভুলে গেল। ভুলে গেল সে আজ দুদিন ধরে ভুখা আছে। সে ভুলে গেল হারুকে কিছুক্ষণ আগেও সে খুন করার কথা ভেবেছে। ওর শরীরে মনে যে অস্বস্তি এতক্ষণ হচ্ছিল, পাড়ে উঠে সব কেমন উবে গেল, নিঃশেষ হয়ে গেল।

একদল বাদুড় উড়ে গেল নদীর অন্য পারে। কিছু শেয়াল ডাকে ডহরের পারে। খানা—খন্দে, ঝোপ—জঙ্গলে পাখিরা সব প্রহরে প্রহরে ডাকছে। ধীরে ধীরে গেরু বালিয়াড়ি ভাঙে। পায়ের ছাপ পড়ছে বালিয়াড়িতে। সে হেঁটে যাচ্ছে। কাঁধে হারু হাজার রকমের কথা বলে খুশি হচ্ছে।

ধীরে ধীরে গেরু চটানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সে শ্মশানটার কাছে এসে দেখল চালাঘরে চার—পাঁচটা লোক বসে বিড়ি টানছে। চালাঘরটার পাশেই মড়াটা রাখা রয়েছে। শিয়রে হারিকেন জ্বলছে। মড়াটা চাদরের নিচে থেকেই ফুলে ফেঁপে উঠেছে। গেরু মড়াটা দেখে ধরতে পারল গন্ধ নিয়ে ধরতে পারল—মড়াটা পচে গেছে। সে দাঁড়াল মড়াটার কাছে। লোকগুলো কিছু বলছে না। ওরা জানে গেরু চটানের লোক। ওরা এখানে আরও কতবার মড়া বেচে অথবা পুড়িয়ে চলে গেছে। গেরু ওদের চিনতে পারল। গেরু ওদের মতো করে কথা বলল।—গেল সালে তোমরা এয়েছিলে নাকো মোড়লের বেটা?

ভিতর থেকে বুড়ো লোকটা উত্তর করল, হ্যাঁ এয়েছিলাম বটে। তুর বাপ বেঁচে নেই। এখন আর আমাদের কে চিনবে!

গেরু বলল, না চিনলে চলবে কেন? না চিনলে বললাম কী করে তুমরা গেল সালে এসেছিলে!

বুড়ো লোকটা জবাব দিচ্ছে।—গেল সালের মড়াটা তো পুড়িয়েই যেতে হলরে বাপু। তুই চিনতে পেরেই আর কতটা উপকার করলি।

গেরু বুঝল ওরা মড়াটা বিক্রি করতে চায়। বুঝল, ওরা বিশ ক্রোশ, পঁচিশ ক্রোশ পথ ভেঙে মড়াটাকে গঙ্গা পাইয়ে দিতে এসেছে। গঙ্গার জলে চুবিয়ে মড়াটা ইচ্ছে করলে ওরা বিক্রি করতে পারে। ইচ্ছে করলে এমনি দিয়ে যেতে পারে। ইচ্ছে করলে কাঠের পয়সায়, ঘাটের পয়সায় ওরা ফুর্তি করতে পারে। গেরু জানে, কৈলাস বেঁচে থাকলে মড়াটা নিয়ে নিত বাবুকে বলে। বাবু রসিদ লিখতেন অথচ কাঠ পুড়ত না। অথচ টাকা পেতেন কিছু, ওদের কাঠের দাম লাগত না। ঘাটের দাম লাগত না। সে পয়সায় নিমা বাগদীর লোকেরা মদ খেত, ফুর্তি করত। গাঁজাভাঙ খেয়ে পাশের একটা বস্তিতে উলঙ্গ হয়ে নাচত।

গেরু বলল, মড়াটা আমি নিলে দেবে আমাকে?

নিবি তুই! নিলে দুর্ভোগ পোহাতে হয় না।

গেরু বলল, তবে জলদি হারিকেনের আলোটা নিভিয়ে দাও। বালিয়াড়িতে নেমে চুপচাপ বসে থাকো।

দুদিন খেতে না পেয়ে গেরুর মুখটা শুকিয়ে গিয়েছিল। মড়াটা পাবে ভেবে শুকনো মুখটা ফের খুশিতে ভরে উঠল। সে হারুকে কাঁধে নিয়ে তাড়াতাড়ি চটানে উঠে যাচ্ছিল। এমন সময়ে ঘাটোয়ারিবাবু ডাকলেন কে যায়?

হামি গেরু আছে বাবু।

কোথায় গেছিলি নেলির বাচ্চাকে নিয়ে?

নদীর ধারে বাবু।

নদীর ধারে গেছিলি। কেমন সন্দেহের গলায় বললেন ঘাটোয়ারিবাবু।

হে বাবু নদীর ধারে। দুরোজ ভুখা থেকে নিদ নেই আতে বাবু! গেরু মনে মনে খুব খুশি হচ্ছে। খুব বুদ্ধি করে কথাটা বলতে পেরেছে ভেবে সে খুব খুশি। ও পা বাড়ায় চটানের দিকে।

ঘাটোয়ারিবাবু আবার ডাকলেন, যাস না কথা আছে।

গেরু বলল, থোড়া বাদ আসছে বাবু। সে হারুকে নেলির পাশে রাখতে যাচ্ছে।

ঘাটবাবু শিবরাম ঘোষ জানালায় বসে অপেক্ষা করলেন। দেয়ালে হারিকেনটা নিবু নিবু হয়ে জ্বলছে। দুঃখবাবু বিকেলে ছেলেপিলের গল্প করে গেছেন। গল্পগুলো এত ভালো লেগেছিল যে তিনি চটানে বসে থাকতে পারেননি—তিনি দুঃখবাবুর সঙ্গে শহর পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছিলেন। দুটো কমলালেবু কিনে দিয়ে বলেছিলেন, ওদের দেবেন। বলবেন, তোদের জ্যাঠামশাই দিয়েছে।

তিনি বসে বসে এমন সবই ভাবছিলেন। ভাবছিলেন হয়তো দুঃখবাবু ওর দেওয়া কমলালেবু দুটো ওদের হাতে দিয়েছেন। ওরা খুশি হয়েছে। হয়তো দুঃখবাবুর স্ত্রী বলেছেন একবার নিয়ে এসো না ওনাকে। একদিন এখানে দুটো খাবেন। অথচ তিনি ধরতে পারলেন না কখন হারুকে চুরি করার মতলবে গেরু নেলির ঘরে ঢুকছে, কখন সে নেমে গেছে নদীতে। তিনি ভাবলেন, এই গেরুকে একটু বকতে হবে। গেরুকে সাবধান করে দিতে হবে। তিনি গেরুর অপেক্ষাতে জানালার ধারে বসে থাকেন।

বাবু।

গেরু বুঝি এল। তিনি চোখ তুললেন।

কে? অঃ গেরু—আয়।

গেরুকে পাশে বসতে বলে বললেন, তুই নেলির বাচ্চাকে নিয়ে যখন তখন চটান থেকে নেমে যাবি না।

যাবে না বাবু।

তুই মনে করবি না আমি কিছুই টের করতে পারি না।

গেরু চুপ করে থাকে। ঘাটোয়ারিবাবুর পায়ের কাছে বসে মুখ নিচু করে থাকে।

তুই মনে করবি না তোর চালাকি কেউ টের পায়নি।

গেরু এবার মুখ তুলে বাবুর দিকে তাকায়।

তুই মনে করবি না বাচ্চাটা শুধু নেলির, বাচ্চাটা আমার। ওটা আমার পায়ের কাছে মানুষ। ওর শরীরে আমার রক্ত না থাকতে পারে। কিন্তু আমার ভালোবাসা আছে। বলতে বলতে সহসা চুপ করে যান। জানালা দিয়ে অন্ধকার দেখতে দেখতে উদাসীন হয়ে যান।

বাবু!

বল।

বাবু একটা কথা বললে রাগ করে লিবেন না?

কী কথা বুলবি?

বাবু একটা মড়া এয়েছে ঘাটে। নিমা বাগদীর মড়া। ঠিক করে বুললে আপনি হয়তো চিনে লিবেন। সাঁইথিয়ার নিমা বাগদী। মড়া বেচে আদমীটা মদ খায়। আপনি জরুর চিনে লিবেন। ও হামারে মড়াটা দিয়ে দিতে চায়। বুলে দিন না বাবু। গেরু বাবুর পায়ের কাছে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল। পা দুটো ছুঁতে চাইল। চোখ দুটো ফের নরম করে ডাকল, বাবু।

ঘাটোয়ারিবাবু একটু সরে বসলেন—এ কী হচ্ছে। তুই অসময়ে আমার পা ছুঁবি না।

গেরু যথার্থই আর ছোঁয়ার চেষ্টা করল না। চোখ দুটো ভারী করে বলল, দুরোজ ভুখা আছে বাবু। দু রোজ দানা—পানি কিছু পড়ছে না পেটে। ঠাকুর ভি ধারে দিচ্ছে না। বৌটা না খেয়ে মরে যাবেক বাবু।

ঘাটোয়ারিবাবু চোখদুটো উদাসীনের মতো করে রাখলেন। গেরুর কথা তিনি যেন শুনতে পাচ্ছেন না।

গেরু দুটো হাত মেঝের ওপর রাখে। হাত দেখানোর মতো করে রাখে। বলে, বাবু আপনি চটানের মা—বাপ।

ঘাটোয়ারিবাবুর চোখ দুটো জ্বলতে থাকে। চোখের মণি দুটো ঘুরতে থাকল যেন। ভাগ, ভাগ। শালা ভাগ। তিনি খিস্তি করতে আরম্ভ করলেন। আমি না—বাপ! ছেলেপুলে নেই, ঘরসংসার বলতে কিছু নেই—আমি চটানের মা—বাপ? আমি মরলে তোরা কখনও কাঁদবি? তোরা চোখের জল ফেলবি? তোদের পাষাণ আত্মা আমার জন্য চোখের জল ফেলবে? শোক করবে? ঘাটোয়ারিবাবু কথাগুলো বলতে বলতে গভীর বেদনায় ভেঙে পড়লেন। গেরু মাথা নিচু করে যেমন বসেছিল, তেমনি বসে থাকে।

ঘাটোয়ারিবাবু রামায়ণ মহাভারত দুটো ঠেলে দিয়ে কাউন্টারটা খুলে দিলেন। লোকগুলো এখনও আসছে না—তিনি বিরক্ত হচ্ছেন। তিনি মড়ার নামধাম রেজেস্ট্রি খাতায় তুলে শুয়ে পড়বেন। আর বসে থাকতে ভালো লাগছে না। জেগে থাকতে ভালো লাগছে না। গেরুকে উঠতে না দেখে বললেন, টাকা চাই? টাকা—নেবার সময় ত মনে থাকে না!

গেরু ডোম চোখ তুলল না। বাবুর পায়ের ওপর চোখ রেখেই বলল টাকা হামার লাগে না বাবু! আপনি কত দিয়ে লিবেন?

তবে কী চাই! কী চাইরে কৈলাসের ছা! নেমকহারাম পাষণ্ড! আমি কী দিতে পারি তোকে!

বাবু আপনি ইচ্ছা করলে সব দিতে পারেন। মড়াটা ফুলে—ফেঁপে গেছে বাবু। মড়াটা হামারে দিয়ে দিতে চায় বাবু। আপ বুলেন ত হামি লিয়ে লি। লয়ত হাম মরবে, বিবিটা ভি মরবে বাচ্চাটা ভি মরবে।

ঘাটোয়ারিবাবুর মনে হল তিনি ভুল শুনেছেন। মনে হল গেরু ওর সঙ্গে মস্করা করছে। অথবা তঞ্চকতা করছে।

গেরু ফের বলে, হামার বাচ্চাটা ভি মরবে বাবু!

তোরও বাচ্চা হল রে গেরু। গেরুর বাচ্চা হবে জেনে তিনি চেয়ারে বসে থাকতে পারলেন না। তিনি ঘরের ভিতরেই দ্রুত পায়চারি করতে থাকলেন। একবার ঘাটের দিকে, একবার চটানের দিকে মুখ ফেরাতে থাকলেন। রাত বাড়ছে তখন। রাত ঘন হচ্ছে। দূরে কোনো পুরনো অশ্বত্থের ছায়ায় ঘাসের নিচে প্রজাপতিরা ডিম পারছে যেন! ডিমের উত্তাপ এ শরীরে এসে তা দিচ্ছে। তিনি এখানে দাঁড়িয়ে হরিণ—হরিণীর জলপান করার শব্দ পেলেন। তারপর দেখতে পেলেন ওরা সব গভীর অরণ্য হয়ে গেছে। গভীর অরণ্যে ঐসব হরিণেরা ভালোবাসার চিহ্ন রেখে যাচ্ছে। যেন কোনো নীহারিকার অতীত থেকে এ বর্তমান শুধু চিহ্ন রেখে যাওয়া। ডিম পেড়ে যাওয়া—হরিণেরাও ডিম পাড়ে—এমন ভাবতেই ঘাটোয়ারিবাবুর ভালো লাগছে। কালের অবক্ষয়ে ইচ্ছার জন্মকে তিনি কোনো সুখী পরিবারে আটকে রাখতে পারলেন না। তিনি শুধু জেনেছিলেন মৃত্যু—মৃত্যুই সব। মৃত্যুর কড়া—ক্রান্তির হিসাবে তিনি কেমন অবিশ্বাস্যভাবে এতদিন এই চটানে…একটা চটানে—বাঁজা হরিণ হয়ে ছুটেছিলেন। গেরুর বাচ্চা হবে জেনে এ সময় হরীতকীকে কাছে পেতে খুব ইচ্ছা হল। একটা বাঁজা হরিণের মতো না বেঁচে একটা ফলন্ত হরিণের মতো বাঁচতে ইচ্ছা হল ওঁর।

ঘাটোয়ারিবাবু জানালার পাশে দাঁড়ালেন। জানালা ধরে অন্ধকার গলে গলে পড়ছে। গেরু পাশে চুপচাপ অপরাধীর মতো বসে আছে। বাবুর ইচ্ছা হচ্ছে না গেরুর চোখে—মুখে ডিম পাড়ার আনন্দ চিহ্ন থাকুক। ইচ্ছা হচ্ছে না চটানে গেরু বাপ হোক। তিনি বিদ্রূপ করে বললেন, তাহলে তুইও বাপ হলিরে গেরু!

বাবুর কথা শুনে গেরু লজ্জা পেল। সে কোনোরকমে বলে, জী বাবু হামি বাপ হবে।—বাবু তিন দিন হোবে মানুষটা মরল।

ঘাটোয়ারিবাবু নিমা বাগদীকে চেনেন। নিমা বাগদীর দল আছে একটা। ওরা দেশ—দেশান্তরের মড়া পুড়িয়ে বেড়ায়। মড়াকে গঙ্গা পাইয়ে দেয়। দূর দূর গাঁয়ের মড়া নিয়ে সে ঘাটে আসে! দূর থেকে এলে মড়াগুলো ফুলে—ফেঁপে ওঠে। কৈলাস থাকলে সে ব্যবস্থা করত ওদের। পোড়ানোর কাঠ লাগত না। ওদের কাঠের পয়সা বাঁচত, ঘাটবাবুর কাঠ বাঁচত। কৈলাসের থাকত কঙ্কালটা। কৈলাস কঙ্কালের পয়সার ভাগ দিত বাবুকে। নিমা বাগদীর অনেকদিন দেখা নেই। তিনি ভেবেছিলেন নিমা বুঝি মরেছে।

গেরু বাপের মতো শরীর টেনে বলল, বাবু আপনার ভি কুছু হোবে। হামার ভি কুছু হোবে।

ঘাটোয়ারিবাবু কী ভেবে একবার গেরুর দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, তা হয় না। দশমাসের আগের মানুষটা আমার বেঁচে নেই। মানুষটাকে পোড়ানো হবে না, সে টাকায় ওরা মদ খাবে। আমার কাঠ বাঁচাবে, দু পয়সা হবে? এসব আমার ভালো লাগে না। ঘাটোয়ারিবাবু ফের চেয়ার টেনে নেন। জানালায় ঝুঁকে পড়েন। কী ভেবে গেরুকে কাছে ডেকে বলেন, তুই যা। মড়াটা পাবি না। মরা মানুষকে ঠকাতে আমার ভয় করছে গেরু।

গেরুকে উঠতে না দেখে তিনি ফের প্রশ্ন করেন, বাচ্চাটার কী নাম রাখবি?

বাচ্চাটা না হতে বিবিটা যে মরে যাবে গ।

ঘাটোয়ারিবাবু যেন সব ভুলে গেছেন এমন ভাব দেখিয়ে বলেন, কেন, কেন? কেন মরবে বিবিটা?

ভুখা থেকে। সে বাত ত বুলছি বাবু।

এ সময় ঘাটোয়ারিবাবুর ইচ্ছা হল বিবিটা ওর মরুক। চটানের সব মরুক। মরে মরে সব সাফ হয়ে যাক। এত মড়া দেখেছেন, আর একটা মড়া দেখতে ক্ষতি কি। তিনি এবারেও বলেন, তুই যেতে পারিস গেরু। মড়া আমি তোকে দিতে পারব না। সারাজীবন তাজা মানুষকে ঠকিয়ে ঠকিয়ে এখন মরা মানুষকে ঠকাতে ভয় করছে।

গেরু শেষবারের মতো চেষ্টা করল, বাবু একটা মরা মানুষ পেলে দুটো জেতা মানুষ বাঁচে।

তুই আর তোর বিবির কথা বলছিস?

জী না। বিবি—বাচ্চাটার কথা বুলছি। বাবু হামার বাচ্চা হবে, ওয়ারে মেরে লিবেন না! হামার বাচ্চা—বড় সাধের, বড় শখের। থোড়া মেহেরবানি করেন। আপ মা—বাপ আছে। গেরু ঘাটোয়ারিবাবুর পা জড়িয়ে কাঁদতে থাকে।

আমি তোর বাচ্চাকে মেরে ফেলব! খুন করব বলছিস?

জী বাবু!

ঠিক বলছিস তুই?

জী ঠিক। আপ দয়া করেন বাবু।

নিমা বাগদী আকন্দ গাছটার নিচে সব শুনছে।

হরীতকী অফিসঘরে গেরুর কথা শুনতে পেল। এত রাতে গেরু বাবুর ঘরে কেন? সে ধীরে ধীরে সিঁড়ি ধরে উঠতে থাকে।

গেরু বলে উঠল, বাবু?

ঘাটোয়ারিবাবু অন্যমনস্কভাবে জবাব দেন, ওঠ! যা! মড়াটা নিয়ে পুঁতে দে গিয়ে। তোর বাচ্চাটা তো বাঁচুক আগে। পাপ পুণ্যের কথা পরে ভেবে দেখব।

গেরু ডোম বের হয়ে গেল। নিমা বাগদী ঢুকল। গড় হলে ঘাটোয়ারিবাবু বললেন, এখনও তবে বেঁচে আছিস?

আছি বাবু। নিমা বাগদীও ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

ঘাটোয়ারিবাবু জানালা থেকে এখন আকাশ দেখছেন।

দূরে পুরনো অশ্বত্থের ছায়ায় ঘাসের নিচে তেমনি প্রজাপতিরা ডিম পারছে। তিনি তার উত্তাপ পাচ্ছেন। গভীর অরণ্যে হরিণ—হরিণীরা তেমনি ছুটছে, ছুটবে। তিনি আকাশ দেখেন আর ভাবেন। তিনি যেন আজ প্রথম আকাশ দেখছেন। আকাশে কত নক্ষত্র, আকাশে কত আলো! কত আনন্দ! কত আনন্দ এই জীবনধারণে। তিনি জানালায় দাঁড়িয়ে গভীর অনুতাপে পুড়তে থাকেন।

হরীতকী ঘরে ঢুকে দেখে বাবু জানালায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছেন। সে ডাকে, বাবু।

ঘাটোয়ারিবাবু উত্তর দিতে পারেন না। তিনি জানালায় দাঁড়িয়ে গভীর এক নিঃসঙ্গ যন্ত্রণায় দুঃখ পান।

বাবু উত্তর দিচ্ছেন না দেখে হরীতকী বিস্মিত হয়। ডাকে, বাবু।

হরীতকী ফের ডাকে, বাবু! বাবু বাবু!—হরীতকী ডেকে সারা হতে থাকে। বাবু জানালা থেকে মুখ তোলেন না। একবার বললেন না—কেন ডাকছিস? হরীতকী জোর করে বাবুকে টেনে নেয় জানালা থেকে। দেখে বাবু কাঁদছে।

বাবু তুই কাঁদছিস?

ঘাটোয়ারিবাবু পাগলের মতো হরীতকীকে বুকে টেনে আনেন, যাবি, যাবি তুই? যেদিকে দু চোখ যায়—এ চটান ছেড়ে অন্য কোথাও?

হরীতকী হেসে গড়িয়ে পড়ল।—বাবু বুলছিস কী তুই? শেষ বয়সে সোয়ামী—বৌ হয়ে সং সাজতে ইচ্ছা তুর। হরীতকীর হাসি আর থামছে না। এর লাগি কাঁদছিস তু বাবু?

জীবনের এই সং সাজার রাজত্বে আজ মনে হল ঘাটোয়ারিবাবুর—নিজেও এখানে সং সেজে বসে আছেন। সং সাজার রাজত্বে দুঃখবাবু, গেরু ডোমের সং সাজার সার্থকতা আছে। কারণ তাদের পাত্রপাত্রীরা চোখের জল ফেলবে কিন্তু ঘাটোয়ারিবাবু সারা জীবন ধরে সং সেজে সেটুকু উপার্জন করতে পারেননি।

হরীতকীর হাত ধরে তিনি বললেন, আমি মরলে তুই কাঁদিস। তিনি ধীরে ধীরে তারপর চেয়ারটায় গিয়ে বসলেন। হরীতকী চলে গেল। রামায়ণ মহাভারতের ওপর মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন তিনি। রাত বাড়ছে রাত হালকা হচ্ছে। এই ধরণির কোলে প্রজাপতিরা সব ডিম পারছে। তিনি চোখ বুজে থেকে কোনো এক গভীর অরণ্যে চলে যাচ্ছেন, ধরণির বিচিত্র রকমের জীবনধারণের সঙ্গে ঘাটোয়ারিবাবুর আবার সেই ইচ্ছাটা জন্মাল—

চটানে আবার ভোর হল। আবার রাত্রি হল। দিন রাত্রি যেতে মাস গেল। শীত এল, শীত গেল। গ্রীষ্ম এল। ঘাটোয়ারিবাবু চেয়ারটায় বসে রামায়ণ পড়তে পড়তে গরমে ছটফট করেন।

ঘন বৃষ্টি হয়েছিল যেমন দুদিন, আবার ঘন রোদ তেমনি দু—সপ্তাহ। দুপুরের দিকে আবার সেই গরম হাওয়াটাই উঠেছে। শিমুল গাছের নতুন পাতাগুলো পুরনো হচ্ছে। এখন একটা পাখি পর্যন্ত চোখে পড়ছে না। এই ঘন রোদে কিছু লোক বাবলার বনে কাঠ কাটছে। নদী থেকে শেষ লোকটা স্নান করে উঠে গেল। দুজন লোক একটা লোককে আমকাঠে পুড়িয়ে শেষ বারের মতো ‘হরিবোল’ দিল। ঘাটোয়ারিবাবু জানালায় বসে সব দেখেন। জানালার একটা কপাট খোলা। ভিতর দিকের দরজা বন্ধ। অন্য জানালাটাও বন্ধ। গরম হাওয়াটা ঘরের ভিতর বেশি ঢুকতে পারছে না। গরম হাওয়াটা দরজায় কিংবা জানালায় আছড়ে পড়ে থমকে থাকছে। বাতাসের শব্দটা বিরক্ত করে মারে বাবুকে। তখন চটানের মেয়ে—মরদদের বলতে শোনেন, গেরুর ছেলে হল।

গেরুর ছেলে হওয়ার কথা শুনেই কেন জানি ঘাটোয়ারিবাবুর একটা পাখি দেখার শখ হল। এই ঘন রোদে পাখিরা উড়ছে না। ওরা কোথায় গেল জানার শখ হল। তিনি দরজা খুলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। দরজা বন্ধ করে শেকল তুলে দেন। তারপর ধীরে ধীরে পাখি দেখার জন্য চটান পার হয়ে অশ্বত্থ গাছটার নিচে এসে দাঁড়ান। এখানে শুধু কাক। ওরা অধিকাংশ ডালে ডালে বসে আছে। মাত্র একটি কাক উড়ে উড়ে চিৎকার করছে।

তিনি অন্য পাখি দেখার ইচ্ছায় ক্রমশ অশ্বত্থ গাছ পেরিয়ে সরু একটা পথে নামলেন। রোদটা ঠিক কপালে এসে নামছে। সেই পথ ধরে যাওয়ায় কয়েকটা বুলবুল পাখি একটা ইষ্টিকুটুম পাখি ও গোটাদুই শালিক দেখতে পেলেন। তিনি এখানেও থামলেন না। পথটা ধরে ক্রমশ দক্ষিণ দিকে আন্দাজ এক ক্রোশ পথ হবে, হেঁটে একটা আমকাঁঠালের বাগানে এসে বসেন। এখানে সব রকমের পাখিরা যেন বাস করে, এমন একটা ধারণা হল ঘাটোয়ারিবাবুর।

তিনি স্মৃতির ঘরে অনেকক্ষণ হেঁটে মনে করতে পারছেন না—একটা চালাঘর, কিছু কাঠ, কিছু মেয়ে—মরদ ভিন্ন তাঁর অন্য অস্তিত্ব আছে। তিনি ঘাসের ওপর বসে সেই স্মৃতিকে বারবার ঠেলে দিয়ে এই পৃথিবীকে দেখার জন্য চোখ খুললেন। আর সঙ্গে সঙ্গে মনে হল এটা যেন দুঃখবাবুর সংসার। কিছু ছেলে, কিছু মেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটছে। কিছু পাখি দোল খাচ্ছে। খঞ্জনা পাখিরা ঘাসের ওপর শুয়ে শরীরের উত্তাপ কচি ঘাসে মিশিয়ে দিচ্ছে। ছেলেমেয়েরা কোঁচড়ে ভরে বাতাসে—ঝরা আম তুলে নিচ্ছে। হাওয়া, পাখি, ফুল, ফল ফুটফুটে ছেলের দল ঘাটোয়ারিবাবুকে বসতে দিল না। তিনি নিজেও কেমন যেন ওদের মতো ছোট হয়ে গেছেন। ধরণির এইসব বিচিত্র কচি কচি উপাদানগুলো যেন বলছে, তুমি আনন্দ কর, আনন্দ কর। তুমি ফুল ফোটাও। তুমি কঠিন হয়ে থেক না। তুমি পাষাণ হয়ে বেঁচ না। তিনি সেজন্য আজ ছুটতে চাইলেন। ছেলেমেয়েদের কোঁচড়ে কোঁচড়ে আম তুলে দিলেন। আর সকল পাখিদের ডেকে বলেন আমি আসব, আবার চলে আসব।

শেষে ঘাটোয়ারিবাবু দেখেন সন্ধ্যা হচ্ছে। সূর্য পাটে বসেছে। গাছে গাছে তার শেষ আলো। নিজেকে বিলিয়ে নিজেকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। ছেলের দল, মেয়ের দল, এক দুই করে চলে যেতে থাকে। এক দুই করে পাখিরা কোনো আঁধারের আশ্রয়ে যেন হারিয়ে যেতে থাকে। নদীর পার ধরে ঘরে ফেরে এই ধরণির সব সুখী লোকেরা। দুঃখবাবুও হয়তো চটান ছেড়ে ঘরে চলেছেন। দুঃখবাবুর সাজানো সংসারের কথা জেনে আজ কেন জানি মনে হচ্ছে যদি তিনি গাছ, অথবা ফুল কী পাখি হয়ে বাঁচতে পারতেন। আর মনে হল ফুলের ভিতর সৌরভ আছে। সেই সৌরভ তার কানে কানে বলে গেল, ঘাটোয়ারিবাবু ফুল ফোটাও—ফুল ফোটাও। ঘাটোয়ারিবাবু, সুখ মেয়েতে—মদে নয়, রামায়ণ—মহাভারতেও নয়, সুখ সৌরভ ফুলের ভিতরে। ফুল ফোটার ভিতরে। তিনি এই প্রথম উপলব্ধি করলেন জীবন মৃত্যুর চেয়ে বড়। মৃত্যুকে উপেক্ষা করার জন্য তিনি শেষবারের মতো জীবনে ফুল ফোটাতে চাইলেন। তিনি গাছ—ফুল—পাখি হতে চাইলেন। কিন্তু হায় তখন তাঁর পারের কড়ি জমা পড়ে গেছে। তিনি গাছ, ফুল অথবা পাখি হতে পারলেন না। তিনি শুধু বসে বসে নিঃশেষে কাঁদলেন।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত