Categories
বাংলার ঐতিহ্য নৌকা বাইচ । স্বরূপ ভট্টাচার্য
আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট
নৌকা বাইচ জল কেন্দ্রিক খেলা। নৌকার গতিময়তার প্রকাশ। বাংলার নদী সংস্কৃতির পরিচায়ক।
দুই বা ততোধিক বিশেষ ভাবে তৈরি নৌকার দৌড়ের প্রতিযোগিতাই নৌকা বাইচ (চিত্র ১)। যে নৌকা এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় তাদেরকে সাধারণ ভাবে দৌড়ের নৌকা বলে সম্বোধন করা হলেও তার বিশেষ নাম আছে। অঞ্চল ভেদে তার আকৃতি, তার বানানোর কৌশল ভিন্ন। এটাই বাংলার বৈচিত্র, বাংলার ঐতিহ্য।
উত্তর ২৪ পরগনা জেলার ইছামতী নদীর পাড়ে টাকি অঞ্চলে দুর্গা পুজোর ভাসান কেন্দ্রিক নৌকা সমাগম হয়। নিতাই সূত্রধর টাকি অঞ্চলের নৌ কারিগর। অশিতিপর নিতাই সূত্রধর বলেন ‘টাকিতে বাইচ হয়’। তার কথা মত দুর্গা ঠাকুরকে নিয়ে নদীতে বিসর্জনের যে রীতি তাতে দুই বাংলার নৌকাই অংশগ্রহণ করে। অনেক নৌকা জলে যে খেলে বেড়ায়, ঘুরে বেড়ায়- তাইই ‘বাইচ’। আবার মুর্শিদাবাদের ভান্ডারদহ বিলেও ঐ একই উপলক্ষে নৌকা করে মানুষ আসে মেলা দেখতে। এই নৌকা সমাগমকেও ওখানকার লোকেরা বাইচ বলে। অর্থাৎ ‘বাইচ’ শব্দের সাথে নৌকা নিয়ে সমাগমকেও বোঝানো হয়। কিন্তু যখন তা ‘নৌকা বাইচ’ তখন তা কেবলই ‘নৌকা দৌড়’। নির্দিষ্ট পথ অতিক্রম করে কোন্ নৌকা আগে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে তার প্রতিযোগিতাই ‘নৌকা বাইচ’। নৌকার শ্রেষ্ঠত্ব প্রর্দশনের পরীক্ষা। নৌকার সাথে জড়িত সেই নৌকার গ্রাম, জড়িত নৌকার মালিকের মর্যাদা তাঁর মান সম্মান। সম্ভবত এই খেলার মধ্যে দিয়েই প্রকাশিত হত কোনো জমিদারের বা কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির কৃতিত্ব। স্বীকৃত হত তাঁর প্রভাব।
এই সময়েও এই বঙ্গের বিভিন্ন অংশে নৌকা বাইচ হয়। সময়টা শরৎকাল। নদী-নালা-খাল-বিল-হাওড়-বাওড় যখন জলে টইটম্বুর। মাঠে ধান। চাষের কাজে আর তেমন সময় দেওয়ার প্রয়োজন নেই। উৎসবের মরসুম (চিত্র ২)। ঠিক সেই সময়েই নৌকা বাইচের আয়োজন। এই আয়োজন কিন্তু বাংলার একান্ত নয়। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রায় প্রতিটি দেশে এই চর্চা আছে। চীন দেশে এই খেলাই ড্রাগনের সাথে সম্পর্কিত। নাম ড্রাগন বোট ফেস্টিভাল (চিত্র ৩)। দক্ষিণ ভারতের কেরালায় ওনাম উপলক্ষে ভাল্লাম কলি স্নেক বোট রেস নামে পরিচিত। অক্সফোর্ডের বোট রেসও বেশ নাম করেছে। তার রেশ হয়তো দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সংস্কৃতির সাথে সম্পর্ক যুক্ত। নৌকা বাইচ বা নৌকা কেন্দ্রিক এই উৎসবের উৎস এই ভূখণ্ডের সংস্কৃতির অনেক গভীরে নিহিত।
উৎস সন্ধান
‘বাইচ’ শব্দের উৎপত্তি ‘বইচ’ থেকে। পূর্ব ভারতের অষ্ট্রিক ভাষা গোষ্ঠীর শব্দ ‘বইচ’। ভাষাতাত্বিকরা এই শব্দের কথা জানেন না। তাই অভিধানে ভুল ব্যাখ্যায় বাইচ রয়ে গেছে। সুকুমার সেনের ছাত্র মন্ডল হেমব্রম এই ‘বাইচ ‘ শব্দের উৎপত্তির সন্ধান দিলেন। তাঁর মতে ‘বইচ’ এক ধরনের জলকেন্দ্রিক ক্রীড়া। গ্রীষ্মের সময়ে জলাশয়ে জল যখন কমে যায় তখন জলাশয়ের মালিক তা উন্মুক্ত করে দেন সাধারণের জন্য। গ্রামের লোকজন খালি হাতে মাছ ধরায় লিপ্ত হয়। এই খেলাকেই মন্ডল হেমব্রম বলেন সাঁওতাল মুন্ডাদের ভাষায় ‘বইচ’। অর্থাৎ জল নিয়ে খেলার এক বিশেষ রূপ। এই বইচ যখন নৌকাকে ঘিরে তখন তাই হল নৌকার দৌড় প্রতিযোগিতা- নৌকা বইচ। আমাদের মুখে মুখে তা হলো নৌকা বাইচ।
স্থান
চীন, কম্বোডিয়া, মায়ানমার অঞ্চলে যে নৌকা বাইচ হয় তার পোশাকি নাম ড্রাগন বোট রেস। এই প্রতিযোগিতা শুধুই প্রতিযোগিতা নয়। এই অনুষ্ঠান বৃহত্তর ড্রাগন বোট ফেস্টিভাল এর অঙ্গ। যে নৌকাতে এই খেলা হয় সেই নৌকার মাথা ড্রাগনের মতো (চিত্র ৪)। নৌকার গায়ে ড্রাগনের গায়ের ছাপ (চিত্র ৫)। দেখলে মনে হয় যেন জলের ড্রাগন। কেরলের নৌকোর প্রতিযোগিতাকেও স্নেক বোট রেস বলে সম্বোধন করা হয়। আন্নামালাই, কোট্টিয়াম, কোবালামে এই খেলার জনপ্রিয়তা।
বাংলাদেশে এই নৌকা বাইচ ভীষণ জনপ্রিয়। মানিকগঞ্জ, পাবনা, নড়াইল, কিশোরগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, ব্রাম্ভণবাড়িয়া অঞ্চলের নৌকা বাইচ স্বনামধন্য।
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অংশে নৌকা বাইচ হয়। এক সময় এই খেলা অনেক জায়গায় হতো। ক্রমশ ফিকে হয়ে এলেও এখনও তার রেওয়াজ আছে বাংলাদেশ সন্নিহিত জেলাগুলোতে। মুর্শিদাবাদের ভান্ডারদহ বিল, নদিয়ার জলঙ্গী নদী, বালি বেলুড় অঞ্চলের গঙ্গাতে, উত্তর ২৪ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জ, মালেকান ঘুমটি, টাকি, হাসনাবাদ অঞ্চলে, দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুন্দরবনের কচুখালি, মালঞ্চ, সূর্যবেড়িয়া, ক্যানিং প্রভৃতি অঞ্চলে আজও বাইচ খেলা হয় (চিত্র ৬, চিত্র ৭, চিত্র ৮)।
সময়
বাংলাদেশের নৌকা বাইচ শ্রাবণ সংক্রান্তি থেকে শুরু করে ভাদ্র-আশ্বিন মাস পর্যন্ত হলেও মূল আকর্ষণ শ্রাবণ সংক্রান্তির নৌকা বাইচ। এই সময়ের নৌকা বাইচ মনসা পুজোকে ঘিরে। মনসার ভাসানকে মাথায় রেখে। যেহেতু সময়টা উৎসব মুখর তাই নৌকা বাইচ অন্যান্য পুজোর সাথেও জড়িত হয়ে পড়েছে। বিশ্বকর্মা পুজো ও দুর্গা পুজো এই দুই পুজোর ভাসানের সাথেও তাই নৌকা বাইচ হয়। সুন্দরবনের নৌকা বাইচ বিশ্বকর্মা পুজোর ভাসান কেন্দ্রিক। অন্যদিকে টাকি অঞ্চলের বাইচ দুর্গা পুজোকে কেন্দ্র করে।
কেরলের ওনাম বর্ষা কালের পুজো আর তাতেই ভাল্লাম কলি। চীন দেশের নৌকা দৌড় বর্ষার মরসুমেই।
অর্থাৎ সময়ের নিরিখে এই নৌকা বাইচের সময় বর্ষার শেষের দিক।
তবে এটাও মাথায় রাখা দরকার প্রথাগত নৌকা বাইচ ছাড়াও ইদানিংকালে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় দেশের বিশেষ দিনকে মাথায় রেখে বাইচ খেলার রেওয়াজ হয়েছে। সেই বাইচের সাথে নৌকা সংস্কৃতির সম্পর্ক খুবই কম। বেশিরভাগই তা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অবদান। কেরলের ‘নেহেরু ট্রফি’ নৌকা বাইচের প্রথম পুরষ্কার যা অনুষ্ঠিত হয় এদেশের স্বাধীনতা দিবসে।
দৌড়ের নৌকা
বাইচ খেলার জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি করা হয় নৌকা। এই নৌকা হয় সরু লম্বা (চিত্র ৯) । কেবলমাত্র নৌকা বাইচ খেলাতেই তার ব্যবহার। সম্ভবত এই নৌকাই ছিল এই অঞ্চলের রণতরী। নদী বিধৌত এই গাঙ্গেয় বঙ্গে নৌ-সাধন জাতির কথা আছে। দৌড়ের নৌকার আস্ফালন বাঙালির জল সাম্রাজ্যের প্রতীক। বাঙালির মুন্সিয়ানার পরিচায়ক।
এই নৌকার আকার অবয়ব বানানোর কৌশল এক এক জায়গায় এক এক রকমের। নামও বিচিত্র। বাংলাদেশের ব্রাম্ভণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জের তিতাস নদীতে সোরেঙ্গী নৌকাতে নৌকা বাইচ হয়। ৫০-৬০ হাত লম্বা এই নৌকা ৪ হাতের বেশি চওড়া হয় না। ৬০ জন বাইচেল তাতে বৈঠা হাতে উঠতে পারে। কিশোরগঞ্জ জেলার নিকালী গ্রামের উত্তরে ষাইট দ্বার গ্রাম। সেই গ্রামের মিস্তিরি পাড়ার নাম হুতার পাড়া (ছুতার পাড়া)। সেখানেই ২০-২২ ঘর মিস্তিরির বাস। তাদেরই একজন ব্রজলাল সূত্রধর। ব্রজলাল তাঁর কাকার কাছ থেকে আয়ত্ব করেছেন বাইচের নৌকার নির্মাণ কৌশল। তিনি ৬-৭ জন সহযোগী নিয়ে বাইচের নৌকা বানান। সময় লাগে ২০-২৫ দিন। কিশোরগঞ্জের একটি ৬০ হাত নৌকা তাঁরই হাতে গড়া। এই সোরেঙ্গী ছাড়াও কিশোরগঞ্জের বাইচ প্রতিযোগিতায় দক্ষিণ দেশ থেকে পেটমোটা পাতাম নৌকাও আসত বাইচে অংশ নিতে। তবে তারা কখনোই সোরেঙ্গী নৌকার গতির কাছে পেরে উঠতো না।
পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে নৌকা বাইচ হয় ছিপ নৌকাতে। ২-৩ হাত চওড়া ৩০-৪০ হাত লম্বা এই নৌকার আগা পাছা অনেক নীচুতে। কেননা যেখানে এই বাইচ হয় সেখানকার জল স্থির। লোকে বলে ‘বিল’। এই বিলের নাম ভান্ডারদহ। হরিহর পাড়ার এই বিল নদীর ফেলে যাওয়া অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ। এই বিলের জলে স্রোত নেই, ওঠে না ঢেউ। তাই ছিপছিপে ছিপ নৌকার আগা-পাছা জল ছুঁইছুঁই। দুহাত দূরের এক একটা গুঁড়োতে দুজন বাইচেলের স্থান। তাদের হাতেই থাকে বৈঠা। চামচের মতো এই নৌকার খোল। সবচেয়ে ওপরের তক্তা ডালি, নৌকার দুই মাথাকে আগলে রাখার মতো করে ঢেকে রাখে। দুমুখো পেরেক (পাতাম) দিয়ে তক্তা জোড়া দেওয়া হয়। এই পাতাম অনেকটা stapler এর পিন এর মতো কাজ করে।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর দেবী চৌধুরানী গল্পে সরু লম্বা ছিপ নৌকার কথা উল্যেখ করেছেন। সড়কি, বল্লম, বৈঠা নিয়ে ছিপ নৌকার খোলে লুকিয়ে থাকতো দেবীর বাহিনী। রঙ্গলালের ইশারায় বৈঠার টানে সেই ছিপ নিমেষে পৌঁছে যেত গন্তব্যে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেবীর লোকজন কাবু করে দিত প্রতিপক্ষকে। সেই ছিপ কিন্তু সম্ভবত একটা গাছের থেকে বানানো। কেননা যে অঞ্চলের কথা বঙ্কিম উল্যেখ করেছেন সেখানে একটা গাছের গুড়ি কে খাবল করে (কুঁদে, scoop) নৌকা বানাবার প্রথা ছিল।
ভান্ডারদহ বিল এ ছিপ নৌকার পাশাপাশি একটা অন্য রকমের নৌকাও অংশ নেয়। নৌকার মালিক কথায় তা কলিগে বাছারী। চাতর সিমুলিয়া গ্রামের লোকজন কিন্তু ওই নৌকাকে ‘রিফিউজি নৌকা’ বলেন। এই রিফিউজি নৌকা তাদের নৌকার মতো নয়। আগা-পাছা অনেক উঁচুতে। লম্বা গলুই। সামনে পেছনে পিতলের কারুকার্য। বড় বড় চোখ। গায়ে রংবেরঙের নকশা। এই নৌকা যাঁদের তাঁরা পূর্ব বাংলা থেকে চলে আসা ছিন্নমূল লোকজন। Refugee। তাই সেই লোকজনদের নৌকাও ‘রেফিউজি নৌকা’। বিদেশী তার হাবভাব।
সুন্দরবনের বাইচের নৌকা বাছারী (চিত্র ১০)। লম্বায় ৩০-৫০ হাত। ক্যানিং, কুলতলীর লোকেরা একে বলে ‘সর্পি নৌকা’ (চিত্র ১১)। এই নৌকার আকার সাপের মতো। গতি সর্পিল। পাতাম দেওয়া এই নৌকার রাগ অনেক বেশি ফলে দুই মাথা জলের অনেক ওপরে থাকে। নৌকার খোল দেখতে হয় ধনুকের মতো বাঁকা। নৌকার গড়ন সুন্দরবনের নদীর ঢেউ কে মাথায় রেখে তৈরি।
বেঙ্গল ট্রাডিশনাল স্পোর্টস ফাউন্ডেশন কলকাতায় বাইচ খেলার জন্য দুটো ১০০ ফুটেরও বেশি লম্বা নৌকা বানিয়েছিল। তার একটার নাম কাইলে (চিত্র ১২) অন্যটা ছানদে বাছারী। দুটো নৌকারই প্রায় ১০ ফুটের গলই (চিত্র ১৩)। গোপালগঞ্জের মনোরঞ্জন কীর্তনিয়া উদ্যোক্তাদের কথামতো তিনি তাঁর দেশের নৌকা বানিয়েছিলেন। সুভাষ সরোবরের জলে এই দুই নৌকা বাইচ খেলতো।
মালেকান ঘুমটি সুন্দরবনের এক প্রত্যন্ত অঞ্চল। সেখানে বাইচ খেলতে বাওনিয়ার ৪১ হাত নৌকার পাশাপাশি ৭০ হাতের একটা বাংলাদেশি নৌকাও অংশ নেয়।
বাইচ
বাইচের নৌকাকে বাইচের জন্য প্রস্তুত করা হয় অনেক আগে থেকেই (চিত্র ১৪)। কোন্ লোক কোথায় বসবে কিভাবে বৈঠা ফেলবে তার প্রশিক্ষণ চলে। নৌকার হাল যিনি ধরেন তাকেই নৌকার প্রধান ধরা হয়। নৌকাতে একজন লোক থাকেন যিনি নৌকার বৈঠা ফেলার যে Rhythm তা ঠিক করেন। একজন গায়ক গান করেন তাকে সাইরদার বলা হয়।
যে দিন নৌকা বাইচ খেলতে নৌকা যায় সেই দিন নৌকার মালিক নৌকার মাথায় ধূপ ধুনা ফুল মালা দিয়ে তাকে বরণ করেন (চিত্র ১৫)। সিঁদুর দেওয়া হয় নৌকার মাথায় তার পর দুধ দিয়ে তাকে বলাহয় ‘জয় যাত্রায় যাও’। এই জয়যাত্রা মনে করিয়ে দেয় রণে বিজয়ের কথা। এই নৌকা বাইচ হয়ত এই অঞ্চলের রণতরীর মহড়া।
নৌকা বাইচের সাথে ওতোপ্রতোভাবে গান জড়িত। এই গান সারি গোত্রীয়। বাংলাদেশে যারা নৌকাতে এই গানের সুর ধরেন তাঁদের সাইরদার বলে। নৌকা যখন বাইচ খেলতে যায় তখন যে গান গীত হয় তা যাত্রা পর্বের।
যাত্রাকালে বাধা দিওনা বিদায় দেওগো সকালে
আমার নীলগো রতন কাল রতন সাজাইয়া দে…
যাত্রা পর্বের পরে যে গান গাওয়ার রীতি তাহল ‘জলভরা’ পর্ব:
রাধিকা সুন্দরী জল ভরিতে যায় সোনার নুপুর বাজে রাঙা পায়
দেখরে কার রমনী জলে যায়।
ব্রাম্ভণবাড়িয়া অঞ্চলে দৌড়ের নৌকায় গাওয়া হয়:
নিশিতে যাইও ফুল বনেরে ভ্রমরা।।
জ্বালাইয়া জ্ঞানের বাত্তি ফুল ফুটাইও নানান জাতি
আরে কত রঙ ধরে ফুলের কলিরে।…
বাইচের নৌকার গান পুরোপুরি নদী কেন্দ্রিক সুরশাসিত। অঞ্চলভেদে সুর ভিন্নতা ঘটলেও এর মাঝেই ব্যপ্ত আছে ভাটিয়িলির সুর। এই অঞ্চলের লোকসঙ্গীতের সকল ধারাতেই নদীর সুর প্রভাবিত।
আয়োজন
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট কমিটি এই খেলা আয়োজন করে। কমিটি তৈরি হয় মনসা, বিশ্বকর্মা অথবা দুর্গা পুজোকে কেন্দ্র করে। কখনো হাট কমিটিও এর আয়োজক। নির্দিষ্ট স্থান থেকে দু-চার কিলোমিটার দূরের নির্দিষ্ট স্থানে যে আগে পৌঁছতে পারে সেই হয় বিজয়ী। সাধারণ ভাবে এই অংশটাতে নদীর বাঁক থাকে কম (চিত্র ১৬)। দুই পারে মানুষ সমবেত হয়ে নৌকা বাইচ দেখতে পাবে এই রকম জায়গা আদর্শ (চিত্র ২)। বাইচের নৌকার মালিকের কাছে কমিটি জানিয়ে রাখে দিনক্ষন। কেননা বাইচের নৌকা সংখ্যায় অনেক কম। পুজো উপলক্ষ্যে মেলা বসে। সেই মেলায় লোক সমাগম হয়। তারাই বাইচের দর্শক। বাইচ হয় পড়ন্ত বিকেলে (চিত্র ১)। প্রতিযোগিতা শেষে পুরস্কার দেওয়া হয়। মালেকান ঘুমটির হাট কমিটি প্রথম পুরস্কার হিসেবে বাওনিয়ার নৌকোর মালিককে দিয়েছিলেন একটা বাছুর। দ্বিতীয় পুরস্কার ছিল পিতলের কলস। কচুখালির বাইচের প্রথম পুরস্কার রেফ্রিজারেটর। দ্বিতীয় টিভি। তৃতীয় রেডিও। আবার চাতরের বাইচে নগদ টাকা দেওয়ার রেওয়াজ আছে। আগেকার দিনে পুরস্কারের থেকেও বেশী প্রাধান্য পেত উৎসবে অংশগ্রহণ। আজ তা ক্রমশ ফিকে।
নৌকা বাইচের ব্যাখ্যা
নৌকা বাইচের সাথে জলের সম্পর্ক। বর্ষার সময়ে ভালো বৃষ্টি হলে ফসল ভালো হবে। সেই ভালো বর্ষার জন্যই প্রতীকী এই নৌকা বাইচ। বাংলাদেশে মনসা পুজো হয় শ্রাবণ মাস জুড়ে। মনসার সাথে সাপের সম্পর্ক। সাপ ঊর্বরতার প্রতীক।
চীন দেশের ড্রাগন বোট রেসের সাথেও এই রকম এক সম্পর্কের হদিস পাওয়া যায়। ভাবা হয় আকাশে অনেক ড্রাগন আছে। তাদের মধ্যে মারামারি রেষারেষি ফল আকাশে বিদ্যুৎ চমকানো এবং বৃষ্টি। আসলে সেই রেষারেষিই শঙ্খলাগা, দুই সাপের মিলন। তৈরি হয় নতুন প্রজন্ম। ঊর্বরা শক্তির প্রতীক এই মিলন। এই কল্পনাকে বাস্তব পৃথিবীতে নামিয়ে আনা হল। সাপের মতো দেখতে দুই নৌকাকে জলে মিলিত হতে দেওয়া হল। এর ফলে বর্ষার জলে ঊর্বর হবে জমি, ফলবে ভালো ফসল।
পশ্চিমবাংলাতেও বাইচের নৌকাকে সাপ হিসাবে কল্পনা করার প্রবণতা আছে। বাইচ মনসা কেন্দ্রিক। মনসার ভাসান গান শষ্য ফলনের গান। সুতরাং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সংস্কৃতির সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের নৌকা বাইচ অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত এবং তা একই ধারণা থেকে সৃষ্ট। উর্বরা শক্তির আরাধনা নৌকা বাইচ।
তথ্যসূত্র
সমুদ্র বিশ্বাস, বাঙালী জীবনে নৌকা বাইচ ও সারিগান, পালিকৃত, ১ বর্ষ; ২য় সংখ্যা, ২০০০, কলকাতা
মাহবুব আলম, নৌকাবাইচ উৎসব, বাংলা একাডেমী ঢাকা, বাংলাদেশ, ১৯৯৮
শরদিন্দু বিশ্বাস, সোনার দাঁড়, পবনের বৈঠা, গণশক্তি শারদ সংখ্যা, ১৯৯৮
প্রবন্ধটি ক্ষেত্র সমীক্ষা থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রস্তুত
কৃতজ্ঞতা সপ্তডিঙা