ইরাবতী পাঠ প্রতিক্রিয়া: নতুন, বিজ্ঞান চেতনার কাব্য । খালেদ হামিদী
০১. কলজে কাঁপে ভয়ে কখন কী যে হয়/পাংগিয়ার চরে আছড়ে পড়ে ঢেউ (…) এদের কারও নেই নামাজ রোজা দেখ/এদের কারও নেই অযথা সন্দেহ (…) আমাকে দেখেছে কি আমি তো একা একা/টেথিস জলধিতে নীরবে ভেসে থাকা (টেথিস সাগরের ভুতুড়ে সন্ধ্যায়)
বলুন তো উপর্যুক্ত অংশত উদ্ধৃত কবিতাটি কার? সঙ্গে সঙ্গে বলতে পারার কথা নয়। এই সম্পূর্ণ নতুন ধরনের কবিতাগুলো সম্প্রতি লেখেন জিললুর রহমান। জিললুরের নতুন ধারার কবিতার আরো কিছু পাঠ নেয়া যাকঃ
০২. শুধু তারামাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে বালুকাবেলায়/পন্চাশ কোটি বছর আগের পৃথিবী পাড়ায় […] তাহাদের প্রেম ভালবাসা লয়ে প্রকৃতির কোনো/কিতাব দেখিনি, লেখা জোখা নেই মান অভিমানও […] কোটি বছরের সূত্রে নিজের পরিচয় খুব অতিথি সুলভ/ আমাকে কেউ তো চেনে না জানে না এত দুর্লভ […] সাঁতরে ফিরেছি পাঙ্গিয়া মহাদেশের দুপারে/মানুষের কোনো টিকি দেখি নাই ধুধু প্রান্তরে/তারা মাছেদের রাজত্বে খুব সাবলীল দিন/কলি যুগে আর ফেরে না কৃষ্ণ বাজবে না বীণ (শুধু তারামাছ)
০৩. একদিন সমস্ত জগত ঢেকে গেল বরফের স্তুপে। প্যালিয়াজোয়িক যুগে সেই যে সায়ানো ব্যাকটেরিয়া আচ্ছাদিত করে সমগ্র লরাশিয়া — আমি তার ফাঁকে ফাঁকে হাঁটতে চেয়েছি কতোকাল। […] লক্ষ লক্ষ বছরের ঘটনাবিহীন পৃথিবীতে প্রাণীহীন প্রাক ক্যাম্ব্রিয়ান যুগে প্যান্থালাসা মহাসাগরের তীরে খাবি খেতে থাকি আমি কোন্ আদম সন্তান! কোন্ স্বর্গ থেকে বিতাড়িত! […] আমি কি প্রথম মানুষ তবে? প্রথম সৃষ্টি ভেবে ভুল করি? আমিই ঈশ্বর তবে? গড়ে তুলব নতুন পৃথিবী? […] তবে আদি পুস্তক এবার লেখা হোক কল্পিত মহাস্বর্গের স্লোকের ভাষায়… (একদিন বরফ যুগে)
০৪. সৎ পথে যত চাই ডাকিবারে, ভুল পথে ছোটা ততো।/যুগ যুগ ধরে প্রকৃতি ছুটেছে অসৎ পথের ডাকে।/আমিই কেবল নামাবলী গাই কেবলাকান্ত টুপি দাড়ি চাই।/শাপশাপান্ত করি প্রাণীকুলে আর —/কে দেখে পথের দিশা?/যতোদিন যায় টেরপেতে থাকি জীবন মানেই ছোটা। (কেবল এগিয়ে যাওয়া)
০৫. লাকুম লাকুম দীনুকুম বলে ওয়ালিয়া দীন প্রচুর দেখেছি। আমি ইতি উতি খুঁজি কোথাও কি মানুষের মতো হিংসা করার ধর্মকে খুঁজি। মন্দির খুঁজি মসজিদ খুঁজি। প্রাণীকুল তার বোঝেনি কিছুই। এরা বুঝে তার বেঁচে থাকবার কাজ করে চলা। […] আমিই কি বৃথা খুঁজি হেথাহোথা অনর্থকের নামে (তখনো জমেনি শীলা)
এই ছোট্ট গদ্যের শিরোনামে কি কোনো আতিশয্য আছে? আপনারা কী বলবেন? আমি যতোটুকু জানি, কবির মানসভ্রমণের এমন প্রেক্ষাপট, অন্তত বাংলাদেশের কবিতায়, আর নেই। গঠনপ্রক্রিয়াধীন প্রাগৈতিহাসিক পৃথিবীর নানা কালপর্বজোড়া নিজের অবস্থিতির এই কাব্যিক অনুবাদ অভিনতুন। এক কোষী প্রাণীর আবির্ভাবেরও আগেনিজেকে জগতে আবিষ্কারের এই সৌন্দর্য অতুলনীয়। না, জগতের সঙ্গে কবির এই একাত্মতাবোধ নতুন নয়। রবীন্দ্রনাথ দেহাবসানের পরেও পৃথিবীর প্রতিটি ধূলিকণার সাথে মিশে থাকবেন বলে জানান, কবিতায়। এই একাকার ঐহিকতা ভবিষ্যৎমুখী। জীবনানন্দ ‘রূপসী বাংলা’য় বাংলার এমন নিসর্গকে/প্রকৃতিকে আপন সত্তায় গ্রথিত করে নেন যা বাংলা কবিতায় থাকে অদৃষ্টপূর্ব। কিন্তু একই সঙ্গে বিজ্ঞানচেতনার প্রাখর্যে ও জগতের আদি হতে অন্ত অব্দি বিস্তৃত-সঞ্চারিত কবিসত্তার আবেগে-অনুভবে এযাবৎ রচিত হয় কি কবিতা? তাছাড়া উপর্যুক্ত কবিতাগুলোর সাফল্যও এখানে যে, এগুলো প্রায়ই ছন্দে লেখা। তাও, বিশেষতলক্ষণীয়, ছয় ও সাত মাত্রার মাত্রাবৃত্তে রচিত। অগম্ভীর সাবলীলতায় তিনি বৈজ্ঞানিক নাম ও পরিভাষাগুলোকে কবিতায় এক অভিভূতকর মসৃণতা দান করেন। কেবলই কি তাই? জিললুর লক্ষ-কোটি বছর পরের মানবীয় প্রচল ও ‘অনর্থকতা‘কেও সরাসরি অথচ অনবদ্য কাব্যিকতাযোগে কটাক্ষ করেন কেবল নয়, খারিজও করে দেন। যেমনঃ
(ক) হঠাৎ মিলেছে দেখা আত্মীয়েরও বেশী/যেমন সাযুজ্য দেহে তেমনি তার পেশী/কেবল সে খর্বকায় লিলিপুট যথা/প্রাইমেট প্রথম স্বজন ওরা গিবনের জাতি/এদের সমাজ ছিল মিশরের দেশে/বিশ লাখ ত্রিশ লাখ বছরের আগে/এখানে তারাই যতো মানুষের জাত ভাই/রূপান্তর ঘটে ধীরে নরবানরের বেশে/কিছু তারা আফ্রিকায় বিচরণ করে/কেউ সমতলে কেউ গাছের উপরে/আমাকে তাদের মতো বুঝি মনে হয়/একে অপরের দিকে ইশারা ফুকারে (মিশরের মরুভূমি ঘুরে ঘুরে চলা)
(খ) করতোয়া আর মহানন্দার ঢল এসে একাকার। আমি ভেসে যাই কালান্তরের পথে, নূহ নবীদের কিস্তিমাতেরও আগে। […] কাল থেকে কালে আমি ভেসে যাই — হাতে কিছু নাই খড়কুটো নাই ধরবার ছুতোখানি। (বানভাসি)
(গ) প্যারাপিথেকাস এসব জানে না।/গাছে গাছে তার নেচে বেড়াবার দিন শেষ হয়ে আসে। সাড়ে চার কোটি বছর আগেই নিভে গেছে তার নাম। এসব নিয়ম কালের লিখনে আমিও তো মুছে যাব। মানুষের নাম মানুষই মুছবে মনে হেন সন্দেহ…(ঘ)বরফ হাতড়ে যতোটুকু যাই/যতোখানি ঘুরি চীন,/ফানকুর কোনো ফসিলের দেখা/মেলে নাই মেলে নাই।/বরফ যুগের হিম শীতলতা/দু:খগুলোকে ঢাকে/লাল চোখ থেকে সূর্যের তেজ/সাদা চাঁদ দেয় প্রেম। (ফানকুর পৃথিবী)
আমপাঠকের সুবিধার্থে কবি তথ্যসূত্রও উল্লেখ করেন এভাবেঃ
০১. (আজ থেকে বিশ ত্রিশ লক্ষ বছর আগের ফসিল নরবানরের সাক্ষ্য দেয়, যাদের সাথে মানুষের অনেক সাযুজ্য খুঁজে পাওয়া যায়)
০২. (চীনাদের একটি প্রাচীন বিশ্বাস: পৃথিবী সৃষ্টি হয় ফানকুর তৈরি বিশাল ডিম ভেঙে। তার এক চোখ থেকে সূর্য, অপর চোখ থেকে চাঁদ জন্ম নেয়।)
বিশ্বকবিতায় বিজ্ঞানচেতনা বা বৈজ্ঞানিক অনুষঙ্গের কি কোনো উল্লেখ নেই? আছে। এমিলি ডিকিনসনের (যার কাব্য অনুবাদ করেন আমাদের আলোচ্যমান কবি) ৮২২-সংখ্যক কবিতায় পরিবেশগত উপাদানের উল্লেখ মেলে। কিন্তু তাঁর সজাগতা সংযোগ-অযোগ্য অভিজ্ঞতার বয়ানেই উত্তীর্ণ, কবি আমাদের নিজেদের মধ্যেই অভিযান পরিচালনায় তৎপর বলেই, ড্যানিয়েল ডেনেট যেমন বলেন {Darwin’s Dangerous Idea (1995), p. 371-372}। এমিলির পুরো কবিতাটাই পাঠ করা যাকঃ
This Consciousness that is aware/Of Neighbors and the Sun/Will be the one aware of Death/And that itself alone # Is traversing the interval/Experience between/And most profound experiment/Appointed unto Men – # How adequate unto itself/Its properties shall be/Itself unto itself and none/Shall make discovery. # Adventure most unto itself/The soul condemned to be -/Attended by a single Hound/Its own identity.
বৈজ্ঞানিক অনুষঙ্গের, পরিবেশগত উপকরণের দেখা মেলে যথাক্রমে ওঅল্ট হুইটম্যান এবং উইলিয়াম ওঅর্ডসওয়ার্থের কবিতায়ও। শুধু তা-ই নয়, মেরী হাওয়ে, ২০১২ সালে যাকে ‘স্টেট পয়েট ফর নিউইয়র্ক’ বলা হয়, স্টিফেন হকিংয়ের প্রয়াণে লেখেন কবিতা Singularity । কিন্তু জিললুরের পৃথকতা কোথায়? উপর্যুক্ত কবিদের ধরনে খণ্ডিত বা সীমিতরূপে বিষয় বা প্রসঙ্গ মুগ্ধতার পরিবর্তে তিনি প্রাগৈতিহাসিক ঢের দূর অতীতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে দূরতর ভবিষ্যৎকে সম্ভাব্য কিংবা দ্যোতিত করে তুলতে চান। জিললুর রহমান সেই সঙ্গে প্রমাণ করেন, প্রকৃত কবি প্রকৃতার্থেই সৃষ্টির আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত, একই সঙ্গে পথিক, নাবিক এবং এমনকি নভোচারী হিসেবেও, পরিভ্রমণরত থাকেন। জয়তু বিজ্ঞানচেতনার কাব্য।
