| 25 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক: চিন্তামণির দরবার (পর্ব-২) । জয়তী রায় মুনিয়া

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

পরকীয়া

চিন্তামণির দরবারে স্বাগত।
খোলা মনে আড্ডা দেওয়ার এই দরবারে প্রশ্ন করতে পারেন অনায়াসে। চিন্তামণি উত্তর দেবে সরাসরি। আজ যে বিষয়টা নিয়ে এসেছি, তার পিছনে আছে একজনের কিছু প্রশ্ন। সেই একজন একটি মহিলা। বয়স চল্লিশ। সুন্দরী। গৃহবধূ। দুটি সন্তানের জননী। সবকিছু ঠিক চললেও, একদিন হঠাৎ মহিলা আবিষ্কার করে তার জীবনে পা রেখেছে নতুন আগন্তুক।
এই পর্যন্ত এসে বলি, আজকের বিষয় পরকীয়া।
পরকীয়া যাকে ইংরেজিতে বলা হয়, Adultery, বিবাহ বহির্ভূত প্রেম। আজকে নতুন কিছু নয়, সেই রাধা কৃষ্ণের আমল থেকে চলে আসছে। নিজের চেনা গন্ডির বাইরে যেতে মানুষের আগ্রহ চিরকালের। আদিম কাল থেকেই মানুষ স্বেচ্ছাচারি। সম্পর্কের বন্ধন মেনে নিতে হয়েছে সমাজ সৃষ্টি হওয়ার পরে। সমাজ অভ্যাসের দাসত্ব করতে বাধ্য করায়। যার ফলে সম্পর্কের তিক্ত দিক, এক ধরনের দিন যাপন মেনে নিতে হয়। সমাজের কঠিন নিয়ম বন্ধ করে দিয়েছে মুক্ত চিন্তার জানালা। ফলত, খুলে নিতে হচ্ছে গোপন পথ। এটাই হতে বাধ্য।

পরকীয়া সমর্থন করা যায় কী?

পরকীয়া অসুস্থ মানসিকতার পরিচয়…. এমন কথা বলে থাকে সমাজ বিজ্ঞানী। এও বলা হয়ে থাকে, পরকীয়া শুধু একটা সংসারকে নয়, একটি সমাজ জাতি ও রাষ্ট্র নষ্ট করে দেয়। তৃতীয়ব্যক্তি দাম্পত্য জীবনে ঢুকে পড়ে তছনছ করে দেয় সমস্ত। সমাজ জুড়ে চলে ধিক্কার। যার আঘাতে মন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। দৌড়তে হয় মনোচিকিৎসকের কাছে। পরকীয়া আঘাত হানে বিশ্বাসের উপর। নর নারীর সম্পর্কের ভিত হল বিশ্বাস, সমস্ত দিনের শেষে মানুষ এসে দাঁড়ায় বিশ্বাসের ছায়াতলে। যাযাবর জীবন যাপনের বিশৃঙ্খলা থেকে সমাজ জীবনের শৃঙ্খলায় নিয়ে আসার এই যে প্রয়াস , তাতে চরম বিদ্রুপের কাজ করে পরকীয়া সম্পর্ক। যেন কালবৈশাখীর ঝড়ের মত লন্ডভন্ড করে দেয় সমস্ত শৃঙ্খলা আর সাজিয়ে রাখা সংসার। সমাজের অহংকারী আকাশে পরকীয়া যেন প্রচন্ড তান্ডব। সমাজ তাকে মেনে নেয় না কিছুতেই।


আরো পড়ুন: ধারাবাহিক: চিন্তামণির দরবার (পর্ব-১) । জয়তী রায় মুনিয়া


পরকীয়া ও ডিপ্রেসন

পরকীয়ার ফলে ক্ষতির তালিকা বেশ দীর্ঘ। প্রথমত সামাজিক সম্মান হানি। দ্বিতীয়ত , আরো একটা সম্পর্ককে বাস্তবে রূপ দিতে গিয়ে নানারকম অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। সমীক্ষায় দেখা গেছে, মার্ডারের মত নৃশংস অপরাধ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরকীয়ার জন্যই ঘটে থাকে। লুকিয়ে চুরিয়ে করা প্রেমের সম্পর্ক অচিরে সামনে এসে পড়ে, তখন আর কোনো উপায় থাকে না। এখন সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে পরকীয়া চলে এসেছে ঘরের মধ্যে। মহিলা পুরুষ উভয়ে বিভ্রান্ত এখন। ঘরের লোককে হারাতে চায় না আবার বাইরের প্রেম ভুলতে পারছে না… পুরোপুরি বিভ্রান্ত। অকারণ ঝগড়া, কিটকিট শুরু হয়ে যায়। যারা ভাবে, পরকীয়ায় মন ভালো থাকে, তাদের বলে রাখা ভালো, দুইনৌকায় পা দিয়ে চলতে গিয়ে মুশকিল হয় ভীষন। অধিকার বোধ কাজ করে ভিতরে ভিতরে। যে বস্তু পাওয়া না যায় তার প্রতি আকর্ষণ থাকে প্রবল, ফলে সংসার জীবনে এসে ধাক্কা মারে বাইরের অধিকারের প্রবল বেগ। যাকে সামলাতে গিয়ে চাপ পড়ে মনের ঘরে। কিছু ক্ষেত্রে কাজ করে অপরাধ বোধ। পাপ বোধ। সব মিলিয়ে যাতনাময় জীবনের শিকার হতে হয়। ডিপ্রেসন ঘিরে ধরে অনিবার্য ভাবে।

পরকীয়া ও যৌনতা

পরকীয়ার মূল আকর্ষণ অবশ্যই যৌনতা। পরকীয়া আর প্রেম এখানেই আলাদা। মূলত যৌন মিলনের চাহিদা টেনে নিয়ে যায় অবৈধ সম্পর্কের দিকে। দাম্পত্য জীবনের যে দিকটি সবচেয়ে অবহেলিত হয় , সেটি হল আকর্ষণীয় যৌন জীবন। পরকীয়ার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা অজানা রহস্যের দিকে মানুষকে ধাবিত করে। যৌনতা এক ধরণের এনার্জির যোগান দেয়। সাময়িক ভাবে হলেও নিজেকে বেশ টগবগ মনে হয়। বারবার পরকীয়ার দিকে আকর্ষণের মূল কারণ হল , নিজেকে তৃপ্ত করা। মানুষ অতৃপ্ত জীব। কিছুতেই যেন মন ভরে না। এই অতৃপ্তির হাহাকার তাকে আকর্ষণ করে পরকীয়ার দিকে।

পরকীয়া আর ভালোবাসা / দুটি কি সমার্থক?

নাহ্। পরকীয়া হল সাময়িক উত্তেজনা, ভালোবাসা অনেক গভীর। বিনি সুতোয় গাঁথা এক অদ্ভুত অদৃশ্য বন্ধনের তীব্র টান হল ভালোবাসা। পরকীয়া ভোগ করতে চায়, ভালোবাসা বিশ্বাস করে ত্যাগে। এইজন্য ভালোবাসায় আবদ্ধ নারী পুরুষ বিবাহিত না হলেও টেনশন বা ডিপ্রেশনের শিকার হয় না। প্রেমের প্রদীপ শিখা চিরতরে জ্বলে। আত্মাকে আলোকিত করে শরীরকে নয়। কবি নজরুলের ভাষায় বলা যায়:
নাইবা পেলাম আমার কণ্ঠে তোমার কণ্ঠাহার
তোমায় আমি করব সৃজন এ মোর অহংকার।
ভালোবাসা কঠিন ত্যাগে বিশ্বাসী। পরকীয়া তরল প্রহসন। চাওয়া পাওয়া , দৈহিক চাহিদা পূরণ, দ্বিধা দ্বন্দ্ব স্বার্থ চরিতার্থ, প্রতিশোধ স্পৃহা , কিছু হলেই স্ক্রিন শট, কামনির্ভর এই সম্পর্কের জেরে মানবতা সমাজ সংস্কৃতি চরম বিপন্নতার শিকার।
নাহ্। ভালোবাসা আর পরকীয়া এক নয়। সম্পূর্ণ বিপরীত। মুশকিল হল, প্রায় সকলেই মনে করে , নতুন করে প্রেমে পড়েছে সে অথবা এখন এলো সত্যিকারের ভালোবাসা। বস্তুত, দীর্ঘ দিনের অনাবৃষ্টির পরে যখন বৃষ্টি নামে , জমি শুষে নিতে থাকে জল। যৌনতা অবশ্যই প্রয়োজনীয় বস্তু। অস্বীকার করে লাভ নেই। এক্ষেত্রে কাউকে ভালোবাসলে যৌনতা আসতেই পারে। কিন্তু, প্রদীপের আলো ততক্ষণ ভালো যতক্ষণ না ঘর পুড়িয়ে দেয়। প্রকৃত ভালোবাসা প্রদীপের আলোর মত , অন্ধকারকে উজ্জ্বল করে। পরকীয়া সাময়িক লেলিহান শিখা , জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে। প্রদীপের মধ্যে ভালোবাসা নামক তেল থাকে, আর পরকীয়ায় থাকে সাময়িক উত্তেজনার দাহ্য পদার্থ।

এতক্ষণের আলোচনায় বোঝা গেল, পরকীয়া ছিল ,আছে, থাকবে। যুগভেদে খুব বেশি পরিবর্তন হয় নি। ফলত, বহু ভয়ঙ্কর ঘটনার ঘনঘটা ঘটে যাচ্ছে সমাজে। শেষ হয়ে যাচ্ছে পরিবার। পরকীয়া থেকে কোনো সৃষ্টি মূলক কাজ গড়ে উঠছে না। যদিও সাময়িক অবসাদ কেটে যায়, কিন্তু, চিরস্থায়ী কোনো সমাধান হয় না। মানুষ আবার একাকীত্বের হাহাকারে নিমজ্জিত হয়।

পরকীয়া থেকে পরিত্রাণের উপায়

:অজানার প্রতি আকর্ষণের কারণে পরকীয়া থাকবেই। কিন্তু, নিয়মিত মনের চর্চা করলে শক্তিশালী মন বুঝতে পারে এর অসার দিক। লোভের দিক থেকে নিজেকে সরিয়ে আনার শাসন পর্ব নিজেকেই করতে হয়।
: দাম্পত্য সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হয়। সম্ভব না হলেও পরকীয়া না করা ভালো। এক ঝামেলা থেকে অন্য ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লে লাভ খুব একটা কিছু হয় না।
: মনের অবস্থার উন্নতি ঘটানো একান্ত প্রয়োজন। মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধতা থাকে। একজন মানুষ আরেকজন মানুষের পরিত্রাতা না হতেই পারেন। সেক্ষেত্রে নিজের মন হয় নিজের অবলম্বন। নিজের মনের চাইতে বড় বন্ধু আর কেউ হয় না। প্রতিদিন ৫ মিনিট সময় নিজেকে দিন , নিজেকে গুছিয়ে নিন। সঠিক পথের দিশা পেয়ে যাবেন। পরকীয়া না প্রেম … কে এলো জীবনে? ঝড় না দখিনা বাতাস … দাবানল না প্রদীপের আলো… সমস্ত বুঝে যাবেন। নিজেই নিজের দিশা হলে ঠকে যাবার ভয় থাকে না।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত