| 23 এপ্রিল 2024
Categories
ইরাবতী তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা

গল্প: স্মৃতি ফিরিয়ে আনে যে হাওয়া । মনিজা রহমান

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

১.

ভ্যালেন্টাইন উৎসব আমার একদম পছন্দ নয়। বছরের এই একটা দিন কত দ্রুত কাটবে সেই অপেক্ষায় থাকি। এর পিছনে একটা নাতিদীর্ঘ ইতিহাস আছে। যদি একটু ধৈর্য্য ধরে শোনেন তাহলেই বলব।

আরেকটা কথা বলে রাখি যে, এই কাহিনী পড়ার সময় ব্যাকগ্রাউন্ডে বিরহের কোন গান শুনতে পারেন। সিনেমা-নাটকে আপনারা দেখেছেন, কিভাবে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ব্যবহার করা হয়! কিন্তু এ আমি কি করলাম, শুরুতেই বলে ফেললাম- এ কাহিনী বিরহের, মিলনের নয়!

আমি সব সময়ই একটু খ্যাপাটে ছিলাম সেই ছোটবেলা থাকে। একটা জিনিস মাথায় ঢুকল তো ঢুকল, ভালো-মন্দ, আগু পিছু না ভেবে করার জন্য মরিয়া হয়ে যাই।

-আমি ইএসএল স্কুলে ভর্তি হতে চাই।

রাতে খাবার টেবিলে স্বামী আর শাশুড়ির সামনে কথাটা বলে ফেলার পরে সেরকম প্রতিক্রিয়া দেখলাম না! সিদ্ধান্ত যে আমি নিয়ে ফেলেছি এটা বুঝতে বাকী নেই কারো।

-আমাদের আমেরিকা যাবার বাকী আর দুই সপ্তাহ। এই কদিনের জন্য ইএসএল ক্লাসে ভর্তি হয়ে কি করবে তুমি!

আমার স্বামী রায়হান তার স্বভাবসুলভ শান্ত কণ্ঠে বলল। ওর যুক্তি মোটেও মাটিতে ফেলার মতো নয়। আমি বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিয়ে দেখেছি তিন মাসের নীচে কোন কোর্স নাই। সেখানে পুরো কোর্সের টাকা দিয়ে মাত্র দুই সপ্তাহ ক্লাস করাটা বোকামী।

-দুই সপ্তাহ হোক আর দুই মাস, আমেরিকা যাবার আগে ইংরেজীতে কথা বলা তো কিছু শিখতে পারবো!

আমার যুক্তি কারো মনে ধরল বলে মনে হল না। শাশুড়ির মুখে স্পষ্ট অসন্তুষ্টি।

-যাবার আগে এমনিতে কত গোছগাছের ব্যাপার থাকে, অনেকে দেখা করতে আসে, এই সময় তুমি ক্লাসে থাকবে, সেটা কিভাবে হয়!

শাশুড়ির কথায় কিছু বলি না। ওনার মুখের ওপর কথা বলার স্বভাব আমার নেই। উনিশ বছরে বিয়ে হওয়ার দিন থেকে কোনদিন ওনার সঙ্গে তর্ক করিনি। তবে যা করার করে ফেলেছি। উনি মনে মনে বিরক্ত হলেও তেমন উচ্চবাচ্য করেননি। তাছাড়া বিয়ের পর থেকে দেখে আসছি উনি অসুস্থ। ওনার অসুস্থতা না থাকলে পাঁচ বছর আগেই আমাদের আমেরিকার চলে যাবার কথা ছিল।

আমার বড় ননাস পুরো পরিবারকে স্পন্সর করেছে যাবার জন্য। পরিবারের একমাত্র পুত্রসন্তান হিসেবে রায়হান অসুস্থ মাকে রেখে যেতে পারছিল না। আমাদের জন্য স্পন্সরের মেয়াদ যখন প্রায় শেষের পথে তখন অনন্যোপায় হয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

ফরিদ মিয়া নামে আমার একজন নিজস্ব ড্রাইভার আছে।  ও কিন্তু গাড়ির না, রিক্সার ড্রাইভার। ওর রিক্সা পুরো দিনের জন্য আমার জন্য বাধা থাকে। দিন শেষে আমি ওকে দুইশ টাকা দিয়ে দেই। ফরিদ মিয়াকে সেই অর্থে আমার দেহরক্ষীও বলতে পারেন। সংসার-সন্তান সামলে ছোটখাটো বুটিকের যে ব্যবসাটা করি তার জিনিসপত্র ডেলিভারিতে ফরিদ মিয়া আমার প্রধান অবলম্বন। আমাদের অবশ্য একটা পারিবারিক গাড়ি আছে, যেটা মূলত রায়হানের অফিস আর বড় ছেলের স্কুলে যাওয়া আসার কাজে ব্যবহার হয়। আর আমার বুটিক ব্যবসার এখন পর্যন্ত যে হাল সেখানে গাড়ি দিয়ে মাল ডেলিভারি দেয়া মানে মশা মারতে কামান দাগার মতোই।

ফরিদ মিয়ার রিক্সায় জিন্দাবাজারে স্পোকেন ইংলিশ শেখানোর স্কুলে যখন পৌঁছালাম, তখন সকাল দশটার একটু বেশী হবে। অফিস রুমে ঢুকেই যে লোকটাকে দেখলাম, তাকে ইএসএল শিখতে চাওয়ার কথা জানালাম।

-আপনি তো এখন ভর্তি হতে পারবে না! আমাদের আজকের ক্লাস বিকাল তিনটায় শুরু হবে। নতুন টিচার ঢাকা থেকে চলে এসেছেন আজ ভোরে।

-আমাকে আজ থেকে শুরু হওয়া কোর্সের সুযোগ দেয়া যায় না!

-তাহলে আপনাকে আজ সকালেই ভর্তি হতে হবে।

-আমি এখনই ভর্তি হতে চাই।

-আপনার সঙ্গে ন্যাশনাল আইডি কার্ড আছে।

-হ্যাঁ আছে।

ব্যাগ খুলে লোকটাকে ন্যাশনাল আইডি কার্ড দিলাম। ব্যাগে সব সময় কয়েক হাজার টাকা রাখি। জিন্দাবাজারে এলেই কিছু কেনাকাটা থাকে প্রায়ই। কোর্সের পুরো টাকাটা দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি হয়ে গেলাম।

তারপর ছুটতে বাসায় এসে গোসল সেরে নাকেমুখে কিছু খেয়ে নিলাম। ছোটছেলেকে দেখাশুনা করার জন্য যে আয়া আছে, ওকে বললাম ক্লাস টুতে পড়া বড় ছেলে স্কুল থেকে ফিরলে খাইয়ে দিতে। এটা ওর জন্য নতুন কোন ঘটনা না, প্রায়ই ওকে এটা করতে হয়। তবে দিনে একবেলা হলেও আমি দুই ছেলেকে নিজের হাতে খাওয়াই। রায়হান সেটা জানে বলে আমার এত বেশী বাইরে বাইরে ঘোরাকে সেভাবে আমল করে না।

‘আমি আজকে ইএসএল ক্লাসে ভর্তি হয়েছি। বিকাল তিনটা থেকে ক্লাস শুরু। আমি সেখানে যাচ্ছি।’ ফরিদ মিয়ার রিক্সায় বসেই রায়হানকে টেক্সট করে জানিয়ে দিলাম। এটা আসলে অনুমতি প্রার্থনা নয়, অবহিত করা আরকি! বাসা থেকে বের হবার আগে শাশুড়িকে স্পোকেন ইংলিশ ক্লাসে যাচ্ছি জানাতে ভুলিনি।

২.

-গুভ আফটারনুন গাইজ। আয়াম পলাশ মাহবুব, ইউর স্পোকেন ইংলিশ টিচার।

ডার্ক কালারের চেকশার্ট আর জিন্সের প্যান্ট পরা টিচারকে দেখে চমকে গেলাম। ওনাকে তো এখানে মানাচ্ছে না। ওনার করা উচিত ছিল মডেলিং কিংবা টিভি নাটক, সেখানে রাজধানী ঢাকা থেকে এত পথ পাড়ি দিয়ে উনি সিলেটে কেন এসেছেন! আমার বিস্ময় যায় না।

-টুডে ইন ফার্স্ট ক্লাস উই জাস্ট ইনট্রোডিউসড ইচ আদার। টেল সামথিং এ্যাবাউট ইউরসেলফ। এন্ড ইউ হ্যাভ টু সে ইন ইংলিশ।

নতুন স্যারের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে ফেললাম। চোখে চোখ পড়লেই তো আমাকে বলার জন্য বলবে। এভাবে নানাভাবে চেষ্টা করলাম স্যারের চোখে যেন চোখ না পড়ে। তাই যখন কেউ কথা বলে, তখন মুখ তুলে শুনি। শেষ হয়ে গেলে চোখ নামিয়ে ফেলি। এভাবে চলতে লাগল কিছুক্ষণ। স্যার এক সময় ক্ষান্ত দিলেন।

-ঠিক আছে, যে যার পরিচয় দিতে গিয়ে পড়ার সময় চলে যাচ্ছে। আজ আর পরিচিতির দরকার নেই। আগামী ক্লাসে করব আমরা।

কথাটা শোনার পরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে যেই চোখ তুললাম, সঙ্গে সঙ্গে স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল- ইউ।

আমি হাসি আটকাতে পারলাম না। স্যারও হেসে ফেলল। বুঝতে পারলাম, আমাকে ধরার জন্য আগের কথাগুলো স্যারের একটা ফাঁদ ছিল। কারণ কিসের কি অন্যকিছু পড়াবেন উনি, ওই দিন পুরো সময় পরিচিতি পর্বেই কাটিয়ে দিলেন। এটাও নাকি ইংরেজী শেখার একটা অংশ!

ফরিদ মিয়ার রিক্সায় বাড়ি ফিরতে পুরো রাস্তা বার বার হাসি পেতে লাগল। সপ্তাহ যে কিভাবে কেটে গেল টের পেলাম না। আহা! পলাশ স্যারের মতো একজন টিচার যদি স্কুল-কলেজে পেতাম নিশ্চয়ই স্ট্যান্ড করে ফেলতাম। ক্লাসের সবাই স্যারের বিরাট ভক্ত। আবার কোথা থেকে কে খবর এনেছে, উনি নাকি খুব ভালো গান গাইতে পারেন। আমরা সবাই মিলে খুব চাপাচাপি করেছিলাম, একটা গান শোনানোর জন্য। শেষ দিনের ক্লাসে শোনাবেন বলে আমাদের থামিয়ে দিলেন।

স্যারের পড়ানোর অনুরাগী হলেও আমার প্রতি স্যারের রোমান্টিক চাউনি কেমন অস্বস্তিতে ফেলে দিত। যখনই তাকাতাম দেখতাম উনি গভীর দৃষ্টিতে সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখে চোখ পড়লেও উনি অন্য দিকে তাকাতেন না। কি বিপদে পড়া গেল! মনে মনে নিজেকে বলতাম, দুইদিন পরে তো আমি চলেই যাচ্ছি। তারপর তো সবই শেষ! তখন আর কার দিকে তাকাবি!

তবে শেষের আগে একটা সরকারী ছুটির দিন চলে এল। পলাশ স্যার যে কারণে বাড়তি আরেকদিন ছুটি নিয়ে ঢাকায় যাবেন বলে সবাইকে জানিয়ে দিলেন। আমি মনে মনে ভেবে দেখলাম, পলাশ স্যারের সঙ্গে তো আর দেখা হবে না। ওনার সঙ্গে তাহলে কথা বলে যাই।

-স্যার, স্পোকেন ইংলিশের ওপর আপনার কোন বই আছে?

শুরুটা কিভাবে করব বুঝে উঠতে পারি না। দেখলাম, পলাশ স্যারের চোখে মুখে আনন্দ ঠিকরে পড়ছে। ক্লাসের পরে আমি তার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি, এজন্য সে খুশীতে আটখানা।

-হ্যাঁ, আমার লেখা একটা বই আছে। ঢাকা থেকে আসার সময় নিয়ে আসবো।

সামনাসামনি তাকালে বোঝা যায় ওনাকে স্যার বললেও আসলে বয়সে উনি আমার চেয়ে বেশ বড় না। হয়ত সমবয়সী হবেন। ক্লাসে আলগা ভারিক্কি ভাব নিয়ে থাকেন।

-স্যার, একটা কথা তো আপনাকে বলা হয়নি। আমরা মানে আমি আর আমার স্বামী এবং দুই ছেলে আমেরিকা চলে যাচ্ছি। আগামী সপ্তাহে আমাদের ফ্লাইট, আমরা কালই ঢাকায় চলে যাব। আপনার ক্লাস আর শেষ করা হল না।

আমি কণ্ঠে যতদূর সম্ভব বেদনা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলাম। যদিও আগে থেকে জানতাম, এই কোর্স আমার পুরোপুরি শেষ করা হবে না। স্যারের দিকে তাকিয়ে চমকে গেলাম। ওনার মুখ থেকে কে যেন সব রক্ত শুষে নিয়েছে। একদম ফ্যাকাশে হয়ে গেছে পুরো অবয়ব।

-আমরা দুজনেই তো ঢাকায় যাচ্ছি। আপনার নম্বরটা দিয়ে যান। ঢাকায় ফোন দিয়ে আপনার বাসার ঠিকানা জেনে পাঠিয়ে দেব বইটা।

আমার নম্বরটা দেবার পরে অনেকটা টলতে টলতে উনি ভিতরে চলে গেলেন।

৩.

-আপনাকে আমি বহুবার ফোন করেছি, কিন্তু আপনি কল রিসিভ করেননি। গত তিন দিন ধরে আপনার বই নিয়ে ঘুরছি।

পলাশের মুখে কথাটা শুনে আনন্দিত হবার পরিবর্তে কেন যেন বিরক্ত লাগল আমার। লোকটার কি খেয়ে বসে কোন কাজ নেই নাকি! এতবার ফোন করার কি দরকার!

-আপনাকে তো বলেছি, আমরা নিউইয়র্কে চলে যাচ্ছি। দেশ ছেড়ে যাওয়া ছোট ঘটনা না। কতরকম প্রস্তুতি থাকে জানেন তো! ফোন ধরার সময় পাচ্ছি না। তাছাড়া আপনার নম্বর তো আমার সেভ করা ছিল না।

এক নিঃশ্বাসে এতগুলি কথা বলি কারণ যাতে এরপরে আর যেন আর কিছু না বললেও চলে। পলাশ সেটা বুঝতে পারে হয়ত!

-আপনি ব্যস্ত বুঝতে পারছি। যাবার আগে কি কোনভাবে দশমিনিটের জন্য দেখা করা সম্ভব?

-কাল বাদে পরশু আমাদের ফ্লাইট! এখন কিভাবে সম্ভব?

-কোনভাবেই সম্ভব না!

এমনভাবে পলাশ কথাটা বলল যে হৃদয়ের একদম ভিতরের আকুতি যেন উঠে এল। কোনভাবে তাকে এড়ানো সম্ভব যেন নয়!

-কালকে দুপুরবেলা মগবাজার আড়ংয়ে যাব আধঘন্টার জন্য। সেখানে আসতে পারেন।

আড়ংয়ের আউটলেটের সঙ্গে ছোটখাটো রেঁস্তোরা থাকে কফি আর স্ন্যাকসের জন্য। পড়ন্ত দুপুরে নিরিবিলি রেস্টুরেন্টে পলাশকে বিষন্ন চেহারায় বসে থাকতে দেখলাম। কেমন যেন দেবদাস, দেবদাস ভাব। আমি সামনে গিয়ে বসার পরেও মুখে কোন কথা নেই।

-কেমন আছেন স্যার? আপনি কি অসুস্থ নাকি?

পলাশের বিরহকাতর মুখ দেখে হাসি চেপে রাখা মুশকিল হয়ে গেল। স্পোকেন ইংলিশের বই দেবার কথা বলেছিলেন, কোথায় কি! হাতে কোন বই নেই!

-স্যার, বই কি এনেছেন? বইয়ের দাম কত?

আমার প্রশ্নের উত্তরের পলাশ এমনভাবে তাকায় যে বই আবার কি জিনিস সে বুঝতে পারছে না! বই শব্দটাই মনে হয় আজ প্রথম শুনলো!

-আই লাভ ইউ ইশরাত।

– কি!

-তুমি আজ দেশ থেকে চলে যাচ্ছ, তোমাকে আমার মনের কথা না জানিয়ে পারছি না।

পলাশ কিছুক্ষণের জন্য থামল। এক লাফে আপনি থেকে তুমি। বাব্বা ছেলেটার সাহস আছে! আমিও ওকে তুমি বলার সিদ্ধান্ত নেই। এসব ছোকরা পোলাপানকে আপনি বলার দরকার কি!

-তুমি তো জান, আমি বিবাহিত। দুই ছেলের মা। আমাকে এই সব কথা বলার মানে কি!

পলাশ স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। গভীর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। মনে হয় আশেপাশে কিছু দেখছে না।

-লাভ এ্যাট ফার্স্ট সাইট- শব্দটাতে তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানি না। কিন্তু প্রথম দেখায় আমি তোমার প্রেমে পড়ে যাই। তোমার মায়াবী চোখের দৃষ্টি সারাক্ষণ আমার মনে ভাসে।

এত রোমান্টিক কথা আমাকে কেউ কোনদিন বলেনি। কিন্তু আমার কেন যেন ভালো লাগল না। মনে এখন উড়াল দেবার ভাবনা। নতুন করে বিদেশের মাটিতে জীবন শুরুর উত্তেজনা। পলাশ যেন সেখানে একটা পিছুটান! বিড়ম্বনা বাড়িয়ে লাভ কি!

পলাশের গভীর চোখের দৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করে গটগট করে চলে আসি।

৪.

পলাশ তবু আমার পিছু ছাড়ে না। তাকে মনে হয় একজন ডুবন্ত মানুষ, যে সামান্য খড়কুটো ধরে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে! আর আমি সেই খড়কুটো, যাকে আকড়ে ধরা ছাড়া কোন উপায় নেই।

জীবনে কখনও সেভাবে কারো প্রেমে পড়িনি বলে পলাশের অনুভূতির গুরুত্ব বুঝি না। শুধু তাকে ঝামেলা মনে হয়। তবু মাঝেমধ্যে তার চাওয়াকে অগ্রাহ্য করতে পারি না। তাকে আমার নম্বর না দিলেও ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে যোগাযোগ অক্ষুন্ন রেখেছে। মেসেঞ্জারে নিয়মিত বার্তা পাঠায় সে।

নতুন শহরে ব্যস্ত দমবদ্ধ জীবনের বিপরীতে মাঝেমধ্যে তার এই আকুলি বিকুলিময় বার্তা পেলে খারাপ লাগে না। মনে হয় আমি যেন বেঁচে আছি। এই পৃথিবীতে কোথাও তাহলে আমারও একটা অস্তিত্ব আছে। কেউ কোথাও আমাকে সারাক্ষণ মনে করে। আমার অনুপস্থিতির শুন্যতা অনুভব করে।

ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচারে আমার ছেলের একটা ছবি দেয়া ছিল। পলাশের  বারংবার অনুরোধে সেই ছবি পাল্টাই। তবে পুরোপুরি ওর কথামতো না, ছবিতে আমি থাকলেও সেখানে পাশে আমার স্বামী থাকে। পলাশ কিছু বলে না। নতুন দেশে আসার পরে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাওয়া হয়। ফিরে এসে বেড়ানোর কিছু ছবি দেই। পলাশ খুঁজে খুঁজে সেখান থেকে আমার একা ছবিগুলো নিয়ে চমৎকার ভাবে এডিট করে পাঠায়। মেসেঞ্জারে ওর পাঠানো ছবি পেলে ভালোও লাগে, আবার আদেখলেপনা দেখে বিরক্তও হই মাঝেমধ্যে।

প্রকৃতপক্ষে পলাশের এই মনপ্রাণ উজাড় করে দিয়ে ভালোবাসা আমার ভালো লাগে না। মাঝেমাঝে ভাবি, ওকে বলি- প্রেমে পড়লে এভাবে ব্যাক্তিত্বহীন হতে নেই। তাহলে কাঙ্খিত জনের ভালোবাসা পাওয়া যায় না। নিজের কিছুটা ভাব বজায় রাখতে হয়।

হলিউডের সিনেমায় দেখেছিলাম নায়ককে তার এক আত্মীয় বলছে, রিলেশনশিপের ক্ষেত্রে সেই বেশী পাওয়ার রাখে যে কম কেয়ার করে। পলাশের সঙ্গে আমার সম্পর্কটাও তেমন ছিল। আমি কিছুই কেয়ার করতাম না! কোন রিলেশনশিপ রাখার প্রয়োজনই বোধ করতাম না। নতুন জীবনকে কতখানি আলোকিত করা যায় সেই ভাবনায় মত্ত থাকতাম।

কিন্তু, তুমি কি জানো, রিলেশনশিপের ক্ষেত্রে সেই বেশী আনন্দ পায়, যে বেশী কেয়ার করে!

পলাশের এই কথাটা আমাকে থমকে দিল। আসলে লোকটাকে এত বেশী অবহেলা করেছি যে ওর মেধার সুবিচার করতে পারিনি। ও এত ভালো গান করে যে চাইলে বিখ্যাত কোন গায়ক হতে পারতো। মাঝেমধ্যে নিজের কণ্ঠে গান রেকর্ড করে আমাকে মেসেঞ্জারে পাঠায়। কখনও আইয়ুব বাচ্চুর গান, কখনও জেমসের গান।

‘আমি অনেক পথ ঘুরে/ ক্ষয়ে ক্ষয়ে অন্ধকারে/ তোমার পথের দেখা পেয়েছি/ আর হৃদয়ের মাঝে/ তোমার কাছে আমি চেয়েছি… সে তারা ভরা রাতে/ আমি পারিনি বোঝাতে/ তোমাকে আমার মনের ব্যথা!’

ঢাকায় খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু রিনাকে সব খুলে বলি। নিষ্ঠাবান বন্ধুর মতো ও সব শুনে কিভাবে পলাশকে বোঝানো যায় সেই চেষ্টা করার কথা বলল। পলাশের সঙ্গে কথা বলার পরে সে উল্টো সুরে গাইতে লাগল।  ফেসবুক থেকে পাওয়া আমার সব ছবি নিয়ে পলাশ ওর পুরো রুম সাজিয়ে রেখেছে। ওর মাসহ পরিবারের সবার সামনে এই কাজটা সে করেছে। শুনে হাসব না কাঁদব বুঝতে পারিনা। তবে প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হয় কেন জানি! পাগলামির একটা সীমা থাকা দরকার।

পলাশের সঙ্গে আর কোন সম্পর্ক না রাখার সিদ্ধান্ত নেই আমি। রিনার মাধ্যমে নানাভাবে যোগাযোগের চেষ্টা অবশ্য করে। রিনার কাছে জানতে পারি, পলাশ আমাকে দেখার জন্য আমেরিকা চলে আসবে বলে জানিয়েছে। শুনে খুব বেশী পাত্তা দেই না। আমি তো ওর সঙ্গে এমন কিছু করিনি যে ও এলে ভয় পাব!

হঠাৎ কিছুদিন লাপাত্তা পলাশ। আমি তো রীতিমত ভুলতে বসেছিলাম ওর নাম।

‘এখন আপনাদের গান গেয়ে শোনাবেন ঢাকা থেকে আগত গায়ক পলাশ মাহবুব ‘

নিউইয়র্ক শহরে নিয়মিতই বাংলাদেশের শিল্পীরা এসে সঙ্গীত পরিবেশন করে। কিন্তু পলাশ যে সেই সূত্রে আসতে পারবে কখনও মাথায় আসেনি। আমাদের ক্লাস নেবার আগে ও দীর্ঘদিন লন্ডনে ছিল। বিদেশে আসা ওর জন্য কোন ব্যাপার ছিল না। আসলে মানুষ হিসেবে ওকে সেভাবে মূল্যায়ন না করার খেসারত এটা।

পলাশ আমার দিকে তাকিয়ে গেয়ে ওঠে-

‘পলাশ ফুটেছে, শিমুল ফুটেছে, এসেছে দারুণ মাস/ আমি জেনে গেছি তুমি আসিবেনা ফিরে/ মিটিবেনা তিয়াস।’

পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে বাংলা সিনেমার মতো মনে হয়। নায়ক যেন মঞ্চে গান গাইছে অহঙ্কারী নায়িকার উদ্দেশ্যে। সিনেমার দৃশ্যের মতোই গান শেষ হবার আগে আমি দর্শক সারি থেকে চলে আসি। পলাশ পরে পাগলের মতো আমার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ওর অতিরিক্ত চেষ্টা কেন যেন বিবমিষার জন্ম দিয়েছে। আমার ভালো লাগেনি। ওর নাম শুনতেও ভালো লাগেনি।

তারপর হঠাৎ করে আমার জীবন থেকে হারিযে গেছে ও। একদম নিশ্চুপ হয়ে গেছে। আমার সঙ্গে আর যোগাযোগের চেষ্টা করেনি কখনও। মাঝে মধ্যে মনে হয় ও বেঁচে আছে তো! বেঁচে থাকলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ না করে কি ও থাকতে পারতো।!

আসলে প্রকৃত প্রেম কাকে বলে আমার জানা ছিল না। পুকুর-ডোবা আর খানাখন্দের মানুষ ছিলাম আমি। যে কারণে ভালোবাসার পুরো সমুদ্র দেখে চমকে গিয়েছিলাম।

এজন্যেই আমার ভ্যালেন্টাইন ডে একদম ভালো লাগে না। কেন যে  বছর ঘুরে ফালতু এই দিনটা আসে! আর পলাশের কথা মনে করিয়ে দেয়!

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত