আনন্দপুরের নামটি কে কবে কখন দিয়েছেন, তা ইতিহাসে নেই। তবে নামের সঙ্গে এই গ্রামের খুব কমই মিল আছে। কারণ, গ্রামের সবাই যে খুব সুখে-শান্তিতে বাস করে, এমনটা নয়। আর দশটা গ্রামের সঙ্গে এর খুব বেশি তফাতও নেই। কল্পনায় গ্রাম যেমন থাকে। খোলা মাঠ, ধানক্ষেত, কাঁচা-পাকা রাস্তা, একপাশে সরু নদী, নদীতে নৌকা চলা, ন্যাংটা ন্যাংটা ছেলেরা নদীর জলে ঝাঁপাঝাঁপি করে, চিত সাঁতার কাটে। সেই আনন্দপুরের আজ বেজায় নিরানন্দের দিন। মোহন রায়ের আমবাগানের সবচেয়ে বুড়ো গাছটি কাটা হচ্ছে। সেই গাছ কাটা দেখতে পুরো আনন্দপুরে যেন কৌতূহলের শেষ নেই। তবে ভজন পাগলা অন্য সব দিনের মতোই আজও আনন্দে আটখানা। গাছ কাটা দেখে ভজনের নাচ কে দেখে!
আবোলতাবোল মুখে যা আসে, বলতে থাকে : আম খাস, গাম পাস। গাছ কাটা, মাছ বাটা। হাহহা, হাহহা!
ভিড়ের এক পাশে গামছা পেতে বসা ছিল পাঁচুগোপাল। বয়স ষাটের কম হবে না। আক্ষেপের স্বরে হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, আহা রে! সেই ছোটবেলার আমগাছ! এই গাছের আম আর খাওয়া হবে না! কত কত স্মৃতি। আহা রে!
পাশেই বিড়ি ফুঁকছিল হারিছ মিয়া। তার আক্ষেপটা আরেকটু বেশি। তার বউ ময়না বিবি এই গাছের আম খেতে খুব ভালোবাসত। সুন্দরবনের চাক ভাঙা মধুর মতো আম। গত বছর করোনায় মারা পড়ল ময়না। আমগাছটি দেখে দেখে ময়নাকে মাঝেমধ্যে মনে করতো হারিছ। এখন তা-ও গেল।
—আজ কী বার রে হারিছ? উদাস কণ্ঠে জানতে চায় পাঁচুগোপাল।
—শনিবার। কেন কাকা? হারিছ জিগ্যেস করে।
—আজকাল সব গেছে। কোনো শনি-মঙ্গলবার আর মানা হয় না। এমন একটা কাজ করা হচ্ছে, তা-ও আবার এই শনিবারে। মোহন কি ধম্মকম্ম সব ছেড়ে দিয়েছে? বার-লগ্নও আর মানে না!
—শনিবারে কাটলে কী হয় কাকা? হারিছ রসিকতার সুরে প্রশ্নটি করে।
—তোরা বুঝবি না। তোরা হচ্ছিস এই কালের পোলাপান। তোদের কাছে শনিবারই কি শুক্কুর বারই কি! সব এক।
পাঁচু কাকার দুঃখ বুঝতে পেরেছে, এমন ভান ধরে হারিছ বলে, কী আর করবে? মোহন কাকা যা ভালো মেনেছেন, তাই করেছেন।
—ধম্মে সইবে না রে! ধম্মে সইবে না। শনিবারে এমন অমঙ্গলের কাজটা মোহন না করলেও পারত?
এমন সময় এক বাচ্চা ছেলে, সম্ভবত পঙ্কজ নাপিতের ছেলেটিই হবে, চেঁচিয়ে উঠল, সাপ, সাপ!
সবার নজর গাছকাটা থেকে একপলকের জন্য বাচ্চাটার কণ্ঠের দিকে চলে যায়। হারিছ দৌড়ে যায় বাচ্চাটার কাছে।
—কই সাপ?
—ওই যে দেখো হারিছ কাকা। কত্ত বড় সাপ। হাঁ-করা মুখের ছেলেটির যেন বিস্ময়ের অন্ত নেই।
হারিছ একটা বাচ্চা ডোরা সাপ দেখে বড় হতাশ হয়ে সন্তুর মাথায় একটা গাট্টা মেরে বলল, এই কলিজা নিয়া ঘুমাস কী করে? যা ভাগ!
সন্তু যেন হাঁপ ছেড়ে পালায়, গাছ কাটার ভিড়ে নিজেকে মিলিয়ে বাঁচে।
সাপটি পিলপিল করে রাস্তার পাশের বাঁশঝাড়ের ডোবার পাশ দিয়ে বেয়ে অদৃশ্য হয়।
হারিছ এসে আবার পাঁচুগোপালের পাশে বসে গাছ কাটা দেখে। দূরে একটা জানালা ফাঁক করে গাছ কাটা দেখে নিত্যানন্দ মাস্টারের নতুন বউটি। নিত্যর এই দ্বিতীয় বউটির নাম শতরূপা। নামটা বড় সুন্দর। তবে দেখতে হাতির পাছার মতো। চোখমুখ সবই আছে, তারপরেও কিসে যেন খামতি আছে। গায়ের রং পোড়া কড়াইয়ের মতো, গড়নটা বাঁধানো। দেখলে পড়ে দুবার তাকাতে ইচ্ছে করে না। হারিছ বুঝল, দিনটা আজ খারাপই যাবে। একে তো মোহন কাকার আমগাছটা কাটা হচ্ছে, তার ওপর সেই নতুন বউ, যাকে দেখলেই হারিছের দিনটাই মাটি হয়ে যায়।
২.
আকাশে তখন গনগনে সূর্য ঢেলে দিচ্ছে তার সব তাপ। দু-এক খণ্ড সাদা মেঘের তুলা একটু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ভাদ্র মাসের গরমে নাকি তাল পাকে। শুধুই কি তাল পাকে, পাছাও ফাটে। না হলে এই ঘাসের তলা থেকে লুঙ্গি ভিজে উঠবে কেন? পরনের লুঙ্গিটা দিয়ে মুখের ঘাম মোছে হারিছ। রাস্তার পাশ দিয়ে কলিম উদ্দিন সাইকেল চালিয়ে বাজারে যাচ্ছিল। কী মনে করে সে গাছ কাটার ভিড়ে এসে দাঁড়ায়। তার সাইকেলটির দিকে হারিছের চোখ যায়। জংধরা, রংওঠা পুরোনো ফিনিক্স সাইকেল। টায়ারও খয়ে গেছে। একবার সাতলার মাঠে কলিমের সাইকেলটা নিয়ে এক চক্কর দিতে গিয়েছিল হারিছ। প্যাডেল মারতে গিয়ে বুঝল, ঊরুর পেশিতে বেশ টান লাগছে। ব্রেক কষতে গিয়ে বিপদেই পড়ল। শালার ওই জিনিসও কাজ করে না। সোজা গিয়ে পাশের ধানিজমির কাদায় গিয়ে ধপাস করে পড়ে। এই দেখে সবার সে কী হাসি!
নিতেন বাড়ৈ বলেছিলেন, কী রে হারিচ্চা, এখনো প্যাডেল মারতেই ভালো করে শিখলি না, তো বউ চালাবি কী করে?
নিতেনের এই ঠাট্টার মর্মার্থ হারিছ বোঝে না। সাইকেলের প্যাডেল চালানোর সঙ্গে বউয়ের কী সম্পর্ক? কথাটি নিয়ে সে ভাবতে থাকে। বন্ধু মানুষ। হয়তো, ইয়ার্কি মেরে মুখে যা এসেছে, বলে দিয়েছে।
সাইকেল কাদায় পড়ে যাওয়া দেখে কলিমের তো হায় হায় দশা! মনে হলো যেন, তাকেই কাদায় ডোবানো হয়েছে। চিৎকার করে বলে ওঠে, খানকির পোলা, আমার সাইকেলটার বারোটা তো বাজিয়ে দিলি।
হারিছও ছাড়ার পাত্র নয়। মুখের ওপর বলে দেয়, এ তোমার বালের সাইকেল। ওই সাইকেলে মুতিও না।
তারপর থেকে একরকম কথা বন্ধ দুজনের। রাস্তায় দেখা হলেও অপরিচিতের ভাব করে একে অপরে। বাজারে পাঁচুগোপালের চায়ের দোকানে পাশাপাশি বসে চা খায়। অথচ কেউ কারও সঙ্গে একটাও টু-টা শব্দ করে না।
আরো পড়ুন: হামিদ কায়সারের গল্প লাথথিখোর
৩.
হরতকি বাজারে পাঁচু-র চায়ের সুনাম বহু বছরের। পাঁচ গ্রাম থেকে তার চা খেতে আসে লোকজন। এখন বয়স হয়েছে পাঁচুর। মেজো ছেলে সজলই এখন সব দেখভাল করে। বড় ছেলে কাজল ঢাকায় থাকে। কোনো এক গার্মেন্টস কোম্পানিতে চাকরি করে। বছরে এক-আধবার গ্রামে আসে বউবাচ্চা নিয়ে। এই আসা স্রেফ সম্পর্ক জিইয়ে রাখার জন্য, সে পাঁচু-ও জানে। বাপ মরলে সম্পত্তি যেন বেহাত না হয়ে যায়, ভাইয়েরা মিলে সব বুড়োর কাছ থেকে লিখেপড়ে না নিয়ে যায়, সেই জ্ঞান কাজলের টনটনে। বাপকে কাজল দুচক্ষে দেখতে পারে না। যত দিন মা বেঁচে ছিল, তত দিন একটু ঘনঘনই আসত সে। সবিতাও দেহ রাখল প্রায় সাত বছর। এখন ঈদের ছুটি ছাড়া আর এমুখো হয় না কাজল। ছোটটা সরকারি দলের পলিটিকস করে। শীতলকে চেনে না, এমন লোক এ তল্লাটে খুব কমই আছে। দুইটা মাডার এরই মধ্যেই করে ফেলেছে। বছর কয়েক জেলও খেটে এসেছে। আবার দিব্যি মোটরসাইকেল চালিয়ে হনহনিয়ে ঘুরে বেড়ায়। শোনা যায়, সামনের ইলেকশনে নাকি শীতল মেম্বার পদে দাঁড়াচ্ছে। ভোট তাকে দিতেই হবে। গ্রামে কয়টা ভোট আছে, সে শীতলের কড়িগনা আছে। একটাও কম পড়লে আগুন জ্বলবে, তা কি কারও জানা নেই? মাহতাব এমপির লোক শীতল। মাহতাবকে কে পাস করাল গতবার? এই শীতলই তো বিরোধী দলের সাজু দেওয়ানকে হাপিস করল। এ কথা কি কেউ জানে না? জানে, সবাই জানে। জানলে কী হবে? পুলিশও শীতলকে সমঝে চলে।
দূর থেকে মোটরের শব্দ পেয়ে হারিছ সেদিকে তাকায়। ডান দিকের রাস্তাটা দিয়ে শাঁই করে শীতল চলে যায়। ইদানীং নিজে মোটরসাইকেল চালায় না। তার এক সাগরেত আছে ঝন্টু। সারা দিন শীতলের পেছন পেছন ঘোরে। মোটরসাইকেল চালানোর সময়ই কেবল সামনে বসে। কী মনে করে শীতলের বাইকটা কিছুটা ঘুরে আবার ফিরে আসে। মোহন রায়ের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। সম্ভবত গাছকাটার থেকে চাঁদা নেওয়ার ব্যাপার আছে। মোহন মাথা নিচু করে কিছু একটা বলেন। শীতলের গাড়িটা আবার জোর শব্দে বাজারের দিকে চলে যায়।
পাঁচু-ও আজকাল শীতলকে খুব ভয় পায়। কবে না আবার বালিশ চাপা দিয়ে বাপকে মেরে ফেলে, তার নেই ঠিক। শীতলের আসা-যাওয়া দেখেও না দেখার ভান করে পাঁচু গায়ের ঘাম মোছে কাঁধের গামছা দিয়ে। পরনের ময়লা ধুতিটার দু-তিন জায়গায় ফুটো হয়ে গেছে। একটা নতুন ধুতি কিনবে, সেই উপায়ও নেই। সজলের কাছে টাকা চাইলে এমন ভাব করে যেন, টাকা নয়, তার কলিজা কেটে দিতে বলা হচ্ছে। হাড়কিপ্টা একটা! বউটাকেও একটা নতুন শাড়ি কিনে দিতে তার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। সেই সজলেরই ছেলে বিটু এসে বলল, দাদু, মা ভাত খেতে ডাকছে। আসো।
পাঁচু উঠে দাঁড়ায়। হারিছ একা একা আমগাছ কাটা দেখতে থাকে। গাছটা এখন প্রায় ন্যাড়া হয়ে পড়েছে। অনেকটা গ্যালিভারের কঙ্কাল দাঁড়ালে যেমনটা হতো। করাতিরা একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য ছায়ায় জোট হয়ে বসে। তাদের পানির জগ ও বাটিভর্তি মুড়ি দেন মোহন। কে জানে, গাছটা সম্ভবত আজ কেটে শেষ করতে পারবে না তারা। এ তো আর যেনতেন গাছ নয়। শত বছরের পুরোনো গাছ। এটাকে কি কচুর ডগা পেয়েছ, যে টান মেরে ছিঁড়ে ফেলবে?
গাছকাটা দেখতে দেখতে হারিছের সময়টা দিব্যি কেটে যাচ্ছিল। এখন কী করবে, ঠিক বুঝতে পারে না। ভম্বলের দোকানে গিয়ে বসে একটু গেজানো যেতে পারে।
দোকানের সামনে কাঠের একটা লম্বা বেঞ্চ। একটা পায়াতে সমস্যা আছে বলেই হয়তো সেটা লক্কড়ঝক্কড় করে নড়ে। হারিছ সেটায় বসতে বসতে বলে, ‘একটা বিড়ি দে তো ভম্বল।’
প্যাকেট ভেঙে একটা বিড়ি দিল ভম্বল। গাছকাটা কদ্দুর গো হারিছদা?
—মনে হয় না আজ শেষ করতে পারবে। মাত্র মাথা ছেঁটেই কাহিল। বলে বোকার মতো হাসতে লাগল হারিছ।
—গাছটা কাটতেই হলো? ভম্বলের গলায় শোকের ছায়া। আহা রে কত কষ্টই না পাচ্ছে গাছটা।
ভম্বলের এ কথায় আবারও নিজের বউয়ের কথা মনে পড়ে যায় হারিছের। বউটা হলেও হয়তো একই কথা বলত।
৪.
বাজটা সম্ভবত সাতলার মাঠেই পড়েছে। কিন্তু কেউ এই বাজ পড়ার কারণ খুঁজে পায় না। এই গনগনে রোদের ভরদুপুরে বাজ পড়তে যাবে কোন দুঃখে? এমন বিকট শব্দ আনন্দপুরের কেউ আগে কখনো শোনেনি। গুলির শব্দ শোনেছে, বোমার শব্দও শুনেছে ইলেকশনের সময়। কিন্তু এ কিসের শব্দ? সবার ঘোরদোর কেঁপে ওঠে। এমনকি টেবিলের ওপরে রাখা কাচের গ্লাসটা পর্যন্ত পড়ে ভেঙে পড়ে লুৎফাদের বাড়িতে। কে যেন প্রথমে বলল কথাটা : আকাশ থেকে রকেট পড়ছে!
রকেট? আকাশ থেকে? কোথায়? কোথায় পড়েছে?
একে একে সবার কৌতূহল জড়ো হতে থাকে। রকেট পড়ছে। রকেট পড়ছে।
আরে ধুর রকেট কি পড়ে নাকি? ওটা তো চাঁদে যায়। ওইটা চাঁদে গিয়া পড়ে। বল, বিমান পড়ছে।
শব্দের সন্ধানে সাতলার মাঠের দিকে ছুট লাগায় সবাই। হারিছকে আর পায় কে? এক দৌড়ে মাঠে পৌঁছায় সে। গিয়ে দেখে আজব কাণ্ড! ইয়া মস্ত বড় একটা হেলিকপ্টার উপুড় হয়ে পড়ে আছে। ভেতর থেকে আগুন আর ধোঁয়া বের হচ্ছে। দাবানলের মতো সেই খবর পৌঁছে যায় আনন্দপুরের প্রতিটি ঘরে। দলবেঁধে সব ছুটতে শুরু করে সাতলার মাঠের দিকে। এর মধ্যেই কে কার আগে যাবে, এ নিয়ে হুড়োহুড়ি লেগে যায়।
মোবাইল ফোনে ভিডিও করার হিড়িক পড়ে যায় রোনালদো ছাঁটে চুলকাটা পোলাপানদের মধ্যে। কেউ কেউ সেলফি তুলে সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছে। বেশির ভাগই ফেসবুকে লাইভ করছে। জ্বলন্ত হেলিকপ্টার দেখে আনন্দপুরের আনন্দ যেন ধরে না! মোহন রায়ের আম গাছ কাটার শোক কখন উবে যায়! আকাশের ওপর দিয়ে চলে যাওয়া হেলিকপ্টার আজ তাদের চোখের সামনে।
—ভেতরে মানুষ আছে। কেউ একজন বলল।
—হ হ, আছে, ভেতরে মানুষ আছে।
—আহা রে পানি নিয়া আয় কেউ।
কেউ পানি নিয়ে আসে না। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত থাকে। দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে থাকে। নেভানোর কারো কোনো দায় নেই, বালাইও নেই। পুড়ে মানুষগুলো কয়লা হয়ে যাচ্ছে। আন্ডাবাচ্চা ছেলেমেয়ে, বুড়োবুড়ি, বাড়ির বউ—কেউ বাদ যায় না! সবাই এসে ভিড় জমায় মাঠের চারপাশে। এ যেন বিরাট প্যান্ডেল টাঙিয়ে সার্কাস খেলা দেখানো হচ্ছে। সবার চোখই ছানাবড়া। কেউ কেউ শাড়ির আঁচল চেপে হাপিত্যেস করছে। ভজন পাগলাও এসে সেখানে হাজির। আগুন দেখে তার মাথা বিগড়ে যায়। নেভানোর জন্য উতলা হয়ে পড়ে। কোথাও কিছু না পেয়ে লুঙ্গি তুলে পেচ্ছাব করতে শুরু করে হেলিকপ্টারটাকে লক্ষ্য করে। ভাবখানা এমন, তার পেচ্ছাবে এত বড় আগুন নিভে যাবে।
ভজন পাগলার এমন কর্ম দেখে হাসির রোল ওঠে। বাড়ির বউ-ঝিরাও মুখ টিপে টিপে লজ্জায় হাসে।
৫.
টাউন থেকে দমকল বাহিনী যখন আসে, তখন সাতলার মাঠ আর মাঠ থাকে না। হাজারো মানুষের জমায়েত। পাশেই ঝালমুড়ির দোকান বসে গেছে। একজন তো টেবিল পেতে পান-বিড়ির দোকান বসিয়ে দিব্যি বেচাবিক্রি করছে। সাতলার মাঠ আজ যেন মেলার মাঠ। চুড়ি-ফিতা-বালা-খেলনার দোকান বসলেও কেউ কিছু মনে করত না। হুইসেল বাজিয়ে দমকল বাহিনী এসে হাজির হয় মাঠের এক পাশে। সঙ্গে এক গাড়ি পুলিশ। পুলিশ এসেই বাঁশি বাজাতে থাকে। রাস্তা খালি করতে বলে। রাস্তা খালি করবে কী? আশপাশের বাড়ির টিনের চাল, গাছের ডাল কোত্থাও তিল ধরার ঠাঁই নেই। নিত্য মাস্টারের বউটিও সেখানে উপস্থিত। ভিড়ের মধ্যে ঠিকই হারিছের চোখে পড়ে যায় সেটা। মনে মনে সে ভাবে, ওই খানকি মাগির জন্যই আজকে অমঙ্গল লাগছে। ওটারে একবার বাগে পাইলে পোয়াতি করে ছেড়ে দিত হারিছ। মনের ইচ্ছা মনেই থাকে।
অনেক চেষ্টায় একসময় আগুন নেভে। খবর পেয়ে একটা অ্যাম্বুলেন্স হাজির হয় সেখানে হুইসেল বাজিয়ে। পুলিশ পুরো এলাকা ঘিরে রাখে। হেলিকপ্টারের কাছে কাউকে ঘেঁষতে দেয় না। ভেতর থেকে কয়লার মতো ডেডবডি বের করা হয়। এর মধ্যে একটা মেয়ে, আরেকটা ছেলের লাশ। লাশ দুটিকে সাদা অ্যাপ্রনে ঢেকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয়। লাশ পোড়ার উৎকট গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। গন্ধটা হারিছের নাকে গেলে বগবগ করে বমি করে ফেলে। হারিছের বমি দেখে কোত্থেকে যেন দৌড়ে এসে সামনে দাঁড়ায় শতরূপা।
—শরীর খারাপ লাগছে? আসেন আমার সঙ্গে। ওই কলের পাড়ে আসেন। বলে হাত ধরে টেনে তোলে হারিছকে। এই দৃশ্য দেখে কে কী ভাবলো, তাতে তার কোনো তোয়াক্কাই নেই।
টিউবকলের পাশে দ-হয়ে বসে থাকে হারিছ। কল চেপে চেপে শতরূপা পানি ছিটিয়ে দেয় হারিছের চোখেমুখে।
—জল খান হারিছ ভাই। ভালো লাগবে।
বিস্মিত হওয়ারও শক্তি পায় না হারিছ। আবারও বমি আসে। সকালে খাওয়া ডালভাত বমি হয়ে বের হয়।
—একটু জল খান আপনে। ভালো লাগবে। শতরূপার কণ্ঠে আকুতি।
শতরূপার হাতের তালুতে বন্দি এক আঁজলা পানি। সেটি ধরা আছে হারিছের মুখের সামনে। কিন্তু মাথা তুলে তাকাতে পারে না হারিছ। আঁজলায় রাখা পানিতে একটি মুখ দেখতে পায় সে। লক্ষ্মীপূর্ণিমার রাতে পচা ডোবার জলে চাঁদের এমন ছায়া পড়ে।
জন্ম ময়মনসিংহ শহরের প্রাণকেন্দ্র গাঙ্গিনারপাড়ের অধুনালুপ্ত লালালজে (স্থানীয় ভাষায় যা ‘লাইলিপট্টি’ নামে পরিচিত ছিল)। এখন রাজধানী ঢাকাতেই অস্থায়ী বাস। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। পেশাগত জীবন শুরু হয় শীর্ষস্থানীয় বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় কাজের মধ্য দিয়ে। কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন সম্পাদিত ‘জেন্ডার ও উন্নয়ন কোষ’ গ্রন্থ প্রকল্পে কাজ করেছেন গবেষণা-সহকারী হিসেবে। এরপর পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেডের ‘ভাষা বিভাগ’-এর দায়িত্বভার পালন করেন। সেখান থেকে বাংলা একাডেমি পরিচালিত ‘বাংলা ভাষার বিবর্তনমূলক অভিধান’ প্রকল্পে গবেষক ও সংকলক হিসেবে কাজ করেছেন। আবার ফিরে আসেন সাংবাদিকতা পেশায়। বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন অনলাইন নিউজ পোর্টাল পরিবর্তন-এ। এরপর দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে কাজ করছেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। কবিতাই মূলত তাঁর যাবতীয় স্বপ্ন-বুননের জায়গা। পাশাপাশি বিচরণ করেন গল্প, প্রবন্ধ, ফিচার, সাহিত্য-সমালোচনা, সম্পাদনাসহ সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায়। পড়তে ভালোবাসেন খুব। তাই নেশার তালিকায় সবসময় প্রথম ও প্রধান হিসেবে রাখতে আগ্রহী বইপড়াকে। প্রকাশিত গ্রন্থ : জলের উপর জলছাপ (কাব্যগ্রন্থ, শুদ্ধস্বর প্রকাশনী-২০১০), আবছায়া আলো-অন্ধকারময় নীল (কাব্যগ্রন্থ, বিজয় প্রকাশ-২০১১), রবীন্দ্রনাথ : জীবনে মৃত্যুর ছায়া (গবেষণা-প্রবন্ধ, মূর্ধন্য-২০১১), তুমুল কোলাহলে কুড়াই নৈঃশব্দ্য (কাব্যগ্রন্থ, অনুপ্রাণন প্রকাশন-২০১৪), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (জীবনীগ্রন্থ, কথাপ্রকাশ-২০১৬)।