| 24 এপ্রিল 2024
Categories
ভাসাবো দোঁহারে

ভাসাবো দোঁহারে: শ্যামল মেঘের ছলনা । পাপড়ি রহমান

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

সকাল বেলায় লালচে রোদে,পাতলা মেঘে, ভিজে ভিজে বাতাসে ওরা উড়ছিল ত্রিচক্রযানে। এখন নিঝুমপুরের মতন দুপুর। রোদ্দুর তার ধবল ডানা ছড়িয়ে আছে। মেলে দেয়া আলোর মাঝে হঠাৎ বৃষ্টি এলো। ঝুরঝার ঝরে পড়লো বৃষ্টি। ঘামের মতো ভিজিয়ে দিলো চুলের মূলও।

ঘুঘু ডাকা নিঝুমপুরের দুপুর। হঠাৎ বৃষ্টিতে নিঃসাড় দুপুর। এগারোতলা বাড়িটার ছাদে দুজন- মুহু আর অন্তু। অন্তু আজই প্রথম মুহুকে এখানে নিয়ে এসেছে। মুহুকে আকাশ দেখাবে। এখন চিলেকোঠার ছায়ায় দুজন। পিঠের সাথে পিঠ। আচমকা বৃষ্টি। বৃষ্টির ছন্দ দ্রুত হয়। ছন্দের তাল লয় তান ঝরে পড়ে। পৃথিবী জুড়ে ঝিরঝিম সঙ্গীতের মূর্ছনা। সে সঙ্গীতে ডুবে যেতে থাকে আকাশ দেখার অভিলাষী বাড়িটা। বাড়িটা স্থির হয়ে অনেক উঁচুতে ভেসে আছে।

ফুলঝুরির মতো বৃষ্টি। ঝুপ্ঝাপ। টুপ্টাপ্। বিশাল ফোঁটা। হৈ হুল্লোড় করে আকাশ জুড়ে। আবছায়া পর্দা। মুহুর আকাশ দেখা হয় না। মুহুর ঘন পল­বিত চোখ বৃষ্টির অবিরাম নাচন দেখে। ঝিরঝিরে। বড় বড় ফোঁটা ফোঁটা মুষল বৃষ্টি। মেঘের কালো আঁচলে আকাশের নীল মুছে যায়। আলোছায়ার অবসাদ এসে আক্রান্ত করে ওদের। সন্ধ্যের সোডিয়াম বাতিগুলো লালচে হয়ে স্থির এখন।

 

ছেলেটির কথা

মাথার যন্ত্রণায় ঘুম ভেঙে গেলো। এখন কতো রাত! চিনচিনে ব্যথাটা খামচে ধরে আছে। একটু বেলা হলেই বুয়াকে চা দিতে বললাম। দিলো একঘণ্টা পর। বুয়াটা ইদানীং খুব ত্যাদড় হয়েছে। কথা বললে কানেই তোলে না। এজন্য অবশ্য বাবা মা দুজনেই দায়ী। দুজনেই ঝগড়া হলে বুয়াকে দাঁড় করার সাক্ষী হিসেবে। আমার কাছে এমন যা-তা মনে হয় যে, কি বলবো।

বাবা মার জীবন ভেঙেচুরে মুড়ির টিনের মতো চ্যাপটা হয়ে আছে। তারপরও একই ছাদের তলায়! আমার ভয়ানক অবাক লাগে। এভাবে মানুষ কিভাবে সম্পর্ক আঁকড়ে থাকে! দুজনের কারোরই কারো জন্যে কোনো দায় নেই, টান নেই। আর ভালোবাসা সেতো বহুদূর। সন্ধ্যের পর অফিসের ক্লান্তি নিয়ে দুজনেই ঘরে ফিরে। এসেই লেগে যায় ধুন্ধুমার। বাবা তেড়েফুঁড়ে তাসের আড্ডায় চলে যায়। ফিরতে ফিরতে ভোররাত। কোনো দিন সকাল। বেশিরভাগ সময়ই মাতাল অবস্থায় ফেরে। আজকাল আবার একটা উড়ো খবর শুনছি। বাবা নাকি কোন এক দরিদ্র অথচ সুন্দরী কুমারীকে বিয়ে করেছে। এ নিয়ে মা চিল-চিৎকার করে। বাবা অবশ্য এসব ব্যাপারে নির্বিকার। মাঝে মাঝে মাত্রা ছাড়ালে হাতাহাতির বিষয়টিও এসে যায়। আমি নিরবে চেয়ে দেখি। কী করবো আমি? অবশ্য এক ধরনের করুণা বোধ করি মার জন্যে। এক জীবনে কিছুই পেলো না।

মাও আজকাল কেমন বদলে যাচ্ছে। যতোক্ষণ বাসায় থাকে, টেলিফোনের লাল রিসিভারটা আঁকড়ে ভনভন করতে থাকে। সকালে অফিসে যাওয়ার সময় ভীষণ এক করুণ চেহারা নিয়ে আমার ঘরে আসে। আমি ঘুমের ভান করে পড়ে থাকি। মা আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকায। একসময় ধীর পায়ে বেরিয়ে যায়। এই সময়টায় মাকে খুব দুুঃখী মনে হয় আমার।

মার এই যে নড়বড়ে জীবন তার পুরোটাই বাবার জন্যে। বাবা, মার জীবনটা একেবারে ভাজা-ভাজা করে দিলো! মা বেচারী কি করবে?

বাবার সাথে আমার অবশ্য খুব কম দেখা হয়। কথা তো হয় আরো কম। দুজনের এই সুদীর্ঘ টানাপোড়েনে আমি শালা মজাছে মস্তানি করে বেড়াই। কলেজে পা দিয়ে স্বাধীনতাটা আরো দশ ডিগ্রি হাতিয়েছি। বাবা-মা দুজনেরই মারকুটে স্বভাব। আমার দম আটকে আসতে চায়। নিজেকে বন্ধুদের কাছে লায়েক প্রমাণ করার জন্য আমিও ‘ডাইল’ গলায় ঢালি ঢক্ঢক। না টানলে যে ইয়ার বন্ধুরা খুব একটা ইজ্জত দিতে চায় না। ঘরে এক স্যাঁতস্যাঁতে জীবন। বাবা-মার, অসুখের আগুন আমাকে পোড়ায়। দগ্ধ করে। কয়লা করে। কয়লা। স্কুলের বেড়াতেই হয়তো আটকে থাকতাম। পাশটাশ করতে আমার ভালো লাগে না। কিচ্ছু ভাল্লাগে না আমার। কিচ্ছু না। মা টের পেলো, কার কার সঙ্গে যেন কিছুদিন গুজুর গুজুর। তারপর গ্রাম থেকে পরীক্ষা দেয়ার বন্দোবোস্ত হলো। বস্তা বস্তা নকল লিখে আমিও একচান্সে লাফ দিলাম। বুদ্ধিমতী জননী। আমাকে ভরাডুবি থেকে উদ্ধার করেছে।

আজ সকালেই এই নতুন মেয়েটাকে বাগে পেলাম। অবশ্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে এর জন্য অনেক সাধুসন্ত সাজতে হয়েছে। আমি শালা নিজেই এক দুই নাম্বার। এক নাম্বাররা কিভাবে যেন জুটে যায়! এজন্য ভোগান্তিও কম হয় না। হাতে-পায়ে ধরেও রাজি করাতে পারি না। যত্তোসব চিড়িয়া। আমার আবার ধৈর্যের বেলুন একেবারেই ফুটো। আজো ধৈর্য ধরতে হচ্ছে। মেওয়ার আশায়।

এই বাড়িটা আমার ফুপুর। মাস দুয়েক হলো ফুপুর ফুল ফ্যামিলি বিদেশে। আমি নিঝুমপুরের বাড়িটায় একা। কেউ নেই। আমি বাড়ির পাহারাদার।

মাথার যন্ত্রণা বাড়াতে ‘ডাইল’ টানতে হলো। পকেটে এখনো দু’বোতল। বৃষ্টি এসে মস্ত ঝামেলা বাঁধালো। মেয়েটি আজ সবুজ রঙের সালোয়ার কামিজ পরেছে। চমৎকার লাগছে। সবুজ রঙে ওকে দারুণ মানায় তো! মেয়েটা কেমন যেন সংকোচে কুঁকড়ে আছে। কালো চুলে সাদা বৃষ্টিকণা লেগে ঝুলন্ত মণিমুক্তা তৈরি হয়েছে। খুব সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। বৃষ্টির আবছায়া, মণিমুক্তা, মেয়েটা-এমন অপূর্ব দৃশ্য আমি অনেকদিন দেখিনি।


আরো পড়ুন: উড়ন্ত গিরিবাজের ইন্দ্রজাল


 

মেয়েটির কথা

হাওয়ায় আমি ভাসছি। ভেতরে কেমন অচেনা ভালো লাগার দুলুনি। নবান্নে কৃষকের বুকে থাকে সুখ। আবর বুক জুড়ে নবান্নের ঘ্রাণ ভরে আছ। সামান্য সুখেও অনাবিল হাসে নিরন্ন মানুষ। আমার হৃদয়ে তেমনি হাসির হিল্লোল। আমার কাছে ভালোবাসা মানে বহতা নদী। নদীতে জলের কলতান। জ্যোৎস্নার সাজানো আকাশ।
অন্তুকে দেখেছি কলেজে ভর্তি হয়েই। বখাটে, কেমন একটা ড্যামকেয়ার ভাব। আমি কিশোরগঞ্জ থেকে কেবল পাশ করে ঢাকায় এসে কলেজে ভর্তি হয়েছি। কলেজে ওকে দেখে প্রথম কেমন যেন ভয় ভয় লাগতো। আশ্চর্য, এই ছেলে আমার পেছনে লাগলো। একদিন-দুদিন-তিনদিন। ছেলেটি আমার পিছু ছাড়লো না। আমিও কিভাবে যে ভালোবেসে ফেললাম-কে জানে। আমি থাকি বোনের বাসায়। অন্তুর সাথে ভাব হবার পর ও বলছিল, উঁচু দালানের ছাদ থেকে আকাশ এতো অপরূপ দেখায় কি বলবো! একদিন চলো তোমাকে দেখাবো। তুমি অবাক হয়ে যাবে।

‘এমন রোমান্টিক কথা আমি প্রথম শুনলাম, ‘আকাশ দেখাবো’ আকাশ দেখাবো’ আহা, অবাক উপরের আকাশ… আমার মন দুলে উঠলো। এই প্রথম আমি অন্তুর সাথে একা একা এতদূর এসেছি। বড়ো আপাকে মিথ্যে বলে এসেছি। বলেছি ‘বান্ধবীর বাসায় নোট আনতে যাচ্ছি।’
আপা খুব একটা আপত্তি করেনি।
অন্তুকে আজ অসম্ভব গম্ভীর মনে হচ্ছে। রিকশায় উঠেই বলেছে মাথা ধরেছে। আামি কথা বাড়াইনি। আমার ভালো লাগছে। খুব ভালো লাগছে…। সকালে লালচে রোদ, পাতলা মেঘ, ভিজে ভিজে বাতাস… আমার পাশে অন্তু-মন মোর মেঘেরও… সঙ্গী-ই-ই।

আকাশ আলকতরা হয়ে এলোরে বৃষ্টি নেমে এলো। আমরা বৃষ্টি থেকে সরে চিলেকোঠায় ভেতর । অন্তু পকেট থেকে বোতল বের করে ঢকঢক করে কি যেন খেলো। আমি বললাম-কি খাচ্ছো?
‘ওষুধ।’
‘দু’দুটো বোতল একসাথে!’
‘অসুখটা যে ভয়ানক।’
‘কি অসুখ তোমার!’
‘নাম জানি না।’
‘সে-কী।’
এরপর থেকে অন্তু কি যেন ভেবে চলেছে। আমার একটু ভয় ভয় লাগছে। চারপাশে সুনসান নিরবতা। সন্ধ্যেটা নাকের ডগায় চশমার মতো ঝুলে আছে। সোডিয়াম লাইটগুলো হলদে চোখে চেয়ে আছে। মসৃণ এক হলুদ আলোর মায়া চারপাশে। বৃষ্টির তুমুল উল­াসে কখনো ভেঙেচুরে বক্র রেখায় ঝরে পড়ছে সে হলুদ। অন্তু সেই কখন থেকে ঝিম মেরে আছে। ওর চোখের তারায় হেমন্তের সুতীব্র বিষাদ। অন্তুকে আমার অচেনা লাগছে।

 

শেষ কথা

রাত ৮টার দিকে মুহুর শরীর নিচে কংক্রিটের রাস্তায় এসে পড়লো। সবুজ ওড়নায় শক্ত করে হাত বাঁধা। মুখে সাদা রুমাল গোঁজা। মাথা ফেটে চৌচির। তাজা রক্তে পীচঢালা পথে বৃষ্টির হলদে জল, খানিক কালচে। মুহুর শরীরের সাথে সততা, সরলতাটুকুও মুখ থুবড়ে পড়েছিল। ভালোবাসার একটি নদী। এ নদীতে জোয়ার, জ্যোৎস্না আছে, ভাটা, ভাঙ্গন আছে, আছে আদর, আছে হাঙ্গর কুমিরের হঠাৎ উল্লাসের! সদ্য যৌবনে দাঁড়ানো মেয়েটির তার কতটুকু জানতো!

ছেলেটি কি জানতো, ভেতরে তার জন্মেছে দানব ভয়াল, হিংস্র অপ্রতিরোধ্য এক দানব। মাথার পেছনে ছেলেটির অসহ্য যন্ত্রণা। সকালে বুয়াটা চা দিতে এক ঘণ্টা দেরি করেছিল…।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত