Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,পাপড়ি

পাঠ প্রতিক্রিয়া: রতনলাল ও চার পরী । প্রতিভা সরকার

Reading Time: 2 minutes
 
আমি পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার ভক্ত। উনি অনেক তরুণী বয়স থেকে কবিতা লেখেন, ফলে ওঁর কবিতা অনেক আগেই আমার কাছে এসে পৌঁছেছে। নাড়া দিয়েছে। অনেকগুলো মনে রয়ে গেছে।
 
কবিতা লিখলেও ভাষার ধোঁয়াশা তৈরিতে ওঁর অনীহা আছে। স্পষ্ট ঋজু উচ্চারণ আর অনুভবী একটা মন, দুইই ওঁর সম্পদ। কী কাব্যে, কী গদ্যে! ওঁর গল্পগ্রন্থ রতনলাল ও চার পরী পড়তে পড়তে এইসবই ভাবছিলাম।
 
২৮ টি গল্পের এই সংকলন মনোযোগ ধরে রাখে আগাগোড়া। মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় অনেক চরিত্র, জীবনের অনেক বাঁকের সামনে। সবগুলোই কাহিনিভিত্তিক। আচ্ছন্ন করে রাখা ভাষার কারিকুরি বা মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা তার forte নয়, ভূমিকায় লেখক যশোধরা রায়চৌধুরী এটি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, ‘মানুষের দৈনন্দিন জীবন, তার সুখ দুঃখ তরতরে বাংলা গদ্যে লিখে চলতে পারাই পাপড়ির গল্পের ভরকেন্দ্র।’
 
অনেকগুলো গল্পই মনে দাগ কাটে। যেমন জলের চিহ্ন, কোনো ধর্ম নেই, ভাড়াটে, কার্গিল, প্রথম গল্পে দার্জিলিং ফেরত দুই বোন স্টেশনে এসে নামে পুজোর সময়। একজন বাড়ি যাবে, বিশ্রাম নিয়ে সন্ধেয় আনন্দময়ী দর্শনে বেরবে। আরেকজন তাকে রিসিভ করতে আসা প্রেমিকের সঙ্গে সারাদিনের টই টইয়ের প্ল্যান করে রেখেছে। কিন্তু প্রেমিক অনেক দেরি করে আসে এবং স্টেশনে অপেক্ষারত পূর্ব পরিচিত আর একটি মেয়েকে দেখে বিস্মিত হয়ে তার দিকে এগিয়ে যায়। তাদের দুজনের রসায়ন দিনের আলোর মতো এতো স্পষ্ট যে প্রেমিকা বাড়ির রাস্তা ধরে বা ধরতে বাধ্য হয়। তবু ফেরার পথে তার অন্ধকার মনে আলো জ্বেলে দেয় এক সাধারণ মানুষের হৃদয়ের উষ্ণতা। কোথা থেকে কখন সান্ত্বনা খুঁটে নেব, আমরাই কি তা সঠিক জানি!

আলোর পথযাত্রী গল্পটি বিষয়ে খুব ভালো। কিন্তু ট্রিটমেন্টে রিপোর্টাজ প্রবল হয়ে ওঠে। আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারও ঠিক মনে হয় না, কিন্তু পরের গল্প ‘কোনো ধর্ম নেই’ কোনো অভিযোগের জায়গা রাখে না। বর্তমান ভারত কোন অন্ধকারে পৌঁছে গেছে, আর কয়েক পা বাড়ালেই কী হতে পারে তা বিশ্বাস্য এবং নিপুণ আঁচড়ে তুলে আনে পাপড়ির কলম। শেষ করে বাঃ বলতেই হয় পাঠককে। অনেকটা কল্পবিজ্ঞানের ধাঁচে লেখা গল্পটি হিমশীতল আতঙ্কের ঢেউ খেলিয়ে দেয় মনে, বিশেষ করে ক্লাইম্যাক্সে, যখন ছাবুকে নিজের মা বাবা ঘরবাড়ি ফেলে খুব গোপনে পালিয়ে যেতে হচ্ছে, কারণ তার বাবা বিষ্ণুপদ হরিবংশের ধর্মান্তরিত হবার পূর্বনাম আতাউর হিলাল। সে দ্যাখে, “মা পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে আর বাবা হাউমাউ করে কাঁদছে আর বলছে —- মা মাগো মা।
কোন মাকে ডাকছে বাবা? বাবার মাকে? দেশকে? নাকি জগত্তারিণী মাকে?”
 
লৌহকপাট আর একটি গল্প যাতে একা মেয়েদের বহুমুখী সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়েছে। অন্তর্ঘাত, সামাজিক বিড়ম্বনা, সব পেরিয়ে মেয়েটি ভাবতে বসে তার মতো আরও একা হয়ে যাওয়া মেয়েদের কথা। একটা সর্বজনীনতা আছে গল্পটির মধ্যে যা অনেককেই রিলেট করতে সাহায্য করবে।
ভালো লাগে বইয়ের নাম যার নামে সেই রতনলাল আর চার পরীর গল্প। সম্পর্কের টানাপোড়েনে ক্লান্ত এমনিতে এক সহজ সরল মানুষ রতনলালের নিজেকে নিয়েই দুর্বোধ্যতা কাটতে চায় না। চোখের তলে কালি পড়ে যায়, কপালে কুঞ্চন। যার কাছে সান্ত্বনার খোঁজে ছুটে ছুটে আসে সে, সেই মাসিমা বোঝেন তাকে, ভাবেন, “একতরফা প্রেম বলে পৃথিবীতে কিছু নেই। সব প্রেমই উভমুখী বিক্রিয়া। ওর জীবনে একাধিক প্রেম এসেছিল। একটিকে ও গ্রহণ করতে পেরেছে। বাকিগুলোকে জীবনে গ্রহণ করতে পারেনি। সেই গ্রহণ লাগা সম্পর্কগুলো ওর হৃদয় কুরে কুরে খাচ্ছে। এক পরী ওর ঘর আলো করে আছে। না-পাওয়া বাকি তিন পরী ওর স্বপ্নে ওড়াউড়ি করে। সেই পরীদের লাল- নীল-হলুদ পালক ও ধরতে চায়– পারে না। সেই যন্ত্রণা ওকে কালো করে দিচ্ছে তিনি স্নিগ্ধ সুরে বললেন,’রতন আজ পূর্ণিমা। খুব সুন্দর চাঁদ উঠবে।বউকে নিয়ে বারান্দায় বসিস’।”
জটিল অবচেতনের সহজ সুন্দর প্রকাশ, শুধু সমস্যা যদি এতো সহজেই মিটত। আমরা অন্ধ ও বধির। চাঁদের আলো বা কুয়াশা পড়ার শব্দ আমাদের চেতনা ফেরাতে পারে না।
 
কবি পাপড়ি আর গদ্যকার পাপড়ি, কে থাকবে প্রাণের কাছাকাছি তা ঠিক করে ফেলবার জন্য বইটা পড়ে ফেলতে হবে।
প্রচ্ছদটি অন্যরকম হলে আমার ভালো লাগত। টাইপো অবশ্য প্রায় নেইই।
রতনলাল ও চার পরী
পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায়
সাহিত্যজগৎ
বিনিময় মূল্য ২০০ টাকা

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>