ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-২৫) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
কনে দেখা
বিকেলের আকাশে মাঝেমাঝে একটা হলুদ আলো ভেসে ওঠে।অদ্ভুত নরম এক স্নিগ্ধতা লেগে থাকে সে আলোর গায়ে।সূর্যমুখী ফুলের রেণু দিয়ে সে আলোর অঙ্গসজ্জা, ভোরের নরম রোদ তৈরি করেছে তার আদুল গা আর কচি সবুজ পাতার বাহারে সে ঝলমলিয়ে উঠেছে।জেনেছিলাম ওই আলোর নাম ‘কনে দেখা আলো’।
আমাদের কিরকম সম্পর্কের এক পিসির নাম ছিল প্রতিমা পিসি।ভারী সুন্দরী ছিল সে।ফর্সা,একটু জাপানী ধাঁচের মুখ,পাতলা গড়নের একমাথা চুলওলা সেই মেয়েটিকে সবাই বলত, “ওর প্রতিমা নাম সার্থক।” অনেক ভাইবোনের একজন সেই প্রতিমা পিসির বিয়ের তোড়জোড় শুরু হল। মেয়ে দেখতে পাত্রপক্ষ এলেন। বড় ভাই,তার স্ত্রী,আর এক ননদ ও এক দেওর।তাদের পছন্দ হলে পাত্র তার বন্ধুকে নিয়ে মেয়ে দেখে গেলেন।খুব মোটাসোটা ভুঁড়িওলা পাত্র,বনেদি বাড়ির ছেলে,তার মুখচোখ,গায়ের রঙ এবং সুমিষ্ট ব্যবহারে গুরুজনেরা সবাই ভীষণ সন্তুষ্ট। দেনাপাওনা তেমন নেই।
আমরা ছোটরা গুজগুজ ফুসফুস করি।কথা সদরে পৌঁছয় না।ওই পাত্রের সঙ্গেই শুভলগ্নে শুভবিবাহ সম্পন্ন হয়।তখনই শুনেছিলাম কনে দেখা আলোর কথা। বিকেলের খোলা জানলায় নাকি সেই আলো এসে পড়েছিল প্রতিমা পিসির মুখে।পছন্দ না হয়ে যায় কখনও।
আমাদের ছোটবেলায় বড়দের সঙ্গে ছোটদের ছিল এক গঙ্গার দূরত্ব।মানে মাঝখান দিয়ে বইত নদীর জলধারা।তা সাঁতরে পাড়ে ওঠার সাধ্য আমাদের ছিলনা।আমার ছিল একটু গা ঘেঁষা স্বভাব। বড়দের গায়ে গা ঠেকিয়ে থাকতাম,আর তারা নির্দিষ্ট কথোপ-কথনের সময় আমাকে বেড়াল বাচ্চা তাড়ানোর মত করে তাড়িয়ে দিতেন। তবু ফাঁকে ফোকরে নিষিদ্ধ কিছু জলবায়ু আমার নাকেও ঢুকত বৈকি।সেভাবেই শুনেছিলাম প্রতিমা পিসির বিয়েতে পাত্রপক্ষ কিছুই নেবেনা।শুধু মেয়েকে দশভরি সোনার গয়না দিতে হবে।আজও মনে আছে মায়ের চওড়া মানতাসা হাতে পরে আমাদের পিসি ‘কিছু না নেওয়া শ্বশুরবাড়ি’তে গিয়েছিল।‘মানতাসা’ নামক সেই বিশাল গয়নার সঙ্গে সেই প্রথম আমার চেনাজানা।
তার পরের বিয়ে বাড়িতে আমাদের আক্ষেপ আরো বাড়ল।ফর্সা টুকটুকে গ্রাজুয়েট সুন্দরী সোমা পিসির বিয়ে হল যে পাত্রের সঙ্গে,তার গায়ের রঙ মিশকালো ।শুনলাম উনি বড়মাপের একজন ইঞ্জিনিয়ার।এখানেও সেই না নেওয়ার গল্প।সোমা পিসিকে তার কলকাতার দিদির বাড়িতে নিয়ে গিয়ে দেখানো হয়।
তার পরে আর আমরা কোন আশা করিনি। জেনে গেছিলাম বড়দের সঙ্গে আমাদের হিসেব-নিকাশ মেলেনা।তাদের হিসাবী মনের হদিশ খুঁজে পাওয়াই ভার।
সেসময় মেয়েদের কোন চাওয়া পাওয়া থাকতে পারে একথা কেউ ভাবত না।ওই প্রতিমা পিসির দিদি বেলা পিসি দিনরাত নিজের মনে গজ্গজ্ করত,সবাইকার ওপর ছিল তার ভারি রাগ।বাবা মাকেও সে ছাড় দিত না।একদিন শুনলাম ওই বেলা পিসির বিয়ে।বিয়ের দিন তাকে বড়ই শান্তশিষ্ট দেখাচ্ছিল।তার পরে শ্বশুরবাড়িতে তার দাদার সঙ্গে তাকে অষ্টমঙ্গলায় আনতে গিয়ে দেখি সে আমূল বদলে গিয়েছে।রাগ অভিমান ভ্যানিস্।মাথায় ঘোমটা দেওয়া তার সেই সলজ্জ মুখখানিতে অনেকখানি খুশি মাখামাখি হয়ে আছে।
আরো পড়ুন: খোলা দরজা (পর্ব-২৪) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
তখন বুঝিনি ,আজ বুঝি ,নিজের বর ,ঘর, সংসারের জন্য তীব্র বাসনা ছিল তার ক্ষোভের কারণ।একটা মজার ব্যাপার ঘটেছিল,প্রতিমা পিসির ছিল ছিমছাম চেহারা,তার বর তেমনি মোটা।আর বেলা পিসি ছিল গোলগাল মোটা-সোটা।তার স্বামী ছিলেন বিরাট লম্বা রোগা,তালপাতার সেপাইএর মত।আমরা ভেবেছিলাম মোটা বউয়ের রোগা বর হয়, রোগা বউয়ের মোটা বর হয়।সব ছেলেমানুষী সিদ্ধান্ত।এখন ভাবলে হাসি পায়।
আমাদের ছোটবেলায় একটা বিয়ে মানে পাড়াশুদ্ধু সকলের অংশগ্রহণ।এছাড়াও কত বিয়ে হয়েছে।আমরা কনে দেখা থেকে শুরু করে বিয়ে অবধি ওই বিয়ে বাড়িতেই কাটিয়েছি।
তখন পাত্রের ব্যাপারে একটা কথা খুব শোনা যেত।“হীরের আংটি আবার বাঁকা?”
বলাবাহুল্য ‘হীরের আংটি’টি হলেন পাত্র। তার কোনও দোষ ধরা যাবে না।এরকম একটা ঘোষণা আগে থেকেই করা থাকত।মেয়েদের ক্ষেত্রে কিন্তু পদে পদে দোষ ধরার একটা প্রবণতা বরাবর ছিল।

ঐতিহ্যময় শহর চন্দননগরের স্থায়ী বাসিন্দা সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতক।১৯৯৬ সালে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়’দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকায়।২০০১ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।‘আনন্দবাজার’, ‘বর্তমান’, ‘আজকাল’, ‘প্রতিদিন’, ‘তথ্যকেন্দ্র’, ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’ ছাড়াও, ‘অনুষ্টুপ’, ‘কুঠার’, ‘এবং মুশায়ারা’-র মতো বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনেও তার কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রকাশের ধারা অব্যাহত। প্রকাশিত উপন্যাস পাঁচটি, গল্পগ্রন্থ চারটি, এবং কবিতার বই একটি।