| 10 অক্টোবর 2024
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক: রাণীয়ার রান্নাঘর (পর্ব-১৬) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 16 মিনিট

 ভোগের খিচুড়ি, হিঙয়ের কচুরি

রাণীয়ার পেন্ডুলাম ভ্লগ দুলে ওঠে রোজ। আলোর মতন, হাসির মতন। ফুলের মতন। লাখ লাখ সাবস্ক্রাইবারের অজস্র কমেন্টের বন্যা সেখানে। ঋতুবদল হয় সেদেশেও। পুজো পাব্বনে তার মনে পড়ে যায় দেশের কথা। তার চ্যানেলের দর্শক শ্রোতাবন্ধুরা অনুরোধ জানায় ভোগের রান্না নিয়ে কিছু বলতে।
রাণীয়ার মাথায় প্ল্যান খেলে তক্ষুনি। মামাবাড়িতে খুব ছোটবেলায় জগদ্ধাত্রী পুজো হতে দেখেছে সে। তার এক মাসী পুজোর দিনে মারা যাবার পরে সেই পুজো বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু অনেককিছু মনে আছে এখনও। জামশেদপুর থেকে হই হই করে চলে আসত মায়ের সঙ্গে সেই পুজোবাড়িতে। রাণীয়া, মিঠি দুজনেই তখন ফ্রক ছাড়ছে সবে। তবে শাড়ি নয়। আধুনিক পোষাকে রঙিন হয়ে উঠেছে তাদের কিশোরবেলা।
মামাবাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজোর সেই এলাহি ভোগরান্নার কথা মনে পড়লে উদ্বেল হয় মন আজও। মিঠি হয়ত তার কেরিয়ারের নেশায় মত্ত হয়ে সব ভুলে গুলে খেয়েছে কিন্তু রাণীয়া ভোলে কেমন করে?  চিরটাকাল অনসূয়ার ছোটোমেয়েটা বড়ই আবেগপ্রবণ। বড়টা যেন কাঠখোট্টা। অতটা সংবেদনশীল নয়।

মনে পড়ে রাণীয়ার। ছোটবেলায় দুর্গাপুজোর পরেই শারদীয় আনন্দ ম্রিয়মাণ হয়ে যেত স্কুল খুলে যাবার কারণে। শীতের হাওয়ার নাচন শুরু হতে না হতেই বার্ষিক পরীক্ষার প্রস্তুতি কালীপুজো, দেওয়ালি, ভাইফোঁটার সব আনন্দ কে যেন ভালো করে দু’হাত পেতে নিতেও দিত না তখন। এসবের শেষে তবুও মাঝেমধ্যে উঁকি দিত আরেক অনুপম হাতছানি। তা হল মামাবাড়ির এলাহি জগদ্ধাত্রী পুজো। টিকিট কেটে ব্যবস্থা করে দিতেন বাবা। যেন উৎসবের মরশুম শেষ হইয়াও হইল না শেষ। আবারও দুই বোনের আনন্দে অবগাহন। সব তুতো ভাইবোনেদের সঙ্গে আহ্লাদে আটখানি হয়ে বাৎসরিক মামাবাড়ি ভ্রমণ। আবারও ছুটির আমেজ আর সবচাইতে মজার হল কব্জি ডুবিয়ে ভোগ খাওয়া।
দক্ষিণেশ্বরে কালী মন্দিরের পাশে গঙ্গার ধারেই ছিল রাণীয়ার সেল্ফমেড ম্যান দাদামশাইয়ের নিজ হাতে গড়া ঘরবাড়ি। সাতক্ষীরা থেকে মাত্র ৮০ টাকা হাতে নিয়ে সাইকেল চড়ে রাতারাতি চলে আসার পর কলকাতায় লোহালক্কড়ের ব্যাবসায় হাতেখড়ি তাঁর। রাতারাতি কলকাতার শিল্পমহলে সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল গ্যাঞ্জেস ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস কোম্পানির। বড় বড় কোম্পনিকে স্প্রিংক্লার সাপ্লাই দিয়ে ধনী হয়ে উঠেছিলেন ওদের দাদামশাই। ব্যবসায় উত্তরোত্তর সাফল্য এবং ঘরবাড়ি করে বসবাস করতে শুরু করে ওপার বাংলার ট্র্যাডিশন মেনেই মা জগদ্ধাত্রীর পুজোয় আপামরজনসাধারণের ভোজনের ব্যবস্থা শুরু করেন তিনি। মনেপ্রাণে খাঁটি বৈষ্ণব কিন্তু শক্তি আরাধনায় খামতি ছিলনা। তবে পশুবলি ইত্যাদি পর্ব সেই আখ এবং চালকুমড়োতেই সীমাবদ্ধ থাকত। মানত ছিল মা জগদ্ধাত্রীর কাছে। ব্যাবসা করে সফল হলে তিনি ওপার বাংলার মা জগদ্ধাত্রীকে এপার বাংলায় প্রতিবছর পুজো করবেন।

রাণীয়ার মায়ের এক বাল্যবিধবা পিসিমা ছিলেন। ওরা ডাকত পিসিদিদা। তিনি যেন সংসারের ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো। দাদুর আপন বোন। জগদ্ধাত্রী পুজোর আগেভাগেই সাদা থান জড়িয়ে চলে আসতেন মামাবাড়িতে। ঠাকুরের ভোগের জন্য তিনরকমের বড়ি প্রস্তুত হত তাঁর তত্ত্বাবধানে। বিউলির ডালের হিঙয়ের বড়ি, ছোটো ছোটো ভাজাবড়ি আর ঘণ্ট ইত্যাদিতে দেওয়ার মটরডালের বড়ি। ডাল ভিজিয়ে শিলে বাটা থেকে রোদে শুকনো করা অবধি সব শুদ্ধাচারে করতেন তিনি। এসব গল্প রাণীয়া মা আর দিদার মুখে ছোটবেলা থেকে শুনে শুনে মুখস্থ। পুজোর জন্য রান্নাঘরের নতুন কাপড়চোপড় কেচে শুকিয়ে গোছানো হত। দুর্গাপুজোর পর থেকেই নিমন্ত্রণের কার্ড ছাপিয়ে আসত। রাণীয়া আর মিঠি যাওয়ামাত্রই দাদু হাতে ধরিয়ে দিতেন। ওরা তা ভাঁজ করত পরম উৎসাহে। পুজোর ঠিক দুদিন আগে নারকোল কুরে দুরকম নাড়ু হত। চিনির রসে রসকরা আর আখের গুড়ের নাড়ু। পিসিমা আবার নারকোল আর ক্ষীর দিয়ে ছাঁচে চন্দ্রপুলি বানিয়ে রাখতেন পুজোর ভোগের জন্য। মার্বেলের পুজো ঘরের মেঝে পরিষ্কার করে ধুয়ে মুছে শুকনো করে ওদের মা অনসূয়ার দায়িত্ব পড়ত পিটুলিগোলা দিয়ে আলপনা দেওয়ার। বিশাল বিশাল কাঠের জলচৌকি তে প্রতিমা বসবেন। সেখানেও বিশাল আলপনা আর মাথায় সাটিনের সুদৃশ্য চন্দ্রাতপ টাঙিয়ে দেওয়া হত। মামাবড়িতে ট্রাঙ্ক থেকে দুর্গাপুজোর পরেই চাঁদোয়া বের করে রোদ খাওয়ানোর মানেই জগদ্ধাত্রী পুজো সমাগত।রাণীয়ারা সব ভাইবোন মিলে প্রায় জনা কুঁড়ি তো হবেই। কচিকাঁচাদের আনন্দ আর ধরত না তা দেখে। সারাবাড়ি আলোর মালায় ঝলমল করে উঠত। দাদু দিদার গুরুদেব আসতেন ভাটপাড়া থেকে। পুজোর ক’ দিন তিনি সেখানে থেকেই দুবেলা পুজোপাঠ করবেন।
পুজোর আগের দিন ওড়িয়া হালুইকর বামুনরা তাদের সহকারীদের নিয়ে, হাতে তাদের পেল্লায় হাতা খুন্তী, বঁটি, সাঞ্চা সব নিয়ে বডি ফেলে দিত মামার বাড়ির উঠোনে। রাণীয়ারাও পৌঁছে যেত তার আগেই। ঠাকুর আনতে যেতে হবে যে। সেও আরেক আনন্দ যে। প্যান্ডেল হয়ে গেছে ততক্ষণে। ত্রিপলের নীচে ভাইবোনেদের দেদার আড্ডার শুরু সেদিন থেকেই। প্যান্ডেলের একটা পাশ খোলা আছে। একফালি নীল আকাশ দেখা যায় সেখান থেকে। রান্নার ধোঁয়া বেরুবে বলে। উঠোনে বিশাল মাটির উনুন পাতাও শেষ হত একসময়। পাশে জড়ো কয়লা, ঘুঁটে, কাঠ। ঘুঘুডাঙা থেকে ছানা আসত নির্ধারিত সময়ে। খোয়া ক্ষীরও রেডি। ময়দা, ঘি, বড় এলাচ সবকিছুর জোগাড় রেডি। বিকেলেই আঁচ ধরিয়ে ভিয়েন বসত। মিষ্টি বানানোর শুরু তখন। জাঁক দেওয়া ছানা আর ক্ষীর দিয়ে পান্তুয়া হবে। তা ভাদয়া ঘিয়ে ভাজা হবে। সেই সঙ্গে ঘিয়েভাজা শুকনো বোঁদে হবে।ওদের  শিল্পী মা অনসূয়া বসে পড়বেন শ্রী গড়তে। সামান্য বিউলির ডাল বাটা, পিটুলি, দশকর্ম ভাণ্ডারের রঙ, জরি সব এসে গেছে তাঁর জন্য। পেতলের থালা সোনার মত মাজা রয়েছে আর রয়েছে শ্রী গড়ার জন্য নতুন ঝাঁটার কাঠি আর সরষের তেল। দিদা সাজাবে বরণডালা। দিদা আর তাঁর এক বন্ধু দুজনে জগদ্ধাত্রীর ভোগ রাঁধবে তাই আগের দিন তাঁদের সংযম। নিরামিষ আহার। আত্মীয় স্বজনে বাড়ি গমগম করছে তখনই। মিঠি আর রাণীয়া আর সব ভাইবোনেরা তখন প্যান্ডেলের ধার দিয়ে পুকুরপাড়ে কিম্বা ছাদের ধারে। নয় কাঠকুটো জ্বেলে পুকুরপাড়ে জমিয়ে দিচ্ছে ছোট্ট করে চড়ুইভাতি কিম্বা পায়ে কাঁটা ফুটিয়ে মায়ের বিপদ বাড়াচ্ছে তারা। কোনওসময় কেউ আবার হাত পুড়িয়ে বার্নলের খোঁজ করছে চুপিসাড়ে।কিম্বা হাত কেটে চুপিচুপি কাপড় বেঁধে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেন কিচ্ছু হয়নি।
জগদ্ধাত্রীপুজোর রীতিও দু্র্গাপুজোর মতোই। তবে বোধন হয় না। রাণীয়ার মামাবাড়িতে নবমীর দিনেই দুর্গাপুজোর সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী পুজো হত।
রাণীয়ার দিদা আর মা, মাসীদের কাছে এটাই ছিল সবচাইতে চাপের ব্যাপার। তাই এক পুজোর ভোগ নামিয়ে পুজোয় নিবেদিত হতে না হতেই পরের পুজোর ভোগরাগের প্রস্তুতি। তাই দুজন ভোগ রাঁধুনি এবং তাঁর দুই সহকারী অবশ্যই থাকত। তেমনই যারা ফল, তরিতরকারি কাটা ধোয়া করতেন সেখানেও তেমনই সব ভাগে ভাগে রাখা থাকত। সেই অনুযায়ী তিন সেট পেতল, কাঁসার বাসন ছাই আর তেঁতুল দিয়ে ঝকঝকে করে আগেভাগেই মাজিয়ে রেডি করা থাকত। পুজোর দিন সকালে ভোগ ঘরে তিন চারটে তোলা উনুনে আঁচ পড়ে যেত। রাণীয়ার মা, মাসীরা যে যার নিজের নিজের বঁটি নিয়ে কেউ ফলপাকড়, কেউ ভোগের আনাজপাতি কাটতে বসে পড়েছেন স্নান সেরে। সবেতেই দিদার প্রচ্ছন্ন তদারকি। সব আনাজপাতি সমান সাইজের হবে। কোনটা ডুমোডুমো, কোনটা ফালাফালা আবার কোনটা ঝিরিঝিরি। আগেভাগেই সব ইন্সট্রাকশন দেওয়া আছে। ভোগের রান্নার শুরুয়াত হত একদিকে চাটনি, অন্যদিকে পায়েস বসিয়ে। এগুলি ঠাণ্ডা নিবেদন করার নিয়ম। তারপরেই পাঁচ ভাজা। ভোগের স্তূপীকৃত চাকাচাকা আলুভাজা ভেজানো রয়েছে পেতলের বালতির জলে। সেখান থেকে তুলে রাখার সময় রাণীর চোখ যেতেই নোলা শকশক। মায়েদের মারমার করে ওঠা। ঠাকুর খেলোনা যে এখনও!  
ওদিকে সপ্তমী পুজো বসে গেছে। কইরে! এখনও তোদের বাতাবীলেবু ছাড়ানোই হলনা! কিম্বা আখগুলো কাটছিস তো কাটছিস! যারা কাটে তারা জানে কী বিষম সেই ফলকাটা। যার ভাগে পানিফল ছাড়ানো পড়ত সে তো দিদার ভয়ে তঠস্থ। হাত না কেটে ফেলে। বঁটি, ছুরি, কাঠারি সবেতেই তো শান দেওয়া হয়েছে আগেভাগেই। দিদার সব নিদিনিক্ষিতে হওয়া চাই। যেমন তরিজুত তেমনি তাকবাক। মনের মত না হলেই পুজোবাড়ি রসাতলে।
ওদিকে হয়ত ভোগঘর থেকে মুখ বাড়িয়ে কেউ চীৎকার করে কোনও ছেলেকে বলল, হ্যাঁরে, ঘিয়ের কৌটোটা কেটে দিলিনা এখনও! তখন টিনের ঘিয়ের কৌটো আসত বাড়িতে। রান্নায় পড়বে ভয়সা ঘি আর লুচি, পান্তুয়া ভাজা হবে গাওয়া ঘি তে।
ফল নৈবেদ্যর পাশাপাশি পাথরের থালায় মাখন, মিছরি, পঞ্চশস্যের সঙ্গে নানারকমের জলে ভেজানো বাদাম, কিসমিস, খেজুর থাকবেই। কোনও অনুষ্ঠানের ত্রুটি থাকবেনা। রাণীয়া আর মিঠির চোখ থাকতো সেইদিকে। পুজো হয়ে গেলেই প্রসাদ বিতরণের দায়িত্ব নিত ওরা দুইবোনে। সেইসঙ্গে বাদামে মুখ চলতেই থাকত। যতক্ষণ না কেউ বারণ করছে। টুক করে বাড়ির বড় কাউকে দিয়ে সেই পাথরের থালাখানি পাশের কোনও ঘরে রাখিয়ে আসতে পারলেই ওদের শান্তি তখন। ড্রাইফ্রুটস বলে কথা। তায় আবার মা জগদ্ধাত্রীর প্রসাদ।

আজও দিব্যি এসব মনে পড়ে রাণীয়ার। মন কেমন করে ওঠে দিদার জন্য। দাদু বেঁচে নেই। মাসীরাও সবাই থেকেও নেই। ভাইবোনেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কিন্তু দেশে কেউ নেই পড়ে। যে যার কেরিয়ার গড়তে পা রেখেছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। কেমন যেন সব হয়ে গেল। বড় হয়ে গিয়েই সব ভুল হল যেন। ভাবে রাণীয়া।

সপ্তমীর মেন্যুতে থাকত সাদা ভাত, ভাজা মুগের ডাল, পাঁচরকমের ভাজা, সদ্য ওঠা মুলো দিয়ে পালংশাকের ঘণ্ট, অসময়ের এঁচোড়ের ডালনা, মটর ডালের বড়ি-বেগুণ-রাঙালু-কাঁচা তেঁতুল দিয়ে টক আর গোবিন্দভোগ চালের পায়েস। ভিয়েনে বানানো সব মিষ্টি আলাদা রেকাবে। সব রান্নার শেষে সুগন্ধি, মহার্ঘ্য আতপ চালের ভাত বসবে। গরম গরম ভাত বড় পেতলের থালায় বেড়ে দেওয়া হবে। থালার পাশে ডান দিক দিয়ে বাঁ দিকে ঘুরে যাবে সব বাটি। ভাতের পাশেও ডান দিকে থরে থরে ভাজা সাজানো থাকবে। একটু নুন আর লেবু থাকবে ছোট্ট একটা পাথরের বাটিতে। পাশে থাকবে পানের খিলির মধ্যে ধোয়া আতপ চলা ভরে। তাও দেওয়া হবে মা’কে মুখশুদ্ধি হিসেবে। রাণীয়া এই টাইম ম্যানেজমেন্ট আর ডিস্ট্রিবিউশন অফ লেবার শিখেছিল দিদা আর মা,  মাসীদের কাছ থেকে। সেটাই যেন সারাজীবনের মত তার পাথেয় হল।গেঁথে গেল নিজের জীবন যাপনের সঙ্গে ওতোপ্রতভাবে।    


আরো পড়ুন: রাণীয়ার রান্নাঘর (পর্ব-১৫) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়


সপ্তমী পুজো হতে না হতেই শুরু হয়ে যেত মহাষ্টমীর তোড়জোড় শুরু। আরেক রাউন্ড ফলমূল, মিষ্টি দিয়ে নৈবেদ্য সাজানোর পালা। হাত লাগাতো ওরা দুই বোনে।অনসূয়ার কড়া নিয়ম। সব কাজ একটু আধটু শিখতে হবে মেয়েদের। বেলা গড়িয়ে প্রায় একটা কিম্বা দেড়টা তখন। সপ্তমী পুজোর ভোগ যারা রেঁধেছেন তাঁদের তখন বিশ্রাম। লেবুর জল কিম্বা ডাব-মিছরির শরবত করে দিত রাণীয়া।সেটাও নাকি পুণ্যির। ব্রতীকে পানীয় দেওয়া। অন্য আরও দুজন ভোগ রাঁধিয়ে তখন পা বাড়িয়েছেন ভোগ ঘরের দিকে। অষ্টমীর ভোগে বিশেষ আয়োজন। সোনামুগ ডাল আর গোবিন্দভোগ চালের খিচুড়ির গন্ধে পাগল সব ছেলেপুলেরা। কখন সেই ভোগ নামবে আর ওরা বসবে কলাপাতায় পাত পেড়ে খেতে। খিচুড়ির সঙ্গে আলু, বেগুণ, পটল, ফুলকপি, রাঙালু, বড়ি আর পাঁপড় নিয়ে সাত ভাজা। একটি পাঁচমেশালী চচ্চড়ি, জলপাইয়ের চাটনি। আবারও পায়েস আর মিষ্টি। সেই ভোগ নামবে। বাড়ির সবার অঞ্জলি পর্ব শেষ হবে আর ওদিকে প্রসাদ বিতরণ চলতে থাকবে। ততক্ষণে নবমীর ভোগ রান্নায় আবারও প্রস্তুত প্রথমবারের দুই রাঁধিয়ে।রাণীয়ার দিদিমার অসাধারণ পরিকল্পনামাফিক অতি সুচারুভাবে পুরো ইভেন্ট টিকে প্রতিবছর যেন প্রাণ দিয়ে পরিচালনা করতে দেখেছে ওরা।
নবমী পুজোয় আবার চালকুমড়ো বলির তোড়জোড়। মাঝখান দিয়ে আড়াআড়ি ছুরি দিয়ে চিরে তার মধ্যে পিটুলির পুতুল গড়ে চুন হলুদ লাগিয়ে সেই চালকুমড়োর মুখ বন্ধ হবে। মায়ের মূর্তির সামনে একটা মাটির ঢিপি গড়ে তারপরে বলিদান হবে। পাশে নৈবেদ্য, ফল মিষ্টি সাজানো থাকবে। নবমীর অঞ্জলির পরে বলিদান আর তারপরে ভোগ উঠবে। আরতি হবে। হোমযজ্ঞ হবে। নবমীর ভোগরাগে ঘি ভাত, পাঁচ ভাজা, ফুলকপির ডালনা। এবার রেলিশ বদলে টম্যাটো, আমসত্ত্ব আর খেজুরের চাটনি। আবারও পায়েস আর মিষ্টি।
সন্ধের পরে বৈকালিকের আয়োজন। মা জগদ্ধাত্রীর শীতল দেওয়া। সন্ধের ভোগরাগ। ভোগের মেন্যু তে গাওয়া ঘিয়ের লুচি, বেগুণ ভাজা, নিরামিষ আলুর দম কিম্বা বাঁধাকপির ডালনা।সঙ্গে সুজির পায়েস আর ভিয়েনের মিষ্টি। সন্ধ্যারতির সময় বাড়িতে তিল ধারণের জায়গা থাকত না। আশপাশ থেকে লোকজনের ভীড় । তার মধ্যে মেয়ে দেখানোর পর্বও চলত। রাণীয়া, মিঠি তখন রাইকিশোরী। কিন্তু তারা ত্রিসীমানায় নেই তখন। দিদা বলত কোথায় যে কার কুটোটি বাঁধা কে জানে!
জগদ্ধাত্রী পুজোর বিজয়া দশমীর দিনে মনখারাপের রেশ পড়ুয়াদের মনে। আবারও ফিরে গিয়ে স্কুল খুলে গেলেই বার্ষিক পরীক্ষার প্রস্তুতি। তার ফাঁকে বিসর্জনের বাজনা বাজলেই মনে ফুর্তি। সব ভাইবোনেরা মিলে লরি করে গঙ্গায় যাওয়া। আসা যাওয়ার পথে কালীপুজোয় উদ্বৃত্ত বাজি পোড়ানো। সেদিন সকালে পুজোর ভোগ সাদামাটা। তিন তিথির এলাহি আয়োজনের পরে মায়ের বডি ডিটক্সিং যেন। সাদাভাতের সঙ্গে থাকত সদ্য ওঠা শিম, আলু, ছোটো বেগুণ দিয়ে বিউলির ডাল, পাঁপড় ভাজা, কচুর শাকের ঘণ্ট, চাটনি আর পায়েস। দই মিষ্টি তো আছেই সঙ্গে। বিসর্জনের বাজনা বাজতেই মা’কে প্রদক্ষিণ আর মাটির হাঁড়িতে জলের মধ্যে রাখা দর্পণে মায়ের মুখ দেখার হিড়িক। দইকর্মার ভাগ বাঁটোয়ারা।
সেদিনই সকাল সকাল মামাবাড়ির পুকুরে জাল ফেলা হত। প্রচুর মাছ উঠেছে ততক্ষণে। দুপুরে সবাই সেদিন ভোগ খেয়ে মাছ ভাত খাবে। এরপর যথারীতি বিকেলের আলোয় মা’কে বরণ ইত্যাদি পর্বের পরেই সিঁদুর খেলা। তবে সিঁদুরখেলায় মাতামাতি হতে দেখেনি রাণীয়া। ওদিকে রান্নাঘরে তখন মা জগদ্ধাত্রী কে উৎসর্গ করা সিদ্ধিপাতা ভেজানো পর্ব চলছে। সিদ্ধির শরবত তৈরী করে খাওয়া হবে বিসর্জনের পর বাড়ি ফিরে। কেউ একজন আফগারী দফতরে চাকরি করার সূত্রে আসল সিদ্ধিপাতা আসত পুজোর সময়।
লরি করে মায়ের প্রতিমা নিয়ে প্রচুর ঘোরা হত। তারপর গঙ্গায় গিয়ে নৌকো ভাড়া করে অনেক দূর যাওয়া হত এবং তারপর বিসর্জন দেওয়া হত।এগুলোই ছিল বিশেষ পাওনা। জামশেদপুরে এসবের কোনও সিন নেই। লৌহনগরী বড় ভালো তবে বেশ যান্ত্রিক। সেখানে ছটপুজো আর টুসুপরবে বড় ধুম।
গঙ্গায় ধুমধাম করে প্রতিমা বিসর্জনের পর বাড়ি ফিরে এসে মিষ্টিমুখের পরে মামাবাড়িতে  অন্যতম আকর্ষণ সিদ্ধির শরবত। রাণীয়াদের জন্য বরাদ্দ যদিও খুবই কম তবুও খুশির অন্ত নেই সেই স্বল্প পরিমাণ শরবত চাখতে।  
বিশাল হাঁড়ির মধ্যে গাঢ় সবুজ সিদ্ধিপাতা বেটে দুধের মধ্যে রাখা থাকত। তার মধ্যে একে একে পড়ত চীনেবাদাম, কাগচি বাদাম, কাজু বাটা, পুজোর প্রসাদই পেঁড়া বা ক্ষীরের মিষ্টি, মৌরী, গোলমরিচ বাটা। বরফ কিনে এনে হামান দিস্তায় গুঁড়ো করে দেওয়া হত সেই মহার্ঘ্য শরবতে। এই ঠাণ্ডাইটা দোলের পার্টিতে রাণীয়া আর মিঠি উদ্যোগ করে অনসূয়া কে দিয়ে বানিয়েই ছাড়ত। জামশেদপুরে আবার অবাঙালীদের মধ্যে এই ঠান্ডাইয়ের খুব কদর কী না।  

পুজো শেষ কিন্তু সেই পিসিদিদা ততক্ষণে রান্নাঘরে বসে গেছেন ভিয়েনের মিষ্টির বেঁচে যাওয়া রস নিয়ে একের পর এক হাতের খেল দেখাতে। সেই রসকে জাল দিয়ে তিনি রেখে দিতেন। নষ্ট হত না। একদিন সারপ্রাইজ এলোঝেলো। একদিন খাজা বা গজা। কোনোদিন আবার গোকুল পিঠে। বাড়ির গোরুর দুধে ছানা কাটিয়ে অনসূয়াও তাঁর দিদিদের সঙ্গে বসে পড়তেন হালুইকরের কাছ থেকে শিখে রাখা পান্তুয়ার এক্সপেরিমেন্ট করতে। মেয়েরা ফিরে যাবে যে যার ঘরে। তাদের জন্য শুকনো মিষ্টি তুলে রেখে দিতেন রাণীয়ার দিদা।

ভোগের খিচুড়ি আর নিরামিষ আলুর দম নিয়ে বকবক করতে হবে ভেবেই এত কথা নিয়ে সেদিন জাবর কাটা তার। মনটা বড় পুরনো স্মৃতিতে ভারাতুর রাণীয়ার।
দিদা যেন ঠিক কী দিত মা? আলুর দম নিরামিষভাবে রাঁধলে কিছুতেই অমন টেস্ট হয়না।
অনসূয়া বলেন কী করে হবে? এখন নেই সেই হিংয়ের গন্ধ আর নেই সেই পুজোবাড়ি। সেদিন মা থাকবেন মেয়ের সঙ্গী হয়ে। রাণীয়ার জবরদোস্তি। মা তোমাকে এবার আমার সঙ্গে বলতেই হবে। হিংয়ের গৌরচন্দ্রিকা করে তিনি জানাবেন হিং সমাচার।
রাণীয়া শুরু করে …
একটুতেই আঁতে হিং লাগানো বাঙালির স্বভাব। আবার উগ্রগন্ধ যুক্ত হিং এর প্রেমে বাঙালীজাতির হাবুডুবু খাওয়াও বহুকালের রসনাবিলাস।
হিং এর সঙ্গে আমাদের বাংলার হেঁশেলের গাঁটছড়া জন্মে এস্তোক দেখে আসছি। আমার মা, দিদা, ঠাম্মা কেউ নিরামিষ আলুর দম রাঁধবে না এই মহার্ঘ্য রেজিনাস বস্তুটি ছাড়া। উপোসের দিনে ছোলার ডাল কিম্বা কুমড়োর ছক্কায় হিং? অথবা কালীঘাট বা দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণীর আমিষ ভোগে পিঁয়াজ রসুনহীন মাছের কালিয়া বা পাঁঠার মাংসে হিং এর ছোঁয়া? আজকে আসুন আমার মা অনসূয়া রায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। তিনিও রন্ধনে পটীয়সী, আমার দিদার যোগ্য স্যাঙাত।
অনসূয়া সেদিন সেজেগুজে ভিডিও শ্যুট করে পাঠিয়ে দিয়েছেন মেয়ের ফোনে।

নিজে পারেন না এসব। ভদ্রলোকের সাহায্য নিতেই হয়। মেইল উড়ে চলে গেছিল রাণীয়ার ইনবক্সে।

আমাদের ছোটবেলায় মফস্বলী কলকাতার অলিগলিতে আফগান পোশাকে হেঁকে যাওয়া দশাশয়ী শ্বশ্রূগুম্ফ সম্বলিত সেই কাবুলিওয়ালার গুরুগম্ভীর স্বরে হেঁকে যাওয়া? “হিং সুরমা হিং”। আমিও শুনেছি জানেন? খুব ছোটবেলায় সেই ডাক। একতলার বাড়ির বারান্দা থেকে তার পাগড়ি পরা চেহারা দেখেই ভয়ে পালিয়ে যেতাম। সেই দেখে আমার মা একদিন রবিঠাকুরের বই খুলে কাবুলিওয়ালা আর মিনির গল্প শুনিয়েছিল। তবুও মা একেকবার বলত, এবার কাবলে টা ভালো হিং দেয় নি। ভালোই দাম নিয়েছে। আমার মায়ের হাতের বেসনে চোবানো পোরের ভাজায় হিং ছিল মাস্ট। অথবা মাঘী পূর্ণিমার সাধুসেবায় কিম্বা জগদ্ধাত্রীপুজোয় বৈষ্ণবী এঁচোড়ের ডালনায় সেই হিংয়ের ঠিক গন্ধটা ঠিক না পেলে পুজোবাড়ি রসাতল হত।
আমি মায়ের মুখে ছোটবেলায় সেই কাবুলিওয়ালার নিন্দেমন্দ শুনে বলেছিলাম, ও তাহলে কী দুষ্টু লোক মা? মায়ের অভিযোগ ছিল সেই আফগানি গাছের ওপর। কাবুলিওয়ালার ওপর নয়।
ঠিকই তো। ওরা ওদের কাঁধের ঝোলাঝুলি ঝেড়ে মিনি কে আদর করে কত শুকনো ফল দেয়। মা বলেছে সেদিন। ওদেশ বড় গরীব। তাই এদেশে আসে ওরা ব্যাবসা করতে। আমাদের বাড়িতে অসাধারণ দস্তার কিউট সুরমা দানী ছিল। তা থেকে কাজল নিয়ে আমরা পুতুল মেয়ের বিয়েতেও পরিয়েছি। কাবুল দেশের কাজল কাবুলিওয়ালাদের চোখে থাকত।মায়েরা সুরমাদানীতে মনসাপাতার কাজল বানিয়ে রাখত।

জানেন কী? কাবলিওয়ালাদের পাগড়ি নাকি সেদেশে এখনও যায় আমাদেরই বাঁকুড়ার সোনামুখী থেকে। বিষ্ণুপুরী রেশমের বৈষ্ণবী পাগড়ি বহুযুগ আগে আফগানরা বরণ করে নেয়। সেই ট্র্যাডিশন এখনও চলছে।
রাণীয়া এবার শুরু করে।
কোথা থেকে কোথায় চলে এল আমার মা। তা আজ সেই হিংগন্ধী রান্না বলব বলেই বসা আমাদের। আসমুদ্রহিমাচল মানে দক্ষিণী বড়া-সম্বর থেকে উত্তরের ডাল রান্নায় হিং ভারতীয় রন্ধনশিল্পে মাস্ট।কাবুলিওয়ালার হিং। দুর্গম গিরি কান্তার মরু পেরিয়ে আসা হিং। দু’ রকম গাছের রেজিনাস আঠা। লাল ও সাদা। সেই ধুনোজাতীয় গাছের আঠার ছোঁয়ায় একটু ঝাঁঝেই কেল্লাফতে হয় রান্না । ইংরেজিতে যাকে বলে ” শার্প ট্যাঙ্গিনেস উইথ আ ড্যাশ অফ অ্যাসাফোয়েটিডা”  
কিন্তু এই মহার্ঘ্য বস্তু গাছের আঠা কখন এবং কিভাবে আমাদের দেশে এল? হিন্দু এবং বৌদ্ধ উভয় ধর্ম গ্রন্থেই হিংয়ের উল্লেখ রয়েছে। এমনকি আমাদের মহাকাব্যদ্বয় রামায়ণ-মহাভারতেও উল্লেখ আছে হিংয়ের।
তখন অনসূয়া বলতে থাকেন আবারও…
 তাহলে মঙ্গলকাব্য কোন ছার?
‘পাকরাজেশ্বর’ গ্রন্থে অন্যান্য মশলার সঙ্গে “হিং ১ তোলা” র উল্লেখ থেকে শুরু করে রক্ষণশীল বাড়িতে আপাত অচ্ছুত আফগান দেশের হিং আলতো অনুমোদনের ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়েছিল সে যুগের হিন্দু বিধবাদের নিরামিষ হেঁশেলে।
রামায়ণে আমরা দেখি হিং দিয়ে আগুনে ঝলসে খাওয়া হচ্ছে সবরকম মাংস। আবার এর ঠিক দু’ হাজার বছর পরে বিজয়গুপ্তের লেখা মনসামঙ্গলে কবি লিখেছেন- রন্ধন রান্ধিয়া সোনাই করিল ভাগ ভাগ / হিঙ্গ মরিচে রাঁধিলে শ্বেত সরিষার শাগ।
হিংয়ের আদি নিবাস আফগানিস্তানের হিন্দুকুশ পর্বতমালার পাদদেশ। আজও সেরা হিং সেখানেই মেলে।
কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর খুল্লনার রান্নার বিবরণে শুক্তো রান্নার পদ্ধতিতে রয়েছে
 ‘বেগুন কুমড়া কড়া, কাঁচকলা দিয়া শাড়া/ বেশন পিটালী ঘন কাঠি।/ ঘৃতে সন্তলিল তথি, হিঙ্গু জীরা দিয়া মেথী/ শুক্তা রন্ধন পরিপাটী।।’
এবার টার্ন রাণীয়ার। সে বলতে থাকে…

হিংয়ের কচুরির বাঙালিয়ানা সর্বজনবিদিত। কারণ উত্তর থেকে দক্ষিণ, পুব থেকে পশ্চিম কলকাতার অলিগলিতে এখনও থিকথিক করছে কচুরির পুরানো দোকান। বঙ্গদেশের চক্রপাণিদত্ত সুশ্রুতের ভেষজ শাস্ত্রের পুঁথির ওপর প্রথম ভাষ্য লেখেন। সেখানে কচুরির সংস্কৃত নাম পূরিকার উল্লেখ আছে। আটার সঙ্গে হিং, মাষকলাই ডালবাটা আর নুন দিয়ে তেলে ভাজার কথাও আছে তার দ্রব্যগুণে। স্বামীজি স্বয়ং হিং ছাড়া কচুরি বানাতেন না।
অতএব বাঙালির সেই প্রাচীন যুগ থেকেই অড়হর কিম্বা বিউলি অথবা ছোলার ডালে হিং স্ফোটন না হলে চলে না তেমনই কচুরির মধ্যেও দুষ্প্রাপ্য হিং এর অনুপস্থিতি মেনে নিতে তাদের বুকে শেল বিঁধে যায়।
অনসূয়ার ফিনিশিং টাচ এবার। সোজা নিয়ে গিয়ে ফেলেন বাংলাসাহিত্যের মেইন স্ট্রীমে।
বিভূতিভূষণের “হিঙের কচুরি” গল্পটি? যা অবলম্বনে অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের নিশিপদ্ম ছায়াছবি তৈরী হয়েছিল। নিম্নমধ্যবিত্তদেরও পকেটে টান না পড়া রোজকার এক কেজো, ফুটপাথিয়া খাবার এই হিংয়ের কচুরি। শুধু কোলকাতাই বা কেন সারা দেশেই চলার পথের সাথী এই গরম হিঙের কচুরি নামক সুখাদ্যটি।
বিভূতিভূষণের বর্নণায় চোখের সামনে ভেসে ওঠে পদ্মপাতায় জড়ানো কিম্বা শালপাতায় মোড়া সেই কচুরীর আস্বাদ। তবে এখনকার রাস্তার কচুরীতে সেই সেই হিং এর গন্ধ আর নেই।

রাণীয়া বলে, মা? শুধু বাংলাই নয় কী বল? উত্তরে কাশ্মীরি মাটন থেকে দক্ষিণে মেদু বড়া, বড়া পাও বা সম্বরডাল, পশ্চিমে গুজরাটের ধোকলা থেকে পূর্বে ওড়িশার সবজী দিয়ে ডালমা সবের স্বাদের মূলে কিন্তু এক টুসকি হিং।

হিং এর ইংরেজী নাম Asafoetida বা asafetida এসেছে পারস্য ভাষা থেকে।পারস্য শব্দে azā র অর্থ হল ‘mastic’ বা আঠালো, চটপটে। আর ল্যাতিন শব্দ foetidus এর অর্থ হল ‘smelling, fetid’। অতএব চটচটে আঠালো এবং উগ্র গন্ধের এই রন্ধনসামগ্রীর কদর কিন্তু সারা ভারত জুড়ে।  
আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনী ভারতে আসার পথে ওদের সঙ্গে এসেছিল মৌরির মতো দেখতে সিলফিয়াম নামে এক মশলা। যার চাষ হতো শুধু সুদূর আফ্রিকা ও গ্রিসে আর জন্মাত অল্প পরিমাণে। বিখ্যাত গ্রিক চিকিৎসক সোরানাস ইফিসাসের লিখিত গ্রন্থ থেকে জানা যায় প্রাচীন গ্রিসে সিলফিয়াম ছিল জন্মনিয়ন্ত্রণের অব্যর্থ ওষুধ।ধীরে ধীরে রোমানদের কাছে পৌঁছায় সে খবর। অমনি তারাও শুরু করল সিলফিয়াম সেবন।
আমাদের এই হিং প্রথম ইউরোপীয় প্ল্যাটফর্ম পায় সিলফিয়ামের প্রক্সি দিতে। রান্না, ওষধি সবেতেই । খ্রিস্টের জন্মের আগে অনেক শতক ধরেই গ্রিকরা ভেবেচিন্তে এর ব্যবহার করলেও আমোদপ্রিয় রোমানদের লাগাম-ছাড়া ব্যবহারের ফলে একদিন সিফিলিয়াম বিলুপ্ত হল।
সিফিলিয়াম প্রতি তাদের আস্থা এতটাই ছিল যে তা না মাখিয়ে মাংস খাওয়া ভাবতেই পারত না তারা। ভারতের একেবারে কাছে এসে খাওয়া-দাওয়া নিয়ে অশান্তি চরমে ওঠে। সেনারা যখন দেশে ফেরত যাওয়ার কথা ভাবছে, ঠিক তখনই তারা আবিষ্কার করল যে হিন্দুকুশের পাদদেশে মানুষ মাংসে হিং মেখে ঝলসে খায়। এ সৈন্যরাই ফেরার সময় দেশবাসীর জন্য হিং নিয়ে গিয়েছিল। এভাবে আলেকজান্ডার ও তার সৈন্যবাহিনীর হাত ধরে হিং ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বে।

বলাই বাহুল্য মা-মেয়ের এই হিং সমাচার অচিরেই জনপ্রিয়তার শিখরে উঠল। অনসূয়ার আগমনে চ্যানেলের টি আরপি বাড়তেই জামশেদপুরের বাড়িতে রান্নাঘরের পছন্দমত জিনিষ কেনাকাটির জন্য অনসূয়ার গিফট কুপন পৌঁছে দিল সেই চ্যানেল।
আবার মায়ের সঙ্গে ছোটো বোনের এহেন ভিডিও দেখতে মোটেও মিঠির ভালো লাগেনি। সে উঠে পড়েছিল ভিডিও দেখতে দেখতে। শৈবাল বলেছিল, আরে! বন্ধ করে দিলে কেন? কী ভালো বলছিলেন তোমার মা। আর আমার শালী তো অ্যাবাভ অ্যাভারেজ। বরের মুখে মা, বোনের এত সুখ্যাতিতেও বেশ ডিস্টারবড হয় যেন মিঠি। এতদিন শুধু বোন ছিল, এখন আবার পাল্লা দিয়ে তাদের মাও?
শৈবাল আজকাল মাঝেমাঝেই মিঠি কে বলে… তুমি আজকাল এত জেলাস হয়ে যাও কেন বলত? মেয়েরাই মেয়েদের ভালো দেখতে পারেনা জানতো?
মিঠি বলেছিল, কী? আমি আমার বোন, মায়ের প্রতি জেলাস? আমার কিসের অভাব যে আমি ওদের প্রতি…আমার কিছু কম আছে নাকি? রূপ, টাকা, বাড়ি গাড়ী, চাকরী…  
শৈবাল কথা বাড়ায় নি আর।
নিজের বৃত্তে ঘুরপাক খেতে খেতে মেয়েরাই বুঝি এমন হয়ে ওঠে বয়স হলে। এইজন্যই বুঝি এই মুহূর্তে মিঠির একটা ইস্যুর খুব দরকার ছিল । একটু রেসপন্সিবিলিটি নিতে শিখতে হয়। সারাদিন মিঠির চিন্তা তার বোন কে নিয়ে… বোনের উন্নতি দেখতে কী তার ভালো লাগছে না তবে? অথচ কী ভালো সব কাজ করে চলেছে রাণীয়া। একের পর এক। নিত্য নতুন সব খাবারের গল্প। এদ্দিনে নিজের বৌয়ের ওপরে একটু হলেও আস্থা হারায় শৈবাল। মিঠি কে চিনতে বেশ ভুল হয়েছিল তার। তার মা তবে বউয়ের সম্বন্ধে যা বলতেন সবটা মিথ্যে নয়। মা হয়ত একটু বেশীই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে আর মা বড় এক্সপ্লিসিট, আউটস্পোকেন। কিন্তু মিঠিও তাই বলে ধোয়া তুলসীপাতা নয়। এইজন্যেই বুঝি তাকে মা বলেছিল একদিন… “দিনের পরদিন ঘর না করলে বোঝা যায়না। এই একদিন তুইও বলবি সে কথা। দেখে রাখিস। মিলিয়ে নিস আমার কথা” বাট  দ্যা ডাই ইজ কাস্ট অলরেডি। এতগুলো বছর পেরিয়ে আর সে ভাবে না নিজের বিয়ে, সন্তান এসব নিয়ে…

শাশুড়ি অনসূয়াও একদিন বলেছিলেন জামাইয়ের অফিসে ফোন করে। “বয়স হয়ে যাচ্ছে মেয়েটার। এইবার একটা বাচ্ছা নাও তোমরা। পরে পস্তাবে কিন্তু। মিঠি কে বুঝিয়ে বল শৈবাল। হয়ে তো গেল কেরিয়ার গড়া। নিজের ফ্ল্যাট, পয়সাকড়ি।আবার কদিন পরে হবে নাহয়। বেশী বয়েসে বাচ্ছা নেওয়াটা কিন্তু খুব চাপের। কমপ্লিকেশন্স অ্যারাইজ করবে”  

শৈবাল বুঝিয়ে বলেছিল অনসূয়া কে। ” মা, বিশ্বাস করুন। আপনার জেদি মেয়েকে আপনি তো ভালো করেই চেনেন। ও কারোর কথা শোনেনা। শুধু নিজের নিয়ে ব্যস্ত সে। কী ভাগ্যি আজকাল একটুআধটু রান্নায় পায় তাকে। আমারও মুখ বদলায়। আমি ওয়েট করে আছি রাণীয়ার কবে একটা ইস্যু হবে। সেই দেখে যদি আপনার বড় মেয়েরও টনক নড়ে”

অনসূয়া হেসেছিলেন। তার মানে তাঁর মত শৈবালও চিনে নিয়েছে তার বৌ মিঠি কে। ছোটো বোনের সঙ্গে তবে একটা ইগোয়িস্টিক আঁতাত চলছে ভেতরে ভেতরে মিঠির। তাই বলে কী আর রাণীয়া হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবে সে দেশে?যার যাতে এলেম আছে। উন্নতি তো মিঠিও কিছু কম করল না চাকরী জীবনে। আজ সে কোম্পানির ব্যাঙ্গালোরের হেড অফ ডেটা সায়েন্স। কিন্তু রাণীয়া তার দিদির কর্পোরেট কেরিয়ার নিয়ে গদগদ মুখে চাদ্দিকে বলে বেড়ায়… কই মিঠি কে তো তিনি রাণীয়ার কাজকর্ম গুলো শেয়ার করতে দেখেননি আজ অবধি । এত কাজ করে মেয়েটা। তারও তো মনে হতেই পারে এসব । দিদি একটু পুশ করুক ছোটো বোন কে।
নাহ! রাণীয়ার এসব মনে হয়না। তার প্রত্যাশা অন্য।
হে পূর্ণ তব চরণের কাছে… যাহা কিছু তার আছে, আছে আছে… নাই নাই ভয়, সে শুধু আমারই, নিশিদিন কাঁদি তাই… মাঝেমাঝেই গুণ গুণ করে সে এই প্রিয় গানখানি।

এটাই যা রাণীয়ার সঙ্গে মিঠির মস্ত তফাত। ছেলেপুলে না হলে মেয়েরা এমন খিটখিটে আর হিংসুটে হয়ে যায় বৈকি। অনসূয়ার মাও বলতেন এমন। সময়ের কাজ সময়ে করতে হয়। সবদিক থেকেই সেটা মঙ্গলের। আবারও বোঝাতে হবে মিঠি কে। অনসূয়ারও তো ইচ্ছে করে। বয়স বেড়ে যাচ্ছে তাঁদেরও। নাতি নাতনী নিয়ে নাড়াচাড়াও করতেও তো মন চায়। এখনও তিনি পারবেন কাছে গিয়ে মেয়ের মেটারনিটি কেয়ার নিতে। তার সন্তানের পোষ্ট নেটাল ব্যাপারগুলোয় মাথা ঘামাতে। সুখবরের অপেক্ষায় থাকেন তিনি। পেলেই ছুটে চলে যাবেন মেয়ে জামাইয়ের কাছে ব্যাঙ্গালোরে। দরকার হলে নিজের স্বামী কে কাজের লোকের হাতে ফেলে রেখেই। তপনবাবুর মা বেঁচে তাই একটু হলেও বেশীদিন থাকার অসুবিধে। অনসূয়া একাই চলে যাবেন নাহয় … রহিল তোমার এ ঘুর দুয়ার… এই বলে। ওয়ান ফাইন মর্নিং। কিন্তু সে সুদিন আর আসেনা।

ভোগের খিচুড়ি নিয়ে রাণীয়ার বকবক শেষ হতেই কুশল বায়না করল খিচুড়ির। কুশলের এই ছোটোখাটো আবদারগুলোকে প্রশ্রয় দিতেই হয় রাণীয়ার।

ডালাসের রান্নাঘরে গুগল ওয়েদার সেদিন বৃষ্টির ফোরকাস্ট করেই রেখেছে। বৃষ্টি ঝরবে কথা ছিল। ফলেও গেছে সেই পূর্বাভাস। সেইসঙ্গে যোগাড়ও ছিল মহার্ঘ্য খিচুড়ির। আবাদরি খিচুড়ির আগেই অফিস থেকে ফিরে কুশল বসে গেছে সুদৃশ্য কাটগ্লাসের পাত্রে। মহার্ঘ্য আফগারী পানীয় নিয়ে। ঠাণ্ডায় শরীর গরম করতে। রাণীয়াও ভাগ বসাবে অবিশ্যি। কী রে আমার গ্লাসটা দিয়ে যা রান্নাঘরে। বলে ওঠে তার বৌ।

রাণীয়া তার রান্নাঘরের কাবারড থেকে বের করে রাখে গোবিন্দভোগ চাল, সোনামুখ ডাল। সব পাওয়া যায় ইন্ডিয়ান স্টোরে। শুকনোখোলায় ভেজে রাখা ডাল আর চাল মেপে ধুয়ে ভিজিয়ে রাখে সে। ডুমো ডুমো ফুলকপি, কুচোনো গাজর, বিনস আর ফ্রোজেন মটরশুঁটি পড়ল তাতে। এবার একটা বাটিতে গ্রেট করা আদা, আর ট্যোম্যাটো কুচি। তার ওপর ছড়ানো হল জিরে আর ধনের পাউডার। সামান্য লাল লঙ্কার গুঁড়ো। এবার ইনস্ট্যান্ট পটে সামান্য ঘিয়ে তেজপাতা, শুকনো লঙ্কা, জিরে আর গোটা গরমমশলার ফোড়ন। স্যতে মোডে মিনিট দুয়েক। চড়বড়িয়ে উঠলেই আদা-মশলার পেষ্ট। সবশেষে চালডাল দিয়ে নাড়াচাড়া, ওলটপালট। এবার সব্জী দিয়ে মেপে জল।ইন্স্ট্যান্ট পটের ঢাকনা সিল হল। গুগল অ্যাসিস্ট্যান্টে অ্যালারম সেট করে রাণীয়া বসে পড়ল ফোন নিয়ে। খিচুড়ি বেত্তান্ত ঘাঁটবে বলে। দশ মিনিট পর ঢাকা খুলে নেড়ে নুন, মিষ্টি, হলুদ ছেটাতে হবে। আবারো ওয়ার্ম মোডে মিনিট দশেক। পরিবেশনের আগে ঘি ছড়িয়ে গরমমশলা গুঁড়ো। খিচুড়িকে জব্দ করেই লাবড়ার যোগাড়। কিন্তু রেসিপি?

পালংশাক একটু, আধটু ফুলকপির কচিকচি পাতা, বাঁধাকপি,  বেগুণ, আলুর টুকরো ফালাফালা করে কেটে  রাঙা মূলো, ফুলকপির কচি ডাঁটা আর অগতির গতি ফ্রেঞ্চ বিনস আর অবিকল কাঁচা কুমড়োর মত সেদেশের একর্ণ স্কোয়াশ কুচিয়ে নিয়ে মা কে ফোন করে

মা বললেন,
তাহলে আর কী? এবার তেলের মধ্যে শুকনো লঙ্কা গোটাকয়েক আর পাঁচফোড়ন। সব্জী ভেজে নিয়ে শাকপাতা ছড়িয়ে নুন, হলুদ দিয়ে সেদ্ধ হলেই মিষ্টি আর ধনে, জিরের গুঁড়ো। ব্যাস! মাখোমাখো লাবড়ার সুগন্ধে ভরপুর রান্নাঘর।মা বলে দিলেন নিখুঁত ভাবে লাবড়ার রেসিপি।ও হ্যাঁ, কাঁচালঙ্কা দিস ক’টা চিরে।  

এবার কী ভাজা খাওয়া যায় খিচুড়ির সঙ্গে? পাঁপড় আছে। কিন্তু বৃষ্টির দিনে শুধু পাঁপড়? আওয়াজ দেবে কুশল। ডিপ  ফ্রিজ থেকে বেরুল ড্রায়েড শ্রিম্প। প্রণ কা বাবালোগ। কুশল নাম দিয়েছে। মামারবাড়ির দিদার ঘুষোচিংড়ি। তবে এখানে টাটকা নয়। চায়নায় প্রোসেসড। প্যাকেট কেটে দেখে চিংড়ির সুগন্ধে ভরপুর। আর কী চাই? সেই বর্ষায়? কাঁচের বাটিতে শুকনো চিংড়ির মধ্যে পড়ল কাঁচালঙ্কা, পিঁয়াজ কুচি, পোস্তদানা, লঙ্কাগুঁড়ো, হলুদ আর বেসন। নুন দেওয়া থাকে এই মাছে তাই নো নুন। এবার হাতের যাদুতে আলগা করে চটকে নেওয়া সেই মিশ্রণ। তারপর ঠিক খাওয়ার আগেই চ্যাপ্টা আকারে ভেজে তুলে নেওয়া চাইনিজ ঘুষোচিংড়ির মুচমুচে বড়া। রাণীয়ার দাদু বলতেন কাদাচিংড়ি। এসব জামশেদপুরে মিলত না। মামাবাড়ির স্পেশ্যাল।

চালে ডালে সেদিন হঠাত করেই খিচুড়ি বসিয়ে দেওয়া দেখে খুশীতে ডগমগ হয়ে কুশল বলে ওঠে, ঘি আছে তো রে? মা কিন্তু গরম খিচুড়ির ওপর ঘি ছড়িয়ে দিত।
রাণীয়া হাসে। একবার দিয়েছি শুরুতে। আবার দেব সার্ভ করার সময়।  

খিচুড়ি খেতে খতে কুশল আইডিয়া দিল। তাহলে এটাও তো তোর বাংলার রান্না নিয়ে লড়িয়ে দিতেই পারিস। রাণীয়া ভাবে, পারে তো সে সবকিছুই কিন্তু আবারও সেই ভিডিও, মিঠির হিংসে? এসব ভাবলে আর কাজ করতে মন চায়না তার। কুশল বলে, এবারের এপিসোডের নাম দিস বরং ভোগের খিচুড়ি। তোর মামাবাড়ির জগদ্ধাত্রীপুজো নিয়ে খানিক হেজিয়ে দিস। অফবিট এপিসোড হবে কিন্তু।
রাণীয়ার চোখ চকচক করে ওঠে।
পরের দিনেই কুশল অফিস চলে গেলেই শুরু হয়ে যায় তার একলা মহলের ভিডিও রেকর্ডিং। সেই ডিজিটাল চ্যানেলের জন্য। সামনেই তো জগদ্ধাত্রী পুজো আসছে। ভালো আইডিয়া দিল কুশল।
রাণীয়া শুরু করে। তার নিজের লেখা একটা ছড়া দিয়ে।

“বৃষ্টি মানেই পিটারপ্যাটার বৃষ্টি মানে টুপটাপ
বৃষ্টি মানেই মায়ের হাতে ভুনি খিচুড়ির উত্তাপ।”  

আপনারা কী জানেন? খিচুড়ির সঙ্গে মোগল সম্রাট আকবরের কী সম্পর্ক?

একদিন আকবর বললেন, একজন মানুষ কি টাকার জন্য সব করতে পারে?
বীরবল বলল, আলবাত!
আকবর বললেন প্রমাণ করো তবে।

পরদিন বীরবল একজন হত দরিদ্র হা’ঘরে কে ডেকে আনল রাজার সামনে। অনতিদূরে একটি জলাশয়ে শীতে বরফাচ্ছন্ন প্রায়। “যদি সত্যিই তোমার অর্থের প্রয়োজন হয় তবে তবে তুমি সারারাত সেই জলাশয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে” শীর্ণ, দীর্ণ, পোষাকহীন লোকটিকে আকবর বললেন। দরিদ্র লোকটি নিরূপায়।খাদ্য নেই, বস্ত্র নেই সেই শীতে। অগত্যা সে সেই জলাশয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সারা রাত ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে পরদিন সে রাজার কাছ থেকে অর্থের আশায় দরবারে এল।

আকবর জিগেস করলেন, “এবার বল হে ঐ ঠান্ডায় কেমন করে সম্ভব হল তোমার শীত সহ্য করে দাঁড়িয়ে থাকা?”

লোকটি বলল,  মহারাজ ঐ দূরে একটা আলো দেখা যাচ্ছে, হয়ত সেই আলোর তাপেই ঠান্ডা সহ্য করে দাঁড়িয়ে ছিলাম।

আকবর বললেন, ওহ্! এই ব্যাপার? তাহলে তোমার আর পুরষ্কার পাওয়া হল না।  তুমি ঠকিয়েছ আমাকে। পুরষ্কার পাওয়া এতই সোজা?

গরীব লোকটি বিফল মনোরথ হয়ে খালি হাতে ফিরে গেল। বীরবল অনেক বোঝালেন আকবরকে কিন্তু তিনি শুনলেন না কোনো কথা।

দিন যায় মাস যায়, বীরবল আর আসেনা রাজার দরবারে। খোঁজ পাঠালে বীরবল জানাল তিনি খিচুড়ি রাঁধতে ব্যস্ত আছেন। তারপরেও যখন অনেকদিন কেটে গেল বীরবল আর আসেনা তখন আকবর নিজে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখলেন বীরবল নিজের ঘরে বসে খিচুড়ি বানাচ্ছে।  রাজা দেখলেন খিচুড়ির জোগাড় হয়েছে কিন্তু তা রান্নার জন্য তাপের ব্যাবস্থা এক মিটার দূরে।   আকবর বললেন, এটা কি তামাশা হচ্ছে? অতদূরে তাপ থাকলে এ জীবনে খিচুড়ি রান্না হবে?  তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি কি লোপ পেয়েছে বীরবল?

বীরবলের কোর্টে তখন বল। সে বলল, “অমন ঠান্ডার রাতে দূরের একটা আলোর তাপে যদি সেই দরিদ্র লোকটির শরীর তপ্ত হতে পারে তবে অত দূরে বসানো খিচুড়ির হাঁড়িও তো গরম হওয়া উচিত মহারাজ, তাই অপেক্ষায় আছি আমি”

আকবর নিজের ভুল বুঝতে পারলেন আর সেই দরিদ্র লোকটিকে ডেকে এনে স্বর্ণমুদ্রা পুরষ্কার দিলেন।

আভিধানিক অর্থ বলছে, খিচুড়ি হল ‘বৈসাদৃশ্যময় উপকরণে তৈরি মিশ্র খাদ্য।’ হচপচ আইডিয়া ছিল বুঝি খিচুড়ির জন্মলগ্নে। তা সে জগন্নাথদেবের দুর্লভ খিচুড়িতেও। তাই তার থেকেই জগাখিচুড়িরও জন্ম।

আলবেরুনী ভারততত্ত্বে যেমন খিচুড়ি প্রসঙ্গ এড়ায়নি তেমনি বাংলার মনসামঙ্গলে আছে পার্বতীকে ডাবের জল দিয়ে মুগডালের খিচুড়ি রান্নার ফরমায়েশ করছেন শিব।

‘আদা কাসন্দা দিয়া করিবা খিচুড়ি’ এটি মঙ্গলকাব্যের উক্তি।

সংস্কৃত শব্দ কৃশরান্ন বা  খিচ্চা, ইবন বতুতার কিশরি, মিশরীয় সৈন্যশিবিরের চটজলদি রান্না  কুশারি,  আর ভারতীয়দের কমফর্ট ফুড খিচুড়ি বা খিচরি যাই বলি না কেন  সবেতেই মধ্যমণি দুজনঃ চাল এবং ডাল।  তারপর এশিয়ার নানান রসুইঘরে রবীন্দ্রগানের মত হয়েছে খিচুড়ির ইম্প্রোভাইজেশন। চাল ডালের মধ্যে মাংস পড়েছে। সব্জী পড়েছে।
এই যেমন আজ বাংলাভাষা খিচুড়িভাষায় পরিণত হচ্ছে কালে কালে। বাঙালীদের সবেতেই কথায় কথায় একটা খিচুড়ি পাকানোর অভ্যেস যেন গেলই না, এমনটিও শুনে আসছি তবুও আজ আমার ডালাসের রান্নাঘরে খিচুড়ি রেঁধেই ফেললাম। একেবারে নিরামিষ ভোগের খিচুড়ি। সামনেই জগদ্ধাত্রী পুজো আসছে। সেই কথা মাথায় রেখে। আপনাদের সবার জন্য। আবার দেখা হবে। হ্যাপি কুকিং!  

খিচুড়ির ভিডিও তুলেই রাণীয়ার একলা মহলে মনে পড়ল মিঠির কথা। দিদির আবার ডিমের অমলেট ছাড়া খিচুড়ি রুচত না। অনসূয়া একদিন প্রত্যেকের জন্য গোটা গোটা হাঁসের ডিম ভেজে খিচুড়ির মধ্যে ফেলে দিয়েছিলেন।
শুরুতেই মিঠির আবদার ” মা আজ অমলেট নেই খিচুড়ির সঙ্গে?“
মা বলেছিলেন, “সারপ্রাইজ আছে”
রাণীয়া গরম খিচুড়ির মধ্যে থেকে একটা ধূমায়িত সেদ্ধ গোটা ডিম পেয়ে খুব খুশি হয়েছিল সেদিন। কিন্তু মিঠি হয়নি। সে বাধ্য করেছিল মা’কে অমলেট বানাতে।
বড় মেয়েটা কে কী অনসূয়া আর তপন বাবু একটু বেশীই প্যাম্পার করতেন ছোটো থেকেই? রাণীয়ার এই দোলাচল যেন কিছুতেই কাটতে চায়না আজকাল। তার দিদির গ্রুমিংয়ের পেছনে বাবামায়েরও অনেক দোষ আছে। নয়ত কেন এমন হবে?

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত