ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-৩৩) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
ভ্রমণের সেদিন এদিন
মাঝে মাঝে আপনার আমার সকলের মনে হয় এই বাস্তবের রোদ ঝলমল শহর থেকে অন্য কোথাও চলে যাই। এই সংসারের তেল,জল মুদীর দোকানের সংস্পর্শ এড়িয়ে ঘুরে বেড়াই এদিক ,সেদিক। প্রয়োজনের ঘেরাটোপে ঘেরা এই জগৎ আর তখন ধরে রাখতে পারেনা।
আমার নিজের ছোটবেলা থেকে বড়বেলার বেশিরভাগ বেড়ানোই আমার বাবার হাত ধরে। বাবা ছিলেন একদম সাধারণ পরিবারের অনেক ভাইবোনের একজন। খুব কষ্ট করে বড় হয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের সব রকমের আনন্দের যোগান দিয়েছিলেন হাসিমুখে। পুরী আর ভুবনেশ্বরে প্রথম যাওয়ার কথা আজো মনে পড়ে। তখন খুব ছোট। মনে আছে আমরা তিন বোন,বাবা, মা আর আমার এক মাসতুতো দিদি গিয়ে উঠলাম ভুবনেশ্বরের এক ধর্মশালায়। সেখানে স্টোভ জ্বালিয়ে মাটির হাঁড়িতে রান্নার ব্যবস্থা হল। নিরামিষ রান্না,আর মাটির হাঁড়িকুঁড়ির কথাটা ভুলিনি। কেননা মাটির হাঁড়িকুঁড়ির ব্যাপারটায় নতুনত্ব ছিল। আর নিরামিষ আমি একদম খেতে চাইতাম না।মনে আছে ধর্মশালার বিরাট ঘর আর টানা বারান্দার কথা।
তারপরে পুরী-র বিশাল সমুদ্র আর জগন্নাথ মন্দিরের গর্ভগৃহের অন্ধকার বড় আশ্চর্য করেছিল আমাকে। ট্রেন থেকে নেমে রিক্সায় যেতে যেতে খালি মনে হচ্ছিল “সমুদ্র কই” তার আভাসটুকুও আসছে না কেন? তারপরে শেষের একটা মোড় ঘুরতেই প্রচন্ড এক বিস্ময়ের ধাক্কা লেগেছিল মনের মধ্যে। বিশালতার মাপ ছাড়িয়ে এ কে? জল শুধু জল,নদীর মত পাড় দেখা যায়না। ঢেউ শুধু ঢেউ, শেষ নেই। হাতে গোনা যায়না। আমার মনে ‘অসীম’ শব্দটার প্রথম ধারণা আসে সমুদ্র দেখে।
আরো পড়ুন: খোলা দরজা (পর্ব-৩২) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
তারপরে কতবার পুরী গেছি,বাঙালিরা চট্ করে বেড়াতে গেলে পুরীতেই যায় তো। একই সঙ্গে ধর্ম আর অসীম সুন্দরের এমন মেলবন্ধন আর কোথায় পাওয়া যাবে। সেই বিস্ময় একই রকম রয়েছে।
ছোটবেলার একটা ছবিতে দেখেছি পুরী-র সমুদ্রের ধারের বালির ওপরে দাঁড়িয়ে আছি। হাতে বালি আর পায়ের কাছে বালির প্রান্তর,আর আমার ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে আমার সেই মাসতুতো দিদি শঙ্করীদি। আবছা আবছা কিছু সুখস্মৃতি মনে আছে। সমুদ্রের ধারে একটা পুরনো বাড়ি, যেখানে শুধু আমরাই থাকি। বাড়ির ছাদে ভর্তি বালি।তাতে পা ডুবিয়ে আমরা এক্কাদোক্কা খেলি। রোজ ভোর হলেই সমুদ্রের ধারে ছুটে চলে যাই,কখনো জলে পা ডোবাই।কখনও বালির মন্দির গড়ি।
রোজ নানা রকমের মাছ খাওয়া হয় । ছোট মাছ ভাজা খাওয়ার কথা এখনও বিতৃষ্ণাসহ মনে আছে। সামুদ্রিক মাছের সেই আঁষটে গন্ধ!তাছাড়া কোনকালেই বা ছোটরা মাছ খেতে চায়?
জগন্নাথ ,বলরাম,সুভদ্রার বেদীর পেছনের ঘন অন্ধকার আর গভীর এক কুয়োর স্মৃতি মনের মধ্যে এখনও গেঁথে আছে।
এখনকার ছোটরা আমাদের মত বেড়াতে যায়না। তাদের আরামের জন্য বড়রা গুছিয়ে সুব্যবস্থা করেন।আমাদের ব্যবস্থা ছিল অন্যরকম।বিরাট লটবহর নিয়ে চল। বিছানার বেডিং,প্রয়োজনীয় মাল মশলা, জামাকাপড় সমেত ট্রাংক যেত সঙ্গে। স্টেশনে কুলীর মাথায় মাল চাপিয়ে বাবা তার পেছন পেছন দৌড়তেন। আর আমরা ভাইবোনেরা, মা সমেত অতিকষ্টে তাকে অনুসরণ করতাম। না যানবাহন,না বাসস্থান, কোথাও কোন সংরক্ষণে র বালাই ছিল না।
আসলে কটা লোকই বা শুধু বেড়াতে যেত। লোকে ধর্মের জন্য যেত তীর্থ করতে।হাওয়া বদল করতে যেত অসুস্থ শরীরে। কিংবা নেহাতই দরকারে বা জীবিকার কারণে পথে বেরোত। তবে আমার বাবার মত অনেক বাবা তাদের সামান্য সম্বল আর অসামান্য ইচ্ছেটুকু নিয়ে পরিবারকে সঙ্গে করে একটু আনন্দের সন্ধানে পথে বেরিয়ে পড়তেন। আর তখন হঠাৎ করেই সেইসব পরিবারের ছোটদের ভূগোল বই এর পাতাগুলো জীবন্ত হয়ে উঠত। প্রকৃতির নানা রঙ,রূপের মাধুরী ধরা দিত তাদের অন্দরের বিশ্বলোকে।
সেসময় সামান্য কিছু অর্থ নিয়ে মহিলাদের কেদারনাথ, বদ্রীনাথে তীর্থ করতে যেতে দেখেছি। অক্লান্ত পরিশ্রমের ধকল নিয়ে তারা যখন ফিরতেন, তখন তাদের পা ফেটে হয়ত ফুটিফাটা, চেহারায় ঠিকমতো না খেতে পাওয়ার জীর্ণ শীর্ণ ভাব।কিন্তু মুখে তৃপ্তির হাসি।ছোট ছোট পুঁটুলিতে না খেয়ে কষ্ট করে সঞ্চিত অর্থে কেনা পাথরের হার, পেতলের পানদানি, হাল্কা ফুলকা পশমের পোশাক, বাহারি নাগরা জুতো। তাদের আনা প্যাঁড়ার প্রসাদ পেত আত্মীয়স্বজন আর প্রতিবেশীরা। কষ্টার্জিত সেই অমৃতের স্বাদ আমিও পেয়েছি। তখন মধ্যবিত্তের জীবনে নিছক ভ্রমণ, এনে দিত এক আকাশ আনন্দ। যার পেছনের কালো কালো কষ্টের স্মৃতিকে তারা তখন একেবারে মনে আনতেন না।
ঐতিহ্যময় শহর চন্দননগরের স্থায়ী বাসিন্দা সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতক।১৯৯৬ সালে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়’দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকায়।২০০১ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।‘আনন্দবাজার’, ‘বর্তমান’, ‘আজকাল’, ‘প্রতিদিন’, ‘তথ্যকেন্দ্র’, ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’ ছাড়াও, ‘অনুষ্টুপ’, ‘কুঠার’, ‘এবং মুশায়ারা’-র মতো বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনেও তার কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রকাশের ধারা অব্যাহত। প্রকাশিত উপন্যাস পাঁচটি, গল্পগ্রন্থ চারটি, এবং কবিতার বই একটি।