প্রবুদ্ধসুন্দর করের গুচ্ছ কবিতা
ভাঁড়
“জতুগৃহ থেকে যারা কখনোই পালাতে পারে না
পালাতে না পেরে যারা প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে
আড়মোড়া ভাঙে, হাই তোলে, দাঁত মাজে
বাথরুমে গান গায়, তারিয়ে সাবান মাখে রোজ
আবারও দপ্তরে ছোটে, টেবিল বাজায়
বেতনবৈষম্য নিয়ে জোর তর্ক করে
বিকেলে রাস্তায় হাঁটে, আড়চোখে মেয়েদের দেখে
জন্মনিরোধক আর বেবিফুড কিনে বাড়ি ফেরে
সেইসব সংখ্যালঘু অর্ধদগ্ধ ভাঁড়
তাদের গোপন আড্ডা থেকে আমাকেও চিঠি লেখে
তীব্র হাহাকার আর গোঙানি মেশানো
সেইসব চিঠি পড়ে,উত্তর না লিখে আজও চুপ করে থাকি
আমার মৌনতাহেতু, সম্ভবত, তাদের ধারণা
জতুগৃহ থেকে তবে আমিও পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি।”
রেডিয়ো স্টেশন
জঙ্গলের ভেতর কোথাও পরিত্যক্ত এক রেডিয়ো স্টেশন
কোনও একদিন খুঁজে পেলে জেনো, স্তব্ধতাই এর সিগনেচার টিউন
নৈঃশব্দ্য ব্যতীত, হাহাকার, বিলাপ, অশ্রুপাতের ধারাবিবরণী
২৩৬.৪ মিটারব্যান্ড তথা ১২৬৯ কিলোহার্টজে প্রচারিত হয়নি কখনও
অধিবেশনের শুরুতে বা শেষে ঘোষিত হয়নি স্টেশনের নাম
জঙ্গলের ভেতর কোথাও স্তব্ধতার সিগনেচার টিউন শুনতে পেলে
জেনো, আত্মকণ্ডূয়নমুগ্ধ এই স্টেশনের ধ্বংসাবশেষই আকাশবাণী প্রবুদ্ধসুন্দর।
স্যানাটোরিয়াম
স্তব্ধতার প্রতিধ্বনি এসে টোকা দিলে রাতারাতি
রুকস্যাক গুছিয়ে বেরিয়ে পড়তে হয় হিলসের পথে।
নক্ষত্র যেভাবে হাতে ধরে অন্ধ নাবিককে গন্তব্যে পৌঁছায়
সাদা অ্যাপ্রনের মেঘও তেমনি তোমাকে নিয়ে যাবে
স্যানাটোরিয়ামে। পথের বাঁকেই পাথর ফাটিয়ে নেমে-আসা
প্লবঙ্গ ঝর্ণায় পূর্ত পাপ ধুয়ে নিয়ে ঊঠে যেয়ো
সর্বোচ্চ শৃঙ্গের দিকে। সবুজ ট্রাপিজ থেকে ঝুলে-পড়া বৃষ্টি
সহসা ভিজিয়ে দিলে তোমাকে আশ্রয় দেবে পাহাড়ি বাজার
মাতৃতান্ত্রিক দোকানে বসে চা-র কাপে ঠোঁট রেখে আড়চোখে
দেখে নিয়ো মিজো যুবতির গালে প্লামের লালিমা।
অসুস্থ শহর থেকে আরোগ্যের লোভে তুমি পাহাড়ে এসেছ
নিসর্গ, স্তব্ধতা, সাদা অ্যাপ্রনের মেঘ আর সান্ধ্য গির্জা থেকে
ভেসে-আসা ড্রাম আর গিটারের ধ্বনি তোমাকে আরোগ্য দেবে
তোমার ঔষধি আছে মিজো যুবতির পরায়ণ হাসি ও লাবণ্যে
যদিও যৌনতা নিয়ে ট্যাবু নেই কোনো, তবু সম্মোহিত প্রেমিকের মতো
মৌন সমর্পণ নিয়ো। পার্সের পকেটে কন্ডোম নিয়ো না।
ঝুঁকি
এতদিন যাকে দেখা গেল, সে আমার ডামি
এতদিন আমার হয়ে সে আগুনের ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়েছে
এক শূন্যতা থেকে ভল্ট খেয়ে ছিটকে পড়েছে আরেক শূন্যতায়
ঘুমের ভেতর সমুদ্রস্বপ্ন আর বোবাধ্বনির ভার নিয়ে মধ্যরাতে সে জেগে উঠেছে
যে পাতার আড়ালে কুয়াশার চেয়ে অস্পষ্ট মেয়েরা পদ্ম ফোটায়
সেই পাতার ওপর অস্থির জলবিন্দু হয়ে অমাকে সে এতদিন আড়ালে রেখেছে
আজ থেকে ডামি সরিয়ে সম্পূর্ণ ঝুঁকি নিতে চাই।
নিজেকে লেখা চিঠি
পরমপিতা তোমাকে রেখেছে কুশলে, আশা করি
ছত্রিশ্ ছত্রাকে গেঁজে ওঠা এই অকবিজীবন
আজকাল বড়ো টকটক লাগে, আরো নুন চাই।
বিবাহলেবুর রসে প্রেম প্রেম হ্যাং-ওভার আমারও কেটেছে
আগ্নেয়াস্ত্র ভেবে আমি এতদিন পেটে গুঁজে বেড়িয়েছি পাতি টয়গান
যা দিয়ে নিদেনপক্ষে ছত্রভঙ্গ করা চলে পায়রামহল।
অস্ত্রসমর্পণশেষে যে পুনর্বাসন হায় উঁকিঝুকি দিল
দাম্পত্যরগড় আর বিমাপ্রিমিয়াম।
মুখ্যমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে মূলস্রোতে গুঁড়ি মেরে থাকি
সমিতিসদস্যপত্র রিনিউ করেছি
ধর্মজিরাফের মতো নিরামিষ খাই।
মহার্ঘভাতার সঙ্গে কালেভদ্রে দেখা হয়ে গেলে
চোখ টিপি, শিক্ষকের আচরণবিধি থেকে ঈষৎ দূরত্বে বসে নেশা করি
বড়োজোর তিন পেগ, বেশি জলে সামান্য বারুণী।
সমবায় ব্যাংকের বোলানো পালকে রোমহর্ষ হলে টের পাই
একদিন আমাকেও সংবর্ধনাসহ জাতির অঙ্গুরীমাল হয়ে যেতে হবে।
চকখড়ি, ব্ল্যাকবোর্ড, সাবরুটিনের ঘেরাটোপ থেকে পালাবার আগে
গ্রীষ্মের ছুটিতে তাই তোমাকেই লিখি।
ডাকবাক্স যদি চিঠি প্রত্যাখ্যান করে
সমাসের ব্যাসবাক্য যদি মনে থাকে, তবে জেনো
প্রবুদ্ধসুন্দর মরে আনালে বিনালে
প্রবুদ্ধসুন্দর পোড়ে তীব্র ঋণানলে।
ফেরা
প্রতিটি ফেরার দৃশ্য স্তব্ধতাখচিত
তোমার অর্ধনমিত মুখে রাষ্ট্রীয় শোকের ছায়া
দিকে দিকে রাষ্ট্র হবে, এই ভয়ে, এ দৃশ্যের কথা কাউকে বলিনি
অসহায় এই ফেরা, স্তব্ধতার তোলপাড়, তবু টের পেয়েছিল
ঝোপজঙ্গল, পাহাড়ি বাক, মেঘ আর নেশাগোধূলির চাঁদ
আলো
সন্ধ্যা নেমে এলে সমূহ মনোবেদনা নিয়ে জ্বলে ওঠে একটি নক্ষত্র
বিষাদস্পৃষ্ট তোমার মুখ
কোনও একদিন যদি স্পষ্ট হয়ে ওঠে
বোঝা যাবে, সেই নক্ষত্রের আলো
পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছে, সামান্য আগে।
আরো পড়ুন: প্রবুদ্ধসুন্দর কর-এর একগুচ্ছ
গতিপথ
লামডিং-এ নদী নেই? আছে। যেন অপ্রস্তুত চোখে অতর্কিত
এ প্রশ্নের দিকে সামান্য তাকিয়েছিলে।
নাম জান?
সাদা বালি, নুড়ি ও পাথরে বুক ঘষে ঘষে ক্রমশ যে নদী
পাখিদের আত্মহত্যা, অম্বালিকা ফাংলোর প্রণয়, ব্ল্যাক উইডো, নিষিদ্ধ লাউপানি
আর টানেল পেছনে রেখে মাহুর পেরিয়ে তোমার রিডের দিকে বয়ে গেছে
তার শীর্ণতা, বিস্মৃতপ্রায় নজরুলগীতির মতো।
তীব্র হাহাকার বুকে চেপে শুশ্রূষাবহ তোমার
গায়কির কাছে সে এসেছে। তার পায়ে পায়ে আমি
নিরাময়শেষে, খরস্রোত নিয়ে হয়তো সে বাঁক নেবে নাগাপাহাড়ের দিকে
আমার আরোগ্য নেই। আমৃত্যু শুশ্রূষালোভী হয়ে
তোমার ত্রিসন্ধ্যা আর হারমোনিয়মের আশ্রয়ে তবে থেকে যাই?
ছায়া
দু-চোখ মোমের শিখা, তাই
কালি পড়ে রাত-জাগা দু-চোখের কোলে
আমাকে এ আলো ভেদ করে না বলেই
এই ছায়া, অনচ্ছ অবগ্রহের মৃত্যুপূর্ব অসুস্থকালিমা।
জ্যোতিষবচন
আপনার শত্রু আর কেউ নয়, আপনি নিজেই
যুক্তি, তর্ক ও মন্তব্য এড়িয়ে চলুন।
ঈর্ষাপরায়ণ বামনেরা মাঝে মাঝে সিটি দেবে
উত্তেজিত হবেন না
মুখ্যমন্ত্রীকে দেখুন, নিন্দা ও প্রশংসা দুটোতেই নির্বিকার।
নির্জনতা ছাড়া কোনও কিছুই সম্ভব নয়
লেখালেখি, চুম্বন, আত্মসমীক্ষা, ধ্যান, এমনকি খুনও
মনে রাখবেন, কোলাহল হলাহল।
যে পা-গুলো এতদিন প্রণামের যোগ্য বলে মনে হয়েছিল
সেগুলো শয়তানের খুর হয়ে আরও স্পষ্ট হবে।
শিবির বিপজ্জনক, নিরাপদ দূরত্বে থাকুন
অত্যুত্সাহ কিংবা বিরোধিতা একদম নয়
বিদ্যুৎ আগুন, জল, শস্ত্র থেকে সাবধান।
বিষম রাশির জাতক আপনি, প্রতিকারহীন
প্রবাল, সিংহলি মুক্তা, পোখরাজ, বার্মিজ গোমেদ
কোনও কিছুই আপনার কাজে আসবে না
বরং ব্রাহ্মণ গ্রহাচার্যকে দারুহরিদ্রা দান করে প্রণাম করুন।
মনে রাখবেন, প্রণাম এমন এক শক্তি
শয়তান তো বটেই, প্রণামের মুহূর্তে শত্রুও
আপনাকে আশীর্বাদ না করে পারবে না।
পরজন্ম
অমৃতের মাদকতা রক্তে মিশে আছে
টলমল করে ওঠে সমস্ত শরীর
পথেও বিপথে ঘুরে খানাখন্দে পড়ি
যেন তীব্র ক্ষুধায় আকন্দপাতা খেয়ে
স্বেচ্ছা-অন্ধ হয়েছি দেবতাদের দেশে।
পরজন্ম বলে যদি সত্যি কিছু হয়
সমুদ্রমন্থন শেষে রাহুর কবন্ধ আমি
অমরত্ব নয়, চাই, চাঁদের প্রণয়।
শাশ্বতী
অগ্রহায়ণের আলো সূর্যাস্তজটিল
রাত্রি ও কুয়াশা তাই অতিবৈবাহিক
যে-কুহক আমাকেও করেছে শরিক
রোমশ জড়ুল নয়, সূচ্যগ্র সে তিল
যদি বিনাযুদ্ধে চাই সন্ধিপত্র মেনে
অস্থির পুরুষকার, মূঢ়, তবে বলো
জটিল সূর্যাস্তশেষে অস্ত্রের ধারালো
নীরবতা কীভাবে মিশেছে রক্তে, নুনে
পৌত্তলিক তার দুঃসাহসের ভেতর
অপরিমেয় সমুদ্র হয়ে শুয়ে থেকে
প্রশস্ত বালিতে, ঢেউয়ের ব্রেলে লিখে
রাখি গলনকাহিনি, তেমন কাতর
ছিলেন সুধীন্দ্রনাথ, সেই সূত্রে আমি
নিজেকে জেনেছি দ্বিধাথরথর মমি ।
হারমোনিয়ম
The sly reeds whisper to the nights—
–James Joyce
এক.
আমাদের বংশের প্রাণস্বরূপ এই হারমোনিয়ম
ভেতরে চিরহরিৎ অরণ্যঅঞ্চল। দিনে
বেলোর পাঁচটি ছিদ্র দিয়ে অনর্গল
অক্সিজেন বেরোতেই থাকে। তাই পৃথিবীর যাবতীয় গাছ
আমাদের কাছে ডামি।
আমিও আত্মহত্যাপ্রবণ। কোনও কোনও পূর্ণিমায়
হারমোনিয়মটিকে শিয়রে রাখি।
বেলোর ছিদ্রগুলির দিকে মুখ রেখে নিদ্রা যাই।
দুই.
হারমোনিয়মের বেলোতে সব মিলিয়ে পাঁচটি ছিদ্র
উপরে তিনটি, নিচে দুটো।
উপরের ছিদ্র ক্ষিতি, অপ, তেজ
নিচে মরুৎ ও ব্যোম।
বাবার ধারণা, পূর্বপুরুষদের আত্মা
এই হারমোনিয়মের ভেতর লীন হয়ে আছে ।
তিন.
বেলোর গায়ে যে ছিদ্রটি বাবার ভাষায় ক্ষিতি
আমি সেই ছিদ্রটিকে কাম বলি।
এভাবে অপকে ক্রোধ ও তেজকে লোভ
মরুৎকে মদ ও ব্যোমকে মোহ
যদিও রিপুপ্রবণ আমার মাৎসর্য নেই
তাই, বেলোর শরীরে গোপনে আরেকটি
ছিদ্র রেখে যেতে চাই।
চার.
পূর্বপুরুষদের চক্ষুদানপত্র মেনে
তাদের মৃত্যুর পর, এক একটি চোখ দিয়ে তৈরি
হারমোনিয়মের প্রতিটি রিড
শুদ্ধ ও কোমল।
ছোটোবোন রিডে আঙুল ছোঁয়ালে ত্রিসন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে
আমি তো জন্মান্ধ। গান গাই
যে গান অন্ধের যষ্টি —-
হুমায়ুননামা
মৃতের নামের আগে যে চন্দ্রবিন্দুটি বসানোর রীতি
সেই চন্দ্রবিন্দু ঈশ্বরপ্রতীক
আমাদের ইতিহাসে হুমায়ুনের প্রার্থনা নেই
তাই তার গোটা আয়ুষ্কালই অভিশপ্ত একটি মৃত্যুশিয়র
যে-শিয়রে অপত্যতাড়িত এক দিকভ্রান্ত পিতা
রাত জেগে বসে থাকে, আর, ভিক্ষুকের মতো পূর্বে ও পশ্চিমে
দুই করতল পেতে পুত্রের আরোগ্য চায়।
আমাদের ইতিহাসে নেই হুমায়ুনের প্রর্থনা
তাই, পিতার যকৃৎ চেপে বসে কর্কটের দাঁড়া
অসহায় হুমায়ুনও জন্মজানুকাটা বলে প্রর্থনা-অযোগ্য।
তহশিল কাছাড়িতে আমার পিতার নথিভুক্ত নাম চন্দ্রবিন্দু হরিপদ কর
কুলাঙ্গার পুত্র আমি, আর, পিতা আমার ঈশ্বর জহিরউদ্দিন মহম্মদ বাবর।
হেমন্তসম্ভব
আর আমাকে বিষণ্ণ কোরো না হেমন্তকাল
না-লেখার অভ্যাস আমাকে গিলে ফেলছে ক্রমশ
একেকটা দিন ধ্বনি হয়ে পাহাড়ের দিকে গিয়ে
মরা আলো ও কুয়াশা মেখে প্রতিধ্বনি
গোধূলির ফাঁদ হয়ে ফিরে আসে রোজ
পা দিলেই ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসে
মনখারাপের বিষ মাখানো অব্যর্থ অজস্র তিরের ফলা।
না-লেখার অভ্যাস, আমাকে অস্থির কোরো না আর
প্রেম আর নুন-চাপা একেকটি অস্থিরতা থেকে
মুখভর্তি রক্ত উঠে আসে।
তোমাকে লিখতে বা মুছে ফেলতে গিয়ে হেমন্তসম্ভব
নিজেরই অজান্তে একটি জোঁকের মৃত্যুদৃশ্য উপমেয় হল।
দরজা
যে তোমাকে ছেড়ে যেতে চায়
তাকে যেতে দাও
আটকে রেখো না।
একটি কথাও না বলে তার
ব্রিফকেস গোছাতে সাহায্য করো।
প্রেসার বা থায়রয়েডের ওষুধ সে যেন
ভুল করে ফেলে না যায়। শূন্যতা ছাড়া
সে যেন ছেড়ে না যায় আর কোনো স্মৃতি।
অশ্রুগ্রন্থি থেকে যেন বেরিয়ে না আসে সূচ্যগ্র তরল
ঘুণাক্ষরেও তোমার মুখে যেন জলবসন্তের মতো
আর্তি আর হাহাকার ফুটে না ওঠে।
শুধু এগিয়ে দেওয়ার পথে নীচু স্বরে বোলো
দরজা ভেজানো থাকবে
টোকা দেওয়ার দরকার নেই।
আলতো ঠেলে দিলেই কপাট খুলে যাবে।
গাইড
দেখুন, এই যে রাজবাড়ি। উজ্জ্বয়ন্ত প্রাসাদ। এখন বিধানসভা ভবন।
এই জোড়া দিঘি, বাঁয়ে জগন্নাথ জিউর মন্দির।
লক্ষীনারায়ণবাড়ি। ডানে আনন্দময়ী আশ্রম।
এই যে স্পোর্টস কমপ্লেক্স দেখছেন
এখানে রাজার আস্তাবল ছিল। ঘোড়া ছিল। ছিল হ্রেষা ও সহিস।
এখন তো আগরতলা খচ্চরে ভরে গেছে
কী বললেন? হ্রেষা? ওহো, এককথায় প্রকাশ পড়েননি?
সেই যে ব্যাঙের ডাক মকমকি। ময়ূরের ডাক কেকা।
কুকুরের ডাক বুক্কণ। হাতির বৃংহন।
তেমনি ঘোড়ার ডাক হচ্ছে হ্রেষা।
তবে খচ্চরের ডাককে এককথায় কী বলা হয়
তা অবশ্য আমাদের বাংলা ব্যাকরণে নেই।
উদাহরণ
ভাদুঘর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে ভৈরববাজার
শুনেছি, বাবার দৌড় এটুকুই ছিল।
আমি ঢাকা অব্দি গেছি
বাবাকে পেরিয়ে যাওয়ার উদাহরণ
এ জীবনে আর কিছু নেই।
নাভি
অবিনশ্বর ভেবেছি এতদিন যেসব লেখাকে
সেইসব লেখালেখি থেকে আজ ভেসে চাপা হরিধ্বনি।
যাদের হাততালিতে প্রেক্ষাগৃহ ফেটে পড়েছিল
তাদের বিদগ্ধ মুখ শ্মশানবন্ধুর মতো অভিব্যক্তিহীন।
পাট্টাকোলাহল ছেড়ে উঠে আসে ডোম
একমাত্র সে-ই জানে, নাভি পুড়ে ছাই হতে অনেক সময় নেয়।
–আগুনে পোড়ে না নাভি, বাবু, শ্রম ও সময় বাঁচাতে
এইটুকু মিথ্যে ছাই বাতাসে উড়িয়ে মাতাল ডোমেরা
চিতার আলোয়, আড়চোখে মেপে নেয় বিশ্বাসযোগ্যতা।
আমাদের লেখালেখি, ডোমপ্রচারিত সেই গুজবের নাভি।
ফলক
আসাম-আগরতলা রোডে পাহাড়ি রাস্তার বাঁকে
পাথরের ফলকের গায়ে একটি লেখা চোখে পড়ে—
বি জেন্টল অ্যাট মাই কার্ভ। বিস্ময়ে রোমাঞ্চ জাগে
যেন পথ সর্পিল রমণী, গাড়িচালকের কানে
মুখ এনে চাপাস্বরে অসহায় আর্তিটুকু রাখে
—আমার শরীরী বাঁকে হে পুরুষ, ভদ্র হয়ে ওঠো।
সঙ্গমে বন্যতা নয়, নারী চায় দিব্য কোমলতা
মদ ও মাংস মিশিয়ে হে পুরুষ, হে গাড়িচালক
রাগমোচনের আগে ডেকে এনো না শীঘ্রপতন।
পাহাড়ি রাস্তার বাঁকে পাথরের ফলকের গায়ে
স্মরণযোগ্য পঙ্ক্তির মতো ইঙ্গিতবহ এ আর্তি
কে লিখেছে জানা নেই, শুধু তাঁর কবিপ্রতিভাকে
ঝিঁঝিঁ-ডাকা নির্জনতায় প্রণাম করে যেতে হয়।
