| 25 এপ্রিল 2024
Categories
গদ্য সাহিত্য

স্মরণ: তুমিও ঠিক করলে না প্রবুদ্ধ দা । শৌনক দত্ত

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

এই লেখাটি এই অসময়ে লিখতে হবে ভাবিনি। খবরটা পাবার পর থেকে ঘিরে ধরেছে অসংখ্য মুহূর্ত। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে প্রবুদ্ধদা (কবি প্রবুদ্ধসুন্দর কর) নেই। গত শতাব্দীর নয়ের দশকে লিখতে এসেছিলেন প্রবুদ্ধসুন্দর কর । জমিল সৈয়দ সম্পাদিত ‘রমেন্দ্রকুমার থেকে প্রবুদ্ধসুন্দর’, বাংলা কবিতার এই সংকলনই তাকে প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিল। এযাবত প্রকাশিত হয়েছে আটটি কবিতার বই। সম্পাদনা করেছেন উত্তরপূর্বের তরুণ কবিদের শ্রেষ্ঠ বাংলা কবিতার সংকলন। যৌথ সম্পাদনা করেছেন উত্তরপূর্বের কবিতা। নয়ের দশকে প্রকাশিত ‘বাংলাকবিতা’-র ১০টি সংখ্যার যৌথ সম্পাদক ছিলেন। অনুবাদ করেছেন ভারতবর্ষের প্রাদেশিক অন্যান্য ভাষার সমকালীন কবিতা। প্রবুদ্ধসুন্দর কর এইসব পরিচিতির বাইরে অসম্ভব ভালো একজন  মানুষ। বাইরে থেকে প্রবুদ্ধদা কে দেখলে যতটা কঠিন বা রাগী মনে হতো যারা এই মানুষটার সাথে মিশেছে তারা জানেন মানুষটা ভিতর ভিতর ততটাই শিশুর মতো সরল।

এই পৃথিবীতে প্রবুদ্ধদার তো বেঁচে থাকার কথাই ছিল না অনেকবার। জন্মমুহূর্ত থেকেই প্রবল বিপত্তি। উল্টো হয়ে জন্মেছিল। পা বেরিয়ে এসেছিল আগে। ৭২ ঘণ্টা কেটে গেলে ডাক্তারসহ সবাই নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। এক বছর বয়েসে নিমোনিয়া। বয়স যখন দুই, অমরপুর যাওয়ার পথে গোটা জিপগাড়িটাই উল্টে গেল। সেই অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেলেন গায়ক সুদীপ্তশেখর মিশ্রের বাবা শুভ্রাংশুশেখর মিশ্র। শুভ্রাংশুশেখর মিশ্রর (প্রবুদ্ধদা মিশ্র জেঠু ডাকত) হাতেই স্টিয়ারিং ছিল। সেই গাড়িতে ছিল প্রবুদ্ধদার বাবা মা,সবাই ভেবেছিলে সামনের সিটে বসা প্রবুদ্ধদা আর নেই। অবিশ্বাস্য, আঘাতের কোনো চিহ্নই ছিল না তাঁর শরীরে। তবে সেই দুর্ঘটনা প্রবুদ্ধদার স্মৃতিতে ফেড রিল হয়ে ছিল। চোখ বুঁজলেই নাকি সৌম্যকান্তি মিশ্রজেঠুর কপাল বেয়ে নেমে আসা রক্তধারা দেখতে পেত। গত অনেক মৃত্যুর মতোই আজকের খবরটাও কি মিথ্যা হতে পারে না? কেউ একটা স্টেটাসে লিখতে পারেননা প্রবুদ্ধ দা অবিশ্বাস্যভাবে বেঁচে আছে। পল্লব দা,অশোক দা, প্রদীপ দা কিংবা সরকার আমিন দা?


আরো পড়ুন: প্রবুদ্ধসুন্দর কর-এর একগুচ্ছ


পারিবারিক ধর্মীয় বাতাবরণে প্রবুদ্ধদার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে। সকাল-সন্ধে প্রার্থনা। উপাসনা। কীর্তনাদি। সেই সূত্রে আজন্ম নিরামিশাষী। খুব কম বয়সে মায়ের কাছেই তাঁর হাতেখড়ি। তিন বছর বয়সে বই বা ম্যাগাজিন টানা পড়তে শিখেছিল। মাসিমা ( প্রবুদ্ধদার মা) ছিলেন ইংরেজি ও সংস্কৃত সাহিত্যের ছাত্রী। তৎকালীন শুদ্ধ বাংলা বানানরীতি প্রবুদ্ধদাকে মসিমা-ই শিখিয়েছিলেন। শিশুসাহিত্য পাঠের পোকা সেই তিন বছর বয়স থেকে। মা ও ঠাকুমা প্রচুর গল্প শোনাতেন। মাসিমার আঙুল ধরে আশ্রমে যেত বিকেলে। বেড়াতে যেত আত্মীয়স্বজনদের বাড়ি। যার বাড়িই যেত, পাগলের মতো গল্পের বই খুঁজতে শুরু করে দিত। মাসিমাকে খুব ভয়ও পেত প্রবুদ্ধদা। আমার মেসো (প্রবুদ্ধদার বাবা) ছিলেন তাঁর ফ্রেন্ড-ফিলোসফার-গাইড। পারিবারিক ধর্মীয় রীতিনীতি ভালো লাগলেও কেন যেন মাঝে মাঝে খুব পালাতে ইচ্ছে করত তার। মাসিমাকে ঘুমে রেখে দরজার ছিটকিনি খুলে বন্ধুদের সঙ্গে দুপুরে খেলতে চলে যেত। প্রবুদ্ধদার কৈশোর কেটেছে ধলাই জেলার হালাহালিতে। ধলাই নদীতে স্নান, সহপাঠী বন্ধুদের সঙ্গে আদাড়ে বাদাড়ে ঘোরাঘুরি। তাঁর শৈশব ও কৈশোর, এক ঘ্রাণময় উপত্যকা।

কবিতায় প্রবুদ্ধদা কে চিনি নিরানব্বই সালের দিকে, সরাসরি দেখা ২০১১ সালে। সেবার প্রথম আমি ত্রিপুরা যাই রাঙাদা কবি সমরজিত সিংহ ও রাঙাদি কবি প্রীতি আচার্য এর সংসারে। তখন কবি দম্পতি বিলোনীয়ায় থাকতেন। কোচবিহার ফেরার আগে তিনদিন আমি প্রবুদ্ধদার বাড়িতে থেকেছি। সেই তিনটা দিন আজ কেবলই স্মৃতি। এরপর বহুবার কথা হয়েছে, যাবার পরিকল্পনা হয়েছে যাওয়া হয়নি, সেইদিনের ছোট্ট বিহু (প্রবুদ্ধদার একমাত্র মেয়ে)আজ  ডাক্তারী পড়ছে। এই তো কদিন আগে বিহুকে নিয়ে মনিপুর যাচ্ছে প্রবুদ্ধদা কথা হলো অনুযোগ ঝড়ে পড়ছিল তাঁর কন্ঠে ‘তোমার সাথে আর কথা নেই শৌনক সেই যে গেলে আসবো আসবো করে আর এলেনা।’

সেদিন হেসেছিলাম প্রবুদ্ধদার কথায় আজ  ঠিক এই লেখা লিখতে লিখতে বুঝতে পারছি সত্যিই খুব অন্যায় করেছি প্রবুদ্ধদা, আমার যাওয়াটা খুব জরুরি ছিল। কিন্তু তুমিও তো কথা রাখলেনা প্রবুদ্ধদা সেইবার নির্মানাধীন জিপসিদের তাঁবুতে আমাদের যে রাত জাগা হলো না। আমি আবার ত্রিপুরা গেলে কে আমাকে নিয়ে ঘুরবে কে শোনাবে ত্রিপুরার ইতিহাস? কে আর বাংলা সাহিত্যের নবীন প্রবীণ কবির নাম ধরে ধরে সেই কবির কবিতা কোড করে শোনাবে? জম্পুই পাহাড়ের গল্প কে বলবে আর? কে গৌহাটির ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা সাহিত্য নিয়ে আড্ডা দেবে? বরিশাল যাবার কথা ছিল তোমার সাথে, কথা ছিল ঢাকায় কবি সরকার আমিন আর কবি ও কথাসাহিত্যিক শাহনাজ মুন্নীর প্রশান্তিবাড়ি যাবো, যাওয়া হলো না তোমার সাথে। আর কোথাও যাওয়া হবেনা, দেখা হবে কথা হবে শুধু কবিতায় কিন্তু তুমিও ঠিক করলে না প্রবুদ্ধদা।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত