| 20 এপ্রিল 2024
Categories
ইরাবতী তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা

বিশেষ রচনা: প্রাগৈতিহাসিক শিকারী নারী: বাস্তব না অবাস্তব

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

দক্ষিণ পেরুর উইলেমায়া পাটিজেক্সা, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪০০০মিটার ওপরে। চলছে প্রত্নতাত্বিক অনুসন্ধানের কাজ প্রাগৈতিহাসিক যুগের এক কবরস্থানে। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফর্নিয়ার র‍্যানডাল হাস এবং তাঁর কিছু সহকর্মীর নেতৃত্বে। প্রায় ৯০০০ বছর আগের ছটি কবর পাওয়াগেছে পাশাপাশি।

আরে! শুধু কঙ্কাল তো নয়! তার সঙ্গে রয়েছে হরেক রকমের পাথরের অস্ত্রশস্ত্র। কী তাদের বাহার! 

একটা কঙ্কাল, দেখে মালুম হয় মারা যাবার সময় বছর আঠেরো বয়েস ছিল, তার সঙ্গেই রয়েছে বেশি সংখ্যক হাতিয়ার। কত রকমের বর্শার ফলা, চপারের মত অস্ত্র নানামাপের, একটা ছুরির মত জিনিস আর অনেকগুলো মসৃণ পাথরের ছাল ছাড়ানোর অস্ত্র।এই কঙ্কালের উরুর হাড়ের ওপর আবার রাখা গোটা কুড়ি ছোট ছোট পাথরের অস্ত্র, মনে হচ্ছে যেন ওগুলো ছিল কোন চামড়ার পাউচে। কালের করাল গ্রাসে চামড়া গলে মিশে গেছে মাটিতে! আর একটা কঙ্কালও এটার পাশেই পাওয়া গেল, কিন্তু তার সঙ্গেঅস্ত্র মাত্র দুটো। তার বয়েস মালুম হয় বছর তিরিশেক।

দলের সবাই এখন একমত যে এই অল্প বয়েসিটিই ছিল দলপতি।

চলল সে কঙ্কাল পরীক্ষার উদ্দেশ্যে।

কী খবর পাওয়া গেল পরীক্ষাগার থেকে?

বলব বৈকি! 

সে খবর নড়িয়ে দিল এতদিনের সব ধ্যান ধারণাকে! তার আগে একটু বলে নিই কী পরীক্ষা হল।

পরীক্ষা হল কঙ্কালের লিঙ্গ নির্ধারণের। কী করে সেটা একটু বলি। 

মানব জীবাশ্মকে স্ত্রী বা পুরুষ কোন দলে ফেলা হবে তার জন্যে একেবারে আধুনিক পদ্ধতি হল কঙ্কালের দাঁতের এনামেলের প্রোটিনের ধরণ বের করা। এই প্রোটিনের নাম অ্যামেলোজেনিন। পুরুষ নারী ভেদে এই প্রোটিনের আণবিক গঠন আলাদা আলাদা। 

পরীক্ষার ফল হাতে এল!

একী! এই টিনএজারটি একটি মেয়ে! আর পাশের কঙ্কালটি একটি যুবকের! 

এই অষ্টাদশীটিই তাহলে ছিল দলনেত্রী! শিকার করত! 

মেয়েরা! 

তা কী করে হয়!

এ যে “Man-The-Hunter”মডেল হাইপোথেসিসের একেবারে পরিপন্থী!

তাহলে হয়ত কোন ধর্মীয় কারণে হয়ত অস্ত্রগুলো রাখা হয়েছিল, এমন ধারণা করা হল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সেই সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে যায়। তার কারণ অস্ত্রগুলোর বৈচিত্র্যময় চেহারা। 

অস্ত্রগুলো খুব যত্ন নিয়ে তৈরি হয়েছিল, যেদিকটা শিকারকে লক্ষ্য করে ছোঁড়ার সেদিকটা অতিমাত্রায় তীক্ষ্ণ, বলা যায় নিখুঁত বিদ্ধ করার অস্ত্র। ছুরিটিও নিপুণভাবে বানানো, ধারালো। এমন জিনিস শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে তৈরি করা হবে সেটা একেবারেই মানা যায় না। তাহলে একটাই সিদ্ধান্তে আসতে হয়, মেয়েটি এই অস্ত্রগুলি ব্যবহার করত।

সহজে কিন্তু সে কথা সবাই মানলেন না!


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com
নানা রকমের অস্ত্রশস্ত্র চিত্রঋণঃঅন্তর্জাল

আদিম সমাজে পুরুষেরা জঙ্গলে গিয়ে পশু শিকার করে আর মেয়েরা বাড়িতে করে শস্য উৎপাদন আর সন্তান পালন -এই তত্ত্বই সর্বজন গ্রাহ্য! আরিজোনা ইউনিভার্সিটির নৃতত্ত্বের অধ্যাপক কিম হালের একটি উক্তিকে (“You can’t just stop in the middle of stalking a deer in order to nurse a crying baby!”)

একসময় মোটামুটি বেদবাক্য হিসেবে ধরে নেওয়া হত!

অর্থাৎ প্রাগৈতিহাসিক যুগের মেয়েরা শিকার করত না। করবে কী করে তাই না? যদি বাচ্চা কেঁদে ওঠে! 

পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা দেশ কাল পাত্রের উর্ধ্বে গিয়ে একটি মতবাদই প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে যুগে যুগে – মেয়েরা অবলা, বাড়িতে সংসার দেখা আর বাচ্চা উৎপাদন আর পালন ছাড়া তাদের বিশেষ কোন শারীরিক বা বৌদ্ধিক ক্ষমতা নেই। পুরুষ শারীরিকভাবে অধিক সক্ষম আর শক্তিশালী তাই তারাই শিকার করবে এটাই সঠিক। আজও আফ্রিকা আর দক্ষিণ আমেরিকার উপজাতিদের মধ্যে এই ধারণাই কার্যকরী। 

কিন্তু সত্যিই কি তাই? মেয়েরা শিকার করত না? শুধুইঘরেবসেথাকত!

অনেকদিন ধরেই নারীবাদীরা এই তত্ত্বের বিরুদ্ধাচারণ করে এসেছেন। আর করবেন নাই বা কেন? এই যে অলিম্পিক থেকে শুরু করে সব রকম ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় মেয়েরা তীর ধনুক চালাচ্ছে, বর্শা ছুঁড়ছে – সারা পৃথিবী জুড়ে, তার বেলা? মেয়েরা দুর্বল হলে পারত? পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লোককথায়, উপকথায় মেয়েদের যুদ্ধ করা, শিকার করার কাহিনি আছে, সেগুলো তা হলে কোথা থেকে এল!

তাই এই আবিষ্কার নতুন করে উদ্দীপনা ঘটালো!

 অতএব খোঁজ! খোঁজ! খোঁজ! 

প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে প্রবল উৎসাহ!

মিলল আরো উদাহরণ!

উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার পুরনো প্রস্তরযুগের শেষ দিকের আর নতুন প্রস্তর যুগের বিভিন্ন ধ্বংসস্তূপে অভিযান চালানো হল। সেই সব জায়গা থেকে ৪২৯টি মৃতদেহাবশেষ উদ্ধার করা হল যার মধ্যে সাতাশ জনকে কবর দেওয়া হয়েছিল অস্ত্র সমেত।

এদের মধ্যে পনেরো জন পুরুষ আর  বারোজন মহিলা।

শুধু তাই নয়, প্রচুর মহিলার ফসিল কিংবা হাড়গোড় মাথার খুলি ইত্যাদি পাওয়া গেছে, যাদের শরীরে ক্ষতচিহ্ন দেখলেই বোঝা যায় মৃত্যু ঘটেছে কোন ধারালো অস্ত্রের আঘাতে।

কিন্তু মানতে রাজি নন সব বিদ্বজ্জনেরা! মেয়েরা শিকার করবে কখন, কীভাবে! 

বাচ্চা সামলাতে সামলাতে! 

হতেই পারে না! 

অস্ত্র সমেত কবর দেওয়া হয়েছে মানেই তো এ নাও হতে পারে যে এই মহিলাই সে অস্ত্র ব্যবহার করত শিকারে!

নৃতত্ত্ববিদেরা সবাই কিন্তু একমত হলেন না। যোগ দিলেন পরিবেশবিদেরাও। তাঁরা জানালেন হয়ত সবএলাকার মেয়েরা শিকার করত না, কিন্তু এই মানুষের দল যারা আন্দিজ পর্বতের ১৩,০০০ফুট উঁচুতে থাকত তারা নারী পুরুষ একযোগেই শিকার করত এটা ধরে নেওয়াযেতেই পারে।

আধুনিক নৃতত্ত্ববিদেরা আরো বলেন যেপুরুষ দূরে দূরে গিয়ে শিকার করত বড় বড় জন্তুদের, আর মেয়েরা মারত বাসস্থানের কাছাকাছি ছোটখাট মাপের জন্তুদের- এ তত্ত্ব মেনে নিতে তো কোন বাধা নেই।শারীরিকভাবে সমস্ত মেয়েরাই যে শিকার করার কাজে অনুপযুক্ত, এ তো হতেই পারেনা। 

যুগের সঙ্গে ধ্যান ধারণা বদলাচ্ছে, তাই মেয়েরা শুধু ঘরে থাকত আর পুরুষেরা শিকার করে খাবার ঘরে আনত এই ভাবনা দুবার ভাববার সময় এসেছে।

 নারীবাদী নৃতত্ত্ববিদেরা জানিয়েছেন সন্তানসম্ভবা বা ছোট বাচ্চার মা ছাড়া বাকিমহিলারা কেন শিকার করতে পারবে না, এ নিয়ে ভাবেনই না গোঁড়ামনেরসিদ্ধান্তকারীরা। তখন জীবন ছিল গোষ্ঠীবদ্ধ। ছোট বাচ্চাকে দেখাশোনা করার লোকের ও নিশ্চয়ই অভাব থাকার কথা নয়। তাই বাচ্চার মাও অনায়াসেই শিকার করতে পারে! 

 আদিম সমাজে নারী পুরুষের ভেদাভেদ পরবর্তীকালের মত এত শত ছিল না। পুরুষ নারী পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করত এমন ধারণাই করা হচ্ছে।

পশু ধরার ফাঁদের ব্যবস্থা করা, বা বড় বড় জন্তুকে তাড়িয়ে জঙ্গলের আর একপ্রান্তে নিয়ে গিয়ে জড়ো করা ইত্যাদি কাজ অবশ্যই মেয়েরা করত। দুর্গম পাহাড়িঅঞ্চলে বড় হরিণ বা বাইসন নারী পুরুষ উভয়েই শিকার করত, এটা ধরে নেওয়া হয়েছে।

তাই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতেই পারে, আদিম মহিলারা শুধু রান্নাই করতেন না রান্নার মাংসও জোগাড় করে আনতেন।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত