| 13 ডিসেম্বর 2024
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক: উত্তর উপনিবেশবাদ ও অন্যান্য (পর্ব-৬) । ফয়েজ আলম

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

পশ্চিমারা শাসন শোষণের স্বার্থে, উপনিবেশ কায়েম রাখার স্বার্থে যেজ্ঞানভাষ্য তৈরি করেছে তাতে উপনিবেশিতদের মানসিকভাবে দাসে পরিণত করেছে। মনোজগতের এই উপনিবেশ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই উত্তর উপনিবেশী ভাবচর্চা জরুরি। উপনিবেশ স্বাধীন হওয়ার পর উপনিবেশক সংস্কৃতির প্রভাব বহাল থাকে স্বাধীন জনগোষ্ঠীর মধ্যে, যাকে বলা হয় উত্তর-উপনিবেশী পরিস্থিতি। এই প্রভাব কাটিয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটাই হলো বি-উপনিবেশায়ন। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্বাধীনতার পর এখন আত্ম-উদবোধন ও প্রতিরোধ সংগ্রাম মূলত উত্তর-উপনিবেশী পরিস্থিতির বিরুদ্ধে, সাংস্কৃতিক ও ভাবাধিপত্যের নিরবচ্ছিন্ন কিন্তু অসম উপস্থিতি ছুড়ে ফেলার জন্য। এর শুরু সাংস্কৃতিক ক্রিয়াশীলতায়, বোধ ও ভাবের সংগ্রামে। উত্তর উপনিবেশবাদ নিয়ে আরো গভীরভাবে জানতে ইরাবতীর ধারাবাহিক ফয়েজ আলমের উত্তর উপনিবেশবাদ ও অন্যান্য লেখাটির আজ থাকছে পর্ব-৬।


বি-উপনিবেশায়ন: কেন্দ্র প্রান্তের প্রসঙ্গ

আজকাল আমাদের এখানে কারো কারো লেখায় ‘প্রান্তে বসে লিখছি’, তৃতীয় বিশ্বের  এক দরিদ্র দেশের প্রান্তবর্তী মানুষ আমরা’, ‘আমরা যারা প্রান্তের  মানুষ তাদের কাছে….’ এ-জাতীয় বাক্যাংশ অনেকের চোখে পড়ে থাকবে। উত্তর-উপনিবেশী অধ্যয়ন সম্পর্কে যারা কেবল পড়াশোনা শুরু করেছেন তাদের কৌতূহল হওয়া স্বাভাবিক এই প্রান্ত  ব্যাপারটা আসলে কী, প্রান্তের বিপরীতে কোনো কেন্দ্র আছে নাকি? কী সেই কেন্দ্র? বি-উপনিবেশনের যে-কটা প্রক্রিয়ার আলোচনা করলাম তার মধ্যে যে-ধারায় হাইব্রিড সংস্কৃতিকে অব্যবহিত বাস্তবতারূপে স্বীকার করে নিয়ে পশ্চিমের জ্ঞানভাষ্যে হস্তক্ষেপ করার কথা বলা হয়, তার মধ্যে প্রান্ত-কেন্দ্রের ধারণার জন্য জায়গা করে দেওয়া সম্ভব। এখানে প্রান্ত সকল উপনিবেশ, আর কেন্দ্র বৃটেন (হয়তো অন্যান্য উপনিবেশী শক্তি, এমনকি সাম্প্রতিক আমেরিকাও)। এ-ধারণার সূচনা কোথায়? সম্ভবত সালমান রুশদির ব্যবহৃত ‘দি এম্পায়ার রাইটস ব্যাক টু দি সেন্টার’ কথাটির সূত্রেই প্রান্ত  ও কেন্দ্রের ধারণা নতুন করে ছড়িয়ে পড়ে থাকবে। আমেরিকায় সত্তরের দশকে বানানো একটি টিভি সিরিয়াল ‘এম্পায়ার স্ট্রাইকস ব্যাক’-এর শিরোনামটি হাস্যরসাত্মক কায়দায় ব্যবহার করেন রুশদি। আবার এ নামে গোটা একটি বই-ই প্রকাশিত হয়ে গেছে নিউইয়র্কের রূটলেজ প্রকাশনা সংস্থা থেকে। বইটির পুরো নাম ‘দি এম্পায়ার রাইটস ব্যাক : থিয়োরি অ্যান্ড প্র্যাকটিস ইন পোস্ট-কলোনিয়াল লিটারেচার’ (১৯৮৯), সম্পাদক তিনজন–বিল অ্যাশক্রফট, গ্যারেথ গ্রিফিথ ও হেলেন টিফিন। সাহিত্য ও সংস্কৃতি তথা সামগ্রিক জ্ঞানচর্চায় কেন্দ্রের ধারণার সঙ্গে জড়িত রয়েছে সতরো শতক থেকে বিকশিত ইউরোপের বিভিন্ন দেশের উপনিবেশের বাস্তবতা। উনিশ শতকে যখন স্থানীয় মানুষদের ‘শিক্ষা প্রদানের নিমিত্তে’ ইংরেজি সাহিত্য পাঠ্য করানো হয় তখন থেকে বিভিন্ন ব্রিটিশ ধারণা স্থানীয়দের মগজে গাঁথা হয়ে যেতে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই সে শিক্ষা ব্যবস্থায় পাঠবিষয়ে বৃটেন কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। এবং তার সূত্র ধরে আসে মার্জিন বা পেরিফেরি কথাগুলোও। উপনিবেশী জ্ঞানভাষ্যে তাই কেন্দ্র-প্রান্তের ধারণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের এখানে কেদ্র ও  মার্জিন শব্দ দুটোর সাম্প্রতিক ব্যবহার ওই পরিপ্রেক্ষিত থেকেই; কাজেই এগুলো উপনিবেশী প্রভাবেরই দৃষ্টান্ত। ক্রোমারের মনোভঙ্গিতে এই কেন্দ্র-প্রান্ত বিন্যাস চিহ্নিত করেন সাঈদ:

পশ্চিমে ক্ষমতার একটি কেন্দ্র এবং তা থেকে বিচ্ছুরিত একটি বিরাট সর্বগ্রাসী যন্ত্র কল্পনা করেন ক্রোমার। কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ সেখানে অক্ষুন্ন থাকে, যন্ত্রটির নিয়ন্ত্রণও থাকে তার হাতে। প্রাচ্যে যন্ত্রটির বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা যন্ত্রটিতে যা সরবরাহ করে তা মানববস্তু, বস্তুগত সম্পদ, জ্ঞান–যা আপনার আছে–যন্ত্রটির দ্বারা প্রক্রিয়াজাত হয়ে রূপান্তরিত হচ্ছে আরো ক্ষমতায়। (সাঈদ ১৯৯৫, ৮২)


আরো পড়ুন: উত্তর উপনিবেশবাদ ও অন্যান্য (পর্ব-৫) । ফয়েজ আলম


এখানেই প্রান্ত-কেন্দ্র-বিষয়ক আলোচনা ফাঁদার কারণটা নিহিত। উপনিবেশে যেসব শ্বেতাঙ্গ কর্মরত ছিল সর্বপ্রথম তাদের কাছেই কেন্দ্র ও প্রান্তের ধারণা অর্থবহ হওয়ার কথা। স্থানীয়রা এ ধারণার সঙ্গে পরিচিত হয় পরে। কিংবা যখনই পরিচিত হয়ে থাকুক, প্রান্তের ধারণাটির মধ্য দিয়ে উপনিবেশিতদের নিকৃষ্ট চিত্রিত করা, অপমান করা, উপনিবেশের শৃঙ্খলে আটকে পড়ার ইঙ্গিত রয়েছে। কাজেই এটি উপনিবেশক সংস্কৃতির আধিপত্যশীল প্রবণতারই স্মারক। তাহলে আমরা এগুলো ব্যবহার করব কেন?

বি-উপনিবেশন প্রক্রিয়া যদি পশ্চিমের জ্ঞানভাষ্যে হস্তক্ষেপ করার ব্যাপার হয় তাহলে উপনিবেশ সম্পর্কে কেন্দ্রের ধারণা প্রয়োগ করা যায়, যেমন সালমান রুশদির লেখায়। যাঁরা ব্রিটেনে বা আমেরিকায় বসে লেখেন বা কথা বলেন, তাদের পক্ষে কেন্দ্রে বসে লেখার বোধ সহজে এড়াবার নয়। প্রসঙ্গক্রমে চিনুয়া আচিবির থিংস ফল অ্যাপার্টের কথা বলা যায়। ওখানে কেন্দ্রের টান খসিয়ে চতুর্দিক ভেঙ্গে পড়ার কথা আছে। কিন্তু ওতে কেন্দ্র হলো প্রাক-উপনিবেশী জনগোষ্ঠীর অতি জরুরি সামাজিক-ঐতিহ্যিক সংসক্তি। উপনিবেশকের অবস্থান বরং প্রান্তেই নির্দেশিত।

আবার, বি-উপনিবেশনের ক্ষেত্রে যে-দৃঢ় সাংস্কৃতিক ও মানসিক ভিত্তি প্রয়োজন, ‘প্রান্তে বসলে সে জোর পাওয়া যাবে না। আমি বলতে চাচ্ছি আমার নিজের পায়ের মাটিটাকে প্রান্ত মনে করলে সে-ভাবনা আমাকে দুর্বলই করবে। আবার বি-উপনিবেশায়ন কেবল পশ্চিমের বিরুদ্ধে পরিচালিত কোনো দৈহিক যুদ্ধ নয়, লড়াইটা বরং অনেকটা নিজের মানসিক অবস্থার সঙ্গে যেখানে আরেক কেন্দ্র হিসেবে উপনিবেশকরাও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে। আবার দুই কেন্দ্রের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় উত্থিত মধ্যবর্তী সংকর অবস্থাকেও শনাক্ত করা সম্ভব; অর্থাৎ বলতে চাচ্ছি, দুটো কেন্দ্র স্বীকার করে নিলেই যে বাইনারী অপোজিশনের ফাঁদে পড়ে যেতে হবে, এমন ধারণা অমূলক। প্রকৃত অর্থে বি-উপনিবেশনের জন্য প্রান্ত ও কেন্দ্রের ধারণারও অবসান প্রয়োজন।

বি-উপনিবেশায়ন একটি জটিল ও দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এজন্য দীর্ঘ প্রস্তুতি ও তৎপরতা দরকার; আবার, ত্বরিত ফলাফল আশা করাও অর্থহীন। উপনিবেশকের সংস্কৃতি বহু যুগ ধরে এখানে কাজ করেছে, প্রভাব বিস্তার করে গেছে। কয়েকটি বই লিখে রাতারাতি সে-প্রভাব  দুর করার ইচ্ছা একরকম কল্পজাগতিক ব্যাপার বলেই বোধ হবে। বি-উপনিবেশনের জন্য প্রথমে প্রয়োজন একটি তাত্ত্বিক ভিত্তি, অত:পর ব্যাপক তৎপরতা। সে-তৎপরতা সূচিত হতে হবে নানা দিক থেকে; প্রবন্ধে-নিবন্ধে, সৃষ্টিশীল রচনায়, সাহিত্য সমালোচনাসহ জ্ঞানকাণ্ডের নানা শাখায়, এমনকি প্রকাশভঙ্গিতেও। উদ্যোগ নিতে হবে সম্মিলিতভাবে।

এরপরও কথা আছে। কেবল সাহিত্যে এই আন্দোলনের সূচনা করে কতটা ফল পাওয়া সম্ভব? এই মুহূর্তে প্রচারমাধ্যম সবচেয়ে শক্তিশালী, জনতার খুব কাছে। ইতিহাস, সমাজবিদ্যার কথাও আনা দরকার। এসব ক্ষেত্রে পরিবর্তন ছাড়া সফল বি-উপনিবেশন অসম্ভব। তবে আশার কথা সচরাচর সাহিত্যের প্রবণতাগুলো আক্রান্ত করে অন্যান্য জায়গাও। আমরা যদি সাহিত্যে বিউপনিবেশন প্রক্রিয়া সূচিত করতে পারি তার আঁচ অন্য সব পরিসরেও ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা যাবে। প্রথমেই দরকার একটি তাত্ত্বিক ভিত্তির। তাত্ত্বিক পরিসর নিয়ে দাঁড়াবার জায়গাটা হয়ে গেলে এরপর আসবে উত্তর-উপনিবেশী পরিস্থিতি অর্থাৎ আমাদের সংস্কৃতিতে উপনিবেশী প্রভাব চিহ্নিত করার প্রসঙ্গ এবং সেইসঙ্গে বিউপনিবেশনের গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়ার কথা। কোন লক্ষ্যে, কী প্রক্রিয়ায় আমরা এগুবো তা নির্ধারণ করাও জরুরি। এসব বিষয় আলোচিত হতে হবে ব্যাপক এবং বহুপাক্ষিক উদ্যোগে। প্রথমেই লেখক-বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিক-সংস্কৃতিকর্মীদের মধ্যে এই বোধ জেগে ওঠা দরকার যে, আমরা উপনিবেশী জ্ঞানভাষ্যের দীর্ঘকালীন ভাবগত ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যে বেড়ে উঠেছি, যা আমাদের আত্মপরিচয় ও ঐতিহ্যিক সঞ্চয়কে চাপা দিয়ে রেখে আমাদের মধ্যে হীনমন্যতার বোধ স্থায়ী করে দিয়ে গেছে। এইটুকু না হলে বি-উপনিবেশনের সূচনা অসম্ভব।

তথ্যের জন্য ব্যবহৃত বইয়ের তালিকা:

Ashcroft, Bill, Griffiths, Garreth, Helen Tiffin (ed), The Post-colonial Studies Reader, Routledge, London and NewYork, 1999.

Bhaba, Homi K., The Location of Culture, Routledge, London, 1994.

Bhaba, Homi K., Nation and Narration, Routledge & Kegan Paul, London, 1994.

Bhaba, Homi K., ‘Sign Taken for Wonders: Question of Ambivalance and Authority Under a Tree Outside Delhi, May 1817’. Critical Inquiry 12, 1985, 144-65.

Fannon Frantz, Black Skin White Mask, trans. Charles Lam Markman (Grove Press, New York, 1967).

Fannon Frantz, Wretched of The Earth, trans. Constance Farrington, Grove Widenfield, New York, 1968.

JanMohammed, Abdul R., ‘The Economy of Manichean Allegory: the Function of Racial Difference’, in Aschcroft, Bill, et al  

Ngugi Wa Thiongo. Decolonizing The Mind: the Politics of Languge in African Literature,  James Curray, London 1986.

Ngugi, James (Wa Thiongo), The River Between, Heineman, London, 1965.

Parry, Benita, ‘Problems in Current Theories of Postcolonial Discourse’, in Aschcroft, Bill, et al

Said, Edward W., Culture and Imperialism , Vintage, London, 1994.

Said, Edward W, Orientalism , Penguin Books, London, 1994.

Salih, Tayeb, Season of Migration to the North, trans. Denys Johnson Davies, Heinman, London, 1970.

Spivak, Gayatri Chakravorty, ‘Can Subaltern speak?” in Ashcroft, Bill et al

Spivak, Gayatri Chakravorty, “In Other World: Essays on Cultural Plitics?” Routledge, New York, 1988.

গৌতম ভদ্র, ইমান নিশান, সুবর্ণরেখা, কলিকাতা, ১৯৯৪।

ফয়েজ আলম, প্রাচীন বাঙালি সমাজ সংস্কৃতি, র‌্যামন পাবলিশার্স, ঢাকা, ২০০৪।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত