Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,প্রেম

অসমিয়া অনুবাদ: রক্তের অন্ধকার (পর্ব-৭) । ধ্রুবজ্যোতি বরা

Reading Time: 4 minutes

সে বসে থাকা অবস্থাতেই তেল পুড়ে পুড়ে একসময় প্রদীপটা নিভে গিয়েছিল। প্রদীপটা জ্বলতে থাকার সময় কাঁপতে থাকা আগুনের আলোটা চারপাশটা অন্ধকারের মতো করে রেখেছিল। নিভে যাওয়ার পরে ভাঁড়ারের ওপর দিয়ে উদয় হওয়া প্রকাণ্ড চাঁদের আলোটুকু উঠোনে এসে আছাড় খেয়ে পড়ল। আর গাছের ছায়া পড়া ফটফটে জ‍্যোৎস্নায় উঠোনের সেই জায়গাটিতে কাল প্রেম অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে ছিল। তার এরকম মনে হচ্ছিল যেন জ্যোৎস্নায় একটা আটার বস্তার বর্ণ ধারণ করা উঠোনে রক্তের দাগগুলি জ্বলজ্বল করে উঠেছে। তার শরীরটা শির শির  করে উঠেছিল।

জমাট বাধা লাল রক্ত একসময় কালো হয়ে উঠেছিল। শরীরটা একবার ঝাঁকিয়ে নিয়ে সে দ্রুত লেংচে লেংচে রান্নাঘরের উঠনের দিকে এগিয়ে গেল।

‘ আয় প্রেম। এখানে এসে বস।’– উঠোনে একটা মোড়া পেতে দিয়ে যতীনের মা তাকে ডাকল।

‘ এত তাড়াহুড়ো ওর।ভালো করে চা-টাই খেয়ে গেল না।’ প্রেমের সামনে তিনি প্লাস্টিকের একটা বাসনে কিছুটা সুজির হালুয়া এবং চিনি দেওয়া তিনটি লুচি দিয়ে গেলেন।

‘ তুই খা, আমি চায়ের জল বসাই।’

বারান্দার মোড়ায় বসে প্রেম লুচি এবং সূজি ভাজা খেতে শুরু করল।হ‍্যাঁ, মানুষটা তাকে ভালোবাসে।তাকে ভালোবাসে।আর ভালোবাসবেই  না কেন? সেই ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার পরে অনেকদিন পর্যন্ত ভয়ে যখন গ্রামের কোনো মানুষ এই বাড়িতে আসত না, যখন ঘটনাটার পরে গ্রামের চারপাশে পুলিশ মিলিটারি দৌরাত্ম্য আরম্ভ করেছিল, তখন একমাত্র প্রেমই লেংচে লেংচে প্রায় প্রতিদিন এই বাড়িতে আসত।এসে কারও সঙ্গে খুব একটা কথা না বলে সামনের বারান্দার একটা কোণে পা ঝুলিয়ে বসে থাকত।

কেন, কিসের আকর্ষণে যে এই বাড়িতে আসতে শুরু করেছিল তা সে নিজেও জানে না। ঘটনাটা ঘটার আগে এই বাড়ির সঙ্গে তার বিশেষ সম্পর্কও ছিল না।

যতীন দাদার ভাই-দাদারা ঘটনাটার কিছুদিন পরেই রাজধানীর দিকে বাসা বদল করে নিল।তাঁরা আজকাল সেখানেই ঘর ভাড়া করে থাকে। গ্রামের বাড়িতে কাজ করা মানুষ নিয়ে কেবল বুড়ো বুড়ি বসবাস করে।

সে যে কেন এখানে আসে তা সে নিজেও জানে না।

তার ভাই এই বাড়িতে এসে অপঘাতে মরা কথাটা সে আজও মন থেকে সহজ ভাবে নিতে পারেনি। ভাইয়ের কী সম্পর্ক ছিল এই বাড়ির সঙ্গে। যতীন ছিল রাজনীতি করা মানুষ – তার সঙ্গে ভাই কেন এসেছিল। ভাই তো কখনও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত রয়েছে বলে সে জানত না।

তথাপি কিছু একটা অজানা অবুঝ আকর্ষণ তাকে বারবার এই বাড়িতে টেনে এনেছিল।

প্রতিদিন আসতে থাকা নিরীহ খোঁড়া ছেলেটির প্রতি যতীনের মায়েরও ধীরে ধীরে একটা স্নেহ জেগে উঠল। তিনি ছেলেটিকে প্রতিদিন এক কাপ চা, কিছু জলখাবার দিয়ে দুই একটি কথা বলতে আরম্ভ করলেন।

দুই একটি কথা বলে তারও  মনটা ভালো লাগে।

লুচি এবং সুজি ভাজা দিয়ে চা টা খেয়ে, এক সময় প্রেম যতীনদের বাড়ি থেকে লেংচে লেংচে  বেরিয়ে এল।

তখন রোদ বেশ প্রখর। 

উজ্জ্বল রোদে চারপাশ তখন ঝলমল করছে ।

যতীনদের বাড়ি থেকে ফেরার সময় গ্রামের পান দোকানটির বাঁশের বেঞ্চে সে বসে পড়ল। তার কিছুটা ক্লান্ত লাগছিল। দোকানটি থেকে চারমিনার সিগারেট একটা নিয়ে জ্বালিয়ে সে ধীরে ধীরে টানতে লাগল।

চোখ দুটো অর্ধেক বুজে সে খুব তৃপ্তির সঙ্গে সিগারেটটাতে টান দিল।

ধীরে ধীরে সে মুখ থেকে  ধোঁয়াগুলি বের করে দিল।

পেট ভরে চা জল খাবার খেয়ে আসার পরে সিগারেটে টান দিয়ে তার খুব ভালো লাগল।বসে বসে সে আবোল তাবোল বহু কথাই ভাবতে লাগল।

টাকাটা আসবে। কথাটা ফাইনাল। ফাইনান্সের সইটা বাকি আছে।

টাকার কথাটা ভাববে না বলে ভাবলেও তার মনে আসতে লাগল।

সর্বা কাল রাতে বলে যাওয়া কথাগুলি মনে পড়ল।

এবার টাকাটা আসবেই। মানুষটা তো সঠিক খবর দিয়েছে। তাড়াতাড়ি আসবে– প্রেম ভাবতে লাগল।

কম টাকা নয়, এক লাখ টাকা।।নগদ এক লাখ টাকা।

ইস, এত টাকার কথা। খবরের কাগজেও এই কথা বেরিয়ে গেছে। ডিসি নিজে  এসেছে।অন্য অফিসারও এসেছে। পুলিশ এসেছে। যতীন দাদার শ্রাদ্ধের দিন তাদের বাড়িতে এসে বাবার সঙ্গে দেখা করে গেছে। উগ্রপন্থীর হাতে নিহত পরিবারদের এক লক্ষ টাকা করে দেবে বলে সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। ডিসি নিজে বাবাকে কথাটা বলে গেছে । রাজধানী থেকে টাকা এলেই ডিসি নিজে খবর দিয়ে ডাকিয়ে নিয়ে হাতে হাতে টাকাটা দেবে।


আরো পড়ুন: রক্তের অন্ধকার (পর্ব-৬) । ধ্রুবজ্যোতি বরা


এখন রাজধানী থেকে টাকাটা বের হওয়ার উপক্রম হয়েছে।খুব তাড়াতাড়িই ডিসির কাছে এসে যাবে।সঠিক খবর।একেবারে সঠিক খবর।

বাবা খবরটা পেলে খুশি হবে।

সর্বা বলে যাওয়া কথাগুলি তার বারবার মনে পড়ছে।কয়েকবার সে জোর করে মন থেকে ভাবনাটাকে তাড়াবার চেষ্টা করেছে,তবু আবার ঘুরে ফিরে কথাটা ম্রনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।কথাটা জোর করে মন থেকে দূর করার জন্য সে অন্য কথা ভাবতে লাগল।চাষবাসের কথা,বাবার অসুখটার কথা,মায়ের ফেঁসে যাওয়া শাড়িটার কথা,বিধবা মালতীর মেয়ে ফুলের কথা।

বদনামী ফুলের কথা।

বিধবা মায়ের সঙ্গে সঙ্গে সেও মাঠে ঘাটে ,মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করে বেড়ায়।মেয়েটি বড় মুখরা।তার মুখের ভয়ে চট করে কেউ তার কাছে ঘেঁষতে চায় না।তা নাহলে তার গায়ের রঙটা মলিন হলেও শরীরের গড়নটা চোখে পড়ার মতো।

পুরুষ্ঠ মুখ,খোঁপাটা গলা থেকে একটু ওপরে বাঁধা-ভারী বুক,হালকা কোমরের নিচে পুরুষ্ঠ পা দুটি হেঁটে যাবার সময় ধানক্ষেতে বাতাসে তোলা ঢেউয়ের মতো একটা ঢেউ খেলে যায়।ইস -কী চাহনি তার।চোখদুটিতে সবসময় একটা উজ্জ্বল দুষ্ট হাসি,পুরুষ্ঠ ঠোঁটদুটির জন্য মুখটা একটু খোলা থাকে।

এত চকচকে সাদা দাঁত সে অন্য কোনো মেয়ের দেখে নি।

আজ কিছুদিন থেকে সে যেখানে প্রেমকে দেখতে পায়,তার সঙ্গে দুই একটি কথা বলে।প্রেমও সেই প্রথম একটি মেয়ের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছে।তারও মনটা ভালো হয়ে যায়।

কেবল তার একটা বদনাম আছে।

সর্বারা বলে থাকে ওকে নাকি টাকা দিলেই কিনতে পারা যায়।

‘টাকা দিলে তার সেই শরীরটা তুই যেভাবে খুশি ব্যবহার করতে পারবি।’-সর্বা তাকে শুনিয়ে একবার কাউকে বলেছিল।আজ পর্যন্ত কতবার যে পেট খসিয়েছে তার কোনো ঠিক নেই।

ফুল সেদিন মাঠের মাঝখানে প্রেমের সঙ্গে দেখা হওয়ায় কথাবার্তা বলতে বলতে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল –‘প্রেমদাদা ,বিয়ে সাদি করবে না নাকি?’

‘কী সব বলছিস,ধ্যা্ৎ‌’

‘রাগ করছ কেন,জিজ্ঞেস করছি।তোমার সঙ্গীদের মধ্যে সবাই এক একজনকে জুটিয়ে নিয়েছে।তোমার পা-টাই শুধু খারাপ,বাকি শরীর তো ঠিকঠাকই আছে।’

কীসের ইঙ্গিত দিয়েছিল সে?

প্রেমের কান মুখ গরম হয়ে উঠেছিল।

‘চুপ কর।নির্লজ্জ কোথাকার।’-প্রেম বলেছিল।‘তোর কি লজ্জা সরম বলতে কোনো কিছু নেই।’

‘লোকের বাড়ি বাড়ি ঘুরে কাজ করার পর থেকে লাজ লজ্জা সমস্ত কিছু গিলে খেয়েছি প্রেম দাদা।‘-সে উত্তর দিয়েছিল।‘লজ্জা দরিদ্রের পেট ভরায় না।’তারপরে একটা কৌ্তুকের হাসি হেসে ফুল বলেছিল-‘এই যে প্রেম দাদা,তোমাকে একটা কথা বলব বলে ভাবছি।আমাকে তুমিই বিয়ে কর বুঝেছ।না হলে আমাকেও বিয়ে করার কেউ নেই আর সহজে তোমাকেও কেউ বিয়ে করবে না।’

ফুলের খিলখিল হাসিতে মাঠের ধান পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল।

প্রেম পুনরায় একবার ‘চুপ কর নির্লজ্জ কোথাকার’বলা ছাড়া কিছুই বলতে পারেনি।ফুল একটা বাঁকা হাসি হেসে প্রেমকে সেখানেই ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল।

ফুল আমার সঙ্গে ঠাট্টা করেছিল নাকি?    

   

   

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>