ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-১১) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
একলা বৈশাখ নয় পয়লা বৈশাখ
তখন আমরা নেহাতই ছোট। স্কুলে বড় বড় করে দিদিমনি বোর্ডে লিখে দিলে দেখে দেখে লিখি। সেসময় একদিন বোর্ডে একটা ‘এক’ তারপর ‘লা’ তার পাশে বৈশাখ লিখে দিদিমনি আমাদের বললেন,“বলতো এটা কী লিখলাম?”
আমি দাঁড়িয়ে উঠে বীরদর্পে বললাম ‘একলা বৈশাখ’।
দিদিমণি হেসে বললেন “না। ওটা পয়লা বৈশাখ বলতে হবে।”
কথাটা কানে ঢুকলেও মনে বা মাথায় ঢুকল না। মাঝেমাঝেই একলা বৈশাখ বলে সবার হাসির খোরাক হতাম।পরে বুঝলাম পয়লা বৈশাখ কোনমতেই একলা বৈশাখ হতে পারেনা। এই ক্ষেত্রটিতে একলা কোন কিছুর অবকাশই নেই। বঙ্গের মানুষের এই উৎসবের সবটাই সমবেত, সবটাই যৌথ প্রয়াস।
আমাদের বাড়ি বা আশপাশের বাড়িগুলোতে দেখতাম বাংলার শেষ মাস চৈত্রের মাঝামাঝি থেকেই সাজো সাজো রব উঠত। ঘর দোর ঝেড়েমুছে পরিষ্কার করা হচ্ছে। বিছানার চাদর,বালিশের ওয়ার কেচেকুচে তুলে রেখে অপেক্ষাকৃত নতুন একটি পেতে দেওয়া হচ্ছে। একজন অতিথি আসছেন,তার নতুন রূপের আবাহনে এই সাজো সাজো রব। না না তিনি কোন মানুষ নন, তিনি নতুন বছরের প্রথম দিন।
ছোটবেলার সেই সময়টিতে পয়লা বৈশাখের আগমন পর্বে বেশ উত্তেজনা চলত। বাজারে মধ্যবিত্তদের সন্তুষ্টি হওয়ার মত একটি কাপড়ের দোকান ছিল। সেই গোকুল দত্তের দোকানে মা,কাকিমা,পিসি, মাসিদের ভিড় উপচে পড়ত। তাছাড়া অন্য দোকানদাররাও মহাজনদের টাকা মেটানোর জন্য পুরনো ভান্ডার থেকে অনেক কিছুই কমদামে ছেড়ে দিতেন। আর মা কাকিমারা দোকানে দোকানে ঘুরে তাদের সারাবছরের পোশাক-আশাকের কেনাকাটা কমদামে সারতেন। শেষ বেলায় আমাদের জামা নাহলেও পাতলা আদ্দি কাপড়ের ফুলতোলা টেপফ্রক দিয়ে খুশি করা হত।
দুটি করে গরমে পরার ওই টেপফ্রক জুটত আমাদের।তাতেই মুখে হাসি ধরেনা। এখনও মনে আছে সাদা হাতকাটা স্বচ্ছ ওই টেপফ্রকের বুকে কাঁথা সেলাইএর ফোঁড় দিয়ে আঁকা থাকত একটি হাঁস তারপরে জলের আঁকাবাঁকা দাগ।আবার হাঁস আর জলের আঁকাবাঁকা দাগ। মাঝে মাঝে একটি করে পদ্ম আর সবুজ পাতা আঁকা ছিল হয়ত। ঠিক মনে পড়ছে না।
এখনও সেই জামার কথা মনে আছে আমার।মায়েদের ডোরা কাটা বারোমেসে শাড়ি কেনা হত। সেও একজোড়া।মাথায় সাবান দিয়ে,চুলে খোঁপা করে, কপালে সিঁদুরের ফোঁটা লাগিয়ে, লাক্স বা হামাম সাবানে গা ধুয়ে নববর্ষের প্রথম দিনে মা যখন ওই সাধারণ ডুরে শাড়িটি পরে ঘরের মধ্যে ঘোরাফেরা করতেন,আমরাও তাঁকে দেখে মোহিত হয়ে যেতাম।
আরো পড়ুন: ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-১০) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
তখন খুবই ছোট আমরা। পয়লা বৈশাখের হালখাতার নেমন্তন্নে , বাবার সাইকেলের সামনের রডে বসে ঘুরে বেড়াচ্ছি দোকান থেকে দোকানে। কেউ বা আমপোড়ার সরবত দিচ্ছে। কেউ আবার লেমনেডের বোতল ধরিয়ে দিচ্ছে হাতে। বাড়তি পাওনা সাদা সরু নলের মত স্ট্র।ওটা দিয়ে টেনে টেনে খেতে ভারী সুখ। এছাড়াও মিঠাই পাওয়া যেত।অনেক দোকানে আবার বসিয়ে লুচি আলুরদম মিষ্টি খাওয়াত।
সেদিন সবার বাড়িতেই অনেক মিষ্টির প্যাকেট জড়ো হত। সেইসব প্যাকেটে খাজা গজা সন্দেশের সঙ্গে কচুরি আলুরদম বা নিমকিও দেওয়া থাকত। সে একটা হই হই কান্ড! রাস্তাঘাটে ভিড়ে ভিড় হয়ে আছে! অনেকেই নতুন জামাকাপড় পরে দোকানে দোকানে ঘুরতে বেরিয়েছে। নেমন্তন্ন রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে দেখাশোনা,আলাপ আলোচনা, সে এক ঝলমলে একলা বৈশাখ থুড়ি পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন।
আমাদের মফস্বল শহরে উৎসব আরম্ভ হত আরো আগে। পুরো চৈত্র মাস জুড়েই গাজনের সন্ন্যাসীরা ‘বাবা চড়কনাথের চরণের সেবা লাগে’ বলে মাটির সরা নিয়ে মাধুকরী করে বেড়াতেন।ওই সরায় মায়েরা চাল পয়সা ভিক্ষে দিলে সেই সংগ্রহ করা চালের ভাত ওরা ফুটিয়ে খেতেন । কোন কোন পাড়ায় নীলের দিনে শিবমন্দিরের সামনে শিবের নাচ হত।আমাদের পাড়ার বটতলায় শিব মন্দিরের সামনে নীলের দিন আমরা ভিড় করতাম।ঘনাদা বাঘছাল পরে মহাদেব সেজে কাঁধে সতীরূপে ঘুমন্ত নিজের ভাইপোকে নিয়ে, সারা মাঠে নাচের ভঙ্গিতে ঘুরপাক খেতেন।তার একহাতে থাকত ডুগডুগি অন্য হাতে ত্রিশূল।

ঐতিহ্যময় শহর চন্দননগরের স্থায়ী বাসিন্দা সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতক।১৯৯৬ সালে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়’দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকায়।২০০১ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।‘আনন্দবাজার’, ‘বর্তমান’, ‘আজকাল’, ‘প্রতিদিন’, ‘তথ্যকেন্দ্র’, ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’ ছাড়াও, ‘অনুষ্টুপ’, ‘কুঠার’, ‘এবং মুশায়ারা’-র মতো বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনেও তার কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রকাশের ধারা অব্যাহত। প্রকাশিত উপন্যাস পাঁচটি, গল্পগ্রন্থ চারটি, এবং কবিতার বই একটি।