| 27 নভেম্বর 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

সুইডিশ অনুবাদ গল্প: ফারকোট। হ্যালমার সদেরবার্গ

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

হ্যালমার সদেরবার্গ (১৮৬৯-১৯৪১) সুইডিশ সাহিত্যের হাতে গোনা বিশিষ্টদের একজন। তিনি বহুল পরিচিত ও জননন্দিত উপন্যাস “ডক্টর গ্লাস” এবং “দেন আল্ভারসামালেকেন”-এর রচয়িতা। এছাড়া সুইডিশ ছোটগল্পে নুতন ধারার সৃষ্টিতেও অবদান রাখেন।ফারকোট (সুইডিশে “প্যালসেন”) তার অন্যতম জনপ্রিয় ছোটগল্প।


অনুবাদক: মাহবুব কাদেরী  

 

সে বছর ভীষণ শীত পড়েছে। লোকজন ঠান্ডায়গুটিয়ে গেছে, যাদের ফারকোট আছে তারা ছাড়া।

জেলাকর্তা রিচার্ডের বড়সর একটা ফারকোট ছিল। বলতে গেলে তাতে ছিল তার প্রতিপত্তিরই প্রতিফলন কেননা একেবারে নুতন একটা কোম্পানীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন তিনি। তার পুরোনো বন্ধু ডাক্তার গুস্তাভহেন্ক -এর কোনো ফারকোট ছিল না। ডাক্তার হেন্ক ছিলেন রোগা ও ফ্যাকাশে। কেউ কেউ বিয়ের পরে মোটা হয়, অন্যরা হয় রোগা। ডাক্তার হেন্ক রোগা হলেন। ওদিকে খ্রিষ্টমাসও এসে পড়লো।

বড়দিনের প্রাক্কালে, ঠিক তার আগের দিন বেলা তিনটার দিকে, সন্ধ্যা হওয়ার আগে আগে ডাক্তার হেন্ক যাচ্ছিলেন তার পুরোনো বন্ধু জন রিচার্ডের কাছে কিছু টাকা ধার করতে। “এ বছরটা বড় খারাপ কাটলো আমার”, নিজের মনে বললেন তিনি।  “খুবই বাজে একটা বছর। আমার স্বাস্থ্যও নড়বড়ে, বলতে গেলে পুরোপুরিই নষ্ট। আমার রোগীরা ওদিকে প্রায় সবাই সুস্থ, আজকাল তাদেরকে দেখাই যায় না আর। আমি মনে হয় শিঘ্রীই মারা যাবো। আমার বৌও তাই মনে করে, তার চোখমুখ দেখলে তা বুঝতে পারি আমি। সেক্ষেত্রে ভালো হয় যদি তা ঘটে জানুয়ারি আসার আগেই, যখন অকাজের জীবন বীমারপ্রিমিয়াম জমা দেয়ার কথা।”

এইসব ভাবতে ভাবতে তিনি গভার্নমেন্টস্ট্রীট  আর পোর্ট স্ট্রীটের কোণায় পৌঁছলেন। সেখান থেকে গভার্নমেন্টস্ট্রীট ধরে সামনে যাওয়ার জন্য যখন রাস্তা পেরুতে গেলেন, তখন পিছলে পরে গেলেন রাস্তায় আর সেই সময়ই একটা ঘোড়ায় টানা গাড়ি দ্রুতবেগে এসে পড়লো সেখানে। কোচোয়ানক্রূদ্ধচিৎকার করে উঠলো আর ঘোড়াটিসহজাতভাবেই একপাশে সরে গেলো কিন্তু এসত্বেও ডাক্তার হেন্ক কাঁধে ধাক্কা খেলেন আর উপরোন্ত একটা স্ক্রু, লোহা বা তেমন কিছু লেগে তার ওভারকোটে বিরাট একটা গর্ত হয়ে গেলো। লোকজন জড়ো হয়ে গেলো তার পাশে। এক পুলিশ কনস্টেবল তাকে টেনে তুললো, একটি মেয়ে তার কাপড় থেকে বরফ ঝেড়েদিলো আর এক বয়স্ক মহিলা তার ছিড়ে যাওয়া ওভারকোট দেখিয়ে আকারে ইঙ্গিতে বোঝাতে চাইলেন সম্ভব হলে তিনি তা সেলাই করে দিতেন সেখানেই। আর রাজবাড়ীর এক রাজকুমার যিনি ঘটনাক্রমে সে পথ দিয়েই যাচ্ছিলেন, তার মাথা থেকে টুপিটি খুলে ডাক্তারের মাথায় পরিয়ে দিলেন আর এভাবেই সবকিছু ঠিক হলো শুধু ওভারকোটটি ছাড়া। 

গুস্তাভ, তোমার এ কি হাল? হেন্ক তার অফিসে ঢুকলে জেলাকর্তা রিচার্ড বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

– গাড়ির সাথে আমার ধাক্কা লেগেছে, হেন্ক বললেন।

-তোমার কাজই এমন, বলে রিচার্ড প্রাণ খুলে হাসতে লাগলেন। কিন্তু তুমি তো এভাবে বাসায় যেতে পারবে না। তুমি আমার ফারকোট নিয়ে যাও, আমি বরং একটা ছেলেকে দিয়ে বাসা থেকে আমার ওভারকোটটাআনিয়ে নেবো।

– ধন্যবাদ, বললেন ডাক্তার হেন্ক।

এরপর প্রয়োজনীয় একশ ক্রোনার ধার নেয়ার পর ফিরে যাওয়ার সময় বললেন – ডিনারে এসো কিন্তু।

রিচার্ড অবিবাহিত আর ক্রিস্টমাসের সময় তার হেন্ক পরিবারের সঙ্গেই কাটে।    

*

বাড়ি ফেরার সময় হেন্ক ছিলেন বেশ খোশ মেজাজে, বহুদিন তিনি এমন খোশ মেজাজে থাকেন নি।

– ফারকোটের জন্যই এমন লাগছে, তিনি নিজেকে বললেন। আমি যদি বুদ্ধিমান হতাম, তবে আমি অনেক আগেই নিজের জন্য একটা ফারকোট কিনতাম, বাকিতে। তাতে আমার আত্মবিশ্বাস বাড়তো আর বাড়তো মানুষের চোখে আমার মর্যাদাও। লোকজন একজন ফারকোটপরা ডাক্তারকে তত অল্প সম্মানী দিতে পারে না যা কিনা তারা এক জরাজীর্ণ সাধারণ ওভারকোটপরা ডাক্তারকে দেয়। খুবই বিরুক্তিকর যে আমি এটা বুঝতে পারিনি আগে। এখন দেরি হয়ে গেছে। 

তিনি রাজকীয় বাগানের ভেতর দিয়ে কিছু পথ পার হলেন।  ততক্ষনে আঁধার নেমেছে, বরফ পড়তে শুরু করেছে আবার নুতন করে, পরিচিতরা তাকে দেখেও চিনতে পারলো না।

– কে জানে আসলে, সত্যিই দেরি হয়েছে কিনা? নিজেকেই প্রশ্ন করলেন হেন্ক। আমি এখনো বুড়ো হইনি, শরীর-স্বাস্থ্যের ব্যাপারে আমার ভুলও হয়ে থাকতে পারে। আমি বনের ছোট্ট এক শেয়ালের মতোই গরিব, কিন্তু জন রিচার্ডও তাই ছিল কিছুদিন আগেও। আমার বৌ কিছুদিন হয় আমার প্রতি শীতল ও অমনোযোগী। সে নিশ্চয়ই আমাকে নুতন করে ভালবাসতো যদি আমি আরো টাকা উপার্জন করতাম আর আমার পরনে এমন ফারকোট থাকতো। আমি লক্ষ্য করেছি, ফারকোট কেনার পরে জনকে সে যেন আগের চেয়ে বেশি পছন্দ করে।  বিয়ের আগে রিচার্ডের প্রতি তার কিছুটা দুর্বলতা ছিল কিন্তু রিচার্ড কখনো তাকে প্রপোজকরেনি বরং সে তাকে ও অন্য সবাইকে বলতো যে বছরে দশ হাজারের নিচে আয় করলে সে কখনোই বিয়ে করতে সাহস করবে না। কিন্তু আমি সাহস করেছিলাম আর এলেনও ছিল গরিব এবং বিয়ে করতে ইচ্ছুক। আমার মনে হয়না সে আমার প্রেমে পড়েছিল যাতে আমি ইচ্ছেমতো তার সঙ্গসুখ উপভোগ করতে পারতাম। কিন্ত তা আমি আশাও  করিনি। কিভাবে আমি এমন ভালোবাসার স্বপ্ন দেখতাম? ষোলো বছর বয়সে প্রথমবার আর্নোল্ডসনের সঙ্গে অপেরায় গিয়ে ফাউস্ট দেখার পর থেকে এমন স্বপ্ন আমি আর দেখিনি। কিন্তু তবুও আমি মোটামুটি নিশ্চিত এলেন বিয়ের প্রথমদিকে আমাকে পছন্দই করতো, এসব বুঝতে কারো ভুল হবার কথা নয়। তাহলে কেন সে আরো একবার তেমন করতে পারবে না? আমাদের বিয়ের প্রথম দিকে সে সবসময়ই জনের কথা খারাপ বলতো, যখনই তাদের দেখা হতো। কিন্তু তারপর জন কোম্পানির মালিক হলো, আমাদেরকে মাঝেমাঝে থিয়েটারের দাওয়াত দেয়া শুরু করলো এবং একটা ফারকোটও কিনে ফেললো। আর ধীরে ধীরে আমার বৌ তার সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করাও ছেড়ে দিলো।  

*

হেন্ককে আরও কিছু কাজ সারতে হলো ডিনারের আগেই। যখন তিনি নানা প্যাকেট নিয়ে বাড়ি ফিরলেন, তখন সাড়ে পাঁচটা বেজে গিয়েছে। তিনি ব্যাথা অনুভব করছিলেন তার বা কাঁধে, অন্যথায় আর কিছুই তাকে মনে করিয়েদিচ্ছিলো না দিনের দুর্ঘটনার কথা, ফারকোটটি ছাড়া।

– খুব মজা হবে দেখতে আমার বৌয়ের কি প্রতিক্রিয়া হয় আমাকে ফারকোট পরা দেখে, ডাক্তার হেন্ক নিজের মনে বললেন।

হলঘর একেবারে অন্ধকার, রোগীর সাথে সাক্ষাতের সময় ছাড়া কোনো বাতি জ্বলে না সেখানে। 

– এখন আমি তার শব্দ শুনছি, ভাবলেন ডাক্তার হেন্ক। সে হাটে হাল্কা পায়ে, ছোট্ট একটা পাখির মতো। ভেবে অবাক হই, আজো আমার হৃদয় উষ্ণ হয়ে ওঠে পাশের কক্ষ থেকে তার হেটে আসার শব্দ পেলে।

ডাক্তার হেন্ক ধারণা করলেন যে তার বৌ তাকে ফারকোটে আবৃত দেখে সাদরে বরন করবে অন্যথায় যা সে করে না। তার সেই ধারণা সত্য হলো। হলঘরের অন্ধকার কোণে তার স্ত্রী নিঃশব্দে তার পিঠ ঘেসে দাঁড়িয়ে দুহাত দিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরলো আর সাগ্রহে উষ্ণ চুমু খেলো তাকে। এরপর ফারকোটের গলার নরম পশমে মুখ গুঁজে ফিসফিস করে বললো,

– গুস্তাভ এখনো বাসায় আসেনি।

– হ্যা তো, কিছুটা দুর্বল শোনালো ডাক্তার হেন্কের স্বর, দুহাত দিয়ে বৌয়ের চুল বিলি করতে করতে তিনি বললেন, হ্যা, এখন সে বাসায়। 

*

ডাক্তার হেন্কের চেম্বারে ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে। টেবিলে হুইস্কি আর পানি।

জেলাকর্তা রিচার্ড চামড়ায় মোড়ানোসোফায় পা এলিয়ে বসে আছেন আর সিগার ফুঁকছেন। ডাক্তার হেন্ক বসে আছেন জড়োসড়ো হয়ে সোফার এক কোণে। পাশের কক্ষের দরজা খোলা, সেখানে হেন্ক-পত্নী ও বাচ্চারা খ্রিষ্টমাসট্রি সাজাচ্ছে।

ডিনার সেরেছে সবাই প্রায় নিঃশব্দে। শুধু বাচ্চারাই ছিল মুখর ও আনন্দিত।

– তুমি তো কিছুই বলছো না দোস্ত, রিচার্ড বললেন। তুমি কি এখনো বসে বসে তোমার ছিড়ে যাওয়া ওভারকোটের কথা ভাবছো?

– না, উত্তর দিলেন হেন্ক। আমি বরং ভাবছিফারকোটের কথা।

কয়েক মুহূর্তের নীরবতা, তারপর তিনি বলতে থাকলেন:

– আমি অন্য কিছুর কথাও ভাবছি। ভাবছি এটাই শেষ খ্রিষ্টমাস যা আমরা একসাথে পালন করছি। আমি ডাক্তার তাই আমি জানি আমার আয়ু আর বেশিদিন নেই। আমি এখন এ বিষয়ে পুরাপুরি নিশ্চিত। একারণেই আমি তোমাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই এই শেষ সময়ে আমার ও আমার স্ত্রীর প্রতি তোমার সহৃদয় ও বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহারের জন্য।

-ওহো, তুমি আমাকে ভুল বুঝেছো, বলতে বলতে রিচার্ড অন্য দিকে তাঁকান।

– না, হেন্ক বলেন, আমি মোটেও ভুল বুঝিনি। আমি তোমাকে আরো ধন্যবাদ জানাতে চাই এজন্য যে তোমার ফারকোটটি তুমি আমাকে ধার দিয়েছিলে। ওটাই আমাকে আমার জীবনের শেষ তৃপ্তিময় মুহূর্তগুলো উপহার দিয়েছে।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত