| 24 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প ধারাবাহিক

মহানগরের নয়জন নিবাসী(পর্ব-৩০)।ডঃ দীপক কুমার বরকাকতী

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

মিজোরামের আইজল শহরের পদার্থ বিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডঃ দীপক কুমার বরকাকতী (১৯৪৮) অসমিয়া সাহিত্যের একজন সুপরিচিত এবং ব্যতিক্রমী ঔপন্যাসিক। আজ পর্যন্ত আটটি উপন্যাস এবং দুটি উপন্যাসিকা, অনেক ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাছাড়া শিশুদের জন্য দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তারই ইংরেজি ভাষার একটি নতুন দিল্লির চিলড্রেন বুক ট্রাস্ট থেকে ১৯৯২ সনে প্রকাশিত হয়। দেশ-বিভাজন, প্রব্রজন, ভেরোণীয়া মাতৃত্ব (ভাড়াটে মাতৃত্ব), ধর্ম এবং সামাজিক বিবর্তন ইত্যাদি তাঁর উপন্যাসের মূল বিষয়। আলোচ্য ‘মহানগরের নয়জন নিবাসী’উপন্যাসে ১৯৩২ সনে স্টালিনের বিরুদ্ধে লেলিনগ্রাডের নয়জন টলস্টয়বাদী গান্ধিজির অহিংসা নীতির দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে করা আন্দোলনের ছবি ফুটে উঠেছে। তাঁর ইংরেজি ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ দুটি হল From Valley to Valley (Sahitya Akademi, New Delhi, 2010) এবং The Highlanders (Blue Rose Publishers, New Delhi, 2010)। বাংলা ভাষায় অনূদিত গ্রন্থ ‘স্থানান্তর’ (অর্পিতা প্রকাশন, কলকাতা, ২০০৭)। বাসুদেব দাসের অনুবাদে ইরাবতীর পাঠকদের জন্য আজ থাকছে মহানগরের নয়জন নিবাসীর পর্ব-৩০।


(শেষ অধ্যায়)

সময়ঃ ১৯৯০ সালের বসন্তকাল

স্থানঃ মস্কো মহানগর

 

জানুয়ারি মাস থেকে শুরু হওয়া তীব্র শীতের প্রকোপের ধীরে ধীরে অন্ত পড়ল। মে মাস পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বরফ গলতে শুরু করল। বরফের ফাঁকে ফাঁকে স্নো ড্রপ গুলি উঁকি মারতে লাগল। গাছপালায় নতুন কিশলয় গজাল।ফিয়ডরের  ডানবাহুর আঘাত ইতিমধ্যে শুকিয়ে এসেছিল। সে নাটালিয়ার সঙ্গে মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারেই শুধু নয় পার্কেও এমনিতেই বসে থাকতে সক্ষম হল।

বন্ধের দিন।

    পার্কে বয়স্ক মানুষগুলি সেজেগুজে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। রঙ্গিন সাজের ছোটো ছোটো ছেলে মেয়ে গুলি খেলাধুলা করছিল। কোনো একদিকে কয়েকজন পুতুল নাচও দেখছিল। আধবয়সী মানুষগুলি দাবা খেলছিল। ওদিকে পার্কের বাইরে– দূরে দেখা যাচ্ছিল চলতে থাকা ট্রাম এবং বাস।

সেই পার্কে ফিয়ডর এবং নাটালিয়া একটা বেঞ্চে বসে ছিল। মৃদু বাতাসে নাটালিয়ার বাদামী রঙের চুলগুলি একটু একটু উড়তে লাগল। মলয়ার স্পর্শ এসে তার গালে লাগল। কাজল রঙের  দুচোখে সে ফিয়ডরের দিকে তাকাতে লাগল। ফিয়ডরের পাতলা রঙ্গিন মোচের নিচে দুই ঠোঁটে তখন একটা মূল্যবান হাসি ছড়িয়ে পড়ছিল।

নাটালিয়া বলল–’ পার্কে নিজের নিজের পরিচিত মানুষ কতজন আছে হিসেব করে বল।’

ফিয়ডরের লেনিনগ্রাডে কাটানো কৈশোরের কথা মনে পড়ল। সে আনন্দিত মনে সায় দিল।

ফিয়ডরের সুস্থ হওয়াটাই ওদের খুশি হওয়ার একমাত্র কারণ ছিল না। অন্য কারণও ছিল।কয়েকদিন আগে সরকার সমস্ত টলস্টয়বাদী এবং গান্ধীর নীতি অনুসরণকারী কে নিরপরাধ এবং নির্দোষ বলে ঘোষণা করেছে। ফিয়ডরের দাদা লিঅ’নিড এড্লারের নামও তার মধ্যে রয়েছে। তাছাড়া জানতে পেরেছে– হয়তো এক বছরের ভেতরে ওরা আরও অনেক নতুন খবর পাবে। লেলিনগ্রাড মহানগরটি হয়তো সেন্ট পিটার্সবার্গ নামে নামকরণ করা হবে। দেশের অন্যান্য ভূগোলও পরিবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনা যে নেই তা নয়।

দুপুরের সূর্যের উষ্ণতা নিয়ে পরিচিত মানুষের হিসেব করে থাকার সময় ওদের কাছে হাসিমুখে অ’য়িময়াকনে সাক্ষাৎ হওয়া আন্ড্রে এবং সেই বোবা মহিলাটি কখন উপস্থিত হল বুঝতেই পারল না। পরিচিত মানুষজন দেখে বোবা মহিলাটি মুখ দিয়ে কিছু শব্দ করে আনন্দিত মনে হাসতে লাগল।

‘ আন্ড্রে?’– ফিয়ডর এবং নাটালিয়া একসঙ্গে বলল।

‘ হ্যাঁ ,আমি আন্ড্রে।ইনি এখন চিকিৎসা করে সুস্থ হয়ে উঠেছেন । এখন তাকে আমি নিয়ে ইউক্রেনে রেখে আসব।’– সে বলল। 

‘ বলতো তার পরে কি হ’ল। আমরা তো ফিয়ডরের চিকিৎসার জন্য সেখান থেকে তাড়াতাড়ি চলে এলাম।’– নাটালিয়া বলল। 

আন্ড্রে বলতে লাগল। বোবা মহিলাটির চিকিৎসার ব্যবস্থা করে পরের দিন নাকি সে নিকোলাই য়াগুটকিনের বাড়িতে গিয়েছিল। মানুষটা আরাম চেয়ারে বসেছিল যদিও ঘরের জিনিসপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়েছিল।–’ আমি আন্ড্রে মহোদয়’– সে মানুষটাকে বলেছিল। পাগলের মতো হয়ে পড়া বুড়ো মানুষটি নাকি তাকে বোবা মহিলাটির কথা দুবার জিজ্ঞাসা করেছিল। যে মানুষটি তাকে সেই মেয়ে  থাকা অবস্থা থেকে এতদিন রান্নাবান্না করে খাইয়ে পড়িয়ে রেখেছিল তাকে গুলি করার জন্য হয়তো তার অনুশোচনা হয়েছিল । কিন্তু এত ক্রুর  মানুষ একটার অনুশোচনা ? আমি বুঝতে পারিনি। হয়তো নিজের অসুবিধার জন্যই সেরকম ভাব প্রকাশ করেছিল। মানুষটা কিছু বলতে চাইছিল। কিন্তু বলেনি। একবার আপনাদের কথা জিজ্ঞেস করেছিল। তারপর বলেছিল–’ আমি…। মানুষটা আর কিছু বলত না। চুপ করেছিল।’ 


আরো পড়ুন: মহানগরের নয়জন নিবাসী (পর্ব-২৯) । ডঃ দীপক কুমার বরকাকতী


আন্ড্রে বলল–’ পরের দিন খবর নিতে গিয়ে দেখলাম মানুষটা আত্মহত্যা করেছে। অনেক কষ্ট করে দুই নলের বন্দুকটাতেই গুলি ভরে বা পা দিয়ে ট্রিগার টিপেছে। গুলি ভালোভাবে শরীরে লাগেনি কিন্তু রক্তক্ষরণ হয়ে হয়ে মানুষটা মারা গেছে। মানুষটার সামনের দিকে লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়ে থাকা জিনিসপত্রের উপরে ব্যতিক্রম ভাবে একটা খামে অর্ধেক বেরিয়ে থাকা দুটো পুরোনো ছবি দেখতে পেলাম। এই মহিলাটি ইঙ্গিতের সাহায্যে বলছে–’ এই ফোটো দুটি নাকি সেই মানুষটা দেখে কিছু ভাবতে থাকা অবস্থায় তিনবারের মতো দেখেছে।’

‘আন্ড্রে হাতে নিয়ে থাকা পুরোনো খামটা ফিয়ডরের হাতে তুলে দিয়ে বলল–’ এর মধ্যেই সেই ফোটোগুলি আছে।’

ফিয়ডর  কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে খামটা খুলল। তার মধ্যে ছিল বহু পুরোনো সাদা-কালো দুটি ছবি।

অস্পষ্ট ছবিগুলি ফিয়ডর উৎসুকতার সঙ্গে দেখতে লাগল। অনেকক্ষণ পরে তার মুখে ধীরে ধীরে হাসি ছড়িয়ে পড়ল।

সে নাটালিয়ার দিকে ছবিগুলি এগিয়ে দিয়ে বলল–’ দেখ, ফোটোগুলি দেখ।’

ধোঁয়া রঙের হয়ে যাওয়া ছবি দুটি চিনতে নাটালিয়ার কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল। ছবি দুটির একটি ছিল টলস্টয়ের এবং অন্যটি গান্ধীর। একজন বৃদ্ধের এবং অন্যজন কর্মশীল যুবকের। একজনের চোখে দার্শনিক বিষন্নতা এবং অন্যজনের উজ্জ্বল চোখে বিশ্বাস এবং আস্থা।

নাটালিয়া উপলব্ধি করল সেই দর্শন এবং আস্থাই ছিল পিটার যেলেনক’ভ মহাশয়ের মতো টলস্টয় বাদীদের প্রচারের মূল ভিত এবং সেই জন্যই তিনি সহকর্মীদের মধ্যে সেই ছবি দুটি বিতরণ করেছিলেন।

এই ছবি দুটি লেনিনগ্ৰাডের পাশের গ্রামে থাকা মেরিনা ঠাকুমার ঘরের বইপত্রের মধ্যে ওরা দেখতে পেয়েছিল।

ছবি দুটির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্তের ভেতরে তার দেহ- মন- হৃদয় আন্দোলিত হয়ে পড়ল।

‘ও ফিয়ডর ‘– নাটালিয়া ফিয়ডরকে দুই হাতে জোরে জড়িয়ে ধরল–’ সেই মানুষটাও টলস্টয় বাদীদের এই ফোটো দুটি সঙ্গে রেখেছিল?’

তার দুচোখ দিয়ে আনন্দের অশ্রুজল গড়িয়ে এল। সে নিজের অজান্তে ফিয়ডরের গালে চুমু খেল।

তা দেখে ইউক্রেনের বোবা মহিলাটি আনন্দে অধীর হল। সে তার অদ্ভুত কণ্ঠস্বরে হাসতে হাসতে কিছু একটা বলতে লাগল।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত