| 17 এপ্রিল 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

বই সবচেয়ে বড় অস্ত্র । সরকার সোহেল রানা

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

আজ ২৩ এপ্রিল বিশ্ব বই দিবস। পৃথিবীতে এতো এতো দিবসের ভীড়ে বই দিবস আর মানুষ মনে রাখে না বা মনে রাখতে চায় না কিংবা মনে রাখতে পারেন না। বর্তমান সমাজে হাত ধোয়া, মুখ ধোয়া, নাক ছোঁয়া থেকে শুরু করে প্রথম দেখা, প্রথম তাকানো (ভাব খানা এমন যেন আগে অন্ধ ছিলেন এই প্রথম কাউকে দেখলেন!), প্রথম কথা বলা, গোসল, ঘুম-অঘুম সমস্ত কিছুরই দিবস আছে! তাই আজ কাল কিছু দিবসের নাম শুনলেই ঘৃণায় লজ্জায় নিজেকে লতা গুল্ম মনে হয়। অথচ যে দিবস জীবন জাগাতে, মানুষকে প্রকৃত মানুষ করতে, মনুষ্যত্ববোধকে, নিজেকে, নিজের অন্তর -অন্দরকে, মন-মনন-সৃজনকে, বিশ্বজগতকে আলোকিত ও আনন্দময় করে তুলতে পারে; সে দিবসের খোঁজ কে ই-বা রাখেন ! ঠিক যেন ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে’ অথবা আমাদের ‘সময় কই সময় নষ্ট করবার’ মতো বিষয়। কিন্তু তা হবার কথা ছিলো না। এক মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে একজন মহান লেখকের চিন্তা থেকে জাগ্রত হয়েছিল এই বিশ্ব বই দিবসটি।

বিশ্ব বই দিবসের মূল ধারণাটি এসেছে স্পেনের বিখ‍্যাত লেখক ভিসেন্ত ক্লাভেল আদ্রেসের চিন্তা থেকে। আদ্রেসের গুরু ছিলেন স্পেনের আরেক বিখ্যাত লেখক মিডেল দে থের্ভান্তেস। তিনি ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের ২৩ এপ্রিল মারা যান। আদ্রেস গুরুকে স্মরণ করতে ও  শ্রদ্ধা জানাতে  ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রতি বছর ২৩ এপ্রিল বিশ্ব বই দিবস পালন শুরু করেন। অর্থাৎ গুরুর প্রতি শ্রদ্ধার মাধ্যমে নিজের মুক্তির পথ বিনির্মাণ। ঠিক যেন চর্যাপদের প্রথম চর্যার কবি লুইপা এর কবিতার মতো : ‘লুই ভণই গুরু পুছিঅ জানিঅ!’ তারপর দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো ২৩ এপ্রিলকে বিশ্ব বই দিবস ঘোষণা করে। তাই ইউনেস্কোর উদ‍্যোগে প্রতি বছর ২৩ এপ্রিল বিশ্বের অধিকাংশ দেশে বিশ্ব বই দিবস পালিত হয়। ইউনেস্কোর কাছে বিশ্ব বই দিবসের উদ্দেশ্য হলো : বই পড়া, বই ছাপানো, বইয়ের কপিরাইট সংরক্ষণ বিষয়ক জনসচেতনতা বাড়ানো।

কিন্তু ভিসেন্ত ক্লাভেল আদ্রেসের উদ্দেশ্য তা ছিলো না। তাঁর অনেকগুলো উদ্দেশ্যের মধ‍্যে ছিলো: বই পড়ার মাধ্যমে মানুষের আত্মার পরিশুদ্ধি, মুক্তি, চিন্তার বিনিময়, জীবনের আনন্দ উদযাপনসহ আরো নানা চিন্তার সন্নিবেশ। অর্থাৎ বইকে তিনি জীবনের এক অনন্য উপাদান হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইউনেস্কো করলেন তার মতো করে। ঠিক যেমনটি করেছিলেন আমাদের রাষ্ট্র ভাষার দাবিতে পালিত ‘শহীদ দিবস’কে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা’ দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে। আমরা আনন্দে উল্লসিত হয়ে নগ্ন নৃত্য করতে করেছিলাম। এখন নিজেরাই আবার হাহাকার করি! রাষ্ট্র ভাষার আন্দোলন আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল। কিন্তু সেই স্বাধীন রাষ্ট্রে ভাষার সকল ক্রন্দন ও হাহাকার গিয়ে পর্যবসিত হয় সমস্ত ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে। অথচ ফেব্রুয়ারি হবার কথা ছিলো চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে শক্তি সঞ্চয়ের মাস। আমরা ঠিক যে নিজের ভাষার মর্যাদা ও আত্ম-সত্তাকে হারিয়ে ফেলেছি তা-ই নয়; রাষ্ট্রের অপর আপর ভাষাকে (ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষাসমূহকে) করছি ভুলুণ্ঠিত। অথচ নিজের ভাষার শক্তি ও রাষ্ট্রের অপর আপর ভাষার কার্যকর প্রয়োগের মাধ্যমে একটি আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন জাতি রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য ছিলো আমাদের সমস্ত আন্দোলন-সংগ্রাম, ত‍্যাগ ও তীতিক্ষা! আদ্রেসের সেই চিন্তাকেও ইউনেস্কো আপন মহিমায় করেছেন বিনষ্ট। কারণ, বইয়ের চেয়ে বড় অস্ত্র দুনিয়াতে আর কোনো কিছু নাই। বোধসম্পন্ন মানুষ একবার জাগ্রত হলে আর পিছুপা হয় না; প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গ করেন তবুও মুক্তির পথ খুঁজে ফিরে।

কবি হুমায়ুন আজাদ ‘বই’ শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। কবিতাটি কিছুদিন আগেও আমাদের দেশের মাধ‍্যমিক স্তরের পাঠ‍্য ছিলো। কর্তৃপক্ষ এই কবিতাকে পাঠ‍্য তালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন। কেন বাদ দিয়েছেন তার কোনো কারণ ব‍্যাখ‍্যা করেননি; সম্ভবত প্রয়োজনও বোধ করেননি। বই কবিতায় এমন কী ছিলো যে কর্তৃপক্ষ হজম করতে পারলেন না! বই কবিতায় হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন :

 ‘বইয়ের পাতায় প্রদীপ জ্বলে

বইয়ের পাতা স্বপ্ন বলে।

যে-বই জুড়ে সূর্য ওঠে

পাতায় পাতায় গোলাপ ফোটে

সে-বই তুমি পড়বে।

যে-বই তোমায় দেখায় ভয়

সেগুলো কোনো বই-ই নয়

সে-বই তুমি পড়বে না।

যে-বই তোমায় অন্ধ করে

যে-বই তোমায় বন্ধ করে

সে-বই তুমি পড়বে না।

বইয়ের পাতায় পাতায় প্রদীপ জ্বলে

বইয়ের পাতা স্বপ্ন বলে।’

এই কবিতায় কবি হুমায়ুন আজাদ বই নিয়ে যা বলেছেন তা আপাত অর্থে ‘সরল’ মনে হলেও কোনো ক্রমেই তা ‘সরল’ নয়। কবিতার কথাগুলো যতোটা তাৎপর্যপূর্ণ, তারচেয়েও বেশি নিবিড়, গভীর ও আত্মস্পর্শী। কারণ, তিনি বলেছেন, ‘বইয়ের পাতায় প্রদীপ জ্বলে/ বইয়ের পাতা স্বপ্ন বলে।’ সত্যি কি বইয়ের পাতা স্বপ্ন বলে? প্রকৃত বই মাত্রই জীবনের কথা বলে, জীবনের ভাবনাগুলো আলোড়িত করে, জীবনকে নতুন করে ভাবতে শেখায়, জীবনের উদ্দেশ্য ও স্বরূপকে সন্ধান করতে শেখায়। আমরা যা কামনা করি ও আমাদের যা প্রত্যাশা এবং আমাদের যা আকাঙ্ক্ষা– তার সমস্ত কিছুরই কথা বলে। শুধু স্বপ্ন নয়; স্বপ্নগুলো কিভাবে বাস্তব রূপ পাবে তার হদিস দেয়।

মানবজীবনের সার্থকতা কোথায় কিংবা ‘এ জীবন লইয়া কী করিব’-এ জাতীয় ভাবনা যেমন মানুষের মৌলিক জিজ্ঞাসা, তেমনি মানুষের অন্তর্যামীর অনুসন্ধান ও অন্দরের আনন্দ সন্ধানও জীবনের মৌলিক কর্ম। কথা হলো মানুষ কেন বই পড়বে? মানবজীবনে বই পড়ার মাহাত্ম্য কী? সাধারণ ভাবে আমরা খোঁজ করতে পারি যে, মানুষ কেন বই পড়বে তার কারণ। বই পড়লে মানুষের চোখ তৈরি হয়। এই চোখ হলো মানবের অন্তর্দৃষ্টি। শারীরিক চোখ দিয়ে আমরা যা দেখি তা হলো ‘সরলভাবে’ দেখা; উপরে উপরে দেখা। মানবজীবনের জন্য প্রয়োজন গভীরভাবে, নিবিড়ভাবে, অন্তর চোখে দেখা। চোখের দেখা তো হয় প্রতিদিনই কিন্তু তা দেখা নয়; মনের চোখে দেখাই আসল দেখা। তবে বলে রাখা ভালো, বই পড়া ছাড়াও ব‍্যক্তির অন্তর্দৃষ্টি তৈরি হতে পারে; তবে, তার জন্য প্রয়োজন গভীর অনুধ‍্যান, অধ‍্যাবসায়, তপস‍্যা, সাধনা ও আত্মমগ্নতাসহ ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের প্রবল অনুধাবন। এই সমস্ত আয়োজনের সম্মিলন যে কোনো ব‍্যক্তির পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে কিন্তু বই পাঠের মাধ্যমে এই সমস্ত আয়োজনের সারাৎসার পাওয়া সম্ভব।

বই পড়ার অন‍্যতম মাহাত্ম্য হলো আপন ভুবন তৈরি করতে পারা যায়। জাগতিক সমস্ত ঝড়-ঝঞ্ঝার উর্ধ্বে উঠে নিজস্ব একটি জগৎ তৈরি করা যায়। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, ব‍্যক্তিক-জাতিক ব‍্যথাকাতর ও বেদনা স্নিগ্ধ মন নিয়ে সময়ের সঙ্গে পথ চলার উপায় কী? সবথেকে বড় উপায় হলো নিজের ভিতর একটি আপন ভুবন সৃষ্টি করা। সব দেবতারে ছেড়ে প্রাণের দেবতার কাছে পৌঁছে যাওয়া। মনের চোখে দুনিয়া দেখা; শরীরের চোখে নয় আর অন‍্যের চোখে তো নয়-ই। পৃথিবীর সব ‘সভ‍্য জাতি’ যতোই মনের চোখের সংখ্যা বাড়াতে ব‍্যস্ত অথচ আমরা আরব‍্য-উপন‍্যাসের এক চোখা দৈত‍্যের মতো ঘোঁৎ ঘোঁৎ করতে ততোটাই অভ‍্যস্ত। মনের চোখে জগৎ দেখার চেষ্টা করি না।

কিন্তু মনের চোখ না থাকলে কি মানুষ হওয়া যায়? মানুষ হওয়া যায় মানে কী? হাত-পা-চোখ-কান-মাথাসহ শরীরের সব উপাদানই রয়েছে ! তাহলে মানুষ নয় কেন? কারণ, অন‍্য প্রাণির জন্য দরকার কেবল শরীরী চোখ কিন্তু মানুষের জন্য শরীরের চোখের চেয়েও বেশি জরুরি মনের চোখ। জর্জ অরওয়েল, ওয়াল্টার বেঞ্জামিন, এডওয়ার্ড সাঈদ, ফ্র‍্যাঙ্ক ও’কনর, ভার্জিনিয়া উলফ, বাট্রান্ড রাসেলসহ অনেকেই দ্বিধাহীন চিত্তে স্বীকার করেছেন মনের চোখে দেখার কথা। বাট্রান্ড রাসেল তো দৃঢ় ভাবে বলেছেন, ‘সংসারের জ্বালা- যন্ত্রণা এড়াবার প্রধান উপায় হচ্ছে, মনের ভেতর আপন ভুবন সৃষ্টি করে নেওয়া এবং বিপদকালে তার ভিতর ডুব দেওয়া। যে যতো বেশি ভুবন সৃষ্টি করতে পারে, যন্ত্রণা এড়াবার ক্ষমতা তার ততোই বেশি হয়।’

রবীন্দ্রনাথ তো ছিলেন আপন ভুবনের অন‍্যতম স্থপতি। তাই হয়তো তিনি তাঁর সকল সমালোচনা, নিন্দা, গীবত, পরশ্রীকাতরতা–সমস্ত কিছু থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছেন। তাঁর সকল আত্মীয়-স্বজন- পরিজন-মন- মননের সখি-পরমজন- প্রিয়জনদের হারানোর ব‍্যথা ভুলেও তিনি আপন সাধনায় সচল থাকতে পেরেছিলেন। আপন ভুবন তৈরি করে নিজের মতো থাকতে পারাটাই প্রকৃত ব‍্যক্তিত্ব। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘ প্রত‍্যেক মানুষের প্রকৃতিতে স্বতন্ত্রভাবে তার জীবনযাত্রার মূলধন দেওয়া আছে। সেইটিকে অর্থাৎ তাঁর আপন বিশেষ শক্তিকে ঠিকমতো খাটাতে পারলেই তার সার্থকতা। সাধারণভাবে যে-কিছু হিতোপদেশ দেওয়া যায় সে কোনো কাজে লাগে না। নিজেকে একান্তভাবে প্রশ্ন করে নিজের প্রয়োজন বুঝে নেওয়া ছাড়া অন‍্য উপায় নেই।’ রবীন্দ্রনাথের এই কথাটি আপাত অর্থে ‘সরল’ কিন্তু নিবিড় অর্থে অত‍্যন্ত মূল্যবান ও মর্মস্পর্শী। একান্তভাবে নিজেকে চেনা ও জানটাই জীবনের মৌলিক কাজ। আত্ম-সত্তার অনুসন্ধানই মানবজীবনের পরমধর্ম।

তাই নিজেকে চিনার ও জানার অন‍্যতম শ্রেষ্ঠ উপায় হলো বই পড়া। বই মানুষ আপন সত্তার সাথে মুখোমুখি করে। সেই সত্তাকে আমরা মনুষ‍্যত্ব, বিবেক, জীবন দেবতা, বোধ, মনের মানুষসহ নানা নামে অভিহিত করা হয়। সবটাই ঘটে নিজেকে জানার মাধ‍্যমে, নিজের শক্তি ও ধর্ম ও সৌন্দর্য সম্পর্কে অবহিত হবার মাধ্যমে। আর বই মানুষকে সেই পথেই চালিত করে। কিন্তু খুব কম মানুষই নিজেকে চিনতে বা জানতে চেষ্টা করে। কারণ আমাদের চারপাশে নিজেকে বিক্রি করার, নিজেকে পণ‍্য হিসেবে উপস্থাপন করার এতো এতো সুযোগ যে, কেন-ই বা মানুষ বই পড়বে বা নিজেকে জানবে? কারণ, আজকের সমাজে সবকিছুর মানদণ্ড যেখানে অর্থ, ক্ষমতা ও কতৃত্ব সেখানে কজনই বা চায় আপন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে মনুষ্যত্ববোধ সম্পন্ন ব‍্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণ করতে! রবীন্দ্রনাথ এই ব‍্যাপারটি গভীরভাবে লক্ষ্য করে সখেদে লিখেছেন, ‘এখন মানুষ আপনার সকল জিনিসেরই মূল‍্যের পরিমাণ টাকা দিয়ে বিচার করতে লজ্জা করে না। এতে করে সমস্ত মানুষের প্রকৃতি বদল হয়ে আসছে— জীবনের লক্ষ্য এবং গৌরব অন্তর থেকে বাইরের দিকে, আনন্দ থেকে প্রয়োজনের দিকে অত‍্যন্ত ঝুঁকে পড়ছে। মানুষ ক্রমাগত নিজেকে বিক্রি করতে কিছুমাত্র সংকোচবোধ করছে না। ক্রমশই সমাজের এমন একটা বদল হয়ে আসছে যে, টাকাটাই মানুষের যোগ‍্যতারূপে প্রকাশ পাচ্ছে।’ আমাদের সমাজ তাই হয়তো আজ ‘লজ্জা’ শব্দটাই অভিধান চ‍্যূত হয়ে পড়েছে।

আজকের কথিত ‘আধুনিক’ ও শরীর সর্বস্ব স্মার্ট যুগে ভোগ ও উপভোগ-ই যেন জীবনের লক্ষ্য। আর নিজেকে বিকিয়ে দেওয়া এবং বিক্রি করাটাই যেন সর্বশ্রেষ্ঠ যোগ‍্যতা। এই সমাজ থেকে মুক্তির উপায় খোঁজ করেছেন সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী, সৈয়দ মুজতবা আলী, অন্নদাশঙ্কর রায় সহকারী বহু মনীষা। তাঁরা মনে করেন, বই পড়া এবং লাইব্রেরি গঠনের অত‍্যন্ত জরুরি। যে সমাজের মানুষ যতো বেশি বই পড়বে এবং মতো বেশি লাইব্রেরি মুখী হবে সে সমাজে মনুষ‍্যত্ববান মানুষের সংখ্যা ততো বেশি হবে। সে সমাজে অপরাধ ততো কমবে এবং আনন্দময় ও শ্রদ্ধা পূর্ণ সামাজিক সম্পর্ক হবে। কিন্তু আমাদের দেশে তো প্রতিদিন সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হচ্ছে! আশ্চর্যের বিষয়, পৃথিবীর অন‍্যতম বিরল প্রজাতির জাতি আমরা যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করি লাইব্রেরি ছাড়াই। লাইব্রেরি নির্মাণে যেন আমাদের সকল প্রতিবন্ধকতা। আর পুরনো লাইব্রেরি ধ্বংস করা যেন আমাদের সমাজের কথিত উচ্চ শিক্ষিত ‘জ্ঞানপাপী কিছু মানুষের প্রধান কাজ। আমাদের সমাজটা কোথায় গিয়ে যে দাঁড়াবে তা যেন স্বয়ং ঈশ্বর জানেন না ! আমাদের বর্তমান সমাজ বাস্তবতা কতোটা বই বিমুখ তার চিত্র খানিকটা উপস্থাপন করেছিলেন আমাদের প্রাণের কবি জসীমউদদীন। কবি তাঁর ‘আরো বই পড়ুন’ নামক প্রবন্ধে লিখেছেন :

‘দুঃখের কথা আর কত কব? বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষায় স্বর্ণপদকধারী গভর্ণমেন্টের উচ্চকর্মচারীদের বাসায় গিয়ে দেখি, তাঁরা কেউ বই পড়েন না। বৈঠকখানায় নানা ভঙ্গীতে তাঁর অথবা বিবির ফটো টাঙানো। একটি কি দুটি আলমারীতে পিতলের কয়টি পুতলি অতি সুন্দর করে সাজানো। অধিকাংশের বাড়িতে বই নেই। যাঁর বাড়িতে একটি বই-এর আলমারী আছে তাও তালাবদ্ধ। খুলে কোন বই দেখতে চাইলে সেই তালার চাবি কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। বিকাল হলে তাঁরা ক্লাবে গিয়ে ফ্লাশ খেলে অথবা উপরস্থ কর্মচারীর গুণগান করে সময়ের অপব্যয় করে। এই ত গেল গভর্ণমেন্ট কর্মচারীদের ব্যাপার।

বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের শত শত অধ্যাপকের মধ্যে কি দেখেছি? অধ্যাপনার চাকরি পেয়ে দুতিন বছর পড়াশুনা করলে ছাত্র পড়ানোর জন্য আর তাঁদের পড়াশুনার প্রয়োজন হয় না। বছরের ছয়মাস তাদের ছুটি -এই সুদীর্ঘ সময় এবং প্রতিদিনের অধিকাংশ সময় তাঁরা কিভাবে ব্যয় করেন? তাস পিটিয়ে বা ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে নানা জটলা পাকিয়ে অথবা পরস্পরের ছিদ্র অনুসন্ধান করে। অবশ্য দু’একজন অধ্যাপক যে পড়াশুনা করেন না সে কথা বলছিনা। আপনারা নিজেরাই সন্ধান করে দেখবেন ডাক্তার বা পিএইচডি খেতাবধারী বহু অধ্যাপক আছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ তিরিশ বছর ধরে তাঁরা শিক্ষাকার্যে বহাল আছেন; কিন্তু এই সময়ের মধ্যে তাঁদের কোনই মৌলিক গবেষণা নাই।’ গবেষণা তো দূরের কথা বই ক্রয়ের অর্থ আত্মসাৎ করা যেন এ সমাজের ফরজ কাজ। তাই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ভাষায় ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’- এর এই যুগে ব‍্যক্তিগত ভাবে সুস্থ, সুন্দর, নির্মল, মাধুর্যময়, প্রাণোচ্ছ্বল, মনন ও সৃজনশীল জীবন যাপনে বই পড়ার বিকল্প নেই। সামষ্টিক ও নৈর্ব্যক্তিক ভাবে একটি সভ‍্য, সুন্দর, শ্রদ্ধা পূর্ণ ও সৌন্দর্যময় সমাজ বিনির্মাণে বই পড়ার বিকল্প নেই। তাই বই ক্রয় ও বই পড়া হোক আমাদের প্রাত‍্যহিক জীবনের নিত‍্য কর্ম। তবে, নিশ্চয়ই, যে বই আলোকিত করে সেই বই পড়া ও ক্রয় উচিত। আসুন বই পড়ি, সুস্থ, সুন্দর, নির্মল, ও মাধুর্যময় জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ি।

 

 

 

লেখক: সরকার সোহেল রানা।
সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সিলেট

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত