| 13 ডিসেম্বর 2024
Categories
গীতরঙ্গ

২৬ মার্চ সংখ্যা: পূর্ব পাকিস্তান । মোস্তফা কামাল

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

শেখ মুজিব রুমের মধ্যে পায়চারি করছেন। কঠিন এক যন্ত্রণা তাঁকে পীড়া দিচ্ছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং তাঁকে হত্যার যে নীলনকশা হয়েছে, তা তিনি মন থেকে দূর করতে পারছেন না। নানা নেতিবাচক চিন্তা তাঁর মনটাকে দুর্বল করে দিচ্ছে।

তিনি মন শক্ত করার চেষ্টা করছেন। মনের সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করে চলেছেন। এ সময় তাঁর রুমের সামনে এসে দাঁড়ালেন এক সেনা কর্মকর্তা। শেখ মুজিব সেনা কর্মকর্তার দিকে তাকাতেই তিনি সালাম দিয়ে তাঁর কাছে এগিয়ে গেলেন। তারপর উর্দুতে বললেন, আপনাকে একটা খবর দিতে এসেছি।

শেখ মুজিব লোকটার দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি মনে মনে ভাবেন, এখানে সবাই কি উর্দুভাষী? কোনো বাঙালি কর্মকর্তা-সৈনিক রাখা হয়নি? বাঙালি কাউকে ডিউটিতে দিলে সে আমার সঙ্গে বসে ষড়যন্ত্র করবে? বাঙালি বিশ্বাসঘাতকতা করবে! এখন পর্যন্ত কাউকে পেলাম না, যে বাংলায় কথা বলে! মেস এলাকায় রেডিওতে কোনো বাংলা খবর কিংবা গান শুনিনি। এখানে কোনো সংবাদপত্র দেওয়া হয় না। আমাকে বাইরের কোনো খবর জানতে দেওয়া হয় না। কত দিন ধরে আছি, অথচ একটা দিন বাঙালির হাতে রান্নাও খেলাম না। শুনতে পেলাম, বাবুর্চি পাকিস্তান থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। পাকিস্তানি কায়দায় মাংস পাকায়। সেই মাংস রুটি দিয়ে আমাকে খেতে হয়। এখানে আমি যে শুধু মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে আছি তা নয়, খাওয়ার কষ্টও পাচ্ছি। অনেক বলা-কওয়ার পর ভাত দেওয়া হয়েছিল। কয়েক দিন দেওয়ার পর আবার বন্ধ হয়ে গেল। কেন বন্ধ হলো, কিছুই বুঝলাম না।  

শেখ মুজিবকে চুপ থাকতে দেখে উর্দুভাষী কর্মকর্তা আবার বললেন, আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? আপনাকে একটা খবর দিতে এসেছি।

শেখ মুজিব ধরা গলায় বললেন, কী খবর? আমার বিচারকাজ শুরু হচ্ছে?

সেনা কর্মকর্তা বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, আরে! আপনি এ কথা জানেন কী করে!

শেখ মুজিব বললেন, জানি বললে ভুল বলা হবে, আমি ধারণা থেকে বলছি।

সেনা কর্মকর্তা বললেন—জি, আপনি ঠিকই ধারণা করেছেন। আগামীকাল (১৯ জুন) আপনার বিচারকাজ শুরু হচ্ছে।

শেখ মুজিব বললেন, আর কিছু বলবেন?

জি না।

সেনা কর্মকর্তা আর কোনো কথা না বলে চলে গেলেন। শেখ মুজিব বিছানার ওপর বসলেন। তারপর পাইপ ধরালেন। পাইপে কিছুক্ষণ পর পর টান দেন। তিনি মনে মনে ভাবেন, কত দিন হলো রেণুর সঙ্গে দেখা নেই। ছেলে-মেয়েরা যে কেমন আছে! ওদের জন্য মনটা কেমন যেন করছে। ষড়যন্ত্রের মামলা আর প্রহসনের বিচার! আগে থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েই আমাকে মামলায় ঢোকানো হয়েছে। একমাত্র বিধাতা ছাড়া আমাকে রক্ষা করার কেউ নেই।

শেখ মুজিবের পাশের খাটের সেনা কর্মকর্তা জাফর ইকবাল চোখ পাকিয়ে তাঁর দিকে তাকান। তাঁর পাইপ টানার দৃশ্য দেখেন। মুচকি মুচকি হাসেন। আবার অন্যদিকে তাকান। তাঁর হাবভাব দেখে মনে হয়, শেখ মুজিবকে চিন্তিত দেখে তিনি মজা পাচ্ছেন। একপর্যায়ে তিনি বলেই বসলেন, খুব টেনশনে আছেন মনে হয়!

শেখ মুজিব কোনো কথা বললেন না। তিনি আপন মনে পাইপ টানছেন। মুজিব ভেবেছিলেন, তিনি চুপ থাকলে ওই সেনা সদস্য কথা বলা বন্ধ করবেন। কিন্তু তিনি থামলেন না। তিনি বকবক করতেই থাকলেন। একপর্যায়ে তিনি বললেন, বিচারে আপনার কোর্ট মার্শাল হতে পারে।

শেখ মুজিব এবার আর চুপ থাকতে পারলেন না। তিনি বললেন, তার মানে সিদ্ধান্ত আগে থেকেই নেওয়া আছে? তাহলে আর লোক-দেখানো শুনানির দরকার কী?

লোকটা আর কথা বললেন না। তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দার দিকে গেলেন। মুজিব নিজের বিছানার ওপর বসে পাইপ টানছেন। তিনি মনে মনে ভাবেন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আমার সঙ্গে আরো যাদের জড়ানো হয়েছে তারা কোথায়? তাদেরও কি ক্যান্টনমেন্টে রাখা হয়েছে! আমার সঙ্গে তাঁদেরও কি কাল বিচারকাজ শুরু হবে!

শেখ মুজিব বিছানার ওপর টান টান হয়ে শুয়ে থাকেন। রাজ্যের ভাবনা চারদিক থেকে তাঁর মাথায় জেঁকে বসে। তিনি চোখ বন্ধ করে আছেন। এ সময় লোকটি রুমে এসে লাইট জ্বালান। লাইটের আলোতে শেখ মুজিবের চোখের পাতা কেঁপে উঠলে তিনি বলেন, আপনি কি ঘুমিয়ে পড়েছেন?

শেখ মুজিব বিরক্তির সঙ্গে বললেন, কেন, আর কোনো নতুন খবর পেয়েছেন নাকি? 

লোকটি বিব্রত হয়ে বলেন, জি না। সরি! বলছিলাম যে আপনি ঘুমাতে চাইলে খেয়েদেয়ে ঘুমান।

শেখ মুজিব আর কিছু না বলে আবার চোখ বন্ধ করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের ঘোরে তিনি দেখেন, ফজিলাতুন্নেছা রেণু তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। তাঁর সঙ্গে ছেলে-মেয়েরাও এসেছে। তাদের কাছে পেয়ে শেখ মুজিব আবেগপ্রবণ হয়ে যান।

শেখ মুজিবের বিচার শুরু হয়েছে। সেই খবর ফজিলাতুন্নেছা রেণুর কাছে পৌঁছেছে। মামলা পরিচালনার খরচ চালানোর দায়িত্ব বর্তায় ফজিলাতুন্নেছার ওপর। আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান খান, মিজানুর রহমান চৌধুরী, আমেনা বেগম প্রমুখ টাকা দিতে গড়িমসি করেন। তাই ফজিলাতুন্নেছাকেই অর্থ জোগাতে হয়। তিনি মামলা শুরু হওয়ার আগেই অ্যাডভোকেট সালাম খানকে অগ্রিম কিছু টাকা দিয়েছেন। পরবর্তীকালে কিভাবে তাঁকে টাকা দেবেন, তা নিয়ে তিনি চিন্তায় পড়েন। তিনি মনে মনে ভাবেন, সংসার চালাতেই আমাকে হিমশিম খেতে হয়! উকিলদের টাকা দেব কোথা থেকে? টাকা দিতে না পারলে যদি তারা কোর্টে যাওয়া বন্ধ করে দেয়! তখন কী হবে! আল্লাহ তুমি রহমত করো!

গভীর রাত। ফজিলাতুন্নেছা হঠাৎ ঘুম থেকে লাফিয়ে ওঠেন। তিনি শেখ মুজিবকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। তার পর থেকে তাঁর বুকের মধ্যে ধড়ফড় করছে। তিনি স্বপ্নে দেখেন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে একতরফা রায় দিয়েছে আইয়ুবশাহির সামরিক আদালত। সেই রায়ে শেখ মুজিবের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। তিনি চিত্কার দিয়ে বললেন, না! না! এ হতে পারে না। একটা সাজানো মামলার রায়ে মুজিবের ফাঁসির আদেশ মানি না। আমরা প্রতিবাদ করব। সারা দেশে প্রতিবাদের আগুন জ্বলবে। নজরুল ভাই কোথায়! আমেনা বেগম কোথায়! সারা দেশে প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করেন।   

কিছুক্ষণ পর ফজিলাতুন্নেছার ঘোর কাটল। তিনি কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসলেন। মনে মনে ভাবেন, এসব আমি কী দেখলাম! মুজিবের ফাঁসির আদেশ! আমি কী সব আজেবাজে চিন্তা করছি! আমাদের সঙ্গে বড় বড় আইনজীবী আছেন। তাঁরা নিশ্চয়ই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়বেন। এত চিন্তার কী আছে!

ফজিলাতুন্নেছা আবার বিছানায় শুয়ে পড়লেন। তিনি ঘুমানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর ঘুম আসছে না। তাঁর সব ভাবনাজুড়ে শেখ মুজিব।

দুই.

প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান নিজের দপ্তরে বসে গভর্নর মোনেম খানের কাছে টেলিফোন করলেন। কিন্তু নেটওয়ার্ক বিজি। বেশ কয়েকবার ফোন করেও তাঁকে পাওয়া গেল না। তিনি বিরক্ত হয়ে নিজের রুমের মধ্যেই পায়চারি করেন। কিছুক্ষণ পর আবার তিনি মোনেম খানের ফোনে চেষ্টা করেন। একই অবস্থা, এঙ্গেজ টোন।

আইয়ুব খান মনে মনে ভাবেন, মোনেম খান এত সময় কার সঙ্গে কথা বলছেন? জরুরি ভিত্তিতে তাঁর সঙ্গে কথা বলা দরকার। তাঁর সঙ্গে কথা না বলা পর্যন্ত আমি কোনো কাজে মন বসাতে পারছি না। আমার উদ্বেগ সম্পর্কে আমার স্টাফরা জানুক তা আমি চাই না। মোনেম খান আমার কাছের মানুষ। মরে গেলেও সে কোনো কিছু ফাঁস করবে না। কিন্তু কর্মকর্তাদের কোনো বিশ্বাস নেই। আমি ক্ষমতা থেকে চলে গেলেই আর আমাকে চিনবে না!

আইয়ুব খান সোফায় হেলান দিয়ে বসলেন। তারপর সিগারেট ধরালেন। কয়েকবার টান দিয়ে হাতের সিগারেট অ্যাশট্রের ওপর রাখতে রাখতেই টেলিফোনের রিং বাজার শব্দ পেলেন। তিনি ফোন ধরার জন্য এগিয়ে গেলেন। হ্যালো বলতেই টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে মোনেম খানের কণ্ঠস্বর টের পেলেন। স্লামুআলাইকুম, স্যার। একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর আছে, স্যার।

আরে রাখেন আপনার গুরুত্বপূর্ণ খবর! আপনার ফোন এত সময় কেন এনগেজড ছিল সেটা বলেন? কেন আপনাকে পাওয়া যায়নি?

সরি, স্যার। আপনি ফোন করেছিলেন?

প্রশ্ন করবেন না। আমি আপনাকে প্রশ্ন করেছি। তার জবাব দিন।

সরি, স্যার। জেনারেল সাহেব ফোন করেছিলেন।

কোন জেনারেল ফোন করেছেন?

সেনাপ্রধান, স্যার।

তাঁর সমস্যা কী?

স্যার, উনি পূর্ব পাকিস্তানের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিলেন।

আপনি কী বললেন?

স্যার, শেখ মুজিবের বিচার শুরু হওয়ার পর পরিস্থিতি কেন জানি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

বলেন কী!

তা-ই মনে হচ্ছে, স্যার। মানুষ বোধ হয় ভালোভাবে নিচ্ছে না।

আপনি যে বললেন, শেখ মুজিবকে সাইজ করতে পারলেই সব ঠিক হয়ে যাবে!

জি, স্যার। এত দিন তো নিয়ন্ত্রণেই ছিল, স্যার।

তাহলে এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় কিভাবে? আপনারা কী করেন?

আমরা তো স্যার চেষ্টা করছিই। আমার মনে হয় শেখ মুজিবকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসানো ঠিক হয়নি।

এ কথা আগে বলবেন না!

স্যার, আমি তো ভাবছিলাম, আপনি বুঝেশুনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তা ছাড়া আপনার সিদ্ধান্ত আমি অমান্য করি কী করে!

মান্য কিংবা অমান্য করার বিষয় না। আপনি আমার নিজের লোক। আমি যদি কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিই, তাহলে সঠিক পরামর্শ দেওয়াও আপনার দায়িত্ব!

জি, স্যার।

এখন কী করা উচিত, সেটা বলুন।

স্যার, আমার মনে হয় হার্ডলাইনে যাওয়া ঠিক হবে না।

এত দিন পর আপনি বলছেন হার্ডলাইনে যাওয়া ঠিক হবে না। গুলি একবার ছুড়লে আর ফেরানো যায়!

এখনো তো গুলি ছোড়েননি, স্যার!

মানে!

আপনি তো মুজিবকে ফাঁসি দিতে চেয়েছিলেন!

ইয়াহিয়া, আপনি এ রকম পরামর্শই তো দিয়েছিলেন!

স্যার, সিদ্ধান্তটা পুনর্বিবেচনা করা দরকার।

কী করলে ভালো হয়?

মুজিবকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনায় বসেন, স্যার।

এত দিন পর আপনি এখন এসব কথা কেন বলছেন?

স্যার, বেআদবি মাফ করবেন। আপনি, আমি; আমরা সবাই চাই অখণ্ড পাকিস্তান।

তো!

শেখ মুজিবকে ফাঁসি দিলে দ্রুতই পাকিস্তান ভাঙবে।

তাহলে এখন কী করতে হবে?

শেখ মুজিবকে আপনি আলোচনায় ডাকেন। আপনি ডাকলে সে রাজি হতে পারে।

ঠিক আছে, দেখি কী করা যায়। শোনেন, আইন-শৃঙ্খলার যেন কোনো অবনতি না হয়!

জি, স্যার। দেখছি স্যার। আর একটা কথা, স্যার—সেনাবাহিনী যেন সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থাকে।

থাকবে, অবশ্যই থাকবে। আর বি কেয়ারফুল! এ সময় কোনো রকম ভুল করা যাবে না।

জি, স্যার।

টেলিফোনে কথা বলা শেষ করে আইয়ুব খান সোফায় হেলান দিয়ে বসেন। সিগারেট ধরিয়ে কয়েকটা টান দেন। তারপর সেনাপ্রধানকে নিজেই ফোন করে ডাকেন। আবার তিনি সিগারেটে টান দেন। মোনেম খানের কথাগুলো তাঁকে ভাবিয়ে তোলে। তিনি মনে মনে বলেন, শেখ মুজিবকে বৈঠকে কী প্রস্তাব দেব তাকে? তা ছাড়া প্যারোলে মুক্তি নিয়ে সে কি বৈঠকে আসতে রাজি হবে? তা ছাড়া তাকে মানাতে হলে আমারও তো কিছু ছাড় দিতে হবে! কী ছাড় দেব? ছয় দফার প্রস্তাব থেকে সে কি সরে দাঁড়াবে? দেখি ইয়াহিয়া কী বলে? তার কাছে বিকল্প প্রস্তাবও থাকতে পারে।

আইয়ুব খান রুমের মধ্যে পায়চারি করেন। তাঁর ভাবনাজুড়ে শেখ মুজিবের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি ঘুরপাক খায়। তাঁর মাথায় কিছুই ধরছে না। কী প্রস্তাব দিলে শেখ মুজিবকে রাজি করানো যাবে তা-ও বুঝতে পারছেন না। ইয়াহিয়া এত দেরি করছে কেন?

আইয়ুব খান নিজের চেয়ারে বসে কলিংবেল চাপেন। সঙ্গে সঙ্গে পিএস সাহেব রুমে ঢোকেন। তাঁকে তিনি বলেন, ইয়াহিয়া আসামাত্র আমার রুমে পাঠিয়ে দেবেন। মোটেও দেরি করবেন না।

পিএস সাহেব জি, স্যার বলে রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমে যাবেন, ঠিক তখনই ইয়াহিয়া খান এসে হাজির হলেন। তাঁকে দেখেই পিএস সাহেব বললেন—স্যার, আপনার জন্যই অপেক্ষা করছেন স্যার। ঢুকে পড়েন।


আরো পড়ুন: ২৬ মার্চ সংখ্যা: ভানুমতী । শাহ্‌নাজ মুন্নী


ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট সাহেবের রুমে ঢুকে সেল্যুট করলেন। প্রেসিডেন্ট সাহেব সেল্যুটের জবাব দিয়ে বললেন, আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি। এত দেরি করলেন কেন?

সরি, স্যার। আমি একটা মিটিংয়ের মধ্যে ছিলাম। আপনার ফোন পেয়ে চলে এলাম, স্যার।

শোনেন, একটা বড় সমস্যায় পড়েছি। আপনার পরামর্শ খুব দরকার। খুব ভেবেচিন্তে পরামর্শ দেবেন।

জি স্যার। সমস্যাটা কী স্যার পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে?

হ্যাঁ।

আমিও তা-ই ধারণা করছিলাম।

শেখ মুজিবকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি করার পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে। দিন দিন পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। গভর্নর সাহেব ফোন দিয়ে জানালেন, পাকিস্তানকে টেকাতে হলে তাড়াতাড়ি মুজিবের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। আপনার কী পরামর্শ? আমার কি মুজিবের সঙ্গে আলোচনায় বসা উচিত?

স্যার, ইতিমধ্যেই মামলা কোর্টে উঠেছে। সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। এই পরিস্থিতিতে তাঁর সঙ্গে বৈঠকে বসা মানে নতি স্বীকার করা।

তা তো বটেই। তার পরও বৃহত্তর স্বার্থে যদি বৈঠকে বসতে হয়! কিছু ছাড় না দিলে তো সে বসতে রাজি হবে না।

তা আপনি বসতে পারেন। তবে আমি মনে করি, আপনি শক্তই থাকেন।   

আমি তো শক্তই আছি। তবে গভর্নর সাহেব যা বলল, তাতে খুব বেশি শক্ত থাকার সুযোগ বোধ হয় নেই।

স্যার, আমি তো টাইম টু টাইম খোঁজখবর নিচ্ছি। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমি আমার বাহিনীকে প্রস্তুত রেখেছি। তারা সতর্ক আছে। আর আপনি যেহেতু বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কোনো অসুবিধা নেই। আপনি বসেন।  

ধন্যবাদ। আপনি তাহলে যান। সব দিক খেয়াল রাখেন।

জি স্যার।

ইয়াহিয়া খান চলে গেলেন। আইয়ুব খান বৈঠকের বিষয় নিয়ে ভাবেন। শেখ মুজিবকে কতটুকু কী ছাড় দেবেন, তা নিয়ে নানা রকম চিন্তাভাবনা করেন।  

আইয়ুব খান ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠলেন। তিনি জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। তাঁকে ঘাম দিয়েছে। শরীরটা ঘামে চুপচুপে হয়ে গেছে। তিনি ফ্যানের দিকে তাকিয়ে দেখেন, ফ্যান চলছে। তার পরও কেন ঘাম দিল! মনে মনে ভাবেন তিনি। তিনি বিছানা থেকে উঠে পাশে রাখা জগ থেকে এক গ্লাস পানি খেলেন। তারপর খাটের ওপর বসে ভাবেন—এসব আমি কী দেখলাম! পাকিস্তান দুই খণ্ড হয়ে গেছে! না, না! আমি বেঁচে থাকতে তা হতে দেব না। পাকিস্তান ভাঙতে দেব না। শেখ মুজিবকে ফাঁসিতে লটকালে কি পাকিস্তান রক্ষা হবে! গভর্নর যে বলল, তাতে পাকিস্তান দ্রুত দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাবে! মোনেম খান সঠিক তথ্য দিচ্ছে তো! যদি তা-ই হয়, তাহলে শেখ মুজিবকে ট্র্যাপে ফেলতে হবে। মিথ্যা প্রবঞ্চনা দিয়ে তাকে ছয় দফার দাবি থেকে সরিয়ে আনতে হবে।

আইয়ুব খান তখনই মোনেম খানের কাছে ফোন করলেন। সাতসকালে টেলিফোনের রিং বাজার শব্দ পেয়ে লাফিয়ে উঠলেন মোনেম খান। তিনি দৌড়ে গিয়ে ফোন ধরলেন। আইয়ুব খানের কণ্ঠস্বর শুনে তো আরো অবাক। স্যার স্যার করে মুখে ফেনা তুললেন।

আইয়ুব খান বললেন, আগে আমার কথা শোনেন, তারপর স্যার স্যার বলেন।

জি স্যার, জি স্যার!

আজ ভোরবেলা আমি খুব খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। আমি স্বপ্নে দেখি, পাকিস্তান দুই ভাগ হয়ে গেছে! আপনি আজ সকালেই আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁদের জানান, আমি শেখ মুজিবের সঙ্গে বৈঠক করতে চাই।

ঠিক আছে, স্যার। আমি বৈঠকের বিষয় নিয়ে কথা বলব। তবে তার আগে আপনি ঢাকায় আসেন। আপনি এখানে এলে পরিস্থিতি অন্য রকমও হতে পারে।

তাই! ঢাকায় গেলে পরিস্থিতি অন্য রকম হবে!

হতে পারে, স্যার। আপনাকে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ খুব পছন্দ করে।

ঠিক আছে, তাহলে আপনি আমার ঢাকা সফরের ব্যবস্থা করুন।

জি, স্যার।

আইয়ুব খান টেলিফোন রেখে বিছানার ওপর বসলেন। তিনি স্থির হয়ে কিছুক্ষণ ভাবলেন। তাঁর নিজের কাছেও ঠিক ভালো ঠেকছে না। একদিকে তাঁর নিজের লোক জুলফিকার আলী ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে, অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। আমার পায়ের তলা থেকে কি মাটি সরে যাচ্ছে!

 

 

 

 

কৃতজ্ঞতা: কালের কন্ঠ

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত