তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা গল্প: স্বীকৃতি । পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায়
মেয়ে দু চক্ষের বিষ ছিল সবিতার। বিয়ের এক বছরের মধ্যেই বাচ্চা এল পেটে। শ্বশুর কূলের সকলের প্রথম সন্তানই ছেলে। সবিতার খুব আশা ছিল যে ওরও ছেলেই হবে। অথচ ধড়াস করে হল একটা হোত্কা কালো মেয়ে। বুকের দুধ্টুকু দেওয়া ছাড়া মেয়েকে কোনোদিন ছুঁয়েও দেখেননি। ঠাকুর্দার হাতেই মেয়ে বড় হল।
মেয়ে বড় হলে যখন ঋতুমতী হল, তখন তাকে ন্যাকড়া পরাটাও শিখিয়েছে কাকিমা। মেয়েকে দেখলেই জ্বলে যান সবিতা। ধুমসো কালো মেয়েটা তার নিজের পেট থেকে বেরিয়েছে ভাবলেই রাগ হয়ে যায়।
মেয়ে পরীক্ষা দিতে যাবার আগে প্রণাম করতে গেলে পা দিয়ে এমন ঝটকা দেন যে মেয়ে ছিটকে যায়।
মেয়ের নাম বনলতা। ঠাকুর্দা আদিখ্যেতা করে এমন কাব্যি করে নাম দিয়েছে। নাতনিকে আদর করে বলেন, তুই কালো নাকি? তুই তো বনের লতার মত সবুজ। কৃষ্ণের গায়ের রঙও এরকম ছিল। দেখলে চোখ স্নিগ্ধ হয়। কখনও নাতনির মন ভার দেখলে বলেন, তোর মা তোকে ওরকম মিছিমিছি বলে। মায়ের নজর লাগে কি না তাই। তুই আবার মোটা নাকি? বনের লতা যেমন সতেজ সরল স্বাস্থ্যবতী, তুই ঠিক তেমন। এমনি এমনি তোকে বনলতা নাম দিয়েছি নাকি ?
বনলতা মাকে ভয় পায়। ত্রিসীমানায় আসতে চায় না। নিজের ঘরে বসে পড়াশুনা করে আর পরীক্ষা দেয়। সব বিষয়ে প্রথম। সব ক্লাসে প্রথম। মা খবর পায়। মুখ বেঁকিয়ে বলে, গুচ্ছের নম্বর পেয়ে হবে টা কী শুনি? নম্বর দেখে বিয়ে হবে?
বনলতা কখনও একটু পাউডার মাখলে বলেন, লজ্জাও নেই মেয়েটার। কালো অঙ্গে সাদা পাউডার যে ফুটে ফুটে বেরোচ্ছে। সাদা পাউডার মেখে ফর্সা হবি নাকি? মেয়ে কখনও নীল গোলাপী লাল সবুজ এসব রঙ পরতে পায় না। মা বলেন, তোকে মানাবে না। সাদা ঘিয়ে বাসন্তী রঙ ছাড়া মেয়ে অন্য কিছু পরতে পায় না।
বনলতা শুভ্রবর্ণা তন্বী মাকে দেবীর মত দূর থেকে ভক্তি করে, ভয় পায়। মায়ের সামনে কখনও পড়ে গেলে নিজেকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। নিজেকে অপরাধী মনে হয়। ভাবে, আমি মাকে বড্ড লজ্জায় ফেলে দিয়েছি গো ঠাকুর। এমন শুক্লবরণী সরস্বতীর মত মাকে এমন একটা স্থূল কালো মেয়ে দিয়েছ। মেয়ে অনেক ডায়েট করে ব্যায়াম করে। ভাবে, কালোকে ফর্সা করা না যাক, মোটাকে রোগা তো করা যায়।
সে ফল হাতে হাতে ফলে। বেবি ফ্যাট ঝরে গিয়ে এখন তার শরীর সত্যিই যেন সতেজ স্বাধীন লতা। কিন্তু দুর্দান্ত রেজাল্ট করেও তার হীনমন্যতা কাটে না। চলনে বলনে আত্মবিশ্বাস ফোটে না। কী করে ফুটবে? তাকে সারাক্ষণ দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে দেয় যে তার সবচেয়ে আপনজন,তার মা।
এই আত্মবিশ্বাসের অভাবের জন্য তার বন্ধুও হয় না তেমন। সাজগোজ করে কলেজে আসা সুন্দর মেয়েদের দূর থেকে মুগ্ধ হয়ে দেখে। অন্য মেয়েরা তাকে ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী হিসেবে প্রায় শ্রদ্ধার চোখে দেখে। কিন্তু বন্ধু হয় না। কিছু না বুঝতে পারলে এসে বুঝে যায়। ক্যান্টিনে দল বেঁধে খেতে যাবার সময়ে ডাকে না। বলে,ও ভালো মেয়ে। ও এখন লাইব্রেরীতে পড়াশুনা করবে।
এই করতে করতে বইই হয়ে যায় তার বন্ধু। দেশ বিদেশের বিজ্ঞানের নানা পত্র পত্রিকা পড়ে। একদিন কী মনে হতে কিছু বিজ্ঞান বিষয়ক সূত্রের নিজস্ব ভাবনা সে পাঠিয়ে দেয় এক বিজ্ঞানের পত্রিকায়। কয়েক মাসের মধ্যে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে এক মেল আসে। সে লেখা ছাপা তো হবেই। আরো লেখা পাঠাতেও সেই পত্রিকার তরফে অনুরোধ করা হয়েছে।
বনলতা বহির্বিশ্ব থেকে এই স্বীকৃতি পেয়ে বেশ উৎসাহিত হল। প্রচুর লিখতে লাগল। ওরা শুধু ছাপেই না। অনেক টাকাও দেয়। কলেজের অধ্যাপক অধ্যাপিকারা এমনিই ওকে স্নেহ করত। এখন আরো মনোযোগ দিল। এই করতে করতে কলেজ জীবনের শেষ ধাপও অত্যন্ত গরিমার সঙ্গে উত্ড়ে গেল। কিন্তু মা আর উচ্চশিক্ষা নিতে দেবেন না। বললেন, আর পড়িয়ে হবে কী? এই কালো মেয়ে পার করতে কত বিড়ম্বনা হবে। কত টাকা ঢালতে হবে। কে যে পছন্দ করবে! বরং পাত্র দেখা শুরু হোক।
পাত্রপক্ষ আসে আর যায়। একে তো কালো বলে কারুর পছন্দ হয় না। তার ওপর রেজাল্ট শুনে বলে, ও বাবা , এত বিদ্যেবতী নিয়ে কী করব? এ মেয়ে তো আমার ছেলের মাথার ওপর দিয়ে হাঁটবে। আমার ছেলে সাদামাটা রেজাল্ট করা মানুষ। ও তো তাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করবে।
বাড়ির সকলে বলে,আমাদের মেয়ে সেরকম নয় গো।শান্ত। বিনীত। মোটে উদ্ধত নয়।
কিন্তু তারা মিষ্টি খেয়ে চলে যায়। খবর দেয় না আর।
সবিতা মেয়ের ওপর আরো রেগে ওঠেন। চুলের ঝুঁটি ধরে ঝাঁকিয়ে বলেন , বই পড়ুনী লিখুনী মেয়ে, এবার বর কোত্থেকে জুটবে শুনি? একটা বিদ্যাদিগগজ ধরে আনো গে।
কখনও আবার বাড়ির লোকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলেন, ওর রেজাল্টের কথা চেপে গেলেই হয়। কলেজ পাস করেছে। ব্যস। এর চেয়ে বেশি কথার দরকার নেই। ওসব লম্বা চওড়া গল্প সুন্দরী মেয়েদের মানায়। ছেলেরা যেচে আসে তাদের বিয়ে করতে।
উচ্চশিক্ষা বন্ধ হয়ে গিয়ে বনলতা ভেঙে পড়েছিল। কিন্তু বিয়ে না লাগায় সে যেন একটু স্বস্তিই পায়। মায়ের মুখ আরো বেড়ে গেছে। তবুও কোথায় না কোথায় অচেনা বাড়ির অজানা ছেলের কাছে অপমানিত হবার চেয়ে নিজের বাড়িতে তবু তো কিছু ভালোবাসার মানুষ আছে।
আত্মমগ্ন বনলতা জানত না যে, স্যার ম্যাডামদের চেষ্টায় তার নাম বেশ ছড়িয়ে পড়েছে। এক সাংবাদিক হঠাত একদিন এক বিখ্যাত দৈনিকে দারুণ রেজাল্ট করা ছাত্রীর উচ্চশিক্ষা বন্ধ হয়ে যাবার করুণ কাহিনী লিখে ফেলল। লিখল এই দেশের কত সম্ভাবনাময় ছাত্রীর পড়া বাড়ি থেকে বন্ধ করে দিচ্ছে শুধু মেয়ে বলে। শুধু মেয়ে বলে তার জন্য বিয়েই নির্ধারিত।
মিডিয়ার চাপে কপাল খুলল বনলতার। আবার লেখাপড়ার দরজা গেল খুলে। এদিকে এক সংস্থা দুর্গাপুজোর সময়ে শুরু করল এক নতুন ধারার পুরস্কার। জগত্তারিনী পুরস্কার। কোনো না কোনো ভাবে স্বনামখ্যাত তরুণীদের মায়েদের এই পুরস্কার দেওয়া হবে। সেই স্বনামখ্যাত তরুণীদের তালিকায় কী করে যেন উঠে গেল বনলতার নাম।
বনলতার মাকে যেতে হবে পুরস্কার নিতে। বনলতা ভয়ে ভয়ে মাকে কিছু বলতেই পারে না। কে জানে মা আবার কত কথা শোনাবেন। শেষে তার চিরকালের আশ্রয় ঠাকুর্দাই মাকে সব বললেন। বরফ গলল। সবিতা রাজি হলেন অনুষ্ঠানে যেতে।
নির্দিষ্ট দিনে সেজেগুজে বাড়ির সকলে চলল অনুষ্ঠানে। বনলতাকে যখন কিছু বলতে বলা হল, তখন ও বলল, আমি তো রূপ গুণ কোনো কিছুতেই মায়ের যোগ্য মেয়ে হতে পারিনি। মায়ের মনের মত হতে পারিনি। তবে আমার হাত সব সময়ে ধরে ছিলেন আমার ঠাকুর্দা। আমাকে সব সময় তিনিই সাহস জুগিয়েছেন। এগিয়ে দিয়েছেন। মা আমার দেবী। কিন্তু ঠাকুর্দা আমার ঈশ্বর। তিনি না থাকলে আমি লেখাপড়ায় এগোতে পারতাম না।
সবিতা দেবীকে যখন কিছু বলতে বলা হল তখন তিনি অনেকক্ষণ কোনো কথাই বলতে পারলেন না। তারপর হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। বললেন, মেয়ে আমার ভুল বলেছে। আমিই ওর যোগ্য মা হতে পারিনি। আমি আমার নিজের মেয়েকে ঠিক মতো চিনতে পারিনি। ও যেটা ঠিক বলেছে তা হল, ও আজ যেটুকু যা এগোতে পেরেছে সব আমার শ্বশুরমশাইয়ের জন্য। তিনিই নাতনিকে উৎসাহ দিয়েছেন। কখনও কাছ ছাড়া করেননি। এই সম্মান আমার প্রাপ্য নয়। তবে এবার থেকে আমি এই সম্মানের যোগ্য হতে চেষ্টা করব। চেষ্টা করব ওর যোগ্য মা হয়ে উঠতে। ওকে আরো এগিয়ে দিতে। আপনারা আমার চোখ খুলে দিয়েছেন।
আমাকে ক্ষমা করে দিস মা বনলতা। আমি নিজে মেয়ে হয়েও তোকে শুধু মেয়ে সন্তান বলেই মর্যাদা দিইনি। হেনস্থা করেছি গায়ের রঙ নিয়ে।
মঞ্চে তখন বনলতার চোখ দিয়েও ঝরঝর করে জল পড়ছে। জীবনে প্রথম তাকে তার মা ভালোবেসে মা বনলতা বলে ডাকল। এর চেয়ে বড় স্বীকৃতি আর কী হতে পারে। এতদিনে সে নিজের মায়ের মন জয় করতে পেরেছে। এই তার সত্যিকারের জয়।
দক্ষিণ কলকাতার মধ্যবিত্ত পাড়ায় একান্নবর্তী পরিবারে জন্ম ও বড় হয়ে ওঠা। বিজ্ঞানের ছাত্রী হলেও সাহিত্যে আগ্রহ অতি অল্প বয়স থেকে।দায়িত্বপূর্ণ পদে চাকরি। নয়ের দশকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে কবিতাকে পাকাপাকি ভাবে আপন করে নেওয়া। তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ “এক-দুপুর ভ্রমণ ” এর জন্য কৃত্তিবাস পুরস্কার প্রাপ্তি। কবিতার পাশাপাশি গল্প ও মুক্ত গদ্যও প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত পত্র পত্রিকায়। এই বছর প্রকাশিত হয়েছে প্রথম গল্প সংকলন।