শারদ সংখ্যা অনুবাদ: একটি রুমাল, একটি আংটি ও একখানা চালুনি
।।অমৃতা প্রীতম।।
কবি কথাশিল্পী প্রাবন্ধিক অমৃতা প্রীতমের জন্ম ১৯১৯ সালের ৩১ অগাস্ট অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের গুজরানওয়ালায়। কবি ও শিক্ষক বাবা কর্তার সিং হিতকরির অনুপ্রেরণায় খুব ছোটবেলা থেকেই তাঁর লেখালেখি শুরু।মাত্র ষোল বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ অমৃত লেহরেঁ।দেশভাগ এবং দাঙ্গা তাঁকে প্রবল ধাক্কা দেয়। নারীর স্থিতি, সংগ্রাম আর স্বপ্ন তাঁর সাহিত্যে নতুন এক ভূখন্ড নির্মাণ করেছে। দেশভাগের পর তিনি চলে আসেন দিল্লীতে।উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে কাগজ তে ক্যানভাস, পিঞ্জর, কোরে কাগজ,আদালত, উঞ্চাস দিন , নাগমণি, রসিদি টিকেট প্রভৃতি।ইংরেজিসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর সাহিত্যসম্ভার। স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন আন্তর্জাতিক পুরস্কারসহ ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্যপুরস্কার জ্ঞানপীঠ। এছাড়া সাহিত্য আকাদেমী, পাঞ্জাব রতন সহ রাষ্ট্রীয় সম্মান পদ্মশ্রী ও পদ্মবিভুষণে সম্মানিত হয়েছেন। ২০০৫ সালের ৩১ অক্টোবর দীর্ঘ অসুস্থতার পর এই কিংবদন্তী সাহিত্যিক অমৃতলোকের পথে যাত্রা করেন।
এই গল্পটি অমৃতা প্রীতমের ‘এক রুমাল, এক অঙ্গুঠি, এক ছলনি’ গল্পের রূপান্তর।
শিশুশ্রেণি থেকে ক্লাস এইট আমরা একসঙ্গে পড়েছি।আমি আর বন্তী অভিন্ন হৃদয় দুই বন্ধু।ক্লাস ফাইভে ওঠার পর বন্তীকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিতে চেয়েছিল তার বাবা।ঘরে পয়সার অভাব।স্কুলের খরচ টানতে কষ্ট হচ্ছিল। হেডমিসট্রেস ওর সমস্ত বেতন মকুব করে দেওয়ায় সে যাত্রা বেঁচে গিয়েছিল তার লেখাপড়ার ইচ্ছে।
ক্লাস সেভেন আর এইটের মেয়েদের জন্য বরাদ্দ ছিল একটাই ক্লাসরুম। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না কে সেভেন আর কে এইট। টিফিন হলে এইটের মেয়েরা আমাদের কাছে ঘেঁষতে দিত না।তারা গোল হয়ে আলাদা একটি বৃত্ত রচনা করে গল্প করত।সেই বৃত্তের ভেতর ঢুকতে চাইলে তারা তেড়ে আসত আমাদের দিকে।ভারি রাগ হত আমাদের। ভাবতাম এইটে উঠলে আমরা জুনিয়রদের সাথে এরকম দুর্ব্যবহার করব না কোনদিন। একদিন আমরাও এইটে উঠে গেলাম। সামার ভ্যাকেশনের পর যখন স্কুল খুলল আমরাও বদলে গেলাম। আমাদের টিফিনের গল্পে সেভেনের মেয়েদের প্রবেশাধিকার থাকল না। এ এক এমন বয়স যার একদিকে কৈশোর আর অন্যদিকে যৌবনের হাতছানি। মাঝে একটি অদৃশ্য মায়া দরজা। অন্তরে বাইরে তখন দুই দিগন্ত। সেখানে সেই গুপ্ত দরজার কাছে সবাইকে ডেকে নেওয়া যায় না।
এইটে উঠতেই প্রতিবেশী একটি ছেলে বাড়িতে এসে রোজ অঙ্ক শিখিয়ে যেত বন্তী কে। গরমের ছুটিতে সে অনেক অঙ্ক শিখে নিয়েছে। রোজ টিফিনের সময় বন্তী চুপিচুপি আমাকে সেই ছেলেটির গল্প বলত। আমরা এইটের মেয়েরা সেভেনের মেয়েদের কাছে ঘেঁষতে দিতাম না এই সময়। বন্তীর এই গল্পের জন্য অপেক্ষা করতাম টিফিনের। যেদিন বন্তী স্কুলে আসত না, সেদিন মনে হত আজ স্কুলে আসাটাই অর্থহীন।
যেদিন গল্প হত, সেদিন ওর পেট থেকে কথা বার করার জন্য বলতাম- আর কিছু হয়নি?
নারে, ওই একটু হাসি, দুটো কথা আর কয়েকবার তাকানো ছাড়া তেমন কিছু নেই।কিন্তু ঐ হাসিটুকুই এত দূর পৌছে গেছে সবসময় কানের কাছে ভেসে বেড়ায়। ভুলতে পারি না।
বেশী কথা বলতে পারত না বন্তী, ওর জিভ শুকিয়ে যেত। ওর শব্দ হারিয়ে যেত। অঙ্কের খাতায় রাজু, রাজু, রাজু।বারবার সেই নাম লিখত।একদিন সেই খাতা টিচারের হাতে পড়ে।টিফিনের সময় বন্তীকে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। আমাদের মুখ তখন শুকিয়ে গেছে ভয়ে।বন্তী ফিরে এল কিছুক্ষণ পর। ওর চোখ কান্নায় লাল। অঙ্কের খাতায় লেখা রাজু শব্দগুলো রবার দিয়ে মুছে দেওয়া। মুছিয়ে দিয়েছিলেন সেই শিক্ষিকা।
ক্লাস এইট একটা জংশন স্টেশনের মতো। এখান থেকে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে যায় আমাদের যাত্রাপথ। আমাদের স্কুল এইট পর্যন্তই ছিল। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হল। আমরা পাশ করলাম। আমাদের কেউ কেউ অন্য স্কুলে ভর্তি হল। বন্তী ভর্তি হল সেলাই স্কুলে। তারপর দুবছর বাদে হঠাৎ একদিন বন্তীর বিয়ের কার্ড পেলাম। কার্ডে পাত্রের নাম খুঁজলাম প্রথমেই। করমচন্দ। রাজুর জায়গায় করমচন্দ থাকলেও প্রত্যেক বিয়েই সুন্দর। তাই শুভেচ্ছা জানিয়ে এলাম ওকে। বন্তীর হাত জুড়ে মেহেন্দি আঁকা। রঙিন চুড়িতে ওর হাত দুটো যেন কথা বলে উঠছে। অভিনন্দন জানালাম। নতুন জীবন ভরে উঠুক বন্তীর।ওর সেই হেসে কথা বলে ওঠা প্রেমের কথা মনে এসেছিল আমার,কিন্তু আজকের দিনে সেই প্রশ্ন করতে মন চাইল না। বন্তী আমাকে ডেকে নিয়ে গেল ঘরের এক কোণে- আমার একটা জিনিস তোর কাছে রেখে দিবি?
-কী ?
একটা রুমাল।
আমি বললাম- কেন ? তোর অন্যান্য জিনিসপত্রের সাথে রুমালটা রাখতে অসুবিধা কোথায়?
রুমালটার এক কোণে ওর নাম লেখা আছে যে।
থাক না, ক্ষতি কী। কে জানতে চাইবে কার নাম?
রাজ লেখা থাকলে ক্ষতি ছিল না, বলে দিতাম কোন বান্ধবীর নাম। রাজু তো কোন মেয়ের নাম হয় না।
আমি বললাম- কী দিয়ে লেখা ?
একদিন ও পেন্সিল দিয়ে লিখেছিল হালকাভাবে, আমি তার উপর সূচ সুতোর কাজ করে নিয়েছিলাম।
আমি বললাম- তাহলে তো খুব সহজ, সেলাইটা খুলে নিলেই হবে।
খুলে নেব! এ কথা তো আমার মাথায় আসেনি কখনও।বন্তী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল- তোর মনে আছে অঙ্কের টিচার আমার খাতা থেকে একদিন ওর নাম মুছে দিয়েছিলেন।আজ রুমাল থেকে আমি ওর নাম মুছে ফেলব, কত সহজ কাজ বল, মুছে দিলেই তো হল।
আমার মন খুব খারাপ লাগছিল। বন্তী ওর মেহেদী আঁকা হাতে ঘরের এক কোণে বসে রেশমী সুতো দিয়ে সেলাই করা রুমালের শরীর থেকে ঘষে ঘষে তুলে নিচ্ছিল রাজুর নাম, যা একদিন খুব যত্ন করে ও লিখেছিল।
আজ আর এসব কথা মনে রেখে কী লাভ। সামান্য হেসে কথা বলা ছাড়া তো তেমন কোন গভীর ছিল না তোদের সম্পর্ক।
তাই তো ভাবতাম। সেই হাসি যে মনের এত গভীরে চলে যাবে তা তো একদিনও ভাবিনি।আজ মনে হচ্ছে রক্তের প্রতিটি কণিকায় তা ছড়িয়ে গেছে।
বন্তী-র চোখ উপচে নেমে আসছিল জলের ধারা।
আমি মন ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য বললাম- কত বড় ঘরে বিয়ে হচ্ছে তোর। করমচন্দ তোর বর।এরপর শেঠ গিন্নি হয়ে আমাদের তো ভুলেই যাবি।
ভোলা যদি এত সহজ হত, তাহলে তো বেঁচেই যেতাম।
আমি মৃদু হেসে বললাম- রাজুকে তুই ভুলে না গেলেও তুই তো ওকে আর কোনদিন চিঠি লিখতে পারবি না। আমাদের মাঝে মাঝে রাজুর কথাই না হয় লিখিস। এতে মন হালকা হবে।
ঠিক বলেছিস, মনের ভার হালকা করার জন্য এর চেয়ে ভালো উপায় আর নেই।আমি মন খুলে সব কথা লিখব।কিন্তু একটা কথা তুই ভুলেও রাজুর কথা চিঠিতে লিখিস না, ওরা কীভাবে নেবে আমি ঠিক জানি না।দেহাতী গাঁয়ের লোক।সপ্তাহে দুদিন চিঠি নিয়ে আসে পিওন। ওরা চিঠি আগে পড়বে তারপর আমার হাতে দেবে।
আরো পড়ুন: ছোটগল্প লেখার শৈল্পিকতার ব্যাপারে উপদেশ । রোবার্তো বোলানিও
এরপর পনের বছর পেরিয়ে গেছে। প্রথম পাঁচ ছ বছর সে আমাকে নিয়মিত চিঠি লিখত।বেশি কথা লিখত না কিন্তু যা লিখত তার মধ্যে নিজের ভেতরের রক্তক্ষরণ ফুটে উঠত।আমি বন্তীর অনুরোধ অমান্য না করেই ওর প্রতিটি চিঠির উত্তর দিতাম। সাদামাঠা চিঠি হত সেগুলো। তার মনের ক্ষতচিহ্নগুলি উপশমের কোন পথনির্দেশ সেখানে থাকত না। প্রায় দশ বছর বন্তী আর কোন চিঠি লেখেনি।আমি এই ভেবে আশ্বস্ত হয়েছিলাম যে নিজের সংসারের সাথে সে মানিয়ে নিয়েছে নিজেকে।সময় তো এভাবেই অনেক ক্ষত মুছে দেয়।
পনের বছর পর আবার চিঠি লিখেছে বন্তী। এই চিঠি তার অন্যান্য পত্রগুলির থেকে আলাদা। এখানে সে শুধু তার নিজের কথা লেখেনি, লিখেছে তামাম নারীজাতির হৃদয় নিংড়ানো কথা। আমার মন ভালো ছিল না। তবু এই চিঠির দীর্ঘ উত্তর লিখতে আমার ইচ্ছে করছিল। তার সমস্ত শর্ত ও অনুরোধ উপেক্ষা করে নিজের অন্তরের সমস্ত ব্যথা বেদনা লিপিবদ্ধ করতে ইচ্ছে করছিল সাদা কাগজে। আমি লিখলাম না। আমি খুঁজতে লাগলাম বন্তীর পুরোনো চিঠিগুলো।এদিক ওদিক নানা জায়গা থেকে দু একটি ছাড়া প্রায় প্রতিটি চিঠিই পেয়ে গেলাম।
পড়তে শুরু করলাম বন্তীর সমস্ত চিঠি।
‘ অদ্ভুত গাঁ! প্রতিদিনের কাজে কোন তফাত নেই। যা আজকের কাজ, সেই কাজ আগামীকালের, পরশুর। বোঝাই যায় না আজ কী বার? মঙ্গল আর শনিবার- এই দুটো দিন আলাদা। এই দুদিন পিওন আসে, হাটবারের ফেরিওলার মতো।চিঠি পেলে দুকথা লিখিস। এই জন্য লিখিস যে আমি তোর চিঠির অপেক্ষা নিয়ে পিওনের পথ চেয়ে বসে থাকব। ইতি- তোর বন্তী।
“আমার বিয়েতে তুই আমার শ্বশুরকে দেখেছিস।মাথায় টাক। কাঁচাপাকা দাড়ি। প্রায় সব দাঁতই ভেঙে গেছে। এই বৃদ্ধ মানুষটিকে আমার শ্বশুর বলে চিনতে তোর অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তুই যদি আমার শাশুড়িকে দেখতিস, চমকে উঠতিস। শাশুড়ি তো কোন ছার, চেহারা যা আছে বউমা বললেও কম বলা হবে। তুই হয়তো ভাবতিস কোন আইবুড়ো মেয়ে। আমার চেয়ে মোটে তিন বছরের বড়।এরকম স্লিম,সুন্দরী, হাসিখুশি চেহারা সবার মন ভালো করে দেয়। সম্পর্কে সৎ শাশুড়ি হলেও সে আমার শাশুড়িই তো। যদি তা না হত আমি তাকে সখী বলে ডাকতাম।
আজ মঙ্গলবার। আজ তোর চিঠি আসবে বলে অপেক্ষা করে আছি। আমার পাশে আমার শাশুড়িও এসে দাঁড়াল। তোর চিঠি যখন হাতে পেলাম দেখলাম শাশুড়ির মুখ থমথমে। সেও যেন আমারই মতো কারোও চিঠির অপেক্ষায় ছিল। জিজ্ঞেস করলাম- তুমি কি কারও চিঠির আশায় ছিলে?
আমাকে কে আর চিঠি লিখবে? শুধু একজনের চিঠির জন্য বসে আছি এতগুলো বছর।
-কার চিঠি?
উপরওয়ালার চিঠি। মৃদু হেসে কথাটা বললেও তার অব্যক্ত কান্নার ধ্বনি শুনতে পেলাম। এ এমন এক কান্না যা চোখে দেখা যায় না।যা আড়াল করে রাখতে একমাত্র মেয়েরাই পারে। আমার খুব ইচ্ছে করছিল জোরে কেঁদে উঠতে যাতে আমার শাশুড়ির চোখে দীর্ঘদিন জমে থাকা অশ্রুর ধারা নদী হয়ে যায়। ইতি বন্তী।”
-“ সত্যি কথা বলতে কি, এই যে ইট কাঠ পাথরের জেলখানা একে আমার কখনও নিজের ঘর বলে মনে হয়নি। এখানে আমি যেন অবান্তর।কাঁটাতার ডিঙিয়ে ঢুকে পড়া এক অনুপ্রবেশকারী। ভগবানের ইচ্ছেয় একটি ছোট রাজু চলে এসেছে এই ঘরে, সে আমাকে প্রাণপন বেঁধে রাখে এ বাড়ির সাথে।এই দেবদূতের নাম ওরা দিয়েছে দীপক। শীতের সকালে আমি তার মাথায় একটি লাল সিল্কের রুমাল বেঁধে দিই, ওর সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি অপলক। ওর মুখ ধীরে ধীরে বড় হয়ে যায়। পঁচিশ বছরের রাজুর সামনে দাঁড়িয়ে থাকি কুড়ি বছরের আমি। ছেলেটার মুখে অবিকল সেই হাসি। ওর দস্যিপনা সামাল দিতে দিতে অস্থির হয়ে যাই। সে বিব্রত করে আমার শাশুড়িকে। তার উনুন ভেঙে দেয়। আমার শাশুড়িকে আবার নতুন করে পাততে হয় তার উনুন। এ ঘটনা প্রায়ই ঘটতে থাকে। এখন আমার শাশুড়ির উনুন পাতা অভ্যেস হয়ে গেছে। সে প্রায় প্রতিদিন নতুন উনুন বানায়। এত ধৈর্য নিয়ে তা তৈরি করে যেন সে ঈশ্বরের মূর্তি বানাচ্ছে। উনুন যে এত সুন্দর হয়, এত শিল্পময় তা আমি জানতাম না।উনুন বানানো তার নির্জন সাধনা। এ সময় সে রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। আপনমনে নিজের খেয়ালে গান গায়।গানের কথাগুলো আমাকে ভাসিয়ে দেয় এক হাহাকারের ভেতর। তার বাবা মাও মেয়ের রূপ আর বয়সের প্রতি উদাসীন থেকে শুধুমাত্র অর্থের মাপকাঠিতে বিচার করেছেন জগতকে। যা ধুলোমাটির বেশি কিছু নয়। এই ধুলোমাটি কাদা দিয়ে সে একা একা নিজের খেলাঘর বানায়।– বন্তী।
“ আমার শাশুড়ির গান নিয়ে তোর জিজ্ঞাসা আছে আগের চিঠিতে। আজ আমার শাশুড়ি গান গাইছে। শব্দগুলো ভেসে আসছে হাওয়ায়-
আ রে চন্দা বিরহা কে আগ হ্যায়।
অঙ্গন মে জ্বলাইলি আগ
হাম সে সেঁক লে-
গলার ভেতর শব্দগুলো হাহাকার করছে এরকম ভাবে-“ তুমি যদি যাবে বিদেশে বিভূঁইয়ে আমাকে পকেটে রেখো/ রাত হলে পথে এ প্রতিবিম্ব একবার শুধু দেখো।”
অথবা কখনও গাইছে
“কীভাবে লিখব কথা, কাজলে বানাই আজ কালি
মেঘে মেঘে বার্তা পাঠাই জলের চোখের জল ঢালি।”
বন্ধ দরজার ভেতর থেকে এই গানের ভেতরের গানটাকে আমি খুঁজতে থাকি। – ইতি বন্তী।
“ আমার শাশুড়ির খুব জ্বর হয়েছিল।হবে নাই বা কেন। সারাদিনে কতটুকু আর বিশ্রাম।খাবে না, ঘুমুবে না।কেবল উনুন বানাবে। একদিন হাসতে হাসতে বললাম – এরকম চলতে থাকলে উপরওয়ালার চিঠি আসতে আর দেরি নেই। সে বলল- ভগবান যেন আমার সেই মনস্কামনাই পূর্ণ করেন। হালকাভাবে কথাটা বললেও তার ভেতরে এমন কিছু মর্মভেদী উচ্চারণ ছিল যা আমার সমস্ত বেদনাকে ম্লান করে দিল।
আমার শ্বশুর মারা গেছেন এর মধ্যে। এই সময় আমি তোকে ইচ্ছে করেই কিছু লিখিনি।লিখতে পারিনি। আমার শাশুড়িকে দেখতাম সে কেমন কঙ্কালসার হয়ে যাচ্ছিল।বিছানার সাথে একেবারে মিশে গিয়েছিল তার শরীরটা।আমাকেই তখন ঘরের সব কাজ করতে হয়। তোকে আগের চিঠিগুলিতে আমার শাশুড়ির উনুন তৈরির কথা বলেছি। এই কাজটি ছিল তার কাছে সাধনার মতো। তীব্র অসুখের মধ্যেও এই কাজ থেমে থাকেনি।আমি ইচ্ছে করেই বাধা দিতাম না, বরং দেখতাম এই রুগ্ন অসহায় মানুষটি কোন দৈবমন্ত্রে সমস্ত শক্তি অর্জন করে উনুন পাতছে।একদিন রক্তবমি করতে করতেও শাশুড়ি বলল- আর তো বেশিদিন নয়, শেষবারের মতো উনুনটা বানিয়ে নিই।আমি বললাম – এরকম বলছো কেন?
সে বলল- আজ তোকে একটা অনুরোধ করব , শুনবি?
বললাম, বলো, যা বলবে সব শুনব, আমি তার বিছানায় মাথা রেখে কাঁদছিলাম।
কাঁদছিস কেন? এটাই তো আমি চেয়েছিলামরে, এই চিঠি, যা আমাকে স্বাধীন মুক্ত করে দেবে।
কী বলছিলে তুমি?
আমাকে এক তাল মাটি এনে দিবি।
আমি অবাক হয়ে তাকালাম মানুষটির দিকে। জীবনে যাকে কোন মায়ায় বাঁধা পড়তে দেখিনি। না, অর্থের , না শরীরের , না জমির , না গয়নার।সেই মানুষটার উনুনের উপর এত মোহ কেন ? জিজ্ঞেস করলাম- কী আনন্দ পাও এই উনুনে?
শুনবি? আমার দিকে চোখ মেলল সে। বড় করুণ সেই চোখ অথচ এক মায়ার আবেষ্টনী যেন জড়িয়ে আছে সেই দৃষ্টিপথ। এই উনুনের নিচে আমি একটা জিনিস পুঁতে রেখেছি।
তা কোন মোহর নয়, সোনা রূপার গয়না নয় আমি জানি। কারণ এসবের উপর কোন মায়া তোমার কোনদিন ছিল না।
বন্তী, তোকে একদিন বলেছিলাম ভুট্টা দানা ভেজে খাওয়াব। বলতাম যে আমি আমি আসলে এক ভাজিওয়ালি।
সে তো মজার কথা।
মজার কথা নয়। আমি সত্যিই একজন ভাজিওয়ালার সহযাত্রিনী। আমার উনুনটা কাঁচা মাটি দিয়ে এমনি এমনি বানানো। তার নিচে আছে আমার সেই ভাজিয়ারের চিহ্ন একটা চালুনি। আর তারই দেওয়া একটা আংটি। দম ফুরিয়ে আসছিল তার। অনেক কষ্টে সে বলেছিল- গাঁয়েরই একটি ছেলেকে ভালোবাসত সে। কিন্তু তার মা বাবা টাকার লোভে তার দ্বিগুণ বয়সী আমার দোজবরে শ্বশুরের সঙ্গে তার বিয়ে দেয়। তার সেই ছেলেটির নাম ছিল মোতি।আমার শাশুড়ির নাম ছিল রূপো। এতদিন তার নামটাও উনুনের নিচে চাপা পড়েছিল। তারও যে নাম থাকতে পারে এটা কখনই আমাদের মনে হয়নি।রূপোর বিয়ের অল্পদিন পরেই মোতি ঘরদোর ছেড়ে গায়ের একপাশে উনুন জ্বালিয়ে ভুট্টা নিয়ে ভাজিওয়ালার কাজ শুরু করে। আর রূপো শ্বশুরবাড়ির গাঁয়ে গিয়ে উনুন বসায়। একদিন ভুট্টা ভাজতে গিয়ে সে মোতিকে দেখে। ভুট্টা নয় তার শরীর যেন উনুনে ভাজা ভাজা হয়ে যায়। একদিন নির্জনে রূপো মোতির পায়ে ধরে সাধল, ঈশ্বরের নামে কিরা দিয়ে তার উনুন ভেঙে দিল রূপো।কড়াইটা তুলে আনা সম্ভব ছিল না বলে শুধু চালুনিটা নিয়ে আসতে পেরেছিল। নিজের চিহ্নস্বরূপ একটি আংটি রূপোকে দিয়ে কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে যায় মোতি।সেই আংটিতে লেখা রয়েছে মোতির নাম। তাকে কোথায় আর রাখা যায় আড়ালে।এইজন্য উনুন ভেঙে সে দুটো জিনিসকেই লুকিয়ে রাখল উনুনের নিচে সবার দৃষ্টি থেকে দূরে। মন অস্থির হলে সেই উনুন ভেঙে চিহ্নদুটি বার করে আনত, কাঁদত। কাঁদতে কাঁদতে গান গাইত আপনমনে। আবার এই চিহ্নদুটি মাটির কাছে সমর্পণ করে উনুন পেতে তার উপর সাজিয়ে তুলত পার্থিব সংসার। এত কথা এক নাগাড়ে বলতে গিয়ে রক্তবমি হল আবার। রক্ত বমি করতে করতে তার বন্দী পাখিটি উড়ে গেল কোথায়। আমি উনুন ভেঙে মোতির নাম লেখা আংটিটা ওর হাতে পরিয়ে দিলাম। চালুনিটা রয়ে গেছে ঘরের এক কোণে।তুই আমার প্রাণের বন্ধু। শিশুশ্রেণি থেকে আজ অবধি তোকে কোন কথাই গোপন করিনি।তুই তো জানিস আমার স্মৃতির নিচে একটা লাল সিল্কের রুমাল রাখা আছে কত যত্নে। এরকম আর কোন বন্তী বা রূপো কি নেই যার বুকের উনুনের তলায় কোন রুমাল বা আংটি লুকিয়ে নেই? সেই উনুনের আঁচে প্রতিটি মুহুর্তের বেঁচে থাকা কীভাবে ভুট্টাদানার মতো ভাজা হয়ে যাচ্ছে। সময়ের চালুনি দিয়ে কতটুকুই বা ছাঁকা যায় তার ?
কবি, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক
জন্ম ১৯৭২, পুরুলিয়ায়। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতকোত্তর। দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনে কর্মরত। প্রকাশিত গ্রন্থ এক ডজন। পেয়েছেন ত্রিবৃত্ত পুরস্কার মালীবুড়ো সন্মান সহ বেশ কিছু পুরস্কার ও সন্মাননা। কেতকী পত্রিকার সম্পাদনার সাথে যুক্ত।