| 19 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক: অমৃতস্য পুত্রা (পর্ব-১) । অনিন্দিতা মণ্ডল

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

Stories have to be told, or they die, and when they die, we can’t remember who we are or why we are here.

Sue Monk Kidd

      এ গল্পের কথক নিজের মতো করে কাহিনি গড়েছে। সে কাহিনিতে বাস্তব আর কল্পনা মিলেমিশে গিয়েছে বারবার। এমন অনেক চরিত্র, এমন অনেক ঘটনা, যা সালতারিখ মিলিয়ে পাওয়া যাবে না, সেসবের দলিল থাকছে লেখায়। দলিল বলছি, কারণ, সেও ইতিহাস। মানুষের কল্পনার ভিত্তি থাকে। ভিত্তিহীন কিছু যদি না লেখা হয় তবে তা ইতিহাসই হল। যেসময়ের কথা লেখা হয়েছে সেসময়ের কিছু নির্দিষ্ট সমাজচিহ্ন ছিল। কাহিনির আধারে সেই চিহ্নগুলো ধরে রাখাই উদ্দেশ্য। কথকের পরিচয়ও বাস্তব ও স্বপ্নের মিশেল। কখনও সে রক্তমাংসের মানুষ, কখনও বা স্বপ্নের নিদ্রিত চেতনায় স্থান কালের কঠিন গণ্ডি ভেঙে দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে আরও আরও নানা পরিচয়ে। আর তাই, লেখার নির্দিষ্ট সময়সারণি নেই। সে যেন ঘুরে ঘুরে নিজের সঙ্গে কথা বলছে। একই সময়ে ঘুরে ঘুরে ফিরে আসছে। তার চেতনায় যে সময়টা সবচেয়ে বেশি প্রকট, সেই সময়ে বারবার ফিরে এসেছে। যেন সেই ক’টি ঘটনাই ধ্রুবক। বাকি সব চলরাশি। তাকে কেন্দ্র করে অতীত আর ভবিষ্যৎ যেন গ্রহের মতো ঘুরে চলেছে। সেইই সূর্য। তাই গল্প এগোয় না। তার পরিণতি হয় না। বৃত্তের চলনে সে যেন নিজের মনে ঘুরপাক খায়।

       পড়তে পড়তে কারোর যদি মনে হয়, এ চরিত্র তো তার! তাকেই লেখা হয়েছে! তবে এ অভিযোগের উত্তর নেই। গল্পের খাতিরে চরিত্র চুরি গিয়েছে হয়ত, খোয়া যায়নি। কারণ, চরিত্রকে ইতিহাস করতেই তো চুরি করা হয়েছে। তবে কথকের সচেতন মন যে সে চুরিতে যুক্ত ছিল না সেকথা হলফ করে বলা যায়। যুক্ত ছিল তার অন্য নানা অস্তিত্ব। কাল্পনিক অস্তিত্ব। শুরু করা যাক বরং।  

          

কলকাতা শহরের উত্তর প্রান্ত। সবদিক দিয়ে উত্তর তখন শহরের হৃৎপিণ্ড। তারও উত্তরে দমদম সিঁথি তখন ওপার বাংলার মানুষের ঢলে ভরেছে। খালপাড়, ট্রেন লাইনের ওপারের কলোনি ছাপিয়ে উঠেছে। মূল শহর এলাকা তখনও বনেদি পরিবারগুলির বাসস্থান।

গঙ্গার ধার তখনও স্থায়ী বাসিন্দাদের এলাকা।

উত্তর কলকাতার এক এমনই বনেদি পরিবার। ষাটের দশক কয়েক বছর গড়িয়েছে। বংশটি তখন শিক্ষা ও সংস্কৃতির আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে আছে। দামী হীরের থেকে যেমন নানাদিকে আলো ঠিকরে পড়ে তেমনই এই পরিবারের উজ্জ্বল কৃতী পুরুষেরা যেন এক একটি হীরকরশ্মি। কিন্তু ভাগ্য অপ্রসন্ন। তাই সংস্কৃতি অন্নের ভরসা স্থল হল না। চিরকাল পৃথিবীর মানুষ যেমন যাযাবরবৃত্তি নেয় শুধুমাত্র অন্ন ও আশ্রয়ের তাগিদে ঠিক তেমনই প্রতিভাধর পিতা যাযাবর হয়ে গেলেন। পেছনে পড়ে রইল পরিবারের এজমালি ঘরদুয়ার। সঙ্গে এলো সেই আলো। এলো বেদনা। এলো উত্তরাধিকার।

আমরা নোয়ার নৌকোয় চেপে বিপর্যয়ের সেই মহাসমুদ্রে ভাসমান হলাম। ছেলেবেলায় কেবল মনে হত তরী তীরে এসে লাগবে। যত দিন যায় তত অনুভব করি, আসলে এ সমুদ্র অগাধ অকুল। কখনোই তরী তীর পায় না। ভেসে থাকাটাই সত্য। কুল পাওয়া মানে যাত্রা শেষ। কিন্তু এ যাত্রা যে অনন্ত! শুধু এক পুরুষ থেকে আর এক পুরুষে নৌকো ভরে উঠছে।

এ লেখা সেই যাত্রার কথা লিখেছে। অনন্ত থেকে যতটুকু ধরা পড়েছে তাই।

কিসসা ১

জন্মেই একটা শক্ত কঠিন মাটি আর শূন্য আকাশ দেখে কেমন ভয় হয়। মনে হয় কে আমি? কোথায় এলাম। তারপর দিন যত যায় শরীর জুড়ে মন জুড়ে বসতে থাকে মায়া। মনে হতে থাকে এই তো আমার জায়গা! এই বিস্তীর্ণ ভূমি এই আসমুদ্র মরুভূমি আমার! ভুলেই যাই, আসলে আমরা সবাই ভাড়াটে। কয়েকদিনের জন্য আসা। সেই ভাড়াটের গল্প তো কখনও একরকম হয়না। নানা রঙের কোলাজ, নানা সুতোয় বোনা। কখনও কখনও সুতো ছিঁড়ে যায়। কখনও কোলাজের ছবি জলের দাগে ধূসর হয়ে যায়। সে জল আনন্দ বা দুঃখ, যারই হোক। সেই টুকরো ছবির কোলাজ, সেই ছেঁড়া সুতোর বুনন নিয়ে এই কিসসা। যেন দরবেশের আলখাল্লা।

       বসতবাড়ি ছাড়তেই হয়। নাহলে ছড়িয়ে পড়া হয়না। তাই বাবা চলে আসেন দমদম রেডিও গলির এক একতলা বাড়িতে। শরিকি ঝঞ্জাট নেওয়া স্বভাবে নেই। তখন ঠাকুমা বেঁচে নেই। তাই ছেড়ে আসার সময় বাবার কষ্ট হয়নি। বাড়িটার কষ্ট হয়েছিল কিনা কে জানে? কিন্তু দমদম রেডিও গলির সেই নিজের বাড়িও ছাড়তে হয়। এক শ্রাবণের রাতে জানলার গরাদ ভেঙে ঘুমের ওষুধ স্প্রে করে আমাদের সর্বস্ব চোরে নিয়ে যায়। আমরা পিঠোপিঠি তিন ভাইবোন। বাবার নাটকের দল শ্বেতকরবী, গুরুকাকু বিপ্লবকাকুরা সবাই বড় দুঃখ পেয়েছিল। কিন্তু বাবার যে সব হারানোর কপাল! বাপ মা নেই, সম্পত্তি বলতে কিছু নেই, আছে শুধু তিনটি ছেলেমেয়ে নিয়ে স্বামী স্ত্রীর পরিবার। আমার বাবার যাযাবর বৃত্তির আভাস এর আগে কেউ তেমন টের পায়নি। সেই চোদ্দ বছর বয়সে কাকাদের খোঁটায় অস্থির ছেলেটা যখন জাহাজে খালাসী হয়ে চলে গিয়েছিল, নোনা জলের স্বাদ মেখেছিল গায়ে, সেই তখন একবার জেগে উঠেছিল যাযাবর। তারপর ফিরে আসতেই হয়েছিল। দিদিদের মরণ বাবাকে নোনা জল থেকে তুলে ডাঙায় এনে ফেলেছিল। ঠাকুমা একা। আবার বাবা যাযাবর হল। তবে এবার একা নয়। সঙ্গে রইলাম আমরা। নিজের বাড়ি ছেড়ে পরের বাড়িতে ডেরা বাঁধা শুরু।


আরো পড়ুন: অসমিয়া অনুবাদ: রক্তের অন্ধকার (পর্ব-১) । ধ্রুবজ্যোতি বরা


প্রথম যে বাসাবাড়ি-তে আমরা ভাড়াটে হয়ে আসি, সেটা ছিল মফস্বলে, একটা গলির মধ্যে। অন্ধ গলি। তবে সাপের মতো এঁকেবেঁকে যাওয়া গলিতে অনেকগুলো বাড়ি। আমাদের এল শেপের দোতলা বাড়ির ওপর তলায় তিনখানা বরাদ্দ ঘর। মাথার ওপরে ছাদ। বাড়ির পেছনে দুটো বাড়ি পরে তাল নারকেলের সবুজের মধ্যে রয়েছে এক পাগলা গারদ। তাকে ঘিরে যে জঙ্গল সেখানে অজস্র হনুমানের বাস। পাখির বাসা। আমি তার আগে বাড়িতে মায়ের কাছে পড়তে শিখেছি। যোগ অংক, অ আ ক খ, এ বি সি ডি, এইসব। দিদি দু বছর পড়েছে সেন্ট নিনিয়ান স্কুলে। কাশীপুরে। দমদমের বাড়িতে থাকাকালে। অবশ্য তাতে যে ও খুব শিক্ষিত হয়ে পড়েছিল তা নয়। প্রথম বছর ও ক্লাসে উঠতে পারেনি। পরের বছর উঠেছিল। এখানে এসে আমরা স্কুলে ভর্তি হব ঠিক হল। অচিনকাকুই বলেছিল, চিলড্রেনস ওন হোম নামে একটা প্রাইমারি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল আছে। সেখানে আমরা তিন ভাইবোন ভর্তি হলাম। একটা রিক্সা ঠিক করা হল। আমরা তাইতে চেপে স্কুলে যাবো। মায়ের বাড়ি থেকে বেরনো অভ্যেস নেই। বাবা একটা চাকরি করে, রেলের চাকরি, কিন্তু এহ বাহ্য। আসল কাজ বাবার, নাটক করা। গ্রুপের নাটক। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া প্রতিভার প্রতি বাবার বিতৃষ্ণা। তবু রক্তের টান এড়ানো যায় না। মাঝে মাঝে বাদলা দিনে অন্ধকার ঘরে বাবা গান ধরেন বা তবলা টেনে নিয়ে বসেন। কিন্তু নাটকের ছেলেরা এলে বাবা যেন লাফ দিয়ে ওঠেন। বাবা ভুলে যান উত্তরাধিকার। রক্তে যা বয়ে এসেছে। অন্য এক উত্তরাধিকার তাঁর রক্তে খেলা করে। নাট্যকার বিধায়ক ভট্টাচার্য, অভিনেতা কানু বন্দ্যোপাধ্যায়, টালাপাড়ার কানাই কাকা। সেসব কি কম নাকি? ছোট্ট ছেলে, সদ্য পিতৃহারা বসে আছে কানাই কাকার বৈঠকখানায়। নিজেদের বৈঠকখানার টানা ফরাসে এসে বসেছেন বাবা আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব। সঙ্গে পুত্র আলি আকবর। ছোট কাকার বন্ধু। পিতৃহারা বালক শুনতে পাচ্ছে, বাড়িতে উৎসবের আমেজ। বাবা আলাউদ্দিন তাঁর আত্মজ আলি আকবর ও মানসপুত্র হীরুর সঙ্গে সঙ্গীতে মেতে উঠেছেন। বহু মানুষ এসেছেন। বৈঠকখানা ছাপিয়ে রকে মানুষের ভিড়। পাশের সেজ ঠাকুরদার বাড়ি থেকে নাটুকাকা এসেছে। আরও কত মানুষ! বালক কতটুকু বোঝে?

ওদিকে কানাই কাকার বাড়িতে কাকিমা জামবাটিতে মুড়ি দেন—‘তপু, এখানে বসে বসে খা আর শোন’। সেসব আজ তিরিশ বছর আগের কথা। এখন সন ইংরাজি ১৯৬৯।  

 

 

 

 

One thought on “ধারাবাহিক: অমৃতস্য পুত্রা (পর্ব-১) । অনিন্দিতা মণ্ডল

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত