বাংলাদেশের চলচ্চিত্র (১৯৪৭-১৯৭৫) শিল্পের স্বকীয়তা
।। ড. মতিন রহমান ।।
সাহসী হবার গল্প
ধর্ম-ভাষা ও ভূগোলের দাবিতে ১৯৪৭ সালে ভারত খণ্ডিত হয়। আমরা লাভ করি পূর্ব পাকিস্তান নামে একটি দেশ। সে দেশে তখন চলচ্চিত্র নির্মাণ না হলেও দর্শকরা এই শিল্পকলা উপভোগ করতো আমদানি করা বিদেশি চলচ্চিত্র বীক্ষণের মাধ্যমে। কারণ সেই সময়ে পূর্ববঙ্গের প্রাণকেন্দ্র মুসলিম অধ্যুষিত ঢাকা শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চর্চা থেকে কিছুটা পিছিয়ে ছিল। এদেশে চলচ্চিত্র নির্মাণ কাঠামোও ছিল না। তবে সামসুদ্দিন আবুল কালাম, ঘুঘু চৌধুরী, রামগুপ্ত ও এফ. আর খান প্রমুখগণ চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্যোগ নেন। তাদের মূল্যায়নে চলচ্চিত্র ছিল, একটি সূক্ষ্ম ভাব প্রকাশের বাহন এবং জাতির ভাব, ভাষা অথবা সংস্কৃতি তুলে ধরার শক্তিশালী হাতিয়ার।
পঞ্চাশ দশকের পুরোটাই ছিল বাংলা বাঙালি অথবা ভাষা সংস্কৃতিকে চিহ্নিত করার সংগ্রাম মুখর সময় [হক, ১৯৯২: ৬৬]। ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে বাঙালি নিজস্ব সংস্কৃতি আপন গণ্ডির মাঝে সমৃদ্ধ হওয়ার উদ্দীপনা লাভ করে। চলচ্চিত্র ছাড়া সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা অথবা নাটক এক ধরনের নতুন গতিবেগ ধারণ করে। এই সময়কালে সৌখিন একজন নাট্যকর্মী প্রচণ্ড জেদ এবং দেশ চেতনার তাগিদেই পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ (১৯৫৬) নির্মাণ করে বসেন। চলচ্চিত্রটিতে নাট্য ধর্মী ভাষার প্রাধান্য থাকলেও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের গোড়াপত্তন করে। ১৯৫৮ সালে দেশব্যাপী সামরিক শাসন জারি হলে বাঙালির বাক স্বাধীনতা কার্যকর ভাবে খর্ব হয়। সমালোচকদের নানা বিরূপ প্রতিক্রিয়া এবং ব্যর্থ শিল্পকলা মন্তব্যে দগ্ধ মুখ ও মুখোশ (১৯৫৬) এদেশে বাস্তব ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের সূচনা ঘটায়। উক্ত চলচ্চিত্রের সাফল্যে অনেকেই দারুণভাবে অনুপ্রাণিত হয়। বহু অনির্দিষ্টতার সমস্যা কাটিয়ে মুখ ও মুখোশ (১৯৫৬) আংশিক বাস্তব ধর্মী চলচ্চিত্র হিসেবেও গণ্য হয়। বাস্তব ধারার চলচ্চিত্র ভিন্ন অর্থে সামাজিক চলচ্চিত্রই বিকাশ লাভ করে।
তবে অনেকে দাবি করেন, স্বাধীনতা পূর্বের চলচ্চিত্র ছিলো যত অদ্ভুত ও অসম্ভব গল্প উপাদানের স্থুলক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। এক ধরনের বিনোদন রসের উপাদান। লোকনাট্য তথা যাত্রা, ধর্মীয় সংলাপ, কণ্ঠস্বর, অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদি বাহ্যিক ও আঙ্গিক বিবিধ রস উপাদানে সাজানো থাকতো চলচ্চিত্রের গঠন কাঠামো। মুখ্য বিষয় ছিল দর্শককে উদ্দীপিত, শিহরিত, রোমাঞ্চিত অথবা আমোদিত করার প্রচেষ্টা। রঙে-ঢঙে, অতি কৃত্রিমতায় কখনো বিকৃত চিন্তা ও চরিত্র চিত্রণই ছিল গল্পকে এগিয়ে নেওয়ার চালিকা শক্তি।
ছায়াছন্দ- অনুরোধের আসর
১৯৪৭ পরবর্তী কালে ঢাকায় আধুনিক গানের বিকাশের যথোপযুক্ত ক্ষেত্র ছিল না। ষাটের দশকের প্রথম দিকে উল্লেখযোগ্য ভাবে চলচ্চিত্রের গানের পৃষ্ঠপোষকতা মেলে। চলচ্চিত্রের সঙ্গীত প্রচারে বেতার ভূমিকা রাখতে শুরু করে। এই দশকের শেষের দিক থেকে টেলিভিশনও আধুনিক গানের বিশিষ্ট প্রচারকের ভূমিকা গ্রহণ করে। চলচ্চিত্রের জন্য রচিত গান বেতার ও টেলিভিশনে প্রচারে পরোক্ষভাবে চলচ্চিত্র শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ হয়। আলী মনসুর, বিনয় ঘোষ, রফিকুদ্দীন ও জহির চৌধুরীর মতো মেধাবী বেতার শিল্পীদের আগমনে চলচ্চিত্রে সংলাপ ব্যবহারে চাতুরী ও মাধুরীর যুগপৎ সন্নিবেশ ঘটে। এইসব সৌখিন, উৎসাহী ও উদ্যমীদের দলে এসে ভিড়ে ছিলেন চলচ্চিত্রে হাত পাকানো মন পাকানো কলকাতা ফেরত ক’জন চলচ্চিত্রানুরাগী। সাংস্কৃতিক সচেতনতার পাশাপাশি যাদের সহযোগী মনোভাবই এদেশের চলচ্চিত্রে সংগ্রামী সূচনা ঘটায়। এর পাশাপাশি চলচ্চিত্রানুরাগীদের স্বতঃস্ফূর্ততার পাশে স্পষ্টভাবে দানা বেঁধে উঠেছিল নিজস্ব পুঁজি গঠনের অঙ্গীকার বা জাতীয়তাবাদী উদ্দীপনা [আহমেদ, ১৯৯২ : ২৮]।
‘ও দাইমা কিসের বাদ্য বাজে’
গণমানুষের শিল্প হিসেবে অবস্থান নিতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে হতে হয়েছে বাণিজ্যিক। আবার ষাটের দশকে বিদেশি ভাষার সাথে পাল্লা দিয়ে বাংলা ভাষার চলচ্চিত্রকে টিকে থাকতে দেশ, মাটি এবং লোকগোষ্ঠীর প্রচলিত সস্তা সংস্কৃতি রুচি ঐতিহ্যের কাছে ফিরে যেতে হয়েছে। একটি দেশের মানুষের যাপিত জীবন প্রণালী, তার জগৎ সম্ভার, তার সমাজ বৈশিষ্ট্য জাতীয় চলচ্চিত্রের বিষয়গত উপাদান হিসেবেও গৃহীত হবার দাবি রাখে। ষাট দশকের চলচ্চিত্র আমাদের নিজস্ব সংগ্রাম, সংস্কৃতি অথবা ঐতিহ্যের হয়তো পুনঃনির্মাণ করতে পারেনি। কিন্তু সেই সময়কালের চলচ্চিত্র পরিচালকরা সৃষ্টিশীল চিন্তায় অথবা মৌলিক অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ ছিল। আত্মপরিচয় ও মুখের ভাষা, স্বাধিকার এবং স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের জন্য সংগ্রাম সংকটকালে বাংলার জনপদের প্রাকৃতিক ভূমি, জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা নিয়ে মগ্ন ছিল।
‘রূপবান’, ‘বেহুলা’, ‘ভানুমতি’, ‘আপন দুলাল’, ‘মধুমালা’ চলচ্চিত্রগুলো তার প্রমাণ। আকিরা কুরোসাওয়া যদি তার চিত্রনাট্যের বৃত্ত রচনায় বার বার ফিরে যেতে পারেন জাপানি লোককাহিনীর ফর্মে। সত্যজিৎ রায়-এর মতো পরিচালকও মন্তব্য করতে পারেন, যে জাতি রশোমন সৃষ্টি করেছে তার আগে কিছু নেই তা হতে পারে না [হোসেন, ২০১০ : ৮২]।
যেকোনো শিল্পমাধ্যম সে দেশের রাজনৈতিক আবহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো জনরুচির চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করে। আমরাও প্রকাশ করতে পারি যে বাঙালি পরিচালকরা রূপবান (১৯৬৫) তৈরি করে সাধারণ মানুষকে সিনেমার দর্শক বানিয়েছে। রূপবান (১৯৬৫) উর্দুভাষার চলচ্চিত্রের প্রতিযোগী হয়ে দাঁড়ায় এবং গ্রামের দর্শকদের হল মুখী করে। যাত্রাপালা রূপবান দেখা দর্শকরা সিনেমার পর্দায় রূপবান দেখা কোন পাপ কাজ মনে করতে পারে নাই।
স্বাধীনতা পূর্বের চলচ্চিত্র ছিলো যত অদ্ভুত ও অসম্ভব গল্প উপাদানের স্থুলক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। লোকনাট্য তথা যাত্রা, ধর্মীয় সংলাপ, কণ্ঠস্বর, অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদি বাহ্যিক ও আঙ্গিক বিবিধ রস উপাদানে সাজানো থাকতো চলচ্চিত্রের গঠন কাঠামো। মুখ্য বিষয় ছিল দর্শককে উদ্দীপিত, শিহরিত, রোমাঞ্চিত অথবা আমোদিত করার প্রচেষ্টা। রঙে-ঢঙে, অতি কৃত্রিমতায় কখনো বিকৃত চিন্তা ও চরিত্র চিত্রণই ছিল গল্পকে এগিয়ে নেওয়ার চালিকা শক্তি।
৪৭ উত্তরকালে এই দেশে পাকিস্তানি চলচ্চিত্রের লাভজনক একটি বাজার তৈরি হয়েছিল। পশ্চিমা বেনিয়ারা কখনো আশা করতে পারেনি মুখ ও মুখোশ (১৯৫৬) তাদের আশায় গুড়ে বালি ঢেলে দেবে। তবুও বেনিয়াদের হীন চক্রান্ত থেমে থাকেনি। ব্যবসায়িক যুক্তি দেখিয়ে বাংলা ভাষার চলচ্চিত্রের পাশাপাশি উর্দু ভাষায় চলচ্চিত্রকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান অব্যাহত রাখেন। কিন্তু এ জে কারদার-এর জাগো হুয়া সাভেরা (১৯৫৯) এবং বেবী ইসলাম-এর তানহা (১৯৬৪) উর্দু ভাষার চলচ্চিত্র হলেও বাঙালির জীবন বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটে। গল্পের বিষয়বস্তু এবং পটভূমির দাবী মেটাতে চলচ্চিত্র ভাষার প্রয়োগ ঘটে। নানা দৃশ্য ও অভিনয় কলায় ধৃত হয় নান্দনিক ব্যঞ্জনা।
১৯৬৫ পুরো সময়কাল ছিল নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো নির্মাণের ইতিহাস। এই সময়কালে দৈনিক সংবাদপত্রের সম্পাদক, চিত্র প্রযোজক, বেতার নাট্যকার, চিত্রশিল্পী, সাহিত্যের অধ্যাপকসহ শিল্প সাহিত্যের নানা ক্ষেত্র হতে উৎসাহীজনেরা চলচ্চিত্র নির্মাণে এগিয়ে আসে। নির্মিত হয় এদেশে প্রথম সিনেমা স্কোপ চলচ্চিত্র বাহানা (১৯৬৫)। পর্যায়ক্রমে চলচ্চৈত্রিক ভাষায় দর্শক উপভোগ করেছে নদী ও নারী (১৯৬৫), কাগজের নৌকা (১৯৬৬), আনোয়ারা (১৯৬৭), সোয়ে নদীয়া জাগে পানি (১৯৬৮), ময়নামতি (১৯৬৯), আসিয়া (১৯৬০), সূর্যস্নান (১৯৬২), কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩) অথবা সুতরাং (১৯৬৪) ইত্যাদি চলচ্চিত্র।
শুদ্ধ ধারার সূচনা
১৯৬৩ সালে ঢাকায় পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদ (পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটি) প্রতিষ্ঠা লাভে এদেশের চলচ্চিত্রের শিল্পরূপ চিহ্নিত হবার সুযোগ সৃষ্টি হয়। ফলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। চলচ্চিত্রকে বাণিজ্য হিসেবে গণ্য করে মূলধারা এবং সুকুমার কলা হিসেবে বিবেচনায় শিল্পধারা অথবা ‘আর্ট ফিল্ম’ নামে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ সফল হয়। ফলে বাণিজ্যিক মূল্যায়ন এবং নন্দন তাত্ত্বিক আলোচনার সূত্রপাত ঘটে। আলমগীর কবীর মনে করেন, চলচ্চিত্র প্রযোজকদের খুশি করার জন্য সমস্ত সমালোচকেরা অর্থ প্রাপ্তির আশায় সমালোচনা লেখাগুলো ফরমায়েশি এবং বাণিজ্য চলচ্চিত্রের অধিক গুণকীর্তনই ফুটে উঠেছে [কবির, ১৯৭৯ : ক- ৩২]।
জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ধারা একটি অপঠিত পাঠ, যা চলচ্চিত্র নয় ‘ক্যামেরা থিয়েটার’ নামে চিহ্নিত হয়। এই প্রসঙ্গে চলচ্চিত্র গবেষক জাকির হোসেন রাজু, উক্ত ধরনের সমালোচনা ও চলচ্চিত্র আস্বাদন নীতিকে ‘সনাতন তাত্ত্বিক’ নীতি বলে বর্ণনা করেন। যে নীতির দৃষ্টিভঙ্গি, যোগাযোগের ‘ম্যাজিক বুলেট’ তত্ত্ব বলে পরিচিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির সারকথা- দর্শককুলের ওপর চলচ্চিত্রের একটি প্রত্যক্ষ প্রভাব কাজ করে। কিন্তু ১৯৫০-৬০ দশকের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে চলচ্চিত্র তেমন গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র নয় [অস্টিন, ১৯৮৯ : ১০১]।
তবে শুধু বাংলাদেশে নয় ১৯৭০ থেকে অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রেও চলচ্চিত্র নিয়ে যে গবেষণা হয়েছে তা টেক্সচুয়াল ধারা, দর্শকের বিষয়টি অনুপস্থিত [স্টেসি, ১৯৯৩ : ২৬১-২৬২]।
ভাষা নির্মাণের মন্তাজ
১৯৫৬ সালে চলচ্চিত্র মাধ্যমটি যে সংগ্রাম ও সাহসী উদ্দীপনার মাঝে বিকাশে এদেশে পথ খুঁজে পেয়েছিল এবং দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল তা ১৯৫৬-১৯৭৫ সাল পর্যন্ত নানা প্রতিকুল পরিবেশে সুষ্ঠু ধারায় বিকাশ লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল। ১৯৫৫-১৯৫৬ সালে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) কোন চলচ্চিত্র নির্মিত হয়নি। জাগো হুয়া সাভেরা (১৯৫৯) পাকিস্তানের (তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান) পরিচালক এবং বিদেশি কলাকুশলীসহ যৌথ প্রযোজনায় নির্মাণ এদেশের শিল্পী কলাকুশলীদের মাঝে প্রবল উৎসাহ সৃষ্টি করে। গল্প নির্বাচন এবং চলচ্চিত্রে সিনেমাটিক উপাদানের যথোপযুক্ত প্রয়োগ এবং প্রশংসা লাভ করলেও পরবর্তীতে এর নান্দনিক ফলাফল তেমনিভাবে অন্যসব চলচ্চিত্রে পরিলক্ষিত না হলেও গল্প নির্বাচনে সমাজ বাস্তবতা বিষয়টি বেশি প্রাধান্য পেয়েছে।
১৯৬০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত দুটি চলচ্চিত্রই বিশেষ কারণে উল্লেখযোগ্যতা লাভ করে। ১৯৫৬ সালে এদেশের চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ আবদুল জব্বার খানের নাম স্বীকৃত হলেও তার নামের পাশাপাশি ফতেহ লোহানী, মহিউদ্দিন, সাদেক খাঁন, জহির রায়হান, এহতেশাম, ফখরুল আলম, ইবনে মিজান, আমজাদ হোসেন, খাঁন আতাউর রহমান, কামাল আহমেদ, মমতাজ আলী, নারায়ণ ঘোষ মিতা ও আজিজুর রহমান প্রমুখ পরিচালকগণ স্ব-মেধা ও শিল্প ভাবনায় দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকেন।
৪৭ উত্তরকালে এই দেশে পাকিস্তানি চলচ্চিত্রের লাভজনক একটি বাজার তৈরি হয়েছিল। পশ্চিমা বেনিয়ারা কখনো আশা করতে পারেনি মুখ ও মুখোশ (১৯৫৬) তাদের আশায় গুড়ে বালি ঢেলে দেবে। তবুও বেনিয়াদের হীন চক্রান্ত থেমে থাকেনি।
১৯৬১ সালে কখনো আসেনি (১৯৬১) চলচ্চিত্র নির্মাণেই জহির রায়হান ব্যতিক্রমধর্মী নির্মাতা হিসেবেও তার সুনাম প্রাপ্তি ঘটে। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র বিক্ষোভ, বাংলাদেশের অস্থির জনপদ, জনমানুষের সংকট সময়ে সূর্যস্নান (১৯৬২) সুস্থ ও শিল্প ধারার চলচ্চিত্র হিসেবে দর্শকদের হৃদয় নাড়া দেয়।
১৯৬৩ সালে শুভ-অশুভ ঘটনার মধ্যেই পাঁচটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩) ও ধারাপাত (১৯৬৩) নামের চলচ্চিত্র দু’টি সমাজ বাস্তবতা এবং নির্মাণশৈলীর কারণে প্রশংসা লাভ করে। পুরো ১৯৬৪ সাল জুড়ে মাত্র ১৬টি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। এই সময়ে সুভাষ দত্ত, ওবায়েদ-উল-হক সরকার, বেবী ইসলাম, এস. এম. পারভেজ, এস. এম. সফি, কাজী খালেক, কাজী জহির’র মতো উল্লেখযোগ্য পরিচালকরা আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৬৬ সালে লোককাহিনী ভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের জোয়ারে লোকপুরাণভিত্তিক গল্পের বেহুলা (১৯৬৬) স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যে মুক্তি পায়। নির্মাণ শৈলীর বৈচিত্র্যের কারণে চলচ্চিত্রটি দর্শকপ্রিয়তা লাভ করে।
১৯৬৭ সাল শুরু হয় জাতীয়তাবাদী চেতনার চলচ্চিত্র নবাব সিরাজউদ্দৌলা (১৯৬৭) মুক্তির মধ্য দিয়ে। এই বছরে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের সংখ্যা ছিল মোট ২৩টি। উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হিসেবে ইসলাম ধর্মীয় এবং গ্রাম্য সমাজ ভাবনার বস্তুনিষ্ঠ সৃষ্ট চলচ্চিত্র আনোয়ারা (১৯৬৭) প্রশংসা প্রাপ্ত হয়। ১৯৬৭ সালেই এদেশে প্রথম রূপকথামূলক চলচ্চিত্র সাইফুল মুলুক বদিউজ্জামান (১৯৬৭) নির্মাণ করেন আজিজুর রহমান। জর্জ মেলিসের ট্রিপ টু দ্যা মুন (১৯০২) এর কারিগরি উৎকর্ষে চলচ্চিত্রের ট্রিক ফটোগ্রাফি, সুপার ইমপোজিশান ইত্যাদি সম্পাদনা বিষয়ক কারিগরি কৌশলের সাথে এদেশের দর্শকদের প্রথম পরিচিতি ঘটায় সাইফুল মুলুক বদিউজ্জামান (১৯৬৭) চলচ্চিত্রটি।
১৯৬৮ সালে মুক্তি পায় ৩৪টি চলচ্চিত্র। দুই ভাই (১৯৬৮), সাত ভাই চম্পা (১৯৬৮), এতটুকু আশা (১৯৬৮) চলচ্চিত্রগুলো কিছুটা নির্মাণ কৌশল, গীত নির্বাচন, গল্পে সমাজ বাস্তবতায় ভিন্নতা দাবি করে।
‘এ খাঁচা ভাঙ্গবো কেমন করে’
চলচ্চিত্রের নিজস্ব একটা বৈশিষ্ট্য আছে। লক্ষ্য আছে বেশি দর্শকের কাছে পৌঁছে যাওয়া। এই লক্ষ্য গুণেই চলচ্চিত্রের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে রাজনীতি। রাজনৈতিক পরিবেশ চলচ্চিত্রকে প্রভাবিত করে। যেমন ঘটেছে মার্কস-হেগেলের দ্বান্দিকতার প্রতিপাদ্যের উপর সের্গে আইজেনস্টাইনের ‘মন্তাজতত্ত্ব’। অনেকেই স্বীকার করেন রাজনীতির উপাত্ত দেশপ্রেম, ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রাম এবং নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর যৌথ আকাঙ্ক্ষা সোচ্চারিত উপাত্ত কখনো চলচ্চিত্রের অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়।
১৯৬৮-১৯৭১ দীর্ঘ এক দশকেরও অধিক কালব্যাপী পাকিস্তানি মৌলবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের দমন ছিল। ১৯৭০ সালে মোট ৪২টি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। সামাজিক কাহিনীর চলচ্চিত্রের সংখ্যা ছিল অধিক পরিমাণ। গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের ইতিকথা রূপক অর্থে চলচ্চিত্রে ধারণ করায় জনগণের সমর্থন লাভে সক্ষম হয় জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০)। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস জুড়ে ১৯৭১ সালেই নির্মিত হয় বেশকিছু বক্তব্য প্রধান মুক্তিযুদ্ধের রিয়াল ফুটেজ নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র। মানবিক দলিল হিসেবে স্টপ জেনোসাইড (১৯৭১) বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে একটা পরম প্রাপ্তি।
‘ও দাইমা কিসের বাদ্য বাজে’ গীতে সিনেমা পল্লীবাংলার মানুষকে হল মুখী করতে পেরেছে। খাঁচা ভাঙ্গার গানে পাকশাসকের সিংহাসন নাড়িয়ে দিয়েছে। ‘স্টপ’ শব্দের প্রতিধ্বনি তুলে মানবতার দাবিতে বিশ্ব বিবেক জাগাতে পেরেছে।
জহির রায়হান তেমন একজন, যিনি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সমাজ বাস্তবতা এবং মানবতার পরাজয়কে সেলুলয়েডে বন্ধী করেন। পূর্ব বাংলার অধিকার, জনগণের সংগ্রাম চলচ্চিত্র দু’টিতে পোস্টারের ভাষায় উচ্চারিত হয়েছে। ইতিহাসের এই সংকটকালে এদেশে নাটক ও চলচ্চিত্র একই ধরনের রাজনৈতিক ব্যঞ্জনা প্রকাশে সোচ্চার ছিল।
আউট অফ ফোকাস
১৯৪৭ -১৯৭৫ সময়কাল ধরে এদেশের চলচ্চিত্রের দায় সংকট বিচার করতে প্রশ্ন দাঁড়াবে উক্ত সময়কাল ধরে এদেশের চলচ্চিত্র কতটা ভাষাগতভাবে বলিষ্ঠ ছিল। প্রকাশগত ভাবে কতটা ছিল ইথিকাল। কতটা ছিল উপমা যুক্ত ভবিষৎমুখী। সকল প্রশ্নের সঠিক জবাব হয়তো পাওয়া যাবেনা। তবে আমরা এদেশের সিনেমা যাত্রায় সাহসী হবার গল্প শুনেছি। ‘ও দাইমা কিসের বাদ্য বাজে’ গীতে সিনেমা পল্লীবাংলার মানুষকে হল মুখী করতে পেরেছে। খাঁচা ভাঙ্গার গানে পাকশাসকের সিংহাসন নাড়িয়ে দিয়েছে। ‘স্টপ’ শব্দের প্রতিধ্বনি তুলে মানবতার দাবিতে বিশ্ব বিবেক জাগাতে পেরেছে। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে নানাবিধ শিল্প ভাবনায় স্থিত হতে শিখেছে। চিত্রনির্মাতারা মুক্তিযুদ্ধ নামের এক নতুন শ্রেণি ধারার সিনেমা নির্মাণ কৌশল শিখেছে।
এসব অর্জনের মাঝে প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়, স্বাধীনতা পরবর্তী চার বছর একটি নতুন জাতিরাষ্ট্র সর্বদিকে কতটুকু অর্জন সাধন করতে পেরেছিল। যেখানে অদৃশ্যে যুক্ত ছিল অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাঠামো জুড়ে যে আধিপত্যশীল ক্রিয়াবাদী প্রক্রিয়া। তার কতটুকুইবা সংশোধন সম্ভব ছিল। এতোকিছুর দায় মুক্ত হবার পর আসতো শিল্প সংস্কৃতি তথা সিনেমা। এ সত্য প্রমাণিত সর্বদায় বিষয়-সংস্কৃতি থাকে অনুরোধের আসরে। সংবাদপত্রের পাতা থেকে রাষ্ট্রের পরিকল্পকদের ফাইলভূক্ত নথিতে।
অতঃপর, ১৯৭৫ সালে বাতাস ভেজা শ্রাবণের শেষ ভোর। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ড। সিনেমাকে জাতীয়করণ করার স্বপ্নে যেসব সিনেমা-সংস্কৃতি কর্মী মহান মুক্তিসংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন তাদের আশা প্রত্যাশায় ছন্দ পতন ঘটে। প্রায় তিন দশকে গড়ে ওঠা নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ভাষা ও চর্চার মাধ্যমে নির্মিত এদেশের সিনেমার রিপ্রেজিন্টেশনও আউট অফ ফোকাস হয়ে যায়। তবুও প্রত্যাশা দর্শক আজ প্রযুক্তির সাহায্যে টেলিভিশনে অথবা কম্পিউটারের পর্দায় চলচ্চিত্রগুলো দেখেছে। বিশ্লেষণ করে স্বমত প্রকাশ করছে। যা দেখেছে সবই ত্রুটিপূর্ণ চলচ্চিত্র। দৃশ্য কাটছাঁট করা। সিডি অথবা ভিডিও মাধ্যমে ধারণ করার কারণে পিকচার রেজুলেশান থাকে কম বা ক্ষয় হয়ে যাওয়া। কোনো চলচ্চিত্র থাকে আবার পুনঃ সম্পাদিত। এতো জটিলতায় একটি চলচ্চিত্রের রস আস্বাদন করা, নির্মাণ শৈলীর বৈচিত্র্যতা পরিমাপ করা অথবা ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল নির্বাচন কতটা যুক্তিসঙ্গত বিচারকর্ম প্রশ্ন সাপেক্ষ। ত্রুটিপূর্ণ চলচ্চিত্রের বিচার বিশ্লেষণ কখনো নিরপেক্ষ অথবা যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না। সন্তোষজনক না হলেও কিছু…অসমাপ্ত ত্রুটিপূর্ণ চলচ্চিত্রের বিচার বিশ্লেষণে প্রাপ্ত ফল কখনো কোনো লিখন আলোচনার পরিপূর্ণ মূল্য দিতে পারে না। এছাড়া অতীতের কোনো ঘটনা অথবা কোনো সময়কে পরবর্তী সময়ের উন্নত মূল্যবোধ দিয়ে বিচার করা কতটা নিরপেক্ষ সেক্ষেত্রে পাঠকের প্রশ্ন থাকতেই পারে। তবে আলোচ্য বিষয়টি ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র (১৯৪৭-১৯৭৫) শিল্পের স্বকীয়তা’ চিহ্নিত করণে উপরিতল বিশ্লেষণ অনুমান দাবি করে।
ড. মতিন রহমান ।। শিক্ষক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা