Categories
২৬ মার্চ সংখ্যা: ভাঙা জানালার ওপারে । শওকত আলী
আনুমানিক পঠনকাল: 12 মিনিট
একটা পাল্লার কব্জা ভাঙা, তাই জানালাটা খোলা যাবে না। খুললেই পাল্লাটা ফ্রেম থেকে খসে পড়ে যেতে পারে।
বাড়ির পুরনো চৌকিদার সাদেকালি বিছানা ঝেড়ে পাতবার সময় হুঁশিয়ার করে দিয়ে গেছে। তাই জানালাটা আবিদ হাসান খোলেন না। সাদেকালি আরো যুক্তি দেখিয়ে গেছে। বলেছে, ওই জানালা খুলে তো লাভ নাই বড় সাহেব। ফাগুন মাস তো সবে গেল, এখনো ঠাণ্ডা লাগে শেষ রাতে-আর দিনের বেলা দুপহরে পছিয়া বয়ার বহে, আর ধুলা উড়ে, জানালাটা বন্ধ থাকাই কি ভালো না, বলেন?
পছিয়া বয়ার মানে লু হাওয়া-আজ দু দিন পার হয়ে গেল এসেছেন, কিন্তু লু হাওয়ার কোনো চিহ্ন দেখেননি, তবু কিছু বলেননি তিনি। তাঁর খারাপ লাগে ভাবতে যে তিনি এ ঘরে থাকবেন, অথচ জানালাটা খুলতে পারবেন না। খারাপ অন্যকিছুর জন্য নয়। খারাপ লাগে জানালা দিয়ে আমবাগানটা দেখতে পাবেন না বলে। এ বাড়িতে এলেই ওই বাগানের দিকে তাঁর নজর লেগে থাকে। ছেলেবেলা থেকেই এই ঘরটা তাঁর জন্য বরাদ্দ ছিল। ওই জানালা সব সময় খোলা থাকত। তার কারণ ওই আমবাগান। ওই আমবাগানে ছেলেবেলায় খেলাধুলা করেছেন। যখন কলেজে, তখনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন ওই আমবাগানে বসেই। ওই রকম সময়েই মধ্যরাতে কমরেড সুনীল রায়ের রাজনৈতিক ক্লাস করেছেন ওই আমবাগানে বসে। পরে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য ওই বাগানের গাছের গুঁড়ির আড়ালে পজিশন নিতে হয়েছিল, যুদ্ধও করতে হয়েছিল ওই রকম পজিশন নিয়ে। সুতরাং পুরনো দিনের কথা মনে পড়লে ওই আমবাগানের দিকে নজর তো আপনা থেকেই চলে যাবে। বিশেষত এই মার্চ-এপ্রিল মাসে। এতে অবাক হওয়ার কী আছে? নিজেকেই বোঝান তিনি, আর আশ্বস্ত করেন। মনে মনে ঠিক করেন, সাদেকালিকে বলে কালই মিস্ত্রি লাগিয়ে জানালাটা ঠিক কারিয়ে নেবেন।
ঝাপসা কাচের ভেতর দিয়ে নজর চলে না, তার গাছগুলো আবার এখন অনেক বড়, ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া হয়ে পড়েছে ডালপালা, তার ওপর এখন আবার মুকুল ফোটার সময়। গাছতলার ঘাস-মাটি বলতে গেলে সামান্যই চোখে পড়ে।
তবু গত দু দিন ধরে থেকে থেকে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ঝাপসা কাচের ভেতর দিয়ে নজর করে দেখছেন।
হ্যাঁ, দেখছেন আর খুঁজছেন। প্রতি বছরই এই সময় ফাতেমাকে ওই আমবাগানে দেখা যায়। হয় গাছতলায় বসে আছেন, নয়তো বাগানের ভেতরে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু এবার তাঁকে দেখা যাচ্ছে না, গতকাল খুঁজেছেন, আজও খুজলেন, কিন্তু দেখা হলো না। তাঁর চিন্তা হয়। মার্চ তো প্রায় শেষ, তবু ফাতেমা নেই কেন?
গত বছরও দেখা হয়েছে। ওই আমবাগানেই প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে দেখা-সাক্ষাত্ আর ঘুরে বেড়ানো। ওই একই জায়গায়। হ্যাঁ, কথাবার্তাও হয়েছে। সবই পুরনো দিনের কথা। কখনো ফাতেমা বলেছেন, কখনো তিনি নিজে। ফাতেমা বলেছেন, মাহমুদের সঙ্গে তাঁর প্রথম আলাপের আর সেই সঙ্গে প্রেমের কথা। দু বছরের দামঙ্ত্য জীবনের কথা, তারপর বিধবা হয়ে যাওয়ার পর একাকী সন্তান পালনের কথা, তার নিসঙ্গ জীবনযাপনের কথা। আর তিনি বলেছেন, তাঁর কলেজ-জীবনের কথা আর ইউনিভার্সিটি জীবনের কথা, সেই সঙ্গে গোপন দলের রাজনীতি করার কথাও-ঘণ্টার পর ঘণ্টা-কথা ফুরোতে চাইত না-কখনো গাছতলায় বসে, কখনো হাঁটতে হাঁটতে। ওসব পুরনো স্মৃতির কথা বলার কারণ তিনি মাহমুদের সহপাঠী ছিলেন, কলেজে যেমন তেমনি ইউনিভর্সিটিতেও শুধু সহপাঠী নয়, অভিন্নহূদয় বন্ধুও। আর যুদ্ধের সময় তো দুজনে সহযোদ্ধা। তাই দুজনার কথা আরম্ভ হলে ফুরোতে চায় না। একই কথা বারবার বলা হতে থাকে, তবু না। অথচ এবার তিনি ফাতেমাকে দেখছেন না, কিন্তু কেন? প্রতিবারই তো ফাতেমাই আগে আসেন, তিনি পরে। এবার কী হলো? গতকাল দেখেননি। আজও দেখলেন না। তাহলে কি সেবারের মতো কিছু ঘটেছে? সেবার মানে বছরতিনেক আগে যেমন আসতে পারেননি, এবারও কি তেমনি আসতে পারেননি?
সেবার তিনি ঠিকই এসেছিলেন। আমবাগানে স্মৃতিচারণ করতে করতে ঘুরেও বেড়িয়েছিলেন। পরে খোঁজ নিতে গেলে জানতে পারেন ফাতেমা আসতে পারবেন না। তাঁর ভাইপো জানায়, ছোট ফুফু বোধ হয় এবার আসতে পারবেন না, মাত্র কয়েক দিন আগে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন।
ওই কথা শোনার পর চুপচাপ চলে এসেছিলেন, কিছুই বলার ছিল না তাঁর। করারও না। বলবেনইবা কী, আর করবেনইবা কী। ঢাকা থেকে দিনাজপুর আসা কি সোজা ব্যাপার? তাও একাকী? অমন অসুস্থ অবস্থায়? সেবার দিন দুই পরেই তিনিও রাজশাহী ফিরে যান। কী যে হয়েছিল এখনো জানেন না, একাকী আমবাগানে ঘুরতে তাঁর খুব খারাপ লাগত। দু দিন পর আর সহ্য হয়নি, তিনি ফিরে গেছেন।
এবারও কি অমন কিছু হবে? ফাতেমা আসবেন না, আর তিনি দু দিন পর আবার রাজশাহীতে ফিরে যাবেন?
এই শহরে পূর্বপুরুষের ভিটা থাকলেও এখানে তিনি থাকেন না। রাজশাহীতে তাঁর বসবাস। ওখানেই চাকরি ছিল, ঘরবাড়িও ওখানেই করেছেন। প্রথম দিকে সপরিবারে আসতেন। প্রায় সপ্তাহখানেক ছুটি কাটিয়ে যেতেন এখানে। এই রকম সময়েই, এই মার্চ মাসের শেষ দিকে। স্ত্রী সাবিনা মুখে কিছু না বললেও স্বামীর মন যে একটা সময় আর একটা জায়গায় বাঁধা পড়ে গেছে, সেটা বুঝতেন। আর সেজন্যই ফেব্রুয়ারি মাস পার হওয়ার পর থেকেই শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার আয়োজন শুরু করে দিতেন। সাবিনাও স্বামীর সঙ্গিনী হতেন আমবাগানে ঘোরার সময়। ফাতেমার সঙ্গে তাঁরও আলাপ হতো। বসে আলাপ করতেন আবার হাঁটতে হাঁটতেও। কী আলাপ হতো দুজনায়, তা কখনো জানতে পারেননি। তবে বুঝতেন, ফাতেমার সঙ্গে আলাপ করতে সাবিনারও ভালো লাগত।
সেই সব দিন আর নেই। এখন ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। সাবিনা চিরবিদায় নিয়ে চলে গেলেন, মেয়ে স্বামীর সঙ্গে কানাডায়, ছেলেরও সংসার হয়েছে। চাকরি ঢাকায়। রাজশাহীতে তিনি একা। দু-চারজন বন্ধুবান্ধব আছে বলে রক্ষা। না থাকলে যে কী হতো বলা মুশকিল! ওদের সঙ্গেই মেলামেশা আর গল্পগুজব হয়। আর বাড়িতে আছে একটি অল্পবয়সী অবাঙালি দমিত। ওরা বাড়িতে থাকে, রান্নাবান্না আর ঘরবাড়ি দেখাশোনা করে। তাঁর সেবাযত্নের দিকেও ওদের মনোযোগ যথেষ্ট। অবশ্যি একেবারে এমনি এমনি নয়, মাসান্তে কিছু টাকা ওদের হাতে নিয়মিত দেন। তবে যা-ই হোক, তিনি স্বীকার করেন, চেনাজানা মহলে তিনি বলেনও যে, শফিক আর গুলবাহার যতদিন তাঁর সঙ্গে আছে, ততদিন দিন গুজরান ভালোভাবেই চলবে। ওদিকে আবার কয়েক বাড়ি পরই সাবিনার এক ভাইঝি থাকে, সেও দু-তিন দিন পরপর খোঁজখবর নিয়ে যায়। তাই ছেলেমেয়ে সঙ্গে না থাকলে কী হবে, আসলেই তাঁর কোনো অসুবিধা হয় না। খুব যে আরামে থাকেন, তা বলতে পারবেন না। তবে যেটুকু স্বাচ্ছন্দ্য পান, তাইবা কম কিসে? পাড়া-প্রতিবেশীরা তাঁকে প্রায় সবাই চেনে হাসান স্যার বলে। যদিও তাঁর পুরো নাম অনেকেই জানে না। একবার এক নতুন পিয়নকে তাঁর চিঠি নিয়ে বেশ কয়েকটা বাড়ি ঘুরতে হয়েছিল। কারণ ঠিকানার জায়গায় বাড়ির নম্বর লেখা ছিল না। লেখা ছিল রাস্তার নাম আর তাঁর পুরো নামটা পেশার পরিচিতি ছাড়া।
সকাল পার হয়ে দুপুর হয়, দুপুর গড়িয়ে বিকেল। বন্ধ জানালার ঝাপসা কাচের ভেতর দিয়ে আমবাগানের দিকে বারবার তাকিয়ে দেখেন কিন্তু বাগানের ভেতরে বা আশপাশে কোনো মহিলাকে আবিষ্কার করতে পারেন না।
বিকেলবেলা আর ভালো লাগে না। তখন বেরিয়ে পড়েন। গেট দিয়ে বেরুবেন, ওই সময় পেছন থেকে ডাকতে ডাকতে ভাগ্নের বড় মেয়ে দোলন ছুটে আসে। বলে, দাদু কোথায় যাও?
বলেন, বেশি দূরে না, এই আমবাগানের দিকে।
আমিও যাই?
তুই যাবি? আবিদ হাসান নাতনির মুখের দিকে তাকান। তারপর কী দেখেন, তিনিই জানেন। বলেন, ঠিক আছে, চল।
তারপর আবার বলেন, তুই মনে হচ্ছে কোথাও বেরুচ্ছিলি?
হ্যাঁ, দোলন জানায়। বলে, কোচিং স্যারের কাছে যেতে হবে, সামনের মাসেই তো পরীক্ষা-কিন্তু সীমার আসতে মনে হয় দেরি হবে।
সীমা কে? কোথায় থাকে?
সীমার পুরো নাম নাসিমা হায়দার, আমাদের বাগানটার পরই ওদের বাড়ি। ওর আব্বার নাম নাজমুল হায়দার, চেনেন?
আবিদ মাথা দোলান, তাতে হ্যাঁও বোঝা যায়, আবার নাও বোঝা যায়।
মিনিট দুই হাঁটতে হয়। তারপর বাগানের ভেতরে ঢোকেন।
দোলন জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা দাদু, তোমরা যখন ছোট ছিলে তখনো কি বাগানটা এই রকমই ছিল?
আবিদ দাঁড়িয়ে পড়েন। বলেন, এই রকম মানে কী রকম?
এই রকম মানে বড় বড় গাছ, মোটা মোটা গুঁড়ি, ছড়ানো ডালপালা আর এমন ঝেঁপে মুকুল আসা! আর আমের গুটি ধরলে, বাঁশের মাচার শুয়ে শুয়ে রাতের বেলা পাহারা দেওয়া?
দোলনের কথা শুনে আবিদ হাসেন। বলেন, হ্যাঁ আগেও এমনই ছিল। আমবাগান তো এমনই হয়ে থাকে-গাছগুলো এখন বড় হয়েছে, আর গুঁড়িগুলোও মোটা দেখায়। শুধু গাছের চেহারা কেন? আরও মিল আছে, মুকুল ফুটলে মৌমাছির ভিড় হবে, ভোমরারও-আম পাকতে ধরলে আমচোরদের উত্পাত বাড়বে, বাতাসে পাকা আমের গন্ধ ভাসবে। ভোর হওয়ার আগেই আমকুড়ানি ছেলেমেয়েদের দেখা যাবে।
দোলন বুঝতে পারে যে দাদু তার সঙ্গে মজা করার জন্য অত কথা বলছেন। সে দু হাত তুলে বলে, হয়েছে দাদু হয়েছে, ওসব আমরা রোজই দেখছি-ওসব আমাদের বলতে হবে না-আমি জানতে চাইছি, বাগানটা আগের মতো আছে কি না।
হ্যাঁ, আমি তো দেখছি, আগের মতোই আছে। আবিদ জানান।
দোলন হাসে। বলে, না দাদু আগের মতো নেই। আমি শুনেছি এই বাগানের ভেতরে রাতের অন্ধকারে মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিং নিত, বিপ্লবী রাজনীতি যারা করত, তাদের ক্লাস হতো এখানে, এখানেই যুদ্ধ হয়েছিল দু-দুবার। শুধু এই বাগানে না, এদিককার অনেক বাগানেই।
আবিদ নাতনির কথা শুনে দাঁড়িয়ে পড়েন, বলে কী মেয়ে! এতসব জানে ুও? তার কাছে অবিশ্বাস্য লাগে।
এবার কিন্তু তোমার বন্ধুর ওয়াইফ আসেননি, তাই না?
আবিদ মনে মনে চমকান, ফাতেমার না আসাটাও ওদের চোখে পড়েছে! বলেন, হ্যাঁ, তাই তো দেখছি, আবিদ ডাইনে বাঁয়ে তাকাতে তাকাতে বলেন।
আচ্ছা, বাগানের এদিকটাতে কি সত্যি সত্যি যুদ্ধ হয়েছিল?
হ্যাঁ এদিকেও যুদ্ধ হয়েছিল, কেন?
আমার বান্ধবী সামিনা বলে, যুদ্ধ নাকি হয়েছিল নদীর ধারে, আমবাগানগুলোতে। ওদের বাড়ির কাছে।
আবিদ আবার থমকান। স্মরণ করার চেষ্টা করেন। আর মনের ভেতর থেকে জবাব পান। কেউ যেন বলে ওঠে, হ্যাঁ ওখানেই তো যুদ্ধের শুরু। তার মনে পড়ে ইপিআর ক্যামঙ্ থেকেই যুদ্ধ শুরু হয়। ওই ক্যামেঙ্র চারদিকের বাগানগুলোতে প্রথম পজিশন নেয় ইপিআরের বাঙালি জোওয়ানরা।
তিনি নাতনিকে বলেন, হ্যাঁ ওখানে যুদ্ধ হয়েছিল, শুধু ওখানেই নয়, যত আমবাগান আছে এ দেশে, সব আমবাগানেই যুদ্ধ হয়। শুধু আমবাগান নয়, খালের পাড়, রাস্তার ধার, জমির আল-সব জায়গায় পজিশন নিয়েছিল মুক্তিযোদ্ধারা।
তোমরা কি প্রথমদিকেই যুদ্ধ করতে যাও? নাকি তখন বাড়িতেই ছিলে, যখন যুদ্ধ হচ্ছিল? কোন গাছের আড়াল থেকে গুলি ছুড়েছিল প্রথম, মনে আছে?
এবার আর জবাব দিতে পারেন না। তার সন্দেহ হয়, তিনি যে গাছের গুঁড়ির আড়ালে পজিশন নিয়েছিলেন, সেটা কি এই আমবাগানে? নাকি ওই দক্ষিণদিকের বাগানে, নাকি তারও দক্ষিণে যে আমবাগান, সেখানে।
আমাদের বাড়িতে তখন কি সবাই ছিলেন? বড় বাপ, বড় মা, মানে তোমার বাবা মা, বড় দাদু, তোমার বড় বোন, তোমার আব্বা, সবাই কি ছিলেন? আমার আব্বা তো তখন খুবই ছোট, তাই না?
আবিদ হাসানের মগজের ভেতরটা কেমন যেন গুলিয়ে যায়। সবাইকে স্মরণ করতে পারেন না। তবে ওই সময় বাড়িতে যে কেউ ছিল না, সেটা তার সঙ্ষ্ট মনে আছে এবং তিনি তা জোরের সঙ্গে বলেন। তারপর তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, কেন, তোর আব্বা বলেনি তোদের? কে কোথায় ছিল তখন?
নাহ্, দোলন মাথা নাড়ায়। বলে, আব্বু কীসব বলেন, কিছু বোঝা যায় না। একবার বলেন, যুদ্ধের সময় এ বাড়িতে ছিলেন; আবার বলেন, ছিলেন না-তারা সবাই আমার দাদীর বাপের বাড়ি ঘুঘুডাঙ্গার চলে গিয়েছিলেন।
আবিদ স্মরণ করার চেষ্টা করেন ঘুঘুডাঙ্গায় কি গিয়েছিল ওরা? নাকি হোসেনপুরে? না রানীগঞ্জে?
ঠিকমতো স্মরণ হয় না, তবে তিন জায়গাতেই যে সরে যেতে হয়েছিল বাবা-মা আর ভাইবোনদের-সেটা তার খুব সঙ্ষ্টই মনে আছে কিন্তু কোথায় আগে আর কোথায় পরে সেটা ঠিকমতো স্মরণ করতে পারেন না।
দোলন একটু পর বলে, জানো দাদু, কয়েক মাস আগে এই আমবাগানের কয়েক জায়গায় খোঁড়াখুঁড়ি করে গেছে কিছু লোক। কোত্থেকে কে নাকি ওদের বলেছিল যে এই আমবাগানে অনেক মুক্তিযোদ্ধার লাশ পোঁতা আছে।
তাই নাকি? আবিদের অবাক লাগে। বলেন, কোত্থেকে এসেছিল ওরা, বলেনি? লাশ পেয়েছিল?
না, পায়নি, পোঁতা হয়ে থাকলে তবেই না পাবে! আব্বা নিষেধ করেছিলেন লোকগুলোকে, ওরা শোনেনি। এখানে কি কোনো লাশ পোঁতা হয়েছিল? তোমার মনে পড়ে?
নাহ্, আবিদ মাথা নাড়ান। বলেন, আমরা শুনিনি। আর দেখার তো উপায়ই ছিল না। কারণ আমরা তখন বর্ডারের ওপারে। ট্রেনিংয়ে ছিলাম। ফিরে আসার পরও আমাদের কেউ বলেনি।
দুজনে হাঁটতে হাঁটতে বাগানের শেষ প্রান্তে পৌঁছে যায়। বাগান শেষ হওয়ার পর ঢালু জমি একদিকে আর অন্যদিকে একটা ডোবা।
আবিদ দাঁড়িয়ে থাকেন, আবাদি ক্ষেতের ওপারে গ্রাম। ওদিকেও আমবাগানের ওপর দিয়েই দিগন্তরেখা দেখা যায়। সূর্যান্তের কিছু দেরি আছে। তার মানে, এবার একটু আগে এসে পড়েছেন। প্রত্যেক বছরই বাগানের এই শেষ সীমানায় দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখেন। এটা আরম্ভ করে ফাতেমা। এখানে এলেই সূর্যাস্ত দেখবেন প্রতিদিন-কেন, তা জিজ্ঞেস করেননি কখনো। কিন্তু পরে খেয়াল করেছেন এখানে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখতে তারও ভালো লাগে।
সূর্যাস্ত পর্যন্ত থাকতে চাইছিলেন। কিন্তু দোলনকে দেখে মনে হলো, ও কেমন যেন উসখুস করছে, বেশ অস্থির দেখাচ্ছে ওকে।
কী ব্যাপার তোর কি খারাপ লাগছে? তিনি জিজ্ঞেস করেন।
না, তা নয়, দোলন জানায়। বলে, ওদিকে সীমা বোধ হয় আমার জন্য বসে আছে, তখন বললাম-না, কোচিং স্যারের কাছে যেতে হবে।
তো ঠিক আছে, চল, ফিরে যাই। কাল না-হয় বাজারে আসব।
দাদুর কথা শুনে তার মুখের দিকে তাকায় দোলন। তারপর বলে, না দাদু, তুমি থাকো, দেখো ঘুরেফিরে, আমি বরং চলে যাই।
আরে নাহ্। আবিদ হাসান ছেলেমানুষি শুরু করেন। বলেন, একা একা বিরহ যাতনা কেন ভোগ করব? একসঙ্গে যাই, যা থাকে কপালে। শুরু হয় ফেরত যাত্রা। আমবাগানের ধার ঘেঁষে রাস্তা। সেই রাস্তার দিকে তাকাতে তাকাতে ফেরেন। তার মনে পড়ে এই রাস্তা ধরেই তারা ফিরেছিলেন। তখন পাঁচজন নয়, তিনজন। দুজনকে হারিয়েছেন শহর ছেড়ে যাওয়ার সময়। পূর্বদিক থেকেই এসেছিল ওরা। তখন আমবাগানই ছিল পজিশন নেওয়ার ভালো জায়গা। ইপিআরের সুবেদার শমসের আলীর কাছে নেওয়া মাত্র কয়েক দিনের ট্রেনিং-ওই ট্রেনিং আর একটা করে রাইফেল আর কিছু গুলি-এই মাত্র সম্বল। ওই সম্বল নিয়ে কতক্ষণ লড়া যায়? ট্রাক, জিপ, রাইফেল, মেশিনগান আর অঢেল গুলি শত্রুপক্ষের। তবু লড়াই করছিল ঘণ্টা দুইয়েরও বেশি সময়।
তাদের পেছাতে হয়েছিল পশ্চিমে, কারণ ওদিকে নদী, আর তার পর বর্ডার। মাহমুদের সঙ্গে আর দেখা হয়নি। তার খোঁজখবরও কেউ পায়নি। মনিরের খোঁজ পাওয়া যায় যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে। পাকিস্তানি আর্মি শহর পুনর্দখল করার সময় যুদ্ধটা হয়। মনিরের বুড়ো বাপ ছেলের লাশ খুঁজে পান দু দিন পর রাতের বেলা। ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে লাশটা সরিয়ে এনে রাতেই দাফন করেন। মনিরের বাবাও প্রতিবছর আসতেন। যতদিন বেঁচে ছিলেন।
হাঁটু গেড়ে বসতেন মাটির ওপর। তারপর দু হাতের পাতা মাটির ওপর রেখে বুলাতে বুলাতে বলতেন, এই মাটি আমার ছেলে মনিরের রক্তে ভিজে গিয়েছিল, এখানে ওর রক্ত মিশে গেছে। এখানে আমি না এসে পারি? এই মাটিই তো আমাকে ডাকে, প্রত্যেক বছর এই সময়।
কিন্তু মাহমুদের লাশ কেউ খুঁজে পায়নি। ওদের আসল বাড়ি ছিল বগুড়ায়। ওর বাবা জজ কোর্টের পেশকার ছিলেন। ভাড়াটে বাড়িতে থাকতেন। বড় ছেলে মাহমুদের তখন লেখাপড়া শেষ। চাকরি খুঁজছেন। প্রেম করে ফাতেমাকে বিয়েও করা হয়ে গেছে। এবং বাপ হতেও দেরি নেই। স্বামী রাজনীতি নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফাতেমা রাগে অভিমানে বাপের বাড়ি চলে গেছে-এদিকে শহরের অবস্থা খারাপ দেখে ওর বাবা-মাও ছেলেমেয়েদের নিয়ে চলে গেলেন বগুড়া।
মার্চ মাসের শেষ কয়দিন আর এপ্রিলের প্রথম দিকে বেশ কিছুদিন দিনাজপুর স্বাধীন ছিল। তারপর আবার দখল করে নেয় পাকিস্তানি আর্মি। মাহমুদের লাশের খবর কেউ বলতে পারেনি। শুধু ফাতেমাই খুঁজে বেড়িয়েছে। স্থানীয় লোক, মানে কসবা এলাকার লোকেরা একেকজন একেক কথা বলে। প্রথমে বলত, আমবাগানে পাকিস্তানি আর্মির লোকেরা অনেকগুলো লাশ পুঁতে রেখেছে। যদি প্রশ্ন করা হতো, ঠিক কোন জায়গায় পোঁতা হয়েছে লাশগুলো? দেখাতে পারবে? তো তখন আর কথা বেরুত না কারোর মুখ দিয়ে।
আবিদ হাসান ডাইনে-বায়ে তাকান। আর হাঁটেন। বন্ধু মাহমুদের শেষ পরিণতি কী হয়েছিল, কেউ বলতে পারে না। আবিদের বুকে গুলি লাগার দৃশ্যটা অনেকেরই চোখে পড়েছিল। তিনিও দেখেছিলেন, বলা যায় কাছ থেকেই, কিন্তু পরে মাহমুদকে কেউ দেখেনি। তবে পরের দিন একটা লাশ টানতে টানতে পাকিস্তানি আর্মির লোকেরা ট্রাকে তুলেছিল, সেই দৃশ্য দূর থেকে অনেকেই দেখেছে। লাশটার পরনে ছিল কালো রঙের জামা। আর তাতেই অনেকের বোঝা হয়ে যায় যে, ওটা মাহমুদেরই লাশ। সেদিন যে পাঁচজন আমবাগানে পজিশন নেয়, তার মধ্যে শুধু মাহমুদেরই পরনে ছিল কালো জামা। লাশটাকে ট্রাকে তুলে নিয়ে যেতে দেখেছে অনেকে কিন্তু তারপর ওই লাশের কী হয়, সে খবর কেউ বলতে পারে না। পুলিশের একজন ড্রাইভার পরে জানিয়েছিল যে, কয়েকটা লাশ এনে কসবার আমবাগানে পুঁতে দিয়েছিল একজন আর্মি অফিসার। গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যায় সে-ই। কিন্তু কোন বাগান সেটা, তা বলতে পারবে না। কারণ তখন মধ্যরাত, আর অন্ধকারটাও ছিল খুব গাঢ়। ওই ড্রাইভারে কথা ফাতেমার বিশ্বাস হয়ে যায়। আর তখন থেকেই ও মনে করে আমবাগানেই মাহমুদের লাশ পোঁতা আছে। ড্রাইভারটি একখানা পকেট ডায়েরিও দেয় ফাতেমাকে। যারা লাশ নামিয়ে ছিল গর্তে তাদেরই একজন ওই ডায়েরিটা দেয়। আর ফাতেমার ডায়েরিটা চিনতে একটুও অসুবিধা হয়নি তিন বছর পরও। আবিদকে দেখাননি ডায়েরিটা, কিন্তু বলেছেন, ডায়েরির ভেতরের পৃষ্ঠাগুলোতে নাকি রক্তের চিহ্ন লেগে আছে।
দোলন বান্ধবীর দেখা পায় বাড়ির গেটের কাছেই। দাঁড় করিয়ে ছুটে ভেতরে যেতে আর ব্যাগ নিয়ে আসতে যেটুকু সময় লাগে। তারপরই রিকশাটা দেখতে দেখতে চোখের আড়াল হয়ে যায়। তার অবাক লাগে, যাওয়ার সময় একটা কথাও বলল না দোলন, এমনকি একবার ফিরেও তাকায়নি।
নাতনি চলে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ বাড়ির সামনে রাস্তায় পায়চারি করেন আবিদ হাসান। আর পুরনো প্রশ্নটা তার মনের মধ্যে বারবার জেগে ওঠে। কেন তিনি এখানে আসেন? ভাগ্নেকে দেখতে? যদি শুধু ভাগ্নেকে দেখতেই আসেন তো বছরের যেকোনো সময় আসলেই তো হয়। মার্চের শেষে কেন আসেন? কেন থাকেন এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত? এখানে তো কেউ তাকে ডাকে না। তবু বছরের এই সময়টা এখানে কাটাবার জন্য কেন তার মন আকুলি-বিকুলি করে? আর কদিনইবা বাঁচবেন! যখন শরীর আরো ভেঙে পড়বে, শরীরে শক্তি থাকবে না। তখন কি আসবেন? আসতে পারবেন?
নিজের মনের দিক থেকে কোনো উত্তর পান না। কারণ তার এখানে আসার যুক্তি দাঁড় করাতে পারেন না। কিন্তু অনুভব ঠিকই করেন, তবু তিনি আসবেন, তার মন এখানে আসবার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকবে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। আকাশের দিকে তাকান। না, চাঁদ ওঠেনি। তার স্মরণ হয়, রাজশাহী থেকে নাইট কোচে রওনা হওয়ার সময় আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ ছিল-তার মানে চাঁদ আজ দেরিতে উঠবে। ওই সময়ই খেয়াল হয়, শহরে তো এখনো দুজন পুরনো বন্ধু আছে তার। তিনি তাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য রিকশায় চেপে রওনা হয়ে যান।
মাহতাবের বাড়িতে গিয়ে শোনেন ও ঢাকায় গেছে চিকিত্সার জন্য। কবে ফিরবে কেউ বলতে পারে না।
দ্বিতীয় বন্ধু কায়সারের বাড়ি যাওয়ার পথে পড়ে ফাতেমাদের বাড়ি। রিকশা দাঁড় করিয়ে খোঁজ নিতে যান। বাড়িটা অস্বাভাবিক রকম চুপচাপ। ডাকাডাকি করার পর দরজা খোলে এবং একটি অল্পবয়সী বউকে দেখা যায়। চেহারা দেখে মনে হয়, বাড়িতে শোকাবহ কোনো ঘটনা ঘটে গেছে। ফাতেমার ভাইপো ইমরানের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে বউটি জানায়, উনি নেই, ঢাকায় গেছেন, আমি ওঁর ওয়াইফ।
ওর ফুফু কি আসবেন?
না, বউটির মুখ থমথম করে ওঠে। মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলে, না আসবেন না, আর কখনো আসবেন না, উনি আর নেই।
আবিদ হাসান মুহূর্তের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে যান। তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয় না। ইমরানের বউ আরো কিছু বলে, কিন্তু কী বলে, তাঁর কানে যায় না? আচ্ছন্ন অবস্থায় কতক্ষণ কাটে, তাঁর খেয়াল ছিল না। রিকশাওয়ালার ডাকাডাকিতে তাঁর হুঁশ ফেরে। রিকশাওয়ালাকে বিদায় করে দেন। কায়সারের বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছেটা তখন আর নেই। পাহাড়পুরের রাস্তায় ভিড় কম, তিনি হাঁটতে হাঁটতে ফেরেন। ফাতেমা তাহলে চলে গেলেন। আর কোনোদিন দেখা হবে না। মাহমুদের কথা আর কেউ তাঁকে বলবে না, আর তিনিও মাহমুদের কথা কাউকে বলতে পারবেন না। কে শুনবে? মাহমুদ একবার একটি সাঁওতাল ছেলেকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল। তারপর তাকে প্রাইভেট স্টুডিও জুটিয়ে দিয়েছিল-এটা এমন কী ঘটনা যে এর জন্য তাকে স্মরণ করতে হবে?
কলেজে পড়ার সময় সে গরিব ছেলেদের বটতলায় বই পড়তে শেখাত, সে কাজটাওবা এমন কী ভালো যে, সেজন্য তাকে স্মরণ করতে হবে? কিংবা ছাত্র আন্দোলনে যে তার ভূমিকা প্রধান ছিল, সেটাও এমন কিছু স্মরণীয় বলে এখন কারো মনে হয় না। হলে নিশ্চয়ই তাকে স্মরণ করত। আর মুক্তিযুদ্ধ? ও তো সবাই করেছে-ও আর এমন কী? অথচ ফাতেমা তাকে সারা জীবন ধরে স্মরণ করেছেন। যতবার দেখা হয়েছে ততবারই মাহমুদের কথা শুনিয়েছেন আর কেঁদেছেন। বলেছেন, আবিদ ভাই, আমি খুব জেদী মেয়েমানুষ-ও আন্দোলন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল বলে মনে হতো আমাকে ও অবহেলা করছে, আমার সন্তানকেও অবহেলা করছে-আমি খুব জেদী আর বোকা মেয়ে ছিলাম আবিদ ভাই-ওই রকম সময় আমি ওকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম-বলুন আবিদ ভাই। আমার এই বোকামি আর স্বার্থপর হওয়ার কি মাফ আছে? আমি ওর কাছে মাফ চাইতে আসি-কিন্তু কোথায় যে আছে ও জানি না, কেউ বলতে পারে না।
হ্যাঁ গতবারও তাঁর কাছে বসে কেঁদেছেন ফাতেমা। এবার আর কেউ কাছে বসে কাঁদবে না। আমাদের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে থমকে দাঁড়াতেন। তারপর পেছনে তাকিয়ে বলতেন, কেউ কি পেছনে থেকে ডাকল? আবিদ ভাই, আপনি শুনেছেন?
বহুবার বলা হয়েছে, মাহমুদের লাশের শেষ পর্যন্ত কী হয়েছে কেউ জানে না-অনেক লাশ মাটিতে পোঁতা হয়েছে। অনেক লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেক লাশ আবার খোলা জায়গায় পড়ে থেকে শেয়াল-কুকুরের খাদ্য হয়েছে-মাহমুদের লাশের পরিণতি এমনই কিছু হয়ে থাকবে কিন্তু ফাতেমার মন মানতে চায়নি। তাঁর নিজের মনই কি মানতে চেয়েছে? আবিদ নিজেকে প্রশ্ন করেন।
আবিদ হাসান হাঁটতে হাঁটতে বাসায় ফেরেন। রোজকার মতোই হাত-মুখ ধুয়ে ঘরে গিয়ে বসলে চা দেওয়া হয়। চা খান, তারপর খবরের কাগজ দেখেন, চুপচুপ রাতের খাবারও খেয়ে নেন। চারদিকের বাতি নিভে যায়, মানুষজন ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু তিনি ঘুমোতে পারেন না। আমবাগানের দিকে তাকান বারবার করে।
বাইরে তখন জ্যোত্স্না। কাচের ভেতর দিয়ে ঝাপসা দৃশ্য দেখতে তাঁর ভালো লাগে না, ঠেলে জানালার একটা পাল্লা খুলে দেন। বাইরের বাতাস এসে লাগে চোখে মুখে, বাতাসে আমের মুকুলের গন্ধ, বাগানের ডালপালাগুলো খুব মৃদু লয়ে যেন দুলছে বলে মনে হয়। জ্যোত্স্না রাতে ওই বাগানের মধ্যে হেঁটেছেন কতদিন তার হিসেব নেই। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই এক সময় একজন মহিলাকে যেন দেখতে পান। এলোচুল, আঁচলে বাতাস লেগে একটু বোধ হয় দুলছে। হাঁটার ভঙ্গিটা খুব চেনাচেনা লাগে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই চিনে ফেলেন-আরে! ও তো ফাতেমা! ফাতেমা কি এসে গেছেন? তাহলে ইমরানের বউ ওটা কেমন খবর জানাল? তাঁর শ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে চায়।
তিনি ভালো করে দেখার জন্য জানালার কাছ ঘেঁষে দাঁড়ান। ততক্ষণে মহিলাটি গাছের গুঁড়ির আড়ালে চলে গেছেন। আড়াল থেকে যখন আবার বেরুলেন, আর ফিরে আসতে লাগলেন। তখন দু চোখ কচলে আবার তাকান আবিদ হাসান-না কোনো ভুল নেই। ফাতেমাই উনি। শুধু বয়সটাই কম মনে হচ্ছে, আট-দশ বছর আগে যেমন ছিলেন, এখনো তেমনই দেখাচ্ছে তাঁকে।
তাঁর মনে পড়ে, তখনো দুজনে পাশাপাশি হেঁটেছেন। আর কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অতীত-বর্তমান একাকার হয়ে যায় তাঁর বোধ আর বুদ্ধিতে। তাঁর কেবলই মনে হয়, তাঁরও এখন আমবাগানে যাওয়া দরকার। এবং উদভ্রান্ত মন নিয়ে তিনি ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে পড়েন-কেউ যেন তাঁকে ডাকছে, এমন মনে হয়। ফাতেমা, না মাহমুদ-বুঝতে পারেন না। তবু আমবাগানের দিকে ছুটে যান।
সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৩ প্রথম আলোর “স্বাধীনতা দিবস” বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত