| 29 মার্চ 2024
Categories
এই দিনে কবিতা সাহিত্য

ইরাবতী এইদিনে: একগুচ্ছ কবিতা । মীরা মুখোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

আজ কবি মীরা মুখোপাধ্যায়ের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা। ইরাবতীর পাঠকদের জন্য রইলো মীরা মুখোপাধ্যায়ের একগুচ্ছ কবিতা


কালবৈশাখী
 
একুশে বৈশাখ আজ
সন্ধ্যার সামান্য আভা মুছে নিল হাওয়ার দাপট,
আমি যে ঝড়কে এত ভয় পাই
জানালার পর্দা সরিয়ে তাও আকাশ দেখলাম
যাকে ঝরোখা দর্শন বলে
এ ঝড়ের নাম আমি নাজিম হিকমত দিতে পারি
 
 
রোগা হাত বাড়িয়ে কি কপাট বন্ধ করে দেবো
যূথবদ্ধ মেঘের জঙ্গলে সব ফেলে ভেসে গেলে
খুব কি লোকসান হবে !
ছড়ানো ছিটানো জীবন ও জীবনের সাজানো
সংলাপ…..
 
ঝড়ের পরের দিন কিছুই ঘটেনা
শুধু ঋতুক্ষান্ত মলিন মেয়েটি
ঝড়ে ছিঁড়ে যাওয়া তার ফুলছাপ পর্দাটি দেখে
সেলাই করার কথা ভাবে
 

 

 

অকথিত কথাগুলি
 
এসব বর্ষার দিনে ইচ্ছে করে
অকপট হতে
যা বলা হয়নি এতো দিন
ঝড়ের শব্দের সাথে বলি
 
ইচ্ছে করে বর্ষণমুখর মধ্যরাতে
মৃদু করে আলোর উৎসবে
সব কষ্ট ধুয়ে ফেলি প্রেমে
বিরহের অতুলপ্রসাদে
 
কিন্তু মাঝামাঝি রাতে বৃষ্টি নামে
পাগলা বাতাসও দেখি
গুটিয়ে নিয়েছে তার ডানা
যা বলা হয়নি তা
অকথিত রয়ে যায় আজও
 
বর্ষাই তো সব নয়
এরপর চৈত্রদিন আছে

 

বিষাদ ছোঁয়া একটি দিন
 
এমন হতাশ একটি পঁচিশে বৈশাখ
আমরা দেখিনি কেউ
ডাকঘর নাটকের জন্য সুধা সাজবেনা দীপা,
তার ফুলের সাজিতে ভরা সাবান ও স্যনিটাইজার
 
কোয়ারেন্টাইন পর্ব শেষ হলে
অমল কি আশা করবে পাঁচমুড়ো পাহাড়ের নিচে
শ্যামলী নদীর ধারে…..
 
আমরা জানিনা কেউ সামনের পঁচিশে বৈশাখে
জগতের আনন্দযজ্ঞে নিমন্ত্রণ পাবো কি পাবোনা
 
পঁচিশে বৈশাখ ঠাঠা রোদে একা দাঁড়িয়ে আছে,
মালা ফুল চুয়া ও চন্দন কেউ আনবেনা জেনে
বাতাসই উড়িয়ে আনছে হৃতপ্রায় বসন্তের
সবটুকু প্রেম ও হুতাশ জন্মদিনের জন্য
 
স্মৃতিটুকু
 
“Take back the hope you gave, — I claim
Only a memory of the same,”
~ Robert Browning
তবে কী তোমার সাথে এই শেষ দেখা শ্যাম !
তবে কী কখনও আর ব্রজভূমে আসবে না তুমি!
কতো কথা দিয়েছিলে, সব মিথ্যে!
এভাবেই তবে আজ রাসভঙ্গ
‘মঞ্জীর চিরহি ঝাঁপি…’ কোথায় সে শ্রাবণ নিশীথ
বিষাদপ্রতিমা আমি, তবু কিন্তু জ্ঞান হারাচ্ছি না
আঙুল ছাড়িয়ে নিচ্ছ বলে…
তুমিই না বলেছিলে এ কলঙ্ক ভাগ কর নেবে !
তুমিই না বলেছিলে রাধা নাম হৃদয়ে লিখেছ !
শ্যাম, কলঙ্ক ছাড়া যে আর কিছুই রইলো না
কাউকে বলার মতো কোন স্মৃতি, কোন অভিজ্ঞান
শেষ দীপটিও ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিলে…
অবশ্য আমার জন্যে রয়ে গেল বটে
কটি স্মৃতিময় ক্ষণ, শষ্পশয্যা, চুম্বনের দাগ এইসব…
‘মাধব বহুত মিনতি করি তোয়’
মথুরা যাবার আগে অভাগী রাধাকে
খানিকটা সেঁকো বিষ আর
তোমার বাঁশিটি দিয়ে যাও
 
 
ক্লীবলিঙ্গের প্রতি
 
তুমিই তো ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছ আমায়…
 
আমি বিষাদ কুড়িয়ে নিয়ে অচেনা শহরে চলে গেছি
এলোমেলো শব্দ জুড়ে অসম্পূর্ণ কবিতাযাপন
 
আর তুমি! আদ্যোপান্ত নিওনে ভিজেছ সারারাত
তুমুল উৎসব শেষে নিষিদ্ধ পল্লীর ঝিম ধরা
ভাতঘুমে
 
জানতে চাওনি কেন এ শহরে ঘড়িঘর নেই
এখানে অনেক রাতে আমি কেন ঘুমোতে পারিনা !
 
ক্লীব সেই শহরের বুক চিরে ট্রেন চলে যায়
সে আমার তীব্র ঘৃণা,ভালোবাসা
 
জানি ফেরাবেনা তবু
ক্লীবলিঙ্গের নিচে পেতে রাখা ফেরার প্রত্যাশা
 
 
 
মিনা বাজার
 
বেশ কিছুক্ষণ হলো বিকেল হারিয়ে গেছে।
সন্ধ্যা নামলো, সন্ধ্যাসমাপনান্তে রঙ্গিন আলোয়
প্রতিটি বেসাতি যেন আশ্চর্যপ্রদীপ।
মিনা বাজারের অলিন্দে ঝলকাচ্ছে তপ্ত শায়েরী
আর অলোকসামান্য সৃষ্টি, নাজুক সংগীত
 
নম্বর মিলিয়ে সে দেখলো তার তের নম্বর স্টল
এক্কেবারে শেষে। একটা ন্যাড়া গুলমোরের নীচে
দুছিটে আলোর মধ্যে ত্রস্ত হাতে সে সাজালো
ছেঁড়া পান্ডুলিপি আর দু চারটে বিষণ্ণ কবিতা
 
রাত বাড়লো, মিনা বাজারের বর্ণময় সমাপ্তি।
সপার্ষদ বাদশাহ্ ফিরছেন
আশ্চর্যপ্রদীপ ঘিরে লক্ষ লক্ষ শামাপোকা।
 
মুদ্রণযোগ্যতা প্রশ্নে তার দুঃস্থ পংক্তিগুলি
দিশেহারা উড়ে যাচ্ছে পত্রিকা দপ্তর হয়ে
অত্যাধিক রাত্রির দিকে
দোল
 
আমার জন্য কখনো কোনো বসন্ত পূর্ণিমা
আমার জন্য কখনো কোনো আবার দেখা হবে
আমার জন্য কখনো কোনো আবীর ভরা থালা
কোথাও নেই কখনো নেই। সমস্ত নয় ছয়
 
আমার জন্য একলাটি মুখ নামিয়ে চলা
আমার জন্য কারো চোখে চোখ না রাখার কথা
লুকিয়ে মোছা অশ্রুজল ,ভোলার চেষ্টা করা
শুধু,আমার জন্য বাংলাভাষা, একটু বরাভয়
 
 
 
 
আলাপ
 
অনেক তো লেখা হলো,
আজ আসুন মুখোমুখি বসে
আপনার কথা শুনি
 
কি করে অতটা দূরে
এতখানি ভালোবাসা দিয়ে শব্দ সাজান!
জানতে ইচ্ছে করে
আ মরি বাংলাভাষা…..
সময় পাবেন না তো, তাও জানি
 
শুধু দূর থেকে এটুকুই,
এপার বাংলার
ভোরের শিউলিফুল একজন পাঠাচ্ছে
প্রবাসে যে আছে তার কাছে
কিংশুক
বাইশ বছর আগে একবার আত্মহননের কথা ভেবেছিলাম আমি
দুঃখে নয়,অভিমানে নয়।তীব্র এক দৈবী মুগ্ধতায়
 
মার্চের প্রথমদিক।পুরুলিয়া ,অযোধ্যাপাহাড় পাহাড়ের সানুদেশ পলাশে পলাশে একাকার
 
মতিচ্ছন্ন এমন বিকেলে
আমার মরে যেতে ইচ্ছে করেছিলো।
একটি পলাশশাখার দিকে চেয়ে দেখেছিলাম
কি অপূর্ব বিন্যাস ! সার বেঁধে এরা কারা,কিম্ শুক!
পাখি নাকি?
সেই একবারই…
ঘাস
জলাঘাসে ভরে গেছে সমস্ত উঠোন
ঘাসকাটা এসে এসে
ফিরে যাচ্ছে রোজ
প্রতিটি সবুজ ঘাসই গর্ভবতী।
মিনতি জানিয়ে আর কটি
দিন চাইছে
তার শষ্প সন্ততিকে
পৃথিবীর আশ্রয়ে রেখে যাবে বলে
এল.টি.সি
হোটেলের বারান্দায় দাঁড়ালে
তিনদিকেই গভীর জঙ্গল
বাকি আর এক দিকে
শীতের বিপাশা পাথরবাহিত হয়ে
বয়ে যাচ্ছে বিলম্বিতলয়ে।
অস্পষ্ট মেঘের ডানা
ভিজে উঠছে গোধূলিআলোয়
এখানে এসেছি আমরা
শেষবার মন বুঝে নিতে
অথচ আমরা কিন্তু
কেউ কাউকে ছুঁতেও পারিনি
কাল ফিরে যেতে হবে
ভিজে ক্যানভাসে অজস্র টানেল আর
সরলবর্গীয় উদাসীন বৃক্ষরাজি।
আমাদের চারপাশে কুয়াশাজনিত
অস্পষ্টতা ছিলো বলে
অশ্রকণা লুকোতে পেরেছি
মৃত‍্যুগাথা
সাধারণ মানুষের কোনো মৃত্যুগাথা থাকেনা।
টিশার্টে আজকাল
যা খুশি ছাপানো যায়
কিন্তু ভূর্জপত্রে মৃত্যুগাথা লিখে
বন্ধুকে কি বলা যায়?
আমার মনের মধ্যে সেই গাথা
মৃত তক্ষকের মতো
চাপা পড়ে থাকে
শুধু মাঝে মাঝে
কারও হিম মৃত্যুদিনে
গাথাটিকে বের করে সামনে রাখি
দু একটি শব্দ পালটাই
অথবা কয়েকটি পংক্তি
ল্যান্ডলেডি
সন্ধ্যার সামান্য আলো
এখনো স্পষ্ট নয় ততো
যতখানি হলে দেখা যেত
মেখলা পরেছো তুমি
আজ শেষ দিন এ শহরে
রাতে ট্রেন
আর হয়তো কোনো দিন….
এবার সন্ধ্যা তার
আলো মেলে দিলো
সে আলোয় দেখলাম
অন্য বোর্ডার এলো
তোমাদের সানডিউ লজে
 
বিসর্জন
অলৌকিক হয়ে আছো লৌকিক নদীটির পাশে বিষণ্ণ গাছের নিচে।
বিসর্জন নাকি এক গাঢ় পরিত্যাগে
চাঁদের শিশির মেখে একা একা জেগে
হয়তো ভাবছো সেই অপরূপ তিথিটির কথা
শুক্লা পঞ্চমীর নাকি কোজাগরী।
সে এক সময় ছিলো….
 
সব মুখ একাকার উদাসীন কুমোরের হাতে
মুদ্রায় প্রকাশ শুধু….
করতল খসে গেলে পরিচয়হীনা
লৌকিক নদীর তীরে
যেখানে সমস্ত গাছই বোধিবৃক্ষ
 
হাঁটতে পারলে হয়তো ভাল হতো
এতো কাছে করতোয়া নদী
প্রথমে পায়ের পাতা, হাঁটুজল তারপর
কোমর অবধি…
কাঁসাই
 
নদীরও বয়স বাড়ে
কাঁসাইকে দেখে তাই স্থির করলাম।
 
রূপ যৌবনে তার বেশ স্পষ্ট ভাটার ইঙ্গিত
কথাও কমেছে বেশ,
আগে দেখা লাস্যের সাথে
আজকের কোনো মিল নেই
 
আমি তার কাছে এসে বসলাম,
ঋতুক্ষান্ত দুঃখী নারীর
শিরাওঠা হাতের পাতায়
তার ততোধিক দুঃখী ঢেউ
ছুঁয়ে আদর করলাম
 
কাঁসাই হাসলো একটু
হাসলে এখনও ওকে
অসম্ভব সুন্দর লাগে
 
 
 
 
 
 
পুরোনো বন্ধু
 
আজ এরকম বৃষ্টি
ভোরবেলা আশাও করিনি
ঝলমলে রোদ ছিল
তাছাড়া মাসটাও চৈত্র
কিন্তু বৃষ্টি এলো।
 
সাঁকোর সামান্য আগে
তোমাকে দেখলাম
অনেক বছর পর, চিনলামও।
 
তুমি কিন্তু চিনলেনা
দুবার তাকালে শুধু….
তারপরই বৃষ্টি এলো ঝেঁপে
 
অথচ সামান্য আগে
কি রকম রোদ ছিলো বলো !
 
 
এমন দিনে তারে
 
বৃষ্টি নেমেছে সন্ধ্যার অবকাশে
এই ফাঁকে ভাবি সাঁকোটির কাছে যাবো
ওখানে তোমার বাড়ি।
উঠোনে দোপাটি ঝরে সদ্য পুষ্পবৃষ্টি হয়ে আছে
তুমি চেয়ে চেয়ে দেখো
 
সাঁকো অব্দি গিয়ে ফিরে আসি
বৃষ্টি থেমে গেছে।
পুষ্পবৃষ্টির মধ্যে যে কথা বলার ছিলো
সেকথা যায়না বলা বৃষ্টি থেমে গেলে
 

One thought on “ইরাবতী এইদিনে: একগুচ্ছ কবিতা । মীরা মুখোপাধ্যায়

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত