| 29 মার্চ 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ইরাবতী ছোটগল্প: দ্রোণগিরির পথে । পৃষতী রায়চৌধুরী

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

পাহাড়ের বাঁক ঘুরতেই নদীটা দেখা গেল। ধৌলি গঙ্গা। সশব্দে বয়ে চলেছে স্রোতস্বিনী। এখান থেকে মাইল দশেক দূরে বিষ্ণুপ্রয়াগে গিয়ে অলকানন্দার সঙ্গে মিশবে। এতটা উঁচু থেকে নদীটা একটা সরু ফিতের মত মনে হচ্ছে। ঘিয়ে রঙা ফিতে।  

– এক মিনিট যরা রুকিয়ে গা ভাইয়া। ব্যগ থেকে এস-এল-আরটা বার করতে করতে দিতি ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বলল।

            কিন্তু পাহাড়ী রাস্তায় বললেই সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়ানো যায় না। সাইডে দাঁড়ানোর ঠিকমত প্রশস্ত জায়গা না পেলে হুট বলতে দাঁড়ানো মুশকিল। পিছনে একট টাটা সুমো আসছিল। তাকে পার হতে দিয়ে আরো খানিক এগিয়ে এক ফালি জায়গা পেয়ে দাঁড়ালো তাদের গাড়ি। এখান থেকে নদীটা দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু একটু আগের সেই অদ্ভত সুন্দর বাঁকটা এখন আড়ালে চলে গেছে।

            – আরে, সামনে আরো বেটার ভিউ পাবে। এ আর কি দেখছ? জয়ন্ত বলল। লেফ্‌টেনান্ট কর্ণেল জয়ন্ত চ্যাটার্জী। সোহমের সঙ্গে স্কুলে পড়ত। পরে আর্মিতে চলে যায়। এখন এই উত্তরাখন্ডের যোশিমঠে পোস্টেড। কাছেই চীনের বর্ডার। কাজেই এই অঞ্চলে আর্মির তৎপরতা যথেষ্ট। যোশিমঠ থেকে দুটো রাস্তা দুদিকে চলে গেছে। একটা অলকানন্দার ধার ঘেঁষে চলে গেছে সোজা বদ্রীনাথ ধামের দিকে। সেই রাস্তায় এখন পর্যটক আর তীর্থযাত্রীদের ঢল। সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, দূর-দূরান্ত থেকে, অনেক পথকষ্ট সয়ে তারা চলেছে বদ্রীনাথজীর দর্শনে। অন্য পথটা ধৌলি গঙ্গাকে পাশে নিয়ে, দ্রোণগিরি পর্বতের গা ঘেঁষে চলে গেছে চীন বর্ডার পর্যন্ত। এই পথে ট্যুরিষ্টের ভীড় অপেক্ষাকৃত কম। কিছু অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী ট্রেকার আসে কুঁয়ারি পাস, কিংবা দ্রোণগিরি পর্বতে ট্রেক করতে আর মূলত যাওয়া-আসা করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর লোকজন। এখানেই ধৌলি গঙ্গার উপরে একটা ব্রিজ তৈরি হবে। মূলত আর্মির জন্যই। সেই কাজেরই বরাত পেয়েছে সোহমের কোম্পানি। আর প্রাথমিক অনুসন্ধান, যাকে ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ভাষায় বলে সাইট ভিসিট, আর সঙ্গে কিছু প্রিলিমিনারি রক টেস্টিং- সেই কাজেই এখানে এসেছে সোহম। তার অফিসের কয়েকজন টেকনিশিয়ান আর জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে নিয়ে। কাজটা গতবছর মে মাসেই করার কথা ছিল। কিন্তু কোভিডের কারণে সব কিছু স্থগিত ছিল মাঝের কয়েকটা মাস। এখন শীত শেষ হতেই আবার শুরু হয়েছে এখানকার কাজ। সোহম এখন কোম্পানির চিফ জিওলজিষ্ট। জয়ন্তের সঙ্গে যোগাযোগটা আবার চাঙ্গা হয়েছে এই সূত্রে। এখানে এসে কোনো হোটেল বা গেস্ট হাউসে না উঠে জয়ন্তর কোয়ার্টারেই উঠেছে সোহম আর দিতি। সঙ্গে তাদের আট বছরের দুই ডানপিটে যমজ ছেলে জোজো আর জিকো। সোহমের অফিস থেকে আসা বাকি স্টাফ আর জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ারদের ব্যবস্থা অবশ্য গেষ্টহাউসে।

            বিয়ের আগে কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে সোহমের এরকম অনেক ফিল্ড ভিসিটের সঙ্গী হয়েছে দিতি। একসময়ের ফ্রিলান্স ফোটোজার্নালিস্ট দিতি আনন্দের সঙ্গেই কাঁধে তুলে নিত ফিল্ড ফোটোগ্রাফির দায়িত্বটা। রাজস্থান, হিমাচল, গুজরাট – অনেক জায়গাতেই সাইট ভিসিটে গেছে দিতি। গত কয়েক বছর ধরে সেসব একরকম বন্ধ। দুই ডানপিটেকে সামলাতেই এখন তার দিন চলে যায়।

            – বলছ? তা হোক, গাড়িটা থামলই যখন, কয়েকটা ক্লিক নিয়েই নিই। ক্যামেরা, লেন্স সব গুছিয়ে নিয়ে গাড়ির দরজা খুলে নামল দিতি। নামতেই একটা শীতল বাতাস ঝাপ্‌টা মারল সারা শরীরে। কনকনে ঠান্ডা বাতাস। বরফমোড়া হিমালয়ের স্পর্শ বয়ে নিয়ে আসা। মাফলারটা ভালো করে গলায় জড়িয়ে নিল দিতি। এতক্ষণ অব্দি মনটা একটু খঁতখুঁত করছিল। ছেলে দুটোকে জয়ন্তর বৌ অনামিকার কাছে রেখে এসেছে। অনামিকাই অবশ্য বলল ওদের নিয়ে সাইটে যেতে হবে না, রাস্তা ভালো নয়, দোকানপাটও নেই, মোবাইলের নেট-ওয়ার্ক নেই, ওসব জায়গায় বাচ্চাদের নিয়ে না যাওয়াই ভালো। বাড়িতে ওরা বরং ভালোই থাকবে, অনামিকা-জয়ন্তের দুই ছেলেমেয়েও একই বয়সী – সাত আর নয় বছরের- ওদের সঙ্গে দিব্বি খেলবে। দিতি যাক, নিশ্চিন্তে ঘুরে আসুক। সোহম আর জয়ন্তও সায় দিল। আর জোজো-জিকোও তাদের নতুন বন্ধু আর ঘরভর্তি খেলনা ছেড়ে নদী-পাহাড় দেখার জন্য বিন্দুমাত্র আগ্রহ প্রকাশ করল না। দিতি এল বটে, কিন্তু তার মনটা একটু খুঁতখুঁত করছিল। তার ছেলেদুটো যে কি পরিমাণ দস্যি আর ডানপিটে তা তো আর অনামিকা জানে না। ঘন্টায় ঘন্টায় নিজেদের মধ্যে মারপিট বাধায় দুজনে। অনামিকাকে কি গ্রাহ্য করবে? কে জানে? এতক্ষণে কি কি কান্ড বাঁধিয়ে বসে আছে কে জানে? একটাই সান্ত্বনা, সমবয়সী খেলার সাথী আর ঘরভর্তি খেলনা- এই দুটো জিনিস পেলে ওরা নিজেদের মধ্যে মেতে থাকে, কাউকে তখন খুব বেশি জ্বালাতন করে না। কিন্তু কতক্ষণ মেতে থাকবে সেটাই চিন্তা। এইসব ভাবনা-চিন্তা অধিকার করে ছিল তাকে এতক্ষণ। কিন্তু এখন এই বরফ-গন্ধী বাতাসে, আকাশ-চুম্বী পাহাড়ের বিশালতায়, কল্লোলিনীর গর্জনে সব পিছুটান, সবার জন্য সব ভাবনা যেন কোথায় হারিয়ে গেল। হিমালয় তার সুবিশাল সর্বময় অস্তিত্বের মধ্যে দিতির প্রতিদিনকার বেঁচে থাকার ছোট গন্ডীটাকে যেন এক নিমেষে মুছে দিয়ে নিজের মধ্যে টেনে নিচ্ছিল। মিলিয়ে নিচ্ছিল নিজের বিশালতার মধ্যে।

            – দিতি, এসো এবার। লেট’স গো। দেরি হয়ে যাবে। সাইটে অনেক কাজ আছে। বাকি ছবি ওখানে গিয়ে তুলো। সোহম নেমে এসেছে গাড়ি থেকে। বিরক্ত একটু। হাতের ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। শুনলে না, জয়ন্ত বলল, এখানে ওয়েদার খুব আনপ্রেডিকটেবল। যা করার দুপুরের মধ্যেই করতে হবে। বিকেল থেকে ওয়েদার খারাপ হতে থাকে।

            – চলো, হয়ে গেছে তো। ক্যামেরা গুটিয়ে গাড়িতে উঠে এল দিতি। মাহিন্দ্রা বোলেরো জীপ। এসব দুর্গম জায়গায় জীপ ছাড়া যাওয়া মুশকিল। গাড়িতে বেশ একটা পিকনিকের আমেজ। অফিসের এই টেকনিশিয়ান আর ইঞ্জিনিয়াররা সকলেই ইয়ং, সদ্য পাশ করে জয়েন করেছে। জুনিয়র জিওলজিষ্ট পুনম আর নীরজ, ফিল্ড টেকনিশিয়ান সোনু আর মনোজ মিলে অন্তক্ষরী খেলায় মেতেছে। তপোবন বলে একটা ছোট্ট জনপদ পার হয়ে খানিকটা এগিয়ে একটা বাঁক নিতেই ডান দিকের একটা পাহাড়চূড়োর দিকে নির্দেশ করে জয়ন্ত বলল, – ওই দেখো, দূরের ওই উঁচু সাদা পিকটা দেখছ, ওটাই দ্রোণগিরি। দূরের একটা বরফচূড়ো দেখিয়ে বলল জয়ন্ত। পাহাড়টার পায়ের কাছে ভ্যালিতে আছে ছোট একটা পাহাড়ী গ্রাম- দ্রোণগিরি ভিলেজ। দ্রোণগিরির মাইথোলজিকাল সিগনিফিক্যান্সটা জানো তো?   

            দিতি আর সোহম ছাড়া দলের আর কেউ বাংলা জানে না। তাই কথাগুলো হিন্দি আর ইংরেজী মিশিয়েই বলছিল জয়ন্ত। হিমালয়ের প্রতিটা চূড়োর সঙ্গে, প্রতিটা উপত্যকার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে হিন্দু পুরাণ, বেদ, রামায়ণ বা মহাভারতের গল্প। কিন্তু দ্রোণগিরির সঙ্গে যুক্ত গল্পটি যে কি তা কেউউ জানে না দেখা গেল। সুতরাং জয়ন্তকেই সেটা বলতে হল। অন্তক্ষরী খেলা থামিয়ে সকলেই মন দিয়ে শুনতে লাগল। রামায়ণের যুদ্ধে যখন রাবণপুত্র মেঘনাদের হাতে লক্ষণ মৃতবৎ, তখন হনুমান সঞ্জীবনী মহৌষধের খোঁজে হিমালয়ে আসে। এই দ্রোণগিরিতেই নাকি আছে সেই সঞ্জীবনী। কিন্তু সঞ্জীবনী চেনার মত জ্ঞান তথা ধৈর্য পবনপুত্রের না থাকায় পুরো দ্রোণগিরিকেই কাঁধে তুলে নিয়ে চলে যায় লঙ্কায়। এর পরের গল্প সবাই জানে। তবে এই দ্রোণগিরিই যে রামায়ণ বর্ণিত সেই গন্ধমাদন পর্বত তা অনেকেই জানে না। তাই আসমুদ্রহিমাচলের হিন্দুরা পবনপুত্রকে যতই পূজো করুক, দ্রোণগিরি গ্রামের লোকজনদের কাছে সে মহাশত্রু।

            কথা বলতে বলতেই ওরা সাইটের কাছে চলে এল। পাহাড়ের গায়ে ছবির মত গুটিকয়েক বাড়ি। ধৌলিগঙ্গা এখানে অনেক খরস্রোতা। এখানেই তৈরি হবে আর্মির ব্রিজ। সোহমের টিম এখানে জিওলজিকাল সার্ভে করবে। তারপর তাদের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে সব কিছু ঠিক থাকলে সামনের মাস থেকে কাজ শুরু হয়ে যাবে। সোহম আর তার টিম যন্ত্রপাতি সেট করে মাপজোখ শুরু করেছে। পাথরের নমুনা সংগ্রহ শুরু হয়েছে। দিতি ওখান থেকে একটু এগিয়ে এসে অন্যপাশের ঢালু অংশ দিয়ে নদীর কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। পাথর-বোল্ডারের ওপর সাবধানে পা রেখে রেখে নেমে এল নদীর ধারে। হাত ছোঁয়াল জলে। বরফ-ঠান্ডা জল। হাত যেন জমে গেল। ঝকঝকে রোদ্দুর চারদিকে, কিন্তু ঠান্ডা হাওয়াটা কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে থেকে থেকেই। ওপরে রাস্তার কিনারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাজ করতে থাকা সোহমের টিমের লোকজনকে স্পষ্ট দেখা গেলেও ওদের কথা শোনা যাচ্ছে না। কিন্তু সেদিকে তাকাতেই বুকে একটা পিন ফুটল দিতির। সোহম আর পুনম বেশ ঘনিষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে কি যেন কথা বলছে। এতদূর থেকে স্পষ্ট বোঝা না গেলেও মনে হচ্ছে সোহম কিছু বলছে আর পুনম শুনছে মগ্ন হয়ে। কি এমন কথা বলছে ওরা? টেকনিকাল কোনো নির্দেশ দিচ্ছে কি সোহম ওকে? তাহলে অন্যদের না দিয়ে শুধু ওকেই কেন? টেকনিকাল কথা ছাড়া আর কিই বা কথা থাকতে পারে ওদের? পর্বত চূড়ো থেকে বয়ে আনা হাওয়ার শীতলতা যেন বেড়ে গেল আগের চেয়ে।

            আগেও অনেকবার নানা সময়ে লক্ষ্য করেছে দিতি, পুনমের প্রতি মনযোগটা সোহমের যেন একটু বেশিই। ওর সুবিধে-অসুবিধের দিকে সোহম বাড়াবাড়ি রকমের নজর। সোহমের পছন্দ-অপছন্দেও যেন একটু অদল-বদল ঘটেছে সম্প্রতি। এত বছর ধরে সোহমকে দার্জিলিং চায়ের ভক্ত বলেই জানত দিতি, কিন্তু কাল হঠাৎ দিল্লি থেকে আসার সময় পথের ধারে ধাবার ক্ষীর-ফোটানো মশালা-চায়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে দেখে কেমন যেন অবাক হয়ে গেল সে। মানুষের এতদিনকার পছন্দ-অপছন্দ কি করে হঠাৎ বদলে যায়? এই বদল কি স্বতঃস্ফূর্ত? নাকি অন্য কারো পছন্দের সঙ্গে ঐক্যতানে বাঁধার জন্য আরোপিত? ঠিক বুঝতে পারে না দিতি। এরকম ছোটখাটো দুয়েকটা ঘটনায়, ইঙ্গিতে একটু-আধটু প্রশ্ন জাগলেও তা উড়িয়ে দিয়েছে দিতি, তেমন পাত্তা দেয়নি। এসব চিন্তা বেশি প্রশ্রয় দেওয়া মানে মনের মধ্যে সংকীর্ণতাকে আহ্বান করা। সন্দেহবাতিক হতে চায় না সে। এই কাঁটাটা জ্বালায় বড্ড। সে ওদের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। চোখ রাখল নীল আকাশের চালচিত্রে ধ্যানমগ্ন গম্ভীর গিরিরাজের ওপর। দাও হে গিরিরাজ, তোমার বিশালতার কিঞ্চিৎ কণিকা দাও আমাকে, যাতে মনের কোণে জমে থাকা অকিঞ্চিৎকর এই সন্দেহবিষ মুছে যায়।

            নদীর ধারে চুপচাপ বসে বসে কতটা সময় পার করে দিয়েছে দিতি কে জানে। দূর থেকে একটা ডাকাডাকি কানে আসতে ঘুরে তাকাল সে। হ্যাঁ, তার উদ্দেশ্যেই হচ্ছে ডাকাডাকিটা। লাঞ্চের জন্য ডাক এসেছে। উপরে উঠে এল সে। একটু দূরেই আছে মিলিটারি ক্যাম্প। অস্থায়ী সেনা ছাউনি। সেখান থেকেই খাবারের প্যাকেট এসেছে ওদের সবার জন্য। জয়ন্তের নির্দেশে। সুন্দর করে সাজানো ফুড প্যাকেটে পরিপাটি ভেজিটেরিয়ান লাঞ্চ। পরোটা, ফ্রায়েড রাইস, আলু-ফুলকপি ভাজা, পনীর মাখানি, স্যালাড, রায়তা, লাড্ডু। জলদি লাঞ্চ খেয়ে আবার কাজে লেগে গেল ওরা। নানা অ্যাঙ্গল থেকে দিতিকে সাইটের কিছু অংশের ছবি তুলে দিতে বলল সোহম। অন্য সময় এই কাজটা খুব আনন্দের সঙ্গে করে দিতি। কিন্তু আজ যেন সেই স্বতস্ফূর্ততা নেই। এমন ঝলমলে দিন বাইরে, কিন্তু মনের মধ্যে কোথা থেকে যে এই একটুকরো মেঘ উড়ে এসে জুড়ে বসল। তবু দায়িত্ব পালন করার মত কিছু ছবি তুলতে লাগল সে। পুরো সাইটটার একটা ভিউ নেবার জন্য সে আবার একটু নিচে নেমে এল। তখনই দেখতে পেল সেই ট্রেকারদের দলটিকে। পাঁচ ছয়জনের দলটি পাহাড়ের পথ বেয়ে নেমে আসছে একে একে। নদীর ধারে একটা প্রশস্ত চাতাল মত জায়গা আছে। সেখানেই এসে দাঁড়াল ওরা। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পড়ল চাতালের ওপর। হাঁফাতে লাগল বসে বসে। পিঠের রুকস্যাক থেকে জলের বোতল বার করে গলায় ঢালতে লাগল। দিতির খুব কৌতূহল হচ্ছে। কোথা থেকে ঘুরে এল ওরা? কোথায় যাবে? থাক, ওরা একটু রেস্ট নিয়ে নিক, তারপর নাহয় দিতি আলাপ করতে যাবে ওদের সঙ্গে।

            আরো কয়েকটা স্ন্যাপ নানা অ্যাঙ্গল থেকে তুলে দ্বিধা কাটিয়ে দিতি ট্রেকার দলের সঙ্গে আলাপ করতে এগিয়ে এল। দল ঠিক নয়, অভিযাত্রী আসলে দুজন। স্যুইজারল্যান্ড থেকে আসা এক দম্পতি। বাকি চারজন তাদের মালবাহক, রাঁধুনী, পথপ্রদর্শক ইত্যাদি। তারা সবাই এই গাড়োয়াল হিমালয়রই বাসিন্দা। ততক্ষণে তাঁবু খাটানো হয়ে গেছে। স্টোভ জ্বালিয়ে রান্নার প্রিপারেশনও শুরু করে দিয়েছে একজন। সুইশ ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা তাঁবুতে ঢুকেছেন বিশ্রাম নিতে। ওঁদের সঙ্গে আলাপটা হল না বলে একটু ক্ষুণ্ণ হল দিতি। কারণ সে বেশ অবাক হচ্ছিল এটা ভেবে যে এত কষ্ট করে সেই সুদূর সুউজারল্যান্ড থেকে হিমালয় ঘুরতে এসেছে ওরা, নিবিড়ভাবে পাওয়ার জন্য, এই ঠান্ডায় বনে জঙ্গলে, নদীর ধারে রাত কাটাচ্ছে। অথচ আমরা কত শত ডলার-ইউরো খরচ করে সুইজারল্যান্ড বেড়াতে যাই, ফেসবুকে গর্বিত ছবি দিই, অথচ ঘরের কাছের এত অপরূপ ধৌলিগঙ্গা-দ্রোণগিরির নামই জানিনা।

            গাড়োয়ালি ছেলেগুলোকে বিদায় জানিয়ে ওপরের দিকে উঠে এসে আবার একটা কন্টকময় দৃশ্যের মুখোমুখি। এবার সত্যি সত্যি কাঁটা। না, দিতির হৃদয়ে নয়, পুনমের পায়ে। কাঁটাও ঠিক নয়, বোধহয় নুড়ি পাথরের ধারালো টুকরো কোনোভাবে জুতোর ফাঁকে আটকে গেছে। এবং চিফ জিওলজিস্ট সোহম দত্ত তার পায়ের কাছে বসে সেই কাঁটা অথবা নুড়ি পাথর বার করতে ব্যস্ত। না, টিমের আর কারো মাথাব্যাথা নেই এই নিয়ে। দিতি মুখটা ঘুরিয়ে নিল। পরোপকারের এই নিদর্শন দেখতে ক্লান্ত লাগছে তার। বরং চোখ রাখা যাক পড়ন্ত রোদ মাখা ধৌলি গঙ্গার ঝিকিমিকি স্রোতে, ধাপ কেটে চাষ করা সবুজ টুকরো টুকরো ধান কিংবা আলুর ক্ষেতে, পাকসাট মারতে থাকা পাখিদের ডানায়, আকাশ ছুঁয়ে থাকা সবুজ মিনারে। কিংবা ওই শীত-গ্রীষ্ম-ভয়-বিপদ তুচ্ছ করে সতেরো হাজার, আঠারো হাজার কুড়ি হাজার ফুট উচ্চতাতেও টহল দিয়ে, ক্লান্তিহীণ দিনরাত জেগে পাহারা দিয়ে দেশকে রক্ষা করতে থাকা ওই সেনাবাহিনীর দিকে। অথবা ওই পদাতিক অভিযাত্রীদের কাঠকুটো জ্বালানো নরম আগুনে, তাদের নিশ্চিন্ত বিশ্রাম শিবিরে। ওদের দলে গিয়ে যদি ভিড়ে যাওয়া যেত? সব ছেড়েছুড়ে পাহাড়-জঙ্গল-নদীর এই জগতে যদি থেকে যাওয়া যেত চিরকাল? সবুজ পাহাড়ের গায়ে ছবির মত এই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ওই গ্রামে যদি কাটিয়ে দেওয়া যেত জীবনটা? এখান থেকে ফিরতে ইচ্ছে নেই তার। কোথায় ফিরবে? ফেরার কি কোনো জায়গা আছে সত্যিই? বুকের ভিতরে কেমন একটা জমাট ব্যাথা। ফুসফুসে যেন বাতাস ঢুকছে না পর্যাপ্ত। কোভিড সিন্ড্রোম? নাকি হাই অল্টিচুড বলে বাতাসে অক্সিজেনের ঘনত্ব কম? কত অলটিচুড হবে এই জায়গাটার? আচমকা একটা চিৎকার ভেসে এল ওপর থেকে। তার নাম ধরে যেন চেঁচাল কেউ? ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখল সোহম আর সোনু দু-হাত নেড়ে খুব যেন ব্যাগ্রভাবে হাঁকডাক করছে। কেন রে বাবা? এই তো এক্ষুণি দিব্বি একটা ‘দেহি পদ পল্লবমুদারম’ জাতীয় দৃশ্যের অবতারণা করেছিল পাহাড় আর নদীর চালচিত্রকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে। এর মধ্যে হঠাৎ দিতির জন্য এত হাঁকডাক কেন? এর মধ্যেই দু’জন জওয়ানকে দেখা গেল তরতর করে নেমে আসছে নিচের দিকে। মিনিট কয়েকের মধ্যেই ওরা দিতির কাছে পৌঁছে গেল। দিতি নিজেই পাথর টপকে টপকে ধীরে ধীরে উঠে আসছিল, কিন্তু একজন জওয়ান তাকে প্রায় হাত ধরে টেনে দ্রুত ওপরের দিকে নিয়ে চলল। অন্যজন ততক্ষণে ট্রেকারদের দলটির দিকে এগিয়ে গেছে। কি হয়েছে? হঠাৎ এত তৎপরতা কিসের? দিতির প্রশ্নের উত্তরে জওয়ানটি শুধু জানাল, – ফ্ল্যাশ ফ্লাড, ম্যাডাম।

            – সে কি? কোথায়? দিতি হাঁফাচ্ছে। এত দ্রুত ওপরে উঠতে গিয়ে এই শীতেও পুরো ঘেমে গেছে সে। ফ্ল্যাশফ্লাডের কথা শুনে সে ঠোক্কর খেয়ে গেল একটা পাথরে। কপালটা ফুলে গেল।

            – সম্‌হালকে আইয়ে, ম্যাডাম। জওয়ানটি বলল। তারপরই সে যেন একটু ভরসা জাগানোর জন্য যোগ করল, – ইধার নেহি ম্যাডাম, উস্ তরফ। ঋষিগঙ্গাকে সাইডমে। রেইনি ভিলেজকে পাস।    

            ততক্ষণে উপরে উঠে এসেছে ওরা। উপরে সবাই উত্তেজিত ভাবে একসঙ্গে কথা বলছে। টেনশনে সকলেরই মুখ শুকিয়ে গেছে। জয়ন্তকে দেখা গেল না। সোহম বলল, ফ্ল্যাশ-ফ্লাডের কথা শোনামাত্র জয়ন্ত অন্য দু’জন অফিসার আর কয়েকজন জওয়ানকে নিয়ে তপোবন গ্রামের দিকে চলে গেছে। সকালে আসার পথে তপোবনের কাছে যে হাইডেল পাওয়ার প্রোজেক্টের কাজ হতে দেখেছিল ওরা, সেটা নাকি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অবস্থা ঋষিগঙ্গার হাইডেল পাওয়ার প্রোজেক্টের। সব ভেঙেচুরে উড়িয়ে নিয়ে চলে গেছে আচমকা ধেয়ে আসা জলস্রোত। পাশের রেইনি বলে গ্রামটার অবস্থাও শোচনীয়। তপোবনের হাইডেল প্রোজেক্টের দুটো টানেলে কাজ চলছিল। সেই টানেল দুটোতে বেশ কিছু শ্রমিক আটকে আছে। তাদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে এখন। তবে জলের স্রোতের সঙ্গে প্রচুর বোল্ডার, নুড়িপাথর আর কাদা বয়ে এনে টানেলের মুখ নাকি প্রায় বন্ধ, ভেতরে যাওয়াই যাচ্ছে না।


আরো পড়ুন: ছোটগল্প: সাহসিনী । অন্বেষা দত্ত


            কিছুক্ষণ পরে মিলিটারি জিপটিতে চেপে মাইল পনেরো দূরের আর্মি ক্যাম্পে এল ওরা। আপাতত এখানে অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কে জানে আজ আর যোশিমঠ ফেরা যাবে কিনা। ফিল্ড সাইটে মোবাইলে সিগনাল ছিল না, কিন্তু এই ক্যাম্পে এসে মোবাইলে সিগনাল পাওয়া গেল। যদিও শুধুমাত্র বিএসএনএল। সকলেই এবার ব্যস্ত হয়ে পড়ল যে যার বাড়িতে খবর দিতে। এতক্ষণে নিশ্চয় সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এই ফ্ল্যাশ-ফ্লাডের খবর। এখানে অফিসার্স মেসের লাউঞ্জে একটা টিভিও আছে, তাতে ঘুরে ফিরে এখানকার খবরই দেখাচ্ছে। প্রবল জলোচ্ছ্বাসের ধেয়ে আসা, জলের তোড়ে ঋষিগঙ্গার ড্যামের দেশলাই বাক্সের মত ভেসে যাওয়া, টানেলে আটকে থাকা শ্রমিকদের উদ্ধারের জন্য ইন্দো-টিবেট বর্ডার পুলিশ আর ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্সের সঙ্গে আর্মির তৎপরতা। মাঝে মাঝে বিশেষজ্ঞদের মতামত। কি কারণে এই অকস্মাৎ জলোচ্ছাস? হিমবাহ-বিশারদ বলছেন,- সম্ভবত হিমবাহের বিস্ফোরণ। যাকে বলে গ্লেসিয়াল আউটবার্স্ট। ভূতাত্ত্বিক বলছেন, -ভূকম্পন জনিত ভূমিপ্রবাহ বা ল্যান্ডস্লাইডও হতে পারে। একজন নদী বিশেষজ্ঞ বলছেন, – সদা পরিবর্তনশীল, জিওলজিকালি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এই গাড়োয়াল হিমালয়। এখানকার নদীগুলিতে একের পর এক হাইডেল প্রোজেক্ট আর ড্যাম বানানো মোটেই সমীচীন নয়। এভাবেই সব ব্যালান্স নষ্ট হয়ে যায়। একজন আবহাওয়াবিদ বলছেন, – সব কিছুর আসল কারণ গ্লোবাল ওয়ার্মিং। হিমবাহ হ্রদগুলি একবার জমাট বাঁধে আর একবার গলে যায়, এতে হাইড্রোস্ট্যাটিক স্ট্রেস বিল্ড আপ হয়, আর তাতেই –

            এরকম জিওলজিকাল আলোচনা চলবে, আর সোহম চুপ করে বসে থাকবে, কোনো কমেন্ট করবে না, কোনো বক্তব্যের সমালোচনা করবে না, এমনটা দেখা যায় না সচরাচর। কিন্তু কেন কে জানে দুপুরের পর থেকে সে বেশ চুপচাপ।

            দিতি উঠে পড়ল। লাউঞ্জের বাইরের খোলা বারান্দাটাতে দাঁড়াল এসে। বাইরে কনকনে ঠান্ডা। রোদ কমে আসার সঙ্গে সঙ্গেই জাঁকিয়ে ঠান্ডা নামছে দেবভূমিতে। সোহমও উঠে এসেছে। সিগারেট বার করল পকেট থেকে। হাওয়া বাঁচিয়ে জ্বালাল সেটা। টানছে চুপচাপ।

            জ্যাকেটের পকেট থেকে ওর ফোনটা আওয়াজ দিল তখনই। জয়ন্ত। স্ক্রিনটা দেখে নিয়ে বলল সোহম। তারপর ফোনটা কানে লাগাল, -হ্যাঁ জয়ন্ত বল। কি সিচুয়েশন ওদিকে?

            – কি বলছে? ফিরতে পারব আমরা আজকে? দিতি এদিক থেকে জিজ্ঞেস করল।

            ফোনটা ওর দিকে এগিয়ে দিল সোহম। – নাও, তুমিই জিজ্ঞেস করো।

            – কি হবে জয়ন্তদা, আমরা কি আজকে তাহলে ফিরতে পারব না? দিতি ফোন ধরেই উদ্গ্রীব হয়ে জিজ্ঞাসা করল।  

            – অফ কোর্স নট। কি করে ফিরবে? তপোবনের কাছে রাস্তায় বোল্ডার আর মাডফ্লোতে রাস্তার অবস্থা হরিবল। কালকের আগে কোনোমতেই ক্লিয়ার হবে না।

            – কিন্তু আমার ছেলেদুটো-। ওরা যে কখনো আমাকে ছেড়ে থাকেনি জয়ন্তদা -। দিতি উৎকন্ঠা চাপতে পারল না। প্রায় আর্তনাদের মত শোনাল ওর গলাটা।

            – হোয়াট আর ইউ টকিং অ্যাবাউট? ধমকে উঠল জয়ন্তদা। এমন একটা এমার্জেন্সির সময় তুমি এই সামান্য ট্রিভিয়াল বিষয় নিয়ে টেনশন করছ? ওরা যেখানে আছে, সেফ আছে, দে আর ইন আ হোম, ওয়েল টেকেন কেয়ার অফ। এটা ভাবছ না কেন, ডিজাস্টারটা কয়েক ঘন্টা আগে-পরে হলে কি হত, যদি তোমরা তখন ওখানে থাকতে? কিংবা ঋষিগঙ্গার ওই দিকে না হয়ে, ধৌলিগঙ্গার এদিকটাতে হলে? যেখানে আমরা ছিলাম সারাদিন, সেখানে? আর সেই লেবারগুলোর কথা একটু ভাবো, যারা এখনো আটকে আছে টানেলে? জানো, একটু আগে সাত জন লেবারকে রেসকিউ করা হয়েছে, তারা টানা চার-পাঁচ ঘন্টা একটা রড ধরে ঝুলে ছিল। ক্যান ইউ ইম্যাজিন?

            ফোনটা রাখার পরেও কানে বাজছিল জয়ন্তদার কথাগুলো। নিচের গর্জনকারী নদীটাকে দেখে এখন কেমন হিংস্র মনে হচ্ছে। সকালবেলায় ঘুঙুর বাজিয়ে নাচতে নাচতে ছুটে যাওয়া মিষ্টি কিশোরী এখন যেন ক্রোধোন্মত্তা ভৈরবী। যদিও এদিকটা আপ স্ট্রীম, এদিকে জলোচ্ছ্বাস সেভাবে ধেয়ে আসেনি, তবু নদীটিকে দেখে বুক হিম হয়ে যায়। একই প্রকৃতির রূপ কয়েক মুহুর্তের মধ্যে এতটা বদলে যায়? অবশ্য শুধু প্রকৃতি কেন, মানুষও কি বদলায় না মুহূর্তের অভিজ্ঞতায়? সকালের দিতি আর এখনকার দিতিই কি একই ব্যক্তি? একই দিনে কত অনুভূতিই না ছুঁয়ে গেল তাকে। সকালে মুক্তিসুধায় অবগাহন করে অমৃত পান করতে না করতেই দুপুরে সন্দেহ আর ঈর্ষাবিষের গরল পান – সব ছেড়েছুড়ে প্রকৃতির কোলে হারিয়ে যাওয়ার তীব্র হাতছানি, সংসারজীবনের প্রতি নির্লিপ্ত বৈরাগ্য। আর এখন? এখন আবার সেই নীড়ে ফেরার জন্য আকুল আকুতি। এখনকার এই অস্থিরতা, এই তীব্রতা দিনের সেই মুক্তিপিপাসার তীব্রতার চেয়ে কিছু কম জোরালো নয়। কিন্তু কেন এত বৈপরীত্যে? নিজের মনের তল খুঁজতে গিয়ে নিজেই দিশেহারা হয়ে যায় দিতি। কোনটা চাওয়াটা সত্যি, আর কোনটা মিথ্যে? বুঝে উঠতে পারে না। হয়ত দুটোই সমান সত্য। নীল আকাশে ডানা ঝাপটিয়ে পাখিদের মুক্তি পানের তৃষ্ণাও যেমন খাঁটি, তেমনিই কি খাঁটি নয় সন্ধ্যে নামলে তাদের নীড়ে ফেরার আকাঙ্খা? নীড় আর আকাশ- এই দুইএর অস্তিত্ব কি সমান ভাবেই মিশে থাকে না তাদের অস্তিত্বে? এই দ্বৈত অস্তিত্বের একটিকে কি অন্যটির চেয়ে খাটো করা যায়?

            সোহম যেন টের পেয়েছে দিতির সুদূর অন্যমনস্কতা। কাছে ঘেঁষে এল সে। হাত রাখল দিতির কাঁধে, – ঠান্ডা বাড়ছে, দিতি। ভিতরে চলো। সোহমের দিকে তাকাল দিতি। পড়তে চাইল ওর চোখের ভাষা। সোহমের মনেও কি বাস করে সেই পাখি? দিনের বেলায় যে মুক্তমন ডানা ঝপটিয়ে উড়ে যেতে চেয়েছিল সংসারের বাধানিষেধ, সমাজের গন্ডীভাঙা অন্যতর ভালোলাগার কাছে, আর এখন সন্ধ্যে নামতে সেই মনও কি এখন নীড়মুখী টানে সংযত? তাই সে এখন দিতির কাছে ফিরে আসতে চাইছে? নাকি সবটাই দিতির কল্পনা?     

            ধীরে ধীরে এক শান্ত নির্লিপ্ততা ছেয়ে যায় দিতির অন্তরে। সোহমের মনে পুনমের জন্য বিশেষ স্থান আছে কি নেই তা যেন নিতান্তই অবান্তর, অনেক দূরের বিষয় এক। সেই শ্রমিকদের কথাই এখন মাথায় ঘুরতে থাকে তার। জল থেকে বিদ্যুৎ আনার জন্য গভীর সুড়ঙ্গে ঢুকছিল যারা। কে জানে তাদের বাড়িতে আর কখনো আলো জ্বলবে কিনা।

            ধৌলি গঙ্গার জলে এখন ডুবন্ত সুর্যের লালচে আলো ঝলকাচ্ছে। ক্ষণস্থায়ী এই আলো চলে যাবে এখুনি। নামবে আঁধার। সারাদিন মুক্তি পান করে নীল আকাশে পাখসাট মেরে বেড়ানো পাখিরা ফিরে আসছে। ক্লান্ত ডানা দিনশেষে খুঁজছে নীড়ের আরাম। সোহম আর দিতির মতই। রাত নামছে পাহাড়ে।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত