| 28 মার্চ 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

শ্রমে ঘামে প্রান্তিকের ভাষাই বলিষ্ঠ । হাবীব ইমন

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

গোঁড়ার কথা

ভাষা আসলে একটি অদ্ভুত প্রতীকী ব্যবস্থা, যেখানে সচেতনতার উপাদানগুলো, যেমন বর্হিজগতের অভিজ্ঞতা, আমাদের চিন্তা, অনুভব ইত্যাদি সম্পর্কিত হয় মস্তিষ্কে ও স্নায়ুর কতোগুলো বিশেষ অঞ্চলের কাজের সঙ্গে। আমরা যখন কথা বলি তখন ক্রমানগতভাবে শরীরের প্রতিটি অঙ্গগুলো চালিত হয় সমন্বিত হয়। ভাষা ব্যবহারের সময় অসংখ্য প্রতীকী শব্দ যখন একই সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কে ব্যবহৃত হয়, তখন একটি জটিল ধারণা বা চিন্তার সমন্বিত প্রবাহ এর সঙ্গে সূত্রবদ্ধ হয়, যার উপাদানগুলো আবার প্রতীকী চেতনার নানা স্তরে, স্থান-কাল-ব্যক্তি নিরপেক্ষভাবে। ভাষা এমন এক অস্ত্র, একটি হাতিয়ার, যা আমাদের ভাবনা, কল্পনা, অভিজ্ঞতা, আকাঙক্ষা, আবেগ বা যুক্তি—সবধরনের অভিব্যক্তিকে ধারণ ও সঞ্চালিত করতে পারে।
তথ্য আদান-প্রদান, তথ্য সংরক্ষণ, এমনকি তথ্য সৃষ্টির কাজটিও সম্পন্ন হয় ভাষায়। ভাষাকে অবলম্বন করে মানুষ তার অভিজ্ঞতা বিনিময় করছে।সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করছে। সামাজিক বন্ধন সম্পর্কের গভীরতম বন্ধন। যারা সাহিত্য ও শিল্পের সাধক, যাঁরা রাষ্ট্রভাষাকে বিশেষ গোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গি, ঐতিহ্য ও আবেগের অভিব্যক্তি হিসেবে মূল্যায়ন করেন, তাঁদের দৃষ্টিতে ভাষার তথ্য সরবরাহের কাজটি হয়তো অনেকটা যান্ত্রিক এবং সেই অর্থে অপ্রধান মনে হতে পারে। কিন্তু সাইবারনেটিক্সের উদ্ভাবক নরবার্ট উইনার বলেছিলেন—‘যর্থাথভাবে বাস করার অর্থ হলো যথেষ্ট তথ্যের মধ্যে বাস করা’।
সুদূর প্রাচীন অপ্রচলিত ভাষাও একটি আধুনিক ভাষার মতো শক্তিশালী ও সম্ভাবনাময়। প্রাচীন, প্রায় অপ্রচলিত, ভাষার অন্তর্নিহিত শক্তি প্রমাণ করে, দীর্ঘদিন ধরে তারা কতোটা প্রস্তুত রয়েছে। অসংখ্য মানুষের বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে ধীরগতিতে ভাষা শোষণ করে আপন শরীরে। এর গড়ন, এর শব্দমালায়, এর ব্যাকরণে তাই সময়ের ও ঘটনার ছাপ আবিস্কার করি। সমাজবদ্ধ মানুষের ভাবনা, কল্পনা ও মননশীলনতা, বুদ্ধিমত্তা কাজ ও শ্রম ভাষাকে তৈরি করে বলে, ভাষা কোনো জাতির সংস্কৃতি ও চেতনার যেমন স্রষ্টা ও তেমনি উত্তরাধিকারও। এর ব্যপ্তি স্থান ও কালের মধ্যে দুলর্ভ ও বিস্ময়কর। আবার ভাষার দায়িত্বহীন ব্যবহার যখন তার বৈশিষ্ট্যকে ধ্বংস করে, হত্যা করে এর অন্তনির্হিত শক্তি, তার প্রভাব হয় ভীষণ মারাত্মক, ভয়াবহ ও দীর্ঘস্থায়ী।
মায়ের মুখের ভাষার অধিকারের জন্যে মানুষ লড়বে, এটা তো স্বাভাবিক বিষয়ই। মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালি জনগণের অনমনীয় লড়াইয়ের চিহ্ন হলেও এটা ছিলো সকল জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় কথা বলা, লেখা ও ভাব প্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইও। সে জন্য একুশে ফেব্রুয়ারি প্রকৃতপক্ষে প্রথম থেকেই একটি বহুজাতিক প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। এই অন্তর্নিহিত শক্তির প্রকাশই ঘটেছে এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে। বস্তুত মাতৃভাষায় শিক্ষা, জ্ঞানচর্চা ও ভাব-প্রকাশের অধিকার বিশ্বের অধিকাংশ ভাষাভাষী মানুষই এখন কার্যকর করতে পারছে না। অধিকাংশ ভাষাই এখন হুমকির সম্মুখীন। অধিকাংশ ভাষা-ভাষী মানুষই বর্তমানে পরাজিত, বিপর্যস্ত অবস্থায় প্রাণপণে চেষ্টা করছেন নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। একুশে ফেব্রুয়ারি তাদের সে চেষ্টায় একটি প্রতীকী অবলম্বন।
বাংলা ভাষা ছাড়াও আছে ৪৫টি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর পাঁচটি মাতৃভাষা। এই ৪৫টি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মোট জনসংখ্যা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশের সামান্য বেশি। আবার কিছু লোকের মধ্যে আছে উর্দু ভাষা। আরবি, সংস্কৃত ও পালি ভাষার সঙ্গে রয়েছে ধর্মীয় অনুষঙ্গ। ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর শিশুরা জন্মের পর থেকেই তাদের ভাষা ও বাংলা ভাষা দুটিই শেখে। তাদের বলা যায় দ্বিভাষিক। তাদের ভাষা বিকাশশীল নয়, বিলীয়মান ভাষারূপে তালিকাভুক্ত। প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা বাদ দিয়ে শুধু তাদের গোষ্ঠীগত ভাষায় যদি তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়, তাহলে কি তাদের উন্নতির সুযোগ বাড়বে?রাষ্ট্রভাষা রূপে বাংলা ভাষা সংবিধানে স্বীকৃতি পেলেও বাস্তবে সরকার ক্রমে ইংরেজির দিকে চলে যাচ্ছে। অন্ধ ইংরেজিপ্রীতি ও বাংলা ভাষার প্রতি অবজ্ঞার ভাবও অনেকের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। এসব শুভ লক্ষণ নয়।পন্ডিত অধ্যাপক ডক্টর আহমদ শরীফ তাঁর লেখা প্রবন্ধ ‘জন্ম যদি তব বঙ্গে’-এ লিখেছেন—‘বাঙলা করেছে শিক্ষার মাধ্যম, যদিও এখনো ইংরেজীই বাস্তবে চাকরি-বাকরি আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি-ক‚টনীতি ক্ষেত্রে আবর্শিক ও অপরিহার্য ভাষা। কাজেই বড় চাকরি যেন ধনী-সামন্ত-বুর্জোয়া বেণেদের আয়ত্তে থাকে শাসন-প্রশাসন-অর্থ-সম্পদ প্রভৃতির মতো, সে ব্যবস্থাই রাখা হয়েছে’। সত্যি বাংলা বড়ো দুভার্গা থেকে গেলো আজ অবধি।
বাংলা ভাষার ওপর ফার্সি ভাষার প্রভাব ঠেকাতে বাংলা ভাষার শত্রুদের কটাক্ষ করতে কলম ধরেছিলেন সপ্তদশ যুগের কবি আবদুল হাকিম। তার লেখা দুটি লাইন আজোপ্রাসঙ্গিক—
‘যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’

মাতৃভাষা নিয়ে লড়াই

এটা বলা দরকার যে, দেশে দেশে জনগণের যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন এর মধ্যে একটি আন্তর্জাতিক মাত্রা থাকেই। প্রতিটি দেশে মানুষ লড়াই করে তার নিজ দেশের অগণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে, অগণতান্ত্রিক মতাদর্শের বিরুদ্ধে; মানুষ লড়াই করে নিজের ভ‚মিতে তার জায়গা তৈরির জন্য, একে সংজ্ঞায়িত করা নেহায়েত বোকামিমাত্র। এসব লড়াই ভৌগোলিক সীমাও অতিক্রম করে, কখনো সঙ্গে সঙ্গে, কখনো একটু দেরিতে। প্রতিটি দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক লড়াই অন্যান্য দেশের গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহকে শক্তি জোগায়। এক দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন অন্য দেশের অগণতান্ত্রিক শক্তির জন্য হুমকি হয়ে ওঠে। মাতৃভাষা নিয়ে লড়াইও তাই।
পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ, কথা-বার্তা—সর্বত্রই বিজাতীয় সংস্কৃতির দাপট। পাঠ্যপুস্তক, ক্যারিকুলাম—সবখানেই আপস। জাতি দৃশ্যত লক্ষ্যহীন, গন্তব্যহীন। মনোজগতে ঔপনিবেশিক দাসত্ব, আদর্শিক দেউলিয়াত্ব। এভাবেই তৈরি হচ্ছে বৈরি একটি সামাজিক মনস্তত্ত¡। চেতনার আধিপত্য কখনই শাশ্বত নয়, পরিবর্তনের সম্ভাবনায় সদা জাগ্রত। দ্বিধাবিভক্ত সমাজ কারো কাম্য নয়। কিন্তু বাংলা ভাষার ‘বাজারদর’ বাংলাদেশে একদম নিচের দিকে পড়ে গেছে। বাজার অর্থনীতি’র চাহিদা জোগানের ভারসাম্যে বাংলা ভাষার অবস্থান এখন করুণ—সকরুণ। বেশিরভাগ জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষাকে এরকম প্রান্তিক অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার বর্তমান উন্নয়ন ধারার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। এই প্রত্যক্ষ সম্পর্ক অনুসন্ধান করতে গেলে আমরা এটাও উপলব্ধি করবো যে যাকে আমরা বিশ্বায়ন বলে জানি তা আসলে একচেটিয়াকরণ। বিশ্বের সকল অঞ্চলের মানুষের জায়গা করে দিয়ে এই বিশ্বায়ন ঘটছে না। এই বিশ্বায়ন বস্তুত সকল অঞ্চলের মানুষকে শৃঙ্খলিত করে ক্ষুদ্র অংশের একক ভাষা, সংস্কৃতি, মতাদর্শ, রুচি এবং একচেটিয়া মালিকানার সকলের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার আরেক নাম।
অর্থনীতি ক্ষেত্রে আমরা এর প্রকাশ দেখি পুরো বিশ্বকে কতিপয় বহুজাতিক সংস্থার করতলগত করবার মধ্যে; মতাদর্শিক ক্ষেত্রে আমরা এর প্রকাশ দেখি শ্রেণি, লিঙ্গ, জাতিগত, বর্ণগত নিপীড়ন ও মতাদর্শের পষ্ট অপষ্ট একটি কাঠামোর আধিপত্য সৃষ্টির মধ্যে; এবং আমরা এর প্রকাশ দেখি অন্য সব ভাষার ওপর কয়েকটি ভাষার, বিশেষত একটি ভাষার একচেটিয়া আধিপত্যের মধ্যে।

ইংরেজি ও বাংলা ভাষার ক্ষমতার দ্বন্দ্ব

ইংরেজি ভাষা এখন শুধু একটি ভাষাই নয়, ব্রিটিশ কলোনিয়াল নয়, এটি এখন ক্ষমতার প্রতীকও। ইংরেজি ভাষা জানা মানে সেই ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া, এই ভাষা জানা মানে অনেক সুযোগের দরজা খুলে যাওয়া, এই ভাষা জানা মানে হীন-দীন অবস্থা থেকে সমৃদ্ধ শক্তিধর অবস্থায় পৌঁছে যাওয়া। বাংলাদেশে ইংরেজি ভাষা জানলে শুধু ক্ষমতার স্বাদই পাওয়া যায় তা নয়; কর্মসংস্থান ও উপার্জনের বিভিন্ন পথের সঙ্গেও তার সংযোগ ঘটে। ইংরেজি ভাষা জানা না থাকলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় স্বচ্ছন্দ বিচরণ, বিশ্বের খবরা-খবর, এমনকি চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে যোগাযোগও বাধাগ্রস্ত হয়।
বাংলা ভাষার তাহলে সমস্যা কী? বাংলা ভাষায় এই কাজগুলো হয় না কেন? এটা কি ভাষার গঠনগত সমস্যা না এই ভাষা যে সমাজের, তার অবস্থান ও গতিপ্রকৃতির প্রকাশ? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে অন্যান্য ভাষার এবং অন্যান্য ভাষাভাষীদের অবস্থাও আমাদের দেখতে হবে। পার্শ্ববর্তী দেশের হিন্দি ভাষার কি একই অবস্থা? না।
হিন্দি ভাষা দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান অধিপতি ভাষা। বিশ্বেও তার প্রভাব বাড়ছে। হিন্দি ভাষাতে বিভিন্ন ভাষা থেকে রূপান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত এবং শক্তিশালী থাকায় কেউ শুধু হিন্দি ভাষাভাষী হলেও তার বিশ্ব-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কায় নেই। ইংরেজির দাপট সেখানেও আছে কিন্তু হিন্দি পাল্টা দাপটের জায়গাও তৈরি করেছে। পাশাপাশি হিন্দি ভাষা এই অঞ্চলের অন্যান্য ভাষার জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। কারণ হিন্দিভাষী একচেটিয়া মালিকদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্যও বাড়ছে।
আরবি ভাষাভাষীদের অবস্থাও অতটা করুণ নয়। এই ভাষাটিও সচল, সক্রিয় এবং বিশ্বের গতিধারাকে ধারণ করার মতো গতিশীলতা সেখানে আমরা দেখি। চিনা ও জাপানি ভাষা এখন বিশ্ব পরিসরে পাল্টা ক্ষমতার জায়গা তৈরি করছে। কম্পিউটার থেকে শুরু করে সর্বত্র এই চেষ্টা উপলব্ধি করা যায়। এছাড়া কোরিয়া বা থাইল্যান্ডও ইংরেজি দিয়ে ভেসে যায়নি। এসব দেশের মানুষ তাদের নিজস্ব ভাষা নিয়ে যুদ্ধ করে টিকে থাকছে বিকশিত হচ্ছে।
বস্তুত পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই যে দেশ, পুঁজিবাদী বা সমাজতান্ত্রিক যে কাঠামোতেই হোক, অর্থনৈতিক উন্নয়ন করেছে বা করছে অথচ সে দেশের জনগণের ভাষা পরিত্যক্ত হয়েছে। চীন, জাপান তো বটেই এমনকি দুর্বলতর কোরিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন সর্বত্রই আমরা দেখি জোরদারভাবে তাদের জনগণের ভাষা যথেষ্ট গুরুত্ব ও কার্যকারিতা নিয়ে টিকে আছে। আর সেসব দেশেই ঔপনিবেশিক প্রভুর ভাষার দাপট একচেটিয়া, যেসব দেশে উন্নয়নের কোনো শেকড় তৈরি হয়নি। বিশে^র সর্বত্র যেখানে প্রথম ভাষার সাথে দ্বিতীয় ভাষা, বা এমনকি তৃতীয় বা চতুর্থ ভাষা সহাবস্থান করে থাকে, সেখানে বাংলাদেশে দ্বিতীয় ভাষাটি প্রথমটিকে হটিয়ে দিয়ে জায়গা দখল করেছে। কাজটি হয়েছে উপযোগিতার যুক্তিতে। উন্নতির অভিলাষে। অথচ উন্নতি ও উপযোগিতার এ যুক্তি আসলে এক ভিত্তিহীন মিথ। পৃথিবীর কোথাও এর উদাহরণ নেই।যে দেশে শাসক শ্রেণি পরগাছার মতো ঝুলে থাকে সে দেশে শাসক শ্রেণির পরজীবী লুণ্ঠন-পাচার প্রক্রিয়ায় মাতৃভাষা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় ভাষা হিসেবে কোনঠাসা হয়ে পড়তে বাধ্য। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা এই ঘটনাই দেখি।
বাংলাদেশে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, কর্মসংস্থান ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা যে রীতিমতো প্রান্তিক বা অপাঙ্ক্তেয় ভাষায় পরিণত হয়েছে তার অনেকখানি ব্যাখ্যা তাই এদেশের শাসক শ্রেণির অবস্থান ও ঐতিহাসিক ধারা থেকে পাওয়া যাবে। পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় বাংলাদেশের অবস্থান প্রান্তিক, এবং এই প্রান্তিক অবস্থান তৈরি হয়েছে ও টিকে থাকছে এদেশের পরজীবী শাসক শ্রেণির কারণে। এই শ্রেণি তার গঠন প্রকৃতি ও বিকাশধারার কারণে দেশে উৎপাদনশীল ভিত্তি নির্মাণ করবার চাইতে দ্রæত লুটপাট করে সম্পদ গঠন ও পাচারেই বেশি আগ্রহী।
ক্ষমতার জায়গা চর্চা হয় তারপরও। প্রান্তিক অবস্থানে কোণঠাসা বাংলা ভাষা দিয়ে আবার ক্ষমতার চর্চা হয় দুর্বলতর জাতিগোষ্ঠীর ওপর। মাতৃভাষার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলা ভাষাকে শাসক শ্রেণি অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষার অধিকার খর্ব করার কাজে লাগায়। বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার সাংবিধানিক অধিকার এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা এখনো নেই। বাংলা ভাষা ক্ষমতাহীনদের কাছে শুধু সীমিত বা আঞ্চলিকতায় পীড়িত হয়ে পড়ছে তা নয়, ভাষাটি ইংরেজি, হিন্দি বা আরবির অনিয়ন্ত্রিত ও যথেচ্ছ অপপ্রয়োগে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছে।
এ কথাও থাকা জরুরি, বাংলার সাথে জনগোষ্ঠীর সম্পর্ক আবেগের বা ঐতিহ্যের নয় কেবল, নিখাদ আর্থিক উপযোগিতা হবে ওই সম্ভাব্য কার্যকর সম্পর্কের ভিত্তি।

সামাজিক বিভাজন প্রক্রিয়া

একটি গল্প দিয়ে শুরু করি। অর্ধকোটি মানুষের দেশ নরওয়ের নাট্যকার হেনরিক ইবসেন ঊনবিংশ শতকের লেখক ছিলেন। ওই সময় নরওয়ে ছিল ডেনমার্কের উপনিবেশ। নরওয়ের রাজধানীর নাম অসলো পাল্টিয়ে ডেনমার্কের রাজার নামানুসারে ক্রিস্টিনিয়া রাখা হয়। নরওয়ের ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ওপর দিনেমার প্রভাব চাপিয়ে দেওয়া হয়। ক্ষেত্রবিশেষে দিনেমার প্রভাব ও অনুকরণকে আভিজাত্য মনে করা হতো। লেখকদের মধ্যে দিনেমার ভাষার আদলে লেখালেখির প্রবণতাও চালু ছিল। কেবল ব্যতিক্রম ছিলেন একজন। তিনি হলেন হেনরিক ইবসেন। তিনি ঔপনিবেশিক স্রোতধারার বিপরীতে নরওয়ের মানুষের মুখের ভাষায় লেখালেখি চালিয়ে গেলেন। আজ ইবসেন পুরো দুনিয়ার মানুষের লেখক। ইবসেনকে মনে করা হয় নরওয়ের ভাষাসৈনিক।
স্ববিরোধিতা-আত্মপ্রতারণার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে শিক্ষিত বাঙালি সমাজের, বাঙালি শাসকদের। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাস এলে মাতৃভাষা বাংলা, ২১ ফেব্রুয়ারি নিয়ে তাদের যে আবেগ-উচ্ছ্বাস দেখা যায়, তার তুলনা যেমন বিশ্বের আর কোথাও পাওয়া যাবে না; তেমনি রাষ্ট্রীয় নীতিমালা, পরিকল্পনা, শিক্ষা, গবেষণা, আদালত, এমনকি সেমিনার-সম্মেলন পর্যন্ত সর্বত্র নিজের মাতৃভাষাকে যেভাবে অবশ্যবর্জনীয়, অব্যবহারযোগ্য হিসেবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে এরা ছুঁড়ে ফেলে দেয়, তারও তুলনা পাওয়া কঠিন হবে। বাংলা ভাষাকে ‘হৃদয়ের ভাষা’, ‘প্রাণের ভাষা’ বলে বলে কাজের ক্ষেত্রে তাকে অপাঙ্ক্তেয় করে রাখা-এই হলো বর্তমান চিত্র।
মুক্তিযুদ্ধের অবলম্বন বাঙালি জাতীয়তাবাদকে উৎখাত করে সাম্প্রদায়িক বিষযুক্ত জাতীয়তাবাদের ধারণাকে জনমানসে কৌশলে সংক্রমিত করা হয়। রাষ্ট্রের ইন্ধনে চলতে থাকে সামাজিক বিভাজন প্রক্রিয়া। ড. কুদরাত-ই-খুদার বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্য থেকে দেশ কক্ষচ্যুত হয়। সমাজকাঠামোয় বিভেদ, বৈষম্য ও কৃত্রিম বিভাজন তৈরি হয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য মানসম্পন্ন বিশ্বজনীন শিক্ষা অধরা থেকে যায়। রাষ্ট্রের সমর্থনে বেড়ে ওঠা নব্য ‘লুম্পেন বুর্জোয়া’কিন্তু তথাকথিত এলিট শ্রেণীর সেবায় রাতারাতি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো গজিয়ে উঠতে শুরু করে।
নতুন কর্পোরেট বেনিয়া শ্রেণির স্বার্থরক্ষায় এরা তৎপর হয়ে ওঠে। বাংলা ভাষা, ইতিহাস ও সংস্কৃতি নব্য এ গোষ্ঠীর কাছে তাচ্ছিল্য ও অবহেলার পাত্রে পরিণত হয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আশ্রয় হয় মাদ্রাসা, যেখানে আধুনিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও ভাষাশিক্ষার সুযোগ অপ্রতুল। নিম্ন-মধ্যবিত্তের জন্য অবশিষ্ট থেকে যায় মানহীন সাধারণ শিক্ষা।
সমস্বত্ব একটি জাতিরাষ্ট্রের জন্য সামাজিক বিভক্তির এ আয়োজন পাকিস্তানি ভাবধারা ও নব্য ঔপনিবেশবাদের একটি অবশ্যম্ভাবী অভিঘাত। অর্থনৈতিকভাবে সম্পন্ন পরিবারের জন্য ইংরেজি। প্রান্তিক পরিবারের অবলম্বন বাংলা। বুদ্ধিবৃত্তিক বিভাজনের এ ধারা জাতিসত্তা বিকাশের পথে স্পষ্ট অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল এবং অনেকেই এ দেশের মুক্ত আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা লক্ষ্য করছেন।
ভাষাকে যতো নিরীহ, অবিচল, অনির্ভর ও অভঙ্গুর বলে আমরা মনে করি, বস্তুতপক্ষে ভাষা মোটেই তা নয়। ভাষা হিংস্র প্রাণীর মতোন গ্রাস করতে পারে দুর্বল ভাষাকে। বদলে যেতে পারে ভিন্ন পরিবেশ পেলে। এর ব্যবহারকারী জনসংখ্যার প্রতাপ ও দাপটে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে পারে, অথবা হারিয়ে যেতে পারে বিস্মৃতির অতলে। এইখানে ভাষায় মানুষে মানুষে বৈষম্য-বিভাজন-অসমতার অন্যমাত্রাগুলোকে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

 

শব্দ, রীতি, ভাব ও চিন্তা

বাংলাদেশে ভাষিক বাস্তবতা এমন যে এখানে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার গুরুত্ব এবং বাংলা ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার পক্ষে যারাই কিছু বলতে কিংবা করতে যান তাঁদেরই সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশনগুলো থেকে ও রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারক মহল থেকে অভিহিত করা হয় ইংরেজিবিরোধী বলে। কিংবা নানামাত্রিকতায় বিদ্রæপ করার একটা প্রচেষ্টা চলে। ইংরেজির উপযোগিতা ও বাংলার অনুপযোগিতা সম্পর্কে বলা হয় অনেক কথা। বাংলাকে খাড়া করা হয় ইংরেজির প্রতিপক্ষ হিসেবে। বাংলা ভাষার উন্নতির প্রতি বাংলাদেশের সব বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের, রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের ও ইংরেজি জানা লোকদের প্রচ্ছন্ন দৃষ্টি দরকার। বাংলাদেশে ইংরেজিকে দেখতে হবে বাংলার অপরিহার্য সম্পূরক রূপে। বাংলার সম্পূরক আরো কিছু ভাষা ছিল ও আছে। যেমন : আরবি, ফারসি, সংস্কৃত ইত্যাদি। সব জীবন্ত ভাষাই অপরাপর ভাষা থেকে শব্দ, রীতি, ভাব ও চিন্তা গ্রহণ করে বিকাশশীল থাকে।
আমাদের দেখা দরকার ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, রাশিয়া, চিন, জাপান, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার রাষ্ট্রগুলোর ভাষানীতি। তলিয়ে দেখা দরকার, ইংরেজি এতো উন্নত ভাষা হওয়া সত্তে¡ও কেনো তারা তাদের রাষ্ট্রভাষা ত্যাগ করে ইংরেজি গ্রহণ করছে না। দেখা দরকার, কিভাবে তারা ইংরেজির সমস্যার সমাধান করছে। এসব দেশের কোনোটিতেই সব শিক্ষার্থীকে ইংরেজি কিংবা অন্য কোনো বিদেশি ভাষা শেখানো হয় না। তাদের অভিজ্ঞতা দেখলে আমাদের বুদ্ধি জাগতে পারে। আমরা কোনোটার অনুকরণ করবো না; তবে অন্যদের অভিজ্ঞতা থেকেও শিক্ষা গ্রহণ করে আমরা আমাদের উন্নতির পথ প্রশস্ত করবো।
আরেকটি প্রসঙ্গ বলে নেয়া ভালো, সাধারণত স্নাতক পর্যন্ত ইংরেজি ভাষা আবশ্যিক হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। কিন্তু এ ভাষাটাকে এতো বেশি গুরুত্ব দেয়ার পরও সঠিকভাবে শেখাটা হচ্ছে না। একই সঙ্গে বাঙালি শিক্ষিতদের মধ্যে ভাষার দক্ষতা আর অদক্ষতা নিয়ে নানা অসমতা রয়েছে। এটাকে আমরা শিক্ষা ক্ষেত্রে ভাষার ‘কাঠামোগত আগ্রাসন’ বলে আখ্যায়িত করতে পারি।এতে শ্রেণি বেনিয়া যথেষ্ট হয়েছে। তবে ইংরেজী ভাষা সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় তেমন হয়নি। ফলে এ ক‚ল-ও কুল দক‚ল গেছে। ইংরেজী শেখেনি, বাংলা ভাষাও অবহেলিত হলো।

জাতিসমূহের স্বীকৃতির প্রশ্ন

ভাষা ও সাহিত্য যে আমূল রাজনৈতিক বিষয়, তা আজ প্রশ্নাতীত। রাষ্ট্র ছলে বলে কৌশলে ইংরেজি চাপিয়ে দিতে চায়, তা এক ধরনের রাজনীতি। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সাহিত্য এবং প্রান্তিক ভাষাগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়া, মূলধারায় তাদের জন্য সম্মানের আসন বরাদ্দ করা আর এক ধরনের রাজনীতি। দ্বিতীয় পথটি আমাদের আত্মাকে স্পর্শ করে যায়, তাতে বহুত্ববাদের স্বীকৃতি আছে। সাহিত্যের যে স্বাতন্ত্র্যের কথা আমরা বলছি, তা কাহিনীর বিষয়বস্তু ও পরিবেশনের মধ্যে লুকায়িত। তা সে গ্রাম বা আঞ্চলিক কথ্য উপভাষায় লেখা হতে পারে, আবার শহুরে প্রমিত বাংলায় ব্যঞ্জনা লাভ করতে পারে। দুই প্রখ্যাত ফরাসি দার্শনিক গিলেজ দেল্যুজ ও ফেলিক্স গুট্টেরি ‘হোয়াট ইজ এ মাইনর লিটরেচার?’-প্রবন্ধে এই বিষয়টা খানিক ছুঁয়ে গেছেন। তাঁদের মতে, অন্ত্যজ মানুষ ভাষার প্রমিত রূপ ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে ব্যক্তির সীমানা পেরিয়ে সম্প্রদায়ের দুর্দশা ও আশা-আকাক্সক্ষা প্রকাশ করার রাজনৈতিক ভঙ্গি অবলম্বন করে। সেই অর্থে ‘মাইনর লিটারেচার’ শব্দবন্ধে যেমন একটা অ্যাঁভা গার্দ বিশিষ্টতার সুর শোনা যায়, তেমনই তথাকথিত ‘মুখ্য’ সাহিত্যের স্বতন্ত্র আভিজাত্যের প্রতি কটাক্ষের সূত্রও খুঁজে পাওয়া যায়। বাংলা সাহিত্য মূলস্রোতের আভিজাত্যের পঙ্ক্তিথেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে বহুত্ববাদী বাঙালি পটভ‚মিতে আত্মমর্যাদা খুঁজে বেড়ায়।
প্রান্তিক জাতিসমূহের মধ্যে লিখিত সাহিত্যের ধারা অবিকশিত বা ম্রিয়মান অবস্থায় থাকার মূল কারণ লুকিয়ে রয়েছে তাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক অধস্তনতার মধ্যে, যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাদের ভ‚মির অধিকার হরণ করে সাংস্কৃতিকভাবে তাদেরকে ‘ক্ষুদ্র’, ‘নিচু’ ও ‘পশ্চাৎপদ’ হিসেবে গণ্য করাসহ তাদের ইতিহাস ও স্বকীয়তা মুছে ফেলার বিবিধ প্রয়াসের মাধ্যমে। আমরা যদি চাই তাদের সবার ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি স্বমহিমায় বিকশিত হোক, তবে গোড়ায় জল দিতে হবে, যথাযথ স্বীকৃতি দিতে হবে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির, মেনে নিতে হবে তাদের ‘আদিবাসী’ অধিকার। এই অধিকার অগ্রাহ্য করে বাহ্যিক বিভিন্ন প্রলেপ দিয়ে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদির প্রদর্শনীমূলক রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা হবে, আর সব বঞ্চনা-অবমাননা-অস্বীকৃতির আদিবাসীরা সাহিত্যিক সৃজনের মাধ্যমে কাটিয়ে উঠবে, তা আশা করা যায় না।
সর্বজনীনতার মধ্যে ছোটো করে গ্রহণ আছে, বর্জন নেই বিদেশি আগ্রাসনের প্রতিস্পর্ধী অবস্থানে কিন্তু আদিবাসীর অন্য ভাষাকে ব্রাত্য করা হয় নি, তাকে অন্য ভাষাগুলোর মতো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।আজ বাড়তে থাকা ক্ষুদ্রজাতি (সরকারি পরিভাষায়) গোষ্ঠীর উৎপীড়ন, সংবেদনশীল মানুষের মনে প্রশ্ন জাগায়, ওরা কতো অসহায়, ওদের নিজস্বতাকেনৃশংসভাবে হত্যা করা কতো সহজ! বাঙালিরভাষাভেদের ঘৃণ্য চেহারা লিঙ্গ বৈষম্য ও পুরুষতন্ত্রর আস্ফালনের চেয়ে আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। এই অবস্থায় এঁরা হন্যে হয়ে প্রতিবাদের ভাষা খোঁজে।
লেনিন সোভিয়েত ইউনিয়নে ‘জাতিসমূহের স্বীকৃতির প্রশ্ন’ নিষ্পত্তির চেষ্টা করেছিলেন। সেটা ঐতিহাসিকভাবে কতোটুকু সফল হয়েছিল, তা ভিন্ন আলোচনা, তবে বাংলাদেশের বেলায় আরও মৌলিক একটা প্রশ্ন তোলা যায়, যা নিয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের ভাবা দরকার: এদেশে যেখানে বাংলা ভিন্ন অন্যকোনো দেশি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই, সেখানে এসব ভাষায় সাহিত্যসৃজনের সুযোগ বা সম্ভাবনা কতোটুকুই-বা আছে?

 

ভাষার অর্থ তৈরি হচ্ছে কৃষকের শ্রমে

কল-কারখানায় যারা কাজ করে, যারা আমাদের মতো ভদ্র পোশাক পরে সুন্দর করে কথা বলতে পারে না, যারা লিখতে পারে না। কিন্তু এরা শ্রম, বুদ্ধি ও উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে নির্মাণ করে চলেছে নানান সামগ্রী। যে কৃষক মাঠে কাজ করে, রোদে পুড়ে ফসল ফলায়, বৃষ্টিতে ভিজে। যে মাঝি দাঁড় টেনে নৌকা চালায়। বয়ে নিয়ে নদী বা সমুদ্র পথে। যারা ইট ভাঙছে, বহন করছে পাথর। মাটি-বালি। তৈরি করছে পথ-ঘাট, বিরাট বিরাট অট্টালিকা। যে কামার লোহা পুড়িয়ে, পিটিয়ে তৈরি করছে জাহাজ। অথচ এরা একটি রেখাকে বাকিয়ে তৈরি করতে পারছে না বর্ণ। অক্ষর সাজিয়ে বানাতে পারে না শব্দ ও বাক্য। কিন্তু সমাজ ও সভ্যতা তৈরিতে একটি অসাধারণ ভাষা নির্মাণ করে চলেছে। যাকে বলা যেতে পারে শ্রমের ভাষা। সেই ভাষা হয়তো প্রচলিত সভ্যতায় উচ্চকিত হয় না। ভাষা বিদগ্ধ মানুষের একক সম্পদ নয়। ভাষার অর্থ তৈরি হচ্ছে কৃষকের শ্রমে। শ্রমিকের ঘামে। কারখানার কর্কশ আওয়াজে। এটাই জীবনঘনিষ্ট ভাষার সংগ্রাম। এইখানে শ্রেণীসংগ্রামের নির্ভীক আওয়াজ। তার ভেতরে লুকিয়ে রয়েছে একধরনের প্রগতি, একধরনের জীবনঘনিষ্ট দর্শন। উচ্চ ডিগ্রিধারী সমাজ তার শিক্ষা, গবেষণা, উপার্জন ও জীবনযাপনের মাধ্যমে তৈরি করছে এক ধরনের সংখ্যালঘু জগৎ, তা দেশের বিপুল প্রান্তিক মানুষের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন। ভাষার দেয়াল টানা দু-জগতে জ্ঞানের, চিন্তার, ভাবের, কল্পনার, পরিকল্পনার এ বিভেদ দিনে দিনে বাড়ছেই। এ বিভেদ বাড়ানোর প্রধান কারিগর রাষ্ট্র নিজেই। আমরা সেই ভাষাটাকে উচ্চকণ্ঠে সোচ্চার করতে চাই। প্রান্তিক মানুষের ভাষাই যে বলিষ্ঠ সে কথা বলতে চাই।

 

ভাষার শত্রু ও দায়

কারোর হয়তো মনে হতে পারে,কথার শব্দ আর বোমার শব্দ এক নয়। কথা কারো ঘরে আগুন ধরাচ্ছে না, মই দিচ্ছে না কারোর পাকা ধানে। কি ক্ষতি কিছু ভালো কথা বলতে, মিথ্যা করে হলেও। আসলে কথার চেয়ে বোমার শব্দ মারাত্মক, বিকট। এর আগুন শুধু ঘর পোড়ায় না। ধ্বংস করে সম্পূর্ণ জাতিকে। দৃষ্টান্তস্বরূপ কয়েকটি পেট্রোলের টিনে লিখে রাখা যাক না শীতল পানি বলে, অথবা বিষের শিশির লেখা যাক মধু। তারপর রেখে দেয়া হোক জনবহুল জায়গাতে। আসলে পেট্রোলের তবু গন্ধ আছে। মানুষ পেট্রোল কিনা সহজে বুঝে নিতে পারবে। কিন্তু বিষকে মধু বলে পান করার দুঘর্টনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। কিন্তু মানুষের ভাষার অসৎ ব্যবহার হরণ করতে পারে গোলাপের গন্ধ। মুছে দিতে পারে বন্ধুর ভালোবাসা। নিভতে পারে সমস্ত আলো। কেননা গোলাপের নামে যদি দুর্গন্ধ ছড়ান হয়। বন্ধুত্বের কথা বলে ছড়ানো হয় বিদ্বেষ। এবং বাতি জ্বালাবার অঙ্গীকার করে ঢেকে আনে অন্ধকার। তখন গোলাপের সুগন্ধের সঙ্গে হারাই গোলাপ শব্দটাও। বন্ধুত্বের সঙ্গে বন্ধু এবং আলোর সঙ্গে বাতি, আমাদের চেতনা থেকে।
আজকাল হরআমেষাই সত্যের বদলে প্রচার চলে মিথ্যার। শক্তের অপরাধ বিচারের বাণী যখন কাঁদে নিভৃতে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তারুণ্যের কণ্ঠ যখন প্রতিবাদের ভাষা ভুলে শেখে তোষামোদ। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র যখন রুগ্ন মায়ের জন্যে স্বান্তনা বয়ে আনে না। তখন আমরা সমাজের ক্ষতির কথা বলি না—বলি ভাষার দায়িত্বহীনতার কথা। এইখানে এই প্রক্রিয়ার সাথে আমাদের সম্পর্কের প্রশ্ন থাকে। জনমানুষের ভাষার স্বার্থ সবসময় উপেক্ষিত থেকেছে।
একটা প্রশ্ন আমাদের সবার সামনে অপেক্ষমান। সেটা হলো আমরা কে কোন পক্ষে। আলোর, নাকি অন্ধকারের? যদি আলোর পক্ষ হই তাহলে কি আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করছি? দায়িত্ব পালন না করলে দেশ কেমন করে এগুবে। প্রশ্নটা শুরুতে ছিল, এখনো আছে, থাকবে আগামীকালও।

তথ্য সহযোগিতা
১. ভাষা ও বিজ্ঞান. আলীআসগর
২. বাংলা যখন প্রান্তিক ভাষা, আনু মুহাম্মদ
৩. বাংলাদেশের ভাষা পরিস্থিতি ও রাষ্ট্রভাষা. আবুল কাশেম ফজলুল হক
৪. আমাদের ‘আদিবাসী’ ভাষা ও সাহিত্য, আনিসুর রহমান
৫. বাংলা ভাষার শত্রু, আনিসুর রহমান

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত