| 9 অক্টোবর 2024
Categories
গীতরঙ্গ

বাংলা লিপি এবং তার অক্ষর-হরফের উৎপত্তি

আনুমানিক পঠনকাল: 2 মিনিট

হাজার বছর ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম জন্মেছে বাঙালি, মিশে গেছে প্রকৃতির সঙ্গে। বিভিন্ন আঞ্চলিক রূপ থেকে আধুনিককালে জন্ম নিয়েছে বাংলা ভাষা। হাজার বছরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে বিভিন্ন ধরনের মানুষের ভাষা। বদলে গেছে দেশের আকৃতি। কিন্তু টিকে আছে বাঙালির ভাষা। তার কন্ঠস্বর। বাংলা ভাষা। বাংলা লিপি এবং তার অক্ষর হরফ।

বাংলা লিপি এবং তার অক্ষর-হরফের উৎস বা উৎপত্তি কীভাবে হল, তা এখনো অজানা, কিন্তু গবেষণাসহ মনে করা হয় যে বাংলা লিপির ব্যবহার খ্রিস্টাব্দ একাদশ শতক থেকে প্রচলিত। বাংলা লিপির ব্যবহার প্রায়ই মধ্যযুগীয় ভারতের পূর্বাঞ্চলে এবং তারপর পাল সাম্রাজ্যের মধ্যে ব্যবহার ছিল। পরে বিশেষভাবে বাংলার অঞ্চলে ব্যবহার করা অব্যাহত ছিল। পরে বাংলা লিপিটিকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্বের অধীনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর দ্বারা আধুনিক বাংলা লিপিতে প্রমিত করা হয়েছিল। যা বাংলার মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে যুক্ত আছে।

ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে সৃষ্টিলগ্নে মানুষের মুখে কোন ভাষা ছিল না। তখন কোন বর্ণমালাও ছিলো না। গাছপালা-মানুষ-প্রাণী’র ছবি এঁকে মনের ভাব প্রকাশ করা হতো। এটা হচ্ছে বর্ণমালার প্রথম স্তর গ্রন্থিলিপি। আনুমানিক দশ-বারো হাজার বছর আগে মানুষ গ্রন্থিলিপি দ্বারা মনের ভাব প্রকাশ করতো। এরপর এলো ভাবলিপি। সম্পূর্ণ ছবি না এঁকে সংকেত বা চিহ্ন বা প্রতীকের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করার মাধ্যম। ভাবলিপি ছিল অনেকটা এমন দিন বোঝাতে পূর্ণ বৃত্ত, অর্থাৎ সূর্য আঁকা হতো, আর রাত বোঝাতে অর্ধ বৃত্তের সাথে আকাশের তারা আঁকা হতো। এরপর এলো তৃতীয় স্তর – শব্দলিপি, এই স্তরে ব্যাপক হারে ছবি’র বদলে চিহ্নের ব্যবহার হতে লাগলো। শব্দলিপি আরো সংক্ষিপ্ত হয়ে এলো চতুর্থস্তর – অক্ষরলিপি। অক্ষরলিপি আরো সংক্ষিপ্ত হয়ে পঞ্চম স্তর হিসেবে এলো ধ্বনিলিপি। এই ধ্বনিলিপি থেকেই আধুনিক বর্ণমালার উৎপত্তি। সেইসময় বিভিন্ন বর্ণে বা রঙে বিভিন্ন অক্ষর লেখা হতো, সেখান থেকেই অক্ষরের নাম হয়েছে বাংলা বর্ণমালা।

বাংলা লিপি হল একটি লিখন পদ্ধতি যেটা ব্যবহৃত করা হয় বাংলা, মণিপুরি, ককবরক, অসমীয়া ভাষায়।

বাংলা ভাষা বিকাশের ইতিহাস ১৩০০ বছর পুরনো। চর্যাপদ এ ভাষার আদি নিদর্শন। বাংলা ভাষার অক্ষর বা লিপির উদ্ভব ক্রমবিকাশের ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলা লিপির উদ্ভব হয় ভারতের মৌলিক লিপি ব্রাহ্মীলিপি হতে। খ্রীঃ পূঃ দ্বিতীয়-প্রথম শতকে ব্রাহ্মী লিপির উত্তর ভারতীয় লিপিরূপ থেকে জন্ম নেয় কুষাণ লিপি, যা থেকে পরে গুপ্ত লিপির উৎপত্তি হয়। গুপ্ত লিপির ক্রমবিবর্তনের ফলে সিদ্ধমাতৃকা লিপির উৎপত্তি হয়, যার কালক্রমিক পরিণতি থেকে বাংলা বর্ণমালা বর্তমান রূপে দাঁড়িয়েছে।

বাংলা বর্ণমালায় মোট ৫০টি বর্ণ রয়েছে। তারমধ্যে স্বরবর্ণ ৬ টি এবং ব্যঞ্জনবর্ণ ২৬টি তার মধ্যে স্বরবর্ণ ১১ টি এবং ব্যঞ্জনবর্ণ ৩৯টি রয়েছে। বাংলা বর্ণমালায় পূর্ণমাত্রা আছে প্রায় ৩২টি বর্ণে। তার মধ্যে স্বরবর্ণ ৬টি এবং ব্যঞ্জনবর্ণ ২৬টি। বাংলা বর্ণমালার স্বরবর্ণ সংক্ষিপ্ত রূপকে কার বলে। ব্যঞ্জনবর্ণের সংক্ষিপ্ত রূপকে ফলা বলে। বাংলা বর্ণমালার কার ১০টি এবং ফলা ৬টি। বাংলা বর্ণমালা ব্যঞ্জনবর্ণ সাহায্য ছাড়া উচ্চারণ করা যায় না।

যুগে যুগে বাঙলা বর্ণমালার আকার-আকৃতি বদলাতে বদলাতে ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে মোটামুটি স্থির রুপ পায়, মুদ্রণযন্ত্রের ঢালাই ধাতুতে তৈরি বর্ণের কল্যাণে। তবে সেগুলো কিন্তু বাঙলা ভাষা-ভাষীরা করেননি, সেগুলো করেছিলো ইউরোপীয়রা। এর আগে, ১৬৬৭ খ্রিস্টাব্দে আমস্টারডাম থেকে প্রকাশিত “চায়না ইলাস্ট্রেটা” নামক বইয়ে বাঙলা বর্ণমালা’র নমুনা ছাপা হয়েছিলো। ১৬৬৭ সালের পর আরো একটি বইয়ে বাঙলা বর্ণমালা’র নমুনা ছাপা হয়, ১৭৪৩ সালে লাইডেন থেকে প্রকাশিত “ডিসারতিও সিলেকটা” নামের বইয়ে। এই নমুনা বর্ণগুলো ব্লকের তৈরী হরফে ছাপা হয়েছিলো। ১৭৭৮ সালে ন্যাথলিয়েন ব্র্যাসি হ্যালহেড হুগলী থেকে বাঙলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ প্রকাশ করেন – “এ গ্রামার অফ দ্যা বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ”। বইটি রোমান হরফে লিখলেও উদাহারণগুলো ছেপেছিলেন বাঙলা বর্ণমালায়। আগে ছাপা হয়েছিলো ব্লকে, এবার ছাপা হয় ধাতব কী-তে। প্রতিটা বর্ণের জন্য আলাদা আলাদা ধাতব কী।

হ্যালহেডকে এই কাজে সহায়তা করেন পঞ্চানন কর্মকার। বর্ণগুলো দেখতে ছিলো আকারে বড়ো, এখনকার বর্ণের চেয়ে একটু আলাদা, তবে অত্যন্ত সুশ্রী ও সাজানো-গোছানো। পঞ্চানন কর্মকার ও হ্যালহেড স্থির করে দিয়ে গেলেন বাঙলা বর্ণমালার রূপ। এরপর মুদ্রণযন্ত্রের প্রয়োজনে ও উৎসাহে আরো সুশ্রী হয়েছে বাঙলা বর্ণমালা। তৈরি হয়েছে মনো ও লাইনো রুপসী অক্ষর। তৈরি হয়েছে নতুন অক্ষর, যুক্তাক্ষর পাল্টেছে মনো-লাইনো টাইপ ও কম্পিউটার টাইপের কল্যাণে।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত