| 19 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

বাংলা হরফের আদি শিল্পী । উদয় শংকর বিশ্বাস

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

আজ যে বাংলা হরফের সাহায্যে অগণিত বাংলা প্রকাশনা হয়ে চলেছে, তার ইতিহাস বেশি পুরনো নয়। সময়ের হিসাবে মাত্র ২৩৭ বছর। ১৭৭৮ সালে হুগলি থেকে প্রকাশিত ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড। (Nathaniel Brassey Halhed, ১৭৫১–১৮৩০)-এর A Grammar of the Bengal Language গ্রন্থে বাংলা হরফের প্রথম উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়। গ্রন্থটি ইংরেজিতে লেখা হলেও বাংলা লিপির নমুনা এর সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। এ গ্রন্থের পাতায়-পাতায় কৃত্তিবাসী রামায়ণ, কাশীদাসী মহাভারত আর ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর থেকে উদ্ধৃতি তুলে ধরা হয়েছে। ছাপার অক্ষরে বাংলায় সেই প্রথম বাংলা হরফের ব্যবহার দেখা গেছে। যদিও ভারতবর্ষে বাংলা হরফের এটিকেই প্রথম ব্যবহার বলে অভিহিত করা হয়েছে কিন্তু বাংলা হরফের ক্ষেত্রে এ কথা সত্যি নয়। গ্রন্থখানি যখন প্রকাশিত হয়, তখন এ অঞ্চলে বাংলা অক্ষর তৈরির প্রধান কারিগর ছিলেন ব্রিটিশ সিভিলিয়ন স্যার চার্লস উইলকিনস (Charles Wilkins, ১৭৪৯–১৮৩৬)। হ্যালহেড নিজের প্রকাশনায় স্বভাবতই উইলকিনসের হরফ তৈরির অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগান। হ্যালহেড জানতেন, উইলকিনসের সাহায্য ব্যতীত তাঁর পক্ষে বাংলায় গ্রন্থ প্রকাশ সম্ভব নয়। কারণ কলকাতায় উইলকিনসই একমাত্র ইংরেজ ছিলেন, যিনি হরফ তৈরির কলাকৌশল জানতেন। সে কারণে মনে করা হয়, উইলকিনস ছেনি কেটে সিসায় ঢালাই করে বিচল হরফের (যাকে নাড়ানো-চাড়ানো যায়) ব্লক বা ছাঁচ তৈরির শ্রমসাধ্য পুরো কাজটি একাই করেছিলেন। সেজন্য বাংলা হরফ তৈরির পুরো কৃতিত্ব তাঁকে দেয়া হয়েছে। উইলকিনসকে সম্পূর্ণ কৃতিত্ব দিলে একটি প্রশ্ন সামনে চলে আসে আর তা হলো— বাংলার মতো জটিল একটি ভাষার (যার অর্ধশত মুক্তবর্ণ এবং কয়েকশ যুক্তবর্ণ আছে) হরফ নির্মাণের শ্রমসাধ্য কাজটি তিনি কি একাই সম্পন্ন করেছিলেন, নাকি এর সঙ্গে অন্যদের সম্পর্ক ছিল। প্রশ্নটি আজো অমীমাংসিত। গুরুত্বপূর্ণ এ প্রশ্নের উত্তর যথাযথ না জানার পরেও ইংরেজরা বাংলা হরফ নির্মাণের পুরো কৃতিত্ব নিজেদের মতো করে উইলকিনসকে দিয়ে এসেছেন, যা ইতিহাসের দিক থেকে অসম্পূর্ণ বলা যায়।

১৭৭০ সালে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে উইলকিনস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সিভিলিয়ন হিসেবে ভারতে আসেন। জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডের সমরসেটশায়ারের ফ্রোমের নাগরিক। বাংলায় এসে প্রথমেই তিনি দেশীয় ভাষা বিশেষত বাংলা ভাষা শেখা শুরু করেন। ভাষা শিক্ষণের প্রতি তাঁর ছিল অসীম আগ্রহ। এছাড়া তিনি ভালো করেই জানতেন, যেকোনো অঞ্চলের মানুষের মনের গভীরে প্রবেশ করার সহজ পথ হলো— সাধারণ মানুষের মুখের ভাষাকে রপ্ত করা বা জানা। সেজন্য তিনি নিজ উদ্যোগে বাংলা ভাষা শেখার পরিশ্রমসাধ্য কাজ শুরু করেন। বাংলার পাশাপাশি অল্প সময়ের মধ্যে সংস্কৃত ও ফারসি ভাষাও রপ্ত করেন। বাংলার তত্কালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস (Warren Hastings, ১৭৩২–১৮১৮) উইলকিনসের ভাষাদক্ষতার বিষয়ে অবগত ছিলেন। ভগবদ্গীতা অনুবাদে উইলকিনসকে তিনি উত্সাহ জোগান। বন্ধুবর হেস্টিংসের অনুরোধে উইলকিনস ভগবদ্গীতার ইংরেজি অনুবাদ The Bhagvat-Geeta or Dialogues of Kreeshna and Arjoon (১৭৮৫) গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এর গুরুত্ব অনুধাবন করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রকাশনার পুরো দায়িত্ব পালন করে। অনুবাদক হিসেবে উইলকিনস ছিলেন যথেষ্ট দক্ষ এবং পরিশ্রমী। শুধু অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশের মধ্যে উইলকিনস নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, বরং তিনি ১৭৮৪ সালে কলকাতা     সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার উইলিয়াম জোন্সের (William Jones, ১৭৪৬–১৭৯৪) নেতৃত্বে কলকাতায় যখন জগত্খ্যাত এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়, তখনো যথেষ্ট ভূমিকা পালন করেন। অনুবাদক কিংবা বিদ্বত্সভার সভ্য হিসেবে নয়, বরং উইলকিনস বাংলাভাষীদের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছেন বাংলা হরফ নির্মাণকারী তথা বাংলা ছাপাখানা ও মুদ্রণ শিল্পের জনক হিসেবে। জানা যায়, পারিবারিক সূত্রে ছেনি কেটে হরফ তৈরির কৃেকৗশল তাঁর জানা ছিল। উইলকিনসের মাতামহ ছিলেন লন্ডনের নামকরা টাইপ নির্মাতা ও খোদাই শিল্পী। খুব কাছ থেকে মাতামহের টাইপ তৈরির কাজ দেখার তাঁর পূর্ব-অভিজ্ঞতা ছিল। পরে সেই অভিজ্ঞতা বাংলা টাইপের নকশা করার সময় ব্যবহার করেছিলেন। বাংলা হরফ খোদাই করে লোহায় তা গলিয়ে পাঞ্চ থেকে একটি একটি করে হরফ তৈরি নিজ হাতে করেছিলেন। তাঁর তৈরিকৃত ফারসি ও নাগরী হরফে অষ্টাদশ শতকের শেষে কলকাতা থেকে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশ হয়েছিল। তাই হ্যালহেড যখন গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন, তখন স্বভাবতই তিনি উইলকিনসের শরণাপন্ন হন। হ্যালহেডের অনুরোধে উইলকিনস পর পর সাজানো ধাতুনির্মিত চলনশীল বাংলা হরফ তৈরি করে দেন। উইলকিনসের এই কৃতিত্ব স্বীকার করে হ্যালহেড তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় বলেন: “That the Bengal letter is very difficult to be imitated in steel will readily be allowed by every person who shall examine the intricacies of the strokes, the unequal length and size of the characters and the variety of their positions and combinations… Mr. Willkins, a gentleman who has been some years in the Indian Company’s civil service in Bengal, to undertake a set of Bengal types.” আগেই বলা হয়েছে, উইলকিনস হরফ তৈরির কাজটি একা করেন নাকি অন্য কারো সাহায্য নিয়েছিলেন, সে বিষয়ে তিনি লিখিত কোনো প্রমাণ রেখে যাননি। বরং এ ব্যাপারে তাঁকে নীরব থাকতে দেখা গেছে। বিভিন্ন সাক্ষ্য-প্রমাণের সাহায্যে বলা যায়, হ্যালহেডের গ্রন্থে ব্যবহূত হরফ নির্মাণে চার্লস উইলকিনসের সহযোগী হিসেবে তাঁকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিলেন পঞ্চানন কর্মকার নামে ইতিহাসবিস্মৃত আরেক বাঙালি খোদাই শিল্পী। যদিও উইলকিনস হরফ নির্মাণে পঞ্চানন কর্মকারকে কোনো ধরনের স্বীকৃতি দেননি। এমনকি হ্যালহেড কোথাও পঞ্চানন কর্মকারের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করেননি। এর সহজ কারণ হতে পারে, ভারতীয়দের প্রতি ইংরেজ সিভিলিয়নদের ছিল উন্নাসিক ধরনের মনোভাব। ইতিহাসে উপেক্ষিত চরিত্র পঞ্চানন কর্মকারের জীবনচরিত নির্মাণের জন্য বেশি তথ্য আজ আর অবশিষ্ট নেই।

পঞ্চানন কর্মকারের জন্মতারিখ ও সাল ঠিক করে জানা যায়নি। বাঙালিদের জন্মসাল ও তারিখ লিখে রাখার রেওয়াজ আঠারো-উনিশ শতকে খুব একটা ছিল না। অধিকাংশ মানুষ নিজের জন্মবারই শুধু জানত। অবশ্য পঞ্চাননের ক্ষেত্রে জন্মবারও জানা যায়নি। জানা গেছে, তিনি জন্মসূত্রে হুগলি জেলার ত্রিবেণীর অধিবাসী ছিলেন। তাঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন হুগলি জেলার অন্তঃপাতী জিরাট-বালাগড়ের অধিবাসী। পরে ত্রিবেণীতে তাঁরা চলে আসেন এবং এখানেই বসবাস শুরু করেন। তাঁদের পৈত্রিক উপাধি ছিল মল্লিক এবং বৃত্তি ছিল লিপিকর। ছুরি, বঁটি, কাটারি ছিল তাঁদের কাজের প্রধান অনুষঙ্গ। তাম্রপটে অলঙ্করণ ও লিখন অথবা অস্ত্রশস্ত্র অলঙ্করণ ও নামকরণে তাঁরা ছিলেন সিদ্ধহস্ত। পিতৃপুরুষের শিল্পভাবনা পঞ্চাননকে প্রভাবিত করেছিল। যদিও পারিবারিক এ বৃত্তির ধারা পঞ্চানন পর্যন্ত সরাসরি অব্যাহত থাকেনি। জীবিকার তাগিদে নিত্যনতুন কাজের সঙ্গে মল্লিকদের একসময় আপস করতে হয়েছিল। তাই পিতামহের বৃত্তি ত্যাগ করে পঞ্চানন নতুন বৃত্তি গ্রহণ করেন। দারুশিল্পে তিনি ছিলেন দক্ষ। যখন ত্রিবেণীতে বসবাস করতেন, তখন হুগলিতে এন্ড্রুজ নামে এক ইংরেজ ভদ্রলোক একটি প্রেস স্থাপন করেছিলেন। যদিও এন্ড্রুজ ও তাঁর প্রেস সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি। অনুমান করা হয়, পঞ্চানন গ্রামের মায়া ত্যাগ করে নাম না-জানা সেই প্রেসে মুদ্রাক্ষর হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। হ্যালহেডের গ্রন্থখানি এখান থেকেই প্রকাশ হয়েছিল। উইলকিনস প্রথম বাংলা অক্ষর এঁকে, পাঞ্চ কেটে, আলাদা আলাদাভাবে ঢালাই করে বাংলা ছাপার হরফের সাঁট তৈরি করেন। জটিল কাজটি উইলকিনস সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন পঞ্চানন কর্মকারের সহায়তায়। বইটি ছাপাতে ছেনি কাটা ঢালাই করা চলনশীল যে ধাতব হরফ ব্যবহার করা হয়, তা সম্ভব হয়েছিল উইলকিনস ও পঞ্চাননের যুগ্ম প্রচেষ্টায়। অল্প দিনের মধ্যে পঞ্চানন হ্যালহেডের ব্যাকরণে ব্যবহূত বাংলা অক্ষর অপেক্ষা সুন্দর আরেকটি সাঁট তৈরি করেন। এ অক্ষরেই ১৭৯৩ সালে কর্নওয়ালিসের কোড মুদ্রিত হয়। এমনকি তিনি নিউ টেস্টামেন্ট ছাপার জন্য প্রয়োজনীয় হরফও তৈরি করেছিলেন। পঞ্চাননের তৈরিকৃত অক্ষরেই তখনকার সব গ্রন্থ প্রকাশ হতো। সে ধারা অনেক দিন পর্যন্ত চালু ছিল। চাহিদার কথা মাথায় রেখে উইলকিনস পঞ্চাননের সহায়তায় হরফ তৈরির নিজস্ব একটি ঢালাইখানা স্থাপন করেন। ১৭৮৫ সালে জোনাথন ডানকানের ইম্পে কোডের বঙ্গানুবাদ প্রকাশ হয় ওই কারখানা থেকে। এ বইয়ের পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ২৪৬, যার মধ্যে ১২০ পৃষ্ঠাই ছাপা হয় বাংলায়। ব্যবহূত বাংলা হরফগুলো ছিল হ্যালহেডের ব্যাকরণে ব্যবহূত হরফ থেকে আকারে ছোট এবং উচ্চতায় মাত্র ৩ দশমিক ৫ মিমি। গঠন সৌষ্ঠব ও সৌন্দর্যের বিচারে নতুন এ হরফ সবার প্রশংসা পায়। মূলত ডানকানের এ গ্রন্থের মাধ্যমেই বাংলা গদ্য রচনার সূচনা হয়। আর এরই মাধ্যমে রচিত হয় পঞ্চাননের সঙ্গে উইলকিনসের ইতিহাসে অনালোচিত এক সম্পর্ক। উইলকিনসকে যদি ভারতের গুটেনবার্গের মর্যাদা দেয়া হয়, তবে পঞ্চাননকে নিঃসন্দেহে জোহান ফুস্টেরের সমকক্ষ বলা যায়।

উইলকিনসের কাছ থেকে পঞ্চানন হাতেকলমে হরফ খোদাই ও ঢালাইয়ের খুঁটিনাটি যে কাজ শেখেন, তাই তাঁর ভাবী জীবনে প্রভূত উপকারে আসে। উইলকিনস ছাড়াও পঞ্চাননের এইচ.টি কোলব্রুকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যা তাঁকে পরবর্তীকালে বিভিন্ন কাজ পাওয়ায় সাহায্য করে। ১৭৮৬ সালে উইলকিনস যখন স্বদেশে ফিরে যান, তখন কোলব্রুকই ছিলেন পঞ্চাননের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। জানা যায়, অষ্টাদশ শতকের শেষ পাদে পঞ্চানন যখন হরফ তৈরির কাজে ব্যস্ত, ঠিক তখন কলকাতায় জোসেফ শেফার্ড নামে আরেকজন ইংরেজ তরুণ খোদাই শিল্পী ছিলেন। তিনিও একই ধরনের কাজ করতেন। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে ১৭৮৭ সালে জোসেফ কলকাতায় মারা যান। ফলে বাংলা হরফ ব্যবহারকারীদের কাছে পঞ্চাননের গুরুত্ব অনেক গুণ বেড়ে যায়। কারণ তাঁর মতো বাংলা হরফ খোদাই শিল্পী কলকাতায় দ্বিতীয় কেউ ছিলেন না। পঞ্চাননের খোদিত অক্ষর আকৃতিতে একটু বড় এবং একই সঙ্গে দামে সস্তা ছিল। তিনি অক্ষরপ্রতি মাত্র দু’আনা মজুরি নিতেন। এত অল্প মজুরিতে অন্য কেউ হরফ সরবরাহ করতে না পারায় কলকাতায় পঞ্চাননের একচ্ছত্র প্রভাব তৈরি হয়। তাই পঞ্চাননকে পেতে এ সময় অনেকেই উঠেপড়ে লাগেন। বিশেষত ধর্মযাজক ও বাংলা গদ্য সাহিত্য অনুরাগী উইলিয়াম কেরিও (১৭৬১–১৮৩৪) ছিলেন এ দলে।

পঞ্চাননের সঙ্গে উইলিয়াম কেরির সংযোগ বাংলা মুদ্রণ ইতিহাসকে অনেকখানি এগিয়ে নিয়ে যায়। বাংলায় আসা অবধি কেরির একান্ত ইচ্ছে ছিল নিজস্ব একটি ছাপাখানার মালিক হওয়া। যার মাধ্যমে তিনি স্বাধীনভাবে ধর্মপুস্তক বিশেষত বাইবেল প্রকাশ করতে পারবেন। ১৭৯৮ সালে যখন কেরি মালদহের মদনাবাটি কুঠিতে তত্ত্বাবধায়ক পদে কর্মরত, তখনই তিনি মনিব জর্জ উডনির কাছ থেকে কলকাতার নিলামে কেনা কাঠের একটি মুদ্রণযন্ত্র উপহার পান। কেরির ইচ্ছে ছিল ছোট্ট এ যন্ত্রের সাহায্যে বাইবেলের মুদ্রণ শুরু করবেন। কারণ টমাস ও রামরাম বসুর সহায়তায় তিনি ১৭৯৭ সালেই নিউ টেস্টামেন্টের বাংলা অনুবাদের কাজ প্রায় শেষ করে ফেলেছিলেন। কিন্তু তাঁর প্রকাশনায় বাদ সাধে প্রয়োজনীয় বাংলা হরফের অপ্রতুলতা। কেরি তাই চেষ্টা চালান বিলেত থেকে হরফ নিয়ে আসার। তাঁর সে উদ্যোগ ছিল বেশ ব্যয়সাধ্য। তিনি হিসাব করে দেখেন, কেবল হরফের জন্যই তাঁকে ব্যয় করতে হবে ৪ হাজার টাকার মতো। বিপুল এ টাকা তাঁর একার পক্ষে সংগ্রহ করা ছিল বেশ দুরূহ। বিশাল খরচের কথা চিন্তা করে কেরি কিছুটা পিছিয়ে আসেন। হরফ সংগ্রহের বিষয়ে তিনি যখন চিন্তাগ্রস্ত, তখনই খবর পান কলকাতায় দেশী হরফ তৈরির কারখানাটি সম্পর্কে। খবর পেয়ে কেরি যারপরনাই খুশি হন। সময়ক্ষেপণ না করে তিনি হরফ নির্মাতাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করেন। পঞ্চানন কর্মকার ছিলেন ওই হরফ নির্মাতা কারখানার প্রধানতম ব্যক্তি। কেরির সঙ্গে পঞ্চাননের প্রথম পরিচয় হরফ তৈরির কারখানায়ই। পঞ্চানন কর্মকারের সঙ্গে উইলিয়াম কেরির প্রথম যোগাযোগ বিষয়ে কেরি বলেন: ‘We have a press and I have succeeded in procuring a sum of money sufficient to get types cast. I have found out a man who can cast them, the person who casts for the Company’s Press; and I have engaged a printer at Calcutta to superintend the casting’. যদিও এ বক্তব্যে কেরি সরাসরি পঞ্চাননের নাম উল্লেখ করেননি, কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হয় না কেরি এখানে পঞ্চাননের কথাই বলছেন। ১৭৯৯ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যেই কেরির জন্য প্রয়োজনীয় হরফ ঢালাইয়ের পুরো কাজ পঞ্চানন সম্পন্ন করেন। কেরি হিসাব করে দেখেন, বাংলা বাইবেল এক হাজার কপি ছাপতে কাগজ, কালি, হরফ, মজুরিসমেত তাঁর খরচ পড়বে ১৬ হাজার টাকার মতো; যা তাঁর পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব। খরচের এ অংকে তিনি উত্সাহ বোধ করেন। ঠিক সেই সময় কেরির কাছে আরেকটি সুসংবাদ আসে। শ্রীরামপুর মিশন প্রেস প্রতিষ্ঠা হবে জেনে তিনি স্বস্তিবোধ করেন। কেরির মতো দক্ষ লোক খুঁজছিল মিশন কর্তৃপক্ষ। শ্রীরামপুর মিশন কর্তৃপক্ষ কেরিকে তাঁদের সঙ্গে কাজ করার সাদর আমন্ত্রণ জানান। কালক্ষেপণ না করে কেরি বাইবেল অনুবাদের পাণ্ডুলিপি এবং সাধের কাঠের ছোট্ট মুদ্রণযন্ত্রটি নিয়ে সোজা হাজির হন শ্রীরামপুর মিশনে। দীর্ঘদিনের মনোস্কামনা পূরণ হতে চলেছে জেনে কেরি যারপরনাই খুশি হন। প্রেসের সব দায়িত্ব মিশন কর্তৃপক্ষ কেরির ওপর অর্পণ করে। পঞ্চাননের কাছ থেকে ক্রয়কৃত বাংলা হরফে কেরি ১৮০১ সালে বাইবেলের (নিউ টেস্টামেন্ট) প্রথম বাংলা অনুবাদ গ্রন্থ ধর্ম্মপুস্তক ছাপেন, যা বাংলা প্রকাশনার ইতিহাসে যুগান্তকারী এক ঘটনা। যদিও এর আগে অর্থাত্ ১৮০০ সালে ১০৭ পৃষ্ঠার মঙ্গল সমাচার মাতিউর রচিত এবং রামরাম বসুর হরকরা ও জ্ঞানোদয় পুস্তিকা দুটি মিশন প্রেস থেকে বাংলায় প্রকাশ হয়েছিল।

বাংলা মুদ্রণ ইতিহাসের আদিপর্বে শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেসের অবদান উল্লেখ করার মতো ঘটনা। ১৮০০ সালের ১০ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত এ প্রেসের সঙ্গে দুজন বাঙালির নাম জড়িয়ে আছে। প্রথমজন হলেন গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য আর দ্বিতীয়জন পঞ্চানন কর্মকার। কম্পোজিটর হিসেবে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য এ প্রেসে শুরুতেই যোগ দেন। তিনি ছিলেন একাধারে মুদ্রণ ব্যবসায়ী, পুস্তক ব্যবসায়ী, প্রকাশক ও সেসঙ্গে গ্রন্থাকার। গ্রাম্য সংস্কার ত্যাগ করে হুগলির (বহরা) অধিবাসী প্রথম বাঙালি প্রকাশক গঙ্গাকিশোর কাজের খোঁজে শ্রীরামপুরের মিশনারিদের সংস্পর্শে আসেন। তিনি ছিলেন বেশ স্বাধীনচেতা। মিশন প্রেসে থাকার সময়ই প্রেস সম্পর্কিত খুঁটিনাটি শিখে ফেলেন। সাহেবদের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় গঙ্গাকিশোর অল্প দিনের মধ্যে চাকরি ছেড়ে সরাসরি কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতায় এসে নতুন করে প্রকাশনা শিল্পে নিজেকে যুক্ত করেন। ১৮১৬ সালে ফেরিস অ্যান্ড কোম্পানির ছাপাখানা থেকে তিনি প্রথম সচিত্র বাংলা গ্রন্থ ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গল প্রকাশ করেন। শুধু তা-ই নয়, বাংলা ভাষার প্রথম সংবাদপত্র বাঙ্গাল গেজেটও গঙ্গাকিশোর তাঁর নিজস্ব ছাপাখানা বাঙ্গাল গেজেটি প্রেস থেকে ছাপান। যদিও বাংলা মুদ্রণ-সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ এই পুরুষের নাম মিশনারিদের নথিপত্রে নেই। তবে দক্ষ মুদ্রাক্ষর পঞ্চানন কর্মকারের নাম মিশনারিদের নথিপত্রে উল্লেখ আছে। যেমন: ‘A native named Punchanun, of  the Caste of smiths, who had been intructed in cutting punches by Lieut’.

আগেই বলা হয়েছে, কেরি পঞ্চাননকে শ্রীরামপুরে নিয়ে এসেছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত (১৮০৪ সাল) তিনি এ মিশন প্রেসের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন। পঞ্চাননকে পেয়ে শ্রীরামপুর মিশন কর্তৃপক্ষ খুশি হয়। কর্তৃপক্ষ অক্ষর ঢালাইয়ের জন্য একটি কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ঢালাই কারখানার মূল দায়িত্ব দেয়া হয় পঞ্চানন কর্মকারকে। যদিও তদারকির মূল দায়িত্বে থাকেন কেরি নিজে। শ্রীরামপুর মিশনে যোগদানের পর পঞ্চানন প্রথমেই দেবনাগরীর একটি সাঁট তৈরি করেন। কারণ তখন পর্যন্ত সংস্কৃত ব্যাকরণ মুদ্রণের জন্য মিশনের কাছে প্রয়োজনীয় দেবনাগরী হরফ ছিল না। নাগরী লিপিতে প্রচুর যুক্তাক্ষর থাকায় পঞ্চাননকে প্রায় সাতশ নাগরী-হরফ তৈরি করতে হয়েছিল। ১৮০৩ সালের মধ্যে তিনি সাঁট তৈরির কাজ প্রায় শেষ করে আনেন। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কাজটি দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ করার নির্দেশ ছিল। এজন্য তিনি মনোহর কর্মকার নামক অন্য এক যুবককে তাঁর সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেন। দেবনাগরীর সাঁট তৈরির সময় পঞ্চানন বাংলা অক্ষরের আরো একটি সাঁট তৈরি করেন। এ অক্ষরে ১৮০৩ সালে নিউ টেস্টামেন্ট-র দ্বিতীয় সংস্করণ ছাপা হয়। এ বিষয়ে জে সি মার্সম্যান বলেন: ‘While engaged in cutting the Nagree punches, Panchanon also completed a fount of Bengalee, smaller in size, and more elegant from that which had been used in the first edition of the Bengalee New Testament. That edition had now been distributed, and a second was called for’.

পঞ্চানন কর্মকার তাঁর অধীত বিদ্যা মনোহর মিস্ত্রিসহ আরো বেশ কয়েকজনকে হাতে-কলমে শেখান। কিন্তু অন্য শিষ্যদের তুলনায় মনোহরের প্রতি তাঁর স্নেহদৃষ্টি একটু বেশি ছিল। হতে পারে উভয়ের আবাসস্থল একই এলাকা ছিল বলে। তিনি যেমন ত্রিবেণীর লোক ছিলেন, তেমনি মনোহর (দাস) কর্মকারও ছিলেন ত্রিবেণীর বাসিন্দা। এছাড়া পৈতৃক পেশার দিক থেকেও উভয়ের মিল ছিল। পঞ্চানন মনোহরকে ছেনিকাটা থেকে শুরু করে ঢালাইয়ের কাজ যত্নসহকারে শেখান। পঞ্চাননের কোনো পুত্রসন্তান ছিল না। তিনি মনোহরকে পুত্রবত্ স্নেহ করতেন। মনোহরের ওপর এতটাই বিশ্বস্ত ছিলেন যে, তাঁর একমাত্র কন্যা লক্ষ্মীমণিকে মনোহরের কাছে অর্পণ করতে দ্বিধাবোধ করেননি। বৈবাহিক জীবনে মনোহর পুত্রসন্তানের জনক ছিলেন। ১৭৭৮ থেকে ১৮০৪ সাল পর্যন্ত যেসব বাংলা বই ছাপা হয়েছে, তাতে ব্যবহূত বর্ণমালার সিংহভাগই ছিল পঞ্চানন কর্মকার কর্তৃক প্রস্তুতকৃত। মনোহর দায়িত্বভার লাভের পর পঞ্চাননের কাজকে অনেকখানি এগিয়ে নিয়ে যান। তিনি বাংলা ছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি দেশী ও বিদেশী ভাষা যেমন আরবি, পারসি, নাগরী, গুরুমুখী, মারাঠি, তেলেগু, ওড়িয়া, বর্মী, চৈনিক প্রভৃতি (অন্তত চৌদ্দটি) ভাষার হরফ তৈরি করেছিলেন। মৃত্যু অবধি মনোহর পঞ্চাননের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করেন। মনোহরের কাছ থেকে হরফ তৈরির কাজ শেখেন তাঁর দ্বিতীয় পুত্র কৃষ্ণচন্দ্র কর্মকার। এভাবে বংশপরম্পরায় তিন পুরুষের হাতে সত্তর বছরের অধিককাল সীমাবদ্ধ ছিল বাংলা হরফ নির্মাণের কলাকৌশল। মুদ্রণ শিল্পের ইতিহাসে পঞ্চানন ও তাঁর জামাতা এবং দৌহিত্র কৃষ্ণচন্দ্রের দান অনস্বীকার্য। কৃষ্ণচন্দ্রের কোনো সন্তানাদি না থাকায় বংশানুক্রমিকভাবে প্রবাহিত বাংলা হরফের ধারা পরে বন্ধ হয়ে যায়। হরফ তৈরির পাশাপাশি তিন পুরুষের কর্মকার পরিবারটি বাংলা মুদ্রণ ইতিহাসেও উজ্জ্বল অবস্থানে আছে। আর তা মনোহর কর্মকারের শ্রীরামপুরের বসতবাটিতে স্থাপিত চন্দ্রোদয় যন্ত্র নামক ছাপাখানার জন্য। বাংলা ছাপাখানার ইতিহাসে এ প্রেসটি বিশিষ্টতার দাবিদার। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, এটি কৃষ্ণচন্দ্র কর্মকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু অন্য গবেষক সবিতা চট্টোপাধ্যায় বাঙ্গালা সাহিত্যে ইউরোপীয় লেখক (১৯৭২) গ্রন্থে ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। তাঁর মতে, মনোহর কর্মকারই এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তবে যিনিই প্রতিষ্ঠা করুন কৃষ্ণচন্দ্রের সময় চন্দ্রোদয় প্রেসের শ্রীবৃদ্ধি যে সবচেয়ে বেশি হয়েছিল তা বলা যায়। বিশেষত এ প্রেসের নতুন পঞ্জিকা-র কদর ছিল সবচেয়ে বেশি। ১৮৫০ সালে ৪৩ বছর বয়সে কৃষ্ণচন্দ্র কর্মকারের যখন মৃত্যু হয়, তখন ছাপাখানাটির মূল দায়িত্ব পালন করেন তাঁরই অনুজদ্বয় রামচন্দ্র ও হরচন্দ্র কর্মকার। ১৮৮৪-৮৫ সালের পঞ্জিকার ছবিতে চিত্রকর হিসেবে হরচন্দ্র কর্মকার, রামচন্দ্র কর্মকার এবং কৃষ্ণচন্দ্র কর্মকারের নাম দেখতে পাওয়া যায়। হরফ নির্মাণের পাশাপাশি পঞ্চানন কর্মকার খোদাই চিত্র শিল্পী হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। সুকুমার সেন তাঁর বটতলার ছাপা ও ছবি (২০০৮) বইয়ে হোগলকুঁড়ে নিবাসী পঞ্চানন কর্মকার নামক একজন চিত্রশিল্পীর উল্লেখ করেছেন। ‘গোপীমণ্ডলে শ্রীকৃষ্ণ’ (ছবি নম্বর: ৪৭), ‘কৈলাসে হরপার্বতী’ (ছবি নম্বর: ৪৮), ‘বাণরাজা’ (ছবি নম্বর: ৪৯), ‘সখী পরিবৃত রাধাকৃষ্ণ’ (ছবি নম্বর: ৮২)-নামক কাঠ খোদাইকৃত ছবির উদাহরণ আলোচ্য গ্রন্থে ব্যবহার করেছেন। আবার সুকুমার সেন, ১২৬১ সনের পঞ্জিকায় প্রকাশিত গুটানো পটরীতিতে অংকিত হোগলকুঁড়ের পঞ্চানন দাসের নবজাত শ্রীকৃষ্ণকে বসুদেব নন্দালয়ে নিয়ে যাওয়া (ছবি নম্বর: ২২) এবং মহাভারতের অর্জুনের লক্ষ্যভেদ (ছবি নম্বর: ২৪)-খোদাই চিত্রদ্বয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। হতে পারে, পঞ্চানন কর্মকার ও পঞ্চানন দাস সম্ভবত একই ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, পঞ্চানন ১৮০৪ সালে মারা যাওয়ার দীর্ঘদিন পর কেন বটতলার বই ও পঞ্জিকায় তাঁর নামাঙ্কিত খোদাইকৃত ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে ছয় সখী পরিবিষ্ট রাধাকৃষ্ণের ছবিটি বটতলার অনেক বইয়েই ব্যবহার করা হয়েছে। যেমনটা ব্যবহার করা হয়েছে বহু বৈষ্ণবীয় নিবন্ধে। তবে এ কথা বলা যায়, পঞ্চানন কর্মকার হরফ নির্মাণের পাশাপাশি পূর্বপুরুষের অঙ্কনরীতি রপ্ত করেছিলেন। কারণ তাঁর দৌহিত্র কৃষ্ণচন্দ্র কর্মকার ছিলেন একজন দক্ষ কাঠখোদাই শিল্পী। পুরনো পঞ্জিকায় শ্রীজগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রাসহ তাঁর বেশকিছু ছাপানো ছবি দেখতে পাওয়া যায়। পরিশেষে বলা যায়, পঞ্চানন তাঁর সাধনা, অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের ফলে বাংলা মুদ্রণের প্রসার, প্রচার ও উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি করেছিলেন। বাংলা মুদ্রণ ইতিহাসে পঞ্চানন কর্মকারই প্রথম সার্থক বাঙালি খোদাই শিল্পী।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত