ভাষার উপনিবেশ বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (পর্ব-৭)
বাংলা ভাষার উদ্ভব, উনিশ শতকে কলিকাতার সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতদের দ্বারা সংস্কৃতায়িত বাংলার সৃষ্টি, বাঙালির সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে গত দুইশ বছর ধরে পরতে পরতে লেখা হয়েছে মিথ্যা আর ভুল তথ্যভিত্তিক বানোয়াট ইতিহাস। দুইশ বছর ধরে আমরা অইসব ভুল বা বানানো ইতিহাস মেনে নিয়ে এর ভিত্তিতেই পুনরায় আমাদের ভাষা আর সংস্কৃতির বয়ান রচনা করে গেছি। আর এভাবে বাংলা ভাষা পরিণত হয়েছে সংস্কৃতের উপনিবেশে। এই প্রথমবারের মত বানানো ইতিহাসের স্তর খুঁড়ে বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বাঙালি সংস্কৃতির রদবদলের আদত ইতিহাস উদঘাটনের চেষ্টা চালিয়েছেন উত্তর উপনিবেশী তাত্ত্বিক ফয়েজ আলম তার “ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস”বইয়ে।
ফয়েজ আলম ঐতিহাসিক ও ভাষাতাত্ত্বিক তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে দেখিয়েছেন ‘বাংলা ভাষা সংস্কৃতের কন্যা’ এটি সচেতন চেষ্টায় তৈরি একটি মিথ্যা বয়ান, যে মিথ্যা রচনার পিছনে কাজ করেছে ধর্মীয় আবেগ ও উপনিবেশি প্রশাসকদের প্রশ্রয়। আসলে সংস্কৃত এবং বাংলা দুটো ভাষাই এসেছে স্থানীয় ভাষা থেকে (যাকে প্রাকৃত ভাষা বলা হয়ে থাকে)। প্রাচীনকালে ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে (বর্তমান পাকিস্তানের অংশ বিশেষসহ) প্রচলিত স্থানীয় ভাষাকে কিছু নিয়মে বেঁধে দেন পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির বাসিন্দা পাণিনি নামের এক পন্ডিত; সেটিই পরে ধর্মচর্চা আর ধর্মীয় লেখাজোকায় কাজে লাগানো হয় আর সংস্কৃত ভাষা নাম পায়। এটি কখনো কোনো মানবগোষ্ঠির মুখের ভাষা ছিলো না। একই সময়ে আমাদের দেশে প্রচলিত স্থানীয় ভাষা মানুষের মুখে মুখে স্বাভাবিক রদবদলের নানা ধাপ পার হয়ে ৬৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি বাংলা ভাষার আদি রূপ নেয় । সংস্কৃতের সাথে বাংলার কোনো সরাসরি সম্পর্কই নাই। অথচ দুইশ বছর ধরে ভাষার ইতিহাসে আর পাঠ্য বইপুস্তকে বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতের মা বানিয়ে রাখা হয়েছে। এরকম অনেক বানোয়াট ধারণা ভেঙ্গে দিয়েছেন ফয়েজ আলম ভাষার উপনিবেশ বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস এই ধারাবাহিকে আজ থাকছে পর্ব- ৭।
ইতিহাসের বিকৃতি
বাংলাভাষার সংস্কৃতায়নের সূত্রে নতুন গদ্যরীতিতে বইপুস্তক রচনা শুরুর প্রথম থেকেই প্রাচীন আর্য রাজন্যবর্গ, দেবদেবী, লোক আখ্যানের দিকে নজর পড়ে পন্ডিতদের। কারণ সংস্কৃতজ্ঞ ঐসব পন্ডিতদের বিদ্যার দৌড় ছিল ঐ পর্যন্ত, আর ধর্মীয় কারণে আগ্রহের জায়গাও ঐটাই। বাঙালির লেখা প্রথম গদ্য বই রামরাম বসুর প্রতাপাদিত্যচরিত ইতিহাসের সামান্য এক চরিত্র নিয়ে লেখা, ছাপা হয় ১৮০১ সালে। এটি সাদা ছাত্রদের জন্য লেখা হলেও পরে বাঙালি পাঠকদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়। একইরকম পাঠকপ্রিয় আরেকটি বই রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়ের মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্ররায়স্যচরিত্রং, প্রথম বের হয় ১৮০৫ সালে। আরো পরে প্রকাশিত হয় নীলমনি বসাকের ভারতবর্ষীয় ইতিহাস ১ম ভাগ ও ২য় ভাগ। এ ছাড়া কিস্সার চরিত্র মহারাজ বিক্রমাদিত্যের আখ্যান বত্রিশ সিংহাসন-এ বিক্রমাদিত্যের কাল্পনিক মাহাত্মের কাহিনি আর্য-গৌরবের কাঙাল ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের মনে খানিকটা বিশ^স্ততার মর্যাদা পায়। এটিও সে কালের বেশ জনপ্রিয় একটি বই।
ভারত বর্ষের লিখিত ইতিহাসের সূচনা মুসলিম শাসনামলে। বারানী, ফিরিশতা, মিনহাজ, বাদায়ূনী, মির্জা নাথান প্রমুখ মুসলিম শাসনামলের যে বিবরণ লিখে গেছেন মূলত তার উপর ভিত্তি করেই প্রথম বারের মতো ভারতবর্ষের ইতিহাস রচনার সূচনা। পরে ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে আরো বিভিন্ন উৎসের সাক্ষ্যও পাওয়া যায়। বাংলা ভাষার রূপান্তরের মধ্য দিয়ে নতুন গদ্য রীতির পুস্তক রচনার প্রয়োজনে লেখা হয় প্রতাপাদিত্যচরিত, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্ররায়স্য চরিত্রং ও এ জাতীয় অন্যান্য বই। আমরা দেখবো এসব বইয়ে ইতিহাসকে নিরপেক্ষতার সাথে লেখা হয়েছে কি না, না হয়ে থাকলে কতটা বিকৃত করা হয়েছে এবং কেন? তার উদ্দেশ্য ও পরিণামই বা কি?
রাজা প্রতাপাদিত্যচরিত: উনিশ শতকে কলিকাতার উচ্চবর্ণের হিন্দু মনের যে কটি গৌরবের বস্তু তার একটি হলো বাংলার বারো ভুঁইয়ার একজন, যশোরের সামন্ত প্রতাপাদিত্যর কাহিনি। প্রথমে ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর অন্নদামঙ্গল কাব্যে তার কাল্পনিক বীরত্বগাথা রচনা করেন। ইতিহাসের সামান্য সাদামাটা সূত্র অবলম্বন করে এ রকম কল্পকাহিনি রচনা মধ্যযুগের কবিদের স্বাভাবিক কবি প্রতিভার বৈশিষ্ট হিসাবে দেখা হয়। এইটুকু অবলম্বন করে রামরাম বসু উনিশ শতকের শুরুতে লিখলেন রাজা প্রতাপাদিত্যচরিত। এবার কিন্তু এ কল্পকাহিনি আর কল্পকাহিনির সীমায় আবদ্ধ থাকে না। বইটি জনপ্রিয় হওয়ার কারণে সারা বাংলায় বহু পাঠক তা পাঠ করে সত্য ইতিহাস হিসাবে। উপনিবেশের দড়িতে বান্ধা তাদের মনের মানসিক অহংকারের জায়গা হিসাবে প্রতাপাদিত্য পরিণত হয় গৌরবের উপলক্ষ্যে। প্রায় পঞ্চাশ বছর পর হরিশচন্দ্র তর্কালঙ্কার আরেকটু ফুলিয়েফাঁপিয়ে লিখলেন মহারাজ প্রতাপাদিত্য চরিত্র। এইসব বইয়ের কল্পকাহিনি পাঠকের কাছে সত্য বলে গৃহীত হয়।
প্রতাপাদিত্য নামক বইয়ের সম্পাদক শ্রীনিখিলনাথ রায় বিএল আমাদের জানাচ্ছেন, “বাঙ্গালী জীবনে যিনি স্বাধীনতার রসাস্বাদে নিজ আত্মাকে তৃপ্ত করিয়াছিলেন, তিনি যে বাঙ্গালীর গৌরবের বস্তু ইহা অস্বীকার করার উপায় নাই।যদি কেহ একবার স্বাধীনতার শ^শানভুমি যশোর বা ঈশ^রীপুরে উপস্থিত হন, তিনি দেখিতে পাইবেন, দেবী যশোরেশ^রীর ভগ্ন মন্দির হইতে আরম্ভ করিয়া বহুদূর বিস্তৃত ইতস্তত: বিক্ষিপ্ত ভগ্নাবশেষ আজিও প্রতাপের কীর্তির সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে।”১০ এই বয়ানের ভাষা ও প্রকাশভঙ্গি থেকে আন্দাজ করা যায় নিখিল বাবু নিজেও এই কল্পকাহিনিতে বিশ্বাসী ও গৌরবান্বিত।
কিন্তু এই প্রতাপাদিত্য ইতিহাসে নথিভুক্ত হয়েছেন সাদামাটা একজন সামন্ত হিসাবে একটিমাত্র অনুচ্ছেদের বিবরণে। তার সম্পর্কে বলা হয়েছে, “অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যে তাঁহার শক্তি, বীরত্ব ও দেশভক্তির যে উচ্ছ্বসিত বর্ণনা দেখিতে পাওয়া যায়, তাহার অধিকাংশরই কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নাই।”১১ রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রতাপাদিত্য সম্পর্কে সাকুল্যে এক প্যারা লিখছেন তার বাংলাদেশের ইতিহাস (দ্বিতীয় খন্ড) গ্রন্থে।
আমাদের মনে রাখতে হবে বাঙালি ইতিহাস লেখার আগে প্রতাপাদিত্য বা কৃষ্ণচন্দ্ররায়স্য চরিত্রং-এর মত কল্পকাহিনি লিখেছে। এবং সাধারণ বাঙালির প্রায় ঘরেঘরে সে কল্প কাহিনি পড়া হয়েছে, ইতিহাস পড়া হয়নি। ফলে রামরাম বসুর প্রতাপাদিত্যচরিত বা হরিশচন্দ্র তর্কালঙ্কারের মহারাজ প্রতাপাদিত্য চরিত্র পড়ে নিজ জাতির বীরত্ব সম্পর্কে বুদবুদের মত যে ধারণা জন্মেছে বেশিরভাগ মানুষের মনে তা কিন্তু পরবর্তী কালে লেখা ইতিহাসের গুণে মিথ্যা হয়ে যায়নি। ফলে এই যে কল্প-ইতিহাস, ফুলানো-ফাঁপানো কাহিনি তার পরিণাম হয় সুদূরপ্রসারী। বহুদশক ধরে সাধারণ বাঙালি পাঠক বইগুলো পড়ে পড়ে প্রতাপাদিত্যকে এক সত্যিকারের বাঙালি বীররূপে চিত্রিত করে। নিখিলনাথের ভাষায়: “বারো ভুঁইয়াদের মধ্যে মহারাজ প্রতাপাদিত্যের গৌরব বাঙ্গলার আবাল-বৃদ্ধবণিতার মুখে ধ্বনিত হইয়া আসিতেছে। ভারতচন্দ্রের অমর লেখনি তাঁহাকে চিরোজ্জ্বল করিয়া গিয়াছে। আজ বাঙ্গলার প্রতি গৃহ হইতে “যশোর নগরধাম, প্রতাপাদিত্য নাম” এই মহাগীতি তাহার জলভারাবনত বায়ূস্তরকে কম্পিত করিয়া অনন্ত স্পর্শ করিবার জন্য ধাবিত হইতেছে। যাঁহার নাম করিতে কঙ্কালসার বঙ্গবাসী পুলকে অধীর হইয়া পড়ে, বঙ্গশিশু আনন্দে করতালি দেয়, বঙ্গবালার অঙ্গ রোমাঞ্চিত হইয়া উঠে, “বরপুত্র ভবানীর, প্রিয়তম পৃথিবীর” সেই মহাগৌরবান্বিত বঙ্গবীরের কীর্ত্তিকাহিনি অমর কবি ব্যতিত আর কে চিত্রিত করিতে পারে! বঙ্গভূমিকে স্বাধীনতার লীলানিকেতন করিবার জন্য যিনি অদম্য অধ্যবসায় আশ্রয় করিয়াছিলেন, বঙ্গবাসীর কাপুরুষ নাম অপনোদনের জন্য যিনি তাহাদের বাহুতে শক্তি দিয়াছিলেন, বাঙ্গালীর রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য যিনি আসমুদ্র বিজয় নিশান উড্ডীন করিয়াছিলেন তাহার গৌরবগীতি গাহিতে কাহার না ইচ্ছা হয়।”১২ উদ্ধৃতিটি থেকে আন্দাজ করা যায় প্রতাপাদিত্য সম্পর্কিত এইসব কল্পকাহিনি পাঠ করে সাধারণ মানুষ কতটা প্রভাবিত হয়েছিলেন।
আমরা দ্বিতীয় যে বইটি নিয়ে আলোচনা করবো তার নাম মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্ররায়সচরিত্রং, লেখক রাজীব লোচন মুখ্যোপাধ্যায়। এটি নদীয়ার জমিদার কৃষ্ণচন্দ্রের জীবনী। বইটি প্রথম ছাপা হয় ১৮০৫ সালে। এটিও খুব জনপ্রিয় একটি বই। সিরাজউদদৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে যারা পরোক্ষে অংশ নিয়েছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র তাদের নেতৃতস্থানীয়। তার বাড়িতে অনেক গোপন শলাপরামর্শও হতো। ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে কৃষ্ণচন্দ্রের হয়ে বেশিরভাগ যোগাযোগ রাখতেন তার বিশ^স্ত সহকারী কালী প্রসাদ সিংহ।
আরো পড়ুন: ভাষার উপনিবেশ বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (পর্ব-৬)
পলাশির ষড়যন্ত্রে যারা আড়ালে থেকে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে নদীয়ার জমিদার কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন সবচেয়ে চতুর। তিনি হিন্দু জমিদার-সামন্তদের একত্রিত করে পলাশির ষড়যন্ত্রে সমর্থন যুগিয়ে প্রত্যক্ষ ষড়যন্ত্রকারী ও ইংরেজদের মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বহুগুণে। এর ফলে ইংরেজরা মনে করে নবাবের দরবার থেকে শুরু করে দেশীয় জমিদার আমাত্যশ্রেণী সকলেই নবাবের বিরুদ্ধে। তাই নবাবকে হটিয়ে দিতে পারলেই তাদের সফলতা আসবে। এই কৃষ্ণচন্দ্রের জমিদারীর পত্তন কিন্তু জনৈক দেশোদ্রোহীর মাধ্যমে। আমরা এখানে তার খানিকটা উল্লেখ করতে চাই।
বাংলার বারো ভুঁইয়ার অন্যতম যশোরের প্রতাপাদিত্যের সাথে মুঘল বাহিনীর যুদ্ধের সময় এক পর্যায়ে প্রতাপাদিত্য একটি দূর্ভেদ্য দূর্গে আশ্রয় নেন। অনেক কসরত করেও মুঘলবাহিনী সেখানে ঢুকতে পারছিল না। এ সময় দূর্গাদাস ওরফে ভবানন্দ এগিয়ে এসে দূর্গে প্রবেশের গুপ্ত পথ দেখিয়ে দেয় মুঘল বাহিনীকে। প্রতাপাদিত্যকে গ্রেফতার ও হত্যার পর বাদশাহ জাহাঙ্গীর খুশি হয়ে দূর্গাদাসকে ১৪টি পরগণার জমিদারী দেন ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে। প্রতিষ্ঠিত হয় নদীয়ার জমিদারী। দূর্গাদাসের অধস্তন পুরুষ কৃষ্ণচন্দ্রও একইভাবে দেশ-বিরোধী ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়ে পলাশির যুদ্ধে ইংরেজদের জয়ী হতে সাহায্য করেন। এর পুরস্কার হিসাবে ক্লাইভ তাকে পাঁচটি কামান এবং দিল্লীতে তদবির করে মহারাজা উপাধি আনিয়ে দেন। এভাবেই দেশোদ্রোহী দূর্গাদাসের বংশধর আরেক দেশোদ্রোহী জমিদার কৃষ্ণচন্দ্র হয়ে উঠেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র। ১৩
রাজীব লোচন মুখোপাধ্যায় তার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্ররায়স্যচরিত্রং বইয়ে লিখেছেন, “শেষে এই পরামর্শ হইল যাহাতে জবন (মুসলমান) দূর হয় তাহার চেষ্টা করহ ইহাতে জগতসেট কহিলেন এক কার্য্য করহ নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় অতিবড় বুদ্ধিমান তাঁহাকে আনিতে দূত পাঠাও তিনি আইলেই যে পরামর্শ হয় তাহাই করিব। . . . পরে এক দিবস জগত সেঠের বাটীতে রাজা মহেন্দ্র (রায় দুর্লভ) প্রভৃতি সকলে বসিয়া রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়কে আহ্বান করিলেন দূত আসিয়া রাজাকে লইয়া গেল যথাযোগ্য স্থানে সকলে বসিলেন।”১৪
রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়ের কাহিনিতে অতিরঞ্জন আছে বলে মন্তব্য করেছেন পলাশির ষড়যন্ত্র ও সে কালের সমাজ বইয়ের লেখক রজতকান্তি রায়। আমরা তার সাথে দ্বিমত পোষণ করি, অত্যন্ত যৌক্তিক কারণে। লেখক রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় জমিদার কৃষ্ণচন্দ্রের আত্মীয় ছিলেন।নদীয়ার জমিদার কৃষ্ণচন্দ্রকে মহত ও বড় করার জন্য বইটি লেখা হয়। এ উদ্দেশ্যে রাজপ্রাসাদ, রাজসভা, অর্থবিত্ত, প্রতিপত্তি, চরিত্রগুণ ইত্যাদি ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানোর প্রয়োজন পড়ে। রাজীবলোচন তাই করেছেনে। কৃষ্ণচন্দ্রের চরিত্রকে যাবতীয় মানুষী ত্রুটি থেকে মুক্ত করে ঐশ^রিক চরিত্রে রূপান্তরিত করেছেন তিনি। তাঁর জমিদারী দফতরকে বাদশাহ আকবরের রাজসভাতুল্য করে বর্ণনা দিয়েছেন। তার প্রতিপত্তি, জনপ্রিয়তা, প্রজাপ্রীতি সবাই অতুলনীয়। এসবই কৃষ্ণচন্দ্রকে বড় করে দেখানোর কাজে লেগেছে। কিন্ত মিছামিছি পলাশির ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে যুক্ত করে দেখানোর মধ্যে তাকে বড় করার সুযোগ নাই। কৃষ্ণচন্দ্রের আত্মীয় হয়ে এ মিথ্যাচার কেন করবেন রাজীবলোচন? দ্বিতীয়ত বইটি লেখা হয় ১৮০৫ সালে। তখনো পলাশির যুদ্ধের সময়কার অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে ছিলেন জমিদার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের পরিবারের লোকজন। এ অবস্থায় তাকে ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে দেখানোর মধ্যে ঝুঁকিও ছিল। তাছাড়া সেই ১৭৫৭ সাল থেকেই লোকমুখে কৃষ্ণচন্দ্র পলাশির ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আসছেন। এসব কারণে আমরা মনে করি না রাজীবলোচন এ নিয়ে মিথ্যাচার করেছেন।
আমরা এখানে দুজন ঐতিহাসিক ব্যক্তির জীবন অবলম্বনে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে কল্পকাহিনি রচনার উদাহরণ হিসাবে দুটো জনিপ্রয় বইয়ের উল্লেখ করলাম যেগুলো সাধারণের মনে সত্য ইতিহাসের মর্যাদা পেয়ে আসছে। সে কালে আরো কিছু চরিত্র নিয়ে এ জাতীয় গ্রন্থ রচিত হয়েছে। যেমন রাজা বিক্রমাদিত্য। রামায়ন মহাভারতের লোক আখ্যানগুলোর বিভিন্ন বীরত্বগাথা এবং বীর চরিত্রগুলোও বিবরণের গুণে ও ধর্মীয় আবেগের কারণে ঐতিহাসিব চরিত্র হিসাবে প্রভাব ফেলেছিল।
আমাদের আলোচনায় যা বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো নদীয়ার জমিদার কৃষ্ণচন্দ্রকে বিরাট ক্ষমতাধর, প্রতিপত্তিশালী রাজামহারাজা হিসাবে দেখানোর প্রয়াস, যে কাজটি নিষ্ঠার সাথে করেছেন রাজীবলোচন। এরপরেও বিভিন্ন জনের লেখায় কৃষ্ণচন্দ্র বিশাল এক শাসক এবং সর্বগুণে গুণান্বিত মানুষ হিসাবেই আবির্ভূত হয়েছেন। তার বিপরীতের সিরাজউদদৌলাকে চিত্রিত করা হয়েছে অযোগ্য, অর্বাচীন, অত্যাচারী ও লম্পট শাসক হিসাবে। শুধু সিরাজ উদদৌলাকেই নয়, এর আগের বিভিন্ন শাসক এবং দিল্লীর বাদশাদেরকেও একই রকমভাবে হীন চরিত্রের অধিকারী হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে উনিশ শতকের প্রথম দিকে লেখা বিভিন্ন বইয়ে।
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের উদ্যোগে বাংলা ভাষার রূপান্তর এবং নয়া গদ্যরীতিতে বইপত্র লেখার উসিলায় এই যে ইতিহাস পুন:নির্মাণের সুযোগ তৈরি হলো তার পুরোটাই কাজে লাগান সে কালের লেখকগণ। এভাবে কাল্পনিক বা লোক চরিত্রকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ইতিহাসসদৃশ কাহিনি রচনা, রামায়ন মহাভারতের ব্যাপক প্রচার ইত্যাদির মধ্য দিয়ে আর্য জাতি সর্বাগুণে গুণান্বিত, দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ একটি বীর জাতি হিসাবে জনমনে জায়গা করে নেয়। এরই প্রভাবে আর্য জাতির উত্তরাধিকার হিসাবে একই মর্যাদা পায় বাঙালি হিন্দুও। একই দৃশ্যপটে বাঙালি মুসলমান চিত্রিত হয় নির্যাতনকারী, চরিত্রহীন, অযোগ্য শাসক-প্রশাসকের জাতি হিসাবে। এ অবস্থা সামগ্রিকভাবে বাঙালি মুসলমানের যৌথ-চৈতন্যে বৈরি প্রভাব ফেলে। ঐসব কল্পিত বর্ণনাকে সত্যি মনে করে তাদের মধ্যে দেখা দেয় প্রচন্ড হীনমন্যতা। পঞ্চাশ বছরের মধ্যে সত্যিকার অর্থেই বাঙালি মুসলমানের মানসিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে যায়। ভাষার রূপান্তরের সূত্রে ইতিহাসের ও বাঙালি মুসলমানের মনোজগতে এই যে বিকৃতি ঘটে যায় এখনো তার পরিপূর্ণ সংশোধন সম্পন্ন হয়নি।
বাংলাদেশে উত্তরউপনবিশেী ভাবর্চচার পথিকৃৎ ফয়েজ আলমের চিন্তার ধরণ, রোখ ও জায়গা আমাদের প্রচলিত ধারার সাহিত্যভাবনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা থেকে ভিন্ন। একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, অনুবাদক, উত্তরউপনিবেশি তাত্ত্বিক। উপনিবেশি শাসন-শোষণ আর তার পরিণাম, রাষ্ট্র ও সমধর্মী মেল কর্তৃক ব্যক্তির উপর শোষণ-নিপীড়ন ও ক্ষমতার নানামুখি প্রকাশ আর এসবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকে থাকার কৌশল নিয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে লিখছেন তিনি। বিশ্বায়নের নামে পশ্চিমের নয়াউপনিবেশি আর্থ-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর রাষ্ট্র ও স্বার্থকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর শোষণচক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার লেখা আমাদের উদ্দীপ্ত আর সাহসী করে তোলে।
ফয়েজ আলমের জন্ম ১৯৬৮ সালে, বাংলাদশের নেত্রকোনা জেলার আটপাড়ার যোগীরনগুয়া গ্রামে। বাবা মরহুম শেখ আবদুস সামাদ, মা সামসুন্নাহার খানম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে বিএ (সম্মান) ও এমএ পাশ করার পর প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণার জন্য এমফিল. ডিগ্রী লাভ করেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ: ব্যক্তির মৃত্যু ও খাপ-খাওয়া মানুষ (কবিতা, ১৯৯৯); প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি ( গবেষণা, ২০০৪); উত্তর-উপনিবেশি মন (প্রবন্ধ, ২০০৬); ভাষা, ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে (প্রবন্ধ, ২০০৮); বুদ্ধিজীবী, তার দায় ও বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব (প্রবন্ধ, ২০১২), জলছাপে লেখা (কবিতা, ২০২১), রাইতের আগে একটা গান ( কবিতা, ২০২২); ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (প্রবন্ধ, ২০২২), এডওয়ার্ড সাইদের অরিয়েন্টালিজম (অনুবাদ, ২০০৫); কাভারিং ইসলাম (অনুবাদ, ২০০৬), ।