| 14 ডিসেম্বর 2024
Categories
গীতরঙ্গ

বাউল কি এবং বাউল কে?

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

আজকাল পল্লীগীতিকেই বাউল গান বলা হচ্ছে ! পরকাল বিষয়ক সব গানকেই মরমী গান বলা যায়। ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন বিষয়ে যে গান আছে, সেগুলি বিভিন্ন নামে পরিচিত। আল্লাহ পাকের প্রশংসা নিয়ে যে গান,সেগুলিকে বলা হয় হামদ, প্রিয় নবী (সাঃ) এর প্রশস্তিমুলক গান হচ্ছে নাত বা নাতে রাসুল(সাঃ), আরও রয়েছে মুর্শিদী, কাওয়ালী , জারী ইত্যাদি ধর্ম বিষয়ক গান। এগুলিকে পাইকারী হারে বাউল গান বলা যাবেনা।(কিন্তু আজকাল তাই বলা হচ্ছে।) কারন বাউল গান হচ্ছে আধ্যাত্মিক গানেরই একটি আলাদা শাখা। কিছুদিন আগে ইউটিউবে একটি চ্যানেলে দেখলাম হাছন রাজার গানকে নাম দিয়েছে– ভাওয়াইয়া গান হিসাবে। যোগাযোগ করে বিষয় টা বুঝিয়ে বললাম। অনেক তর্ক করলেন ভদ্রলোক। শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারলেন। কিন্তু তাঁর পুরো চ্যানেলই ভুল শিরোনামের গানে ভরা। কত আর সংশোধন করবেন ? তাছাড়া সেই জ্ঞান থাকলেই না সংশোধন করবেন। পরে গোটা চ্যানেলটাই বন্ধ করে দিয়েছেন।
বাংলাদেশের অবস্থা জানিনা, তবে এই বিলেতে বাংলা টিভি চ্যানেল গুলো কি করে এই মারত্মক ভুল করে জানিনা। তারাও লোকগীতির বা পল্লীগীতির অনুষ্ঠানকে বাউল গানের অনুষ্ঠান বলে প্রচার করছেন। যারা ভুল সংশোধন করার কথা, তারাই যদি ভুল প্রচার করেন,তবে তাদের দেখাদেখি আরও অনেকেই ভুল করবেন। তখন কিছু বললে তারা বলবেন, টিভিতে তো তাই বলেছে, ওরা কি ভুল বলেছে নাকি ?
আমার নিজেরও বাউল বিষয়ে যা সীমিত জ্ঞান তা একটু প্রসারিত করতে কিছু বই সংগ্রহ করলাম। বাউলদের বিখ্য্যাত এলাকা বলে পরিচিত পশ্চিম বঙ্গের বীরভূম। বিশ্বখ্যাত জয়দেব এর কেন্দুলি মেলা হয় যেখানে, আদি বাউল বলে পরিচিত বীরভদ্র জন্মেছেন যে অঞ্চলে সেই বীরভূম। সেখানকার ই এক লোক-গবেষক ইন্তাজ আলী। তাঁর কাছ থেকে এ বিষয়ে কি কি বই পড়া যেতে পারে এ ব্যাপারে পরামর্শ চাইলাম। তিনি বললেন, উভয় বাংলায়ই বেশ কিছু গবেষকের বই আছে। বাউলদের সাথে বিশ/ত্রিশ বছর চলাফেরা করে, এই গবেষক গন লিখেছেন বেশ কিছু বই । এই গুনী গবেষকদের মধ্যে উনি যাদের নাম বললেন, তারা হচ্ছেন-
অধ্যাপক মনসুর উদ্দীন, আনোয়ার উল করিম, ক্ষিতিমোহন সেন, শক্তিনাথ ঝা, সুধীর চক্রবর্তী এবং আরো অনেকে। বন্ধুত্বের আহবানে জনাব ইন্তাজ আলী বেশ কিছু বই পাঠিয়ে দিলেন।

ফেইস বুক এ অনেকের নামের সাথেই বাউল শব্দটা লেখতে দেখি। এদের প্রায় নিরান্নব্বই ভাগই বাউল কি তা না জেনেই, নিজের নামের সাথে বাউল লেখে থাকেন। তারা মনে করেন, যিনি পল্লীগীতি গেয়ে থাকেন তিনিই বাউল। এরা মূর্খ … বললে কম বলা হয়। পল্লীগীতি গায়কই যদি বাউল হয়ে থাকেন, তাহলে মরহুম আব্দুল আলীম কি বাউল আব্দুল আলীম ? মরহুম আব্বাস উদ্দীন আহমেদ কি বাউল আব্বাস উদ্দীন আহমেদ ??
সংক্ষেপে বাউল তাদেরকেই বলা যায়, যারা নির্দিষ্ট গুরুর নির্দেশে নিয়মিত যোগ সাধনা করেন, সন্তান জন্মদান থেকে বিরত থাকেন, স্ত্রী অথবা সাধন সঙ্গিনী গ্রহণ করেন এবং তার সাথে মিলে বিন্দু ধারন সহ বিভিন্ন সাধনা করেন যা ইসলাম ধর্মে নেই। সেই হিশাবে বাউল মুসলমান নন। এই বিচারে আমাদের যুগ শ্রেষ্ঠ পল্লী সঙ্গীত রচয়িতা শাহ আব্দুল করিম, কিংবা ক্বারি আমীর উদ্দীন আহমেদ, কামাল উদ্দীন আদৌ বাউল নন, এরা মুসলমান, তাদের ধর্ম হচ্ছে – ইসলাম। তবে তারা যেমন পল্লী গানের শ্রেষ্ঠ গীতিকার, সেই সাথে অল্প কিছু বাউল গানেরও লেখক হয়ে থাকতে পারেন।

 পীর হতে হলে যেমন অন্য একজন পীর থেকে বয়েত হতে হয়, তেমনি বাউল হতে হলেও একজন বাউল গুরুর কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে তবেই বাউল হতে হয়। আবার বাউল হবার পর তিনিও তাঁর শিষ্যকে আনুষ্টানিক বাউল দীক্ষা দিয়ে বাউল টাইটেল দেন। এ রকম না করে শুধু পল্লীর এবং মরমী গান লিখলে বা গাইলে এদের বাউল বলা যাবেনা। তারা নিজের গানে নিজেকে বাউলবললেই বাউল হওয়া যায়না। এ হলো এক পরম্পরার সাধনার বিষয়। গুরুর কাছ থেকে পেতে হয়, আবার শিষ্যের কাছে সমজিয়ে দিতে হয়। আজকে যাদের কে বাউল সম্রাট বলা হচ্ছে, এরা কারো কাছ থেকে বাউল পদবী পান নি, আর কারো কাছে সমজাতে ও দেখিনি। তাইএরা বাউল নন্। মরমী ও লোককবি এরা। অজ্ঞতা বশত: এরা বাউল বা বাউল সম্রাট বলে পরিচিতি পেয়ে আছেন।
বাউল হতে হলে গান গাইতেই হবে এমন কোন কথা নেই। গান না গেয়েও বাউল হওয়া সম্ভব। কারণ এটা গান গাওয়ার উপর নির্ভর করেনা। আগেই বলেছি, পল্লীগান গাইলেই যদি বাউল হওয়া যেতো তাহলে আব্বাস উদ্দীন, আব্দুল আলীম কেও সবাই বাউল বলতেন। বাউল ইসলাম বা হিন্দু ধর্মের বাইরে একটা বিশেষ ধর্ম । সেই বিশেষ পথ ও পদ্ধতি অনুসরন করে জীবনাচরন পরিচালনা যারা করেন, তারাই বাউল।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত