Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,বাঙালি সংস্কৃতি

বাঙালি সংস্কৃতি :উপাত্তের সন্ধানে । গাজী আলমগীর

Reading Time: 6 minutes
বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতির আত্মনির্মিতি বা আত্মপরিচিতির সংজ্ঞা রাষ্ট্রীয় ভৌগোলিক সীমারেখায় স্থিত নয়। বাঙালি দেশ বা অঞ্চলভিত্তিক একটি ভাষাজাতি। যে অঞ্চলের ভৌগোলিক সীমারেখা একাধিক রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত। এ একাধিক রাষ্ট্রীয় দোটানার বিবিধ সংমিশ্রণে বাঙালির বেড়ে ওঠা। বাঙালির ইতিহাস বাংলা ভাষার উৎপত্তি এবং তার সমাজ বিন্যাসের ইতিহাসই বাঙালির ইতিহাস। যে ইতিহাস বাঙালি ও বাংলা ভাষার বহুধা প্রতিবন্ধকতার চড়াই-উতরাই ও অসংখ্য সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল স্বাজাত্যবোধে মহিমান্বিত। যা দেশের সীমানা পেরিয়ে সমগ্র পৃথিবীব্যাপী সম্প্রসারিত এবং প্রচারিত। তবু এ যাবৎকাল বাংলা বা বাঙালির সাংস্কৃতিক বিকাশের ধারাবাহিক নির্মোহ কোনো ইতিহাস লেখা হয়নি। কেন লেখা হয়নি সে বিষয়টি বেশ জটিল। এ জটিলতার বিষয়টিতে অনেক সরলীকরণ অনেক সমীকরণ হয়েছে তথাপিও কোনো আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
 
 
যে যুগে বাঙালির অস্তিত্ব পাওয়া যায় সে সমসাময়িককালে গ্রিক দর্শনে বাঙালির দর্শনের প্রমাণ মেলে। কিন্তু পারস্য তুর্কি মুসলিমদের আগমনের আগে বাঙালিদের মননশীলতায় কোনো রকমের বহিরাগত দর্শনের প্রভাবের প্রমাণ পাওয়া যায় না। এবং ভারতে বহিরাগত জাতিগুলোর গ্রন্থে দর্শনের বিষয়টিও ছিল ভীষণ রকম অস্পষ্ট। তবুও তখনকার সমসাময়িক জাতিদের মধ্যে বাঙালিদের রচিত গ্রন্থগুলো অথবা অন্যান্য আদি ভারতীয়দের গ্রন্থগুলোয় বাঙালির মনন সংস্কৃতির প্রভাবের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যে ইঙ্গিত সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশের ইতিহাস। যে ইতিহাস কর্মবাদী একটি জনজাতির বিকাশের ইতিহাস। পৃথিবীর প্রাচীন যুগগুলোতে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীতে প্রায় সর্বত্র সামাজিক বিন্যাস ছিল বেশ জটিল এবং পদমর্যাদার বিভেদাত্মক বিবিধ ধাপ যা শ্রেণি বিভাজন। যে বিভাজনে ছিল শ্রেণিগুলোর অভ্যন্তরীণ স্তরভেদ। এরকম শ্রেণি জটিলতা বাঙালি সমাজে ছিল না। বাঙালি সমাজ সংগঠিত হয়েছিল কর্মবাদী শ্রেণি বিকাশে।
 
বাঙালি বলতে আমরা ভৌগোলিক বাঙালিত্বকে বুঝব না। ব্যাপক অর্থে অখন্ড বাঙালি সত্তাকে বুঝব। দীর্ঘদিন বাঙালিদের ধর্মের আলোকে অথবা ভূখন্ডের আওতায় কৃত্রিম বিভক্তির দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার চেষ্টা হয়েছে। আসলে বাঙালিকে বিচার করতে প্রয়োজন নিখাদ বাঙালিত্ব ও তার সংস্কৃতি। যা অঞ্চলভিত্তিক একটি জনজাতির বিস্তৃতির ইতিবৃত্ত।
 
 
বাঙালির কখনো অখন্ড ভূখন্ড ছিল না। পাল পূর্ব ও পরবর্তী যুগে শাসকরা কেউই বাঙালি ছিলেন না। তারা শোষণের কায়েমি স্বার্থান্বেষী পান্ডা। যাদের মাধ্যমে কোনো ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত বা বিকশিত হয়নি। তাদের ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াটিও ছিল পেশিশক্তির মাধ্যম। ফলে বাঙালির শাসনব্যবস্থায় কোনো প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়নি অথবা ধারাবাহিক কোনো সৃজনশীলতার চর্চাও হয়নি। যা কিছু হয়েছে তা শুধু আবহমান লোকজন বাঙালির মানসলোকের বোধ থেকে। যে বোধ শুধু গতিশীল সংস্কৃতি বিকাশের আত্মনিয়ন্ত্রণের পটভূমি। যে পটভূমিতে হাজার বছরের লালিত আকাঙ্ক্ষার বিকাশ সংগঠিত হয়েছে। তবুও বাঙালির ঐতিহ্যে বাঙালিত্ব সংগঠিত হয়েছে সামগ্রিক ঐক্যের ভিত্তিতে। সেই প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালিদের মেধা ও মননে একটি গণতান্ত্রিক সংগ্রামী ধারার আকাঙ্ক্ষা চলমান ছিল। যে চলমানতায় কখনো রাষ্ট্র্রক্ষমতার শাসক নির্ধারণ অথবা গণঅভু্যত্থানে গড়িয়েছে বাঙালির ইতিহাস।
 
 
বাংলা সাহিত্য শুরুর থেকে পূর্ণতা পেলেও আসলে তার উপাদান ছিল ধর্মভিত্তিক। দেব-দেবীদের লীলা ও স্রষ্টা কীর্তন আর তত্ত্ব উপদেশ। এসব ধর্মীয় উপকরণের বাইরে সাহিত্য সৃষ্টি হতে পারে তখনও এমন চিন্তা আসেনি তৎকালীন কবিদের মধ্যে। তবুও এসব অপার্থিব বিষয় ছাপিয়ে সে সময়কার সাহিত্যে যে চিত্রকল্প রচিত হয়েছিল তাতে মানবীয় জীবনাচরণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। এ স্পষ্টতার ভেতর থেকে মানুষ গেয়ে উঠল, ‘মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে আমি আর বাইতে পারলাম না।’ এ বাণী ধর্মীয় ক্লান্তিবোধের বাইরের সৃষ্টি। এ বাণী চিরায়ত মানুষের। সেই থেকে মূল এবং বিকল্পধারা সৃষ্টি। যে সৃষ্টির কোনো শেষ নেই। ছোটদের নয়, বড়দের নয়- শুধু আর্থ-সামাজিকতার ক্রমবিকাশ। যে বিকাশ পুরোপুরি বাঙালির।
 
বাঙালির দর্শন বাউল দর্শন। এ দর্শনে সাহিত্য রচিত হয় ষোড়শ শতাব্দীতে। অবশ্য সেই চর্যাপদ, বৈষ্ণব পদাবলি ও মঙ্গলকাব্যে বাউল দর্শনের উপাদান বিকশিত হয়েছিল আবহমান বাংলা ও বাঙালির মননে। যার পূর্ণ স্বরূপ অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি লালন সাঁইয়ের হাতে। যার উপস্থিতি অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকজুড়ে। তিনি এ মতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। তবে এ মতের উৎপত্তির ইতিবৃত্ত ও বিকাশ নিয়ে রয়েছে প্রচুর বিতর্ক। কেউ কেউ এ বিতর্ককে হিন্দু বা মুসলিমায়ন করতে চেয়েছে। অনেকে বলেছে বাজনা বাজানো গাইয়েরাই বাউল।
 
বাংলার বাউল দর্শনের উৎপত্তির যত বিতর্কই থাকুক না কেন এ দর্শনের উৎপত্তি লোকজ বাঙালির সংস্কৃতি থেকে। ড. আহমদ শরীফের ধারণা ‘বজ্রকুল’ থেকেই কালে ‘বাউল’ শব্দের উদ্ভব। বৌদ্ধ বজ্রসহজযানীদের থেকে এ মতের আবির্ভাব। পরপর্যায় বিবিধ মত ও দর্শনের অনুপ্রবেশের ফলে দৃঢ়মূল হয়েছে এ দর্শন বাঙালির মননশীল সৃজনীতে। বাঙালির এ বাউল দর্শনে মিশ্রণ ঘটেছে বৈষ্ণব, সুফি ও মরমিবাদের। প্রভাব পড়েছে ব্রাহ্মণ, জৈন, বৌদ্ধ এবং ইসলামের।
 
শ্রীকৃষ্ণ এবং চৈতন্যকেও বাউল বলা হতো। তা অবশ্য ‘বৈষ্ণব’ ব্যাপক অর্থে। এ বৈষ্ণব বাউল দর্শনের অজেয় কবি চন্ডীদাস ফরাসি বিপস্নবের প্রায় আড়াইশ বছর আগে গেয়েছিলেন মানবতাবাদের গান- ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’। তারপরও বাঙালির মননশীলতার বিকাশ ঘটেনি। যতটুকু ঘটেছিল পরবর্তী সময়ে তার থেকে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছিল। যে পিছিয়ে পড়াটা আবহমান বাংলা ও বাঙালির প্রগতিশীলধারাকে অবদমিত করে ফেলে। যে কারণে মূলধারার বিকাশ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়েছে। ফলে সৃষ্টি হয়েছে একাধিক ক্রান্তিকাল। যে ক্রান্তিকালকে অতিক্রম করতে হয়েছে আবহমান বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতিকে।
 
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ঘাঁটলে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়, বাংলা সাহিত্য বা বাঙালির মননধারাকে বিভিন্ন ধর্ম ও শাসকরা তার বিকাশ পথকে অবরুদ্ধ করতে চেয়েছে ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে। আসলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য কোনো কালে কোনো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি। যেটুকু পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে তার সবটুকু শাসকের স্বার্থ রক্ষার্থে। যা বিভ্রান্তিকর বিপর্যয়কর অপসংস্কৃতির বিচ্ছিন্নধারা। কারণ পরাধীন দেশে পৃষ্ঠপোষকতা তো দূরের কথা জাতীয় চেতনা এবং ঐতিহ্য বিকশিত হয় না। জাতীয় চেতনা ও ঐতিহ্য ঔপনিবেশিক বুর্জোয়া প্রভুদের স্বার্থবিরোধী। তবুও পৃষ্ঠপোষকতাহীন অনেক মহোত্তম কবিদের উৎকৃষ্ট সৃষ্টি আজকের এ আধুনিক বাংলা কবিতার স্বরূপ। যে স্বরূপ অন্তঃপ্রেরণার তাগিদে সৃষ্টি।
 
লালন উত্তর যুগে মাইকেল মধুসূধন দত্ত প্রায় ৬০০ বছরের প্রচলিত কাব্যধারায় বিপস্নবী আঙ্গিকের আধুনিকায়ন ঘটায়। যা গতিশীল এবং বিকাশমান। যার শ্রেষ্ঠ বিকাশ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সমকাল পরপর্যায় নজরুল আর জীবনানন্দের মতো কবিও ছিলেন। প্রাসঙ্গিকক্রমে বলতে হয় বাঙালি কোনো নৃতাত্ত্বিক জাতি নয়- ভাষাভিত্তিক জাতি। নৃবিজ্ঞানের মতে বাঙালি একটি শঙ্কর জাতি। যার মধ্যে রয়েছে দ্রাবিড়, মঙ্গলীয়, ককেশিয়ান এবং নেগ্রিট। এসব কারণে বাংলায় নৃতাত্ত্বিক বিবর্তনীয় ধারায় কোনো একক নৃতত্ত্ব বিকশিত হয়নি। বিষয়টি নিয়ে এখনো কোনো নির্মোহ গবেষণাও হয়নি। তেমনি নির্মিত হয়নি কোনো অখন্ড কেন্দ্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপায়ণে। যার মাধ্যমে সব বিতর্কিত বিষয়গুলোর মীমাংসা হতে পারে। ফলে জাতীয় ঐক্যের পরিবর্তে ব্যবধান বেড়েই চলেছে। এ ব্যবধান এতটা এগিয়েছে, স্বাধীনতার মতো বিষয়টি নিয়েও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। যে বিতর্ক হাজার বছরের ধারাবাহিক ঐতিহ্যপূর্ণ।
 
আর্যপূর্ব ভারতবর্ষে বর্ণপ্রথা কর্মভিত্তিক সামাজিক বিবর্তনের মাধ্যমে অবিন্যস্তভাবে গড়ে উঠেছিল। তবে আর্যদের মতো এ বর্ণ-বিন্যাস মানুষকে ঘৃণার পর্যায়ে উন্নীত করেনি কখনো। যা ছিল সম্পূর্ণ কর্মভিত্তিক। দ্রাবিড় বাঙালির খাওয়া-দাওয়া আচার-আচরণ বিবাহে বাধানিষেধ ছিল বটে কিন্তু চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রে আর্যদের মতো বিধি-নিষেধ ছিল না। কর্তাদের মতো জন্মান্তরবাদের ধারণাও ছিল না ভারতীয় অনার্য দ্রাবিড় সমাজে। এ অনার্য অস্ট্রো-এশিয়ান দ্রাবিড়রা গাঙেয় ব-দ্বীপ অঞ্চলে শক্তিশালী কর্মবাদী আর্থ-সামাজিকতার এক স্বনির্ভর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলেছিল।
 
বাঙালির কর্মবাদী সমাজে ৪১টি পেশাভিত্তিক বর্ণ বিন্যাসের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। যে বর্ণ বিন্যাসের কিছু উপাদান আর্য সমাজ থেকে বাঙালি সমাজে এসেছিল। এ বিন্যাসগুলো আজকে পৃথকীকরণ খুবই দুঃসাধ্য। সম্ভবত সেন আমলে এগুলো প্রবেশ করে থাকতে পারে। পাল আমলে এ ধরনের আত্মঘাতী বর্ণবিন্যাস ছিল না। এ বিভেদাত্মক বর্ণ বৈষম্যের ফলে সেন রাজত্ব বাঙালিদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। গ্রহণযোগ্য হয়নি সনাতন ধর্মের আবেদন। আর্য সনাতন ধর্মের শ্রেণি বিন্যাস ভারতীয় জনজাতির সমাজ ও সভ্যতার বিকাশকে বিভ্রান্ত করেছিল। তাদের সমাজ ও সভ্যতার বিকাশের যে আঙ্গিক বাংলার সমাজ ও সভ্যতার আঙ্গিকের ধরন সেরকম নয়। তারা তাদের আর্থ-সামাজিকতা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল বাঙালিদের ওপর। কারণ তারা তাদের ধর্ম ও দর্শনকে রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল লোকজ বাঙালিদের উচ্ছেদপূর্বক জাতপাত ও শ্রেণি বৈষম্যের সনাতনী আর্যধর্মীয় সমাজব্যবস্থা। উৎপাদন সম্পর্কহীন এক দল পরজীবী ব্রাহ্মণ্য সমাজ। যা সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল।
 
বাঙালির পেশাভিত্তিক বর্ণ বিন্যাসগুলো ছিল এরকম যেমন; নাপিত, ধাই, সূত্রধর, ধোপা, শূদ্র (চাষি) সুতার, কামার, কুমার, তাঁতি, জেলে, গোয়ালা, মুচি ও চন্ডাল। আর আর্যরা তাদের চতুর্বর্ণ দ্বারা সারা ভারতবর্ষকে বাঁধতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রথমে বাধাপ্রাপ্ত হয় বাঙালির পেশাভিত্তিক বর্ণের কাছে। বাঙালির এ কর্মজাতের অস্তিত্ব উপমহাদেশের কোথাও ছিল না। আর্যরা সমগ্র ভারতীয় আর্থ-সামাজিকতাকে চারভাগে বিভক্ত করেছিল এ কথা অনস্বীকার্য। যেমন- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। শুধু যে আর্যদের মধ্যে শ্রেণি বৈষম্য ছিল তা নয়- তৎকালীন পৃথিবীর সব জনজাতির সভ্যতাগুলোয় শ্রেণি বিভাজনের এ বিষবাষ্প চলমান ছিল। চলমান ছিল জাতি পুনর্গঠনের ধাপে। আর এ বৈষম্যমূলক শ্রেণি সমাজের উদ্ভব আর্যদের আদিনিবাস ইউরোপে।
 
ইউরোপে দর্শন বিকাশের ইতিহাস ধর্মীয় প্রভাব বহির্ভূত ব্যক্তিকেন্দ্রীয় ধারাবাহিকতার ইতিহাস। এ ক্ষেত্রে ইউরোপীয় দর্শনের ইতিহাস লেখা যতটা সহজ বাংলারটা তেমন নয়। তেমনি রাষ্ট্র ও বিজ্ঞানের ইতিহাস লেখা যতটা সহজ শিল্প সংস্কৃতির ইতিহাস ততটা কঠিন। রাজ্য, রাজবংশ, যুদ্ধবিজয় এবং শাসনব্যবস্থার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও ব্যাখ্যা যেমন সুবিধা শিল্প সংস্কৃতি বা দর্শনের ক্ষেত্রে সেরকম নয়। মৌল বিষয়গুলো অভিন্ন থাকলেও পৃথিবীর অন্যসব অঞ্চলে সমাজ ও সভ্যতার বিকাশ যেভাবে বিকশিত হয়েছে বাংলার সমাজ ও সভ্যতার বিকাশ সেরকম নয়। কারণ ধর্মীয় আগ্রাসন যেভাবে বাঙালির সংস্কৃতির স্বরূপকে বিকৃত এবং বিভ্রান্ত করেছে সেজন্য এখন তার মৌল স্বরূপকে উদঘাটন ব্যাপক অনুশীলন ও গবেষণার বিষয়। ফলে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ব্যাপক অনুশীলনের মাধ্যমে একটি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন তত্ত্ব নির্মাণ আবশ্যক। এ ক্ষেত্রে সম্পন্ন দার্শনিকের ভূমিকা অপরিসীম।
 
বাংলা ভাষা ভারতীয় প্রাচীন ভাষাগুলোর মধ্যে একটি অন্যতম ভাষা। একক জনজাতি হিসেবে বাংলা ভাষা পৃথিবীর বৃহত্তম জনজাতির জাতীয় ব্যবহারিক ভাষা। বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত সংগ্রহে এক সময় অধিকাংশ পন্ডিত বেদ ও উপনিষদের ওপর নির্ভর করতেন। এ ধারণা অবশ্য এখন আর নেই। ভাষা এবং সাহিত্যের বিবর্তনিক ইতিহাসের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির চর্চা বিকশিত হচ্ছে। ফলে বেরিয়ে এসেছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সঠিক ইতিবৃত্ত।
 
বাঙালি জনজাতির কর্মবাদী সংস্কৃতির সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে বহিরাগত ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ এবং সুদীর্ঘকালের পরাধীনতার কারণে এ বিকাশের পথ বারবার বিঘ্নিত হয়েছে। বিভ্রান্ত হয়েছে বাংলার সংস্কৃতির ধারাবাহিক বিকাশের ঐতিহ্য। যা হয়েছে তা মিশ্র বা শঙ্করাশ্রয়ী সংস্কৃতি। বিষয়টি এরকম শাসক এবং জনজাতির সংস্কৃতিতে সৃষ্টি হয়েছে ভিন্নতা। অর্থাৎ পাল ও সুলতানী আমলে যে দর্শনের সূত্রপাত হয়েছিল তা আর বিকশিত হয়নি। পরপর্যায় মোঘল এবং ইংরেজ শাসনকালে ‘অফলা’ ‘বিভক্তি’ শব্দ দুটোর রাজকীয় বিকাশ ঘটেছে পুরো এ দুটো আমলজুড়ে।
 
দ্বিজাতিতত্ত্বের গোলক ধাঁধায় বাঙালির নৈতিক অধঃপতনের অপঘাতে পতিত হয়েছে জাতীয় ঐক্যসহ ভূখন্ড। যার চূড়ান্ত রূপ বাঙালি জনজাতির বিভক্তি। তবুও বাঙালি পরাধীনতা ও ষড়যন্ত্রের শৃঙ্খল ভেঙে জাতীয়তাবাদী চেতনাসহ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দীর্ঘ সংগ্রামের পথ অতিক্রমে ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতা। যে স্বাধীনতা ভারতীয় উপমহাদেশের একমাত্র অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনার স্রষ্টা।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>