রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) গোরা (১৯১০) উপন্যাসের নায়ক নিজেকে সগর্বে হিন্দু বলে প্রচার করে বেড়িয়েছিল যতক্ষণ না সে জানতে পারে যে আসলে সে আইরিশ পিতা-মাতার সন্তান- ভারতের সকল মন্দিরের দ্বার তার কাছে রুদ্ধ। প্রচণ্ড হতাশার মধ্যেও খানিকটা স্বস্তি লাভ করে গোরা তখন ঘোষণা করে : ‘আমি যা দিনরাত্রি হতে চাচ্ছিলুম অথচ হতে পারছিলুম না, আজ আমি তাই হয়েছি। আমি আজ ভারতবর্ষীয়। আমার মধ্যে হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান কোনো সমাজের কোনো বিরোধ নেই। আজ এই ভারতবর্ষের সকলের জাতই আমার জাত, সকলের অন্নই আমার অন্ন।’ উপন্যাসে যদিও কথাটা সেভাবে বলা নেই, গোরা আরেকটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারত, সে এখন প্রকৃতপক্ষে যা হয়েছে, তা ভারতবর্ষীয় নয় বা কেবল ভারতবর্ষীয়ই নয়, বরং জাতধর্ম- দেশকালের সীমানা পেরোনো মানুষ- বিশ্ববাসী।
গোরার গল্পে কিন্তু ব্যক্তির একাধিক আত্মপরিচয়ের ইঙ্গিতটা আছে। একজন মানুষ একইসঙ্গে অনেক কিছু, তাই তাকে নানাভাবে চিহ্নিত করা যায়- তার ভাষা দিয়ে, লিঙ্গ দিয়ে, গায়ের রং দিয়ে, ধর্ম দিয়ে, শ্রেণি দিয়ে, পেশা দিয়ে, বৈবাহিক মর্যাদা দিয়ে, এমনকি খাদ্যাভ্যাস দিয়ে (যেমন, নিরামিষাশী)। একজনের একটি ব্যক্তিগত পরিচয় থাকতে পারে, আবার সংস্থাগত, দলগত, জাতিগত কিংবা ভৌগোলিক পরিচয় (যেমন, এশীয়) থাকতে পারে। এসব পরিচিতির কিছু কিছু পরিবর্তনীয় আবার কিছু কিছু অপরিবর্তনীয়। সাধারণত এক ধরনের পরিচিতি অন্য ধরনের পরিচিতির সঙ্গে বিনিময়যোগ্য নয়- যেমন, ভাষার সঙ্গে ধর্মবিশ্বাস তুলনীয় নয়। তাই কেউ হিন্দু কি বৌদ্ধ কিংবা মারাঠি কি গুজরাটি, তা জানতে চাওয়া যায়, কিন্তু তিনি বাঙালি না মুসলমান, এ প্রশ্ন অচল। তবে অনেক সময়ে বেশ কয়েক ধরনের পরিচিতিকে একসঙ্গে গাঁথা চলে। যেমন, কাউকে কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন মহিলা আইনজীবী বলে যদি আমরা পরিচয় করিয়ে দিই, তবে একইসঙ্গে তাঁর গাত্রবর্ণ, জাতীয়তা, লিঙ্গ ও পেশা- এই চার ধরনের পরিচিতিকে কোনো অসঙ্গতি ছাড়াই একসূত্রে বাঁধা চলে। আবার কখনও কখনও এক ধরনের পরিচিতিকে তার অন্তর্গত নানাভাগে ভাগ করা যায়। যেমন, ধর্মবিশ্বাসগতভাবে একজন হিন্দুকে শৈব, শাক্ত ও বৈষ্ণব বলে তার সম্প্রদায়গত পরিচয়ে, ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ প্রভৃতি বলে বর্ণগত পরিচয়ে, বারেন্দ্রী, বঙ্গজ, রাঢ়ী বলে অঞ্চলগত পরিচয়ে এবং তারও পরে পেশাগত ইত্যাদি পরিচয়ে চিহ্নিত করা রীতিসিদ্ধ ছিল। বঙ্গদেশের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি কোনো কোনো পেশাগত গোষ্ঠীকে ধর্মীয় পরিচয়ে ভাগ করা হতো। যেমন, তন্তুবায়দের মধ্যে যাঁরা মুসলমান, তাঁরা জোলা বলে এবং যাঁরা হিন্দু, তাঁরা তাঁতি বলে পরিচিত হয়ে এসেছেন। তেমনি মৎস্যজীবীদের মধ্যে কাবাড়ি ও নিকারি বা নিকিরি বলতে মুসলমান এবং কৈবর্ত, জেলে ও মেছুয়া বলতে হিন্দু বুঝিয়েছে। বিপরীতপক্ষে, ভিন্ন ধর্মের মানুষকে আমরা একই পেশা গ্রহণ করে একই উপাধি ব্যবহার করতে দেখি এবং শেষ পর্যন্ত তা তাদের পদবি বা অন্ত্যনামে পরিণত হয়। যেমন, খান বা খাঁ, চৌধুরী, তালুকদার, মজুমদার, মল্লিক, শিকদার, সরকার, হাজারি।
আগের কথায় ফিরে আসি। মানুষের অনেকরকম পরিচয় রয়েছে। অবস্থাভেদে কিংবা প্রসঙ্গানুযায়ী কেউ তার কোনো একটি পরিচিতির উল্লেখ করে কিংবা একটি পরিচিতির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে। তার অর্থ এই নয় যে, সেটিই তার একমাত্র পরিচিতি কিংবা সেটিই তার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পরিচিতি। যখন অনেকে একই পরিচয়ে পরিচিত হতে চায়, তখন তা তাদের সমষ্টিগত পরিচয়ে পরিণত হয়। সেই সমষ্টিগত পরিচয়ের মধ্যে কিন্তু বহুত্বের একটা স্বাভাবিক সুযোগ নিহিত থাকে। বহুধাবিভক্ত পরিচয়গুলো যেহেতু বৃহত্তর পরিচয়ের অন্তর্ভুক্ত থাকে, সমষ্টিগত সেই বৃহত্তর পরিচয়টিই তখন বৃহৎ তাৎপর্যে মণ্ডিত হয়। আমার কাছে বাঙালি পরিচিতিকে তেমন ধরনের আত্মপরিচয় বলে মনে হয়।
দুই.
বাঙালির আত্মপরিচয়ের নিশানাগুলো কী, তা এখন খোঁজ করা যায়। আর তা করতে হলে, তার বসতি- পুরনো কালের ভাষায়, বিষয় এবং আমাদের কালের ভাষায়, দেশ- ও ভাষার তল্লাশ করতে হবে।
বঙ্গভূমিকা গ্রন্থের সূচনায় সুকুমার সেন প্রায় সিদ্ধান্তের মতো করে বলেছেন, ‘ভাষা নিয়ে জাতি, জাতি নিয়ে দেশ। বাংলা ভাষার উৎপত্তির সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি জাতির ইতিহাস শুরু।’ তিনি জানিয়েছেন, ‘কোন জাতির অধ্যুষিত দেশ (‘বিষয়’) সেকালে সেই জাতি নামে পরিচিত হতো। এই সূত্রে সেকালের অনেক দেশনাম একাল পর্যন্ত চলে এসেছে। পূর্ব ভারতের জাতিদেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আগে উল্লেখিত দেখা যায় ‘বঙ্গ’।’ পরে এ প্রসঙ্গে তিনি আরও একটু যোগ করেছেন :
…বলেছি যে আমাদের পুরনো দেশনামগুলি জাতিনাম থেকে এসেছিল। সেখানে বলা হয়নি যে প্রাচীন গ্রন্থসমূহে উল্লিখিত একটি ছাড়া সব জাতিদেশ নামগুলো অনেককাল আগেই লুপ্ত হয়েছে। লুপ্ত হয়নি শুধু ‘বঙ্গ’ নামটি। সে নাম এখনও রয়েছে। যখন সমগ্র ভারতবর্ষের এমনকি আর্যাবর্তেরও নামকরণ হয়নি তখনও ‘বঙ্গ’ এই জাতিনামটি চলিত ছিল।
প্রতœলিপিতে বঙ্গের উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দী থেকে আর বঙ্গালের উল্লেখ পাওয়া যায় অন্তত একাদশ শতাব্দী থেকে। দুটোই ভৌগোলিক এককের নাম, তবে তা থেকে তার পরিবর্তমান সীমা-সরহদ সব সময়ে স্পষ্ট বোঝা যায় না। বঙ্গের উল্লেখ ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, বোধায়ন ধর্মশাস্ত্র, রামায়ণ-মহাভারত-এ, কালিদাসের রঘুবংশ এবং পতঞ্জলির মহাভাষ্যতে আছে বলেও আমরা জানতে পাই।
দেশবাচক বাংলা শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে পণ্ডিতদের অনেক মত আছে। সুকুমার সেন বলেন, বঙ্গ শব্দের এক অর্থ কার্পাস-তুলো- বঙ্গজাতি এককালে কার্পাস-চাষের ও বস্ত্রশিল্পের জন্যে বিখ্যাত ছিল। ‘বঙ্গাল’ মানে প্রচুর বঙ্গ অর্থাৎ তুলা-উৎপাদনকারী ভূমি। এই নাম থেকে পরে ‘বাঙ্গালা’ ও ‘বাঙ্গালী’ শব্দ এসেছে। একাদশ শতকের মধ্যভাগে আলবেরুনি ‘বঙ্গাল’-প্রণীত শকুন-বিদ্যাবিষয়ক একটি গ্রন্থের উল্লেখ করেছেন। দ্বাদশ শতাব্দীতে ‘বঙ্গাল’ নামে অথবা ছদ্মনামে এক কবি প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। শ্রীধরের সদুক্তিকর্ণামৃতে এঁর দুটি সংস্কৃত শ্লোক সংকলিত হয়। তার একটিতে বাংলা ভাষার প্রতি তিনি গভীর অনুরাগের পরিচয় দিয়েছেন : গঙ্গা ও বঙ্গাল-বাণী, (দুটিই) প্রগাঢ় রসময়, গভীর, সুন্দর গতিভঙ্গিময় এবং কবিদের উপজীব্য। (দুটিতেই) অবগাহন করলে পুণ্য হয়।
বাংলার প্রাচীনতম কবিতার সংকলন চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়-এ বঙ্গ, বঙ্গাল ও বঙ্গালীর উল্লেখের মধ্যে অনেকে জনপদের সঙ্গে জনপদবাসীর নামও খুঁজে পেয়েছেন। তবে বঙ্গাল শব্দের পাঠ নিয়ে মতান্তর আছে, তা ছাড়া পণ্ডিতেরা কেউ কেউ বলছেন যে, বঙ্গালী বলতে এখানে সহজিয়া বৌদ্ধ সাধনার তিনটি পন্থা- অবধূতী (দ্বৈতবাদ), চণ্ডালী (দ্বৈত ও অদ্বৈতবাদের মিশ্রণ) ও ডোম্বী বা বঙ্গালী (অদ্বৈতবাদ)-তার একটি বোঝানো হয়েছে।১০ অবশ্য এ-কথা নিশ্চিত যে, সংস্কৃত অভিধান অমরকোষ-এর যে-টীকা বন্দ্যঘটীয় সর্বানন্দ দ্বাদশ শতাব্দীতে রচনা করেছিলেন টীকাসর্ব্বস্ব নামে, তাতে শুঁটকিপ্রিয় অশিষ্ট বঙ্গবাসী অর্থে ‘বঙ্গালবচ্চার’ প্রয়োগ গৃহীত হয়েছে। সর্বানন্দ ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের লোক, অভিধানের টীকা রচনার সুযোগে তিনি কি পূর্ববঙ্গীয়দের একহাত নিলেন? নাকি ওতে বঙ্গাল দেশের নিম্নশ্রেণির লোকদের খাদ্যাভ্যাসের কথা বলা হয়েছে?
চর্যাপদের বাঙালি যে সাধন পদ্ধতির নাম, এ কথা যাঁরা বলেন, তাঁদের মধ্যে পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তাঁর মতে, ওই সাধনপদ্ধতি থেকেই বাঙালি নামের উৎপত্তি। এ কথা মেনে নেয়া যায় না। তিনি আরও বলেছেন, বাংলার অধিবাসী অর্থে বাঙালি শব্দের প্রয়োগ মুঘল আমলের পূর্বে পাওয়া যায় না। এ কথাও যথার্থ নয়। চতুর্দশ শতাব্দীর বাংলার সুলতান শামসউদ্দীন ইলিয়াস শাহকে তাঁর সমসাময়িক ইতিহাসবিদেরা শাহ্-ই-বাঙ্গালাহ, সুলতান-ই-বাঙ্গালাহ ও শাহ্-ই-বাঙ্গালিয়া বলে উল্লেখ করেছেন। পঞ্চদশ শতাব্দীতে বাংলার সর্বাধিক খ্যাতনামা আলেম ছিলেন নূর কুতুব আলম-সাধারণ্যে তিনি পরিচিত ছিলেন শেখ নূর বাঙালি বলে। অথচ তাঁর পিতা, বিখ্যাত পীর সৈয়দ আলাউল হক, আরব থেকে এসে বাংলায় বসতি স্থাপন করেন।
পরবর্তীকালে আমরা আরও দুজনের কথা জানি, যাঁরা নামের শেষে বাঙালি শব্দটি যোগ করেছিলেন। এঁদের একজন লালা বাঙালি- তিনি অষ্টাদশ শতাব্দীতে মুঘল সম্রাট মাহমুদ শাহের দরবারের সংগীতজ্ঞ ছিলেন। আরেকজন ছিলেন ফেনীর সন্তান ইনামউদ্দীন বাঙালি- সৈয়দ আহমদ বেরিলভির খলিফা, ১৮৫৭ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। এঁরা অবশ্য অনেক পরের লোক-আমরা বলছিলাম চৌদ্দ-পনেরো শতকের কথা। যদিও সাক্ষ্যপ্রমাণ খুব সামান্য, শামসউদ্দীন ইলিয়াস শাহ্র উপাধি এবং নূর কুতুব আলমের পদবি থেকে মনে হয় যে, তাঁদের এই পরিচিতির ভিত্তি ছিল ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক এলাকা, অন্য কিছু নয়। সেই এলাকা নানাভাবে বিভক্ত হচ্ছিল, তার সীমানাও ছিল পরিবর্তমান, তবু বঙ্গ থেকে বাংলা এবং তার অধিবাসী হিসেবে বাঙালির একটা পরিচয় গড়ে উঠছিল।
ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে বাংলা সাহিত্যকর্মে বাংলার অধিবাসী ও বাংলাভাষী এই উভয় অর্থে বাঙালি শব্দের ব্যবহার দেখতে পাই। এ সময় থেকে বাংলা ভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখার প্রয়াস দেখা যায় কবিদের মধ্যে। তার কারণ আছে। হিন্দু-মুসলমান উভয় স¤প্রদায়ের ভেতরে এরই মধ্যে ধর্ম ও ভাষার পারস্পরিক সম্পর্ক-নির্ধারণের একটা পালা গড়ে উঠেছিল বলে মনে হয়। সংস্কৃত কিংবা আরবি ও ফারসিকে দেখা হয়েছিল পবিত্র ভাষারূপে, আর প্রাকৃতজনের ভাষাকে গণ্য করা হয়েছিল হীন বলে। রামায়ণ-এর প্রথম বাংলা অনুবাদক, পঞ্চদশ শতাব্দীর কবি কৃত্তিবাস এবং মহাভারত-এর শ্রেষ্ঠ বঙ্গানুবাদক, সপ্তদশ শতাব্দীর কবি কাশীরাম দাসকে ‘সর্বনেশে’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল তাঁদের অনুবাদকর্মের জন্য। য়ুসুফ-জলিখা কাব্যের রচয়িতা শাহ মুহম্মদ সগীর লিখেছেন, কিতাবের কথা লিখলে লোকে দোষ ধরবে, এই ভয়ে অনেকে এই কাজ থেকে নিবৃত্ত থাকে। ভেবে দেখলাম, এ ভয় মিথ্যা; কথার সত্যমিথ্যা আছে- ভাষার নেই। মহাজনেরা বলেন, রতন-ভাণ্ডারের মধ্যে বচন এক ধন। সেই বচন-রতন-মণি যতœ করে ভরে প্রেমরসে ধর্মবাণী শোনাব। নীতিশাস্ত্রবার্ত্তা অনুবাদ করতে গিয়ে মুজাম্মিল বলেন, লোকে আরবি ভাষা বোঝে না, সবাই যাতে বুঝতে পারে, তাই পয়ার রচনা করলাম। যে যা বলে, বলুক, আমি লিখে ফেললাম। ভালোমন্দ খণ্ডনের উপায় নেই। আরেক কবি, হাজী মুহম্মদ, পাঠকের কাছে মিনতি করেছেন, ‘হিন্দুয়ানী অক্ষর দেখি না করিও হেলা।…দেশীভাষা দেখি মনে না করিও ঘীন।’ নবীবংশ-প্রণেতা সৈয়দ সুলতানের বক্তব্য :
মুনাফিকে বোলে আক্ষি কিতাবেতু কাড়ি
কিতাবের কথা দিলুঁ হিন্দুয়ানি করি।
আল্লাএ বুলিছে, ‘মুঞি যে দেশে যে ভাষ
সে দেশে সে ভাষে কৈলুঁ রসুল প্রকাশ।’…
কর্মদোষে বঙ্গেত বঙ্গালি উতপন
না বঝে বঙ্গালি সবে আরবি বচন।…
এত ভাবি নবীবশ পাঁচালী রচিলুঁ
বুঝে হেন মত করি যে কিছু কহিলুঁ।…
আলিমে কিতাব পড়ি বাখানে যে কালে
হিন্দুয়ানি করি যদি না বাখানি বোলে।
বঙ্গদেশি সকলরে কিরূপে বুঝাইব
বাখানী আরবি ভাষে বুঝাইতে নারিব।
যারে যেই ভাষে প্রভু করিছে সৃজন
সেই ভাষ তাহার অমূল্য সেই ধন।
কিফায়েতুল-মুসল্লিন-এর কবি শেখ মোতালেবের মনে কিন্তু ভয় ছিল :
আরবিতে সকলে ন বুঝে ভালো মন্দ।
তেকারণে দেশি ভাষে রচিলু প্রবন্ধ।।
মুছলমানি শাস্ত্র কথা বাঙ্গালা করিলু।
বহু পাপ হৈল মোর নিশ্চয় জানিলু।।
কিন্তু মাত্র ভরসা আছয়ে মনান্তরে।
বুঝিয়া মুমিন দোয়া করিব আমারে।।
মুমিনের আশীর্বাদে পুণ্য হইবেক।
অবশ্য গফুর আল্লা পাপ থেমিবেক।।
ফারসি থেকে আমির হামজা অনুবাদ করেছিলেন আবদুল নবি, কেননা বঙ্গের লোকে ফারসি জানে না :
মুছলমানী কথা দেখি মনেহ ডরাই।
রচিলে বাঙ্গালা ভাষা কোপে কি গোঁসাই।।
লোক উপকার হেতু ত্যজি সেই ভয়।
দৃঢ়ভাবে রচিবারে ইচ্ছিলুম হৃদয়।।২৪
তবে এ বষয়ে ভয় ছিল না আবদুল হাকিমের। তিনি উল্টো বাংলা ভাষাবিদ্বেষীদের সম্পর্কে দুর্বাক্য প্রয়োগ করেছেন :
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সেসব কাহার জন্ম নির্ণএ ন জানি।।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়াএ।
নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন যাএ।।
যেসব কবির কথা উপরে বললাম, সাহিত্যের ইতিহাসকারেরা তাঁদের নানাভাবে স্থাপন করেছেন পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যে। বোঝা যাচ্ছে, সে ময়ে দেশে একদল বাংলাবিদ্বেষী ছিলেন আর অপরদল- সম্ভবত তাঁরাই ছিলেন প্রবল ও মুখর- বাংলা ভাষার সঙ্গে নিজেদের জড়িয়েছিলেন অচ্ছেদ্যবন্ধনে। যদি বলি, অভিজাতেরা ছিলেন বাংলাবিরোধী, তাহলে তো বলতে হবে, সেই অভিজাত শ্রেণির মধ্যে থেকেই এই বিরোধিতার বিরোধিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। নিঃসন্দেহে যা বলা যায়, তা এই যে, বাঙালির আত্মপরিচয়ের আরেকটি সূত্র নির্মিত হয়েছিল তার ভাষাকে ঘিরে।
তিন.
ভাষা, সংস্কৃতি ও দেশের সঙ্গে নিজেকে সচেতনভাবে যুক্ত করার প্রয়াস জোরালোভাবে দেখা দিল উনিশ শতক থেকে। এ প্রক্রিয়া চলে এসেছে ধারাবাহিকভাবে। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের (১৮১২-৫৯) স্বদেশপ্রেম ও নিজভাষাপ্রীতি এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তের (১৮২৪-৭৩) বঙ্গভাষাস্তুতির কথা আমাদের সবার জানা আছে। তবে বাঙালি জীবনের নানা দিক নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ আমরা প্রথম পাই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৩৮-৯৪) হাতে। উনিশ শতকের নব্যবাবু সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্রের শ্লেষোক্তির কথা আপাতত উহ্য থাক। গভীরতর ভাব নিয়ে কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র বাঙালির ঐক্য ও বহুত্ব উপলব্ধির প্রয়াস পেয়েছিলেন।
বাঙালির নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ এবং ইংরেজের সঙ্গে তাদের তুলনা করে বঙ্কিমচন্দ্র এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে,
ইংরেজ এক জাতি, বাঙ্গালীরা বহুজাতি। বাস্তবিক এক্ষণে যাহাদিগকে আমরা বাঙ্গালী বলি, তাহাদিগের মধ্যে আমরা চারিপ্রকার বাঙ্গালী পাই। এক আর্য্য, দ্বিতীয় অনার্য্য হিন্দু, তৃতীয় আর্য্যানার্য্য হিন্দু, আর তিনের বার এক চতুর্থ জাতি বাঙ্গালী মুসলমান। চারিভাগ পরস্পর হইতে পৃথক থাকে। বাঙ্গালী সমাজের নিম্নস্তরেই বাঙ্গালী অনার্য্য বা মিশ্রিত আর্য্য ও বাঙ্গালী মুসলমান; উপরের স্তরে প্রায় কেবলই আর্য্য। এই জন্যে দূর হইতে দেখিতে বাঙ্গালী জাতি অমিশ্রিত আর্য্যজাতি বলিয়াই বোধহয় এবং বাঙ্গালার ইতিহাস এক আর্য্যবংশীয় জাতির ইতিহাস বলিয়া লিখিত হয়।
এ গেল নৃতত্ত্বের কথা। বাংলার ইতিহাস প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র বলছেন :
পরাধীন রাজ্যের যে দুর্দ্দশা ঘটে, স্বাধীন পাঠানদিগের রাজ্যে বাঙ্গালার সে দুর্দ্দশা ঘটে নাই।…পাঠানশাসনকালে বাঙ্গালীর মানসিক দীত্ত অধিকতর উজ্জ্বল হইয়াছিল।…এই দুই শতাব্দীতে বাঙ্গালীর মানসিক জ্যোতিতে বাঙ্গালার যেরূপ মুখোজ্জ্বল হইয়াছিল, সেরূপ তৎপূর্ব্বে বা তৎপরে আর কখনও হয় নাই।
…মোগল পাঠানের মধ্যে আমরা মোগলের অধিক সম্পদ দেখিয়া মুগ্ধ হইয়া মোগলের জয় গাইয়া থাকি, কিন্তু মোগলই আমাদের শত্রু, পাঠান আমাদের মিত্র। মোগলের অধিকারের পর হইতে ইংরেজের শাসন পর্যন্ত একখানি ভাল গ্রন্থ বঙ্গদেশে জন্মে নাই। যেদিন হইতে দিল্লীর মোগলের সাম্রাজ্যে যুক্ত হইয়া বাঙ্গালা দুরবস্থা প্রাপ্ত হইল, সেইদিন হইতে বাঙ্গালার ধন আর বাঙ্গালায় রহিল না, দিল্লীর বা আগ্রার ব্যয়নির্ব্ব হার্থ প্রেরিত হইতে লাগিল।
…বাঙ্গালার হিন্দুর অনেক কীর্ত্তির চিহ্ন আছে, পাঠানের অনেক কীর্ত্তির চিহ্ন পাওয়া যায়, শত বৎসর মাত্রে ইংরেজ অনেক কীর্ত্তি সংস্থাপন করিয়াছে, কিন্তু বাঙ্গালায় মোগলের কোনো কীর্ত্তি কেহ দেখিয়াছে?
এইখানে বঙ্কিমচন্দ্রের যে কণ্ঠস্বর আমরা শুনতে পাই, তা বাঙালি জাতীয়তাবাদীর কণ্ঠস্বর। বঙ্কিমচন্দ্র সকল সময়ে এই ভাবের পোষকতা করেননি, এও সত্য। তবে তাঁর যে দুটি উদ্ধৃতি এখানে ব্যবহার করেছি, তার ভিত্তিতে রয়েছে বাংলার ভাষা, অঞ্চল ও মানুষ।
রবীন্দ্রনাথ কিন্তু একান্তভাবে জোর দিয়েছিলেন ভাষার উপরে। বাঙালি সত্তার পরম প্রকাশ ঘটেছিল ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পর, তার বিরুদ্ধে ছবছরব্যাপী আন্দোলনে। এই আন্দোলনের প্রথমদিকে রবীন্দ্রনাথ এর পুরোভাগে ছিলেন। যখন তিনি এই আন্দোলনে আর সক্রিয় ছিলেন না, তখন, ১৯০৭ সালের একটি ভাষণে তিনি বলেন :
একবার ভাবিয়া দেখুন, বাঙালিকে আমরা যে বাঙালি বলিয়া অনুভব করিতেছি, তাহা মানচিত্রে কোনো কৃত্রিম রেখার জন্য নহে। বাঙালির ঐক্যের মূলসূত্রটি কী? আমরা এক ভাষায় কথা কই।
১৯২৯ সালে, আবার একটি অভিভাষণে, তিনি বললেন :
তাই বলছি, বাঙালি বাংলাদেশে জন্মেছে বলেই যে বাঙালি তা নয়; বাংলা ভাষার ভিতর দিয়ে মানুষের চিত্তলোকে যাতায়াতের বিশেষ অধিকার পেয়েছে বলেই সে বাঙালি।…
যেখানে বাংলার শুধু ভৌগোলিক অধিকার সেখানে সে মানচিত্রের সীমাপরিধিকে ছাড়াতে পারে না। সেখানে তার দেশ বিধাতার সৃষ্ট দেশ; সম্পূর্ণ তার স্বদেশ নয়। কিন্তু ভাষা-বসুন্ধরাকে আশ্রয় করে যে মানসদেশে তার চিত্ত বিরাজ করে সেই দেশ তার ভূসীমানার দ্বারা বাধাগ্রস্ত নয়, সেই দেশ তার স্বজাতির সৃষ্ট দেশ। আজ বাঙালি সেই দেশটিকে নদী প্রান্তর পর্বত অতিক্রম করে সুদূরপ্রসারিতরূপে দেখতে পাচ্ছে, তাই বাংলার সীমার মধ্যে থেকে বাংলার সীমার বাহির পর্যন্ত তার আনন্দ বিস্তীর্ণ হচ্ছে।
১৯৩৮ সালে এ প্রসঙ্গে প্রায় তাঁর শেষ কথা বলে দিলেন রবীন্দ্রনাথ :
বাংলাদেশের ইতিহাস খণ্ডতার ইতিহাস। পূর্ববঙ্গ পশ্চিমবঙ্গ, রাঢ় বারেন্দ্রের ভাগ কেবল ভূগোলের ভাগ নয়; অন্তরের ভাগও ছিল তার সঙ্গে জড়িয়ে, সমাজেরও মিল ছিল না। তবু এর মধ্যে যে ঐক্যের ধারা চলে এসেছে সে ভাষার ঐক্য নিয়ে। এতকাল আমাদের যে বাঙালি বলা হয়েছে, তার সংজ্ঞা হচ্ছে, আমরা বাংলা বলে থাকি। শাসনকর্তারা বাংলাপ্রদেশের অংশ-প্রত্যংশ অন্য প্রদেশে জুড়ে দিয়েছেন, কিন্তু সরকারি দফতরের কাঁচিতে তার ভাষাটাকে ছেঁটে ফেলতে পারেননি।
চার.
বাঙালির জন্য ভাষা ও ভূমি দুই-ই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথম কয়েকটি বছরে। ব্রিটিশ প্রশাসন যে সময়ে বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা আঁটছিলেন, সে সময়েই সরকারি এক কমিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তক রচনার এক নতুন প্রস্তাব নিয়ে হাজির হন। কমিটির বিবেচনায় গ্রাম্য ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে যেহেতু সংস্কৃতায়িত পাঠ্যপুস্তক সহজে বোধগম্য নয়, তাই তাঁরা সুপারিশ করলেন যে, এখন থেকে সরকার নিয়োজিত একটি গোষ্ঠী ইংরেজিতে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করবেন এবং তারপর তা উত্তর, মধ্য, পূর্ব ও পশ্চিমবাংলার স্থানীয় ভাষায় অনুবাদ করে পাঠ্যরূপে গৃহীত হবে। জননেতারা এই প্রস্তাবকে দেখলেন বাংলা ভাষাকে খণ্ড খণ্ড করার- রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ভাষাবিচ্ছেদের- প্রয়াস বলে। ফলে অচিরেই এর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ ধ্বনিত হলো, রবীন্দ্রনাথ নিজেও ‘সফলতার সদুপায়’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখে এই সৃষ্টিছাড়া প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেন। বিরোধিতার মুখে প্রস্তাবটি পরিত্যক্ত হলো।
তবে বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা সরকার ঠিকমতোই এগিয়ে নিয়ে গেলেন এবং ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবরে তা কার্যকর হলো। সেদিন পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে নতুন প্রদেশের পত্তন হলো। সরকার অনেকদিন ধরে নানাভাবে জানিয়ে এসেছিলেন যে, এতে মুসলমানদেরই লাভ হবে। ১৯০৪ সালের মার্চ মাস থেকে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়ে যায় এবং যেদিন বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয়, সেদিন এই প্রতিবাদ রূপ নেয় গঙ্গাস্নানে, বাড়িতে অরন্ধনে (এটি ছিল রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর, ১৮৬৪-১৯১৯, প্রস্তাব), বাঙালির হাতে রাখিবন্ধনে (এটি ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাব), মিছিলে ও জনসভায়। রবীন্দ্রনাথ নিজেই এমন একটি মিছিলে অংশ নিয়ে রাখি পরিয়ে দেন নাখোদা মসজিদের ইমামের হাতে- যিনি প্রসন্ন হাসি হেসে কবিকে পুরস্কৃত করেন এবং পথিপার্শ্বে দণ্ডায়মান মুসলমান গাড়োয়ানদের হাতে- যারা তাদের প্রতি ভদ্রলোকদের এই অস্বাভাবিক ও অপ্রত্যাশিত আচরণে চমৎকৃত হয়ে যায়।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের আদিতে বাঙালির ঐক্যের প্রকাশ শিখরে পৌঁছেছিল। রবীন্দ্রনাথের ভাষণ ও বিশেষ করে তাঁর গান এতে বড়রকম ভূমিকা রেখেছিল। আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল কলকাতা, কিন্তু তা ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বঙ্গদেশে, বিশেষ করে, পূর্ববঙ্গে তার গতি ও গভীরতা ছিল অনেক বেশি। বাংলার মুসলমান জননেতা ও ধর্মপ্রচারক এবং মুসলমান পরিচালিত পত্রপত্রিকা ও সংগঠনও এতে যোগ দেন, তবে, মোটের ওপর, বঙ্গভঙ্গকেই সমর্থন করেছিল বেশিরভাগ মুসলমান। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সঙ্গে অচিরেই যুক্ত হয় আরও তিনটি আন্দোলন : জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন, স্বদেশি আন্দোলন ও বিদেশি পণ্য বর্জনের আন্দোলন। প্রথম আন্দোলনটি অল্পকালের মধ্যেই বিভক্ত হয়ে পড়ে, তবে শেষ পর্যন্ত তার পরিণাম দেখা যায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠায়; দ্বিতীয়টি প্রেরণা দেয় কিছুসংখ্যক স্বদেশি শিল্প স্থাপনে; আর তৃতীয়টি সারা বাংলায় সংঘাত ও সংঘর্ষের জন্ম দেয়। মুসলমান এবং নিম্নবর্ণের হিন্দুদের বড় অংশ এখন শুধু যে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন থেকে সরে গেল, তা নয়, অনেকে এর বিরুদ্ধে প্রবলভাবে দাঁড়াল। এতে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের অনেক নেতা শুধু অবাক হননি, হতাশও হয়েছিলেন। বিষয়টাকে গভীরভাবে চিন্তা করে রবীন্দ্রনাথ সেদিন বলেছিলেন :
ময়মনসিংহ প্রভৃতি স্থানে আমাদের বক্তারা যখন মুসলমান কৃষি সম্প্রদায়ের চিত্ত আকর্ষণ করিতে পারেন নাই তখন তাঁহারা অত্যন্ত রাগ করিয়াছিলেন। এ কথা তাঁহারা মনেও চিন্তা করেন নাই যে, আমরা যে মুসলমানদের অথবা আমাদের দেশে জনসাধারণের যথার্থ হিতৈষী তাহার কোনো প্রমাণ কোনোদিন দিই নাই; অতএব তাহারা আমাদের হিতৈষিতায় সন্দেহ বোধ করিলে তাহাদিগকে দোষী করা যায় না। ভাইয়ের জন্য ভাই ক্ষতি স্বীকার করিয়া থাকে বটে, কিন্তু ভাই বলিয়া একজন খামকা আসিয়া দাঁড়াইলেই যে অমনি তখনই কেহ তাহাকে ঘরের অংশ ছাড়িয়া দেয় এমনতরো ঘটে না। আমরা যে দেশের সাধারণ লোকের ভাই তাহা দেশের সাধারণ লোকে জানে না এবং আমাদের মনের মধ্যেও যে তাহাদের প্রতি ভ্রাতৃভাব অত্যন্ত জাগরূক আমাদের ব্যবহারে এখনও তাহার প্রমাণ পাওয়া যায় নাই।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ফলে, সরকার যাকে বলেছিলেন স্থিরীকৃত বাস্তব, তা রদ হয়ে গেল ১৯১১ সালে। মানচিত্রে নতুন রেখা টানা হলো বটে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের প্রার্থনা- বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাইবোন এক হোক, এক হোক, এক হোক- তা অচরিতার্থই রয়ে গেল।
পাঁচ.
তবে রবীন্দ্রনাথ যখন অন্যরকম বিবেচনার দ্বারা পরিচালিত হয়েছেন, তখন দেখা যায়, তাঁর স্বদেশভাবনা ভিন্ন কক্ষপথে ধাবিত হয়েছে। যে গভীর আবেগের বশবর্তী হয়ে তিনি ‘আমার সোনার বাংলা’র প্রতি ভালোবাসা নিবেদন করেছেন, তেমনি আবেগ দিয়েই তিনি ভারতভাগ্যবিধাতার জয়ধ্বনি করেছেন- সেখানে পাঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মারাঠা দ্রাবিড় উৎকলের সঙ্গে স্থান বঙ্গের, কাউকে ছাড়িয়ে নয়। কবির চিত্তে ভারতবর্ষের আসনটি ছিল যথেষ্ট বড়। প্রাচীন ভারতের ধর্মীয় ভাব ও সামাজিক সংগঠনের প্রতি তিনি সর্বদাই দৃষ্টিপাত করেছেন অনুরাগ ও মুগ্ধতার সঙ্গে। তিনি অবশ্য নিশ্চিতভাবেই জানতেন যে, সেই গৌরবময় যুগের অবসানের সঙ্গে এখানে জীবনপ্রবাহ রুদ্ধ হয়ে যায়নি। তাই তিনি এ কথা বলতে পেরেছেন যে, ভারতবর্ষের ইতিহাস যেমন হিন্দুর ইতিহাস, তেমনি মুসলমানের ইতিহাস এবং ইংরেজের ইতিহাস।
বঙ্গদেশ যে ভারতবর্ষের অংশস্বরূপ, তাতে তিনি আনন্দিত ছিলেন এবং সেই সম্বন্ধের স্থায়িত্ব তাঁর কাম্য ছিল। মহাজাতি সনদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে গিয়ে ১৯৩৯ সালে তিনি বলেন : ‘আত্মগৌরবে সমস্ত ভারতের সঙ্গে বাংলার সম্বন্ধ অচ্ছেদ্য থাকুক, আত্মাভিমানের সর্বনাশা ভেদবুদ্ধি তাকে পৃথক না করুক এই কল্যাণ- ইচ্ছা এখানে সংকীর্ণচিত্ততার ঊর্ধ্বে আপন জয়ধ্বজা যেন উড্ডীন রাখে।
এ ক্ষেত্রে কেবল রবীন্দ্রনাথের কথা বললে তাঁর প্রতি অবিচার করা হবে। সেই রামমোহন রায়ের (১৭৭২-১৮৩৩) সময় থেকে সুভাষচন্দ্র বসুর (১৮৯৭-১৯৪৫) কাল পর্যন্ত বহু বাঙালি জননেতা ও বুদ্ধিজীবী ভারতীয় জাতীয়তার সাধনা করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র এবং তাঁর আগে-পরে অনেকে আবার ভারতীয় ও হিন্দুকে সমার্থকও গণ্য করেছেন। এমনকি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৭৬-১৯৩৮) মতো মহৎ ঔপন্যাসিকও শ্রীকান্ত (১৯১৭) উপন্যাসে বাঙালিদের সঙ্গে মুসলমানদের ফুটবল খেলার কথা বলেছেন। অন্যপক্ষে, উনিশ শতকের মুসলিম ধর্মসংস্কারান্দোলনগুলোও বাংলার মুসলমানদের উৎসাহ দেয় বাংলার বাইরে তাদের মূল খুঁজতে। সেই যে একটা পুরনো কথা আছে : ‘গত বছর আমি জোলা ছিলাম, এবারে শেখ হয়েছি; ফসল যদি ভালো হয়, সামনের বছর আমি সৈয়দ হয়ে যাব।’ উনিশ শতক থেকে মুসলিম জাতীয়তাবাদের একটি হাওয়া বইতে থাকে। তা প্রবল হয় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সূচনায়, ১৯০৬ সালে, ঢাকায় নিখিল ভারত মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠায়।
বাঙালি পরিচয়কে এইসব অন্য পরিচিতির সঙ্গে- ভারতীয়, হিন্দু ও মুসলিম পরিচিতির সঙ্গে- পাল্লা দিতে হয়েছে। ঔপনিবেশিককালের বাংলায় বাঙালিত্বের শক্তি প্রদর্শনের শেষ মহামুহ‚র্ত এসেছিল ১৯২৩-২৪ সালে- যখন চিত্তরঞ্জন দাশের (১৮৭০-১৯২৫) অধিনায়কত্বে বাংলার হিন্দু-মুসলমান নেতারা বেঙ্গল প্যাক্টে স্বাক্ষর করেন। এতে যে সম্ভাবনার দ্বার খুলে গিয়েছিল, চিত্তরঞ্জনের অকাল মৃত্যুতে তা রুদ্ধ হয়ে গেল।
চিত্তরঞ্জনের মহাপ্রয়াণের পরের বছর, ১৯২৬ সালে, বাংলায় হিন্দু-মুসলমানে বড়রকম দাঙ্গা হয় প্রথমবারের মতো। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগ লাহোর প্রস্তাব গ্রহণ করে- তার প্রতি জোরালো সমর্থন আসে বাংলা থেকেই। অবশ্য এর সমর্থকরা তখন বাংলা ও আসামকে একটি ভৌগোলিক এককরূপে গণ্য করছিলেন। তবে হিন্দু-মুসলমানের যাত্রাপথ প্রকৃত প্রস্তাবে ভিন্ন হয়ে গেল ১৯৪৬ সালের সা¤প্রদায়িক দাঙ্গায়। ১৯৪৭ সালের জুন মাসে ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষের স্বাধীনতা দেওয়ার ও বিভক্ত করার- সেইসঙ্গে পাঞ্জাব ও বাংলাকে ভাগ করার- ঘোষণা দিল।
১৯৪৭ সালের এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে মুসলিম লীগের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (১৮৯৩-১৯৬৩) ও আবুল হাশিম (১৯০৫-৭৪) এবং কংগ্রেসের শরৎচন্দ্র বসু (১৮৮৯-১৯৫০) ও কিরণশঙ্কর রায় (১৮৯১-১৯৪৯) ভারত ও পাকিস্তানের বাইরে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। এই ‘একভাষাভিত্তিক অখণ্ড রাষ্ট্রে’র আহ্বান জানানো হয়েছিল বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে অক্ষুণœ রাখতে এবং তার অর্থনীতিকে চলমান রাখতে। এই প্রয়াসের বিরুদ্ধে সফল অভিযান চালিয়েছিল হিন্দু মহাসভা- কংগ্রেস তার সঙ্গে একমত হয় এবং মুসলিম লীগ তাতে সায় দেয়।
ছয়.
স্বাধীন ভারতের বাঙালি অধিবাসীদের পক্ষে তাদের বাঙালি সত্তাকে বৃহত্তর ভারতীয় সত্তার সঙ্গে সমন্বিত করা সম্ভবপর হয়েছিল। আমরা ভুলে যাচ্ছি না যে, ১৯৫৬ সালে আসামে বাংলা ভাষার জন্য একটি আন্দোলন ঘটেছিল এবং তাতে কয়েকটি প্রাণও বিসর্জিত হয়েছিল। কিন্তু, আন্দোলনকারীদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে হয় যে, তা ছিল স্থানীয় বাংলাভাষীদের সঙ্গে অহমিয়াদের দ্ব›দ্ব- সারা ভারতে তার তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া ঘটেনি।
পাকিস্তানে কিন্তু বিষয়টা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সূচনালগ্ন থেকেই সেখানে বাঙালিরা ভাষা, হরফ ও সংস্কৃতি নিয়ে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হয়। এর কারণ বুঝতে হলে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে মুসলমান পরিচয় ও বাঙালি পরিচয় বঙ্গদেশে হাত ধরাধরি করে চলেছে। তথাকথিত আশরাফেরা তখন তাঁদের শিকড় খুঁজেছেন আরবে, পারস্যে, তুরস্কে, মধ্য এশিয়ায় কিংবা অন্তত, উত্তর ভারতে, যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমানেরা গ্রামবাংলাকেই নিজের পূর্বপুুরুষের বাসভূমি বলে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নিয়েছে। পূর্বপক্ষ যদি নিজেদের সাংস্কৃতিক উৎস ও প্রকাশভঙ্গির জন্য আরবি, ফারসি ও উর্দুর শরণাপন্ন হয়ে থাকে, উত্তরপক্ষ কিন্তু তখন বাংলা ভাষাকেই নিজেদের মাতৃভাষা বলে সগৌরবে ঘোষণা করে, উর্দুর চেয়ে বাংলা ভাষার প্রতি তাদের পক্ষপাত বারেবারেই প্রকাশ করে। এ কথাও বলা হয়েছে যে, বাংলা কেবল তাদের মাতৃভাষা নয়, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকল বাঙালির জাতীয় ভাষা। সুতরাং এটা মোটেই আশ্চর্যজনক নয় যে, ৩ জুন ১৯৪৭-এ মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে যায় এবং তরুণ লেখক, প্রবীণ সাংবাদিক ও বর্ষীয়ান শিক্ষকরা তাতে বাংলার পক্ষে জোরালো যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আরও অনেকে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন।
রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে পূর্ববাংলায় অসন্তোষের প্রথম প্রকাশ ঘটে ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে- পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ছমাস পরে, এটাই চরমে ওঠে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে। বাংলা ভাষার জন্য প্রাণদানের কারণে দিনটি এখন পর্যন্ত বাঙালি আত্মপরিচয়ের প্রতীক হয়ে রয়েছে।
পাকিস্তান সরকার ও পূর্ববঙ্গের জনগণের মধ্যে ভাষা, হরফ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও প্রকাশভঙ্গি নিয়ে বিরোধ লেগেই থাকে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৮ সালে ঢাকায় একটি সাংস্কৃতিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা পরিষদ গঠিত হয়। ততদিনে শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-৭৫) ছয় দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করে ফেলেছেন। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার হয়ে উঠেছে সময়ের দাবি। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময়ে সারা পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে শোনা গেল ¯েøাগান : ‘জাগো, জাগো, বাঙ্গালি জাগো’ এবং ‘তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা মেঘনা যমুনা’। বোঝা গেল, বাঙালি আত্মপরিচয় ক্রমশ জোরালো হচ্ছে এবং তার একটা আঞ্চলিক ভিত্তি দেওয়া হচ্ছে। পাকিস্তানে যখন প্রথম সাধারণ নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে, তখন ১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে শেখ মুজিব দাবি করলেন, পূর্ব পাকিস্তানের নামকরণ হোক ‘বাংলাদেশ’। এর সঙ্গে সঙ্গে নতুন দুটি ¯েøাগান ধ্বনিত হলো দেশজুড়ে : ‘জয় বাংলা’ এবং ‘তোমার দেশ, আমার দেশ/বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’। ১৯৭০ সালের নভেম্বরে প্রলয়ংকর ঝড়ঝঞ্ঝা যখন সমূহ ক্ষতিসাধন করল এ অঞ্চলের, তখন ঢাকার সবকটা বাংলা পত্রিকা প্রথম পৃষ্ঠাজুড়ে শিরোনাম দিয়েছিল : ‘কাঁদো, বাঙালি, কাঁদো’। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে যুবকদের মুখে ধ্বনিত হলো আহ্বান : ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো/বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। অচিরেই সেই সময় এসে গেল, যখন তারা প্রমাণ করল যে, এ কেবল ফাঁপা ¯েøাগানই ছিল না।
সাত.
বাঙালির আত্মপরিচয়ের জন্য বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা বড় এক অগ্রগতি। এখানে ভাষা ও অঞ্চলের অভূতপূর্ব মিলন ঘটল। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে সমজাতীয়তার ভাব এত প্রবল হলো যে, দেশে যে অন্যান্য নৃতাত্তি¡ক জনসমষ্টি বাস করে, সে কথা লোকে ভুলে গেল। বাংলাদেশ গণপরিষদের যখন সংবিধান বিল পেশ করা হয়, তখন নাগরিকদের কোনো নামের কথা তাতে বলা হয়নি। সরকারি দলের একজন সদস্য এই মর্মে সংশোধনী উত্থাপন করেন যে, বাংলাদেশের নাগরিকেরা ‘বাঙালি’ নামে পরিচিত হবেন। এই প্রস্তাব গৃহীত হলো, যদিও তার আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত একমাত্র সদস্য মানবেন্দ্রনাথ লারমা প্রতিবাদ করে বলেন যে, সংবিধানে এমন বিধান গৃহীত হলে তা চাকমা জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার পথ উন্মুক্ত করবে। পাঁচ বছর পরে সামরিক আইনের ফরমানবলে সংবিধানের সেই বিধান অবশ্য পরিবর্তিত হয়ে যায়। নৃতাত্তি¡ক সংখ্যালঘুদের কথা বিবেচনা করে নয়, বরঞ্চ বাঙালি জাতীয়তাবাদের আওতায় অন্য দেশের বাঙালিরা স্থান করে নিতে পারে, এই আশঙ্কার সংবিধান-সংশোধনের প্রবক্তারা ‘বাঙালি’র বদলে ‘বাংলাদেশি’ শব্দ স্থাপন করেন, তাঁদের যুক্তিতর্ক থেকে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। আসলে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের পক্ষে যা যা বলা হয়, তা ১৯৪০-এর দশকে মুসলিম লীগের দ্বিজাতিতত্ত্বের ব্যাখ্যার সঙ্গে অভিন্ন। পাকিস্তান আমলে যে কারণে কিছু লোক বলতেন তাঁরা বাঙালি নন, পাকিস্তানি, সেই একই মানসিকতার বশবর্তী হয়ে এখন অনেকে বলতে আরম্ভ করলেন, তাঁরা বাঙালি নন, বাংলাদেশি। নাগরিকত্বের পরিচয় এবং নৃতাত্তি্বক পরিচিতিকে স্বতন্ত্র ধারায় দেখলে বাঙালি ও বাংলাদেশির মধ্যে বিরোধের সুযোগ থাকে না।
বাংলাদেশে অবশ্য বাঙালি আত্মপরিচয় সমুন্নত রাখার চেষ্টাটাই যথেষ্ট পরিমাণে দুর্বল হয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় কাজে এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ক্রমহ্রাসমান ব্যবহারে তার পরিচয় পাওয়া যাবে বিশেষ করে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার পরে নাগরিক মধ্যবিত্তের অপ্রত্যাশিত বিত্ত সঞ্চিত হয়েছে। তারা এখন সন্তানদের বিদেশে পড়াতে, এবং সম্ভবপর হলে, সেখানে অভিবাস করাতে চায়। ফলে পোষ্যদের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পাঠিয়ে ইংরেজি ভাষাকে এসব ছেলেমেয়ের দ্বিতীয় নয়- প্রথম ভাষা করে তুলতে তারা আগ্রহী। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের শহিদদের প্রতি এখনও উদ্দীপনাসহকারে শ্রদ্ধা জানানো হয়, বাংলা নববর্ষ ক্রমবর্ধমান উৎসাহের সঙ্গে পালিত হয়, কিন্তু বাংলা ভাষার সঙ্গে নতুন প্রজন্মের যোগ ক্রমে বিলীয়মান হয়ে পড়ছে।
ভারতেও নতুন প্রজন্মের বাঙালিদের ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য। গত কয়েক দশক ধরে ভারত ও বাংলাদেশ থেকে অন্যভাষী অঞ্চলে অভিবাসন ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীরা ছেলেমেয়েদের বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির কিছু পাঠ দিতে চান। কিন্তু যারা অন্য সংস্কৃতির মধ্যে জন্মলাভ করে কিংবা বেড়ে ওঠে, তাদের পক্ষে এটা স্বাভাবিক বা সহজ মনে হয় না। যেখানে তারা বসবাস করে- জায়গার প্রতি এবং সেখানকার সংস্কৃতির প্রতি তাদের আকর্ষণ দিনে দিনে বাড়ে। তারা নিজেদের অভিবাসী বলেও গণ্য করতে চায় না। ফলে তাদের কাছে বাঙালি পরিচিতির মূল্য প্রতিমুহ‚র্তে কমে আসতে থাকে।
আজ বাঙালি আত্মপরিচয় নানারকম হুমকির মুখে- বিশ্বায়ন, কোনো না কোনো ধরনের মৌলবাদ, বিচ্ছিন্নতা, হিন্দি চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের প্রভাবে। এই অবস্থায় এর কী দশা হবে, ভবিষ্যৎই তা বলতে পারবে। আমার আশা, বাঙালি আত্মপরিচয়ের অপরাজেয় ভাব সকল প্রতিক‚ল বাস্তবতাকে অতিক্রম করে যাবে। ব্যক্তির ও সমষ্টির আত্মপরিচয়ের সঙ্গে বাঙালি আত্মপরিচয়ের নানারকম সংঘাত ঘটতে পারে ভবিষ্যতে, তবে আমি নিশ্চিত যে, বিশ্বজনীন মানব-পরিচয়ের সঙ্গে তার কখনও বিরোধ হবে না।