ধারাবাহিক: অমৃতস্য পুত্রা (পর্ব-৭) । অনিন্দিতা মণ্ডল
কথা ২
লিখতে লিখতে ট্রান্স ভাঙে কোণে রাখা টেলিফোনের তীব্র আওয়াজে। এখন এ ঘরে কেউ নেই। বুবু রান্নাঘরে। ধীরে ধীরে উঠে ফোনটা ধরলেন তিনি। ফোন তো তাঁরই আসে। কোনও প্রযোজক, পরিচালক, বা অভিনেতার ফোন। কম পয়সায় লিখে দিতে হবে। কিন্তু আজ ফোনের ওপার থেকে ভেসে আসে এক বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর। ‘তপু?’ বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে তিনি সাড়া দেন ‘বাবাবু?’ শুনতে পান অসুস্থ বৃদ্ধের প্রলাপ ও বিলাপ। ‘আমাকে তোর কাছে নিয়ে চল তপু। তুই যা খাওয়াবি তাই খাবো।’ বাবাবু! সেই দোর্দণ্ডপ্রতাপ হীরু গঙ্গোপাধ্যায়! ভারত বিখ্যাত! তিনি মুহূর্তে অতীতে ফিরে যান। এই এক স্বভাব তাঁর। অতীত ভুলতে পারেন না। মা জানতেন ছোটকাকা ঠিক কতটা বঞ্চিত করেছিলেন তাঁকে। আর কেউ নয়। সবাই তাঁর গুণমুগ্ধ। সততার প্রতিমূর্তি। কিন্তু এখন আর তিনি এসব ভাবছেন না। বরং অসহায় অসুস্থ মানুষটার কণ্ঠস্বর তাঁকে বিব্রত করে। অস্থির করে। তিনি রান্নাঘরের দুয়ারে এসে দাঁড়ান। ‘বুবু আমাকে দুটো খেতে দাও তো, বাবাবুকে একটু দেখে আসি।’ দেওয়ালে ঝোলানো দুটো অয়েল পেন্টিং এর দিকে তাকান। এই ফ্ল্যাটবাড়ির ঘরে একেবারে বেমানান ছবি দুটো। তবু রেখেছেন তিনি। একটি তাঁর ঠাকুরদার ছবি। অন্যটি তাঁর অকালমৃত বাবা। বাবাকে তাঁর মনে পড়ে না। নাহ, বাবাবুর কোনও ছবি তিনি এখানে রাখবেন না।
ভাত বাড়তে বাড়তে ভারতী মৃদুগলায় বলেন – শোনো, বাবাবুকে এখানে আনলে ওনারই খুব অসুবিধে হবে। এই ছোট্ট ঘরে দোরে। আর এই ফ্ল্যাটের মধ্যে নারায়ণ কোথায় থাকবেন? তুমি বুঝিয়ে বোলো। বরং মধুশ্রীকে বোলো একটু যত্ন করতে। উনি চুপ করে খেতে থাকেন। বুবু ঠিক কথাই বলছে। ও সবসময় ঠিক কথা বলে। তিনিই ভুল করে এসেছেন চিরকাল।
সে অনেকদিন হল। বাবাকে মনে পড়ে না। অস্পষ্ট হয়ে আসছে বাবার মুখ। টালার বাড়ির সেই লম্বা দালানে খেতে বসা। পরপর সকলে বসেছে। পিসেমশাই ঘরজামাই। পিসিমা একমাত্র মেয়ে। ভীষণ প্রতাপ। ‘আমাকে ঘি দিলে না?’ কেউ কিছু বলার আগেই মা এসে কাঁসার থালাটা টেনে নিলেন। ‘বাপমরা ছেলে যে দুটো অন্ন জুটছে এই ঢের’। সেদিন মা আর বোনেদের খাওয়া হল না। কি করে হবে? তপুর মুখের সামনে থেকে থালা সরিয়ে নিলেন যে!
খাওয়ার তদারকিতে থাকতেন ঠাকুমা। সদ্য বিধবা বউমার এই স্পর্ধা সহ্যের অতীত। ভীষণ নীচু স্বর ছিল তাঁর। ছোট ছেলেকে ডাকলেন—হীরু, দালানের ওপাশে পাঁচিল তুলে বউমাকে ছেলেপুলে নিয়ে থাকার জন্য ঘর চারখানা দিয়ে দাও। ধীরু নেই। থান কাপড়ে বউমাকে আমি সহ্য করতে পারি না। ছোট কাকা ওরফে বাবাবু একবার বলতে চেয়েছিলেন, ‘ঘিয়ের বদলে দালদা নাই দিতো দিদিমণি’। ঠাকুমা হাত তুললেন—যে ছেলের বাপ নেই তাকে কষ্ট করা শিখতে হবে বইকি। সাধে কি বাসি রুটি গুড় দালদা খাওয়া শেখানো হচ্ছিল? বউমা যদি ভালো রাখতে পারেন তাহলে আমার কি বলার আছে? পেছনের বস্তির ভাড়াটা বরাদ্দ করে দাও। ছোট কাকা আরও একবার বলতে চেয়েছিলেন, ‘দাদার আয় যা ছিল তার কিছুটা…’। মুখের কথা মুখে থেকে যায়। শীতল চোখে চেয়ে ঠাকুমা উঠে পড়েন।
তবলার তাল লয় জানতে গেলে কিছুই বলতে পারব না। হলই বা আমার পিতৃকুল তবলার উত্তরাধিকার নিয়ে গর্বিত। আমরা সেসব কিছুই জানিনি। কারণ ভুলোকাকার মতন আমরাও সাত রাজ্যের ভাড়া বাড়িতে জীবন কাটিয়েছি। আমার ছোট ঠাকুরদা বলতেন, বনেদী বাড়ির রীতিনীতি বিসর্জন দিয়ে বিদ্যালাভ করা যায়না। তার একটা রীতি হল বাপ ঠাকুরদার ভিটেয় মাটি কামড়ে পড়ে থাকা। শত বঞ্চনা শত অপমান সহ্য করেও। কিন্তু আমার বাবা জল আর ধানের খোঁজে পুঁটলি বেঁধে বেরিয়ে পড়েছিলেন। নিরুপায়। এই ছন্নজীবনে অনেকগুলো বাড়ি দেখলাম। সেসব ভাড়াটে বাড়ির কোনো নিজস্ব নিয়মনীতি ছিল না।
আরো পড়ুন: অমৃতস্য পুত্রা (পর্ব-৬) । অনিন্দিতা মণ্ডল
বছরে একবার যেনতেন বিজয়ার প্রণামটুকু সারা ছাড়া বনেদী বাড়িতে আমাদের পা পড়ত না। চিরকালের অন্যরকম বাবা তাই বংশ ছেড়ে কুল ছেড়ে নাড়া বেঁধেছিলেন কাশীর সেসময়ের এক বিখ্যাত ওস্তাদের কাছে। তাঁর নামের প্রথমেই ছিল ‘খলিফা’, যেটা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে বাবা আঙুল কানে ছোঁয়াতেন। গুরুর নাম উচ্চারণ করতে নেই।
বাবার সেই গুরুভাই মীরসাহেব। দুজনেই দুজনকে ‘ভাই’ বলে ডাকতেন। মীরসাহেব এলে দুজনে আমাদের বসার ঘরে শুতেন। সারাদিন কাশী আর ওস্তাদ খলিফাসাহেব, নয়তো কাশীর দাদুর কথা হতো। সেই অবকাশে তবলা বাজানোও চলত খুব। আমরা পড়াশুনো করতে করতে শুনতাম সেই লহরা, যুগলবন্দী, কত কিছু।
একবার মীরসাহেবকে ধরে বসলাম আমরা তিন ভাইবোন। আমাদের তবলা শোনাও। তুমি তো সব বাজাতে পারো। দেখি আমরা যা বলব বাজাতে পারো কিনা? মীরসাহেব ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠত। কী শুনতে চাও বাচ্চা? বললাম, ঘোড়া দৌড়নোর শব্দ বাজাও। মীর সাহেব বললেন—বহোত খুব। আঁখ বন্ধ করো। আমরা চোখ বন্ধ করে ফেললাম। তবলা বেজে উঠল। খুব দূর থেকে একপাল ঘোড়া দৌড়ে আসছে। কাছে আসতেই সে কী খুরের আওয়াজ! আবার সে আওয়াজ দূরে মিলিয়ে গেলো। আমি একবার চমকে চোখ খুলেই আবার বন্ধ করে ফেললাম। ভেসে উঠল এক ঘন অরণ্য ভেদ করে ছুটে চলেছে একপাল বুনো ঘোড়া। আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। আমি সেই দুর্দান্ত দৌড়ে হারিয়ে ফেললাম আমার চেনা ঘরবাড়ি। প্রাচীন কোন এক অরণ্যে যেন বাস আমার। আমি যেন ওইরকম দৌড়বাজ এক বুনো ঘোড়া।
কাশীর দাদু ছিলেন আমাদের কুলগুরুর বংশ। বাবা মা তাঁর কাছে দীক্ষা নেননি। কিন্তু ধীরুদার ছেলে যে তাঁরও ছেলে! বিশেষত বাপমরা ছেলে। কাশী তাই আমাদের শৈশবের স্নেহের স্থান হয়ে রইল। সুরকির রাস্তা দিয়ে একটা গলির শেষ প্রান্তে একতলা একটা বাড়ির দালানে চৌকিতে বসে থাকতেন দাদু। তাঁর ফর্সা বুক ঘিরে ঝুলত দুধ সাদা পৈতের গোছা। দিদার ঘোমটা দেওয়া শীর্ণ মুখে স্নেহ মাখা থাকত। প্রতিমার মুখে গর্জন তেলের মতোই। বাবা বেশির ভাগ সময়েই দূরদেশে গিয়ে ফেরার সময় কাশীতে নামতেন। ফেরার সময় টাকা যেত ফুরিয়ে। আমরা দাদুর কাছে গিয়ে দু একদিন থেকে ফিরতাম। সেই দরিদ্র ব্রাহ্মণ গৃহের বনেদীয়ানা কী ছিল জানিনা, জানি দাদু দিদা আমাদের ভালবাসতেন খুব। সেই স্পর্শ ভোলার নয়। এখানেই মীরসাহেব একদিন এলো। বাবাকে দেখেই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে কি কান্না! ‘ভাই ভাই, ইতনা দিন আয়ে নেহি কিউ?” আমরা দেখেছি বাবা আর মীরসাহেব যতটা প্রাণের কাছাকাছি ছিলেন এমন আর কেউ না। বানারসেই মীরসাহেবের সাতপুরুষের বাস। আতরের উত্তরাধিকার তিনি পেয়েছিলেন। তাঁকে মাটি পাল্টাতে হয়নি।
সকলের মতো আমারও ছোট থেকেই মাঝে মাঝে মনে হত কি করে এখানে এলাম। এ জায়গাটা আসলে কোথায়। এর আগে কোথায় ছিলাম। বা, সত্যিই কোথাও ছিলাম কিনা। যদি না থেকে থাকি তবে হঠাত এলাম কি করে। থাকলে, কোথায় ছিলাম। এইরকম ভাবনাগুলো যখন বড্ড ভাবিয়ে তুলত তখন আমি নিজের সঙ্গে খুব একা হয়ে যেতাম। চারিদিকে বাবা মা ভাই দিদি থাকলেও মনে হত আমি বিচ্ছিন্ন। একা। কি জানি কোথা থেকে এসেছি। আবার কোথাও চলে যাব। যেমন রাঙাদাদু চলে গেল। যেমন মা ছলছলে চোখে আমার না দেখা মাসির কথা বলে। সেই সব দিন আমি খেলতে পর্যন্ত যেতাম না। দিদি ঠেলা দিয়ে ডাকত। এখনি চল, নয়ত খেলায় নেব না। আমার যে খেলার নেশা। না খেললে পড়াশুনো মাথায় ঢুকতে চায় না। মন খারাপ হয়ে থাকে। কিন্তু এখন যে তার চেয়েও বেশি মন খারাপ। তাই খেলতেও যাই না। অগত্যা দিদি ছুটে চলে যায়। আমি একা বিশাল মাঠের এক কোণে বসে থাকি। চুপ করে চেয়ে দেখি সকলে খেলছে। আমার কান্না আসে। হঠাত পিঠে কার হাতের স্পর্শ পাই। চেনা হাত। ভারী হাত। চেয়ে দেখি, বাবা। আমার মুখের দিকে অদ্ভুত ভাবে দেখছে। –উঠে এসো। একা একা বসে আছ কেন? খেলতে নেয়নি তোমায়? আমি কিছু না বলে উঠে আসি। মাথা নাড়ি। –তবে কেন খেলতে যাওনি? অস্ফুটে বলি, ভাল লাগছে না। বাবা আর কিচ্ছু না বলে হাত ধরে বাড়ি নিয়ে আসে।
বাড়ি ফিরে বাবা মন খারাপ নিয়ে একটি কথাও বলে না। হাত পা ধুয়ে বৈঠকখানা ঘরে এসে বসে। ডাক দেয়, এদিকে এসো। বসো। আমি বুঝতে পারি, আধো অন্ধকারে বাবা নিজেও একলা হয়েছে। আমার মতো বাবারও মন খারাপ লাগছে। বাবা নিচু স্বরে সুর লাগায়।
বদরা ঘির আয়ি, আন্ধিয়া ঘিরি রে…।
ক্রমশ সুর ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ঘরের বাতাসে তার মূর্ছনা ঘোর লাগায়। দেশ রাগের আর্তি ঘরের দেওয়ালে দেওয়ালে আছড়ে পড়ে। কি এক অব্যক্ত বেদনা যেন বাদল মেঘের মতই আঁধার ঘরে ঘিরে ঘিরে আসে। আমি বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি, বাবার মুখে একই কষ্ট টের পাই। সেই কষ্ট আমাদের ঘরটাকে যেন নিজের কথা বলবার জন্য সুর আশ্রয় করেছে। কখন যে গানের মধ্যে উঠে গিয়েছি বাবার কাছে নিজেই জানি না। বাবার হাতের তানপুরাটার মাঝ দিয়ে আমার নিঃশ্বাস বাবার গায়ে লাগে। বাবা চোখ মেলে তাকায়। তানপুরা নামিয়ে কাছে টানে আমায়। মাথার চুলে হাত ডুবিয়ে বলে, কি হয়েছে রে? আমি খানিক চুপ করে থাকি। গুছিয়ে কষ্টের কথা বলতে পারিনা। তারপর ধীরে ধীরে বলি। আমার কিচ্ছু ভাল লাগেনা। এই যে এখানে আমি এসেছি। আমার বয়স দশ। দশ বছর আগে আমি কোথায় ছিলাম? যদি কোত্থাও না থেকে থাকি তাহলে এ কেমন থাকা? বাবা তখন আমার কেউ ছিল না? তা কি করে হয়? বাবা আমাকে আরও কাছে টানে। বাবার বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে শ্বাস নিতে নিতে শুনতে পাই, বাবা বলছে – কোথায় থাকবি বাবা? এই তো এখানেই ছিলিস। আমি যে তোর মতো একটা মেয়েই চেয়েছিলাম মনে মনে। বাবার কথায় আনন্দ হয়। কিন্তু অস্তিত্বের সঙ্কট মেটে না। একটা অবিরাম জীবন প্রবাহের সন্ধান না পেলে যেন মন শান্ত হবে না।
এমন সময়ে মা ঘরে ঢোকে। সুইচ টিপে বড় আলোটা জ্বালিয়ে দেয়। আমাকে আর বাবাকে ওরকম করে বসে থাকতে দেখে কি জানি কি বুঝতে পারে। বলে—লেখাপড়া করতে বসবি না গুগুল? লেখাপড়া করে বড় হলে দেখবি সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছিস। তোর বাবা চিরকাল অঙ্কে কাঁচা। যা জিজ্ঞেস করছিস তার সবটা জানে না। মা কেমন করে জানল যে বাবাকে আমি কিছু বলেছি? বাবার বিব্রত মুখটা মনে হয় মাকে তেমন কথাই মনে করিয়েছিল। আমি মায়ের কথা শুনে পড়ার টেবিলে গিয়ে বসি। ও ঘরের আলো ফের ঝিমিয়ে যায়। ফের সুর ঝিম ধরায়।
বদরা ঘির আয়ি
আন্ধিয়া ঘিরি রে।
আমার মনের মধ্যে অন্ধকার ভেদ করে জেগে ওঠে পরের লাইন।
এয়সি অন্ধেরে মে তুম কাঁহা
তুম কাঁহা শ্যাম রে।
তাহলে একা নই! অন্ধকার ভেদ করে আলোর দিশার মতন কেউ আছে! সে অমর! অসীম! অনন্ত!
আমি বই খুলে ধরি। মুহূর্তের মধ্যে সঙ্কট সরে যায়।
কয়েকটি ছোট গল্প প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়। জাগ্রত বিবেকে মাঝে মাঝে প্রবন্ধ লেখা হয়। মাতৃ শক্তিতে ধারাবাহিক উপন্যাস ‘অমিয়কায়’ প্রকাশ হয়ে চলেছে। খোয়াবনামা থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘লঙ্কাধীশ রাবণ’। ঋতবাক প্রকাশনা থেকে ঐতিহাসিক গল্প সঙ্কলন ‘রাজোচিট; প্রকাশিত। এছাড়া ঋতবাকে নিয়মিত লেখা প্রকাশ হয়। আত্মপ্রকাশ ‘একালের রক্তকরবী’ থেকে।