| 19 এপ্রিল 2024
Categories
ইরাবতী তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা

তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা গল্প: জলকাদার উপাখ্যান । বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

ঘরে মন বসে না লখিরামের। সবসময় ঘ্যানঘ্যান করে বউটা।সাত কথা শোনায় এতে ভারি হয়ে যায় বুকের ভিতরের কলকব্জা। রাগে গরমাগরম শব্দ মুখ ফসকে বেরিয়ে আসতে চায়। বউ বলে কী না – ‘খুব ত জমিদারী, কবে পোলাও খেয়েছ, এখনও বাহ্যি যাচ্ছ। থামাও উসব পেন্দা গুলগপ্প।“

মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল তখনই। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়েছিল। জমি হচ্ছে মায়ের মতন। তাকে নিয়ে অকথা কুকথা কাঁহাতক আর সহ্যি হয়। নেহাত বউয়ের সাথে বাক-বিতণ্ডা করার ইচ্ছে তার নেই। তাই ঘর ছেড়ে পালিয়ে আসা। এই আম জাম আঁখড়া গাছের তলে তার নিজের দুনিয়া। এখানে মন জুড়ানো ছায়ায় দিব্যি দুটো খড় আঁটি নিয়ে ঘুম দেওয়া যায়। চারদিকে গাছ আর গাছ তার হাওয়ায় পেরাণে আরাম হয়, চোখে নিদ জড়িয়ে আসে। তখন কোথায় বউ আর কোথায়ই বা তার মাথা গরম করা কথা। কিন্তু আজ হল না। আজ তার মায়ের কথা মনে পড়ল খুব। তার মা বলত – বউ হল ঘরের নোক্ষী, তার মনে দুখ দিস না কোনদিন। তাই সে ঝগড়া না করে পালিয়ে আসে। কিন্তু পালিয়েই বা কতদূর যাবে। সব্জিক্ষেত নয়তো খামারবাড়ি। পুঁটি মাছের দৌড় বিষ্টুর ডোভা। এই ছায়া ঘেরা খামার বাড়িতে এসে মনমরা হয়ে যায় সে। দেখে এবার ধান তেমন ভালো হয়নি। ভাঙা পাঁচিল ঘেরা ঠুনকো বনেদিয়ানা নিয়ে পড়ে আছে লম্বা খামার। নামেই তালপুকুর কিন্তু আজ আর ঘটিও ডোবে না।

এককোণে কুষ্ঠ রুগীর মতন অবহেলায় জমা করা আছে দুটো ধানপালুই। অথচ একসময় থই থই করত চারপাশ। ধানের গোলাগুলো খড়ের ছাউনি দিয়ে ঢাকা থাকত। জমিদার হিসেবে বেশ নামডাক ছিল তার বাপ মতি লায়েকের।পাঁচটা পাটাতনে ধান ঝাড়ত দশজন মুনিষ। তাদের মদত করত সাত সাতটা কামিন। এসব কোন রাতকহনি নয়, লখিরামের নিজের চোখে দেখা। সে দিনগুলো মনে পড়লে এখনও জমিদারি রক্ত ছলকে উঠে। ধান পেটানো নয় যেন প্রতিদিন পরব চলত এখানে। সেই রমরমা অবস্থা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। নিজের স্বভাব দোষে নিজেই তা ছিচ্ছাতুর করে গেছে তার বাপ মতি লায়েক। স্বভাব চরিত্তির সুবিধার ছিল না লোকটার। মদের নেশা তো ছিলই আরও কত কিসিমের বদ নেশা। সুয্যি ডুবছে কি আর ঘরে বাস নেই তার। ভাটিখানার দিকে যাওয়ার জন্য সুড়সুড় করত পা দুটো। মদভাটির সাথে এমন পীরিত হয়ে গিয়েছিল সেখানে গিয়ে না বসলে ভাত হজম হত না তার, পেট ফুলে ঢোল হয়ে যেত। তখনই বোধ হয় শুরু হয়েছিল ধস নামা। শিশুগাছের ডালে বসে যে লক্ষ্মীপেঁচাটা ডাকত প্রতিদিন। তাকে বেশ নরম চোখ মেলে দেখত লখিরাম। তার মা উর্মিলা সন্ধ্যে মাড়ুলি দিতে এসে বিড়বিড় কিছু বলত পেঁচাটাকে। সাদা ধবধবে পেঁচাটা চুপচাপ বসে থাকত ডালে। মদ নয় শেষে আরও অনেক নেশাই গিলে ফেলল মতি লায়েককে। দিনকে দিন মদের নেশায় শুধু লিভার নয় ঢিলা হয়ে যেতে লাগল তার চরিত্তির। এক একটা কামিনের জন্য নিত্য নতুন শাড়ি, স্নো, পাউডার আর হাত খরচের ব্যবস্থা করতে গিয়ে বিক্রি হতে লাগল এক একটা খেত।একদিন লক্ষ্মীপেঁচাটা কেঁদে উঠল জোরে।

তুই কাঁদিস কেনে মা? লখিরাম জিজ্ঞেস করেছিল অজান্তেই।

উর্মিলা আঁচলে চোখের জল মুছতে মুছতে বলেছিল ঘরের বউয়ের মনে দুখ দিলে লক্ষ্মীপেঁচা আর সেখানে থাকে না।

খামারে এসে আজ মধ্য পঞ্চাশেও সেই লক্ষ্মীপেঁচাটার খোঁজ করল লখিরাম। শস্যময় দুনিয়ায় মানুষের ঘর সংসার হয়ে উঠবে সব জীবজন্তুর পরিবার। একলা খাওয়া নয়, দিয়ে থুয়ে ভাগ করে খেতে হবে। এতে আনন্দ বাড়ে। সেই আনন্দের সন্ধানে পাখিটা আসবে। একবুক দীর্ঘনিঃশ্বাস নিয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। ফাঁকা খামার বাড়িতে দীর্ঘশ্বাসের শব্দটা বারবার ধাক্কা খেয়ে তাকে যেন ভেংচি কাটল। অন্য বছর ফসলে ফসলে ভরে থাকে সারাবাড়ি। এবার দুটো মাত্র ধানপালুই। তাও একমানুষের বেশি উঁচু নয়। সাত সাতটা পেট এর উপর ভরসা করেই সম্বছর চলে। নিজেদের তো যা হবার হবেই সেই সাথে অবলা গরুগুলোও সারা বছরের দানাপানির অভাবে মারা পড়বে। এই কষ্ট সে সইতে পারবে না। তার আগে যে করেই হোক তাকে একটা কিছু বন্দোবস্ত করতে হবে। অদালির হারুমাঝির সাথে দেখা হয়েছিল সেদিন। কথায় কথায় তাকে এই দুখকহনি বলে রেখেছে লখিরাম– নিজের জন্য কিছু বলছি নাই হারু খুড়া, শুধু ই অবলা গাই গরুগুলার কথা ভাইব্যে পেরান শুকাই যায়।

হারুর আমসি শুখা মুখে কোন আশ্বাসবানী শুনতে পায়নি লখিরাম– ই অবস্থা ত হামদেরও, ভাবছি সব বিক্রিবাটা কইরে দিব।

 এই ব্যবস্থা মনঃপুত হয়না লখিরামের। সে চাষার ছেলে। শত দুখেও সে বেচতে রাজি নয়।একটা কিছু ব্যবস্থা তাকে করতেই হবে। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে একদলা কষ্ট তার বুকের পাঁজর কাঁপিয়ে সরসর করে নেমে যায় তলপেটে। সে ভাবে সারা দুনিয়ার ভাবনা মাথায় নিলে বিগড়ে যেতে পারে সব কলকব্জা। তারচেয়ে ঘুমোনোই ভালো। ঘুম এই শব্দটির কথা ভাবলেই তার চারপাশে শান্তির বাতাস বইতে থাকে। দুটো পালুই খুব কাছাকাছি। একটা মানুষ যাওয়া আসার জন্য যতখানি পর্যাপ্ত রাস্তা লাগে ঠিক ততটাও নয় তার অর্ধেক জায়গা নিয়ে মাঝখানে একটি পথ। সেখানে দু আটি পুয়াল দিয়ে বেশ নরম করে পাতা থাকে তার বিছানা। আর এক আটি পুয়াল দিয়ে সুন্দর এক বালিশ। এই শয্যা তার একান্ত নিজস্ব এবং নিভৃত। এই নিদ্রাকক্ষে কেউ তখন তাকে দেখতে পায় না। বেশ আরাম করে ঘুম হয় কোন রকম বিঘ্ন ছাড়াই। নিদ্রা যেন তার আজন্ম ফুল পরান , ডাকলেই এক নিমেষে এসে হাজির। পাঁচ মিনিটের মাথায় ঘড় ঘড় নাক ডাকা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু আজ কোথায় কি? অশান্তি দুশ্চিন্তা থেকে সহস্র হাত দূরে এক শান্ত শীতল পৃথিবী। আজকাল স্বপ্নগুলো কেমন ঢিলেঢালা। বয়সের সাথে সাথে শুধু চামড়া নয় স্বপ্নগুলো লোল হয়ে যায়। ছিঁড়ে যাওয়া পুঁতির মালার মতো চারদিকে ছড়িয়ে যায়। তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনে আবার একত্রিত করা সে এক ঝকমারি কাজ। লখিরামের খুব ইচ্ছে করত বড় ছেলেটা ফাইলেন পরীক্ষায় পাশ করলে কলেজে পড়বে। চাকরির জন্য নয়। চাষার ছেলে চাষই করবে। তাই বলে কি পড়াশোনা শিখবে না? পাশ করলেই আরও কয়েক বিঘা ধানি জমি কিনবে সে।সেখানে সারা বছর পুকুর চুয়ানো জল নেমে আসবে। শুখা মাটিতে চাষ করার বহুত কষ্ট। নাবাল জমি থাকলে বছরে ধান বাদ দিয়েও আরও অনেক শস্য ফলানো যায়। সারা বছর আনন্দে কাটবে। যেভাবে চেরাগের আলোটা জ্বেলে রেখেছে খিলি। তার মেয়ে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছে জাত চাষার ঘরে। ছেলে এগ্রিকালচার নিয়ে পড়েছে। চাকুরি করেনি। পাত্র দেখতে গিয়ে লখীরাম প্রথমেই জিজ্ঞেস করেছিল- এতদূর পইড়লে চাকরি বাকরি নাই কইরবে?

ছেলে উত্তর দিয়েছিল- চাষই যদি নাই কইরব তবে চাষবাস লিয়ে পইড়লম কেনে?

যাক তবু মেয়েটার তো হিল্লে হয়েছে। জামাইয়ের যেমন পেটানো শরীর কাজেও সেরকমই মতিগতি। যতদূর চোখ যায় মাইলের পর মাইল সবুজ জমি। গায়ের সবাইকে টেনে এনেছে এই কাজে। সমবায় খামার গড়েছে। যন্ত্র দিয়ে ছোট জমিগুলোকে বড় জোতে পরিণত করেছে। সেচের সুবিধা সারের সুবিধা লোনের সুবিধা দিয়ে নতুন ছেলে ছোকরাদের নিয়ে এসেছে এই কর্মযজ্ঞে। নিজের উদ্যোগে তৈরি করেছে বাজার। একার বুদ্ধি কিন্তু হাজার হাজার হাতে সামলায় এইসব কাজ। গত মাসে মেয়ের বাড়ি গিয়ে সবকিছু দেখে শুনে বুকটা ছলকে উঠেছিল আনন্দে। খিলির হাসি হাসি মুখে পিদিমজ্বলা আলো। দেখে বুঝতে পেরেছিল বেশ সুখেই আছে মেয়ে। পুকুর থেকে কেজি পাঁচেক মাছ ধরে দিয়েছিল রতন –‘ লিয়ে যাও বাবা , ই হইছে আমার লিজের হাতে চাষ করা দেশি মাছ।’

বাতাসে ফুরফুর করছে প্রাণের মহক। এই গন্ধটা হারিয়ে যাচ্ছে গা থেকে। গাঁ থেকে।

চারদিকে আমেরিকান আর ম্যাড্রাসি মাছের দাপাদাপি। সদ্য ধরা রুই মাছগুলোর দিকে তাকিয়ে বুকের মধ্যে সুড়ুত করে এক রাশ জীবনের গন্ধ ভরে নিয়েছিল লখিরাম। পেল্লায় সাইজের পুকুরের আলে বসে সে জরিপ করছিল চারপাশ। পুকুরের নীচে ধানি জমি। কে যেন সবুজ রং দিয়ে ছবি এঁকে দিয়েছে সারা তল্লাট। যতদূর চোখ যায় কচি হাতের ইশারা। ধানচারা গুলো হাত সান দেয়, কথা বলে। মন ভরে গিয়েছিল এই জাদুতে।

জামাইয়ের কাজ কারবার দেখে চোখদুটো সপুন দেখতে শুরু করেছিল। ঠিক এভাবেই সাজাতে হবে স্বপ্নটাকে। একটা বড় পুকুর, নাবাল জমি, গোয়াল ভর্তি গরু, হাস মুরগি ছাগল। সব্জিবাড়িতে সম্বছরের শাকসবজি। সবকিছু নিজের। নিজের হাতের তৈরি। জলকাদার গন্ধ লেগে থাকবে শস্যের গায়ে। এই গন্ধটুকু ছাড়া মানুষ কি বাঁচে ? নিজের গায়ের গন্ধ। নিজের ঘামের গন্ধ। একটি একটি করে ধুলোবালি মাটি সাজিয়ে তার উপর রঙ বুলিয়ে জলসেচ করে নিয়ে আসতে হবে এই গন্ধ যা তার ঠাকুরদা দিয়ে গেছে তাকে। এক আশ্চর্য পৃথিবীর স্বপ্ন।

ধীরুকে কথাটা বলতেই সে উড়িয়ে দিল ঠাট্টা করে– “তুমার অমন পেন্দা সঁপুন হুরুতে যাক। চাষবাসে আইজকাল কিছু হয় না। শুধু খাটালিই সার। আমি কারখানায় কাজ লিব। ঝা চকচকে জীবন, হিরো হুন্ডায় চাপলে লিজেকে মনে হবে সিনিমার নায়ক। ঘরে টিভি ফিরিজ আর ওয়াশিং মেশিন। ছিমছাম জীবন। কুথাও মাটির গন্ধ নাই, কাদার গন্ধ নাই।”

তর্ক করেনি লখিরাম। শুধু সবুজ চোখদুটো স্থির হয়ে গিয়েছিল সাময়িক। জানত ভবিষ্যৎ একদিন এর জবাব দেবে।

ধীরুর ইড়কানো স্বভাব তাকে থিতু হতে দেয়নি কোন কাজে। বার পাঁচেক মাধ্যমিকে ঘল্টাতে ঘল্টাতে সে যখন একদিন ঘোষণা করল – ইসব লিখপড়া আমার কম্ম লয় বাপ। তখনই স্বপ্নটা ছিচ্ছাতুর হয়ে গিয়েছিল লখিরামের – না পইড়লে কী করবি শুনি ?

“কারখানায় কাজ লিব, গুজরাট চইলে যাব। কত লোক যাইছে। কী সুখের জীবন।”

সুখ কী? কেমন তার রঙ? এই যে লোভ লালসাহীন ভালোবাসার জীবন। গাছের সাথে মাটির সাথে মানুষের সাথে, ঘরের পোষ্য প্রাণিদের সাথে পীরিতির জীবন। সবাইকে এক এক সুতোয় বেঁধে রাখে। এর চেয়ে সুখের , এর চেয়ে শান্তির ও আনন্দের জীবন আর কোথায় আছে? তাই সজোরে চিৎকার করে ছেলেকে বলেছিল- যাবিস নাই। চাষার ছিলা উপাস দিয়ে বেত ফাইড়ে মরবি তবু মাটি ছাইড়ে কুথাও যাবিস নাই।

তুমার কথায় ফাঁকা হাওয়া, তাতে প্যাট ভইরবেক নাই। প্যাট ভরাইতে টাকা লাগে।

 থাইলে একট ধান ভানা মিশিন কিনে চালা। তবু গাঁ ছাইড়ে মা ছাইড়ে কুথাও যাইস না বাপ আমার।

মেয়ের বিয়ের পর এক লপ্তে এতগুলো টাকা বের করা লখিরামের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবু মনে হয়েছিল ছেলেটাকে চাষের মায়ায় জড়িয়ে রাখার জন্য দরকার হলে সে ধারদেনা করবে। ছেলে রাজি হয়নি। একটা টাটকা তাজা স্বপ্নকে সে মিইয়ে যেতে দেখেছিল সেদিন।

কিছুদিন পর ধীরু একটা সেকেন্ড হ্যান্ড বাইক কিনল। সেটা হাঁকিয়ে দিন নেই রাত নেই ঘুরে বেড়াত। স্পঞ্জ আয়রণের কারখানায় কাজ নিল একে তাকে ধরে। সারা গায়ে কালিঝুলি মেখে সন্ধ্যেবেলায় যখন বাড়ি ফিরে আসত তখন এই কালিমাখা মুর্তি দেখে টসটস করে জল ঝরত লখিরামের চোখে।“ ই ত ভুসাকালি, ধুয়া আর বিষাক্ত ছাইয়ের গন্ধ, মাটির মহক তুই কুথায় হারাই ফেললিস ব্যাটা।” নিরুচ্চারিত কথাগুলো গুমরোতে লাগল পেটের ভিতর, চাষার ছেলে নিজের জমিতে চাষ কইরবেক কুথায় থায় তা লয় অন্যের লেবারগিরি কইরছে।

ধীরুকে এ কথা বলতেই সাতকাহন শুনিয়েছিল সে। রুখা মাটিতে কতটুকুই বা ভরসা আছে চাষবাসের। তার উপর ফসলের দাম মেলে না। নিজের মেহনতই সার। গরমে পুড়ে বরষায় ভিজে বছর শেষে যা উঠে আসে তা দিয়ে ভর্তি করা যায়না সাত সাতটা পেটের গাভা। লখিরাম আগেই জানত ছেলের থিরবীর নাই। এক কাজে বেশিদিন মন বসে না। দুমাসের মাথায় সে কাজও ছেড়ে দিল ধীরু। তারপর একদিন সিমেন্টের কারখানার কাজ নিয়ে চলে গেল ভিন রাজ্যে।

মনটা আজকাল কেমন ছটফট করে লখিরামের। তাহলে কি সবাই সবাই গাঁ ছেড়ে চইলে যাবেক শহরে? মানুষ কি সিমেন্ট খাবেক ? বিদ্যুত খাবেক ? লোহালক্কড় আর যন্তরপাতি খাইয়ে বাঁইচে থাইকবেক ? হাজার হাজার বছর আগে যখন ইসব কিছুই ছিল নাই তখন… শুধু আনন্দ লিয়েই তো বাঁইচে ছিল মানুষ।

সনাতন মাস্টারকে একদিন স্বপ্নটার কথা বলে ফেলেছিল লখিরাম- ‘’এখন ত আর আগের মতন চাষ হয় না কতকিছু লতুন লতুন জিনিস আমদানি হইয়েছে। তুমি আমারে তার হদিশ দেবে গ মাস্টার– আমি আনপড় মানুষ। ভাইবেছিলম বেটা ট লিখাপড়া শিখলে দুখ ঘুইচবেক, মাটির সাথে শিক্ষার মিশেল দিয়ে নতুন গা গইড়ব আমি। নাই হল মাস্টার। কপালে ঘি না থাইকলে শুধু শুধু ঠক ঠক কইরে কী লাভ।‘’

সনাতন মাস্টার তাকিয়েছিল অনেকক্ষণ তারপর বলেছিল –‘ তুমি চাষ নিয়ে খুব ভাব লখিরাম, আমিও ভাবি।’

‘জমি লিজের ছিলার মতন মাস্টার। লিজের ছিলারে যেমন খাওয়াতে হয় , ডাক্তার দেখাইতে হয়। তার ভবিষ্যত লিয়ে ভাইবতে হয় , তেমনি ই মাটিও।‘

সনাতন মাস্টার চুপ করে দাঁড়িয়েছিল সেদিন। খবরের কাগজ খুললে চাষীর আত্মহত্যা, উপোসী কৃষকের দেনা, অনাহার, ফসলের নাহ্য দাম না পাওয়া এসব আজ জলভাত।শূন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসেছিল তার – শেষ তক বুধন দাসও গলায় দড়ি নিল।

ইটই ত ভাবার আছে মাস্টর, সবাই চাইছে চাষাগুলা মরুক, উপাস দিয়ে না খাইয়ে মরুক, বেইজ্জতের ভার বইতে বইতে মরুক। অপমানে জ্বালায় লুকানো চাবুকের দাগ, ফালা ফালা শরীর। গা গতরে হাজার জ্বাল। কেউ দেইখতে পায় না। আমি দেইখতে পাই… যারা দেশ চালায়, যারা আইন বেনায় তারা জমি থাইকে চাষিকেই উচ্ছেদ কইরতে চায় পথমে। তাই ঘাম ঝরা ফসলের দাম পাওয়ার নাহ্য আইন হয়না। ফসলের বীজ আসে বিদেশ থাইকে। দেশী বীজের সপুন ভুইলে যায় চাষি। কেনে এমন হয় জানেন?

বিস্ময়াবিষ্ট চোখে তাকিয়েছিল সনাতন মাস্টর- কেনে ?

তুমরা ত পড়ালেখা জানা বাবু আছ, বইপড়া লক আছ, আমাদের দুখ বুইঝবে নাই। আমি ত চইখ থাইকতেও কানা। টিপছাপ দিয়া মুখ্যু লোক, কিন্তুক মাটি শুইংগে বুইঝতে পারি, বড় বড় বেনিয়ারা মানুষকে চাষ ভুলাইতে চায়, বিদেশী হাইব্রিড শস্য, একবার ফসল ফইললে সব শ্যষ, কনহ বীজ নাই, ভবিষ্যত নাই, উত্তরাধিকার নাই।নাই কলমকাঠি, ঝুলুর আর রামশাইল ধানের সপুনবীজ। চাষ উইঠলে আবার হাত পাত আবার বীজ কিনঅ, তবে চাষ হবেক। আর বীজের দাম ঠিক কইরবেক, সেই বেনিয়া লকগুলা। যারা মাটি চিনে না।যারা গাছ পাখি আর ফুল ভালবাসে না, শুধু পয়সা ভালবাসে।

সনাতন মাষ্টার হাঁ করে তাকিয়েছিল অনেকক্ষণ। মাটিতে পা রাখা মানুষটা আকাশের সমান লম্বা। খড়ের বিছানায় শুয়ে এইসব এলোমেলো সাতপাঁচ মনে আসছে তার।

 ধীরু এখন একটা কারখানায় লেবারের চাকরি নিয়ে ঘর ছেড়েছে। এতেই গদগদ হয়ে লখিরামকে আবার সাত কথা শুনিয়েছে ওর বউ – তুমার যে মুরাদ নাই , বেটা আমার তা কইরে দেখাইতে পাইরল। কী দিয়েছ তুমি? দেইখছ পথম মাসের মাইনা পাইয়ে ছিলা কিনে দিয়েছে তাঁতের লইতন শাড়ি।

লখিরাম কথা না বলে চুপচাপ বেরিয়ে এসেছিল ঘর থেকে। তারপর এই খামার। শক্ত মাটিতে শুয়ে টানটান হয়ে আছে তার শিরদাঁড়া। সমস্ত চক্রান্তের বিরুদ্ধে এ তল্লাটে সে স্বপ্নের বীজ বুনে যাবেই।এ তার সারাজীবনের প্রতিজ্ঞা।

সে বসে থাকে অনেকক্ষণ। সন্ধ্যা নেমে আসে। স্তব্ধ আকাশে সে খুঁজে বেড়ায় কিছু। কিছুই পায় না। কয়েকটা কাক উড়ে যায়। চিল চীৎকার করে ওঠে। চারপাশে পচা গন্ধ। ভাগাড়ের দুর্গন্ধ। মৃত চাষীদের গলিত কঙ্কাল পেরিয়ে সে লক্ষ্মীপেঁচাটাকে খুঁজে চলে। চাঁদের আলোয় সে দেখতে পায় অনন্তগর্ভা মাটি। তার চারপাশে নেমে এসেছে নদী। দূরবর্তী সব নৌকাগুলো ফিরে আসছে নদীপথে। মাটির কাছাকাছি। যেখানে আবহমান জলকাদার গন্ধ।

কোথাও একটা পেঁচা ডাকছে এখন।

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত