| 29 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক

ইরাবতী ধারাবাহিক: একাকিনী (পর্ব-৮) । রোহিণী ধর্মপাল

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

তিনি ভারতসম্রাজ্ঞী। অথচ পারিবারিক কোন্দল আর ঈর্ষার কারণে সভামধ্যে পরিবারের মানুষেরাই কাপড় খুলে তাঁকে উলঙ্গ করার চেষ্টা করল। রাজকোষ পরিচালনার দক্ষতা যাঁর ছিল, তাঁকে সাজগোজ করানোর কাজ নিতে হল। যাঁকে চেয়েছিল ভারতবর্ষের তাবৎ পুরুষ, তিনি নিজের বাঞ্ছিত প্রেম পেলেন না। দুইটি পুরুষের পারস্পরিক প্রতিহিংসা সাধনের কারণে তাঁর নিজের জীবন ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল। নারী যুদ্ধের কারণ? না পুরুষের অহমের আগুনে নারী বলিপ্রদত্ত জন্ম থেকেই? একাকিনী। এক নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখব তেজে ভরপুর অথচ একা এক নারীকে। আজ থাকছে একাকিনীর পর্ব-৮।


 
কুন্তী মায়ের কাছে পিতামহ ভীষ্মের নামের গল্প শুনেছিলেন দ্রৌপদী। কেমন করে দেবব্রত নামের এক সন্তান বাবার কামেচ্ছার সামনে নিজের সমস্ত ভবিষ্যতকে বলি দেয়। নিজের যা কিছু সহজে প্রাপ্য, সবটাই ছেড়ে দেয় অনাগত সৎ ভাইয়েদের জন্য। ভীষ্ম, মহা ধনুর্ধর এবং শাস্ত্রজ্ঞ। তাঁর প্রতি দ্রৌপদীরও অগাধ শ্রদ্ধা ছিল। যেমন ছিল পঞ্চ পাণ্ডবদের। কিন্তু দ্যূতসভার দিন দ্রৌপদী বুঝলেন ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ এঁরা প্রত্যেকেই কাপুরুষ এবং অর্থ ও ক্ষমতার দাস। কোনও দিন এঁদের পাবেন না পঞ্চপাণ্ডব। দুর্যোধন কর্ণ দুঃশাসন তবু নিজেদের স্বরূপটি সবার সামনে খুলে দিয়েছে। কিন্তু এই তথাকথিত ভালো মানুষেরা আসলে আরোই ভয়ঙ্কর।
 
দ্রোণাচার্য্য আর কৃপাচার্য্য, দুজনেরই জন্ম অদ্ভুত ভাবে। দ্রোণের বাবা ছিলেন মহর্ষি ভরদ্বাজ। কোনও একদিন, স্নানের সময় অর্ধনগ্ন ভেজা শরীরে ঘৃতাচী নামের এক অপ্সরাকে দেখে তিনি কামার্ত হয়ে ওঠেন এবং তাঁর বীর্য-স্খলন হয়। সেই বীর্য তিনি ধরে রাখেন একটি যজ্ঞের পাত্রে। সেই পাত্রটির নাম দ্রোণ। সেই বীর্য থেকে জাত সন্তান হলেন দ্রোণ। প্রায় একই ভাবে মহর্ষি শরদ্বান, যিনি পড়াশোনার থেকে তীরধনুক চালাতে বেশি ভালোবাসতেন, তিনি ইন্দ্রের পাঠানো জানপদী নামের এক অপ্সরা দেখে বিশৃঙ্খল হয়ে যান। এতোটাই উত্তেজিত হন যে তাঁরও বীর্য-পাত হয়ে যায়। সেই বীর্য আবার একটি শরপাতায় পড়ে দুই ভাগ হয়ে যায় এবং কৃপ আর কৃপী, এই দুই ভাইবোনের জন্ম হয়। দুটো গল্প শুনেই দ্রৌপদী মনে মনে খুব হেসেছিলেন। মহর্ষিদের যদি এত কাম থাকে, তবে গৃহস্থদের কী বা দোষ! আর যদি কোনও সুন্দরী মেয়েকে দেখলেই এমন বীর্য পড়তে থাকে, তাহলে তো এঁদের সংযম বলে আদৌ কিছু আছে নাকি, তাইই নিয়ে ভাবতে হয়! এই কৃপ আর কৃপীকে শান্তনু রাজা আশ্রয় দেন। দ্রোণকে পরে ভীষ্ম হস্তিনাপুরের রাজপুত্রদের অস্ত্রশিক্ষক নিযুক্ত করেন। এই দুজন আবার সম্পর্কে শালা-ভগ্নিপতি। কৃপী হলেন দ্রোণের স্ত্রী। সুতরাং কৃপ আর দ্রোণ দুর্যোধনের কথার ওপর কথা বলবেনই না। দুজনেই পুরোপুরি দুর্যোধনের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু মহান ভীষ্ম!! বিশেষ করে যেখানে তাঁরই পরিবারের বধূর ওপর এমন নির্লজ্জের মতো দুঃসহ আক্রমণ নেমে আসছে!
 
হ্যাঁ। দুজন পুরুষ দেখেছিলেন বটে দ্রৌপদী। সেই দিন। না,না। খুব অন্যায় হল। তিন জন পুরুষ। যখন ওই দুঃশাসন তাঁর একটি মাত্র কাপড় ধরে, তাঁর চুলের গোছা ধরে টানতে টানতে সভায় এনে ফেলেছিল, তখন সবার প্রথম তিনি রাগে অভিমানে তাকিয়েছিলেন তাঁর পাঁচটি স্বামীর দিকে। অবাক হয়ে দেখেছিলেন চারজন চোখ নামিয়ে বসে আছে! একী শিশুদের লুকোচুরি খেলা! যে চোখ নামিয়ে বসে থাকি, সামনে যা হচ্ছে হোক, আমি দেখব না! আশ্চর্য হয়েছিলেন অর্জুনকে দেখে! নিস্পন্দ হয়ে বসে! হাঃ! এই নাকি বীর অর্জুন! নিজের স্ত্রীর অপমানে যে এইভাবে বসে থাকে, সে বীরপুরুষ!! একমাত্র ভীম ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছিলেন। তাঁর হাতের আঙুলগুলো বারবার মুঠো হচ্ছিল, খুলছিল। রাগে তাঁর মুখ টকটকে লাল হয়ে যাচ্ছিল। একমাত্র তাঁকে দেখে দ্রৌপদী মনে জোর পেয়েছিলেন। কিন্তু এও বুঝেছিলেন যুধিষ্ঠিরের অনুমতি ছাড়া এইরকম পরিস্থিতিতেও বাকি চারজনের কেউই কিছু করবেন না।
 
ভীমের থেকেই পরে প্রশ্ন করে করে জেনেছিলেন দ্রৌপদী। যুধিষ্ঠির যখন সব শেষে তাঁকে পণ রূপে ঘোষণা করেন, সভার লোকেদের প্রতিক্রিয়া কী ছিল। ভীম বলেছিলেন, “কৃষ্ণা, প্রথমে তো আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারিনি। একী করলেন মহারাজ! ধন সম্পদ, তারপরে আমরা। তারপর নিজে। তাতেও থামলেন না! শেষ পর্যন্ত তোমাকে! পাঞ্চালী! সেই মুহূর্তেই আমার মনে হচ্ছিল মহারাজের ওই হাতটি পুড়িয়ে দিই। কিন্তু তখনও আমি কিছু বলিনি। আশা করেছিলাম সভার সকল মানুষ প্রতিবাদ করবেন। পিতামহ ভীষ্ম আছেন। দ্রোণাচার্য্য আছেন। কৃপাচার্য্য আছেন। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রটা কিছুই করবে না, জানতাম। কিন্তু এতজন তো আছেন! হ্যাঁ। প্রাথমিক একটা হাহাকার উঠল চারিদিক থেকে। কিন্তু কেউ তো সামনে এগিয়ে এল না! আর ওই তিনজন! দ্রৌপদী! ভীষ্ম পিতামহ হতে পারেন, দ্রোণ আমাদের আচার্য্য হতে পারেন, কৃপ আমাদের অস্ত্রগুরু হতে পারেন; মহারাজ যুধিষ্ঠির, অর্জুনরা তাঁদের এখনও শ্রদ্ধা করতে পারে, আমি পারি না পাঞ্চালী। কোনও দিন পারব না। আমি যে নিজে দেখলাম তোমাকে পণ রাখা মাত্র ওই তিন জন ঘামতে আরম্ভ করলেন। ভীষ্মদ্রোণকৃপাদীনাং স্বেদশ্চ সমজায়ত।। কারণ তাঁরা তো বুঝতেই পারছিলেন, যুধিষ্ঠির এও হারতে চলেছে। বুঝতে পারছিলেন যে তোমাকে ওরা ছাড়বে না। তোমাকে অপমান করলে আমরা সবথেকে বেশি অপমানিত হব! অথচ কিছুই করতে পারব না। কিন্তু বিশ্বাস করো কৃষ্ণা, আমি মনে মনে প্রস্তুত ছিলাম। যদি দেখতাম তুমি দুর্বল হয়ে পড়েছ, আমি সব ভুলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সবার সামনেই দুঃশাসন দুর্যোধন দুজনকেই স্রেফ পিষে মেরে ফেলতাম। আমার কাছে তোমার থেকে মূল্যবান আর কিছুই নেই।”
 
হ্যাঁ। ভীমের প্রতি সেই বিশ্বাস দ্রৌপদীর ছিল। তবে যেমন দ্রৌপদী কোনও দিন ভুলতে পারবেন না দুর্যোধন দুঃশাসন শকুনি কর্ণের অসভ্যতা, তেমন ভুলবেন না বিকর্ণের কথাও। সেদিনের ওই সভায়, যখন চতুর্দিকে কাপুরুষদের দেখছেন, তাঁর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে প্রত্যেকে মাথা নিচু করে চোখ নামিয়ে পুতুলের মতো বসে আছে, সেখানে দুর্যোধনেরই এক ভাই বিকর্ণ উঠে দাঁড়িয়ে তীব্র স্বরে বললেন, “আপনারা কেউ দ্রৌপদীর এই সহজ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছেন না কেন? আপনারা, এতগুলি গুরুজন যদি এই বিষম অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস না পান, তবে আমিই বলছি। শুনুন সবাই। মৃগয়া,পাশা খেলা, মদ আর মেয়েমানুষে অতিরিক্ত আসক্তি রাজাদের পরিত্যাগ করার কথা। যদি রাজা এই চারটি বিষয়ের কোনও একটিতেও মত্ত হয়ে কিছু কাজ করে, তবে তা অন্যায় বলেই ধরা হবে। যুধিষ্ঠির পাশাখেলায় আসক্ত হয়ে দ্রৌপদীকে পণ রেখেছেন। দ্বিতীয়ত তিনি নিজে আগে হেরে তবে দ্রৌপদীকে পণ রেখেছেন। তৃতীয়ত তাঁর নিজের দ্রৌপদীর কথা মনে আসে নি, শকুনি তাঁকে বলেছেন দ্রৌপদীকে পণ রাখুন! সব মিলিয়ে এতো জলের মতোই পরিষ্কার যে দ্রৌপদীকে দুর্যোধন মোটেও জেতেন নি”!
 
বিকর্ণের যুক্তি শুনে সভাগৃহে রীতিমত চিৎকার চেঁচামিচি হই-হট্টগোল শুরু হল। দুর্যোধনেরা খানিক থমকেও গেল। কিন্তু আবার উঠে দাঁড়াল কর্ণ। দ্রৌপদী ভাবেন কর্ণের কথা। অর্জুনের সঙ্গে কর্ণের দ্বৈরথ নিয়ে। কর্ণ নাকি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম যোদ্ধা। অর্জুনের থেকেও। অথচ অর্জুনের সামনাসামনি হয়েছেন যতবার, গো হারান হেরেছেন। দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় তো পালিয়েছিলেন। যুদ্ধের বদলে বরং এই পাশাখেলার সময় কর্ণের গলার জোর ছিল দেখার মতো। শত্রুপক্ষকে অসহায় পেয়ে যে আক্রমণ করে এমনভাবে, সে কীসের বীর! ধিক্ তার বীরত্বে! নিজেকে রাধেয় বলত কর্ণ। মা রাধার নামে নিজের পরিচয় দিত। সুযোগ থাকলে তিনি কর্ণকে জিজ্ঞেস করতেন, মায়ের নামে নিজের পরিচয় দেওয়া ছেলে কী করে আরেকটি মেয়েকে এমন অবস্থায় নগ্ন করার কথা বলে!! মাকে সত্যি সত্যিই ভালোবাসলে, শ্রদ্ধা করলে এমন কি কেউ করতে পারে! বিকর্ণকে ধমকে কর্ণ বলে উঠল, সমস্ত সভা যখন চুপ করে আছে, বোঝাই যাচ্ছে সবাই মেনে নিচ্ছেন যে দ্রৌপদী এখন দুর্যোধনের দাসী। মেনে নিয়েছেন বলেই তো চুপ করে আছেন। তুই ব্যাটা কথা বলার কে?? তোর তো বালকত্বও এখন ঘোচে নি! তুই এসছিস বড়দের মাঝে কথা বলতে! যেই মুহূর্তেই যুধিষ্ঠির তাঁর সর্বস্ব পণ রেখেছেন, সেই মুহূর্তেই দ্রৌপদীকেও পণ রেখেছেন। আর শোন্ রে! যে নারীর একাধিক পতি, সে তো বেশ্যাই। তাকে এক কাপড়ে বা ন্যাংটো করে, যেমনভাবে খুশি সভায় আনা যায়! একাম্বরধরত্বং বাপ্যথবাপি বিবস্ত্রতা”!
কুৎসিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা বোধহয় চিরকালই এমন ভাবে। রাবণ রম্ভাকে জোর করে ধর্ষণ করেছিল তার কাকুতিমিনতিতে কান না দিয়ে এই কথাই বলে, বেশ্যার আবার ধর্ম কী! বর্তমান সময়ে মহিলা মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর সহচরেরা বলে যার কাজ বেশ্যাবৃত্তি, তার ধর্ষণ তো ধর্ষণ নয়! টাকাপয়সা নিয়ে খদ্দেরদের সঙ্গে ঝগড়া! আর কর্ণ সভার সকলের সামনে অনায়াসে এই কথা বলে দিল!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত