| 10 ডিসেম্বর 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অসমিয়া অনুবাদ উপন্যাস: অর্থ (পর্ব-২২) । ধ্রুবজ্যোতি বরা

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

ডক্টর ধ্রুবজ্যোতি বরা পেশায় চিকিৎসক,অসমিয়া সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য লেখক ২৭ নভেম্বর ১৯৫৫ সনে শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন ।শ্রীবরা ছাত্র জীবনে অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ছিলেন ।’কালান্তরর গদ্য’ ,’তেজর এন্ধার‘আরু’অর্থ’এই ত্রয়ী উপন্যাসের লেখক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। ২০০৯ সনে ‘ কথা রত্নাকর’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বাকি উপন্যাসগুলি ‘ভোক’,’লোহা’,’যাত্রিক আরু অন্যান্য’ ইত্যাদি।ইতিহাস বিষয়ক মূল‍্যবান বই ‘রুশমহাবিপ্লব’দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’,’ফরাসি বিপ্লব’,’মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ’।শ্রীবরার গল্প উপন্যাস হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা, মালয়ালাম এবং বড়ো ভাষায় অনূদিত হয়েছে।আকাডেমিক রিসার্চ জার্নাল’যাত্রা’র সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ।’ কালান্তরর গদ্য’ উপন্যাসের জন্য ২০০১ সনে অসম সাহিত্য সভার ‘ আম্বিকাগিরি রায়চৌধুরি’ পুরস্কার লাভ করেন।শ্রীবরা অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি।


অনুবাদকের কথা

কালান্তর ট্রিলজির তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হল’অর্থ’। সশস্ত্র হিংসার পটভূমি এবং ফলশ্রুতিতে সমাজ জীবনের দ্রুত অবক্ষয়ের মধ্যে বেঁচে থাকার তাড়না এবং বেঁচে থাকার পথ অন্বেষণেই আলোচ্য উপন্যাসের কাহিনী ভাগ গড়ে তুলেছে। সম্পূর্ণ পৃথক একটি দৃষ্টিকোণ থেকে এখানে অসমের মানুষ কাটিয়ে আসা এক অস্থির সময়ের ছবি আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে। মানুষের অন্বেষণ চিরন্তন এবং সেই জন্যই লেখক মানুষ– কেবল মানুষের উপর আস্থা স্থাপন করতে পারে।

এবার উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ নিয়ে এলাম।আশা করি ইরাবতীর পাঠকেরা এই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত অসাধারণ উপন্যাসটিকে সাদরে বরণ করে নেবে ।নমস্কার।

বাসুদেব দাস,কলকাতা।


 

‘ বুড়োর অবস্থা দিন দিন খারাপ হয়ে আসছে দেখছি?’রুমে থাকা একটি ছেলে অন্য একজনকে বলল।

‘তিনদিন একেবারে খাওয়া-দাওয়াকরেনি।’

‘ডাক্তারকে খবর দেওয়াহয়েছে কি? সেদিন তো দেখেছিলেন। কী বললেন?’

‘ কোনো ট্যাবলেটদিয়েছিলবোধহয়।’

‘ দুটো স্যালাইন দিতে পারলে, জোর পেতেন।’

‘ কোথায় স‍্যালাইন দেবেন, জেলের  ডিসপেন্সারিতেস্যালাইন আছে কি?’

‘ আমাদের বুড়োর একটু খোঁজখবর নিতে হবে। কিছু একটা করতে হবে।’

ছেলেগুলি এবার একটু নীরব হল। একজন তাসগুলি সাফল করে সামনে রাখল, কিন্তু খেলা আরম্ভ করতে কারও ইচ্ছা হল না।

‘ তার স্ত্রীও তাকে ছেড়ে চলে গেছে,’ একজন আস্তে করে বলে উঠল।

‘ কি বলছিস? কখন? তুই কীভাবে জানতে পারলি?’

‘ দাদু জানে কিনা?’

‘ কথাটা আমি আগে থেকেই জানি,’ প্রসঙ্গটা আরম্ভ করা ছেলেটি বলছিল, কাউকে বলিনি, তাকেও বলিনি। কী আর বলব। জানতে পারলে তিনি হয়তো সহ্য করতে পারবেন না।’

ছেলেগুলি আবার নীরব হয়ে পড়ল।

‘ আমাদের ওদিকেই মানুষটার ঘর,’ প্রথম ছেলেটি আবার বলতে আরম্ভ করল, আমি সবকিছু জানি। তিনি অ্যারেস্টহওয়ার এক বছর পরেই হবে বোধ হয়, খাওয়া-দাওয়াচলাফেরায় অসুবিধা হল। কোনো এক মহাজনের গরু নিয়ে পুষছিল। কিছুদিন পরই মহাজন নিয়ে গেল। স্ত্রীর বয়স কম ছিল। কী করবে। গুয়াহাটিগিয়ে জামিনের জন্য উকিল কাছারি করতে করতে টাকা পয়সা গহনা সব শেষ হল। দুধ দোয়ানোর জন্য একজন মানুষ ছিল– তার সঙ্গেই চলে গেল।’

শেষের দিকে ছেলেটিরকণ্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে এল।

‘ এখন কেসের অবস্থা কিরকম?’

‘ পাঁচ ডজন। বেশি হতে পারে কম নয়। পাঁচ ডজন কেস আছে। সহজে বেরিয়ে আসার কোনো আশা নেই। উকিলও নেই? কে লড়বে? সব টাডা কেস। ডেজিগনেটেড কোর্টের…’ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ছেলেটি অনুচ্চকন্ঠে বলেছিল,’ এখন বেরিয়েগিয়ে কী করবে? কিছুই তো বাকি নেই । এখানেই ভালো। থাকুক।’

বুড়ো মানুষটাহঠাৎ নড়াচড়া করে উঠলেন।   উঠল।তিনি যেন পাশ ফিরতে চেয়েছিলেন,কিন্তু পারলেন না।ছেলেগুলি ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

‘দাদু,জেগেউঠেছেন?শরীর কেমন আছে? খুব বেশি খারাপ লাগছে নাকি?’

চোখদুটি মেলে বুড়ো ওদের দেখার চেষ্টা করল।ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে তিনি যেন অস্পষ্টভাবে দেখছিলেন তাকে কয়েকটি মানুষ ঘিরে ধরে আছে।

‘উঠ,উঠদাদু।একটু বসুন।’

ছেলেগুলি বুড়োকে ধরাধরি করে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল।

‘আজ তো কিছুই খান নি?’একটি ছেলে জিজ্ঞেস করল।

‘খায় নি নাকি?আমাদের সঙ্গে কিছু আছে কি?বিস্কুট?’

ছেলেগুলি লাল চা বানিয়ে আনল।বিস্কুটের একটা পেকেট বের করে বুড়োর হাতে গুঁজেদিল।চায়ের মগটা ঠোঁটে লাগিয়েদিল।ওরাধরাধরি করে দেওয়ায় বুড়ো দুটো বিস্কুট এবং দুয়েক চুমুক চা খেল।বিস্কুট আর চা খেয়ে বুড়োর খুব ভালো লাগল।বিস্কুটের স্বাদটা বড়োমিষ্টি,বড়োমিষ্ট।বুড়োর মনটা প্রফুল্ল হয়ে পড়ল।

কৃতজ্ঞ চাহনিতে ছেলেগুলির দিকে তাকিয়ে তিনি বলেছিলেন,’আমি ঘুমোই।’

ছেলেগুলি ঝেড়েঝুড়ে পেতে দেওয়া বিছানায় তিনি আনন্দিত মনে হাঁটু দুটো বুকের কাছটাতে চাপিয়ে এনে গায়ে দেওয়া কম্বলটারউষ্ণতায় তিনি যেন পরম নির্ভয়তায় মায়ের গর্ভের ভেতরে শোয়ারমতোশুয়ে পড়লেন।

ঘুমের ভাব আবার তাকে দ্রুত ঘিরেধরল।সেইতন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় তিনি স্বপ্নের মতো বাল্যকালের ছবি দেখলেন।স্বপ্ন!স্বপ্নকী?কোথায় তার আশেপাশে থাকা ছেলেগুলির শারীরিক অবস্থা তো তিনি টের পাচ্ছেন।ওদেরস্পর্শ,ওদের শরীরের ঘ্রাণ এবং ওদের অবস্থিতি সৃষ্টি করা তরঙ্গের তিনি আভাস পেয়েছেন।ওদের মধ্যে তিনি নিজের ছেলেটির মুখটাও দেখেছেন নাকি?হ্যাঁ।তাইনাকি?ঐ যে তার ছেলেটি।তার কোমল মসৃণ ত্বকের স্পর্শ-আঃ,তার অপরিচিত আপন আপন গন্ধ! তার অবস্থিতি তিনি তো সম্পূর্ণ জানতে পেরেছেন।

সেও ওদের মতোই হবে।

ছেলেটির জন্মের দুইবছর পরেই তার মায়ের মৃত্যু হয়েছিল।তিন তখন সফল তরুণ।ব্রহ্মপুত্রের বুকে এক নামহীন দ্বীপের মোষের বাথানে তিনি তখন কাজ করতেন।তখনই সংসার পেতেছিলেন।মায়ের মৃত্যুর পরে ছেলেটি তার সঙ্গেই বড়ো হয়েছিল।ছয় বছর বয়সেই সে প্রকান্ড শিং থাকা মোষের পিঠে উঠে ঘুরে বেড়াতে পারত।এক সময়ে নদী দ্বীপ ছেড়ে তিনি অরন্যের ভেতরে প্রবেশ করেছিলেন।কেন এসেছিলেন বা আসতে হয়েছিল সেসব কথা মনে নেই। তাঁর স্মৃতিতে আছে কেবল একটা ফর্সা ছেলে,ক্ষীণ,বড়ো বড়ো চোখের একটি ছেলের স্থিতি…

পাহাড়ের কাছে তিনি তখনও উঠে যান নি।মিলিটারি শিবিরটার পাশের জায়গাটাতে ছিলেন। জায়গাটাতে ছিল দুটি ছোটো ছোটো ঘুমটি দোকান, দুটি ধাবা। তাতে বিদ্যুতের বাতি জ্বলছিল। রাতে বাইরে পেট্টোম্যাক্স লাইট জ্বালিয়েঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। বড়োবড়োট্রাকগুলি এসে সেখানে দাঁড়িয়েছিল। তারই একটি ধাবায় তার ছেলেটি একদিন কাজে ঢুকে ছিল। ধীরে ধীরেছেলেটিবাড়িছেড়েধাবাতেই থাকতে শুরু করেছিল। সে ভালোভাবেরান্নাবাড়া করতে শিখিছিল। দীর্ঘ দেহী পাঞ্জাবিরড্রাইভার গুলি খাওয়া গরম গরম ফুলকা, তরকা এবং শাক দিয়ে মুরগির মাংস বানাতে শিখেছিল। লাই, সরষে,মাটি কাদুরি,খুতরা, লংকা এই সমস্ত কিছু মিলিয়ে মাংস বানাতে শিখেছিল। বড়ো গোটা একটা পেঁয়াজ একটা কাঠের তৈরি যন্ত্রে এক হাতে চেপে ধরে একটা বাটিতে  রস বের করতে শিখেছিল। ছেলেটি যুবক হয়ে পড়েছিল।

বড়ো ভালো রাঁধত সে। একবার সে বাবাকে তার হাতের রান্না খাইয়েছিল।

ছেলেটি দিনরাত ধাবায় পড়ে থাকতে শুরু করায় বুড়ো নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিল। তখন সে লোকের বাড়িতে গরুর দেখাশোনা করত। মহাজনের গরুর। পাহাড়েরহেলানোগায়ে বানানো তার ছোট্ট কুঁড়েঘরটির কাছে, স্বর্ণতরু গাছের নিচে হেলান  দিয়ে তৈরি গোয়ালঘরটা তখন ছিল না। তার অনেক পরে এসে গোয়াল ঘর বানিয়ে মহাজনের হাত থেকে গরু নিয়েপুষতে  আরম্ভ করেছিল।

আর একটা সময়ে নিঃসঙ্গতা পূরণ করার জন্য তিনি ধন মায়া কে নিয়ে এসেছিলেন।

ইস কী অদ্ভুত যোগাযোগের মধ্য দিয়ে ধন মায়া তার জীবনের এসেছিল! অনাথ মেয়েটি এসে তার জীবনটাকে বদলে দিয়েছিল।

কিন্তু ধনমায়া আসার পরে ছেলেটিও বদলে গিয়েছিল। রাতের ভেতরে সে যেন তার থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিল।

বুড়োর মনটা ধড়ফড় করে উঠেছিল– ঘুমের মধ্যে কথাটা মনে পড়ে বুকটা ধপধপ করে উঠেছিল। বুকের খাঁচার মধ্যে একটা পাখি যেন ধড়ফড় করছিল, খাঁচা ভেঙ্গেবেরিয়ে যাবার জন্য হুলস্থূল  করছিল। জিভটা প্রচন্ডভাবেশুকিয়েগিয়েছিল। বুড়োর খুব তৃষ্ণা পেয়েছিল– একটু গরম জল পেলে। কপাল এবং গলা থেকে গল গল করে ঘাম বের হতে শুরু হয়েছিল।

ধনমায়া আসার এক বছর পরেই কাউকে কিছু না জানিয়েছেলেটিধাবাছেড়ে চলে গিয়েছিল। বড়োট্রাকে উঠে উঁচু লম্বা ড্রাইভারের সঙ্গে সে কোথায় যেন চলে গেল। ধনমায়া আসার পরে সে একবারও বাড়িতেআসেনি।– না, একবার মাত্র এসেছিল। মাত্র একবার। এক রাত সে বাড়িতে ছিল। তারপর সে আর কোনো দিন বাড়ি আসেনি। আগে সে কখনও কখনও আসত, রাতে কখনও বাড়িতেও থাকত। বুড়োর একবার ম্যালেরিয়া হওয়ার সময় সে ধাবাছেড়ে কয়েক দিন বাড়িতে থেকে বাবার পরিচর্যা করেছিল। কুইনাইনের বড়িখাইয়েছিল। তখন বাড়িতে একটা গাভী ছিল। তখন সেই বুড়িগাভীটি মহাজনের কাছ থেকে সে পালতেএনেছিল। সেই গাভীর দুধ দিয়ে ক্ষীর বানিয়ে সে বাবাকে খাইয়েছিল।

সে চলে যাবার বারো বছরের বেশি হয়ে গেল। তার চেয়েবেশিহয়েছে। ছেলেটি বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে এক যুগের বেশি হয়ে গেল।

থাকলে সেও এখন এই ছেলেগুলির বয়সী হত।

তন্দ্রাচ্ছন্ন বুড়ো-র বুক থেকে একটা বাষ্প ঘন বাতাস গোঙ্গানির আকারে বেরিয়ে এল। তিনি নিঃশব্দে ছেলেটিকে ডাকতে লাগলেন– বাবা, তুই আমার কাছে ফিরে আয়। বুড়োর এরকম মনে হল যেন ছেলে এক ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মধ্য দিয়ে ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছিল– চোখের সামনে থেকে চলে যাচ্ছিল এবং তিনি চিৎকার করে উঠেছিলেন,’ যাবিনা, বাবা, তুই দূরে চলে যাস না।’

বুড়ো মানুষটা বিছানায় ধড়ফড় করে উঠল।

‘ কী হয়েছেদাদু ,কীহয়েছে?’ ছেলেগুলি ব‍্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল ।

উঠুন । রাত হয়েছে ।কিছু একটা খেয়ে নিন।’

ওরাবুড়োকে পুনরায় বসিয়ে দিল। জেলের ভাত এবং ডালের জল মেখে বানানো একগ্ৰাস তারা ধীরে ধীরে তার মুখে ঢেলে দিল। কোন ধরনের প্রতিবাদ না করে তিনি খাবারটা গিলতে লাগলেন। আর একটা সময় গিলতে না পারায় তার দুই কোয়াদিয়ে খাবার বেরিয়ে এল। ছেলেগুলি কী বলছিল তিনি কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। তার শুধু শোবার ইচ্ছা করছিল। চোখ জোড়া ঘুমে জড়িয়ে এসছিল। তাকে বারবার ঘুম অচেতন করতে চাইল।

‘ এতক্ষণ ধরে শুয়ে থাকা ভালো নয়,দাদু। একটু বসুন।’

‘ মুখটা মুছে নিন।’

ছেলেগুলি  কিছু একটা বলছে, কিন্তু কী বলছে তিনি কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। বহুদূর থেকে অস্পষ্টভাবে যেন ভেসে আসছিল ওদের কথাগুলি। ভেজা গামছা দিয়েওরা তার মুখ মাথা গলা এবং শরীর মুছে দিলে একটু সতেজ মনে হলো জেলের ঘরের এক কোণে স্টোভজ্বালিয়ে কেউ এক কাপ গরম হরলিক্স করে এনে দিল। বুড়ো খুব ধীরে ধীরেদেওয়ালে হেলান দিয়ে হরলিক্সটুকু খেল। এবার শরীরটা সত্যি অনেক ভালো লাগল। চোখ দুটো ভালোভাবে মেলে ধরে বুড়ো ছেলেগুলির দিকে তাকাল- ওরা তার দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়েআছে।তাঁর এরকম মনে হল যেন সেই ছেলেগুলির মধ্যে তার নিজের ছেলেটিও আছে– সেও যেন তার দিকে অধীরভাবেতাকিয়ে রয়েছে। বুড়োর মন ভালো হয়ে গেল, এক ধরনের নিরাপত্তার উষ্ণতা তার মনটাকেভরিয়ে তুলল। তিনি ছেলেগুলির ভিড়ের মধ্যে থাকা নিজের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে সুন্দর করে হাসলেন ।তারপরে চোখ দুটি পুনরায় বন্ধ হয়ে এল।

দে, দে দাদুকে ভালোভাবেশুইয়ে দে। পুনরায় ঘুম পেয়েছে,’ কেউ একজন বলল।

ছেলেগুলি ধরাধরি করে তাকে বিছানায় শুইয়ে গায়ে কাপড় জামা চাপিয়ে দেওয়াটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। গুঁজে দিচ্ছিল এবং বুড়ো মানুষটা পুনরায় শিশুর মতো হাঁটু দুটো বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

তিনি আবার স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করেছিলেন।। বিভিন্ন টুকরো ছবি তার মনে ভেসে আসছিল– সতেজ ছবি। ঠিক সিনেমার মতোএকটার পরে আরেকটা করে।বড়ো সতেজ ছিল সেই ছবিগুলি।বড়ো স্পষ্ট সবুজ পাহাড়ের হেলানো গায়ে চাষের জমির খন্ড গুলির উপরে অস্তায়মান সূর্যের আলো পড়েছিল- সোনালি রঙের আলো। আর সেই আলোতে সমগ্র পাহাড়, চাষের জমি, ভুট্টার গাছগুলি এক অপূর্ব স্বর্গীয় রঙের সমারোহে বর্ণময় হয়ে উঠেছিল। উজ্জ্বল আলোতে জ্যোতিষ্মান হয়ে উঠেছিল পৃথিবী।

আকাশটা ছিল উজ্জ্বল নীল হলদে এবং গোলাপী চাষের জমি সোনালি- কমলা- উজ্জ্বল সবুজ- গাছগুলি ঘননীলবেগুনি এবং গোলাপী… …

কী অপূর্ব!

এই রকম বর্ণময় পৃথিবীর রূপ মন বাহাদুর আগে কখনও দেখেনি।

হ্যাঁ তার বাড়ি থেকে যে উঁচু পাহাড়টা দেখা যায় এটা সেই পাহাড়টাই– ইস এত উজ্জ্বল দ‍্যুতিতে ভাস্বর…   …

এক অনিবর্চনীয় আনন্দের স্রোত যেন তার  সমগ্র মনকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল– তিনি শিশুর মতো আশ্চর্য হয়ে পাহাড়টার দিকে তাকিয়ে ছিলেন…   …গাভীগুলি হাম্বা রবে ডাকছিল।

ধোঁয়ার মতো ঘিরে ধরা  কুয়াশার মধ্য দিয়ে তিনি ওদেরহাম্বারব শুনতে পেয়েছিলেন। ভোর হয়েছে? হয়েছে নাকি? তিনি ভাবছিলেন। দুধ দোয়ানোরসময়হয়েছে, দুধের ভারে গাভীগুলি হাম্বারবে  ডাকছিল– খোয়াড়ে ভরে রাখা বাছুর গুলির কোমল কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছিল, ওদের ক্ষুধা পেয়েছে।

গাভী দোয়ানোর সময় হয়ে গেছে‐- দুধ দোয়ানোর সময়।

মন বাহাদুর ধড়মড় করে বিছানা থেকে উঠতে চাইছিলেন‐- নাতিনিউঠতেপারেননিউঠতেপারছিলেননা।তারকপালেবিন্দুবিন্দুঘামফুটেউঠছিল।

স্বর্ণতরু ফুটেছিল। সমগ্র গাছটা যেন হলদে ফুলের ভারে নুয়েপড়েছিল। গাছটা যেন পুরোপুরি ডাল পালাগুলি মেলে দিয়েছিল। গাছ থেকে ঝরে পড়া ফুলগুলি গাছের গোড়ায় পেতে দিয়েছিল  একটি সোনালি রঙের কার্পেট। সন্ধ্যার ফটফটেজ্যোৎস্নায়  ধনমায়া তাকে স্বর্ণতরূর গাছের নিচে বানিয়েনেওয়া বাঁশের  চাঙটাতে রাতের আহার খেতে দিয়েছিল‐- ধোঁয়াউড়তেথাকাএকথালাগরমভাত।

ছেলেগুলি এসেছিল দুটো পাহাড়ের মধ্যে জঙ্গলে ঢুকেযাওয়ার আগে ওরা তার বাড়িতেআশ্রয়নিয়ে বিশ্রাম নিয়েছিল।বাইরেরচাঙটাতেওরা বসেছিল। জলচেয়ে কিংবা দুধ কিনে খেয়েছিল। ওদের জন্য সে দোকান থেকে বেশি করে চিনি কিনে এনে রাখত। ধনমায়াওদের দুধ গরম করে দিত। গরমের দিনে দই খেত। দই বা দুধের সঙ্গে করা সবসময় চিনি চাইত। কোলাহল করে ওরাপাহাড়ের পাশে কথা বলত।

বন্দুক গুলি, পিঠের ঝোলা গুলি ওরা বারান্দার ওপরে বেড়ায় হেলান দিয়ে রাখত।

পরবর্তীকালে একটা জগে দুধ নিয়ে সে নিজেই প্রতিদিন ওদেরকে দুধ দিয়ে আসতে শুরু করেছিল। সেই দিনগুলোতে সেই অপরিচিত ছেলেগুলি বড় আপন হয়ে পড়েছিল তার। কেন জানি মনে হয়েছিল যে তার হারিয়ে যাওয়ার ছেলেটিও তিনি একদিন ওদের মধ্যেই খুঁজে পাবেন। নিরুদ্দেশ হওয়া ছেলেটিকে খুঁজে পাবে সেই জঙ্গলের মধ্যে শিবির বানিয়ে রাখা ছেলেগুলির মধ্যে…  …

বুড়োহঠাৎ গোঙ্গাতে শুরু করল।

কেউ দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে একটা মোম ধরাল। মোমের আলোয়মশারি তুলে বুড়োকে দেখল একটা ছেলে। না তো, সবই ঠিক আছে ,নিঃসারেশুয়ে আছেন তিনি। কেবল কপালটা ঘাম ছিল এবং শীর্ণ বুকটা  কাপড়ের স্তূপের নিচে দ্রুত উঠানামা করছিল। ধনমায়া,ধনমায়া এসেছিল। 

ঐ যে,ঐ যে,ঐ তো ধনমায়া, বেগুনি পথ দিয়ে সে ধীরে ধীরে পা ফেলে আসছিল।

পাহাড়ের পাশের ঘরটাতে থাকার সময়  প্রথম দিন যেভাবে এসেছিল, সেভাবেই সে আসছিল। স্বর্ণতরু ফুলের গালিচা মাড়িয়ে সে আসছিল–তার গায়ের গহনা গুলি রুনুঝুনু করে বাজছিল। কমলা রঙের পাহাড়টার পাশের বেগুনি পথ দিয়ে সে আসছিল– পথের পাশের ঘন নীল ঘাসের পাতায় ঢেউ তুলে…   …

বহুদিন চেষ্টা করে তাকে মনবাহাদুর নিজের কাছে আনতে পেরেছিল। কত মানুষকে লাগিয়েছিল সে, কত চেষ্টা করেছিল…  … ধনমায়া, ধনমায়া!

লজ্জিতভাবে সে তার কাছে এসে বসেছিল। তার বাহুর সজোর আকর্ষণে কোমল হয়ে তার বুকের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল– তার চুলে ছিল গন্ধ তেলের গন্ধ আর শরীরে ঠোঁটে নিঃশ্বাসে দুধের ফেনার সুবাস।

কাঁচা দুধের ফেনা আর হলুদের গন্ধ তার শরীরে।

বুড়ো আবার একবার গুঙ্গিয়ে উঠল– একটা আহত পশুর মতো শব্দ বের হল তার খুলে যাওয়া ঠোঁট দুটি থেকে। ঘরের ছেলেগুলি তখন গভীর ঘুমের কোলে ঢলে পড়েছিল।

মনবাহাদুরের বুকটা তখন খুব জোরে ধপধপাতে আরম্ভ করেছিল। ধপধপানির শব্দটা ক্রমে বেড়ে গিয়ে দুটো কানে তালা লেগে যাচ্ছিল। নিঃশ্বাস নেওয়া কষ্টকর হয়ে পড়ছিল…  …

ধনমায়া তাকে একটা লতার মতো জড়িয়ে  ধরেছিল। নিবিড় থেকে নিবিড়তম হয়ে পড়ছিলওদের আলিঙ্গন। চারপাশের পাহাড়, অরণ্য, জোৎস্না, অন্ধকার এবং খসেপড়তে চলা, ফুটতে চলা ফুলগুলি কিছুক্ষণের জন্য স্থির হয়ে গিয়েছিল, স্তব্ধ হয়েছিল বাতাস আর বিষ্ময়ে পৃথিবী অপেক্ষা করছিল…   …

আঃ আঃ কী আনন্দ বুকের মধ্যে হৃদপিণ্ডটা যেন ফুলে উঠেছিল মস্তিষ্কের মাঝখান থেকে শরীরের প্রতিটি কোষে কোষে বইতে আরম্ভ করেছিল এক অসহনীয়অনিবর্চনীয় পুলক। এক স্বর্গীয়অসহ্যকরঅনুভূতি।আঃ আঃ…   … 

জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে থাকা মানুষটাচিৎকার করে উঠতে চেষ্টা করল– নিঃশব্দ ভাবে তার মুখটা খুলে গেল। নাকের পাটা দুটি ফুলে উঠল। গলার কাছে চ্যাপ্টা পেশী গুলি প্রকট হয়ে পড়ল– নিমিলিত চোখ জোড়া অর্ধেকটা খুলে গেল। জেলের  নগ্ন, নিঃসঙ্গ ঘরের ভেতরে, পুরোনো কম্বল পেতে  নেওয়াবিছানাটার উপরে, মানুষটা এবার হাত পা গুলি টানটান করে মেলে ধরল…  সকালের পৃথিবীটা ছিল আশ্চর্য ধরনে শান্ত।

জেলের সীমানার বিরাট বিরাটকৃষ্ণচূড়া কাজগুলির পাতার মধ্য দিয়ে ছিটকে আসা সকালের সূর্যের আলো বন্ধ ঘরের সংকীর্ণ জানলা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছিল। ছেলেগুলি ঘুম থেকে উঠে হাতমুখধুতেতাড়াহুড়োলাগিয়েছিল। ঘণ্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের দরজার তালা খুলে দেওয়া হবে। তখন হুড়মুড় করে প্রত্যেকেই মুক্ত আকাশের নিচে বেরিয়ে যাবে।

বিছানাগুলি গুছিয়ে রেখে প্রত্যেকেই যাবার জন্য প্রস্তুত হল।

মশারির ভেতরে কম্বল গায়েদিয়ে নিথর হয়ে পড়ে থাকা বুড়ো মানুষটি কে দুই একজন উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখছিল। তাকে জাগিয়ে দেবার জন্য ওদের ইচ্ছা করছিল না।

বুড়োমানুষটি কিন্তু তখন জেল থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিল।

নিঃশব্দে এবং একা। ছেলেগুলি তখন জানতে পারেনি।

বুঝতে পারেনি যে ধোঁয়াউড়তে থাকা একথালা গরম ভাত, ধবধবে জ্যোৎস্না, নিস্তব্ধ রাতের অপরিচিত ফুলের সুঘ্রাণ, স্নেহের বেদনা এবং মৈথুনের মাদকতাকে স্মরণ করে মুক্তির প্রতীক্ষায় থাকা মানুষটা কখন জেলের বন্ধ ঘর থেকে বাইরে বেরিয়েগিয়েছিল …

আর ওরাহয়তো কখনও জানতেও পারবে না…  …

তার শরীরের জ্বর ঘাম তখন শুকিয়েগিয়েছিল।

অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ঘাম বের হওয়া।

তার চোখে মুখে ভেসে ছিল মাত্র এক পরিতৃপ্তশ্রন্তির আবেশ…   …

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত