| 18 এপ্রিল 2024
Categories
শারদ সংখ্যা’২২

শারদ সংখ্যা শিশুতোষ গল্প: বুলি দুলির গল্প । মলয় সরকার

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

সেদিন সকালে বুল্টি বাগানে ফুল দেখতে গেছে।এটা ওর অনেক দিনের অভ্যেস। বাবা কত যত্ন করে বাগান করে, গাছ লাগায়, বাগান পরিষ্কার করে নিজের হাতে।আর সকালে কোনো গাছে ভাল ফুল হলে, কি কোন ফল ধরলে, হাসি হাসি মুখে মাকে এসে খবর দেয়, আজ অবশ্যই দেখো আমার বাগানে কেমন শশা ধরেছে, কি নাইট কুইন ফুটেছে, কিংবা গোলাপ কি ক্যাকটাসের কুঁড়ি দেখা গেছে।যেদিন এরকম হয় বাবার মনটা খুব খুশী থাকে।বাবার বাগানে কত রকমের গাছ।কত পাখি আসে, বাসা বাঁধে সেখানে।

বাবাই ওকে বলেছে, ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে, বাগানে গিয়ে গাছ আর ফুল দেখতে।তখন নাকি ফুলেরা ঘুম থেকে জাগে। আমাদের চোখ খোলার মত ওরাও আস্তে আস্তে চোখ খোলে আর সারাদিন চেয়ে চেয়ে সব কিছু দেখতে থাকে।ওরা তো কোথাও যেতে পারে না, তাই ওদের কাছে কোন বন্ধু এলে ওরা খুব খুশী হয়।ওরা গান শুনতে, হাওয়ায় দোল খেতে খুব ভাল বাসে।তাই তো, ভোরবেলা দোয়েল, কোকিল, বুলবুলি,টিউ টিউ পাখি এই সব পাখিরা শিস দেয়, গান ধরে। মৌমাছি ভোমরারাও না কি গান করে ফুলের কানে কানে।বুল্টি একদিন খেয়াল করে কান পেতে শুনেছিল, ওয়া কেমন একটা ভোঁ ভোঁ আওয়াজ করে।ওটাই নাকি ওদের গান।আর ওরা এলেই ফুলগুলো মাথা দোলাতে থাকে।

ফুলেরা তো বেশি দিন বাঁচে না। কেউ এক দিন মাত্র, কেউ বা একটু বেশি। তাই ওরা এই অল্প সময়ে কেউ দুঃখ করে বাঁচে না।যেটুকু সময় থাকে, নিজেরা আনন্দ করে সবাইকে আনন্দ দিয়ে চলে যায়।বুল্টি বলেছিল, আচ্ছা, ওরা কি করে সবাইকে আনন্দ দেয়? বাবা বুঝিয়েছিল, কেন, দেখ নি, কত পাখি আর রঙীন প্রজাপতি, মৌমাছি  আসে সারাদিন ওদের সাথে খেলতে, গান শোনাতে।ওরাও তাদের গন্ধ, মধু সব দেয়।সেই মধু খেয়ে ওরা খুশী হয়ে চলে যায়।ওরা এক ফুলের খবর দেয় অন্য ফুলকে আবার তার খবর দেয় আর এক ফুলকে।ফুলেরা তো নিজেরা কেউ কারোর কাছে যেতে পারে না।তাই তাদের এই খবরাখবর দেওয়ার, জিনিস দেওয়া নেওয়ার কাজ করে দেয় ওই প্রজাপতি আর মৌমাছিরা। আমাদের যেমন কেউ চিঠি পাঠালে বা কোন কিছু পাঠালে, সেটা পোস্ট অফিসের পিয়ন বা ‘কুরিয়ার’ এর ছেলেরা ঘরে দিয়ে যায়, অনেকটা সেই রকম আর কি।ফুলেরা সকাল থেকেই অপেক্ষা করে, কখন বন্ধুরা আসবে। যার কাছে কেউ আসে না সারাদিনেও, সে খুব মনের কষ্ট পায়। বুল্টি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, ফুলেরা আবার বন্ধুকে কি পাঠাবে?ওদের কিছু আছে নাকি? বাবা একটা ফুলের কাছে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছিল, ওরা এক রকম হলুদ গুঁড়ো তৈরী করে রাখে অন্য ফুলের জন্য।আর মৌমাছিরা তাদের চিরুণী পা দিয়ে আঁচড়ে সেই হলুদগুঁড়ো তুলে নেয় তাদের পায়ের সাথে আটকানো থলিতে। তারপর তা পৌঁছে দেয় অন্য ফুলের কাছে। এজন্য দুজনেই তার দাম হিসাবে ওদের মধু খেতে দেয়।কাজেই সবাই খুশী হয়। প্রজাপতিরাও একই কাজ করে একটু অন্যভাবে।এই হলুদ গুঁড়োগুলোকে বলে পরাগ।বাবা বেশ সুন্দর করে গল্পের মত করে বুঝিয়ে দেয়।

সেই থেকে বুল্টির একটা কেমন নেশা হয়ে গেছে, এই ভোরবেলা এসে প্রথমেই ফুল দেখার।খুব ভাল লাগে ওর।মনটা বেশ ভাল হয়ে যায়। ও চেষ্টা করে বাবারও আগে বাগানে এসে ফুল আর গাছ দেখার। কিন্তু প্রায়ই সেটা পেরে ওঠে না।

সেদিন, বুল্টি সত্যিই বাবার আগে উঠে মুখ ধুয়েই বাগানে হাজির।

ও মা, একটা এতটুকু ছোট্ট পাখির বাচ্চা পড়ে রয়েছে মাটিতে আর চিঁ চিঁ করে চেঁচাচ্ছে। ও তাকিয়ে দেখে একটা বেড়াল দূর থেকে এগোচ্ছে পাখির বাচ্চাটার দিকে।বুল্টি চট করে গিয়ে, পাখির বাচ্চাটাকে হাত দিয়ে ধরে তুলে নিল।না হলে এখনই বেড়ালটা খেয়ে ফেলবে যে।ও বাচ্চাটাকে তুলে ধরে দেখে ওর গায়ে পালক খুব বেশি বেরোয় নি।উড়তে বা ডাকতেও ভাল করে পারে না। 

   

বুল্টি বাচ্চাটাকে তুলে নিয়ে এল ঘরে।দেখাল বাবাকে।বাবা দেখেই বলল, এটা তো বুলবুলির বাচ্চা। কোথায় পেয়েছ? ও বলল, বাগানে গাছের নীচে। বাবা বুঝিয়ে দিল, হয়ত বে-কায়দায় বাসা থেকে পড়ে গেছে। আবার না কি এমনও হয়, কোন খুঁতওয়ালা বাচ্চা হলে তাকে মা পাখি সরিয়ে দেয়, যত্ন করেনা।

যাই হোক,বুল্টি বাবাকে বলে একটা সুন্দর রঙীন তারের খাঁচা নিয়ে এল। পাখিটাকে তার মধ্যে রেখে কিছু ধান, কিছু পাকা ফলের টুকরো ইত্যাদি আর একটা বাটিতে জল রেখে দিল।

পাখিটার ভয় ভেঙে যেতেই একটু পরে ছোট ছোট ঠোঁট দিয়ে খাবার, জল খেতে লাগল।

দুদিন যেতে না যেতেই পাখিটা বুল্টিকে যেন চিনে গেল।ওকে দেখতে পেলেই ও গোটা খাঁচায় উপর নীচ করে ছটফট করতে থাকে আর ওর দিকে তাকিয়ে কি যেন বলার চেষ্টা করে।বুল্টি বোঝে,ও যেন কিছু বলতে চায়।বুল্টি ওকে খাঁচা থেকে হাত দিয়ে বের করে দিতেই, ও ওর ঘাড়ে উঠে এসে বসল।ওর দিকে তাকিয়ে যেন কত কথা বলতে চাইছে। উড়তে তো পারে না। তারপর নেমে গোটা ঘর ঘুরতে লাগল নির্ভয়ে।

রোজ এইভাবেই ঘোরে আর খাঁচা খোলাই থাকে।ইচ্ছা হলে ঢুকে গিয়ে দাঁড়ে বসে ঘুমোয়। 

মা বলল, বুল্টি, দেখিস, দরজা জানালা বন্ধ করে রাখবি যখন ও খাঁচার বাইরে থাকে, নাহলে বিড়াল কি কিছু  ধরে নেবে ওকে।

বুল্টি অবশ্য সতর্কই থাকে। ও ওর নাম দিল বুলি।কদিন পরে বুলি বলে ডাক দিলেই ও মুখ তুলে তাকাতে শিখল। একটু একটু করে বুলি বেশ পোষ মানা প্রাণীর মত তার হাবে ভাবে ইচ্ছা অনিচ্ছা ভাললাগা মন্দলাগা সব বুঝিয়ে দিতে পারল। 

বুল্টি যখন পড়ে, তখন ও চুপ করে ওর বইয়ের উপর গিয়ে বসে থাকে।ও যখন খেলে, বুলি তখন ওর ঘাড়ে মাথায় ওঠে নামে, ওর সঙ্গে খেলে।

আবার একদিন, এরকম বাগানে গিয়ে বুল্টি দেখে সকালে আবার একটা পাখির বাচ্চা পড়ে আছে।সাদায় কালোয় মাখা।বাবাকে দেখাতেই বাবা চিনিয়ে দিল, এটা হচ্ছে, দোয়েলের বাচ্চা।

সুন্দর পাখিটা।বুল্টির খুব ভাল লাগল দেখে, যদিও ওর গায়ে তখনও ভাল করে লোমও গজায় নি। বুল্টি তো এখন এইসব পাখির বাচ্চা মানুষ করায় এক্সপার্ট হয়ে গেছে।

ও তুলে এনে বাচ্চাটাকে আগের মতই খাঁচায় রাখল। এটা কিন্তু খুব ভয়ে ভয়েই ছিল। 

বুলি তো এখন বেশ একটু বড় হয়ে গেছে। চঞ্চলও হয়েছে। ওর কিন্তু এই একই খাঁচার ভিতর নতুন আগন্তুককে বোধ হয় খুব পছন্দ হয় নি। ও নতুন বাচ্চাটার কাছ থেকে দূরে দূরেই থাকছিল।কখনও বা একটু ঠুকরে দিচ্ছিল।আর নতুন বাচ্চাটা ভয়ে গুটিসুটি মেরে বসেছিল।

এই দেখে বুল্টি, বাবাকে বলে আবার একটা খাঁচা আনাল।মা বলল, এবার মনে হচ্ছে, বুল্টির লেখাপড়া শেষ হবে।

বাবা মুচকি হাসল। ও জানে, বাবাও এই পাখি, ফুল খুব ভালবাসে।মা-ও যে বাসে না তা নয়। বাবা মাঝে মাঝে বলে, শুধু বই পড়েই সব কিছু শেখা যায় না।প্রকৃতি, আকাশ গাছ পালা সব কিছু থেকেই শেখার আছে।এ সব ব্যাপারে বাবার খুব উৎসাহ। ওর মনে আছে, বাবা একবার শীতকালে পাখি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল, সাঁতরাগাছির ঝিলে।বাবা চিনিয়েছিল কোনটা নর্দান পিন্টেল, কোনটা হুইসলিং বার্ড, কোনটা গাডওয়াল।কিংফিশার বা মাছরাঙ্গাও দেখেছে ও।দেখেছে আরও কত পাখি।বাবা একটা পাখি চেনার বইও কিনে দিয়েছে।

নতুন বাচ্চাটাকে নতুন খাঁচার ভিতর রাখতে ও কিছুটা স্বচ্ছন্দ হল।একদিন জানালার ধারে নতুন বাচ্চার খাঁচাটা ঝুলিয়ে রেখেছিল।বুল্টি আশ্চর্য হয়ে দেখে, ওর মা খাঁচার বাইরে থেকে এসে ওকে ঠোঁটে করে কিছু খাওয়াচ্ছে। বুল্টি চুপিচুপি সরে গিয়ে দৌড়ে ওর মাকে ডেকে আনল।

মা বুল্টির মাথায় মুখে আদর করে চুমা খেয়ে বলল, দেখেছ, মায়েরা এরকমই ছেলেদের আদর করে। নিজের সন্তানকে চিনতে পেরে কেমন এসে খাইয়ে যাচ্ছে।আর বাচ্চাটা আগ্রহ ভরে খেয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর সব মা-ই এরকম হয়।সে বাঘ সিংহই হোক আর পাখি কিংবা মানুষ।

 সেদিন থেকে বুল্টি ঠিক সময়ে দিনের বেলায় জানালায় ঝুলিয়ে রাখতে শুরু করল।আর ওর মায়ের দেওয়া খাবার পেয়ে বাচ্চাটাও বেশ চনমনে হয়ে খুব তাড়াতাড়ি বেড়ে উঠতে লাগল। বুল্টি এর নাম রাখল বুলির সঙ্গে মিলিয়ে, দুলি।

বুল্টির সংসারে বুলি আর দুলিকে নিয়ে সুন্দর কাটতে লাগল।ওর বেশ ভালই খেলার সঙ্গী হয়েছে এরা।এখন বুলির দেখাদেখি দুলিও খাঁচার থেকে বেরিয়ে সারাদিন গোটা ঘরে ঘুরে বেড়ায় আর খেলা করে। মাঝে মাঝে দুটোতে ঠোকরা ঠুকরি করে।বুলি বড় বলে বড়ত্ব ফলায় ওর উপরে।দুলিই বা ছাড়বে কেন। এই অন্যায় ও-ও মানে না। বেশ আছে দুজনে।

বুল্টি একা নয়, মা বাবারও বেশ মায়া পড়ে গেছে ওদের উপর।ঠিক সময়ে খাবার বা জল না পেলে ওরা ঠিক জানান দেয়। দুলিও এখন ভালই ডাকতে শিখেছে। বুলির কিন্তু নিজের ডাক এতদিনেও ঠিক আসে নি।

স্কুল থেকে ফিরেই বুল্টি ওদের খোঁজ খবর নেয়। যত্নআত্তি করে। ওরাও যেন অনেকক্ষণ বাদে ওকে দেখে আনন্দে নেচে ওঠে।

এর মধ্যে দেখা গেল, দুলি যতটা বেড়েছে বা যেমন সুন্দর ওর ডানায় রঙ ধরেছে বুলির যেন তেমনটি নয়।বুদ্ধিতে সে চৌখস কিন্তু চেহারা ভাল আর হয় না। ডানায় তেমন জোর নেই, লোমগুলোও কেমন খাওয়া খাওয়া। উড়তে আর পারে না। লাফিয়ে লাফিয়েই সারা ঘর ঘুরে বেড়ায়।

বুল্টি বাবাকে বলে, ওর জন্য ওষুধ পত্র ব্যবস্থা করে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না।

দুলি এখন ঘরময় বেশ একটু উড়তে পারে। কখনও খাটের উপর বসে, কখনও আলমারীর উপরে। আবার ডাকলে নেমেও আসে। কাজেই ও যখন খাঁচার বাইরে থাকে ঘরে সব ফ্যান বন্ধ রাখতে হয়। নইলে চলন্ত ফ্যানে লেগে মরে যাবে যে। এখন আর ওর মা খাওয়াতে আসে না। ও বড় হয়ে গেছে তো।এখন ও নিজেই বুল্টির দেওয়া খাবার খায়।

সেদিন বুল্টি বাবাকে বলল, বাবা, বুলি তো উড়তে পারে। ওকে এখন বাইরে ছেড়ে দিলে কেমন হয়। বাবারও দেখা গেল একই মত। মায়ের যেন ঠিক ইচ্ছা নয়। আসলে কেমন মায়া পড়ে গেছে তো।

যাই হোক, পরদিন সকালে বাগানে নিয়ে গিয়ে খাঁচাটার দরজা খুলে দিল বুল্টি। ও বেরিয়ে বাইরে এল। কিন্তু উড়ে গেল না। খাঁচার উপরেই বসে রইল আর চুপ করে দেখতে লাগল চারিদিক। যেন নতুন অচেনা পৃথিবীকে চিনে নিতে চেষ্টা করছে।

বুল্টি ওকে ধরে একটা বড় গাছের ডালে বসিয়ে দিতেই, ওর মা কোথা থেকে এসে সেই ডালের উপরের ডালে বসল। তারপর ডাকতে লাগল। হঠাৎ দুলি চনমন করে উঠল। তারপর ফুরুত করে উড়ে গেল।

বুল্টির মনটা এক অদ্ভুত আনন্দে ভরে গেল। দুলিকে আবার তার নিজের জগতে সুস্থভাবে ফিরিয়ে দিতে পেরে ওর মনটাও যেন একটা মুক্তির আনন্দ অনুভব করতে লাগল।

ঘরে ফিরে দেখে বুলি বসে আছে চুপ করে আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।

বুল্টি বুঝল, যতই ঝগড়া ঝাঁটি করুক আর ঠোকরাঠুকরি করুক, দুলিকে ও নিশ্চয়ই ভালবাসত। দুলিকে ও চারদিকে তাকিয়ে খুঁজছে। তাই যেন দুলি চলে যাওয়ায় ও -ও মনমরা হয়ে পড়েছে। 

যদিও দুলির, নিজের জগতে সুস্থ ভাবে ফিরে যাওয়ায়, একটা আনন্দ ছিল, তবু বুলির এই মনমরা ভাবটা বুল্টি ওর মা আর বাবার মনটাকেও নাড়া দিয়ে গোটা বাড়িতে একটা অদ্ভুত বিষন্নতায় ভরিয়ে তুলল।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত