| 20 এপ্রিল 2024
Categories
শারদ সংখ্যা’২২

শারদ সংখ্যা উপন্যাস: এই প্রেম এই নিঃসঙ্গতা । বিতস্তা ঘোষাল

আনুমানিক পঠনকাল: 62 মিনিট

অবশেষে টানা ২ বছর অপেক্ষার পর প্রতীক্ষিত কলটা এল। সময়টা বেলা দুটোর আশেপাশে। ভিক্টোরিয়া মেমরিয়ালের ডিরেক্টরের সঙ্গে দেখা করে তখন সবে গাড়িতে উঠেছে ইরাবতী।

 অন্যপ্রান্ত থেকে যে কলটি এল সেটা অনেকটাই অপ্রত্যাশিত। এই মানুষটির সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য বহুবার ইরাবতী তাঁর অফিসে ফোন করে এ্যপয়েনমেন্ট চেয়েও পায়নি। একটাই উত্তর এসেছে। স্যার বাইরে। এলে ফোন করে ডেকে নেবেন।

  কলটি যে বহু প্রতীক্ষার ফসল, সেটা সেই মুহূর্তে মাথায় এল না। বরং মনে হল একজন পরিচিত মানুষ ওপ্রান্ত থেকে বললেন, এই তুমি ফ্রি আছ? আমি এখন ফ্রি। তুমি চলে আসতে পারো। যেমন ইরাবতী অফিসে ফ্রি থাকলে বা মন খারাপ করলে নিজের কাউকে ফোন করে বলে, এই তুমি ফ্রি আছ!

ভিক্টোরিয়া থেকে অফিস বিল্ডিংটার দূরত্ব খুব বেশি হলে এক মাইল, গাড়িতে ১০ মিনিটও না। বাইরের  তাপমাত্রা পুড়িয়ে দিচ্ছিল চোখ। গাড়ির এসি গায়েই লাগছিল না। গাড়িতে ইরাবতীর অফিস সহযোগী অমল। জানলা দিয়ে চলমান গাড়ি বাস বাইক দেখতে দেখতে সে তাকে জিজ্ঞেস করল- তুমি এঁর সঙ্গে  যোগাযোগের জন্য এত কেন গুরুত্ব দিচ্ছ? 

ম্যাডাম, আপনার মাথাটা বোধহয় আজ গরমে কাজ করছে না।

মানে? 

আপনি ভিক্টোরিয়া কেন এসেছিলেন? 

ইরাবতীর বলতে ইচ্ছে হলো, প্রেম করতে। তা না বলে বলল, কাজে।

আমার তো মনে হল না।

কেন? 

আপনি ডিরেক্টরকে কী বললেন? 

কী আবার বললাম! বললাম যে আমি একটি প্রতিষ্ঠান চালাই. . 

ব্যাস, শুধু এইটুকুই বললেন। আর তারপরেই বললেন, আমাকে একটু চা খাওয়াতে পারবেন? কেন আপনাকে আমি অফিসে চা খাইয়ে আনিনি! ওখানে নামার মুখেও চা খেলেন। 

হ্যাঁ , তাতে হলটা কী? 

হল মানে! আপনি যে কাজের জন্য গেছিলেন তার কথা বললেন একবারও? চেয়ে চা নিলেন, সেটাও খেলেন না পুরো। জাস্ট দু’ চুমুক! 

অমল আমি বুঝতে পারছি না তুমি কী বলতে চাইছ? 

আমি এটাই বলতে চাইছি, আজ আপনি কাজের মুডে নেই। অন্য কোনো ভাবনার মধ্যে ডুবে আছেন।

ও! আচ্ছা। শব্দ করে হাসল ইরাবতী। এবার বলো যার কাছে যাচ্ছি , তিনি আমাদের জন্য কী করবেন?  

ম্যাডাম, উনি এই বাংলার সবচেয়ে বড় বিজনেজম্যান। 

ওঃ তাই!

কী তখন থেকে ও- ও করে যাচ্ছেন! এই বাবু গাড়ি ঘুরিয়ে নে। ম্যাডাম আজ বাড়ি গিয়ে কবিতা লিখুক, কিংবা ময়দানে নামিয়ে দে। বসে বসে আকাশ দেখুক।

গাড়ি ততক্ষণে সেই ৩০ তলা বিল্ডিং-এর সামনে।

এসে গেছি। নামুন। তবে আপনি কী কথা বলবেন আজ? নাকি আমি গিয়ে যা বলার বলব!

ইরাবতী এবার নিজের মনেই হেসে বলল, অমল, পৃথিবীতে যা জন্মায় তার বিনাশ হয়, সেটাই অবশ্যম্ভাবী। শুধু সময়ের হেরফের ঘটে। যদি আমাদের কাজের আয়ু আরো থাকে তবে আমার বলা না বলার উপর তা নির্ভর করবে না। সে টিকে থাকবে, ঠিক যেমন এত ভূমিকম্প, খড়া, মড়ক, সুনামী, ভূস্তরের প্লেটের ভাঙন সবকিছুকে বিনষ্ট করে দিলেও আরশোলা টিকে আছে সৃষ্টির সময় থেকে আজও।

লিফটে কুড়িতলায়। অমল ঠিকই বলছিল।আজ তার সত্যি কোথাও যেতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু এতদিন বাদের সাক্ষাতের সুযোগটাও হাতছাড়া করতে চাইছিল না বলেই আসা।একটু বিরক্তি নিয়েই রিসেপসনে নাম লিখে ভিতরে ভিসিটর রুম গেল। খুব ছিমছাম রুচি সম্মত একটা অফিস। ভিজিটর রুমের সামনেই কাচের দেওয়াল দেওয়া ঘরে এম ডি বেদান্ত রায়ের নাম লেখা। সেদিকে একবার চোখ বুলিয়ে সোফায় বসা মাত্র নীল সাদা বর্ডার দেওয়া কাপে চা দিয়ে গেল একটি অল্প বয়সী ছেলে। গলায় তার কোম্পানির নাম লেখা কার্ড।

ইরাবতী তার দিকে তাকিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে হেসে চায়ে চুমুক দিল। তৎক্ষণাৎ মনটা ভালো লাগায় ভরে গেল তার।

আর তখনি মনে পড়ল বাবার কথা। চায়ের উষ্ণতা দিয়ে পরিমাপ করা যায় যার কাছে আছিস বা গেছিস সেই মানুষটার অতিথিদের প্রতি উষ্ণতা কেমন।

বুঝলাম না বাবা। চায়ের সঙ্গে মানুষের উষ্ণতার কী সম্পর্ক? 

যেখানে যত্ন করে চা পরিবেশিত হয়, বা চায়ে চুমুক দি়য়ে মনটা হঠাৎ ভাল হয়ে যায়, সেখানে বুঝবি সেই চায়ের প্রতিটি উষ্ণতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেখানকার কর্তার নিবিড় ভালবাসা , সেই ভালবাসা দিয়েই তিনি সফল।

 চা নিশ্চয় তিনি নিজে হাতে বানিয়ে দেবেন না। মেয়ের কথার প্রেক্ষিতে বেদব্যাস বললেন,তা হয়তো দেবেন না। কিন্তু তিনি অতিথিকে ভালবাসেন বলেই তার কুক চা বানানো যত্ন  করে শিখেছে,এর সঙ্গে তাঁর মালিকের অন্তরের যোগ আছে, সেটা সে উপলব্ধি করেছে ।

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আরেকবার চুমুক দিল ইরাবতী। এই চা তার প্রিয় ফ্লেভারের। সেইমুহূর্তেই সে অজানা অচেনা একটা মানুষকে ভালোবেসে ফেলল, কোনোদিন না দেখেই। কোনো কথা না বলেই ।

এখন ঘরটা ততটা খারাপ লাগছে না।

দশ মিনিট বাদে কাচ ঢাকা সামনের সেই ঘরে ঢোকার অনুমতি পেল ইরাবতী। ঢোকার পর সামনের চেয়ারে বসে প্রথম দেখল মানুষটিকে। এবং আশ্চর্য হল। এই মানুষটা এত বিখ্যাত ও প্রথিতযশা শিল্পপতি ভেবেই তার অবাক লাগল। যেভাবে তিনি ঘরে ঢোকা মাত্র মিষ্টি হেসে আপ্যায়ণ করলেন, তাতে ইরাবতীর মনে অসম্ভব কাছের কোনো চেনা মানুষের সামনে বসলে যেমন অনুভূতি হয় ঠিক তেমনি অনুভূতি তৈরি হল। সে মনে করার চেষ্টা করল কোথায় কীভাবে এঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল! না, মনে পড়ছে না। সে এবার সোজাসুজি তাকালো। উল্টোদিকের মানুষটিও দেখছে তাকেই- বুঝে হাসল।

বলো, কী চাইছ? বলা মাত্র ইরাবতী ব্যাগ থেকে ব্রোসিওর বের করে এগিয়ে দিল তাঁর দিকে। দায়সারা ভাবে কিছু একটা বলল বা বলার চেষ্টা করল ঠিকই, কিন্তু কোনো কথাই সম্পূর্ণ হল না। সেই মুহূর্তে শুধু একটি কথাই তার মনে গভীরে গুঞ্জরিত হল- চিনি তোমারে চিনি।

দু-একটা মামুলি কথার পর হঠাৎ ইরাবতীর মনে হল, আসলে এখন তার আর কোনো কথা নেই। আর নেই- বলেই বসে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। সে- আসি, ভাল থেকো, বলে উঠে পড়ল। 

গাড়িতে উঠে ফেরার পথে অমলকে জিগেস করল, এঁর কিসের ব্যবসা? 

ম্যাডাম, এদের বিভিন্ন খাদ্য দ্রব্যের গুড়ো মশলা, ও অন্যান্য প্রডাক্টের ব্যবসা। ওই যে টিভিতে অ্যাড দেয়, রান্নার স্বাদে বিপ্লব… একটুখানি গুঁড়ো মশলা… মশলা মানেই…। যাক, আপনি বললেন আমাদের সাহায্য করতে? 

না, তা বলিনি।ইরাবতী বাইরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল।

কী বললেন তাহলে? 

কিছু কী বলেছি! কিছু কী বলার ছিল! 

ম্যাডাম, আপনার দ্বারা আর কোম্পানি চালানো সম্ভব নয়। আপনি নিজের টাইম পাস করার জন্য অফিসে আসেন, আর আমারও সময় অপচয়। এভাবে এগোলে আগামী কয়েকমাসের মধ্যে আমার স্যালারি তো দূরের কথা, অফিস চালানোর খরচও উঠবে না।

ইরাবতী কোনো উত্তর দিল না। তার চোখের সামনে লম্বা, ফর্সা, টিকোলো নাক,  উজ্জ্বল চোখের একটা মানুষের মুখ উঁকি মারছে। যার থেকে কোনো সাহায্য চাওয়ার নেই। যার সঙ্গে কোনো স্বার্থে সে কথা বলতে ইচ্ছুক নয়।

গভীর রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করল ইরাবতী -আমি কি তাঁর প্রেমে পড়লাম! 

সে প্রশ্ন গ্রহ নক্ষত্র তারা মেঘের কাছে পৌঁছে গেল। সমস্ত কক্ষ পথ ছুঁয়ে তারপর নেমে এল বারান্দায়। যেন উত্তর এসেছে। না, প্রেম নয়, এ মায়ার বাঁধন। যে মায়ায় মাঘী পূর্নিমার চাঁদ পথ ভুল করে এ সেই বাঁধন। এই বাঁধনের  পেছনের পথ নানা গলি -উপগলি -চড়াই- উতরাই-এ মোড়া।

জোয়ার ভাটার মতই জীবন জুড়ে নানান গল্প এই মানুষটির ঝুলিতে। সেই ঝুলির মুখের গিট শক্ত করে বাঁধা। একটানে খোলা যায় না সেই গিট।

ইরাবতী সেই শক্ত  গিটে চুপিচুপি ঠোঁট রাখল। ফিসফিস করে বলল, তোমার চোখের মধ্যে লুকিয়ে আছে একটা নীল সমুদ্র, আমি সেটার গভীরে সাতাঁর কেটে দেখতে চাই। ঠিক কতটা যন্ত্রণা আর কতটা ভালবাসা, কতটা একাকীত্ব আর কতটা ভাল থাকার অভিনয় লুকিয়ে সেখানে।

সবচেয়ে কোন বিষয়টা বেশি ভাবায় তোমাকে? ইরাবতী প্রশ্নটা করল বটে, কিন্তু সে যেন জানতো উত্তর কী হতে পারে। সে অপেক্ষা করল।

তুমি কী কোনো সোস্যাল ইস্যু বা বিশেষ কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে জিজ্ঞেস করছ? 

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজের সঙ্গে এডজাস্ট করেই তাকে চলতে হয়। কিন্তু আমি এই সংক্রান্ত কোনো প্রশ্ন করিনি।

বেদান্ত ইরাবতীর প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে রিভলভিং চেয়ারটা ঘোরালো।

ইরাবতী নিজের অফিসের ঘরে বসে যেন সেটা দেখতে পেল। সে  অপেক্ষা  করতে লাগল।

সবচেয়ে ভাবার জিনিস হচ্ছে মন। মনটা যদি নিয়ন্ত্রণে না থাকে তাহলে কেবল ইমোশনাল হয়ে কোনো কাজ করা যায় না। 

উত্তরটা বাড়িতে ফেরার পথে গাড়িতে উঠে নেট অন করার পর পেল ইরাবতী।

হুম । মানুষের মন হল অন্তহীন দ্রৌপদীর শাড়ি। কথাটা ভেবে সে লিখল, তুমি মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারো? স্বয়ং যুধিষ্ঠির বলেছেন, মন সবচেয়ে দ্রুতগামী, তাকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।

বেদান্ত কোনো উত্তর দিল না। মনকে বশে রাখা যে কত কঠিন তার থেকে বেশি কে জানে! মনের দাসত্ব করতে গিয়ে কতবার কত সমস্যায় জর্জরিত, রক্তাক্ত হতে হয়েছে তার খবর কেউ রাখে নি।

কোনো কোনো আকর্ষণ সত্যি এড়ানো যায় না। জড়িয়ে যায়, জট পাকা উলের মত। যখন বুঝতে পারে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলেছে, তখন প্রাণ হাসফাস করে তার থেকে মুক্তি পাবার জন্য। নিজের মনেই ভাবছিল, কলকাতায় থাকলে এত ব্যস্ত জীবন যে নিজস্ব ভাবনার পরিধি ছোট হয়ে আসে।তখন শুধু কাজ আর কাজ।নিরাপত্তার ঘেরাটোপে নিজেকে আটকে রাখা। অথচ কী ভীষণ ইচ্ছে করে দুম করে কাউকে না জানিয়ে পালিয়ে যেতে। কোনো লোকাল ট্রেন কিংবা সিট বুক না করা দূরপাল্লার ট্রেন বাসে চেপে চলে যেতে যেদিকে মন চায়। 

কত নতুন নতুন মানুষ, তাদের চেহারা , ভাষা, কথা বলার ভঙ্গি , ভাবনা সব কেমন আলাদা । অল্পে খুশি কত মানুষ। তার মনে পড়ল, কাজ থেকে বাড়ি ফেরার সেই সব দিনগুলো। কতবার স্টেশনে এসে দেখেছে লাস্ট ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে । দৌড়ে উঠে পড়েছে ভেন্ডার কামরায়।

প্রথম প্রথম দূরে দূরে, তারপর সেই দূরত্ব ঘুচে কখন যেন এক বন্ধন গড়ে উঠেছে। তাস থেকে বিড়ি, বাড়ির গল্প থেকে প্রধানমন্ত্রী. .  সব একে একে উঠে এসেছে তাদের সেই শেষ ট্রেনের আড্ডায় ।

অ়থচ এখন যে দ্রুততায় সহজেই পৌঁছে যায় সারা পৃথিবীর পি এম থেকে প্রেসিডেন্টের কাছে, সেই মানুষগুলোর কাছে ফেরা হয় না। ইচ্ছে থাকলেও হয় না।

কত নস্টালজিক এই জীবন। একের পর এক সেগুলো ছায়া বেছায়। তারপর কখন যেন ছায়া কেটে চরিত্রগুলো আবছায়া হয়ে ওঠে। চেনা জীবন হঠাৎ অচেনা হয়ে যায়।

মল্লার। একটা নিঃশ্বাস ফেলল বেদান্ত। মল্লারের সঙ্গে কেমন জড়িয়ে গেছিল।

মল্লার অভিনেত্রী । স্বামীর অত্যাচারে প্রায় মরতে বসেছিল। বড় মায়াময় আকর্ষণ ছিল তার। ক’দিনের দেখা সাক্ষাৎ, কথোপকথন ।

আমাকে একটা নতুন জীবন দেবে বেদান্ত? হাতদুটো নিজের মুঠোয় নিয়ে বলেছিল মল্লার ।

 হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠল নীতার সেই বেঁচে থাকার আকুতির দৃশ্য । আমি বাঁচতে চাই।

কী যে হল বেদান্তর ! সেই মুহূর্তে মনে হল যেভাবে যেকোনো মূল্যে মল্লারকে বাঁচাতে হবে। ভুলে গেল সে একজন পাকা অভিনেত্রী। 

ভুলে গেল পারিপার্শিক অবস্থান । ভেসে গেল মল্লার ধ্বনীতে। কিন্তু মল্লার! সেতো বর্ষার  রাগ! সারা বছর জুড়ে তার প্রভাব থাকলে বন্যা অপরিহার্য । তার জীবনেও বন্যা এল। খড়কুটোর মত জীবনকে আকঁড়ে ধরে সাঁতার কেটে যখন পাড়ে এসে পৌঁছল তখন অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে।

ক্ষতিপূরণ দিয়ে মুক্তি। নিজেকে তখন মাঝে মাঝে আসামী লাগত বেদান্তর। পরিবারের কাছে এবং নিজের কাছে ছোটো লাগত। শেষ অবধি তার থেকে জামিন মিলল কিংবা মুক্তি। যেন দীর্ঘ সময় কারাগারে কাটাবার পর রোদ এল আবার । আ: বাইরে কত আলো।

ছোট থেকে একটা জিনিস জানত, টাকা গেলে টাকা রোজগার করা যায় । মান গেলে মান ফেরে না। এই এক ধাক্কায় তার সেই জ্ঞান চক্ষু যেন খুলে গেল।

সহসা ভাবনার জাল কেটে গেল বেদান্তর। ক্লিক করে মেসেজ আলার্ট। ইরাবতী । এই মেয়েটা কেন যখন তখন ঢুকে পড়ে আর কীই বা সে চায় বুঝে উঠতে পারে না সে।

 মোবাইলে হাত রাখল। দেখি কী লিখেছে সে, ভেবেও ফোন রেখে দিল । নির্ঘাৎ কবিতা। মেয়েটা প রিচয়ের পর থেকে কত যে নিজের লেখা কবিতা পাঠিয়েছে।মন্দ লেখে না।কিন্তু এত! মেসেজ আনসিন রেখে আবার ভাবনার স্রোতে ডুবে গেল বেদান্ত।

রাস্তায় যেতে যেতে ইরাবতী লিখল, যখন তোমার সময় হবে তখন তুমি এস। তপ্ত দুপুর, মেঘলা বিকেল, নিঝুম সন্ধ্যা . . . সব পেরিয়ে এসো।

বেদান্তর সঙ্গে আলাপ হবার পর থেকে তাঁকে জানার একটা তীব্র আকাঙ্খা ইরাবতীর মনে দানা বেঁধেছে। ক্রমশ মনে হচ্ছে এই মানুষটির সঙ্গে কোথাও একটা যোগ রয়েছে তার। বেশ কিছুদিন ভাবনা চিন্তার পর অনলাইনে বেদান্তকে অ্যাক্টিভ দেখে লিখল ইরাবতী- তোমার একটা ইন্টারভিউ নিতে চাই। যেটায় শুধুমাত্র প্রথাগত কিছু প্রশ্ন থাকবে না। আমার ভীষণ ইচ্ছে তোমাকে নিয়ে কিছু লিখি। প্লিজ অনুমতি দাও। তারপর অপেক্ষা করতে লাগল ‘সিন’ চিহ্ন দেখার।

বেশ খানিকক্ষণ বাদে উত্তর এলো, আমাকে নিয়ে কী লিখতে চাও?

তুমি আমার দেখা সবচেয়ে বৈচিত্রপূর্ণ মানুষ। এত বিখ্যাত মানুষ, কিন্তু কোথাও তোমার মধ্যে একটা অন্য রকম মানুষ লুকিয়ে। ভীষণ রোমান্টিক, মাটির কাছাকাছি একটা মানুষ, যাকে বাইরে থেকে অতটা বোঝা যায় না, কিন্তু…।

ইরাবতীর কথায় বেদান্ত বলল,দূর! আমাকে নিয়ে কিছু লেখার নেই। তার থেকে তুমি একটা দীর্ঘ প্রেমের কবিতা লেখ।

আমি প্রেমের কবিতা লিখতে পারি না।

কেন? তোমার জীবনে প্রেম নেই নাকি !

হা হা। প্রেম নেই জীবন… যদি কোনোদিন লিখি তোমায় নিয়ে লিখব কেমন!

সেটাই ভালো হবে।

আমি কিন্তু সত্যি তোমায় নিয়েই লিখতে চাই।

আমি এখন দেশে নেই। আতলান্তিক সাগরের কিনারায় বসে। বেদান্ত জানালো।

জানি। এটাকে বোধহয় নর্থ সি বলে। যদিও আতলান্তিকেরই অংশ। একটু আগেই তোমার ছবি দেখেছি। সেই নিয়ে একটা লিখেও ফেললাম।

পাঠাও দেখি। বেদান্ত বলল।

ইরাবতী লিখল – সমুদ্র কিনারে বসে একা, স্তব্ধ কোলাহল, কেবল ঢেউয়ের আনাগোনা, কান পেতে শুনি সমুদ্রের কথা। এত কথা ছিল! এত নিঃসঙ্গতা! আমি তো ভেবেছি অবিরাম স্রোতে সব ক্লান্তি সব শোক ভেসে যায়। অথচ বুঝিনি ভিতরে ভিতরে জমা হয় গাঢ় বিষাদ। সন্ধ্যার গা বেয়ে যে প্রেম নামে তাও বড় বেদনাময়…

বেশ কিছুক্ষণ নীরবতার পর বেদান্ত বলল, এটা তুমি আমায় নিয়ে লিখেছ?

হুঁ। ইরাবতী উত্তর দিলো বটে , কিন্তু সে এখন আর নিজেও জানে না সত্যি কি ভেবে সে লিখল এটা! তার চোখের সামনে এখন ঘন নীল সমুদ্র, সাদা ঢেউগুলো যেন তার সাদা দাঁত , আর তার নোনতা জলরাশি যেন তারই চোখের জল। তার আর কথা বলতে ইচ্ছে করলো না। কিংবা সব কথা হঠাৎ করেই ফুরিয়ে গেল। সে বালিশে মুখ গুঁজে উল্টোদিক ফিরে শুয়ে পড়ল।

ইরাবতীর সঙ্গে কথা বলার পর সমুদ্রের ধার থেকে ফিরে একের পর এক মিটিং শেষ করল বেদান্ত। আমেরিকা থেকে কাল রাতে তার প্রবাসী বন্ধু অঙ্কন এসেছে।তাকে নিয়েই বার্লিন ঘুরে দেখার ইচ্ছে। বার্লিন ভাবলেই প্রথমেই হিটলারের কথা মনে পড়ে। ছেলেবেলা থেকেই এই নামটার সম্পর্কে প্রায় কিছু না জেনেই তাদের ডিকশিনারিতে ঢুকে গেছিল। যাকে-তাকে যখন –তখন হিটলার নামে ডাকা হতো। বিশেষ করে স্কুলের রাগী স্যারেদের তো বটেই। এমনকি মাঠে খেলার সময় পাশের বাড়ির দিদিমা বল আটকে রাখলে তাঁকেও অবলীলায় হিটলার আখ্যা দিয়েছে তারা। আসলে কে সেই হিটলার না জেনেই একটা ধারণা হয়ে গেছিল যে হিটলার মানেই অত্যাচারী। আজ সেখানেই দাঁড়িয়ে। মনটা উত্তেজিত হয়ে উঠল তার।

দুই বন্ধু বার্গার দিয়ে লাঞ্চ সেরে রওনা হল ওরানিওএনবুর্গের দিকে। উচ্চারণটা ঠিক হলো কিনা সেই নিয়ে দুজনে খানিক তর্ক জুড়লো। তারপর হাল ছেড়ে জোরে হেসে উঠল।

এখন তারা চলেছে স্যাশেনহাউজেনে।এটাই নাকি সবচেয়ে বড় নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প।কয়েক লক্ষ ইহুদিকে এখানেই নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছিল।

তোর কি মনে হয় হিটলারের এই ইহুদি বিদ্বেষের কারণ কী? অঙ্কন জিজ্ঞেস করল।

একটু ভেবে বেদান্ত উত্তর দিল। দেখ আমার মনে হওয়াটা এখানে মাইনর। অনেকে বলেন এক ইহুদি ডাক্তারের ভুল চিকিৎসাতে তাঁর মা মারা গেছিলেন, সেটাই তাঁর রাগের কারণ।

তুই বলছিস এখন যেমন রোগীর কিছু হলেই ডাক্তারকে মারা হয় কিংবা হাসপাতাল ভাঙচুর হয় এটাও তেমন কিছু ছিল?

হতে পারে। তবে আমার নিজস্ব ভাবনায় ডাক্তারের প্রতি রাগে পুরো জাতটাকে কী এভাবে মেরে ফেলা যায়? অবশ্য কোনো একটা বিষয়কে কেন্দ্র করে জাতিবিদ্বেষের ঘটনা সারা পৃথিবীতেই বারবার ঘটেছে। এশিয়া ইউরোপ আমেরিকা লাতিন আমেরিকা সব দেশের ইতিহাস দেখ। উনিশ আর বিশ।

হুঁ। তবে অনেকে আবার বলে শিল্পী হবার স্বপ্নে বিভোর হিটলার দু’বার আর্ট আকাদেমিতে ভর্তি হতে না পেরে চারবছর ভিয়েনার ফুটপাথে বসে হাতে আঁকা পোস্টকার্ড বিক্রি করতেন। তখনি তাঁর ইহুদিদের প্রতি বিদ্বেষ জন্মায়। আসলে মানুষের মন নিজেও জানে না সে কী চায়? তার ভেতরে কি চলছে। নইলে দুটো পাশাপাশি বাড়ির মানুষ, কিংবা এক পরিবারের মানুষ যারা হয়তো কিছুদিন আগেও বন্ধু ছিল তারা কিভাবে রাতারাতি পরস্পরের শত্রু হয়ে ওঠে! কিভাবে যাকে চেনেও না সেই মানুষকে আরেকজন খুন করে!

কথা বলতে বলতে তারা ৩৫ কিমি পথ অতিক্রম করে পৌঁছে গেল স্যাশেনহাউজেনে। উঁচু পাঁচিল ঘেরা প্রায় হাজার একর জায়গা জুড়ে ক্যাম্প। 

অভিজ্ঞ গাইড ইংরেজিতে ক্যাম্পের বিস্তারিত বর্ণনা করছিল। প্রায় পাঁচ ঘন্টা ধরে স্টেশন জেড কিলিং সেন্টার মেমোরিয়াল, গ্যাস চেম্বার, ওয়াচটাওয়ার, বন্দীদের দৈনন্দিন রুটিন, শাস্তির জায়গা , ইহুদি-ব্যারাক, কম্যান্ডান্টস হাউজ, ডেথ মার্চ মেমোরিয়াল, রোল কল স্কোয়ার, ইনফারমারি মিউজিয়াম, ফাঁসির জায়গা দেখে যখন সেখান থেকে দুই বন্ধু বেরিয়ে এল তখন তারা আবিষ্কার করলো, এতক্ষণ নিজেদের মধ্যে তারা একটা কথাও বলেনি। শুধু শুনেছে গাইডের বর্ণনা।

সম্পূর্ণ নিরামিষাশী, কোনোপ্রকার নেশায় আসক্তিহীণ, রঙ তুলিতে সৃষ্টিশীল, ফুল প্রিয় এক মানুষ কিভাবে এমন নির্মম হতে পারে তা কল্পনাতীত ছিল।

ক্যাম্পের বাইরে এসে বহুক্ষণ কোনো শব্দ মনে এলো না বেদান্তর। অঙ্কনও চুপ করে দূরের দিকে তাকিয়ে রইল।

সামনে ছড়ানো সিটিস্কেপ। অনেকেই ছবি তুলছে। তারা দুজন কোনো ছবি তুলল না। আকাশটা খুব কাছে মনে হচ্ছে। যেন হাত বাড়ালেই নাগাল পাওয়া যাবে। সেখানে দাঁড়িয়ে বুকের ভিতরটা কেমন যেন শূন্য লাগছে। এই মুহূর্তে নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হল বেদান্তর। বিশাল আকাশের নিচে মহাশূন্যের বুকে একটা ছোট্ট বিন্দুর মতো।

কোথায় যেন পড়েছিল বাংলা ভাষার সঙ্গে জার্মান ভাষার মিল আছে। দুজনেরই আদি ভাষা নাকি সংস্কৃত। বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীর দুই প্রান্তে এখন দুই ভাষা। একটার সঙ্গে আরেকটার কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাচ্ছি না, নিজের মনেই ভাবল বেদান্ত। আর তখনি তার মনে বার্লিন প্রাচীর ভাঙার দৃশ্যটা ভেসে উঠল। এক দেশ বিভাজিত হয়ে গেলে তার রেশ কি হতে পারে ছোটোবেলায় উপলব্ধি করেছিল। সেই দিনগুলোর কথা মনে করে শিউড়ে উঠল বেদান্ত।

চমক ভাঙলো অঙ্কনের ডাকে। চল, একটু কফি খাই।

এতক্ষণে তার মনে হল খিদে পেয়েছে। বেশ কিছুটা হেঁটে রাস্তার ধারের এক খাবারের স্টলে স্যান্ডউইচ, সসেজ আর কফি নিয়ে বসল।

অঙ্কন স্ট্রিট ফুড খেতে পছন্দ করে না।কিন্তু বেদান্তর চাপে পড়ে নিতে বাধ্য হলো। খাবার পাতে সস হিশেবে কাসুন্দি পেয়ে তার মুখে হাসি ফুটল। খেতে খেতেই সে বলল, যাই বল বাবা বাঙালী বেঁচে থাকুক রান্নার স্বাদে। সারা পৃথিবী ঘুরলেও আমাদের মতো রান্না কেউ বানাতে পারবে না। সে চাউমিং হোক কী ফ্রায়েড রাইস থেকে একবারে স্যান্ডউইচ সবেতেই নিজস্ব সিগনেচার থাকবেই।

হুঁ, বলে কফিতে চুমুক দিল বেদান্ত। তার মনটা এখনো অদ্ভুত এক স্তরে। একদিকে ক্যাম্প অন্যদিকে বার্লিন প্রাচীর- তার মধ্যে কোথাও যেন নিজেকে খুঁজছিল সে।

হোটেলে ফিরেও কেমন এক বিষন্নতা ঘিরে রইল তাকে। এই মুহূর্তে ক্যাম্প নয়, বার্লিন প্রাচীরটা তাকে টানছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর শেষে হঠাৎ রাতারাতি ভাগ হয়ে গেল দেশটা। পূর্ব আর পশ্চিম জার্মানি।কত মানুষের হাহাকার।

ঘুম আসছে না। সারা গাঁয়ের লোক এক হয়ে হাঁটছে রাতের অন্ধকারে। লুকিয়ে। কোনোভাবে খান সেনাদের হাতে পড়লে মৃত্যু অবধারিত। তখনো মৃত্যু কাকে বলে তারসঙ্গে সরাসরি পরিচয় না হলেও সেই আট ন’ বছর বয়সেই বুঝে গেছিল বন্দুকের গুলি যেকোনো জায়গায় যখন তখন তাদের হাঁটা- চলা- বন্ধ করে দিতে পারে। কখনো ধানের ক্ষেতে লুকিয়ে বিষাক্ত সাপের পাশাপাশি প্রায় শুয়ে, কখনো কোনো পরিত্বক্ত স্কুল বাড়িতে একটা কথাও না বলে দিন রাত কাটানো। অপেক্ষা কখন সেনারা চলে যাবে, তারা আবার সীমান্তের দিকে হাঁটবে।

ঘেমে যাচ্ছে বেদান্ত। দু পকেটে ভরা টাকা পয়সা, যে যা পেরেছে বাচ্চাদের পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছে। সেনারা বাচ্চাদের ছেড়েও দিতে পারে ভেবে। বিশাল দলটা পিছন থেকে ক্রমশ কমে যাচ্ছে। কেন তারা এভাবে পালাচ্ছে না বুঝেই তারা চোরের মত পালচ্ছে…। পিছনে আসছে খোলা তরোয়াল, বন্দুক নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে সেনারা…

নাঃ ধড়মড় করে বিছানা ছেড়ে উঠে বসল সে। গলাটা একবারে শুকিয়ে গেছে। জিভ দিয়ে ঠোঁটে সার আনতে চেষ্টা করল। তারপর ধীরে ধীরে জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

রাতের আকাশটা কত রহস্যময়। লক্ষ লক্ষ গোয়েন্দাও পারছে না তার রহস্য ভেদ করতে। নিষ্পলক ভঙ্গীতে সেদিকেই তাকিয়ে রইল সে। কী ভেবে মোবাইলটায় হাত দিল।

ইরাবতীর মেসেজ। একটা কিছু লিখতে চাইছি। আলো খুঁজছি অথবা তোমার গভীর চোখ। হাতদুটো ধরবে? ছুঁয়ে দেবে তোমার যাদুকাঠি? তারপর মুখোমুখি বসে গল্প… তোমার গল্প- আমার গল্প-জীবনের গল্প। কবে শোনাবে বলতো?

মেসেজটা কয়েকবার পড়ল বেদান্ত। মেয়েটা ক্রমশ টানছে। এ টান প্রেমের নয়, কিন্তু কোথাও একটা মনের গভীরে ধাক্কা মারছে, একেই হয়তো নিশ্চিন্তে বলা যায় জীবনের নানা গোপন কথা। সে জানালো, ফিরে কথা বলব। 

সকাল থেকেই অঝোর বৃষ্টি। লোকেদের মধ্যে বিশেষ করে কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে বৃষ্টি নিয়ে একটা অদ্ভুত আদিখ্যেতা আছে। ভাবটা এমন বৃষ্টি হলে তবেই সাহিত্য সৃষ্টি হবে। নইলে … আরে বাবাঃ বৃষ্টিতে শুকিয়ে যাওয়া নদী নালা প্রাণ ফিরে পায়, গরমে দগ্ধ মাটি জল পেয়ে সজীব হয়ে ওঠে। এটাই প্রকৃতির নিজস্ব কেমিস্ট্রি। সে সবসময় ব্যালেন্স করে দেয়।

কিন্তু সারাদিন একনাগাড়ে বৃষ্টির অত্যাচারে জনজীবনও যে থমকে যায় সেটার খেয়াল আর কে রাখে! বিশেষ করে যারা রাস্তাতেই বাস করে তাদের দুর্দশা চোখে দেখা যায় না।

গাড়িতে অফিস যাবার পথে এসবই ভাবছিল ইরাবতী। আর বিরক্ত হচ্ছিল। সেইসময়ই ফোনটা এল।

ফিরে গেছি। আজ খানিকটা ফ্রি আছি। বিকেল পাঁচটার পর ক্লাবে চলে এসো। দু-তিন ঘন্টা কথা বলা যাবে নিশ্চিন্তে।

আচ্ছা। দেখা হচ্ছে, বলে- বেদান্তর কল কাটল ইরাবতী।

খুব দ্রুত অফিসের কিছু কাজ সারলো ইরাবতী।অমলের এক ভাবে বলে যাওয়া কিছু কথা তার কানে এলেও মাথা অবধি প্রবেশ করল না।

ঠিক পাঁচটার সময় অফিস থেকে বেরল সে। বৃষ্টি এখনো পড়ে যাচ্ছে। বেদান্ত খানিক আগেই জানিয়েছেন জায়গাটা পরিবর্তন হয়েছে। সেটাও বাইপাশেই।তবে পাঁচটার বদলে ছটা হয়েছে।

গাড়িতে উঠে মাথার উপরে হাতদুটো তুলে একটা হাতে আঙুলের ফাঁকে আর একটা হাতের আঙুল ঢুকিয়ে আড়মোড়া ভাঙল সে। ঠিক কী জানতে সে বেদান্তর সঙ্গে দেখা করতে চাইছে নিজের কাছেও তার কোনো জবাব পেল না। শুধু মন বলল,একটা অল্প চেনা মানুষের অজানা জীবনের কথা শুনতে ভিতর থেকে তাগিদ বোধ করছে। আর তার জন্যই এই মুখোমুখি বসা।

ট্রাফিকের গতি মন্থর। ছটা বাজতে খুব বেশি দেরি নেই। এখনো অর্ধেক রাস্তাও যেতে পারলো না ভেবেই বিরক্ত হল। তখনি বেদান্তর ফোন এলো। কতদূর তুমি ?

অনেকদূরে- বলতে গিয়েও থেমে গেল ইরাবতী। আসছি- বলে ফোন রাখল।

বাইপাশে উঠে রাস্তা ফাঁকাই পেল। মিনিট দশেকের মধ্যেই ক্লাবে পৌঁছল সে।

অল্প আলোয় বেদান্তর মুখে একটা ছায়া- আলো আঁধারই। জানলার ধারে একটা কর্নার টেবিলে বসে, কানে ফোন। তাকে দেখে হাত নাড়ল। সামনে এসে ইরাবতী না বসে একটু দূরে দাঁড়ালো। ঈশারা করে বেদান্ত ইরাবতীকে বসতে বলল।

ইরাবতী চেয়ার টেনে বসল, কিন্তু মন দিল ঘরটা দেখায়।

এই অল্প নিয়নের আলোয় একটা মায়াবী বাতাবরণ তৈরি হয় ঘরে। আগে এমন সব ঘরে ঢুকলে তার ভীষণ মন খারাপ হয়ে যেত। খুব নাম করা এক ব্যক্তির বাড়িতে সে বারবার যেত। আনন্দে, দুঃখে, রাগে, অভিমানে সব কিছুতেই সেই মানুষটাই ছিলেন তার একমাত্র বন্ধু। জীবনের কত অজানা গল্প শুধুমাত্র তাকেই বলা হয়েছে তার। তিনিও পরম স্নেহে, ভালোবাসায় দিনের পর দিন তাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন।

এত কিছুর মধ্যেও তাঁর বিশাল বাড়িটায় ঢুকলেই মন খারাপ হয়ে যেত। কেমন ছায়া ছায়া বিষন্নতা ঘর জুড়ে। তার মুখ ভালো করে দেখা যেত না।

মাঝে মাঝে মনে হত, মুখের, চোখের, ঠোঁটের মধ্যে মানুষের নানা অভিব্যক্তি ধরা পড়ে। সেগুলো যেন ভালোভাবে বোঝা না যায়, কিছু রহস্য থেকে যায় তাই বুঝি এমন মায়া জাল। অথচ সম্পর্ক নামক গাছটাতে কোনো ছায়া পড়েনি তাদের মধ্যে আজও। এখন আর নিয়ম করে সেভাবে যাওয়া হয় না তার কাছে। তবু তিনি জড়িয়ে থাকেন নানা ভাবে। ভাবতে ভাবতে ইরাবতীর মন উদাস হয়ে পড়েছিল।

চমক ভাঙল বেদান্তর ডাকে। সরি একটা জরুরী ফোন এসেছিল। তুমি অনেকটাই দেরি করে ফেললে। যতটা বলব ভেবেছিলাম, ততটা আজ আর হবে না।

ইরাবতী একটু চুপ থেকে বলল, তাহলে আর অন্য কথা না বলে শুরু করে দিই।

এক মিনিট। বলেই সে কাউন্টারে দাঁড়িয়ে থাকা স্টাফকে ডেকে দার্জিলিং টি আর স্যানডুইচ অর্ডার দিল। তারপর বলল, বলো কি জানতে চাইছ?

প্রথাগতভাবে কিছু জানতে চাইছি না। তুমি তোমার বেড়ে ওঠা কিভাবে, তোমার ছোটোবেলা, কিংবা এইমুহূর্তে যেটা বলতে ইচ্ছে করছে সেটাই বলো।

বেশ, তুমি নোট করে নাও। কিন্তু কতটা তুমি লিখবে বা কিভাবে ব্যবহার করছ সেটা কিন্তু আমাকে দেখিয়ে নেবে।

সিওর। বলে ইরাবতী রেকর্ডিং অন করল।

আমার জন্ম বর্ধমানে। অনেকে ভাবেন আমরা বাংলাদেশের থেকে ভিটে মাটি উচ্ছেদ হয়ে আসা শরণার্থী। কিন্তু সেটা সত্যি নয়। ওদেশে আমাদের কোনো পূর্বপুরুষই কখনো ছিলেন না। সে অর্থে ও দেশে আমাদের কিছুই ছিল না। আমার মার বড় দাদা মানে আমার মামা থাকতেন যশোরে। মামার পরিবার ছিল না, বিয়ে থা’ও করেননি। তাই আমার বাবা তার দেখাশোনা করার জন্য ওখানে যাতায়াত করতেন। তারপর তিনি অসুস্থ হয়ে মারা গেলে জমি বাড়ি সব দেখাশোনা করার জন্য বাবা সেখানেই থেকে গেলেন,এভাবেই আমরা এখানে-কখনো ওখানে। আমি বর্ধমানে বাড়ির কাছে স্কুলে ভরতি হলাম। যদিও এখানে স্কুল যাওয়া হতো না। যেহেতু মা ওখানেই থাকতেন, আমিও বেশিরভাগ সময় সেখানেই। তাই প্রাথমিক পড়াশোনা সে অর্থে বাড়িতেই।তখন তো স্কুলে এত কড়াকড়ি ছিল না। ফলে অসুবিধা হত না। 

খুব মজাতেই ছোটোবেলা কাটছিল। চারধারে জমি, আলখেত, ধানের ক্ষেত, গাছপালা , সাপ, নদী , পুকুর…। আশেপাশে মুসলিমদের বাস। তারা বেশ সমীহ করতেন আমাদের। আবার ওদের বাচ্চাদের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বও ছিল। ছুটি-ছাটায় এখানে আসতাম। সবাই মিলে আনন্দ করতাম। তারপর আবার ফিরে যেতাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় তুমি জন্মেছ? কথা বন্ধ করে প্রশ্ন করল বেদান্ত।

না। ঠোঁট উল্টিয়ে মাথা নেড়ে উত্তর দিল ইরাবতী।

জানোতো মুক্তি যুদ্ধের বিষয়ে?

এমা! এটা জানব না কেন?

সেই। বলে আবার বলা শুরু করল বেদান্ত। হঠাৎ একদিন শুনলাম মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। সবাই তাতে অংশ নিচ্ছে। অত তো জানি না তখন।কাদের মুক্তি কিসের জন্য মুক্তি, কাদের সঙ্গে যুদ্ধ কিছুই জানি না। কানা ঘুষো শুনছি। বাংলা ভাষার জন্য যুদ্ধ। তা আমরা তো বাংলাতেই কথা বলি। তবে! শুনলাম, উর্দু বলতে হবে সকলকে। বাংলা বলা যাবে না। তাই বাংলা যারা বলে তারা যুদ্ধ করছে উর্দুভাষীদের বিরুদ্ধে। 

তখন আমরা এখানে চলে এলাম। আবার শান্ত হলে ফিরে গেলাম। কিন্ত খান-সেনারা তখন একে একে সব জায়গার দখল নিচ্ছে। যদিও আমাদের উপর সেরকম কোনো আঘাত আসেনি, তবুও বাড়ির লোক আর চাইছিল না আমরা ওখানে থাকি।

আশেপাশের পরিস্থিতিও ক্রমশ খারাপ হচ্ছিল। তখন সবাই মিলে ঠিক করল, এদেশে চলে আসা হবে। সেইমতো যাত্রা শুরু হলো। বেশিরভাগ সময়ই রাতের বেলা লুকিয়ে হাঁটা হতো, যাতে সেনাদের হাতে ধরা পড়ে বেঘোরে প্রাণ না যায়। সকালে কোনো স্কুল বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া হতো। আর সবসময় ভয় কাজ করত এই বুঝি তারা এল। আমার মধ্যে অবশ্য ভয়ডর ছিল না। বরং একটা অন্যরকম সাহস কাজ করত।

বেদান্ত এতটা বলে চুপ করে গেল। কিছু যেন ভাবছে এমন ভঙ্গীতে ঠোঁটের উপর ডান হাতের মুঠোটা ঠেকিয়ে বার দুই হাত নাড়ালো। তারপর যেন মনে পড়ে গেছে কিছু, এমন ভাবে হঠাৎ বলে উঠল, এভাবেই এপারে এসে পৌছলাম। এখানে স্কুলে নাম ছিল ঠিকই, কিন্তু কোনো পরীক্ষা দিইনি। তখন আর ১০-১২ দিন বাকি ফাইন্যাল  পরীক্ষার।বইপত্র যোগার করে পড়া শুরু করে দিলাম। তখন মেড ইজি পাওয়া যেত সব বিষয়ের। বাড়িতে পড়লেও বেশিরভাগটাই জানা ছিল। বেদান্ত আবার থামলো। নিজের মোবাইলটা দেখল। কী যেন একটা ভাবল। চায়ে চুমুক দিল। কাকে একটা মেসেজ করল। পরমুহূর্তেই ফোন করল কাউকে। সম্ভবতঃ ওপ্রান্তে ফোনটা ধরল না। 

ইরাবতী আড়চোখে তাকে দেখল। বেদান্ত অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে। না,এখন নিজে থেকে কিছু বলা ঠিক নয় ভেবে, সে মনোযোগ দিয়ে চায়ে চুমুক দিল। উফঃ ঠান্ডা হয়ে গেছে।

এত দামি চাগুলো কেন যে কাচের পটে দিয়ে যায়! খানিকবাদেই জুড়িয়ে জল। এসির ঠান্ডায় কতক্ষণ আর গরম থাকে! কিন্তু এখনো সেই পুরোনো দিনের অভ্যাস- ভাবতে ভাবতেই ইরাবতীর মনে পড়ে গেল প্রথম এমন কাচের পট দেখার দিনটা। কতই বা বয়স তখন! চার-পাঁচ। কিন্তু এখনো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে পুরীর রাজবাড়িতে তাদের সামনে কাঠের সুদৃশ্য ট্রেতে করে দেওয়া এমন পট। তাতে আবার ক্রুসের ডিজাইন করা হালকা বাদামী কাপড়ের কভার। কভার খুলে পট থেকে চা কাপে ঢেলে আলাদা করে রাখা দুধ, চিনি মিশিয়ে পরিবেশন করছে সাদা শার্ট প্যান্ট পরা একব্যক্তি। তার মাথায় আবার বিশাল পাগড়ি। অবাক বিস্ময়ে সে দেখছিল তাকে।   

আমরা কোথায় ছিলাম যেন? চমক ভাঙল বেদান্তর ডাকে।

হ্যাঁ, ওই তোমার স্কুল…

বেদান্ত বলা শুরু করল, অবশ্য এক চান্সেই পরীক্ষায় পাস করলাম।

বাঃ। বেশ মজার তো! ইরাবতী হেসে উঠল।

বেদান্ত হাসল।

কিছুক্ষণ চুপ করে কী একটা ভাবল বেদান্ত। ইরাবতীর দিকে তাকিয়ে রইল মুহূর্তখানেক। মোবাইলটা দেখল। কাউকে একটা টেক্সট করল। তারপর হঠাৎ করেই বলতে শুরু করল, হ্যাঁ, যা বলছিলাম, ইলেভেনে ভরতি হলাম সায়েন্স নিয়ে।

ইরাবতী লক্ষ করছিল, বেদান্ত কথা বলছে ঠিকই, কিন্তু কোথাও একটা ছন্দ পতন ঘটছে বারবার। আর তখনি মনে হল, বেদান্ত প্রেম করছে। তাকেই বারবার জানাচ্ছে কিছু, কিন্তু ওপাশ থেকে উত্তর আসছে না , কিম্বা হয়তো যে উত্তর আসছে তা বেদান্তর মনের মতন হচ্ছে না। তাই অস্থিরতার পারদ চড়ছে। সে গভীরভাবে চশমার আড়াল দিয়ে বেদান্তর দিকে তাকালো। এ কী দেখল সে! এই মানুষটা চরম আঘাত পাবার জন্য খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে। চোখ ঘুরিয়ে নিলো। একটা প্রেম ব্যর্থ হয়ে যাবে ভেবে মন খারাপ হয়ে গেল।

সে ধীরে সামনে রাখা কাপে চা ঢালল। চুমুক দিল। ঠান্ডা হয়ে গেছে। কাপ নামিয়ে রেখে আবার বেদান্তর দিকে তাকালো।

ঠান্ডা হয়ে গেছে? ওটা খেতে হবে না। আর একবার বলছি দাঁড়াও।

না, থাক। আজ এই অবধি থাক। বাকিটা আবার একদিন শুনব।

ঠিক আছে তাহলে। আবার একদিন বসছি তবে। এমনিতেও এখনি একজন আসবে। সে এলেই আমিও উঠে পড়ব।

ইরাবতী হেসে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল। তার মনে হল, বেদান্ত যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। নিজের মুখে বলতে পারছিল না। অথচ…

চলি। দেখা হচ্ছে। বলে সে এগিয়ে গেল লিফটের দিকে।

এসো। সাবধানে যেও। বলে হাত নাড়ালো বেদান্ত।

   বেশ ভোরেই বিছানা ছাড়ে বেদান্ত। এটা তার বহুদিনের অভ্যাস। বাবা বলতেন, সূর্য উঠে গেলে আর উঠে কাজ নেই। যা কিছু ভালো সব তার আগেই উঠে সেরে নিতে হয়। নইলে সূর্যদেব রাগ করেন। সত্যি সূয্যিমামা রাগ করেন কিনা কোনোদিন পরখ করা হয়নি তার। কিন্তু অভ্যাসটা রয়েই গেছে।

বিছানা ছেড়ে মুখ ধুয়ে ঘড়ি ধরে এক ঘন্টা যোগ ব্যায়াম করল। ওয়াকারে ৬০ স্পিডে তিরিশ মিনিট হেঁটে ঘর ছেড়ে বাইরের লনে বেরিয়ে এল।

এখান থেকে তাদের শোবার ঘরটা পরিস্কার দেখা যায়। আমাদের শোবার ঘর কথাটা ভেবেই নিজের মনে হাসল সে। কত বছর হয়ে গেল এই ঘরটা, বিছানাটা তার নয়, কিম্বা হয়তো তারও। কিন্তু এখন সে আর ওই ঘরে থাকে না। অবশ্য বাড়িতে থাকিই বা কতটুকু সময়! দিনের পর দিন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা, এক দেশ থেকে অন্য দেশ ঘুরে চলেছি। কখনো কখনো নিজের বাড়িতে নিজেকেই অচেনা লাগে।

পিয়াকেও কী পুরোটা চিনি আমি? নিজেকেই বা কতটা চিনতে পেরেছি? অথচ পিয়ার জন্য একদিন কত পাগল ছিলাম। এখনো কী আমি পিয়াকেই সবার প্রথম স্থান দিই না!

দুজনের মধ্যে মানসিক দূরত্ব বেড়েছে এটাও যেমন ঠিক, তেমনি তাকে ছেড়ে অন্য কারোর সঙ্গে ঘর বাঁধব এই ভাবনাও তো কখনো মাথায় আসেনি।

আমার প্রথম প্রেম, আমার স্ত্রী, সব ছাড়িয়ে সে আমার সন্তানের মা। তাকে ছাড়া আমি কী পূর্ণ হতে পারি! নিজের মনেই বিড়বিড় করছিল বেদান্ত। তখনি মনে পড়ে গেল পিয়ার সঙ্গে প্রেম, বিয়ের কথাগুলোই বলা হয়নি ইরাবতীকে। সে লন ছেড়ে নিজের স্টাডিরুমে ফিরে এল। মোবাইল অন করে হোয়াটাস আপে ভয়েস রেকর্ড করতে শুরু করল।

হাই ইরাবতী কি খবর? নিশ্চয়ই ঘুমোচ্ছ তুমি? কাল রাতে কিছু পাঠিয়েছিলাম। দেখেছ কী? এখন তোমাকে আবার কিছুটা পাঠাচ্ছি। আমার আর পিয়ার পরিচয় থেকে মৌসমের জন্ম অবধি যতটা মনে পড়ছে পাঠাচ্ছি।

হ্যাঁগো, শুনছ? তুমি কী চা খেলে? পিয়ার প্রশ্নে রেকর্ড  অফ করল বেদান্ত। একটু অবাক হল। এত তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছে পিয়া! তার ঘুম ভাঙতে ভাঙতে আটটা হয়েই যায়। শরীর ঠিক আছে তো! বেদান্ত স্টাডিরুম ছেড়ে ডাইনিংরুমে বেরিয়ে এল।

চা খেয়েছ?পিয়া আবার জানতে চাইল।

না। তুমি এত সকালে উঠে পড়লে? শরীর ঠিক আছে তো?

সব ঠিক আছে । ঘুম ভেঙে গেল। মনে হল এক সঙ্গে চা খাই আজ। তাই আর কী!

বেদান্ত হাসল। দাঁড়াও আজ আমি চা বানাই। বলে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়াবার আগেই দীনবন্ধু চা নিয়ে হাজির হল।

আমি আপনারও বন্ধু, দীনেরও বন্ধু। দীনবন্ধু। চা রেডি দাদা। টেবিলে চায়ের প্লেট নামিয়ে বৌদির মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল কোনো নির্দেশের জন্য।

পিয়া কিছু বলার আগেই বেদান্ত বলল, আজ একটু লুচি ভাজতে পারবি? রোজ ওই কর্ণফেক্স আর পাউরুটি খেতে খেতে পেটে ছাতা পড়ে গেছে।

তুমি এই সক্কাল সক্কাল লুচি খাবে? পিয়া তেড়ে উঠল।

হ্যাঁ ,খাব। তুমিও একটা খাবে। আরে বাবা শরীরে কখনো কখনো তেল যাওয়া ভালো। মৌসম কোথায়? উঠেছে? ওকেও আজ লুচি খাওয়াও।

দীনবন্ধু তখনো দাঁড়িয়ে আছে দেখে বেদান্ত বলল, নিশ্চিন্তে ভাজ লুচি। একদিন বৌদি কিছু বলবে না।

আচ্ছা। বলে রান্না ঘরের দিকে গেল দিনবন্ধু।

কী ব্যাপার বলতো! আজ তোমাকে দারুণ খুশি মনে হচ্ছে। ভাল কিছু স্বপ্ন দেখেছ বুঝি!

বেদান্ত জোরে হেসে উঠল। পিয়া মানুষ কেন বাঁচতে চায় বলতো? চারদিকে তো খালি সব নেগেটিভ। খবরের কাগজ থেকে টিভি সব জায়গাতেই নেগেটিভ দিয়ে দিন শুরু। ঘুমের মধ্যে ভালো স্বপ্ন দেখে বলেই বাঁচতে পারে মানুষ।

যা খুশি দেখ,আমার আপত্তি নেই, খালি আমি থাকলেই হলো সেখানে।

স্বপ্নে?

হুঁ।

বেদান্তর হঠাৎ মনে হল, স্বপ্নে কী আজকাল পিয়া আসে? নাকি পার্বনী?সে মুখে কিছু না বলে হাসল পিয়ার দিকে চেয়ে। চায়ে চুমুক দিয়ে শেষ করল কাপ। তারপর বলল, আমি স্টাডিতে বসছি।একটু কাজ আছে।এখন কাউকে পাঠিও না।

লুচি ভাজতে বললে যে! খাবে না? এক্ষুনি হয়ে যাবে তো!

ওখানেই পাঠিয়ে দিও।একটা জরুরী নোটস এখনই না পাঠালে ভুলে যাব পরে, বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল।

পিয়া জানে এরপর কিছু বলা বৃথা। সে চেয়ার ছেড়ে উঠে রান্না ঘরে গেল। দুপুরের রান্না আর অফিসের টিফিনের নির্দেশ দিতে। তেল ঝাল মশলার মাপ ঠিকমতো বলে না দিলে গুচ্ছের তেল দিয়ে দেবে।তখন আরেক ঝামেলা।

স্টাডি রুমে গিয়ে আবার মোবাইল হাতে নিলো বেদান্ত। পার্বনীর মেসেজ। ঘুম ভাঙল সোনা? কখন থেকে অপেক্ষা করছি।

উঠেছি অনেকক্ষণ। ভাবছিলাম তোমাকেই ফোন করব।

ভাবছিলে? মিথ্যে, নিশ্চয়ই পিয়ার সঙ্গে ছিলে, তাই আমাকে…

বেদান্তর মুড অফ হয়ে গেল। পার্বণী আজকাল প্রায়ই যে ঢঙে কথা বলে সেটা তার পছন্দ হয় না। ঠিক কথাই হৃদয়ের একটা বড় অংশ জুড়ে পার্বণী। তবু মাঝে মাঝে দম বন্ধ হয়ে আসে। মনে হয় জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত কেড়ে নিচ্ছে সে। কারোর জন্য, এমনকি নিজের বা পরিবারের জন্যেও তার আর সময় নেই। সর্বক্ষণ একটা তীক্ষ্ণ মনিটারিং এর মধ্যে থাকছে সে।

প্রথম প্রথম এত পজেসিভনেস ভালো লাগত তার। কিন্তু এখন এক সঙ্গে মন আর মাথার মধ্যে বিরোধ চলে। মাথা যেন বুঝিয়ে দেয় এই তীব্র প্রেম, এই আসক্তি তার জন্য ঠিক নয়, তবু…

বেদান্ত মাথার প্রতিক্রিয়ার উপর আচ্ছাদন পরিয়ে দিয়ে মনকে গুরুত্ব দিয়ে বলল, না, সোনা। আমি ভাবলাম,কাল অত রাত অবধি আমরা গল্প করলাম, এই তো সাড়ে চারটেয় শুলে তুমি… হয়তো একটু ঘুমিয়েছ সবে, আবার তুলে দেব? তাই অপেক্ষা করছিলাম তোমার ফোনের। তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্য আমি তো ছটপট করি, তুমি বোঝ না সোনা…। বেদান্তর গলায় তীব্র প্রেমের মাদকতা পার্বণীকে স্পর্শ করল। সে কতগুলো চুমু দিল। সেই চুমুর শব্দ ইথারতরঙ্গ ছুঁয়ে বেদান্তর কাছে পৌঁছে গেল। সেও তার প্রত্যুত্তর ভাসিয়ে দিল একই পথে। তারপর, এখন একটু কাজ সেরে নিই। বিকেলে দেখা হচ্ছে, বলে ফোন রেখে দিল। মোবাইলকে এরোপ্লেন মোডে দিয়ে রেকর্ডার অন করল।

গাড়িতে উঠে কানে হেডফোন গুঁজে বেদান্তর হোয়াটসআপে পাঠানো অডিও শুনতে লাগল ইরাবতী।

কলেজে ভর্তি হবার সময় দাদা এলেন মাদ্রাজ থেকে। বললেন,সেখানে মশলার ব্যবসা খুবই জনপ্রিয়। দাদার এক বন্ধুর রাস্তার ধারে বাড়ি ছিল। সেখানেই দুটো ছোটো ঘর ভাড়া নিলাম। আমরা লিফ্লেট বানিয়ে আটা জ্বাল দিয়ে নিজেরাই ট্রেনের টিকিট কাউন্টারের সামনে, এখানে সেখানে লাগিয়ে দিলাম।কম পয়সায় ভালো মশলা… ইত্যাদি প্রভৃতি।

একদিন ট্রেনে ফিরছি। এক ভদ্রলোকও একই ট্রেনে ফিরছেন। গল্প করতে করতে ব্যবসার কথা শুনে তিনি বললেন, এ্যাড দাও কাগজে। ভালো রেস্পন্স হবে।

আমি বললাম, টাকা পয়সা নেই, কী করে বিজ্ঞাপন দেব!

উনি একটা কার্ড দিলেন। মিস্টার রাঘব চ্যাটার্জী। তাদের একটা মিডিয়া এডভারটাটাইসিং এজেন্সি ছিল। রাসেল স্ট্রিটে অফিস। দু-তিন বাদে তার কাছে গেলাম। তিনি একটা লে-আউট করে দিলেন। 

যেদিন এ্যাড বেরোলে সেদিন বিকেলের দিক থেকে ছোটো ছোটো দোকানের লোকজন খোঁজ শুরু করল। তারপর আস্তে আস্তে অর্ডার বাড়তে লাগল। সেখান থেকে আজ এখানে।   

কানে হেডফোন গুঁজেই অফিসে পৌঁছল ইরাবতী। নিজের ঘরের দরজা খুলে চেয়ারে বসে জল খেল। তারপর

ভয়েস রেকর্ড অফ করে দিল। প্রতিটা মানুষের উত্থানের পিছনে কঠোর পরিশ্রম লুকিয়ে থাকে। প্রত্যেকের জীবনের গল্পটা হয়তো আলাদা, পথটাও, কিন্তু সংগ্রামের কাহিনিটা এক। বাবাকে কী কম সংগ্রাম করতে হয়েছিল এতগুলো মানুষের মুখে খাবার তুলে এবার জন্য!

নামেই সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মেছিলাম। কোন ছোটোবেলা থেকে কী অপরিসীম লড়াই করতে হয়েছে দুমুঠো ভাতের জন্য, সে কথা ভাবলে নিজের চোখেই জল আসে। এই যে তোরা এত উপন্যাস গল্প পড়িস, তার থেকে কোনো অংশে কম নয় আমার জীবন। নিজের পড়াশোনা চালানো, ভাই বোনদের মুখে খাবার যোগানো, পড়ানো সব একা হাতে। বাবা অতবড় জমিদারি, বাড়ি ঘর সংসার ছেড়ে সন্ন্যাস নিলেন। একবারও আমাদের কথা ভাবলেন না। কতই বা বয়স ছিল আমার! খুব বেশি হলে বারো। চার চারটে ভাইবোন, মা সব নিয়ে অকূল জলে পড়লাম।

ইরাবতী চুপ করে শুনত বেদব্যাসের কথা।

প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ভাবতাম আজ চলবে কী করে! মাথায় মুট পর্যন্ত বয়েছি ওই দশ এগারো বছর বয়সে। তোরা কল্পনাও করতে পারবি না খিদে কাকে বলে! একটা চালের বস্তা বয়ে আনলে দশ আনা পাওয়া যেত। তাই দিয়ে চাল কিনে আনতাম। মা কাঁদত আমার অবস্থা দেখে। সোনার বরণ, গৌরাঙ্গর মতো লালাভ গা, মুট বয়ে হাতে পিঠে কালসিটে পড়ে গেছিল।

তুমি এত পড়াশোনা করলে কখন বাবা? ইরাবতী অবাক হল বেদব্যাসের কথায়।

যে বাড়িতে থাকতাম সেখানে ঘর কোথায় থাকার মতো! যে স্কুলে পড়তাম, সেখানকার মাস্টারমশাই একদিন বললেন, স্কুল রাতে পাহারা দেবার জন্য একজন লোক খুঁজছেন। বললাম তাঁকে, স্যার আমি পাহারা দেব। তখন আমার বয়স বারো তেরো।

মাস্টারমশাই অবাক আমার কথা শুনে। কী বলে ছেলেটা! এতবড় স্কুল রাতে পাহারা দেবে এতটুকু বাচ্ছা ! তাছাড়া সবাই ভাবত আমরা বেশ বড়লোক। কারণ স্কুলে প্রতিদিন ইস্ত্রি করা জামা প্যান্ট পরে যেতাম। আমার মাকে দেখেও কেউ বুঝতেই পারতেন না আমাদের বাড়ির ভিতরের অবস্থা এই।

আসলে ঠাম্মার চেহারাটাই তো দারুণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন। দেখলেই শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে। ইরাবতী বলল।

হ্যাঁ। সেই যুগে মা যেভাবে অনর্গল পাঁচ- ছটা ভাষায় কথা বলে যেতেন, তা সকলকে চমক লাগিয়ে দিত। অমন মা দূর্গার মত দেখতে, লাল পাড় সাদা শাড়ি পাট ভেঙে পরে যখন বাচ্চাদের পড়াতে যেতেন সকলে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতেন মার দিকে। মা শিখিয়েছিলেন যতই অভাব অনটন থাক, সেটা কোনোভাবে শরীরে বা মনে যেন প্রকাশ না পায়। বাইরের কেউ যেন বুঝতে না পারে তোমরা শাক ভাত কিম্বা শুধু নুন দিয়ে ভাত খাচ্ছ। তাহলেই সহানুভূতির ঝড় বয়ে যাবে। কাজেই আমরা খুব সচেতন ছিলাম এটা নিয়ে।

তারপর তুমি স্কুল বাড়িতে চাকরি পেলে?ইরাবতী জানতে চাইল বাবার থেকে।

হ্যাঁ। বললাম, বাড়িতে অনেক মানুষ, নিরিবিলিতে পড়ার জায়গা চাই। এর থেকে ভালো আর কিছু হতে পারে না। তিনি তখন এর বিনিময়ে কী চাই জানতে চাইলেন। আমি বললাম, টাকা পয়সা চাই না। স্কুলের পড়াশোনা ফ্রিতে করে দিতে। কীসব দিন গেছে সেইসময়। অন্ধকার ঘর। আলো নেই। একটা বালিশ আর চাটাই খালি সম্বল। হ্যারিকেনের আলো তো সারারাত জ্বালিয়ে রাখা যাবে না। কেরোসিন কেনার টাকা কোথায়! প্রথমেই তাই খানিকটা পড়ে নিয়ে আলো নিভিয়ে দিতাম। মশা, ব্যাঙ, কখনো কখনো সাপ ঘুরে বেড়াতো। মাঝে মাঝেই অচেনা লোকেদের আগমন হতো গভীর রাতে।

তারা কারা বাবা?

ভূত। বলেই হেসে ফেলল বেদব্যাস। আসলে কিছু ভবঘুরে রাতে ওখানে আশ্রয় নিত। যাতে কেউ তাদের তাড়িয়ে না দেয়, বা রাতে কেউ তাদের খোঁজ না পায়, তার জন্য দিনের বেলা তারাই ভূতের আজগুবি কাহিনি লোকেদের শুনিয়ে ভয় দেখিয়ে রাখত।

তোমাকে দেখায়নি?

চেষ্টা করেছিল। কিন্তু শ্মশানে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কাটাতে কাটাতে ততদিনে আমি নিশ্চিত ছিলাম ভূত বলে কিছু নেই। আর যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই আছে, তারাও বুঝে গেছে আমি কে! চেনা বামুনার যেমন পৈতে লাগে না, আমার মুখও তেমনি তাদের চেনা হয়ে গেছে। কাজেই তারা আমার ঘাড় মটকাবে না , এই বিশ্বাস ছিল। হেসে উঠল বেদব্যাস।

ইরাবতীও হাসল।      

বেদব্যাস বলল, আসলে মানুষের মনের অন্ধকারই হল ভূত। তারপর উদাস ভঙ্গীতে বলল, কিন্তু একটা অদৃশ্য শক্তি আমাকে সবসময় পথ দেখিয়েছে, যার জন্যই আজ এখানে পৌঁছতে পেরেছি। ভাই-বোন প্রত্যেকে প্রতিষ্ঠিত। মা বাবা দুজনেই শান্তিতেই গেছেন। 

বাবা তুমি দেখ আমরা কেউ তোমায় কষ্ট দেব না।

আজ আর নতুন করে কোন কিছুই আমায় স্পর্শ করে নারে। সুখ দুঃখ আনন্দ শোক এগুলো সবই অস্থায়ী। নিজের মধ্যেই এখন আমি অনন্ত আলো পেয়ে গেছি। কিন্তু আমার এখন চিন্তা তোকে নিয়ে। আমি যখন থাকব না তোকে কে দেখবে? তুই তো নিজের জন্য সামান্যতম দাবীও করতে শিখলি না।

বাবা তুমি কী কারোর কাছে কোনো দাবী করেছিলে? সব তো একা সমাজের নানান প্রতিকূ্লতার বিরুদ্ধে লড়াই করে অর্জন করেছিলে। আর আমার তো কিছু চাই না। সম্পত্তি, টাকা, যশ , ক্ষমতা কোন কিছুই আমাকে টানে না। শুধু তুমি থেকো আমার সঙ্গে। তাহলেই হবে।

যা এবার, অনেক হয়েছে, নিজের কাজে ফের। আমি পুজোয় বসি। অনেক বেলা হয়ে গেল।

হ্যাঁ, আসছি বাবা।

ম্যাডাম, ও ম্যাডাম ঘুমিয়ে গেলেন নাকি? বাবু এবার বেশ জোরে ডাকল। ম্যাডাম… বাবুর ডাকে সম্বিৎ ফিরল ইরাবতীর।

কি হয়েছে?কিছু বলবি?একটা স্বপ্ন হঠাৎ ভেঙে গেছে যেন এমন বিষন্ন স্বরে ইরাবতী খুব আস্তে জানতে চাইলো।

চা দিয়ে গেছিলাম অনেকক্ষণ আগে। কোনো সাড়া শব্দ নেই দেখে অমলদা দেখতে পাঠালো। কথা বলতে বলতে ঠান্ডা চা পালটে দিয়ে ফ্ল্যাক্স থেকে নতুন গরম চা ঢেলে দিল বাবু।

থ্যাঙ্কস। অমলকে ডেকে দিস। আর শ্রেয়া ম্যাডাম এসেছে?

হ্যাঁ শ্রেয়া আর মোম ম্যাডাম দুজনেই এসেছেন। মোম ম্যাডাম টাইপ করছেন আর শ্রেয়া ম্যাডাম অমলদার থেকে কাজ বুঝছেন।

আচ্ছা। বোঝানো হয়ে গেলে পাঠিয়ে দিস।

বাবু চলে গেলে চায়ের কাপে লম্বা চুমুক দিল ইরাবতী। বেদান্ত এর পর কী বলছে জানার আগ্রহ হল। পরমুহূর্তেই মনে হল, অফিসে বসে কোনো রেকর্ড শোনা ঠিক হবে না। প্রতিটি মানুষের একটা ব্যক্তিগত জীবন থাকে। কারোর সঙ্গে যদি তা সে ভাগ করে নিতে চায় তবে সেটা গোপন রাখাই ভাল। সেই গোপনীয়তা সর্বসমক্ষে ছড়িয়ে দেওয়ার নয়। ল্যাপটপ অন করে অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল ইরাবতী।

অফিসে প্রায় থাকাই হয় না বেদান্তর। সারাক্ষণ দৌড়ে বেরাচ্ছে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। বিশ্বের যে কোনো বিজনেস ফেস্টের বাংলার প্রধান মুখ সেই-ই। তাছাড়া বিভিন্ন বিজনেস ক্লাবের চেয়্যারম্যান, প্রেসিডেন্ট সবই সে। আজকাল আর তার ভালো লাগে না এত গম্ভীর মুখ করে সব সময় কমার্সিয়াল আলোচনা শুনতে। বড্ড ক্লান্ত লাগে। না পাবার তো কিছু নেই। সবই এখন তার আয়ত্ত্বে। এত জায়গায় ব্যবসা, নাম ডাক যশ অর্থ সুন্দরী গুনবতী স্ত্রী, প্রেমিকা… জীবনে বেঁচে থাকতে গেলে যা যা দরকার সব আছে তার। তবু যেন কী নেই। একটা অস্থিরতা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেরায়। মাঝে মাঝেই মনে হয় বেশ হত যদি একটা আশ্রম করে দূরে কোনো নির্জন পাহাড়ের কোলে বা জঙ্গলে বাস করা যেত। আবার মনে হয়, সেতো রক্তমাংসের তীব্র অনুভূতিপ্রবণ একটা মানুষ। যদি আশ্রমে থেকেও লোভ সম্বরণ করতে না পারে, কোনো নক্কারজনক কাজে জড়িয়ে পড়ে, তবে তার থেকে লজ্জার আর কিছুই থাকবে না।

এই যে পার্বণীর সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠতা, তারই বা পরিনতী কী! মেয়েটা দিন দিন আরো বেশি করে তাকে বেধে ফেলছে। সেও যে তাতে খুশি হচ্ছে না, এমন তো নয়। গাড়ি নিয়ে দুজনে যখন লং ড্রাইভে যায় তখন নিজেকে মনে হয় সবচেয়ে সুখী মানুষ। সমুদ্রে নেমে হুটোপুটি, ঘন জঙ্গলের ভিতর লুকোচুরি, হাতের উপর হাত রেখে চুপ করে বসে থাকা, কিংবা পার্বণীর কোলের উপর মাথা রেখে চোখ বুজে শুয়ে থাকার মুহূর্তগুলো যেন এক একটা স্বর্গীয় সুখ। কিন্তু তারপরেই হঠাৎ সব ফাঁকা লাগে।

অনেকদিন বাদে নিজের অফিসে বসে এসব কথাই ভাবছিল বেদান্ত। ইন্টারকমটা বেজে ওঠায় ভাবনার ঘোর সহসা কেটে গেল।

স্যার, পার্বনী ম্যাডাম এসেছেন। পাঠাচ্ছি।

হ্যাঁ , পাঠাও। মুখে বলল বটে, কিন্তু কোথাও একটা ছন্দে গন্ডোগোল হচ্ছে, ঠিক মনটা আগের মত খুশিতে ভরে উঠল না। তবু মুখে প্রশান্তির এক চিহ্ন এঁকে নিল। পার্বণীর কাছে স্বাভাবিক থাকতে হবে। নইলে অনর্থক কিছু ঘটাতে দু’মুহূর্তও সময় নেবে না সে।

দরজা খুলে এক গাল হাসি নিয়ে ঘরে ঢুকে সামনের রিভলভিং চেয়ারে বসল পার্বণী। সঙ্গে সঙ্গে ঘরটা এক অজানা সুগন্ধীতে ভরে গেল।মেয়েটা সামনে এলে আর তার থেকে চোখ সরানো যায় না। এখনো সেই প্রথম দিন দেখার মুহূর্তে বুকের মধ্যে যে মাদল বেজে উঠেছিল তার শব্দই প্রতিধ্বনীত হয় যতবার সামনে সে আসে।

পার্বনী আজ একটা কাঁচা হলুদ রঙের লাল পাড় নকশা কাটা তাঁতের শাড়ি পরেছে। হাতে লাল হলুদ চুড়ি, গলা, কান সব ম্যাচ করে পরা। কোমর ছাড়িয়ে এক মাথা কালো কোচকানো চুল, তাতে আবার হাইলাইট করা।ঠোঁটে স্মিত হাসি।বাদামি চোখে গভীর উজ্জ্বলতা।

 চেহারার এই দৃপ্তি, গাঢ় গোলাপি ঠোঁটের বেঁকানো হাসি, চোখে আদিম অরন্যের মাদকতা দেখেই সে পাগল হয়েছিল সেই দিন।

আজও মনে আছে সেই দিনটা।

 অফিসে ঢোকার মুখেই মোবাইলে মেসেজ এসেছিল একটা অচেনা নম্বর থেকে। স্যার আমি নাচ করি। নজরুলমঞ্চে আমার অনুষ্ঠান আছে। আপনি যদি চিফ গেস্ট হন খুব ভাল লাগবে। আমি সম্মতি নেবার জন্য আপনার অফিসের সামনে অপেক্ষা করছি।

সাধারণত এই ধরনের মেসেজ অনবরত আসতেই থাকে বলে বিশেষ পাত্তা দেয় না সে। কিন্তু সেদিন কী যেন একটা ইচ্ছে জাগল। উত্তর দিল, এসো। তবে মিনিট দুই-য়ের বেশি সময় দিতে পারব না।

নিজের চেম্বারে গিয়ে বসার পর দরজার ফাঁক দিয়েছিল অস্থির ভাবে তার ঘরের দিকে চেয়ে অসাধারন সুন্দরীকে দেখে তার চোখ মন ধাধিয়ে গেল।

বিন্দুমাত্র তর সইছিল না তখনি তাকে ডাকার জন্য। তবু ইচ্ছে করেই মিনিট পাঁচেক বাদে ডেকে পাঠালো। তারপরের সময়টুকু শুধু ভেসে যাওয়া।

হার মেনেছিল বয়স, পদ মর্যাদা, মন সহ সবকিছু।

পার্বণী বলে যাচ্ছিল নানা কথা বিনীত ভাবে। কিছু কানে যাচ্ছিল, কিছু নয়। শুধু মন চাইছিল এইটুকু সময়ের জন্য থমকে যাক ঘড়ির কাটা। স্তব্ধ হয়ে যাক আশেপাশের যাবতীয় কর্মযজ্ঞ। শুধু সে আর পার্বণী ছাড়া আর কোনো কিছুই যেন সত্য না হয়।

ক্রমশ দুজনের ঘনিষ্ঠতা বেড়েছিল। পার্বণী ছাড়া যেন জীবন মানেহীণ। নিজেকে কৃষ্ণ আর তাকে রাধা মনে হচ্ছিল। পার্বণীও তাকে ভরিয়ে দিয়েছে ভালবাসার মাদকতায়, প্রেমে, আদরে, চুম্বনে, নানা ভাবে,নানা রঙে।

তবু কোথায় যেন একটা বিরহের সুর নীরবে বাজছে, বেদান্ত চশমার ফাঁক দিয়ে খুঁটিয়ে পার্বণীকে দেখতে দেখতে এসবই ভাবছিল।

কী দেখছ অমন করে? সলজ্জ ভঙ্গীতে বেদান্তর চোখের দিকে তাকিয়ে মুখ নামিয়ে নিল পার্বণী।

বেদান্ত হাসল। দেখছি তোমার চোখে সমুদ্রের হাতছানি।

 আমরা কী বেরতে পারি? নাকি এখানেই বসে থাকতে হবে!চোখে দুষ্টুমির হাসি হেসে পার্বণী বলল।

বেদান্তর ইচ্ছে হল না বেরতে। বেশ কয়েকমাস বাদে আজ অফিসে বসেছে। কিছু জরুরী মিটিংও আছে। সে শান্তভাবে বলল, যেতে তো ইচ্ছে করছে, তুমি এসেছ, আমার কী এখানে বসে থাকতে ভাল লাগছে ! না লাগবে? কিন্তু…

বুঝেছি। নিশ্চয়ই পিয়াদিও আসবেন। বেদান্ত কিছু বলার আগেই পার্বণী উঠে পড়ল। চলি। আজ আর কথা হচ্ছে না। বাই।

কেন আজ কী আছে? আমি একটু কাজগুলো সামলে নিয়ে আসছি। তুমি খানিকক্ষণ অপেক্ষা করো প্লিজ। বেদান্ত বলল।

না। মুড অফ হয়ে গেছে। বলে পার্বণী আর কোনো কথার অপেক্ষা না করে দরজাটা সজোড়ে টেনে বন্ধ করে বেরিয়ে গেল।

বেদান্তরও মেজাজটা বিগড়ে গেল। যখন তখন পার্বণীর এই মুড অফ, তার কাজকে অস্বীকার করা, ইচ্ছাকৃত ভাবে কষ্ট দেওয়াটা আর মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে। সে একবার ভাবল টেক্সট করে পার্বনীর মন ঠিক করে দেবে। আবার ভাবল, সব মিটিং ক্যান্সেল করে দেবে।

কী হবে এত কাজ করে? কেনই বা করব? অনেকদিন তো হল। এখন সব ঠিক চলছে। আমি না থাকলেও খুব অসুবিধা হবে না। কিন্তু …। থাক। ওই বা কেন আমাকে বুঝবে না! আজ কোথাও যাব না, অফিসেই থাকব- ভেবে মোবাইলটা হাতে নিয়ে কাউকে ফোন করতে গেল। তখনি ইরাবতীর মেসেজ এল । না দেখলেও হয়। এমন কিছু প্রয়োজনীয় মেসেজ নয়। তবু কিসের একটা আশায় পড়ল।

 ইরাবতী লিখেছে- ‘মন তোমাকে চায় , মন তোমাকে চায় না, প্রাণ তোমাকে চায়, প্রাণ তোমাকে চায় না। এই নিয়েই চলে দ্বন্ধ,এটাই কী তবে ভালোবাসার ছন্দ!’।

লেখাটা বার দুয়েক পড়ল। ইরাবতী কীভাবে মনের কথা পড়তে পারে! কী করে জেনে যায় তার মধ্যে এমন টানাপোড়েন চলছে – বেদান্ত সেইমুহূর্তে কোনো উত্তর না দিয়ে হোয়াটস আপে স্টেটাস দিল- মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে…

তারপর সামনে রাখা ফাইলগুলো ভাল ভাবে না দেখেই সই করতে লাগল।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছিল পিয়া। নিজেকে দেখতে সে একবারেই ভালোবাসে না। কী ভীষণ মোটা হয়ে গেছে সে! বুকে পেটে কোমড়ে পাছায় একগাদা চর্বি জমে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে বড়সড় একটা পিপে। যতই ফর্সা আর ভালো মুখশ্রী হোক না কেন এই বেঢপ সাইজটা দেখলেই আয়না দেখার ইচ্ছেটা চলে যায়। সে আরেকবার নিজেকে দেখে নিয়ে আয়নার সামনে থেকে সরে এল।

দেওয়ালে ঝোলানো ঘড়িটার দিকে তাকালো। হাতে এখনো ঘন্টাখানেক সময় আছে। এর মধ্যে আজকের আলোচনায় নিজের বক্তৃতার বিষয়টা ঠিক করে নিতে হবে। লেডিস ক্লাবে আলোচনা নারী বিশ্ব নিয়ে। বক্তারা সকলেই নামকরা সফল নারী। কিন্তু এই সফল নারীদের নিয়েই কী বিশ্ব!

পৃথিবী জুড়ে অজস্র মহিলা আছেন, যারা নিজেদের সংসার বজায় রাখার কিংবা ছেলে মেয়ে মানুষ করার জন্য প্রাণপণ পরিশ্রম করে চলেছে। কিন্তু তাদের কথা নিয়ে কোথাও আলোচনা হয় না। এমনকি তাদের পরিশ্রমের কোনো দামও দেয় না কেউ। অথচ নারীর বিশ্ব নিয়ে এত আলোচনা চলছে। আচ্ছা, নারীর কী কোনো নির্দিষ্ট দিন হয় নাকী বিশ্বটা তার! যে যাই ভাবুক আর আধুনিক হোক শেষ অবধি কিন্তু নিজের স্বামী পুত্র কন্যার মধ্যেই তার সবকিছু আবর্তিত বিবর্তিত হয়। না হলে একা থাকা। কিন্তু সেই একা থাকলেও কী পূর্ণ স্বাধীনতা পাওয়া সম্ভব! আজ আমাকে আলাদা করে ক’জন চেনেন! যদি এই মানুষটির সঙ্গে আমার বিয়ে না হতো তবে কী এখন যেখানে দাঁড়িয়ে সেখানে পৌঁছাতে পারতাম!

মনে মনে নিজের বক্তব্য গুছিয়ে নিচ্ছিল পিয়া।কোথা থেকে তার বক্তব্য শুরু করবে আজ! বেদান্তের সঙ্গে তার আলাপ, প্রেম,মাঝে কিছুদিন ব্রেক আপ, তারপর বেদান্তের গাড়ি দূর্ঘটনা…। দূর্ঘটনার কথা মনে পড়তেই চোখ বন্ধ করে ফেলল পিয়া।

রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারদিক। বেদান্তের মাথাটা একজনের কোলে।মুখটা থেঁতলে গেছে।চেনাই যাচ্ছে না।তাকে ওই অবস্থায় দেখে নিজেকে ক্ষমা করতে পারছিল না কিছুতেই।সে জোর করে বেদান্তের জীবন থেকে সরে যাবার চেষ্টা করেছিল।বেদান্ত ভেবেছিল, তার অন্য কোনও সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। সে নিজে থেকে এই ভুল ভাঙাবার কোনও ইচ্ছে পোষণ করেনি।

কী ভীষণ যন্ত্রণাময় ছিল সেই দিনগুলো। একদিকে নিজের ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়েছে। ডাক্তার বলছেন,যতদিন বাঁচবে নিয়ম করে রক্ত পালটাতে হবে, অন্য দিকে বাচ্চা হবার সম্ভাবনাও ক্ষীণ, অতিরিক্ত কেমো, স্টেরয়েড এবং দীর্ঘদিন ধরে চলা ওষুধের কারণে।

বেদান্ত আর সে তখন পাগল দুজন দুজনের জন্য। কিন্তু সে কী দিতে পারবে বেদান্তকে? না শান্তি না সুখ।এমনকি একটা সন্তানও নয়। মানুষটা কিসের আশায় বাঁচবে তবে? এই অবস্থায় নিজেকে বেদান্তের থেকে সরিয়ে নেওয়াটাই একমাত্র পথ বলে মনে হয়েছিল তার।

কতই বা বয়স তখন তার! সতেরো আঠেরো। বেদান্তের সামনে অন্য একটা ছেলের সঙ্গে হাত ধরে ঘুরে বিশ্বাস করাতে চেয়েছিল সে আর বেদান্তকে ভালোবাসে না। বেদান্ত মুখে কিছু বলেনি ঠিকই, কিন্তু নিজেকে শেষ করে দেবার নেশায় মেতেছিল। নইলে কেউ সদ্য গাড়ি চালাতে শিখে হাই রোডে একশো পঞ্চাশ কিমি বেগে গাড়ি চালায়! চলন্ত গাড়ির সামনে গরু এসে পড়ায় ব্রেক করার মত আর অবস্থা ছিল না। গরুকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের মৃত্যুর পথটাই বেছে নিয়েছিল।

তারপর টানা তিন মাস যমে মানুষে টানাটানি।কী সব দিন গেছে তার!খবরটা পেয়ে আর নিজেকে সংযত রাখতে পারেনি সে। দৌড়ে গেছিল হাসপাতালে। পরবর্তী তিন মাস বাড়ি ঘর ভুলে হাসপাতালটাকেই নিজের বাড়ি বানিয়ে নিয়েছিল সে।দিন রাত বেদান্তের পাশে থেকে তাকে সুস্থ করার জন্য প্রাণ মন লাগিয়ে দিয়েছে।

তারপর হাসপাতাল থেকে ফিরে একবারে বিয়ের পিঁড়িতে সেই যে চার হাত এক হল, এত বছরেও তাতে কোনও ফাটল ধরতে দেয়নি সে।

তবু যেন মাঝে মাঝে মনে হয় তাদের সম্পর্কের মধ্যে কোথাও একটা কেবল দায়িত্বের ভার এসে গেছে, আগের মত স্বতস্ফূর্ত ভাবটা আর নেই। অবশ্য দুজনের বয়স বাড়ছে, কাজের চাপও ক্রমশ বেড়েছে। আর মৌসম তাদের ব্যক্তিগত সময়গুলো কখন যেন নিয়ে নিয়েছে।

ঈশ্বরের অশেষ আশীর্বাদ শেষ অবধি নানা প্রতিকূলতা কাটিয়ে মা হতে পেরেছিল সে। মৌসম। তাদের একমাত্র সন্তান। হাসি খুশি, গোলগাল বন্ধু প্রিয় ছেলেটা পড়াশোনায় দারুণ হয়েছে। আমাদের কোম্পানীর পরবর্তী ডিরেক্টর… নিজের মনেই বলছিল পিয়া।            

সেই মুহূর্তেই মা, আছ? বলতে বলতে মৌসম ঘরে ঢুকলো। পিয়ার সাজগোজ দেখে বলল, বেরচ্ছে?

হুম। কখন ফিরলি?

এই তো এখনি। দীনবন্ধু কাকু বলল, তুমি আছো, তাই… বলেই বলল, দারুণ লাগছে তোমাকে।গর্জিয়াস।

আচ্ছা আচ্ছা। ঠিক আছে। বলে হাসল পিয়া। তারপর বলল, হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে নে। দীনবন্ধুকে কী খাবি বলে দে।

আসতে আসতেই অনলাইনে অর্ডার দিয়ে দিয়েছি।

অর্ডার? কি অর্ডার দিলি শুনি?

পাস্তা।

আবার পাস্তা? তুই কী করে রোগা হবি এত জাঙ্ক ফুড খেলে! পিয়া ছেলের চিবুকে আঙুল ছোঁওয়ালো।

হয়ে যাব মা। ডোন্ট ওয়ারি। তুমি কখন বেরবে?
এই তো দশ মিনিটের মধ্যে। একটু থেমে বলল, কলেজে সব ক্লাস হল?

হ্যাঁ মা। ক্লাস হবে না কেন?রোজ এক প্রশ্ন করো কেন বুঝি না।

পিয়া বলল, আসলে জানিস তো আমার সময় প্রায়ই ক্লাসে স্যারেরা আসতেন না। তখন আমরা আড্ডা মারতাম। তাই জানতে ইচ্ছে করে এখন কলেজগুলোর কী অবস্থা!

মা, আমি একটা বেস্ট কলেজে পড়ি।সেখানে ক্লাস পালানো বা প্রফেসর না আসা এগুলো কোনোটাই হয় না।তুমি নিশ্চিন্তে থাকো এসব নিয়ে।তুমি একা যাচ্ছ?

হ্যাঁ। অনুষ্ঠান আছে।

আচ্ছা। সাবধানে যেও। আমি ঘরে গেলাম। বলেই ঘরের সামনে থেকেই হাঁক দিল, দীনবন্ধু কাকু দেখ তো খাবারটা এসে গেছে দেখাচ্ছে।

হ্যাঁ। ঘরে দিয়ে দেব?দীনবন্ধু বাইরে থেকে উত্তর দিল।

দিয়ে দাও।  টা টা মা। সাবধানে যেও। বলে পিয়ার ঘর ছেড়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো।

এই যে ছেলে এসে মা বলে জড়িয়ে ধরল, এটা কী আমার কাছে আস্ত একটা বিশ্ব নয়! সন্তান সুখ- স্বামী সোহাগী হওয়া কী কম আনন্দের! সব নিয়েই আমার বিশ্ব। এই নিয়েই বলব আজ- ঠিক করে নিল সে। তারপর দূর থেকে আয়নায় নিজেকে আরেকবার দেখে নিয়ে অল্প সুগন্ধী হাতের চেটোয় লাগিয়ে বেরিয়ে এলো পিয়া।

ম্যাডাম আসব? অমল দরজা সরিয়ে কথাটা বলল ঠিকই, কিন্তু উত্তরের অপেক্ষা না করেই ভিতরে ঢুকে এলো।

ইরাবতী ল্যাপটপ থেকে চোখ না সরিয়েই আসার কারণ জিজ্ঞেস করল।

আমি বোধহয় আর এই চাকরিটা করতে পারব না।

ইরাবতী উত্তর না দিয়ে চুপ রইল। আজকাল সে অনেক কথারই উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করে না।

আপনি আমার স্যালারি বাড়াচ্ছেন না। আমি জানি এর থেকে বেশি দেওয়া আপনার পক্ষে সম্ভবও নয়। তবু যদি হাজার দুয়েক বাড়াতেন, তবে চালিয়ে নেবার চেষ্টা করতাম। কিন্ত…।

ইরাবতী এবারও কোনো কথা না বলে টাইপ করতে লাগল।

ম্যাডাম, আপনি আবার একজন স্টাফ রাখছেন। তার স্যালারি কিভাবে দেবেন? তাকে তো আমার মতো কম টাকায় রাখতে পারবেন না।

লেখার মধ্যে একটা দাড়ি দিয়ে শব্দ করে টাইপ বন্ধ করল ইরাবতী। একটু বিরক্ত ভঙ্গীতে বলল, তোমার মাইনে থেকে নিশ্চয়ই দেব না। আর তুমি নিজেও জানো এর বেশি দেওয়া আমার সম্ভব নয়।এবার তুমি ঠিক করে নাও কী করবে!

আপনি কী আমায় ছেড়ে দিতে বলছেন?

আমি কিছুই বলিনি। যদি ভালো কোনো সুযোগ পাও, তবে সেখানে যাওয়া উচিত এটাই বলছি।

ও, বলে দাঁড়িয়ে রইল অমল।

আর কিছু বলবে?

না, যিনি জয়েন করছেন, কী কাজ করবেন জানতে পারি কী?

তুমি যে কাজগুলো পারো না, সেগুলো। আর কিছু?

কত স্যালারি দেবেন তাকে?

অমল আমার মনে হচ্ছে আজ তোমার কোনো কাজ নেই। যদি না থাকে তবে এ মাসে কী কী খরচ হয়েছে অফিসে , আর কতটাকা বাজার থেকে তুলেছ, সেটার হিশেবটা লিখে এনে দাও। বলে ইরাবতী আবার নিজের কাজে মগ্ন হয়ে গেল।

অমল বেশ শব্দ করেই দরজাটা টেনে দিয়ে ঘর ছাড়লো।

সেদিকে তাকিয়ে চেয়ারে মাথা এলিয়ে হাতদুটো মাথার উপর তুলে একটা লম্বা হাই তুলল ইরাবতী। অমল ছেড়ে দিলে একটু অসুবিধা হবে। কিন্তু পৃথিবীতে কোনো কিছুই, কেউই স্থায়ী নয়। নিজেই কাল এই টেবিলে এসে বসবে কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। শরীর হঠাৎ করেই খারাপ হচ্ছে। ওভারিতে তেরো সেমি টিউমার বাড়তে বাড়তে ডালপালা বিস্তার করে নিশ্চিন্তে রক্ত শুষে বংশবৃদ্ধি করছে। 

কিন্তু তা বলে কী সে না থাকলে সব থেমে যাবে! শূণ্যস্থান ঠিক ভরাট হয়ে যাবেই। কাজেই ভেবে লাভ নেই। সে আরেকবার হাই তুলল। পাশের ড্রয়ারটা টেনে দেখল সিগ্রেট আছে কিনা! নেই। একটু বিরক্ত হলো। একবার ভাবল বাবুকে ডেকে আনাবে। পরমুহূর্তেই সেই ইচ্ছে দমন করে আবার নিজের কাজে মন দিল।

অনেকরাতে বাড়ি ফিরে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে রইল ইরাবতী। চাঁদের একটা ক্ষীণ রেখা জানলা ভেদ করে ঘরে এসে পড়ছিল। ইরাবতী মুখ ঘুরিয়ে আলোটার দিকে তাকালো। তার বুকটা কেমন উদাসী হয়ে গেল। আচ্ছা সে কী পালটে যাচ্ছে! অমল চাকরী ছেড়ে দেবে বলল, তাতেও কোনও প্রতিক্রিয়া জাগল না। বরং মনে হল, যা যাবার তা যাবেই। এই যে এক ধরণের নির্লিপ্ততা, সেটা কী তার পরিবর্তন, নাকী নানান প্রতিকূল পরিবেশে একা লড়তে লড়তে আজকাল এমনি হয়ে গেছে সে!

এভাবেই আলোর দিকে মুখ করে শুয়ে শুয়ে আরো নানা কথা ভেবে চলল। তারপর উঠে বসে মোবাইলে লিখল, জানো আমার ভীষণ ইচ্ছে করছে তোমার সঙ্গে গল্প করতে,ইচ্ছে করছে চুপ করে তোমার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকতে। কিংবা শুধুই বসে থাকতে।হাতটা ধরা থাক বা না থাক,পাশাপাশি থাকা, কখনো তোমার কথা শুনব,কখনো নিজের কথা বলব।হয়তো ইচ্ছে হলে জড়িয়ে ধরে তোমার গায়ের গন্ধ নেব, কিংবা আঙুলে আঙুল… কোনো একদিন লং ড্রাইভে যাব। সবুজের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া কিংবা রাস্তা ভুল করে এক অপরিচিত জায়গায়। উৎকন্ঠা কিংবা নিরাপদ আশ্রয় কোনটাই আমাদের তোলপাড় করল না। এমনটিই তো চেয়েছিলাম আমরা।স্পর্শ গন্ধ দৃষ্টি সব দিয়ে তোমাকে ছোঁয়া। তোমার আমাকে দেখা। অথচ দেখো এগুলো সবই ইচ্ছে। ভালোবাসাটাও একটা ইচ্ছে অথবা স্বপ্ন। কোনো আঁকড়ে ধরার তাগিদ বা বাধ্যতা নেই।

লেখা শেষ করে পাঠিয়ে দিল বেদান্তকে। তারপর মোবাইল সাইলেন্টে রেখে আবার জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখতে লাগলো। 

খুব ভোরে ইরাবতীর লেখাটা পেল বেদান্ত। বার তিনেক পড়ল। এই মেয়েটা কিভাবে তার মনের কথা বুঝতে পারে! অথচ দীর্ঘদিনের পরিচয় তো নয়! এমনকি কখনো একান্তে নিজের মতো করে পেতেও ইচ্ছে করে না। প্রতিদিনের জীবনে নিত্য নতুন কত মানুষের সঙ্গে কথা হয়। অন্তরঙ্গতাও গড়ে ওঠে। কিন্তু মনের কথা কী সকলে বুঝে নিতে পারে!

এই যে পার্বণী হঠাৎ করেই টেক্সট করে কথা বলা বন্ধ করে দিল, একবারও বুঝলো না তাকে ছেড়ে থাকাটা আমার কাছে কী ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক! প্রতিটা মুহূর্ত যার সঙ্গে কাটালাম এতগুলো দিন, সে এমন পারে! তাকে আমি কোনোদিক দিয়ে কষ্ট দিইনি। নিজের অনেক কাজ অবহেলা করেও শুধু ভালোবেসে তাকে সময় দিয়েছি।

 অন্যদিকে ইরাবতী, তার সঙ্গে আত্মিক কোনও যোগ নেই। প্রতিদিন নিয়ম করে যে কথা হয় তাও না। তবু কোথায় একটা সংযোগ অনুভূত হয়। কেন এমন হয় এই প্রশ্নের কোনো সঠিক জবাব নেই।

বেশ কিছুদিন আগে সে ইরাবতীর কাছে জানতে চেয়েছিল, তোমার কবিতাগুলো সবসময় আমার জীবনের সঙ্গে মিলে যায় কী করে বলতো!

উত্তরে সে লিখেছিল, তাহলে বোধহয় তোমার তুমিটাকে দেখতে পাই।

হুম। রাধার প্রেমের সঙ্গে তোমার কবিতাগুলোর আশ্চর্য রকম মিল। যেন আমারই কথা কিংবা রাধার…

বেদান্তের কথার প্রেক্ষিতে ইরাবতী লিখল, তুমি নিজেকে কৃষ্ণ ভাবো? তোমার বুঝি একজন রাধা আছে?

ফিজিক্যালি সম্পূর্ণ ভাবে আছে বলব না, তবে নিশ্চয়ই আছে। প্রতিটা মানুষের মনই তো কোথাও না কোথাও হয় রাধা নয় কৃষ্ণকে খোঁজে তাই না? বেদান্ত খানিকটা ধোঁয়াশা রেখে জানালো।

ইরাবতী সেটা বুঝতে পেরে বলল, তা ঠিক। আসলে সূক্ষ্ম অনুভূতিপ্রবণ মানুষগুলোর প্রেম একই রকম যন্ত্রণাদায়ক, বিষাদ আর বিরহের। তবে একটা কথা, তোমাকে আমার ভীষন চেনা লাগে, কোথাও যেন মনে হয়, তুমি যা বলছ, তার বাইরের বা ভিতরের সবটাই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি , তাই হয়তো লেখায় বা কথায় সেটাই আসে। আমি তো খুব ক্যালকুলেসন করে, গ্রামার, বা ছন্দ বুঝে কথা বলতে পারি না, তাই যেটা যেভাবে দেখি বা ভাবি তাই লিখি, বলি। ইরাবতী বলেছিল।

এই মুহূর্তে সেই কথাগুলোই মনে পড়ল। ইরাবতী বলেছিল, আসলে জানোতো আমাদের এই জীবন আগের অনেকগুলো ফেলে আসা জীবনের সঙ্গে যুক্ত। সেই জীবনটা আমাদের মনে নেই, অথচ দেখবে সেই সব মানুষের সঙ্গেই মনের সংযোগ গড়ে ওঠে যারা নাকি আগেও কয়েক জন্মে কাছের ছিল। হয়তো চেনা যায় না, হয়তো মাঝখানে বহুবার মৃত্যু হয়েছে,  কিন্তু তারা কখনো না কখনো আবার কাছে আসবে।

ইরাবতীর কথায়, তাই নাকি নতুন কাউকে দেখলে হঠাৎ করেই কিছু না জেনেই ভালো লেগে যায়, কথা বলতে ইচ্ছে করে, আপন লাগে, আবার কাউকে দেখলেই বিরক্ত লাগে, দেখা মাত্র মনে হয় এর সঙ্গে দেখা না হলেই ভালো হত। ইরাবতীর কথা যদি মেনে নিই, তবে কোনো এক জন্মে নিশ্চয়ই সে আমার খুব কাছের কেউ ছিল।তাই আমার সব কিছু তার এত চেনা।

ভাবতে ভাবতে বাইরের দিকে তাকালো বেদান্ত। জানলার বাইরেই হিমালয়। মনে হচ্ছে হাত বাড়ালেই তাকে ছুঁয়ে ফেলা যাবে। অথচ কত দূরে সে। সূর্যের আলোটা ছড়িয়ে পরে চূড়ার বরফগুলো আগুনে রাঙানো মনে হচ্ছে। যে মানুষগুলো ওই উচ্চতায় পৌঁছচ্ছে, তাদের মনে নিশ্চয়ই আর কোনো লোভ হিংসা পাপ মোহ কাজ করে না, ওখানেই বোধহয় স্বর্গ।

স্বর্গ শব্দটা মনে হতেই আচমকা তার নরক শব্দটা মনে এলো। ইরাবতী ক’দিন আগেই জানতে চেয়েছিল সে ডিভাইন কমেডি পড়েছে কিনা! এই মেয়েটা কী তাকে মহাজ্ঞানী ভাবে নাকি পরখ করে দেখে নিতে চায় তার জ্ঞানের পরিধি! আগে এই প্রশ্ন তার মাথায় এলেও এখন এটা আর মনে হয় না। মেয়েটা এমনই। হয়তো নিজে পড়ছে, তখন জানতে চাইলো সেটার সম্পর্কে। না জানলে পরমুহূর্তেই সেটা খুব সহজে জানিয়ে দেবে। অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছে,এটা একটা মেথড। নিজে যেটা বুঝলাম সেটা অন্যকে কতটা বোঝাতে পারলাম তার একটা পথ।

ইরাবতী লিখেছিল, জানো ক্লাস ফোরে পড়ার সময় বাবা তিনটে বই পড়তে দিয়েছিল। অল কোয়াইট অন দ্যা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট, ওয়ার এন্ড পিস আর ডিভাইন কমেডি। প্রথম দুটো পরে বাংলা অনুবাদে পড়েছি। এত ভয়ঙ্কর সেই লেখা যে আমি তখন থেকেই যুদ্ধকে ভয় পাই, মনে হয় কেন মানুষ এই ভাবে সব ধ্বংস করে! কেউ তো কাউকে চেনে না, অথচ তাও এত নৃশংসতা! না জেনেই খুন!

যুদ্ধ তো দেশের জন্য হয়, নিজের দেশকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করাটাও তো ধর্ম, বেদান্ত বলেছিল।

ধর্ম কাকে বলে গো! যুগ পুরুষরা তো যুগে যুগে মানুষের প্রতি ভালোবাসাটাকেই ধর্ম বলে গেছেন। তাহলে কী তা মিথ্যে! এত রক্ত, হানাহানি মারামারি কেন! এর থেকে ভালোবেসে অধিকার বিস্তার করা অনেক ভালো।তার আয়ু দীর্ঘকাল। দেখ না রাজাদের কথা মানুষ ক্রমশ ভুলে যায়, কিন্তু যারা ভালোবাসার কথা, প্রেমের বানী প্রচার করে, তারা মানুষের ঘরে ঠাকুরের আসনে বসে পরে।

ইরাবতীর কথার উত্তরে বেদান্ত লিখল, হুম। হয়তো তোমার ভাবনাটা ঠিক।তুমি ডিভাইন কমেডির কথা বলছিলে।

 ও হ্যাঁ।এই বইটা আমি সযত্নে এড়িয়ে গেছি এতগুলো বছর ধরে।বড় শক্ত ছিল।আর আজ যখন পড়লাম, তখন আমার নিজের স্বর্গ নরক বোধ সব গুলিয়ে গেল।নরক এমন হয়! কি যন্ত্রণাময় দৃশ্য! আমার ঘুম উড়ে গেছে।প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে মানুষের পাপের ফল যদি এমন হয় তবে কেন মানুষ পাপ করে!

বেদান্ত বলল, ইরাবতী, পাপ পুন্যি বলে আদৌ কী কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা আছে?তোমার কাছে যেটা পাপ বলে মনে হচ্ছে অন্যের কাছে সেটা পাপ নাও হতে পারে।তুমি ভক্তিভরে ঠাকুরের মাথায় দুধ ঢেলে ভাবলে পুন্যি অর্জন করছ, আর আমি তখন ভাবলাম,এই দুধটা যদি কোনো বাচ্চা পেত তবে তার খিদে মিটত। জীবন তো তাই যে যেমন ভাবে দেখে তাই না?তুমি এসব না ভেবে পড়ার আনন্দে পড়ো।

ইরাবতীকে বলল বটে, কিন্তু নরক শব্দটা কোথাও যেন নাড়া দিয়ে গেল। চোখের সামনে একটা দৃশ্য উঁকি মারলো। বড় বড় পিতলের কড়াই। তেল ফুটছে গনগন আঁচে। উনুনের ধোঁয়ায় ভরে গেছে চারপাশ। আর তাতেই ফেলে দেওয়া হচ্ছে পাপীদের। তাদের শাস্তি এটাই। কোথায় যেন পড়েছিলাম, এভাবেই মধ্যযুগে দোষীদের শাস্তি দেওয়া হত। ইরাবতী ঠিকই বলে, মানুষের থেকে নৃশংস আর কোনো প্রানী নেই।

ভাবতে ভাবতে আবার জানলার বাইরে চোখ বিছিয়ে দিল সে। এই মুহূর্তে পার্বণী, পিয়া, কেউ তার দৃষ্টির সামনে নেই। একদিকে দেবদারু, ওক, পাইনের সারি, অন্যদিকে খাদ।সামনে সুউচ্চ স্বাধীন পর্বতমালা। হঠাৎই এক পশলা মেঘ হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে ভিজিয়ে দিল বিছানা।সেদিকে তাকিয়ে থাকতে বেদান্তের মন পৌঁছে গেল কৈশোরে। আলপথ ধরে দৌড়চ্ছে সে।বৃষ্টি নামল ধানের ক্ষেতে।যেন আজন্মের বৃষ্টি। মুগ্ধ হয়ে সেদিকেই তাকিয়ে রইল সে। সোনালি শিষের গা ছুঁয়ে কত মনিমুক্ত। একটু পরেই আকাশ জুড়ে রামধনু। উপচে পড়া সে আলোয় ভেসে গেল জমে থাকা যাবতীয় বিষাদ।

বেদান্তের এখন মনে হল জীবন সত্যিই বড় সুন্দর।

 মোবাইল ব্লিঙ্ক করছে। ইরাবতী আবারো ঢুকে পড়েছে তার নির্জনতা ভাঙার জন্য। সামান্য বিরক্ত হলো। এত সকালে কি চায় মেয়েটা!

সময়টা দেখল। না, এটা এই মুহূর্তে পাঠানো মেসেজ নয়। কাল রাতেই পাঠানো। সময় বলছে, রাত তিনটে। এত রাতে কী লিখেছে? ভেবে, পড়ে দেখল লেখা, একটা কথা বলো, তুমি জীবনকে কিভাবে দেখো?

সে একটু ভেবে লিখল, বেলুনের মতো।

সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় ইরাবতীর প্রশ্ন এলো, বুঝিয়ে বলো। বেলুনকে তো ফোলানো হয়, গ্যাস বা হাওয়া দিয়ে। সেটা ফুরিয়ে গেলেই শেষ। কিন্তু জীবনকে?

সে উত্তর দিল, অন্যভাবে দেখো। বেলুন উড়ছে। কিন্তু একটা পিন ফুটলেই সে ফুটুস। ঠিক তেমনি জীবন, যতক্ষণ আছি ততক্ষণই তার গুরুত্ব, যেই নেই তখনি সব মিথ্যে। আজ আছি কাল নেই, লগবগে প্রাণ…।

ইরাবতী বলল, তার মানে মাঝে মাঝে তোমার মনেও এমন প্রশ্ন জাগে যে এই চারদিকের এত বৈভবের মধ্যেও একটা বিষাদের সুর আছে, যা কানে কানে বলে যায় সব সাময়িক, আজ আছি কাল নেই…

ইরাবতী এর থেকে বড় সত্য এই জগতে আর কিছু নেই। সব কিছুই সাময়িক, ক’দিনের এই যাওয়া আসা, স্রোতে ভাসা। আমাদের ভেসে থাকাটাই হয়, বাকি সব দোদুল্যমান।

বেদান্ত উত্তর দিয়ে নেট অফ করে দিল।

এবার তাকে রেডি হতে হবে। সি এম একটু বাদেই মিটিং-এ বসবেন সবাইকে নিয়ে। তাকে থাকতেই হবে সেখানে।

সে ইলেক্ট্রিক কেটলিতে জল গরম করে টি ব্যাগ ডুবিয়ে প্রয়োজনীয় কাজগুলো দ্রুত সারতে সারতে নিজের মনেই বলল, এটাই জীবন, যা নিজের ইচ্ছেয় চলে না। তা সর্বক্ষণই দৌড়ে চলেছে তাড়া খাওয়া পশুর মত, বিরামহীণ, যতক্ষণ না অন্য কোনও জগত থেকে নির্দেশ আসছে- স্টপ।

বেশ কিছদিন ধরে বাবুর মাথাটা ঠিক কাজ করছে না। অকারণেই মাথা গরম হয়ে পড়ছে। ম্যাডামের সঙ্গেও মাঝেমধ্যেই মারাত্মক দুর্ব্যবহার করে ফেলছে। তখন তার কোনও হুঁশ কাজ করছে না। এই নিয়ে অফিসেও অশান্তি বাড়ছে। সে জানিয়েও দিয়েছে আর চাকরি করবে না।

শুধু যে অফিসেই এমন হচ্ছে তা নয়, বাড়িতেও দিদি মা বাবার সঙ্গে অযথা ঝামেলা লেগে যাচ্ছে।

সে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছে এই পরিবর্তনে। কেন হঠাৎ করে এসব হচ্ছে নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না। ম্যাডাম কখনো বুঝিয়ে ঠান্ডা করছেন, কখনো রেগে গিয়ে বকছেন। সে উপলব্ধিও করছে, যা বলছে সে তার সঙ্গে তার নিজের চরিত্রের কোনো মিল নেই।

অথচ এমন হওয়ার নয়। নিজের শরীর সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিল সে। ভোরবেলা উঠে নিয়মিত জিমে যেত আগে। কিন্তু কয়েকমাস ধরে ঘুম থেকে উঠতেই প্রচুর দেরি হয়ে যাচ্ছে। ফলে জিমে যাওয়াও ক্রমশ অনিয়মিত হয়ে পড়ছে। আবার অফিসেও সঠিক সময়ে পৌঁছতে পারছে না। দশটা থেকে বাড়তে বাড়তে এখন বারোটার আগে কোনোভাবেই ঢোকা যাচ্ছে না।

ম্যাডাম কিছু বলার আগেই সে নিজের মতো যুক্তি সাজিয়ে নিয়ে বলে দিচ্ছে, আমি আর চাকরি করব না, চাবি দিয়ে দিচ্ছি, ইত্যাদি। কখনো বলছে, এই মাইনেতে চলছে না। অথচ সে নিজেও জানে না কিসে তার এত খরচ হচ্ছে!

ম্যাডাম বলেন, তুই দিন দিন নেশারু হয়ে যাচ্ছিস। মুখে দিন রাত খৈনি। এটাই তোকে শেষ করে দিচ্ছে। দেখবি এরপর সারা মুখে ঘা হয়ে যাবে।

সে  নিজেও বুঝতে পারছে এই নেশাটা ঠিক নয়, তার সুন্দর দাঁতগুলোতে এর মধ্যেই কালচে দাগ পড়তে শুরু করেছে। এছাড়াও আজকাল রাত হলেই একধরনের পুড়িয়ার নেশা তাকে আচ্ছন্ন করে রাখছে। সেই সময় তার সামনের দুনিয়াটা দারুন রঙিন মনে হয়। চারদিকে কত আনন্দ। তখন সে পৃথিবীর সেরা নায়ক কল্পনা করে নিজেকে। বাইক নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে যেখানে ইচ্ছে। বার পাঁচেক মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে এভাবে বেপরোয়া চালাতে গিয়ে। কিন্তু তখন কোনো তাল যে থাকে না তার, সে একথা কাকে বোঝাবে!

বাবু, এসব করিস না। এত অল্প বয়স তোর, বিপদ কিছু ঘটে গেলে যদি মরে যাস তো খেল খতম, আর নইলে হাত পা ভেঙে বিছানায় পড়ে থাকতে হবে। বাবা মার একমাত্র ছেলে তুই। দিদিরা কত ভালোবাসে তোকে। তাদের কী অবস্থা হবে ভেবে দেখেছিস কখনো? ম্যাডামের এই জ্ঞানগুলো শুনতে যে ভালো লাগে না, এটা সে কিভাবে বোঝাবে!

মহিলা বড্ড বেশি মা মা সুলভ। সারাক্ষণ তুই আমার ছেলের মতো, বাচ্চা ছেলে, এসব বলার দরকার কী! আবার বলে কিনা একটু পড়াশোনা শিখলে তো ভালো হতো রে। কী একবারে উদ্ধার হতো? স্কুল কলেজে পড়ে দেখছি তো চাকরির অবস্থা! বেকার সব ঘুরে বেরাচ্ছে, আর বাপ মায়ের টাকার শ্রাদ্ধি করছে। এদিকে মাথা নিচু করে কোনোও কাজও করতে তাদের প্রেস্টিজে লাগছে। বাবু কিনা সব! তার থেকে আমি দিব্বি আছি। 

 জন্মেছি ড্রাইভারি করার জন্য। দশ বছর বয়স থেকে সেটাই শিখছি। লরির, টেম্পোর খালাসি হয়ে কত জায়গায় ঘুরেছি শুধু গাড়ি চালাবো এই স্বপ্ন দেখে। এখন যেখানে মাইনে ভালো পাবো সেখানেই চলে যাব। এসব বলে সেন্টু দিয়ে কোনো লাভ নেই। নিজের মনেই বিড়বিড় করল বাবু।

দূর মাইরি, রাতেও এই মহিলা রেহাই দেবে না। আমি এখন অন্য একটা সুখে আছি। কেমন মাথার উপর দিয়ে বেলুন উড়ে যাচ্ছে। হেভ্ভি দেখতে ছোটো ছোটো জামা পরা মেয়েগুলো হাতে সিগারেট নিয়ে ঘুরে বেরাচ্ছে। সামনের মেয়েটার মাইটাও বেরিয়ে। এ মেয়েটা আমার দিকেই তো এগিয়ে আসছে, চোখটা ভালো করে কচলে নিল বাবু। শালা, আমি ভাবব না এখন ম্যাডামের কথা। ভাবতে ভাবতে সে এগিয়ে চলল তার দিকে এগিয়ে আসা মেয়েটার দিকে। ততক্ষন সে এগোলো যতক্ষণ না তার কানের সামনে উচ্চ স্বরে মোবাইল বেজে উঠল।

ঘুম ঘুম চোখে ফোন ধরে হ্যাঁ, বলা মাত্র ম্যাডাম বলে উঠল, উঠেছিস? দেরি করিস না। বারোটার মধ্যে পৌঁছতে হবে …

আসছি। বলে ফোন রেখে দিল বাবু। শালা কে করে চাকরি! ঘুমোতেও দেবে না শান্তিতে, একটা খিস্তি দিয়ে মোবাইলে সময় দেখল। সাড়ে দশটা। আজও লেট। কোনো দিকে না তাকিয়ে দৌড়ে বাথরুমে ঢুকল সে।

বেশ কয়েক মাসের ব্যবধানে বেদান্তের সঙ্গে দেখা হল ইরাবতীর। অভিজাত এক ক্লাবের বারান্দায় পাতা বেতের সোফায় বসে বেদান্ত মন দিয়ে মোবাইলে কিছু করছিল। ইরাবতী সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বেদান্ত মোবাইল স্ক্রিন থেকে মুখ তুলে বসতে বলল পাশের চেয়ারটায়। তারপর আবার মোবাইলে কিছু লিখতে লাগল।

ইরাবতী বেদান্তের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে রইল। বেদান্তের পরনে সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট। গলায় জড়ানো টাইটা আলগা করে লাগানো।

ইরাবতী সকালেই কাগজে দেখেছে বেদান্ত রায় এবছর সর্বভারতীয় বিজনেস এ্যসোসিয়েশনের চেয়্যারমান হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। আজ তার প্রথম ভাষণ ছিল দুপুরে। বেদান্ত জানিয়েছিল সেটা শেষ করেই তারা বসবে এই ক্লাবে।সেইমতো নির্ধারিত সময়েই ইরাবতী পৌঁছে গেছে।

ইরাবতীর পরনে আজ খাদির কালো পাঞ্জাবি, তার উপর স্টাইলিস্ট জ্যাকেট। অফিস থেকে বেরবার আগে অমল বলেছে, ম্যাডাম আজ হেভ্ভি লাগছে। মাঝে মধ্যে এই প্রশংসা শুনতে মন্দ লাগে না, ভেবে এখন হেসে ফেলল সে। সেদিকে লক্ষ করে বেদান্ত বলল, আর দুমিনিট।

 ঠিক আছে, কাজ সারো, বলে ইরাবতী সামনের সবুজ লনের দিকে তাকালো। এই শহরে এটাই প্রথম ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠিত ক্লাব। তারা চলে যাবার পর এখানকার সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা এর সদস্য।বেশ কয়েক বার এই ক্লাবে আসার সুযোগ হয়েছে তার।অবশ্য ক্লাব কালচার আর তার ভালো লাগে না।

লনে দুটো বাচ্চা নিজেদের মতো খেলে যাচ্ছে।তাদের মা মাঝে মাঝে চিৎকার করে সাবধান করছে মারপিট করবে না। শান্ত হয়ে খেল…।

ইরাবতীর মনে পড়ল প্রান্তি এই বয়সে কী ভীষণ দুষ্টু ছিল। হাতের সামনে যা পেত –দুঃ যা বলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আনন্দে চিৎকার করত। বকলে ঠোঁট ফুলিয়ে বসে পড়ত। তবে তা ক্ষণিকের জন্য। পরমুহূর্তেই দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে সে সারা বাড়ি তোলপাড় করে তুলত। তার পিছনে দৌড়তে দৌড়তে ইরাবতী হাঁফিয়ে বসে পড়ত মাটিতে। তখন প্রান্তি ছুট্টে এসে তার কোলে বসে হামি দিয়ে তাকে খুশি করার চেষ্টা করত।

লনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সেই দিনগুলো রোমন্থন করছিল ইরাবতী। চমক ভাঙল বেদান্তর ডাকে।

সরি, তোমাকে বসিয়ে রাখলাম। খাবে তো? বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলল, এই ক্লাবের সবচেয়ে ভালো খাবার হল ডিম পরোটা। বলেই ওয়েটারকে ডাকল। দুটো ডিম পরোটা আর দুটো দার্জিলিং চা।

আরে না, একটা পরোটা বলো। আমি অল্প খাব। ইরাবতী বলল।

ফিগার মেন্টেন করছ? বলে ইরাবতীর দিকে তাকিয়ে হাসল বেদান্ত। হ্যাঁ, মনে হচ্ছে রোগা হয়েছ অনেকটা। বলে ওয়েটারকে বলল, একটা দিন। ম্যাডাম ডায়েটে আছেন।

ওয়েটার চলে যাবার পর বলল, চলো শুরু করা যাক। আজ কী বলব?

তোমার কাজের পিছনের গল্প বলো। এত বড় প্রতিষ্ঠান সামলাতে গিয়ে কী কী বাধা এসেছে ,সমস্যা হয়েছে সেগুলো শুনি।

বাধা? বলে বেশ খানিকক্ষণ চুপ থাকল বেদান্ত।

 ইরাবতীর মনে হল, কোন কথা কতটা বলবে সেটাই ভেবে নিচ্ছে সে। ইরাবতী নিজেও বোঝে সব কথা বলা যায় না, বিশেষ করে একজন বিজনেসম্যানকে অনেক বেশি ক্যালকুলেশন করে চলতেই হয়। দলমত নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক না থাকলে বেদান্ত রায় হয়ে ওঠা যায় না। সে অপেক্ষা করতে লাগল।

ওয়েটার এসে ডিম পরোটা আর পটে করে চা দিয়ে গেল। বেদান্ত পট থেকে নিজেই চা বানিয়ে দিল। এই স্বভাবটা ইরাবতী আগেও লক্ষ করেছে। বেদান্ত এই কাজটা নিজে করতে ভালোবাসে। মাঝে মাঝে তার মনে হয়েছে বেদান্ত কী সকলকেই এভাবে চা বানিতে দেন নাকি বিশেষ কিছু মানুষকে! তৎক্ষণাৎ মাথা থেকে চিন্তাটা উড়িয়ে দিয়েছে। আর যাই হোক, সে কখনো বেদান্তর বিশেষ কোনো মানুষ নয়। এই কাজটার সূত্রে কিছু সময় একসঙ্গে বসে তারা গল্প করেছে। এর বেশি কিছু নয়।

বেদান্ত খুব মন দিয়ে চা বানিয়ে ইরাবতীকে দিল।এক চুমুক নিজে মুখে দিয়ে শুরু করল, এখন তো আমরা ফুড হাব, রেস্তোরা, এমনকি হোটেল ম্যানেজমেন্ট ইন্সটিটিউশন পর্যন্ত খুলেছি। বেদান্তের মুখে এক ধরনের প্রচ্ছন্ন গর্বের আভাষ। সেটা দেখে ইরাবতী জানতে চাইল,  

গর্বের মাঝামাঝি কখনো ডিপ্রেসন আসে না? সাধারণভাবে বলা হয় মানুষ যত উপরে ওঠে, অর্থ, ক্ষমতা অর্জন করে তত তার একাকীত্ব বেড়ে যায়। তোমার ক্ষেত্রে তাহলে সেটা নেই বলছ? ইরাবতী পরোটার একটা টুকরো মুখে তুলে জানতে চাইল।

বেদান্ত ইরাবতীর দিকে তাকিয়ে পরোটার একটা টুকরো তুলল। ভালো না? আমি এখানে এলে নয় এটা কিংবা সিঙারা খাই। তুমি খাবে?

কী?

সিঙারা। খেয়ে দেখতে পারো। বেশ ভালো।

থাঙ্কস, কিন্তু আমি পছন্দ করি না।

আচ্ছা। বলে বেদান্ত আবার শুরু করল বলা, কখনো কখনো ডিপ্রেশন আসে। মনে হয় কেন আমি এত চাপ নেব! এত দায়িত্ব কেন আমাকেই বইতে হচ্ছে।আমি তো নিজের মত পড়াশোনা করতে পারতাম, বই লিখতে, ঘুরে বেড়াতে পারতাম। কিন্তু এত চাপ ! খুব ভয় হয় মাঝে মাঝে। তুমি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ, অনেক সময় আমি নেট অন করি না। খুব দরকার ছাড়া ফোনও বন্ধ রাখি। এগুলো আসলে ডিপ্রেশনের পিরিয়ডে।

 সবাই আমার কাছে থেকে খালি সাহায্য চায়।কেউ চাকরি, কারোর মেয়ের বিয়ে , কারোর শরীর খারাপ… তাদের ধারণা আমার কাছে চাইলেই পেয়ে যাবে। কেউ ভাবে না এত আমি কোথা থেকে পাব! আমারও একদিন কত অভাব গেছে।কাউকে বলিনি এটা লাগবে বা এটা আমাকে দাও। মনে আছে বাড়িতে এমন দিনও গেছে, বাড়ির সামনে উঠোনে গাছে মুলো হয়েছে, সেটাই তুলে রেঁধে ভাত দিয়ে খেয়েছি। তখন তো কেউ দেখেনি।

বেদান্ত থামল। আরেকটা চা বলি? দুটো চায়ের অর্ডার দিয়ে বলল, জানো ইরাবতী, লোকজন আমাকে খুব বোকা ভাবে। আমি বহুদিন ট্রেনে করে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করেছি। একদিন ট্রেনে আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে দেখা। ট্রেন থেকে নেমে সে সিগারেট খেতে চাইল দামি একটা কোম্পানির। আমি তাকে ভালোবেসে পুরো প্যাকেটটাই কিনে দিলাম। সেই সময় দাম বোধহয়  ১০০ টাকা। নব্বই দশকের শেষের দিকের কথা বলছি।

কিছুদিন পর আরেক বন্ধু বলল, তুই ওকে একটা দামি সিগারেটের প্যাকেট দিয়েছিলি। ও সেটা বন্ধুদের খেতে দিয়ে বলল, বেদান্তটা কী বোকা! একটা চাইলাম, পুরো প্যাকেট পেলাম।

শুনে আমার খারাপ লাগল। কিন্তু আমি এমনই। আমি আসলে কোনোদিন মুখের উপর কাউকে না বলতে পারি না। খুব হয়তো মুড অফ, তখন ‘না’ বলি। আসলে আমাকে ছোটোবেলা থেকেই ঈশ্বর প্রচুর ধৈর্য শক্তি, নম্রতা বোধ দিয়েছেন। চট করে কারোর সঙ্গে রূঢ় ,খারাপ ব্যবহার করতে পারি না।

তোমার বোধহয় চাওয়াটাই কম। ইরাবতী বলল।

বেদান্ত হাসল। এটা ঠিক বলেছ। মানুষের কাছে আমার চাওয়াটাই খুব কম। যতটা পারি নিজেই করে নিতে চেষ্টা করি। স্ত্রী পুত্র, বাড়ির কাজের লোক কারোর কাছেই সে অর্থে কোনো চাহিদা আমার নেই। হয়তো কিছু খেতে দিল, টিফিন বানিয়ে দিল, তাতেও যেমন খুশি, তেমনি না দিলেও দুঃখ নেই আমার। অফিসে এসে মুড়ি, পাউরুটি যা পেলাম খেয়ে নিলাম। লোকের উচ্চাশা থাকে, পাবার আশা করে, আমি কিছুই আশা করি না। মনে হয় এটা খারাপ। যদি কোনো আকাঙ্খাই না থাকে তবে কিসের জন্য সব করা! কিন্তু কী করব! কোনো কিছুই আমাকে আর সেভাবে প্রভাবিত করে না।

ইরাবতী কথাগুলো শুনতে শুনতে বেদান্তের মধ্যে বেদব্যাসকে দেখতে পাচ্ছিল। 

জানিস ইরাবতী, কখনো কখনো মন খারাপ করে, সবাই খালি আমার কাছে এক্সপেক্টটেসন নিয়ে আসে। আগে ছোটো বাড়িতে সব সময় আত্মীয় স্বজনের ভিড় লেগেই থাকত। আর দেখ এই বাড়িতে প্রায় কেউ আসে না। আসলে এখনকার মানুষ নিজেদের নিয়ে , নিজের বন্ধুবান্ধব গোষ্ঠী নিয়েই ব্যস্ত। তাছাড়া আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধব আগে যারা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আসত, তারাও এখন আর স্বার্থ ছাড়া আসেন না।  আসলে ক্রমশ যত সাফল্য এসেছে দেখেছি আমি একা হয়ে যাচ্ছি। আমি তো চাই সবাই আসুক। আমি ভালোবাসি বন্ধু, আত্মীয়। কিন্তু সেটা আর হয় না।

আমার জীবনে কোনো উত্তেজনাই এখন কাজ করে না। কোনো সাফল্যের পালকই আমাকে এখন সেভাবে স্পর্শ করে না।

বেদব্যাসের কথার প্রতিধ্বণী ইরাবতী শুনছিল। খালি জায়গা আর মানুষটা আলাদা।ক্ষমতার শীর্ষে থাকা সব মানুষই কী ক্রমশ একা হয়ে যায়! কিন্তু বেদব্যাস স্বেচ্ছায় নির্বাসন নিয়েছেন, এই লোকজন আর তার ভালো লাগে না। চল্লিশ বছর বয়সেই খ্যাতি, যশ, অর্থ সব ছেড়ে তিনি নিজেকে বন্দি করে রেখেছেন একটা ঘরে। সেটাই তার সাধনার ঘর। সে ঘরে মাত্র কয়েকজনের প্রবেশের অনুমতি মেলে। বাকিরা দূর থেকেই দর্শন করে ফিরে যেতে বাধ্য হয়।

 বেদব্যাস নিজের মতো মুক্তি খুঁজে নিয়েছেন তাঁর ঈশ্বর সাধনার মধ্যে।কিন্তু বেদান্ত? সে কেন একা বোধ করবে? তার চারপাশে তো বহুর ভিড়। চাইলেই যা ইচ্ছে তাই পেয়ে যাবে। তবু কেন এই শূ্ন্যতা! ইরাবতীর বুক হঠাৎ একটা অজানা সংকেতে হাহাকার করে উঠল। সে মনে মনে বলল, না না বেদান্ত, তুমি বেদব্যাস হয়ে যেও না। এই সমাজ তোমাকে চায়।

বেদান্তর সঙ্গে কথা চলাকালীনই  বিভিন্ন মানুষ এগিয়ে এসে তাকে অভিনন্দন জানিয়ে যাচ্ছিল। বেদান্ত হেসে সামান্য উত্তর দিয়ে আবার নিজের কথায় ফিরছিল।

শুনতে শুনতেই ইরাবতীর হঠাৎ নজর গেল সামনের মানুষটার দিকে। এগিয়ে আসছিল তাদের দিকেই। বেদান্ত তাকে দেখেই বসতে অনুরোধ করল।

ইরাবতীর বুকের মধ্যে মত্ত হাতির ডাকের শব্দ বাজছিল। এই মানুষটি তার ভীষণ চেনা। বহু বছর আগে এই মানুষটির প্রেমে পড়েছিল।মাল্টি ন্যাশানাল এক কোম্পানির সি ই ও। দেখা সাক্ষাৎ না হলেও কত সমস্যার হাত থেকে যে মানুষটি তাকে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রেখেছিল, সেটা একমাত্র সেই জানে।

মৃগাঙ্কও আশা করেনি ইরাবতীকে এখানে দেখবে। ইরাবতীর মনে হল, সে একই সঙ্গে অবাক ও ক্ষুন্ন হল। সামলে নিয়ে মৃগাঙ্ক বলল, কি ব্যাপার এখানে?

সে উত্তর দেবার আগেই বেদান্ত বলল, ইরাবতীকে চেন? ও আমার একটা ইন্টারভিউ নিচ্ছে।

মৃগাঙ্ক  ইরাবতীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, বহু দিন ধরে চিনি। তা কিসের জন্য ইন্টারভিউ?

ইরাবতী বুঝতে পারছিল, মৃগাঙ্ক পছন্দ করছে না বেদান্তের সঙ্গে তার বসে থাকাটা। সে শান্ত গলায় বলল, এখনি বলতে পারব না। তারপর কথা ঘুরিয়ে বলল, কবে এলে? আছ এখন এখানে?

এসেছি ক’দিন হল।আপাতত আছি। তোমার খবর তাহলে এখন ভালো?

ইরাবতীর মনে হল মৃগাঙ্ক এই ‘ভালো’ শব্দটার আড়ালে অন্য কিছু ইঙ্গিত করছে। সে সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, ভালো লাগল এতদিন বাদে দেখা হয়ে। ভালো থেকো। তারপর, বেদান্তের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি আজ উঠি। পরে আবার যেদিন ফ্রি থাকবে বোলো। বাকিটা শুনব।

উঠবে? আচ্ছা বেশ। আশা করছি এই সপ্তাহেই আরেকদিন বসতে পারব।

ইরাবতী মাথা নেড়ে উঠে একবারও পিছন না ফিরে সামনে এগিয়ে গেল। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছিল, দু’জোড়া চোখ তাকে তীব্রভাবে দেখছে।

সারাটা রাস্তা মৃগাঙ্কর চোখ যেন ইরাবতীকে অনুসরণ করে গেল। ইরাবতীর মনের কোণে প্রথম আলাপের দিনটা ভেসে আসছিল।তার এক বন্ধু কোন একটা কাজে গেছিল মৃগাঙ্কর অফিসে। সে বসেছিল গাড়িতে।বিরক্ত লাগছিল তার। প্রায় ঘন্টাখানেক বাদে ফোন করেছিল বন্ধুকে। তোর হল নাকি আমি চলে যাব?

তাদের কথোপোকথন কানে গেছিল মৃগাঙ্কর।সে কাউকে দিয়ে ভেতরে ডেকে পাঠিয়েছিল তাকে। ঘরে ঢোকা মাত্র অবাক হয়ে তাকিয়েছিল ইরাবতীর দিকে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই প্রিন্টার থেকে একটি মেয়ের ছবি বের করে বলল, এই দেখ হুবহু তুমি। ইরাবতী আশ্চর্য হয়ে গেছিল সেদিন।

বাড়ি ফেরার পথে কী ভেবে লিখেছিল, পাশে থেকো।সেই থেকে এতগুলো বছর নানা ভাবে রয়ে গেছে মৃগাঙ্ক। কখনো বছরের পর বছর কথা না বলে, কখনো বা শুধুই মেসেজের মধ্যে দিয়ে। তাদের মধ্যে এমন কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি, যার কিছু একটা নাম দেওয়া যায়। তবু আজ মৃগাঙ্কর দৃষ্টিটা তাকে ভাবালো।    

সেদিন গভীর রাতে মৃগাঙ্ককে অন লাইনে দেখল ইরাবতী। সে লিখল, তোমার সে দিনটা মনে আছে মৃগাঙ্ক? পরিচয়ের দুদিনের মাথায় তুমি বলেছিলে, তোমার –আমার যে রিলেশন তৈরি হতে চলেছে তাতে যেন কোনোদিন কোনো অধিকারবোধ, দাবি, দায়িত্ব নেওয়ার অঙ্গীকার, এমনকি ভালবাসা শব্দটাও না আসে।!এই দায় না নেওয়ার বিষয়টা সেদিন আমার মাথায় ঢোকেনি।কিন্তু এটা বুঝেছিলাম তুমি কোনো বন্ধনে জড়িয়ে পড়তে চাও না।ভাল লেগেছিল তোমার সরল স্বীকারোক্তি। কারণ আমি নিজেকে যতটা চিনি, জানি, তাতে বুঝতে পারি বন্ধনে আমিও বেশিদিন আটকে থাকতে পারি না। দমবন্ধ হয়ে আসে, মুক্তি খুঁজি।তাই তোমার কথা মেনে নিয়েছিলাম।আজ তবে কেন তোমার চোখের ভাষায় অন্য কিছু দেখলাম!

ওপাশ থেকে মৃগাঙ্ক লিখল, তোমার আমাকে আর পছন্দ নয়, বেদান্ত এখন তোমার প্রিয়, সেই বুঝি প্রচুর টাকা দিচ্ছে!

বেদান্তের সম্পর্কে মৃগাঙ্কের এমন কথায় দুঃখ পেল ইরাবতী। সে বলল, ছিঃ,এ কথা তোমার মুখে শোভা পায় না। তুমি নিজেও জানো, অর্থের প্রয়োজনে আমি কারোর কাছে বিক্রি হয়ে যাই না।

তেমনি জানতাম। মৃগাঙ্ক সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিল।

তাহলে এখন কেন এমন ভাবছ? তাছাড়া দীর্ঘদিন তুমি তো যোগাযোগ রাখোনি আমার সঙ্গে।শুধু প্রচন্ড শীতে জমতে জমতে আমার নগ্ন শরীর দেখতে চেয়েছ।

এমনভাবে বলছ, যেন তুমি সঙ্গে সঙ্গে ছবি তুলে পাঠিয়েছ!

 না। পাঠাইনি। এটা আমার মনে হয়েছে তুমি অন্যায় দাবি করছ। ভুলে যেও না , আমি তোমার স্ত্রী, প্রেমিকা, রক্ষিতা বা কর্মচারী নই, তোমার কথা শুনতেও বাধ্য ছিলাম না। সত্যি বলতে কী তোমার কথা শুনে ঘৃণায় গা গুলিয়ে ওঠছিল। কী ভাবো আমায়! যা বলবে শুনতে আমি বাধ্য নাকি! এদিকে বলে কোনো অধিকার, কোনো ভালবাসা, কোনো দাবি নেই, অথচ এমন অন্যায়!রাগে শরীর কাঁপে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে ইরাবতীর।

অথচ তুমি আমার দেওয়া টাকায় ফুটপাথের বাচ্চাদের জন্য বই, জামা, শীতে সোয়েটার কিনে ছবি পাঠিয়েছ।

ইরাবতী লেখে, ঠিক। কিন্তু নিজের জন্য কিছু চেয়েছি কী?

মৃগাঙ্ক চুপ করে যায়। ইরাবতীর চোখ বেয়ে জল নামে।

   দীর্ঘ সময় কেটে গেল। ইরাবতীর চোখে ঘুম নেই। তার নিজের উপর রাগ হচ্ছিল। কোনো কিছুর জন্য কারোর কাছে নিজেকে ছোটো করতে চাইনি বলেই আজও সে রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে।এই মানুষটা যাকে সে সত্যি ভালোবাসতে চেয়েছিল একদিন, যার সঙ্গে কখনো তেমন সম্পর্ক গড়েই উঠল না, সে কিনা এমন ভাবে তাকে আজ ছোটো করছে!

ইরাবতীর চোখ জ্বালা করছে অপমানে, রাগে অভিমানে। সে লিখল, আমি আর তোমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চাই না।

আমি তো তোমায় বলিনি রাখতে, তোমার উপর কখনও দাবী করিনি , ভালও বাসব ভাবিনি , তবু তুমি কি ভাবে এসে গেছ অজান্তেই , মৃগাঙ্ক বলল।

সেসব শুধুই সময়ের খেলা। আমার তোমার নিয়তি। মৃগাঙ্কর লেখাকে গুরুত্ব না দিয়ে লিখল ইরাবতী।

তাতে কি? ভালবাসা নানান রঙের হয়। তার সঙ্গে সমস্যা কোথায়?

সমস্যা নেই। কিন্তু ভাল না বেসে শরীর নিয়ে খেলায় আমার যে বিশ্বাস নেই। আমি মন খুঁজি।

শুধু মন আর মন! কত বার মন ছুঁতে গিয়ে বিপদে পড়েছি তুমি জানো না। তবে এই মন এখন তোমায়… মৃগাঙ্কর কথায় অন্য আবেগ।

ইরাবতীর তীব্রভাবে বলতে ইচ্ছে করল, একদিন সত্যি চেয়েছিলাম তোমাকে। কিন্তু তাকে প্রশ্রয় না দিয়ে লিখল,আজকের পর আর আমাদের কোনো সম্পর্ক রইল না ।

না গেলেই কি নয়! আর একবার ভেবে দেখো প্লিজ…।

 সেই তীব্র ডাক উপেক্ষা করে মোবাইল অফ করে দিল ইরাবতী। কেন এমন হয়! যখন একদম নিঃসঙ্গ মনে হত নিজেকে, যখন সব দিক থেকে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করত কাউকে, কারোর বুকে মাথা দিয়ে আশ্রয় চাইবার ইচ্ছে জাগত, তখন যার প্রতি টান অনুভব করেছিল, সে বুঝতে পারেনি। আর আজ যখন সত্যি এসবের থেকে অনেক দূরে সরে গেছে তার মন, কাজের বাইরের জগতটাতে সীমারেখা টেনে নিজের মতো করে একা বাঁচার চেষ্টা করছে তখন কেন ফিরে আসছে!

ইরাবতীর আর কান্না পাচ্ছে না। তার মনের মধ্যে দুটো আলাদা গান একই সঙ্গে গুঞ্জরিত হতে  লাগল- ‘ তোমার মহাবিশ্বে কিছু হারায় নাতো কভু’-র পাশাপাশি ‘ যারা চলে যায় ফেরে না তো হায় পিছু-পানে আর কেউ’।

সেইমুহূর্তে এক গভীর উপলব্ধি হল ইরাবতীর। জীবন এমনি। দুই সুরেই বাঁধা। ‘হ্যাঁ’ এর পাশে ‘না’ আছে বলেই নিরন্তর পথ চলা।      

বেদান্তর মন ভালো নেই। একই সঙ্গে তীব্র একটা বিরক্তি বোধ করছে। ইন্সটিটিউটটা হবার পর থেকেই নানা কারণে তার সঙ্গে দাদার মতবিরোধ হচ্ছে।একটু আগেই যেমন হল।

 ব্যাস, আর কোনো চিন্তা নেই, বুঝলি, যত খুশি টাকা ডিম্যান্ড করা যাবে এখন। হাতের মুঠো ভরে যাবে টাকায়, বিচ্ছিরি ভাবে হেসে উঠেছিল রেবান্ত রায়,  বি এস এল গ্রুপের চেয়ারম্যান ।

কী বলছ তুমি? টাকা রোজগার করাই আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল? আমাদের স্বপ্নগুলো কী মিথ্যে ছিল দাদা? 

ওসব স্বপ্ন টপ্ন বলে কিছু হয় না। অর্থই স্বপ্ন তৈরি করে।এ বিষয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না।এটা আমাকেই বুঝে নিতে দাও। বেদান্তর কথাকে তীব্র ভাবে উপেক্ষা করে রেবান্ত টেবিলের উপর রাখা ফাইলে মন দিল।

ভারাক্রান্ত মন নিয়ে চেয়্যারম্যানের ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের চেম্বারে ফিরে এল বেদান্ত।

তিলতিল করে গড়ে তোলা এই প্রতিষ্ঠান কী কেবল অর্থ রোজগারের যন্ত্র! লক্ষ্য ছিল অল্প টাকায় হাজার হাজার সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের ছেলেমেয়েদের যথার্থ শিক্ষা দেওয়া, যাতে এখান থেকে বেরিয়ে তারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, আরো বহু মানুষের দায়িত্ব নেবার ক্ষমতা অর্জন করে। 

এতদিন ধরে সেতো কেবল সেই চেষ্টাই করে গেছে।দেশে বিদেশে যেখানেই গেছে সেখান থেকেই বেস্ট ফ্যাকাল্টি নিয়ে এসেছে কলেজের জন্য, যাতে শুধু প্রথাগত রান্না বা মশলা বানানো নয়, ছাত্র ছাত্রীদের চরিত্র গঠনের পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষাও দেওয়া যায়।মোটা  টাকার বিনিময়ে ছাত্র ভরতি হলে সেখানে আর যাই হোক শিক্ষার মান শেষ অবধি বজায় থাকতে পারে না।

অস্থির লাগছিলো বেদান্তর। বেশ কিছুদিন ধরেই দাদার সঙ্গে আদর্শে মিল হচ্ছে না তার। কখনো কর্মীদের সঙ্গে বিরোধ, কখনো কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ করেই তাঁর কাজকর্মকে আক্রমণ করা,কর্মীদের ছাঁটাই,-সব নিয়েই মতান্তর ঘটছে তাদের।

পিয়াও বেশ কিছুদিন ধরে তাকে বলছে বৌদি নাকি বলে বেরাচ্ছে যে সে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে , আর তার কর্তা একাই পরিশ্রম করে এত বড় একটা প্রতিষ্ঠানকে টেনে ধরে আছে। কোনো কাজ না করলে আলাদা হয়ে যাওয়া উচিত এসব কথাও বৌদি বলছেন।

যে বৌদিকে পছন্দ করে, বিয়ে দিয়ে দাদার বৌ করে নিয়ে এলাম, যিনি এত স্নেহ ভালবাসা দিয়ে এত বছর রাখলেন তার মুখে এসব কথা কী করে আসে,বেদান্ত ভাবতেই পারছে না।

সে বেশ জোরে ধমক দিয়ে পিয়াকে এসব ব্যাপারে নাক গলাতে বারণ করলেও  মনে মনে বুঝতে পারছে , ইচ্ছে করেই বৌদি এই কথাগুলো প্রচার করছে যাতে তার কানে এসে পৌঁছয় ।

এতদিন তার মনে হয়েছিল, বৌদি আর পিয়ার এই ব্যবসাকে কেন্দ্র করে মন কষাকষিটা বোধহয় একবারে মেয়েলি ইগো সংক্রান্ত সমস্যা। কার পপুলারিটি বেশি, কার পরিশ্রম বেশি , কার কম, এই সব নিয়ে হীনমন্যতা তাদেরই । দাদা বা তার মধ্যে কোনো ঝামেলা, ভুল বোঝাবুঝি নেই।

কিন্তু ব্যাপারটা এখন অতটা সহজ বলে মনে হচ্ছে না। সম্পত্তি নিয়ে যুদ্ধই শেষ পর্যন্ত কুরুক্ষেত্রকে রক্তাত্ব করেছিল। ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল কত রাজা মহারাজাকে। তবে কী এখনো সেই ধারাই অব্যহত! এর থেকে কী মুক্তি নেই কারোর? কিভাবে এই সমস্যার সমাধান হবে, শেষ অবধি কী ব্যবসা ভাগ হয়ে যাবে এইসব চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক করছিল।

ইন্টারকম বাজছে। অনিচ্ছা স্বত্তেও ধরল।

স্যার, ভিজিটার অপেক্ষা করছেন, পাঠাব কী?

একবার মনে হল এখন কাউকে পাঠিও না বলে দিতে, পরমুহূর্তেই ভাবল, কারোর সঙ্গে কথা বললে মনটা কিছুটা অন্যদিকে যাবে। পাঠাও, বলে নিজের চশমাটা খুলে একবার ফুঁ দিয়ে আবার পরে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো।

ভিজিটর ভদ্রলোক দূর সম্পর্কের আত্মীয়। প্রথমেই বললেন তার সঙ্গে বৌঠানের মানে বেদান্তের মা’র সঙ্গে সুসম্পর্কের কথা।

তোমার মা আমাকে খুব স্নেহ করতেন। যখন বিয়ে হয়ে এল আমি তার পায়ে পেয়ে ঘুরতাম। কত জ্বালাতন করেছি। বলতে নেই, তোমার মা রত্নগর্ভা। তোমরা আজ প্রতিষ্ঠিত, ভুললে তো হবে না তাতে বৌঠানের অনেক অবদান। আর তোমরাও তার যথার্থ সন্তান হয়েছ। মা বাবার প্রতি এত শ্রদ্ধা ভক্তি আজকাল দেখাই যায় না। 

এই ভদ্রলোককে সে কখনো দেখেছে বলে মনে করতে পারল না। তাছাড়া এইসব কথাগুলো এখন আর তাকে প্রভাবিত করে না। একটু প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকেই এই জাতীয় স্তোত বাক্য সে শুনছে।প্রথম প্রথম চেষ্টা করত সাড়া দিতে।এখন চুপ থাকতেই পছন্দ করে। সে অপেক্ষা করতে লাগল ভদ্রলোক কিসের জন্য এসেছেন শোনার জন্য।  

ভদ্রলোক ইনিয়ে-বিনিয়ে শেষপর্যন্ত নিজের ছেলের চাকরির জন্য বললেন।

 এক নজরে বায়োডাটায় চোখ বুলিয়ে মেল করে দিতে বলে, বেদান্ত বলল, এই বিভাগটা আমার দাদা দেখেন। আপনি তাঁকেও একবার জানিয়ে দেবেন। আমি মেল পেলে ফরোয়ার্ড করে দেব। তবে আপাতত কিছু হবার সুযোগ কম।

শুনেই ভদ্রলোক প্রায় কাঁদো কাঁদো ভঙ্গীতে বলল, না না এমন বোলো না। আমি জানি তুমি বললেই হয়ে যাবে। তিনি আরো অনেক কিছু বলে যাচ্ছিলেন।

বেদান্তর মেজাজটা বিগড়ে গেল। সে খুব শান্ত গলায় কঠোর ভাবে বলল, আচ্ছা, আপনি এখন আসুন।আমি একটা জরুরী মিটিং-এ বেরোবো।

একপ্রকার বাধ্য হয়েই ভদ্রলোক চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। তারপর বললেন, অনেক আশা নিয়ে এসেছি, তুমি আছো যখন চিন্তা নেই, নিশ্চিন্তে যাচ্ছি, হবে এই ভরসা নিয়েই।

বেদান্তর ইচ্ছে হল বলতে, কোনো ভরসা দিতে পারছি না, আপনার ছেলের থেকে অনেক বেশি যোগ্যতা সম্পন্ন ছেলেমেয়েদেরও চাকরি দিতে পারা যাচ্ছে না। কিন্তু কিছু না বলে মোবাইল থেকে কল করে গাড়ি বের করতে বলে পাশে রাখা বেলটা বাজালো।

ভদ্রলোক আরো একবার- দেখো বাবা, বলে চেম্বার থেকে বেরলেন।

বেদান্তর হঠাৎ তার মুখটা দেখে মায়া হল। সন্তানের জন্য মানুষকে কত কিছু করতে হয়। এমনকি হাত কচলে চাকরিও ভিক্ষা চাইতে হয়। অথচ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সেই সন্তান কোনো কাজেরই যোগ্য নয়। তাকে বহাল করে অর্থ তো যাইই, তার থেকেও বেশি কাজের ক্ষতি হয়। অভিজ্ঞতায় দেখেছে এরাই সবচেয়ে বেশি মালিকের নিন্দে করে এবং কর্ম সংস্কৃতিকে লাটে তুলে দেয়।

 মুডটাই অফ হয়ে গেল, ভাবতে ভাবতে কী মনে করে ইরাবতীকে ফোন করল। রিং হয়ে কেটে গেল।সে উঠে পড়ল। এলোমেলো ঘুরতে হবে, পার্বণী থাকলে ভালো হত। কিন্তু সে ঠিক করেছে নিজে থেকে আর তাকে ডাকবে না।

সেদিন ওভাবে পার্বণীর চলে যাওয়া ও যাবার আগের ব্যবহার এখনো সে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। অথচ তাকে ভুলতেও পারছে না। এ এক দুঃসহ অনুভূতি। সে ইরাবতীকে লিখতে গেল, একটা ভালো কবিতা পাঠাও।

লেখা পাঠানোর আগেই ইরাবতীর ফোন এল। হ্যাঁ বলো।

ব্যস্ত? কোথায় আছ?

এই তো বাড়ি ফিরে রান্না বসালাম।

তুমি রান্না করতে পারো? বেদান্ত অবাক হল ইরাবতীর কথা শুনে।

মানেটা কী?

আমার তো ধারনা ছিল এই এন জিও চালানো মহিলারা,যারা আবার কবিতাও লেখেন, তারা শান্তিনিকেতনী স্টাইলে ঘাড়ে ব্যাগ ঝুলিয়ে চুল এলো করে ফুল গুঁজে চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলে আর নেচে নেচে কবিতা পড়ে বেরায়।

এই রে! এতো সাংঘাতিক কথা বললে। কবিরা শুনলে তোমাকে চাঁদা তুলে পেটাবে। বলে ইরাবতী হেসে উঠল।তার পর বলল, আচ্ছা বলো, কী বলতে ফোন করলে?

বেদান্ত নিজেও মনে করতে পারল না ইরাবতীকে কেন ফোন করেছিল। সে মুহূর্তখানেক কথা খুঁজে পেল না। তারপর বলল, একটা কবিতা পাঠাও।মন ভালো করে দেওয়া।

কার কবিতা?

তোমার। বলেই কথা ঘুরিয়ে বলল- কী রান্না করছ? সত্যি তুমি রান্না করতে পারো?

ইরাবতী বলল, এই তোমার কী হয়েছে? আমি রান্না করতে পারি না এই ধারণা কিভাবে হল? তাছাড়া আমি তো কবি নই। তুমি যেমন বললে, আমাকে সেভাবে দেখেছ কখনো?

বেদান্ত এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, কবিতা পাঠাও।আমি অপেক্ষায় রইলাম।

ফোন রাখার পর বেদান্তর মনে হল, ইরাবতীর কাছে এমন অদ্ভুত আবদার কেন করি! কেনই বা মেয়েটাকে বিশ্বাস যোগ্য মনে হয়!

সে সাইলেন্ট করে দিল ফোন। তারপর বেরিয়ে পড়ল অফিস থেকে। এখন তার নির্জনতা একান্ত ভাবে দরকার।

বেদান্তর ফোন রাখার পর ইরাবতী রান্না শেষ করল। নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় বসে মোবাইল নিয়ে লিখতে বসল।

ইরাবতী নিজেও জানে না কেন সে বেদান্তর জন্য লেখে! অথচ যেই মুহূর্তে সে বলে, কবিতা পাঠাও, ওর তখনি কিছু লেখার জন্য মন ছটপট করে। সেতো কবি নয়। তবুও কী যেন অমোঘ আকর্ষণে সে লিখতে বসে। কি লিখবে ভাবতে ভাবতে সে লিখল, কবিরা নাকি রাঁধে না! চাঁদে শুয়ে চরকি বোনে! খিদে পেলে কলম খায়! তুমি দেখেছ এমন কবি! আমি দেখেছি এক পাগল, সেও নাকি অল্পবিস্তর লেখে। ভোর রাতে পড়তে বসে, কৃষ্ণ নাম সঙ্গে চলে, আটটা বাজলে রান্নাঘরে, এগারোটায় অফিস যায়, বাড়ি ফিরে হেঁসেল ঘরে। তারপর সে ধ্যানে বসে, ধ্যানের মধ্যেই ছন্দ আসে আলোয় ভেসে।বুকের মধ্যে জমা রাখে মেঘ পিওনের চিঠি।সেই চিঠির ভাঁজে লুকিয়ে আছে একদিস্তে শব্দমালা। একদিন, কোনো একদিন তার সঙ্গে ঠিক দেখা হবে তোমার।

লিখে পাঠিয়ে দিল।তারপর সাউন্ড সিস্টেম চালু করে কম ভলিউমে রবীন্দ্রসংগীত শুনতে লাগল।

বেদান্ত অফিস থেকে বেরিয়ে খানিকটা যাবার পর ড্রাইভারকে বলল, চার্চ লেনে যেতে। একঘন্টা বাদে পৌঁছল  ব্যস্ত জনবহুল রাস্তা এড়িয়ে মিশনের আশ্রমে।হলুদ রংয়ের তিনতলা এই সাদামাটা বাড়িটায় মন বিষন্ন থাকলে মাঝে মাঝে চলে আসে সে।

সন্ধ্যার মুখে তাকে দেখে মহারাজ একটু অবাক হলেও হেসে অভ্যর্থনা জানালেন। কি ব্যাপার?মন খারাপ?

বেদান্ত ম্লান হাসল।

আমাদের এখানে এখন রাতের খাওয়া শুরু হয়ে গেছে। তুমি যাবে সেখানে?

বেদান্ত মাথা নাড়ল।

চলো, বলে সন্ন্যাসী এগিয়ে গেলেন টানা বারান্দার দিকে।

টানা বারান্দার দু- ধারে বসে বৃ্দ্ধারা। বেদান্ত হাত তুলেন নমস্কার জানানো মাত্র তারাও প্রতি নমস্কার করল। বেদান্ত লক্ষ্য করছিল দীর্ণ মুখগুলোতেও কেমন হাসি লেগে। খুব মন ছুঁয়ে যাওয়া হাসি। বেদান্তর বুকটা হঠাৎ মায়ায় ভরে গেল। এদেরও নিশ্চয়ই একদিন সংসার ছিল, বাড়ি ঘর, পরিবার, যেমনি হোক না কেন, নিজস্ব গল্প ছিল। কিন্তু আজ এরা এখানে।

প্রথম দিন যখন এখানে এসছিল সে, প্রশ্ন করেছিল, কোথা থেকে আসেন এরা?

 মহারাজ জানিয়েছিলেন, এদের কখনো স্থানীয় মানুষ, কখনো পুলিস দিয়ে যান। আবার কখনো বস্তি,ফুটপাথ এমনকি রেল স্টেশন থেকেও আমরা তুলে নিয়ে আসি।বেশিরভাগই অসুস্থ, অনাহারে অপুষ্টিতে ভোগা। সুস্থ করে চেষ্টা করি ফিরিয়ে দিতে পরিবারের কাছে।কিন্তু এদের স্বজনরা ফেরত নিতে চায় না।অগত্যা এখানেই রেখে দিই। ঈশ্বরের সন্তানকে তো ফেলে দিতে পারব না।

বেদান্তর চোখ আটকে গেল একজনের মুখের দিকে। আগের বার জেনেছিল, তার মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে মেরেছিল কেউ। তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল বাড়ির লোকেরাই। খবর পেয়ে পোড়ার যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকা সেই মহিলাকে নিয়ে এসেছিল মহারাজ।

মুখের চামড়া কুঁচকানো, নাকের জায়গায় শুধুই গর্ত, চোখে দৃষ্টি নেই। সে তাড়াতাড়ি চোখ ঘুরিয়ে নিল। তার গলার কাছে দলা বেঁধে কান্না এল। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে এগিয়ে গেল।

পরের মুখটাও তার চেনা। সামনে গিয়ে দাঁড়ানো মাত্র প্রায় নব্বই বছর বয়সী বৃদ্ধা হাসল। ফোকলা মুখে শিশুর মত নিস্পাপ সে হাসি দেখে বেদান্তর মন ভালো হয়ে গেল। এখনো মানুষ কিভাবে বেঁচে আছে ভাবতেই তার মনে হল এদের থেকে অনেক বেশি সুখে আছে সে।

বৃদ্ধার পাশে গিয়ে বসে পড়ল সে। শিরা ওঠা শুকনো আঙুলে বেদান্তর হাত জড়িয়ে ধরলেন তিনি। আঙুলগুলো কাঁপছিল। বেদান্ত কিছুক্ষণ সেখানেই বসে রইল। সেখান থেকেই সে দেখল সন্ন্যাসীরা নিজেদের মত জপ করে চলেছেন কাজের মধ্যেই। প্রত্যেকের মুখেই একটা প্রশান্তির ছাপ। এত যন্ত্রণাময় দৃশ্যের মধ্যে থেকেও এদের মধ্যে কিভাবে এই শান্তি বিরাজ করে সে বুঝতে পারলো না। কিন্তু এখন তার মন আর অতটা অস্থির লাগছে না।    

আরো ঘন্টা খানে বাদে সে ওখান থেকে বেরিয়ে এল শান্ত মন নিয়ে। গাড়িতে উঠে ইরাবতীর মেসেজ দেখল।

 সে ইরাবতীকে লিখল, পার্বণীর সঙ্গে আমার প্রেমের গল্পটা তোমাকে বলিনি বোধহয়। এমনকি পিয়ার সঙ্গে কিভাবে বিয়ে হল তার কথাও বলা হয়নি।এরপর যখন দেখা হবে তখন বলব। কিন্তু তুমি যখন কিছু বলো তখন মনে হয় আরে এই কথাটাই তো আমি বলতে চাইছিলাম।অথচ সঠিক শব্দ পাচ্ছিলাম না। 

 ইরাবতী বলল, তাই বুঝি!

বেদান্ত শুধু ‘হুম’ বলে জানতে চাইল, কি করছ? রান্না শেষ হল? খাওয়ায় নিশ্চয়ই শেষ।

সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ইরাবতী বলল, একটা মন খারাপ করা চাঁদ আকাশে, কেমন চারদিক ঘিরে উজ্জ্বল চক্রবলয়। বহুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে তোমাকে খুঁজলাম।তুমি কখনো সাদা হাঁসের মতো গ্রীবা বেঁকিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে হাসলে। তোমার ঠোঁটের কালো তিল এখান থেকেও দেখা যাচ্ছে ।সেখানে তাচ্ছিল্য ছিল।আবার তুমিই পরমুহূর্তে সোনার মতো ঝলমলিয়ে উছলে, পরনে তখন নীল জরির শাড়ি।পাড়ে বসানো জরোয়ার ঝুমকো, তুমি ওখান থেকেই চোখে চোখ রাখলে।সাড়া দেব কিনা ভাবতে ভাবতেই তোমার রূপ বদলে গেল।এখন তুমি চন্দ্রের ষোলোকলা পূর্ণ করে আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছ এক দীর্ঘ কালো চুলের বেনী। ধরতে যেতেই চোখ ঝলসে গেল।তুমিও মুখ ঘুরিয়ে নিলে। সেই থেকে আমি নিঃস্পলক দৃষ্টিতে ওই চাঁদের দিকেই তাকিয়ে , তুমি দেখতে পাচ্ছ ঠিকই, শুধু অনুভব করছ না। তারপর বলল, মন খারাপ করে বেশিদিন থেকো না, ওতে মন আরো একা হয়ে যাবে , তার থেকে একা একা ঘুরে বেড়াও, কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় আবদ্ধ না থেকে, কত নতুন নতুন মানুষ, তাদের আলাদা আলাদা জগত, মন এমনিই নিজেকে খুঁজে নেবে।

বেদান্ত ক্লান্ত স্বরে বলল, দূর আমি বুড়ো হয়ে গেছি। চুলে পাক ধরেছে। ক্লান্ত লাগে বড়ো। 

কই নাতো! তুমি একটুও বুড়ো হওনি। এখনো তুমি যথেষ্ট হ্যান্ডসাম, আমি প্রেমে না পড়লে কী হবে প্রচুর মানুষ এখনো তোমাকে দেখে মুগ্ধ হবেই। 

বেদান্ত হাসল। ইরাবতীর মনে হল, সে হাসিতে অনেক যন্ত্রণা জড়িয়ে আছে। সে বলল, মন খারাপ কোরো না। খুব খুব মজা করো, জীবন তো একটাই তাই না ! জানো আমার মন খারাপ হলে আমি কী করি?

 বলো শুনি।বেদান্ত জানতে চাইল।

 কাক ভোরে ঘুম থেকে উঠে যা পাই তাই ধরে যেখানে কোনোদিন কখনো যাইনি এমন জায়গায় চলে যাই, জানিও না সেখানে আমার খাবার জুটবে কিনা, আমার ভাগ্যে কী ঘটবে, কাউকে চিনিও না।কিন্তু ঘুরতে থাকি সেই অজানা গ্রাম, কিংবা কোনো শ্মশান কিংবা নদীর ধার।ধীরে ধীরে দেখি আমার চোখের সামনেই একটা নতুন দিন শুরু হল, একটা অজানা জায়গার মানুষ, কাজে বেরচ্ছে , মাঠে ধান কাটছে, নিজের আনন্দে গান গাইছে, সারা শরীর তার ঘামে ভেজা , মেয়েরা অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে , আমার দেখা জগতের থেকে পুরো আলাদা , আস্তে আস্তে আমি নিজেকে ছন্দে খুঁজে পাই, দেখি তারা বৃষ্টিতে ভিজে রোদে পুড়ে কাজে ব্যস্ত, ঠোঁটের কোণে,তবুও হাসি, তখন মনে হয় আমি তো এদের তুলনায় অনেক আনন্দে থাকি , তাহলে কেন মন খারাপ করব! নিজেকে বলি, ইরাবতী ডোন্ট বি আপসেট, লাইফ ইস ফুল অফ লাভ, তুমি এই মেথড কাজে লাগাতে পারো যদি কমফোর্ট ফিল করো, ইরাবতী বলল।

তোমার এই কথাগুলো আমি নিয়ে নিলাম। দেখব যদি কাজে লাগে। বেদান্ত বলল।

ইরাবতী বলল, শোনো জ্ঞান ভেবো না, একটা মূল্যবান পরামর্শ দিচ্ছি , সবার প্রথম নিজেকে ভালোবাসো, তাহলে কোনোদিন ভালবাসা হারাতে হবে না।আর কষ্টও পেতে হবে না, অন্যকে ভালবেসে না পেলে খুব কষ্ট, কিন্তু এখন তো লায়লা মজনু হতে পারবে না কেউ, তাই নিজেকে খুব ভালোবাসো।

বেদান্ত ছোট্ট করে কেবল বলল, ঠিক।

একটা কথা বলি, আমি জানি না, তোমার ঠিক কী বিষয়ে মন খারাপ।তবে অনুমানের ভিত্তিতে বলছি, যে যায় — তেমন করে সে আর ফেরে না কখনও। একটু একটু করে কখন যে রোদ নিভে যায়, আলো থাকে না আর, আমরা টেরও পাই না। খুব ছোট ছোট কারণকে, যৎসামান্য ফাটলকে বিরাট করে দেখে প্রায়শই আমাদের যোগাযোগের নিটোল সেতুটিকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলি। ফলে দুটো মানুষের মধ্যেকার নিবিড় আতিথ্যগুলি, পারস্পরিক আহ্বানগুলি আর সেভাবে কাজ করে না। ঘষা খাওয়া কাচের মতো অস্পষ্ট হয়ে যায় দুটি হৃদয়ের সব আবেদন। ‘সম্পর্ক’ নামের এক কাঠামোর মধ্যে দুটো মানুষ তখন দুমুখো দাঁড়িয়ে থাকে শুধু। ইচ্ছে করলেও, সেই নিটোল মনটাকে হাজার ডাকলেও সে আর ফেরে না কিছুতেই। 

খুব ভালো বললে কথাটা। বেদান্ত বলল। 

 এটা নিছক লেখা নয়, এটা একটা দর্শন, নিজের উপলব্ধি। তুমি বন্ধন ভালবাসো না খোলা আকাশ? ইরাবতী জানতে চাইল।

 খোলা আকাশ

 উঁহু , তাই যদি হত তবে এভাবে মন খারাপ করতে না।

মন খারাপ এড়ানো খুব কষ্টসাধ্য। আমরা সবাই বুঝি এটা দীর্ঘস্থায়ী না হওয়াই ভালো। কিন্তু সব কিছুর সমাধান যুক্তি দিয়ে হয় না ইরাবতী।

খানিক থেমে ইরাবতী বলল, এই জায়গায় তোমার সঙ্গে সহমত। মন খারাপটা আসলে বৃষ্টির মতো। মেঘ না এলে গরমে মরে যাব, আবার এলে বলব কবে এর শেষ, চলে গেলে ভাবব ইস! ! চলে গেল! এবার তবে কিভাবে ফসল ফলবে, মাটি ভিজবে,

কিছুক্ষণ দুই পক্ষই চুপ। দুজনেই অপেক্ষা করছিল পরবর্তী শব্দের জন্য। বেদান্তের গাড়ি এখন বাইপাশে। দুপাশে আলো ঝলমল করছে। এই শহরে আর রাত নামে না। ঘড়ির কাঁটা বলছে সময় অনেকটাই। কিন্তু এখনো কত গাড়ির সারি। বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল বেদান্ত। কতগুলো বাইক লাগামহীণ গতিতে তাদের গাড়ি ক্রশ করল। বেদান্তের এক লহমায় বহুদিন আগের সেই বাইক দুর্ঘটনার কথা মনে এল। কী ক্ষতি হত সেদিন যদি সে না বাঁচত!

 তার ভাবনার জাল ছিন্ন করে ওপার থেকে ইরাবতী সহসা বলে উঠল, তোমার সঙ্গে এত কথা বলতে বলতে আজকাল একটা কথা প্রায়ই ভাবি, মন যদি কিছু দিন অন্তর খারাপ না হয় তবে বোধহয় জীবন অসম্পূর্ণ, কারণ মানুষ তো নিজেও জানে না শেষ অবধি কোনটা সে চায়..।

আবার ক্ষণিকের বিরতি।

 আমার মনে হয় জোর করে ভোলার চেষ্টা কোরো না, সময়ের স্রোতে তাকে ছেড়ে দিতে হয়, একমাত্র সময়ই সব ক্ষত ভুলিয়ে দিতে পারে, ইরাবতী বলল।

তুমিই হয়তো ঠিক ইরাবতী। তবু বুকের মধ্যে যখন ভাঙনের শব্দ শুনতে পাই তখন তার গোঙানির আওয়াজটাও শোনা যায় তাই না! একটু থেমে বেদান্ত বলল, এত ভেব না আমাকে নিয়ে। আর তোমার সঙ্গে এতক্ষণ কথা বলে এখন অনেকটাই ভালো লাগছে।

ইরাবতী হেসে উঠল বাচ্চাদের মতো। বেদান্তের মনে হল, ইরাবতী সত্যিই একটা বাঁধনহারা দিল খোলা নদী, যা ভেসে যাবার সময় ধুয়ে মুছে দেয় মনের সব বিষণ্ণতা। সেও হাসল।

ইরাবতী হাসতে হাসতেই বলল, তোমাকে ভাল রাখার জন্য এত জ্ঞান দিই, তুমি এবার থেকে আমাকে পারিশ্রমিক দেবে, বিনা পারিশ্রমিকে এত কবিতা, জ্ঞান পোষাচ্ছে না।

ঠিক আছে। এরপর যখন দেখা হবে তুমি নিয়ে নিও তোমার পারিশ্রমিক। বেদান্ত আশা করেছিল, ইরাবতী জানতে চাইবে কী পারিশ্রমিক দেবে!

কিন্ত সেই প্রসঙ্গে একটি কথাও না বলে বলল,এবার রাখছি। ঘুম আসছে। শুভরাত্রি। প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করেই ইরাবতী ফোন রেখে দিল।

একটু বাদেই মোবাইলটায় টুং করে আওয়াজ হল। চা নিয়ে বিছানায় ঠেস দিয়ে বসে ইরাবতী দেখল, বেদান্তের মেসেজ। তুমি কখনো খেলনা-বাটি খেলেছ?

ইরাবতীর খুব মজা লাগল এহেন প্রশ্নে। ছোটোবেলায় কোন মেয়ে আর খেলনাবাটি খেলে না! তার নিজেরই কতগুলো আলুর পুতুল ছিল। আর ছিল প্রিয়রঞ্জন মামার বানিয়ে দেওয়া মাটির পুতুল। সেগুলোর জন্য শাড়ি, জামা বানানো হত। আবার কিছুদিন অন্তর তাদের মধ্যে মেয়ে পুতুলগুলোর বিয়ে দিয়ে শ্বশুড় বাড়ি, আর ছেলেগুলোর নিয়ে দিয়ে তাদের বৌ আনা হত পাশের ঘর থেকে। খাটের উপরে চাদর দিয়ে তাঁবু বানিয়ে সেখানেই নব দম্পতির বাসর সাজানো হত। মা লুচি তরকারি মিষ্টি দিয়ে অতিথিদের খাওয়াতেন।

আরো একটি বড় হবার পর সেই মা’ই একদিন  বলেছিল, ছোটো বেলা থেকে আমাদের মেয়েদের হাতে পুতুল তুলে দেওয়া হয়। সেই পুতুলের সংসার আর খেলনাবাটি খেলতে খেলতে আমরা মেয়েরাই যে কবে নিজেরাই পুতুল হয়ে যাই টেরও পাই না।

আছ? বেদান্তের প্রশ্নে ইরাবতী বাস্তবে ফিরে এল। সে অতীতের খোলা পাতা চোখের সামনে খুলে রেখে উত্তর দিল, হ্যাঁ খেলি তো!

এখনো খেলো?

হুম, আমার তো এখনো একটা বড় পুতুল আছে। আর রোজ নিয়ম করে আমার বাস্তব সংসারের হাতা খুন্তি দিয়ে ভাত ডাল তরকারি রান্না করি গো।

ওঃ। জানোতো, ছোটোবেলায় আমিও রান্নাবাটি খেলতাম। দিদিরা আমাকে মেয়ে সাজিয়ে, ফ্রক পরিয়ে বড় চুল বেঁধে দিয়ে তাদের খেলায় নিয়ে নিত। আমি জঙ্গল থেকে ডালের মত দেখতে ফল, সুরকি বেটে ডাল, নানা কিছু দিয়ে রান্না হত। কী মজাই না হোত! পুতুলের বিয়ে হত। আমি সব সময় বর পক্ষ হতাম।

তারপর? ইরাবতীর মনে হচ্ছিল আসলে সে বেদান্তকে না, নিজেকেই প্রশ্ন করছে, তারপর কী হল? 

তারপর আমার যখন চার বছর একদিন দেখলাম দিদি ছলছল চোখে আমাকে জড়িয়ে ধরল। শাড়ির আঁচলে বাঁধা গিট খুলে  দশ আনা দিয়ে চলে গেল।

দিদির তখন কত বয়স? বিয়ে হয়ে গেল?

হ্যাঁ। দিদির তখন পনেরো ষোলো বছর হবে বোধহয়। একটু থেমে বেদান্ত বলল, তুমি চিঠি লিখতে কাউকে? নাকি তোমার সময় পেজার, মোবাইল এসে গেছে?

আরে না। অত ছোট আমি নই। বস্তা বস্তা চিঠি লিখতাম আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব…। আমার তো পেন ফ্রেন্ডও ছিল। নীল ইংল্যান্ড খামে সেই চিঠির আনন্দই ছিল আলাদা।

হুম। আমাকেও দিদি চিঠি পাঠাত। ছবি এঁকে, ছন্দে। আমিও উত্তর দিতাম। তখন তো চিঠি আসার মজাই আলাদা ছিল। পোস্ট মাস্টার এসে নাম ধরে চিঠি দিচ্ছে, তার আলাদাই গুরুত্ব। নিজের বুকের ছাতিটাই যেন এক লহমায় বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যেত। বেদান্ত বলল।

বেদান্তের কথা শুনতে শুনতে ইরাবতীর মনে পড়ল, তার দিস্তে দিস্তে চিঠি লেখার কথা। কত চিঠিতে থাকত অভিমান, ভালোবাসা, রাগের অভিব্যক্তি।সেই নীল খাম- হলুদ পোস্ট কার্ডে কী ভালোবাসা লুকিয়ে ছিল যেগুলোর বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে ভালোবাসা শব্দটাও হারিয়ে গেল কী! কে জানে!

সে বলল, তোমার এখন একা লাগে, তাই না?

বেশ খানিকক্ষণ চুপ থেকে বেদান্ত বলল, ঠিক একা নয়, এত মানুষের সঙ্গে এখন যোগাযোগ যে নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় পাই না। কিন্তু তবু কখনো কখনো মনে হয় নিজের কথা বলার লোক কেউ নেই। সবার কথা আমি শুনছি, আমার কথা কাকে বলব! আর বললেও বিশ্বাস করে বলব, তার মর্যাদা সে রাখবে তো!

ইরাবতী খানিকক্ষণ চুপ থাকলো। তারপর বলল, আমাকে বিশ্বাস করতে পারো।

ওপাশ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে ইরাবতী রান্না ঘরে উঠে গেল মোবাইল চার্জে বসিয়ে।

দীর্ঘদিন বেদান্তের সঙ্গে দেখা হয়নি ইরাবতীর। মাঝখানে ফোনে, হোয়াটসআপে কথা হলেও তেমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয় সেগুলো। কাল রাতে বেদান্তের মেসেজ পেয়ে দেখা করতে এল ইরাবতী। দেখে বেশ রোগা আর ক্লান্ত লাগছিল তাকে।যদিও ঠোঁটের কোনে একচিলতে হাসি ধরে রাখা। তবু ইরাবতীর মনে হল এই হাসিটা হাসতেও বেদান্তের কষ্ট হচ্ছে খুব।

ইরাবতী  ঠিক করেই এসেছে বেদান্তের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করবে তার জীবনী শোনার বিষয়ে।গত দুবছরেও তার থেকে এমন কিছুই জানতে পারা যায় নি যাতে করে সত্যি কোনো কিছু লেখা যায়। টুকরো টুকরো কিছু কথোপকথন কিংবা ঘন্টা খানেক একসঙ্গে বসে কিছু শোনা।তারপর দীর্ঘ বিরতি। তখন গল্পের রেশ হারিয়ে গেছে।

বেদান্তর ঘরে কয়েকজন অতিথি আছেন। ঈশারায় তাকে বসতে বলে সামনে ফেলে রাখা মোবাইল তুলে তার থেকে কাউকে চা বিস্কুটের অর্ডার দিল। ইরাবতীর দিকে চেয়ে জানতে চাইল- আর কিছু?

ইরাবতী এতজনের মাঝখানে তাকে প্রশ্ন করেছে বেদান্ত এটা চট করে ধরতে পারলো না। বেদান্ত আবার জিজ্ঞেস করল, আরে তোমাকেই বলছি। খাবে কিছু?

ইরাবতীর লজ্জা লাগল। যদিও খিদে পেয়েছিল, তবু সে মাথা নেড়ে না বলল।

বেদান্ত ফোনে বলল, একটু বেশি করে বিস্কুট, আর কম চিনি দিয়ে লিকার। তারপর ইরাবতীর দিকে তাকিয়ে বলল, একটু অপেক্ষা করতে হবে।সময় নিয়ে এসেছ তো!

ইরাবতী জানে, বেদান্ত যতই বলুক ফ্রি, আসলে সে সব সময় ব্যস্ত। তার মধ্যেই ফাঁক ফোকরে যতটা বলা যায় সেই চেষ্টাটা করে।সে বলল, ঠিক আছে।

এই অফিসটায় ইরাবতী এর আগে আসেনি। সদ্য গড়ে ওঠে শহরের শেষ প্রান্তে এই নতুন বাড়িটা তৈরি হয়েছে বিশাল জায়গা জুড়ে। বেদান্তের অন্যান্য অফিসের তুলনায় এটা বেশ ছড়ানো ছিটানো। যে কনফারেন্সরুমে সে বসে সেটারই আয়তন কম করে চারহাজার স্কোয়ার ফিট হবে। ঘরটার একপাশে বিশাল সোফা তিনদিক জুড়ে। মাঝে কাঠের টেবিলের উপর কাচ। তারপাশে বইয়ের শেল্ফ। তাতে বেশ কিছু বিদেশি বই।

বেদান্ত যেখানে বসেছিল তার মাথার পিছনে পেল্লাই সাইজের একটা  অয়েল পেন্টিং। বাকি দেওয়াল জুড়েও অনেকগুলো পেন্টিং।

ইরাবতী বসেছে ঘরে ঢুকেই বাঁ দিকের একটা চেয়ারে। তার উল্টোদিকে দেওয়াল ঘেঁসে একটা ডাইনিং টেবিল। সেখানে কতগুলো বোন চায়নার চায়ের কাপ আর প্লেট পড়ে। তার পাশে আবার পর পর বুক শেল্ফ। সেগুলোতে বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যিকদের পাশাপাশি যোগ, মেডিটেশন, মনোবল বাড়াবার নানান বই রাখা।

ইরাবতী খুব মনোযোগ দিয়ে ঘরটা দেখছিল। তার মনে হল এই ঘরটার ডেকোরেশনের দায়িত্ব বা মত কোনোটাই বেদান্তের নয়। এই ক’দিনে বেদান্তকে যতটুকু চিনেছে সে, তার সঙ্গে এই রুচির কোনো মিল নেই। ঘরটা বিশাল হওয়া সত্ত্বেও খুবই জবর জং।

ভাবনাটা ভাবার পর ইরাবতীর নিজের মনেই হাসি পেল। কেন হঠাৎ মনে হল এটা বেদান্তের রুচির সঙ্গে যায় না! সত্যি কী সে এতটুকুও চেনে বেদান্তকে! সেতো ঠিক তত খানিই জেনেছে তাকে, যতটা বেদান্ত নিজে বলেছে। একটা মানুষ কী কখনোই কারোর কাছে নিজের সমস্ত মনের কথা উজার করে দেয়, নাকি দিতে পারে? সে নিজেকে ততটাই উন্মুক্ত করবে যতটা প্রকাশ করলে তার সব ভালো দিকগুলো চোখে পড়বে। এখনো পর্যন্ত কিন্তু বেদান্তের চরিত্রের বা সবভাবের এমন কোনো দিক উন্মোচিত হয়নি যাতে সাদা বেদান্তের পাশাপাশি ধূসর কিংবা কালো কোনো দিকও ফুটে ওঠে।এই গল্প ভীষণভাবে এককেন্দ্রিক বহুমুখী এক ভালো নায়কের গল্প। সেখানে সব নিখুঁত করে রচনা করা।

হ্যাঁ,এ কথা ঠিক দীর্ঘ স্ট্রাগল আছে, দুঃখ আছে, প্রেম আছে, মনোকষ্ট আছে, হাহাকার আছে, কিন্তু তার পাশাপাশি সুখ, শান্তি,ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, অর্থ, যশ… সব সব আছে।

ইরাবতী এসব ভাবতে ভাবতে বেদান্তের দিকে তাকালো।বেদান্তের চোখের নিচে কালি।তাকে বেশ বুড়ো দেখাচ্ছে। কথা বলছে, হাসছে।কিন্তু ইরাবতীর বারবার মনে হচ্ছিল বেদান্ত নিজের ছন্দে নেই।কোথাও একটা সুর কেটে গেছে।

বেদান্ত কথা বলতে বলতে তার দিকে তাকালো।তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে?

না, তুমি কাজ সেরে নাও।বলে ইরাবতী পাশে রাখা শেল্ফ থেকে একটা বই তুলে নিল।

একজন এসে চা বিস্কুট আর নানা রকম কুকিজ দিয়ে গেল। ইরাবতী চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বইটা পড়ায় মন দিল।

বেশ কিছুক্ষণ বাদে মিটিং শেষ হল বেদান্তের। সবাইকে বাই বলে সে ইরাবতীকে নিজের চেম্বারে আসতে বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

ইরাবতী বইটা হাতে নিয়েই উঠে পড়ল। ওয়াশরুমে গেল। নিজেকে আয়নায় দেখল। চোখের তলার কাজলটা খানিক ধ্যেবরে গেছে। তার মনে পড়ল বিয়ের পর কলেজে প্রথম প্রথম এরকম কাজল ছড়িয়ে গেলে বন্ধুরা হাসত। কিরে বরের খুব আদর খেয়ে এসেছিস বেরবার আগে!

 লজ্জায় সে কাজল পরাই ছেড়ে দিয়েছিল দীর্ঘদিন।তারপর বর বিষয়টাই আর রইল না।দুজনের দুটো পথ হয়ে গেল প্রান্তি হবার পর। সেও কুড়ি বছর হয়ে গেল।প্রান্তিরও বিদেশে চলে যাওয়া এক বছর অতিক্রান্ত।একা একাই কাটিয়ে ফেলল দিনগুলো।

এখন বয়স হচ্ছে।প্রান্তি বলে, মা কাজল না পরলে চোখের তলাটা কেমন ফ্যাকাসে লাগে। তাই পরা বন্ধ করেনি। কিন্তু ধ্যেবরে যাওয়াটা এখনো রোধ করতে পারেনি। ব্রান্ড পরিবর্তন করেও সেই একই কান্ড। প্রান্তি বলে, তোমার মুখ খুব তেলতেলে। যাই করো না কেন এমনি হবে। তার চেয়ে এটাই ভালো। এটাই তোমার স্টাইল।

ইরাবতী হাসে। স্টাইল ডিভা শব্দটা এক সময় কলেজে তাকে বলা হত। সব কিছু ম্যাচ করে পরার মাঝেও সে নিজের এমন একটা বোহেমিয়ান লুক তৈরি করেছিল, যে সকলে ভেবেই নিয়েছিল সে সবার থেকে আলাদা। এই সবার মাঝে থেকে নিজের একটা আলাদা ইমেজ ধরে রাখাটা ইরাবতীর মজা লাগত। সে প্রতিটা মুহূর্তে উপভোগ করত তাকে নিয়ে বন্ধুদের নানা আলোচনা।

বহু বছর আগের সে সব কথা। এখন ভাবলে মনে হয় প্রাগৈতিহাসিক কালের কথা। কত বছর হয়ে গেল, সে আর নিজের দিকে ভালোভাবে তাকায় না। আয়নার সামনেও দাঁড়াতে ইচ্ছে করে না। যাহোক একটা পরে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেই হল।

বেদব্যাস ভীষণ রেগে যায় মেয়ের সাজগোছ নিয়ে এমন অদ্ভুত নির্লিপ্ততায়। নিজেকে সুন্দর ভাবে প্রেজেন্ট করাটাও একটা আর্ট। উগ্র সাজের যেমন দরকার নেই, তেমনি রুচিসম্মত ভাবে এমনভাবে সাজবে যাতে তুমি ঘরে ঢুকলেই একটা আলাদা বাতাবরণ গড়ে ওঠে। জানবে বাগানে সুন্দর ফুল অনেক, কিন্তু কোন ফুলটা কিভাবে নিজেকে মেলে ধরছে সেটাই প্রকৃতির কাছ থেকে শেখার। যখন বেরবে তখন যেন একটা দীপ্তি ঝরে পড়ে। রোজ একটু করে ধ্যান করো। ব্যায়াম করো। দেখো চেহারার লালিত্য, আভিজাত্য এমনিই আসবে। লিপস্টিক না পরলেও চলবে। কিন্তু যতটুকু সাজবে যেন দেখেই মন ভালো হয়ে যায়।

আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে এসব কথাই মনে পড়ছিল ইরাবতীর।সে ব্যাগ থেকে টিস্যু পেপার বের করে বাড়তি কাজল মুছলো। আলতো করে মুখের ঘাম মুছে বেদান্তের চেম্বারের দিকে গেল।

বেদান্ত চেম্বারে গিয়েও মিটিং-এ বসে গেছে। তাকে দেখেই বলল, দু’মিনিট।

ইরাবতী হেসে বাইরে অপেক্ষা করতে লাগল।

চেম্বারের রিসেপসনের মেয়েটির বয়স অল্প। সে ইরাবতীকে জিজ্ঞেস করল, ম্যাডাম আপনার কিছু লাগবে? চা কফি এনিথিং?

নাথিং। থ্যাঙ্কস, বলে ইরাবতী মোবাইল বের করল। প্রান্তির ঘুম থেকে ওঠার সময় হয়ে গেছে।সে ফোন করে জেনে নিল- উঠলি?

এই যে মা, আর মিনিট পনেরো মিনিটের মধ্যে বেরব। তুমি? ফিরে গেছ?

না মা। একটু দেরি হবে মনে হচ্ছে। তুমি পৌঁছে একটা টেক্সট করে দিও। আমি মিটিং-এ ঢুকবো। ফোন হয়তো ধরতে পারব না।

ইটস ওকে মা। সাবধানে ফিরো।

তুমিও সাবধানে যেও। ফ্রি হয়ে কল কোরো।

ওক্কে মাম্মি। বাই…ই। প্রান্তি ফোন কেটে দিল।

রিসেপশনের মেয়েটি তখনি ডাকলো। ম্যাডাম , স্যার ডাকছেন।

হেসে ভিতরে ঢুকলো ইরাবতী।

দাঁড়াও আগে একটু তোমার জন্য ভালো চা বানাই, তারপর কথা…

তুমি বানাবে?

হ্যাঁ।এটা খুব ভালো চা।সবাই বানাতে পারে না ঠিক করে।

ইরাবতী হেসে ফেলল। তোমার বুঝি টি এস্টেটও আছে?

দূর! ইচ্ছে করলে কিনতে পারি। কিন্তু শুনেছি টি এস্টেটের মালিকরা খুব নিষ্ঠুর হয়। হাসল বেদান্ত। তারপর বলল, এটা এক বন্ধুর বাগানের। সে নিয়মিত পাঠায়।ভালো লাগলে তোমার জন্যে আনিয়ে দেব।

রিসেপশনের মেয়েটি একগাদা চেক নিয়ে ঢুকল। স্যার, এগুলো সই করে দিতে বলেছে একাউন্টস থেকে।

কয়েকটা সাইন করার পরেই হঠাৎ রেগে গেল বেদান্ত।পারব না।সব নিয়ে যাও।এত চেক একসঙ্গে কেন পাঠিয়েছে? এই নিয়ে পরে কথা বলব।

মেয়েটি স্যারের এই রূপ দেখে তাড়াতাড়ি ফাইল তুলে নিয়ে বেড়িয়ে গেল ঘর থেকে।

পুরো ছ’মাস পর বেদান্তকে এত সামনাসামনি দেখল ইরাবতী। বেদান্ত বেশ রোগা হয়ে গেছে। অসুস্থ ও ক্লান্ত লাগছে। চোখের তলায় পুরু কালি। সে বেশ কিছুক্ষণ সব কিছু ভুলে বেদান্তের দিকে তাকিয়ে রইল।

চা খাবে তো? কী দেখছ এসে থেকে?

ইরাবতী খানিকটা অসয়স্তি নিয়ে চোখ সরিয়ে নিল।তারপর বলল, একী চেহারা হয়েছে তোমার? 

 রোগা হয়েছি কী? বেদান্ত হেসে বলল।

ইরাবতী দেখল বেদান্তের সেই প্রাণবন্ত হাসিতেও যেন ক্লান্তির দীর্ঘশ্বাস। সে আবার জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে তোমার? শরীর ঠিক নেই মনে হচ্ছে। ডাক্তার দেখিয়েছ? 

কিছু হয় নি। হাসল বেদান্ত। তুমি কোনোদিন প্রেমে দাগা খেয়েছ? 

বহুবার।ইরাবতী হেসে ফেলল।কেন তোমাকে কে দাগা দিল? কার ঘাড়ে এত বড় মাথা যে বেদান্ত রায়ের ভালোবাসা প্রেম ফিরিয়ে দেয়! 

তুমি মজা করছ।সকলেই করছে। আমার বন্ধুরা তো আমাকে নিয়ে রীতিমত হাসি ঠাট্টা করছে।বেদান্ত বলল।

ব্যাপারটা কী বলতো? তুমি কিন্তু তোমার প্রেমের কথা সেভাবে কিছুই বলোনি।ইরাবতী বলল।

সেভাবে কী কোনো কথা বলা গেল ইরাবতী! আসলে আমি খুব বোকা।

ইরাবতী চুপ করে পরবর্তী কথা শোনার অপেক্ষায় রইল।

বেদান্ত বলল,যার প্রেমে পড়লাম, ভেবেছিলাম সেও আমাকে খুব ভালোবাসে।কিন্তু দেখলাম, আমাদের মাঝে এক অন্য মানুষ রয়েছে। সে আমাকে ঝুলিয়ে রেখেছে, ছেড়েও দিচ্ছে না, আবার পুরোপুরি আসছেও না।

মানে? 

মানে আর কী! খেলাচ্ছে , আমি বুঝেও না বোঝার মত হয়ে আছি। গান্ধারী যেমন সব জেনে শুনেই চোখে কালো পট্টি বেঁধে রেখেছিল, ঠিক তেমনি আমিও প্রেমে অন্ধ হয়ে রয়েছি।

দূর কী বলছ কিছুই বুঝতে পারছি না।

এতে না বোঝার কী আছে? ম্লান হেসে সে বলল, আমি আসলে খুব বোকা।এসবে পাকা খেলোয়াড় নই।তাই হৃদয় দিয়ে সব ভাবি, মস্তিষ্ক নিষ্ক্রিয় রাখি।

ইরাবতীর বুকটা হঠাৎই কেমন শূন্যতায় ভরে গেল।মানুষটা বড় কষ্ট পাচ্ছে ।কিন্তু তার তো কিছুই করার নেই। সে অস্পষ্ট স্বরে বলল, তুমি খুব ভালো বেদান্ত। কষ্ট পেও না, যে গেছে সে যদি তোমাকে সত্যিই ভালো বেসে থাকে ফিরে আসবে। ভরসা রেখো নিজের ভালোবাসার উপর।

ইরাবতী বলল বটে, কিন্তু তার ভিতরে লুকিয়ে থাকা এক অন্য আমি বলে উঠল, না সে আর ফিরবে না। হাজার চেষ্টা করলেও সে ফেরার নয়।

বেদান্ত ম্লান একটা হাসি হাসল।আমি মন থেকে চাই, ও আর না ফিরুক।তবু কোথায় যেন মনের জোর পাচ্ছি না।শুধু ফাঁকা লাগছে সব।

ইরাবতী কিছু না বলে চুপ থাকল। কোনো কারণ ছাড়াই তার চোখের কোণ চিকচিক করে উঠল।এই মানুষটাকে যত দেখছে তত মুগ্ধ হচ্ছে।তবে কী ভালোবাসাও জন্ম নিচ্ছে নিজের অজান্তেই! 

দূর, কী সব ভাবনা ভাবছি! মানুষটা নিজেই প্রেম নিয়ে পুরো ঘেঁটে আছে।যেন রাধার বিরহে আধমরা হয়ে গেছে। এর হৃদয়ের কোনো জায়গাতেই সে কখনো প্রবেশ করতে পারবে না। যেটুকু সৌজন্য সে দেখায়, সেটা তার সহজাত গুন।প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রেই এই মানবিক বোধ তার তীব্র ।

তবু কোথাও যেন একটা কষ্ট তাকে তোলপাড় করে দিল।সে নিজেকে সংযত করে নিয়ে কোনো বাহ্যিক  প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, তোমার কী জ্বর হয়েছে?

বেদান্ত একটু চুপ করে বলল, কিভাবে বুঝলে?

তোমার চোখ মুখ দেখে। ক্লান্ত লাগছে। চোখ লাল হয়ে আছে। মুখ থমথমে।

হুম। ক’দিন ধরেই জ্বর।

ডাক্তার দেখিয়েছ?

না, সময় পাইনি। তবে আমার এক ডাক্তার বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে ওষুধ নিচ্ছি। বলে ঘরের এক সাইডে রাখা ইলেকট্রিক কেটলির দিকে চা করার জন্য উঠে গেল বেদান্ত।

ইরাবতীর ইচ্ছে করছিল নিজেই বেদান্তকে চা বানিয়ে দিতে। কিন্তু নিজেকে সংযত রেখে বলল, অন্য কাউকে বললে হত না?

বেদান্ত হাসল। আমি নিজে বানাতে পছন্দ করি। তাছাড়া এটা ঠিক মতো ভেজানো না হলে পুরো মাটি।

ইরাবতী আর কিছু না বলে হাসল।

মিনিট দুয়েকের মধ্যে চা বানিয়ে কাপে নিয়ে নিজের সিটে ফিরে এল বেদান্ত। পাশে রাখা বিস্কুটের কৌটো থেকে বিস্কুট বের করে এগিয়ে দিল ইরাবতীর দিকে। এটা দারুণ খেতে। খেয়েছ আগে?

সেদিকে তাকিয়ে ইরাবতী মাথা নাড়ল। জীবনে কতটুকু আর খেয়েছি কিংবা দেখেছি! সংসার সমুদ্রে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতেই তো কেটে গেল এতগুলো বছর। সে নিজের মনেই বলল।

চায়ে চুমুক দিয়ে বেদান্ত বলল, আজ ভেবেছিলাম তোমাকে বেশ কিছুটা বলব, কিন্তু দেখতেই পাচ্ছ কী অবস্থা! এসে থেকে এতটুকুও বসার অবকাশ পাইনি। ক্লান্ত লাগছে।

ইরাবতী বলল, হ্যাঁ তোমাকে দেখেই বুঝতে পারছি। তবে আমি আজ কিছু শুনতে আসিনি। যতটা তোমার থেকে শুনেছি সেটা লিখে দিতে এসেছি।

প্রিন্ট নিয়েছ?

না। তোমার অনুমতি ছাড়া কিভাবে এখানে প্রিন্ট নেব?

বেদান্ত বলল, দূর বোকা! এতে অনুমতি কেন লাগবে? বলেই বেল বাজিয়ে রিসেপশনের মেয়েটিকে ডেকে বলল, ম্যাডামের পেন ড্রাইভে একটা ফাইল আছে। প্রিন্ট দিয়ে যাও তো।

মেয়েটি বলল, কী নামে আছে?

ইরাবতী বলল, অজানা গল্পের খোঁজে।

মেয়েটি বেরিয়ে যাবার পর বেদান্ত জানতে চাইল, চা কেমন হয়েছে ?

দারুণ।

বলো, অল্প সময়ে কী বলা যায়?

একটা কথা বলব?

হ্যাঁ, বলো।

আজ কোনো ব্যক্তিগত কথা শুনব না। তুমি খুব ক্লান্ত। তোমার বিশ্রাম দরকার।

বেদান্ত হাসল। কে দেবে আমাকে বিশ্রাম? দেখছ না একটার পর একটা কাজ করে চলেছি। মাঝে মাঝে নিজেকে মোটবাহী গাধা মনে হয়। পিঠে বোঝা নিয়ে হেঁটেই চলেছি। কোনো বিশ্রাম নেই, খাওয়া নেই, ঘুম নেই… শুধু …।

ইরাবতী সেই অসমাপ্ত কথার রেশ ধরেই বলল, আমরা সবাই পিঠে বোঝা নিয়েই হেঁটে যাচ্ছি। হাঁটার গতিটা কম বেশি হয়। কিন্তু বোঝাটা সবার কাঁধে, পিঠে থাকেই। আসলে সংসার নামক এই যে রঙ্গমঞ্চ, তাতে থেমে থাকা মানেই তুমি শেষ। তোমার রক্তাত্ব শরীরকেই পিষে দিয়ে আরেকজন এগিয়ে যাবে। এটাই শাশ্বত সত্য। কিন্তু তা বলে তো একনাগাড়ে দৌড়ানো যায় না, থামতে হয়। নইলে মুখ থুবড়ে পড়লে উঠে দাঁড়াতে পারবে না যে। তুমি খুব ভালো করে ডাক্তার দেখাও। আমি এতগুলো দিনে তোমাকে কখনো এত ক্লান্ত দেখিনি।

বেদান্ত ম্লান হাসল।

রিসেপশনের মেয়েটি প্রিন্ট বের করে দিয়ে গেল। স্যার, কিছু লাগবে?

না। মেয়েটি চলে গেল।

এই যে অফিসটা দেখেছ এটা নতুন। আগের অফিসটা ভাগ হয়ে গেছে দাদার আর আমার মধ্যে। জানো, কখনো ভাবিনি, ভাইয়ে ভাইয়ে বিরোধ হতে পারে। লোকের বাড়িতে দেখেছি, সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা। আমি মুচকি হেসেছি। আমাদের পরিবারে এসব হবে না। ওসব নিচু মানসিকতার মানুষদের মধ্যে হয়।অদৃশ্যে ভগবান হেসেছিলেন। সেই জন্য বলে কোনো বিষয়ে অহঙ্কার করতে নেই। করেছ কী মরেছ!

ইরাবতী শুনছিল বেদান্তের কথা। তার মনে হচ্ছিল, আজ বেদান্তর মুড ঠিক নেই। একে জ্বর তার উপর এই ভাগাভাগির ব্যাপারটা তাকে খুব আঘাত দিয়েছে।

সে চুপ করে রইল।

তুমি নিশ্চয়ই কাগজে এসব নিয়ে মুখোরোচক লেখা পড়ছ! সবাই খুব মজা পাচ্ছে। কিন্তু বিশ্বাস করো আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।

এত ভেবো না। গীতার কথা মনে করো। যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জুন ভেঙে পড়েছে, চারদিকে নিজের আত্মীয় পরিজনের খন্ডবিখন্ড দেহ। তখন কৃষ্ণ তাকে বলছেন, তুমি যাদের নিজের মনে করছ তারা কেউ নিজের নয়। সব আলাদা আলাদা অস্তিত্ব বুঝলে। একটা কমন প্ল্যাটফর্মে আমরা থাকি, কিছুদিন একসঙ্গে জীবন কাটাই, তারপর যে যার নির্দিষ্ট ঠিকানায় নেমে যাই। তখন পথ আলাদা হয়ে যায়। ইরাবতী কথাগুলো একদৃষ্টে বেদান্তের দিকে তাকিয়ে রইল।

বেদান্ত বলছিল, তুমি হয়তো ভাবছ, সম্পত্তির জন্য আমার মন খারাপ। হ্যাঁ, এ কথা ঠিক, চুলচেরা ভাগ তো হয়নি, আমি তখন কমই পেয়েছি।কিন্তু বলতো, টাকা পয়সা সম্পত্তি এগুলোই কী জীবনের একমাত্র লক্ষ্য !  নিজের রক্তের সম্পর্কের সঙ্গে মানসিকভাবে ভাগ এই যন্ত্রনা সহ্য করা বড় যন্ত্রণার।

থাক না আজ এসব কথা। ইরাবতী খুব আস্তে আস্তে বলল, এখন কোনো কথা নয়/ ঘন কালো আকাশ/বিদ্যুতের ঝলকানি,/গভীর প্রেমে মত্ত দাদুরী…/ তুমিও মত্ত জীবনের চাওয়া-পাওয়ায়-/ বহুদিন চোখ খোলোনি… । যা গেছে তা যাক, সেই নিয়ে শোক কোরো না।বরং এটা ভেবে নেওয়াই ভালো যা পেলাম সেটাই আমার অতিরিক্ত পাওয়া।

তুমি বড্ড অন্য রকম ইরাবতী।

জানি। বলে ইরাবতী ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসল। তারপর বলল, এবার আমি উঠি।

কিন্তু আজ তো তোমার সময় নষ্ট হল, অথচ কিছু বলা হল না। বেদান্ত বলল।

তোমাকে তো আজ প্রথমেই বলেছি, আমি কিছু শুনতে আসিনি। শুধু দেখা করতে এসেছি।

তাহলে আবার এরমধ্যে সময় বের করে বসছি। দেখি সামনের সপ্তাহে যদি টানা সময় দেওয়া যায়। বেদান্তের কথায় শব্দ করে হাসল ইরাবতী।

তুমি নিজেও জানো না কখন তোমার সময় থাকবে। কিন্তু আমি আর কিছু শুনতে চাই না।ইরাবতী বলল।

আমার তো এখনো কিছুই প্রায় বলা হয় নি তোমাকে, সামনে রাখা প্রিন্ট আউটে চোখ বোলাতে বোলাতে বেদান্ত বলল।

হ্যাঁ। ঠিকই। যা বলেছ, সেটা তোমার জীবনের হয়তো দুই শতাংশ অংশও নয়।

আমার এখনো পিয়া, পার্বণীর কথাই বলা হয়নি তোমাকে। পার্বণী…

বেদান্তকে চুপ করিয়ে দিল ইরাবতী। আমি জানি,তুমি না বললেও অনুভব করেছি তাকে। আমি এও জানি তার আর তোমার প্রেম এখন অনেকটাই রং বদলে গতিপথ পালটে ফেলেছে। তবু সে আছে। আবার পিয়াদি’ও আছেন। এই থাকাটাই সত্য। তুমি বললেও সত্য, না বললেও তা থেকে যাবে।

শুধু তো এগুলোই নয়, আরো প্রচুর ঘটনা তোমাকে বলা বাকি।

একটা মানুষের ঘটনাবহুল জীবনের কাহিনি কী কয়েক ঘণ্টায় বলা যায়! এতো সিনেমা নয় যে তুমি দুম করে দৌড়তে দৌড়তে বড় হয়ে গেলে। আর জীবনটা আড়াই ঘন্টা তিন ঘন্টার জার্নিও নয়। ইরাবতী থামল। গভীর দৃষ্টিতে তাকালো বেদান্তের দিকে। তারপর আবার বলল, তাছাড়া সব কথা কি জানানো যায় ! মনের ভেতরের কত কথা তো নিজেই জানা যায় না ঠিকঠাক। কখনও কখনও একটু আভাস পাওয়া যায় মাত্র, কিন্তু কথাটা? না, তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। হঠাৎ কোনও উদাসীন হাওয়ায়, কিংবা কোনও নিঝুম ঘুমভাঙা রাতে একলা জানলায় দাঁড়ালে মনে হয় কি যেন বলার ছিল, কাকে যেন বলার ছিল  কত কথা। সেই পরম মানুষটি কোথায়? তাকে পাওয়া যায় না। আমৃত্যু চলতে থাকে তার অন্বেষণ। 

   বেদান্ত বলল, তুমি খুব সুন্দর কথা বলো। মন ভালো হয়ে যায়। কিন্তু তাহলে আমার এই গল্প কী অপূর্ণ থেকে যাবে?

 নাতো! সাময়িক বিরতি নেবে। টিভিতে কোনো অনুষ্ঠান চলাকালীন যেমন ব্রেক দিয়ে বলে, ফিরে আসছি সামান্য বিরতির পরে- ঠিক তেমনি ভাবেই আমি আবার ফিরে আসব। শুরু হবে কাহিনির দ্বিতীয় ইনিংস। নাম দেব- কাহিনি নং- টু। বলে ইরাবতী হেসে উঠলো।

বেদান্তও হাসল। তারপর বলল, একটু অপেক্ষা করো। আমি এক্ষুনি আসছি।

ওকে। বলে ইরাবতী ঘাড় নাড়ল।

বেদান্ত উঠে গেল।

ইরাবতীর মন খারাপ করছিল খুব। তোমাকে খুব মিস করব বেদান্ত। এই যে তোমার গল্প শোনার জন্য এত কৌতূহল, তার পিছনে হয়তো তোমার সঙ্গে আড্ডা মারাটাও একটা অভ্যেস হয়ে গেছিল। কিন্তু সব অভ্যেসের একটা সীমারেখা টানা উচিত। সেটা না টানলে সব কিছু ওলোট পালট হয়ে যায়। ইরাবতী চোখ বুজে এসবই ভাবছিল।

কাচের দরজা খোলার আওয়াজে চোখ খুলল। বেদান্ত ফিরে এসেছে।

ইরাবতী হাসল তার দিকে তাকিয়ে।

নিজের চেয়ারে বসে বেদান্ত একটা ব্রাউন খাম এগিয়ে দিল ইরাবতীর দিকে।

এটা কী? ইরাবতী অবাক হয়ে জানতে চাইল।

এই যে তুমি এতদিন আমার জন্য সময় দিলে, এই খসড়াটা তৈরি করে দিলে এটা তার একটা সান্মানিক। তোমার কাজের তুলনায় খুবই সামান্য।

ইরাবতী খানিকক্ষণ বেদান্তের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। চোখের মধ্যে যেন একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা ফুটে উঠল। সে খামটা ফেরত দিল। বেদান্তের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় সে বলল, তাহলে তো আমারও তোমাকে পারিশ্রমিক দেওয়া উচিত। তুমিও আমার জন্য অনেক সময় দিয়েছ। কিন্তু আমি তো এই মুহূর্তে খালি হাতে এসেছি। তোমার উপযুক্ত সাম্মানিক পাঠিয়ে দিতে হবে আমাকে। আগে দিই, তারপর না হয় নেব।

কিন্তু ইরাবতী, প্রতিটা মানুষের সময়ের মূল্য আছে।তুমি এটা না নিলে আমার খুব খারাপ লাগবে। বেদান্ত বলল।

কে বলেছে নেব না কিছু? এর চতুর্গুণ নিয়ে নেব তোমার থেকে। তুমি নিজেই বলেছ, আমি তোমার ভালো বন্ধু। আর বন্ধুর অধিকার সবচেয়ে বেশি।

বেদান্ত এবার হাসল। এনি টাইম, আমি তোমার জন্য আছি। যখনি কোনো অসুবিধা হবে আমাকে নির্দ্ধিধায় বলবে।

  সিওর। খুব সাবধানে থেকো তুমি, ডাক্তার দেখিয়ে নিও। আর হোয়াটসআপে আমাদের কথা তো হতেই থাকবে। বলে ইরাবতী উঠে পড়ল।

তারপর খুব ধীরে ধীরে বলল,একটা কথা বলার আছে। আমার কাছে অর্থ মূল্যহীণ।কিন্তু যেকোনো সম্পর্ক অনেক বেশি মূল্যবান। তোমার কিছু বলার ছিল, আমার কিছু শোনার ছিল কিংবা হয়তো একদিন তোমার কিছু শোনার থাকবে,আমারও কিছু বলার। মনের কথা বলার বা শোনার লোক পৃথিবীতে বড় কম।তাই এই জায়গাটা এমনি দেনা -পাওনার বাইরে থাক।পাশে থেকো, এটাই চাওয়া।  

বেশ, তাই হোক।তুমি সাবধানে থেকো। বেদান্ত নিজের সিট ছেড়ে উঠে এসে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল ইরাবতীকে।

গাড়িতে ওঠার পর ইরাবতীর ভীষণ কান্না পেল। দলা দলা কান্না তার গলার কাছে আটকে এখন তার খুব নিঃসঙ্গ লাগছে। মনে হচ্ছে খুব আপনজনের কাছ থেকে বহুদূরে চলে যাচ্ছে সে। আর কখনো ফিরে আসা হবে না তার কাছে।

একটা শূন্যতা ঘিরে রইল সারাটা পথ। সেতো বেদান্তের প্রেমে পড়েনি। তবে কেন এত কষ্ট হচ্ছে! এ জীবনে বহু মানুষের সংস্পর্শে এসেছে সে। তাদের কারোর কারোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আবার ভেঙেও গেছে তা। সময়ের স্রোতে অনেকের মুখ ফিকে হয়ে গেছে। কিন্তু এত ফাঁকা তো কখনো লাগেনি। তবে কী এটাও একধরণের নিরুচ্চারিত প্রেম যা দুজনের মধ্যেই নীরবে বয়েছে, অথচ কেউ কখনো বুঝতে দেয়নি কাউকে।

সব কেমন যেন এলোমেলো লাগছে। সে গাড়ির এসি অন থাকা সত্ত্বেও কাচ নামিয়ে দিল। ঠান্ডা হাওয়া চোখে মুখে এসে পড়ছে। চুলটা এলোমেলো হয়ে গেল নিমেষে। 

ফাঁকা রাস্তা দিয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়িগুলো। মাঝে মাঝে আলোর ঝলকানি। মুহূর্তেই আবার অন্ধকার।

ইরাবতীর কিছুই ভালো লাগছে না।

আকাশটা ঘন কালো। তার মনে হচ্ছিল একটু পড়েই বজ্র বিদ্যুৎ সহ তুমুল বর্ষন শুরু হবে। তার এখনি বৃষ্টি চাই, আজানু তাকে ভিজতে হবে,বৃষ্টিতে ধুইয়ে মুছে ফেলতে হবে এই নিঃসঙ্গতা। তবেই তার মন শান্ত হবে। তার চোখ বেয়ে নেমে আসতে চাইছে জল। সেই জলকে নিজের খেয়াল মতো নামতে দিয়ে সে তাকিয়ে রইল দৃষ্টির বাইরে এক নিদারুণ শূন্য দৃষ্টিতে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত