Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,ব্যাকড্রপে নগরধ্যান

‘ব্যাকড্রপে নগরধ্যান’: নগ্ন বাস্তবতার পরিচ্ছন্ন পাঠ । সিদ্ধার্থ অভিজিৎ

Reading Time: 3 minutes
ভাব-ভাষা-ছন্দ-অলঙ্কার প্রভৃতি উপকরণের সপাক নিবেদন কবিতা। কথিত আছে, এক ব্যাধ মুনিবর বাল্মিকীর সম্মুখেই এক মিলনরত ক্রৌঞ্চযুগলের পুরুষ ক্রৌঞ্চটিকে শরবিদ্ধ করে। স্ত্রী ক্রৌঞ্চটি তখন প্রিয় হারিয়ে বিলাপ করতে থাকে এবং তা দেখে বেদনার্ত ও ক্রুদ্ধ বাল্মিকীর মুখ থেকে যে আপ্ত বাক্য নিসৃত হয় তাই-ই ভারতীয় সাহিত্যের আদি কবিতা হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত।
“মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমঃ।
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।।”
উপরের বক্তব্য পেশ করার কারণে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, কবিতা সুখানুভূতির বহিঃপ্রকাশ নয়; বরং, বেদনার আঁচে রান্না হয় কবিতার নানাবিধ পদ।
 
সাহিত্য এমন এক বিশেষ শিল্পমাধ্যম— যেখানে বাস্তবতা ও কল্পনার সহাবস্থান পরিদৃশ্যমান। সময়ের অন্যতম অগ্রগামী কবি শিশির রাজন, যার মননে ও অভিজ্ঞানে কবিতার দৃপ্ত বসবাস। কার্যত, নাগরিক জীবনের যাপিত সময় তাঁর কবিতায় ফিরে ফিরে এসেছে। কবির সদ্যজাত শিল্পসন্তান ‘ব্যাকড্রপে নগরধ্যান’ (২০২২)।
 
ভাবনার অভিনবত্ব, শব্দবিন্যাসের মুন্সিয়ানা ও অন্তঃবাস্তবতার সুসংহত মিশেল ঘটেছে ‘ব্যাকড্রপে নগরধ্যান’-এর কাব্যশরীরে। কবির শহুরে জীবনের অযাচিত বেদনাবোধ গীতল চলনেও গুমরে ওঠে। চলতি জীবনে না চাইতেই কত জনের নাথে ঘটে যায় দেহজ স্পর্শ; মনে হয় ‘জনসমুদ্রে’ ভেসে আছি— তবে প্রকৃত প্রস্তাবে, ‘একসাথে নয়, আসলে যে একা’— একাকিত্বের আচারে যখন আমরা মোহগ্রস্ত, কবি শিশির রাজন তখন করেন গঙ্গা জলে গঙ্গা পুজো। চোখে আঙুল দিয়ে দেখান:
“বৃষ্টি ঝরে হেমন্তের শীতে! নগরজুড়ে ভাব কীর্তন কোথাও মানুষ
নেই; ঘরে ফিরে গেছে উষ্ণতায়…”
(‘একা; নৈঃশব্দ’)
 
আমাদের দিনাগত সময় বড্ড নির্মম, বড্ড বীভৎস— শোক, তাপ, ব্যাধি, বেদনা, মৃত্যুপুরীর শর্ট সিলেবাস। আশাবাদী কবি শত হতাশার মধ্য দিয়েও নতুন সূর্যের জন্য অপেক্ষ্যমাণ। ‘আশ্রম’-এ কবি খুঁজে ফেরেন শান্তির জল। সত্যবাক কবি উচ্চারণ করেন শান্তির শ্লোক:
“মাটির নরমে অহিংস ফসলের সবুজ
আছে বেঁচে থাকার প্রেসক্রিপশন
 
আত্মার গোলাপে প্রেম চিরঞ্জীব
মুগ্ধ-আশ্রমে ময়ূর-যাত্রা; ভালোবাসার অঝোর-বৃষ্টি।”
(‘আশ্রম’)
 
কবিতা ও বক্তব্যের সহজতর পার্থক্য হলো রহস্যময়তায়। কবিতায় থাকে রহস্যময় বক্তব্যের উপস্থাপনা। চলতি শব্দের অপরিচিতকরণের মধ্য দিয়ে কবি কবিতায় শব্দের বিন্যাস ঘটান। ‘আশ্রম’ কবিতার ‘অহিংস’, ‘সবুজ’ কিংবা ‘প্রেসক্রিপশন’ অতিপরিচিত শব্দ হলেও কবি শিশির রাজন চিত্তাকর্ষক কাব্যদ্যোতনা সৃষ্টির লক্ষ্যে শব্দগুলোর বিচিত্রমাত্রিক ব্যবহার করেছেন। ভাব-ভাষা ও কাব্যিক চমৎকারিত্বে কবিতাটি অনন্য মাত্রায় পোঁছেছে।
 
‘হরফ’ কবিতায় কবি দেখেন এবং দেখান মুখোশাবৃত সমাজ, সভ্যতা— ‘মুখোশের চাকুতে গোলাপি হরফ’। সুশীল(!) সভ্যতার আগ্রাসনে মানুষ বিভাজিত হচ্ছি ক্রমাগত— কালো-সাদা, ধনী-গরীব, শোষক-শোষিতের মতো প্রভূত দ্বন্দ্ব সমাজবদ্ধ পদের ভীড়েও উদীয়মান তারকা শব্দবন্ধরূপে জাগ্রত অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে ‘সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু’। কবি ‘শকুন’ কবিতায় স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বাস করতে পারছেন না নিজের রাষ্ট্রকে।
“রাষ্ট্র আমার কাছে হন্তারক
মাটির সাথে, তার গন্ধের সাথে
প্রতারণা করেছে বারংবার
যন্ত্রের আচারণে হত্যা করে মানুষ।”
(‘শকুন)
কবি ধিক্কার জানিয়েছেন ‘সংখ্যালঘু’ বর্ণ-বিন্যাসকে। মানুষের মাঝে ভেদারেখারূপে দাঁড়িয়ে রয়েছে এ শব্দটি।
 
এরপরে কবি ক্রমান্বয়ে সাজিয়েছেন ‘নগরধ্যান’ শীর্ষক সিরিজ কবিতা। পরপর ১৪টি সিরিজ কবিতার সমাবেশ কাব্যে যোগ করেছে ভিন্নমাত্রা। সিরিজবদ্ধ কবিতাবলীতে কবি নগরের পুঁথি পাঠ করতে করতে বারংবার ফিরে যান গ্রামের অন্দরে; আশাভঙ্গের অযাচিত খেলায় গ্রামের আঁচলে খুঁজে ফেরেন রাত্রির আশ্রয়। গ্রামীণ ও শহুরে চাবিশব্দের সমন্বিত এবং যথার্থ ব্যবহার যে কবিতাগুলোর কাব্যিক শ্রী বৃদ্ধি করেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
“ডুবুরির মতো হন্যে হয়ে খুঁজি মগরার পলল। বেলুন পৃথিবীতে
একাই; শহরের বুক! সর্পিল নদী।
বটপাতার চিঠি— বিরহী বাউল।
… … … …
নগর দেয়ালে লিখা থাক— পুনশ্চ মন।
আত্মার মিছিল; সরল বায়োস্কোপ!”
(নগরধ্যান-৪)
 
কাজী নজরুল ইসলাম একদা বলেছিলেন— ‘আমি যে কবি, আমার আত্মা যে সত্যদ্রষ্টা ঋষির আত্মা।’ প্রকৃত প্রস্তাবে, কবি মাত্রেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে উক্ত বক্তব্যের পারম্পর্যতা স্বীকার করবেন। ‘জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা’— আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর বক্তব্যও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। কবি শিশির রাজনের কবিতায় বাঙ্ময় হয়ে ওঠে ‘সত্যদ্রষ্টা ঋষির আত্মা’র প্রতিধ্বনি।
“কচ্ছপ গতিতে হাঁটে রাষ্ট্র, যেমন হাটে পিঁপড়ার দল
মানুষের শূন্য মিছিলে করাত কলের শব্দ।
হৃদপিণ্ডের দু’ভাগে গণিকারা মরে যায়
অথচ রাতের স্নান শেষে বর্ষজীবী হয়ে ওঠে পুরুষের আয়ু!”
(‘নগরধ্যান-৫’)
‘নগরধ্যান-৫’ শীর্ষক কবিতায় কবি নগ্ন বাস্তবতাকর কাব্যিক সুষমায় সিক্ত করেছেন। নগরধ্যান সিরিজের প্রতিটি কবিতায় কবি পাঠককে অবগাহন করান চেনা নদীর অচেনা স্রোতে।
 
‘নগরধ্যান-১৪’ কবিতায় কবি অবক্ষয়, যুগযন্ত্রণা, চেতনা বিশ্বাসের মূল্য হ্রাস প্রভৃতির নেতিভাবনাকে স্মরণে রেখেও শেষ পর্যন্ত আশাবাদের জয়ধ্বজা উত্তলিত করেন। সবুজ আগামীর স্বপ্ন দেখেন। ‘তবুও তো পেঁচা জাগে’— বিবেচনায় রেখে কবি নতুন সকালের প্রত্যাশা করেন।
“মরিচিকায় অস্পষ্ট ভাবের দর্শন! নদীর করতলে
যীশুর তপস্যায় পৃথিবী আবার শুদ্ধ হবে।”
(‘নগরধ্যান-১৪’)
 
‘ব্যাকড্রপে নগরধ্যান’ কাব্যটি যে কোনো মননশীল পাঠককে এক অভিনব জার্নির ভেতর দিয়ে নিয়ে যায়। বিচিত্রমাত্রিক কাব্যিক বয়ানে কবি পাঠকের হৃদয়ে চিন্তার এলার্ম বাজতে সক্ষম হয়েছেন এবং দাঁড় করিছেন কিছু জিজ্ঞাসা চিহ্নের মুখোমুখি।
 
 
অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২২ । স্বদেশ শৈলী স্টল-১১০ । প্রচ্ছদ-মিজান স্বপন । আলোকচিত্রী-মেসবাহ্ সুমন।
 
লেখকঃ সিদ্ধার্থ অভিজিত,কবি।
 
 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>