| 11 অক্টোবর 2024
Categories
ইতিহাস

প্রাচীন ভারতীয় ভাষাচিন্তার ইতিহাস । সৌভিক ঘোষাল

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

প্রাচীন ভারতের ভাষাচিন্তার কথা উঠলেই যাঁর নাম সবার প্রথমে মাথায় আসে তিনি হলেন পাণিনি। তাঁর সময়কালটি নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে তাঁর লেখা অষ্টাধ্যায়ী সেকালে যেমন প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছিল, তেমনি একালেও বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষায় অনুবাদের মধ্যে দিয়ে আন্তর্জাতিক ভাষাচর্চায় তা প্রভাবশালী ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পাণিনির আগেই শব্দ উৎস সন্ধান করে যাস্ক লিখেছিলেন তাঁর নিরুক্ত। অন্যান্য নিরুক্তকারদের রচনা আমরা পাই নি। পাণিনির পরে ভারতীয় ব্যাকরণ চর্চায় যে দুই বিখ্যাত ভাষাচিন্তকের নাম আমরা পাই তাঁরা হলেন খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর কাত্যায়ন এবং খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের পতঞ্জলি।

পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীতে যে পরিণত ব্যাকরণচিন্তার প্রকাশ আমরা দেখি সেখান থেকে সহজেই বোঝা যায় এর আগে অনেকদিন ধরেই ভারতে ব্যাকরণ চর্চার ধারাটি বিকশিত হয়ে উঠছিল। বস্তুতপক্ষে ঋগ্বেদের মধ্যেই ভাষাচিন্তার বেশ কিছু নিদর্শন আমরা পাই।

ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের ১৬৪ নং সূক্তের ৪৫ নং ঋক্‌টি আমাদের জানিয়েছে – “বাক্ চারি প্রকার। মেধাবী ঋত্বিকেরা তাহা জানেন। উহার মধ্যে তিনটি গুহায় নিহত, প্রকাশিত হয় না। চতুর্থ প্রকার বাক মনুষ্যেরা কহিয়া থাকেন।” আর দশম মণ্ডলের ৭১ নং সূক্তের ৪ নং ঋক্‌টি আমাদের জানাচ্ছে – “কেহ কেহ কথা দেখিয়াও কথার ভাবার্থ গ্রহণ করিতে পারে না, কেহ শুনিয়াও শুনে না। যেমন প্রেম পরিপূর্ণ সুন্দর পরিচ্ছদধারিণী ভার্যা আপন স্বামীর কাছেই কেবল নিজ দেহ প্রকাশ করেন, তদ্রূপ বাগদেবী কোন কোন ব্যক্তির নিকট প্রকাশিত হয়েন।” ঋগ্বেদে ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা এরকম ভাষাচিন্তার পাশাপাশি আমরা পাই দশম মণ্ডলেরই ১২৫ নং সূক্তটিকে, যার আটটি ঋকের সবকটিকেই বলা হয়েছে বাগদেবীর উক্তি।

বেদ ছাড়াও ব্রাহ্মণ, আরণ্যক বা উপনিষদে ভাষাচিন্তার বেশ কিছু ছড়ানো ছেটানো নিদর্শন আছে। তবে বেদাঙ্গ রচনার সময় থেকেই আমরা প্রকৃত অর্থে ভাষা বিশ্লেষণের নিদর্শনগুলি পেতে শুরু করি। ছটি বেদাঙ্গর মধ্যে কল্প ও জ্যোতিষ ছাড়া বাকি চারটিই – শিক্ষা, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ – ভাষা নিয়ে আলোচনা করেছে। বেদাঙ্গের ভাষা আলোচনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল বেদের ভাষাকে অবিকৃত রাখার আগ্রহ। সেইসময়ে কালের নিয়মে বৈদিক শব্দগুলির উচ্চারণ লোকমুখে বদলে গেছে ও প্রাকৃত ভাষার জন্ম হয়েছে। অন্যদিকে বেদ তখন ধর্মগ্রন্থের পবিত্র মর্যাদায় অভিষিক্ত। তার ভাষাকে সঠিকভাবে বোঝা, সংরক্ষণ করার আগ্রহ প্রাচীন ভারতীয় ভাষাচিন্তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। ভাষাতাত্ত্বিক তারাপুরওয়ালা মনে করেছেন বদলে যাওয়া লোকভাষার আমলে বৈদিক স্তোত্রগুলিকে পদ হিসেবে পড়ার সময়েই দরকার পড়েছিল প্রতিটি পদকে আলাদাভাবে বোঝা এবং তার উপাদানগুলিকে বিশ্লেষণ করা। এই কাজটা করতে গিয়েই দরকার পড়ে ধ্বনিতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, সমাস বিশ্লেষণ ইত্যাদির। এই যে বিশ্লেষণ করা অর্থে ব্যাকৃত করা, এখান থেকেই ব্যাকরণ (বি + আ + কৃ + অনট্‌) শব্দের প্রচলন হয়। ভাষাতাত্ত্বিক ডঃ রামেশ্বর শ মনে করেছেন, “বৈদিক যুগেই ব্রাহ্মণ গ্রন্থাবলীতে ব্যাকরণেরও মূল ধারণা গড়ে উঠেছিল।” তাঁর মতে পাশ্চাত্যে যাকে সাংস্কৃতিক ভাষাতত্ত্ব বা ফিললজি বলা হয়, তার সূত্রপাত ব্রাহ্মণের মধ্যে হয়ে গিয়েছিল। বৈদিক সংহিতার ভাষা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সেখানে ধ্বনির উচ্চারণ, সন্ধির বিধান, পদ বিভাগ, বিভক্তি, বচন ও ক্রিয়ার কাল সম্পর্কে কিছু কিছু আলোচনা করা হয়েছে। তবে ধারাবাহিক, সুনির্দিষ্ট ও বিস্তারিত ভাষাচর্চার সূত্রপাত যে বেদাঙ্গর বিভিন্ন শাখাগুলিতেই হয়েছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

শিক্ষা ও প্রাতিশাখ্য গ্রন্থাবলিতে ধ্বনিতত্ত্বের আলোচনা –

দুরূহ শব্দবিশ্লেষণের তাগিদ থেকে ধ্বনিপরিবর্তনের বিভিন্ন সূত্রের কথা প্রাচীন ভারতীয় ব্যাকরণবিদদের ভাবতে হয়েছিল। ধ্বনির আগম, লোপ, বিপর্যয়, স্বরের গুণ, বৃদ্ধি, অন্তঃস্থ ধ্বনির স্বরায়ন ইত্যাদি নিয়ে তাঁরা গভীরভাবে ভেবেছেন ও এই সংক্রান্ত নানা সূত্র আবিষ্কার করেছেন। সরাসরি ধাতু চিনতে না পারলেও ধ্বনিপরিবর্তনের সূত্রগুলিকে মাথায় রেখে শব্দার্থ দেখে ধ্বনিসাম্যের সাহায্যে শব্দের নির্বচন বা উৎস সন্ধানের পরামর্শ দিয়েছেন নিরুক্তকার যাস্ক।

ধ্বনি সংক্রান্ত আলোচনার জন্য বেদাঙ্গর একটি স্বতন্ত্র শাখাই গড়ে উঠেছিল। সেটি হল শিক্ষা। অধ্যাপক সিদ্ধেশ্বর বর্মা অন্তত ৬৫ টি শিক্ষাগ্রন্থের অস্তিত্বের কথা বলেছেন। তার মধ্যে আপিশল শিক্ষা, পাণিনীয় শিক্ষা, নারদ শিক্ষা, যাজ্ঞবল্ক্য শিক্ষা, সর্বসম্মত শিক্ষা ইত্যাদি প্রসিদ্ধ।

মূল শিক্ষাগ্রন্থগুলির অধিকাংশই পরবর্তীকালে বিলুপ্ত হয়ে যায়, পরবর্তীকালের রচনা কিছু শিক্ষাগ্রন্থ পাওয়া যায়। শিক্ষার পরিপূরকরূপে যে গ্রন্থমালা রচিত হয় সেগুলি হল প্রাতিশাখ্য বা পার্ষদ গ্রন্থমালা। বেদের প্রতিটি শাখার পৃথক পৃথক প্রাতিশাখ্য ছিল। প্রতি শাখা থেকেই প্রাতিশাখ্য কথাটির সৃষ্টি।

বিভিন্ন প্রাতিশাখ্যতে বৈদিক শব্দের উচ্চারণ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। মনে করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ র মধ্যে প্রাচীন শিক্ষাগ্রন্থগুলি রচিত হয়েছিল। আর খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৫০ অব্দের মধ্যে প্রাতিশাখ্যগুলি রচিত হয়েছিল। ঋগ্বেদের ঋক্‌ প্রাতিশাখ্য, সাম বেদের সাম প্রাতিশাখ্য, কৃষ্ণ যজুর্বেদের তৈত্তিরীয় প্রাতিশাখ্য, শুক্ল যজুর্বেদের বাজসনেয়ি প্রাতিশাখ্য, অথর্ব বেদের অথর্ব প্রাতিশাখ্য ধ্বনিসংক্রান্ত আলোচনায় বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ঋক্‌ প্রাতিশাখ্যের রচয়িতা হিসেবে বলা হয় শৌণকের কথা, বাজসনেয়ি প্রাতিশাখ্যর রচনাকার হিসেবে কাত্যায়নের নাম আমরা পাই। প্রাতিশাখ্য ছন্দ নিয়েও আলোচনা করেছে। অবশ্য ছন্দ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য বেদাঙ্গর মধ্যে একটি আলাদা শাখাই গড়ে ওঠে। ব্যাকরণ গ্রন্থগুলি বৈদিক ভাষা ছাড়া কখনো কখনো লৌকিক ভাষা নিয়েও কথা বলেছে। প্রাতিশাখ্য গ্রন্থগুলি কিন্তু শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট বেদের আলোচনাতেই নিবিষ্ট থেকেছে। প্রাতিশাখ্যগুলি কেবল কোনও একটি নির্দিষ্ট বেদ বা তার শাখার ধ্বনিতত্ত্ব রূপতত্ত্ব নিয়েই কথা বলেছে। এ কারণেই এক একটি প্রাতিশাখ্য অনেক সময় ভাষা সংক্রান্ত একেকরকম সূত্র হাজির করেছে। যেমন ঋক্‌ প্রাতিশাখ্যে আটটি সমানাক্ষরের কথা রয়েছে, কিন্তু তৈত্তিরীয় প্রাতিশাখ্যে সমানাক্ষর হ্রস্ব, দীর্ঘ ও প্লুতস্বরের কথা রয়েছে।

শিক্ষা গ্রন্থগুলিতে প্রথমে বৈদিক ধ্বনির উচ্চারণ সম্বন্ধে শিক্ষা দেওয়া হত, পরে ধ্বনিতত্ত্বের মূল নীতি আলোচনা করা হয়। প্রাতিশাখ্য গ্রন্থগুলিতে এই মূলনীতি প্রয়োগ করে বেদের ধ্বনিগুলির বিচার করা হয়। এভাবে শিক্ষা গ্রন্থগুলিতে সাধারণ ধ্বনিবিজ্ঞান ও প্রাতিশাখ্যতে প্রয়োগমূলক ধ্বনিতত্ত্বের বিকাশ ঘটে। অবশ্য বিভিন্ন প্রাতিশাখ্যতে এর পাশাপাশি সাধারণ ধ্বনিবিজ্ঞান এবং ব্যাকরণের কিছু আলোচনাও রয়েছে।

ঋগ্বেদের মূল শিক্ষাগ্রন্থটি এখন লুপ্ত। পরবর্তীকালে রচিত ‘পাণিনীয় শিক্ষা’কেই এখন ঋগ্বেদের শিক্ষাগ্রন্থ হিসেবে ধরা হয়। পাণিনির নাম এতে যুক্ত থাকলেও এটি সম্ভবত পাণিনির নিজের লেখা নয়, পাণিনীয় ধারার ব্যাকরণবিদ পিঙ্গলের রচনা। সামবেদের শিক্ষা গ্রন্থের নাম ‘নারদীয় শিক্ষা’, শুক্ল যজুর্বেদের শিক্ষা গ্রন্থের নাম ‘যাজ্ঞবল্ক্য শিক্ষা’ এবং অথর্ববেদের শিক্ষা গ্রন্থের নাম ‘মাণ্ডূকী শিক্ষা’।

পাণিনীয় শিক্ষায় ধ্বনিতত্ত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। উচ্চারণস্থান হিসেবে রয়েছে আটটি স্থানের কথা। উর, কণ্ঠ, শির, জিহ্বামূল, দন্ত, নাসিকা, ওষ্ঠ, তালু। ব্যাসশিক্ষায় শির বা জিহ্বামূলের উল্লেখ নেই। তবে মুখগহ্বরের মধ্যে আদি, মধ্য ও অন্ত – এই তিনটি ভাগ করা হয়েছে। আপিশল শিক্ষা উচ্চারণের কাল বা মাত্রা সম্পর্কে আলোচনা করেছে এবং হ্রস্ব, দীর্ঘ, প্লুত ভেদে যথাক্রমে এক, দুই এবং তিন মাত্রার কথা বলেছে। ব্যঞ্জনে বলেছে অর্ধমাত্রার কথা। উদাত্ত, অনুদাত্ত, স্বরিত – তিন ধরনের স্বরের কথাও বলেছে আপিশল শিক্ষা। পাণিনীয় শিক্ষায় পাখির ডাককেও মাত্রা আলোচনায় টেনে এনে বলা হয়েছে – নীলকণ্ঠ পাখির স্বরে একমাত্রা, কাকের স্বরে দুই মাত্রা, ময়ূরের স্বরে তিনমাত্রা থাকে। নকুলের স্বরে অর্ধমাত্রা বোঝা যায়।

বাহ্যপ্রযত্নের আলোচনায় পাণিনীয় শিক্ষা বলেছে বিবৃত, সংবৃত, শাস, নাদ এই চারটির কথা। তৈত্তিরীয় প্রাতিশাখ্য; বলেছে শ্বাস, নাদ, হকার – এই তিনটির কথা। আভ্যন্তর প্রযত্ন ঋক্‌ প্রাতিশাখ্যের মতে তিনটি – স্পৃষ্ট, অস্পৃষ্ট, দুস্পৃষ্ট। আপিশল শিক্ষা বলেছে আভ্যন্তর প্রযত্ন চারপ্রকার – স্পৃষ্ট, ঈষৎস্পৃষ্ট, বিবৃত, ঈষদ্‌বিবৃত। পাণিনীয় শিক্ষায় এই চারটির নাম – অস্পৃষ্ট (স্বরধ্বনি), ঈষৎস্পৃষ্ট (অন্তঃস্থ ধ্বনি য, র, ল, ব) , নেমস্পৃষ্ট (উষ্মধ্বনি শ, ষ, স, হ) ও বাকি বর্ণের জন্য স্পৃষ্ট।

নিরুক্ত ও শব্দকোষের আলোচনা –

বেদপাঠের জন্য যখন বেদাঙ্গের বিভিন্ন ধারা গড়ে উঠল, তখন নিরুক্ত, ব্যাকরণ ইত্যাদি ধারা ভাষাচিন্তা নিয়েই নিজেদের সুনির্দিষ্টভাবে নিয়োজিত করল। নিরুক্ত মূলত মনোনিবেশ করল শব্দের উৎস নিয়ে। যাস্কের নিরুক্তই কেবল আমাদের একালে এসে পৌঁছেছে। এটি কোন সময়ের রচনা তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকের রচনা বলে অনেকে অনুমান করেন, অনেকের মতে তা আরো পরবর্তীকালের। অপ্রচলিত দুর্বোধ্য বৈদিক শব্দের একটি তালিকা হিসেবে এই সময়ে ‘নিঘণ্টু’ নামের একটি গ্রন্থও রচিত হয়েছিল। প্রাচীন টীকাকারদের অনেকে এটি অজ্ঞাতনামা লেখকের রচনা বলেছেন। মহাভারতের সূত্র অনুসারে প্রজাপতি কাশ্যপ নিঘণ্টুর রচয়িতা। একালের পণ্ডিত ভগবৎ দত্ত ও স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী মনে করেছেন নিরুক্তকার যাস্কই নিঘণ্টুরও রচনাকার। প্রধানত নিঘণ্টুর শব্দতালিকা অনুসরণ করেই যাস্ক তাঁর নিরুক্ত রচনা করেছিলেন। নিঘণ্টুর শব্দগুলি পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত এবং যাস্কের নিরুক্তও তাই। নিরুক্তের প্রথম তিনটি অধ্যায়ে বৈদিক শব্দের প্রতিশব্দ দেওয়া হয়েছে। চতুর্থ অধ্যায়ে রয়েছে দুরূহ শব্দাবলীর তালিকা। পঞ্চম অধ্যায়ে রয়েছে বৈদিক দেবদেবীদের তালিকা। যাস্কের নিরুক্তে শুধু শব্দের ব্যুৎপত্তিই দেওয়া হয় নি, তাদের অর্থও দেওয়া হয়েছে। এমনকি একালের প্রয়োগ অভিধানের মতো বেদের প্রাসঙ্গিক উক্তিও সংকলন করা হয়েছে।

বৈদিক শব্দাবলীকে সাজিয়ে তাদের ব্যুৎপত্তি রচনার যে প্রয়াস নিরুক্ততে দেখা যায়, তাতেই আধুনিক অভিধানের পূর্বসূত্র রয়েছে। বেদাঙ্গর যুগের পরে ক্লাসিক্যাল সংস্কৃতের যুগে এসে সংস্কৃতে অনেক কোষগ্রন্থ রচিত হয়েছিল। এই কোষগ্রন্থগুলির কয়েকটি লুপ্ত হয়ে গেছে। অন্য উৎস থেকে তাদের কথা জানা যায়। যেমন কাত্যায়নের নামমালা, বাচস্পতির শব্দার্ণব, বিক্রমাদিত্যের সংসারাবর্ত। কোষগ্রন্থগুলির মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার অন্যতম অমর সিংহের লেখা ‘নামলিঙ্গানুশাসন’ যেটি অমরকোষ নামে জনপ্রিয়। অমরকোষের অনেকগুলি টীকা পরবর্তীকালে রচিত হয়েছিল। ক্ষীরস্বামী, সর্বানন্দ, ভানুজি, মহেশ্বর ও রায় মুকুটমণির টীকা বিখ্যাত। এগুলির মধ্যে ১১৫৯ খ্রিস্টাব্দে রচিত বন্দ্যঘটী সর্বানন্দের টীকাটি বাংলায় বিশেষ জনপ্রিয় হয়েছিল। যাস্ক ও অমর সিংহের উত্তরসূরিরা বিভিন্ন সময়ে অনেক কোষগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এর মধ্যে খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীতে হলায়ুধ রচিত অভিধান রত্নমালা, একাদশ শতাব্দীতে যাদব রচিত বৈজয়ন্তী, দ্বাদশ শতাব্দীতে জৈন পণ্ডিত হেমচন্দ্র রচিত অভিধান চিন্তামণি ও অনেকার্থ সংগ্রহ, জৈন ধনঞ্জয় রচিত নামমালা, মহেশ্বর রচিত বিশ্বপ্রকাশ, চতুর্দশ শতাব্দীতে মেদিনীকার রচিত অনেকার্থ শব্দকোষ ইত্যাদি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এইসব কোষগ্রন্থের অধিকাংশ ছিল মূলত সংস্কৃত ভাষার অভিধান। জৈন পণ্ডিত হেমচন্দ্রের দেশী শব্দের অভিধান ‘দেশী নামমালা’ এর মধ্যে অভিনব ও ব্যতিক্রমী।

নিরুক্ত এবং ব্যাকরণ আলাদা ধারা হলেও সম্পর্করহিত ছিল না। যাস্কের নিরুক্ততে নাম বা বিশেষ্য, সর্বনাম, আখ্যাত বা ক্রিয়া, উপসর্গ, নিপাত ইত্যাদির উল্লেখ রয়েছে। অন্যদিকে ব্যাকরণবিদেরাও নিরুক্তকারদের পাশাপাশি শব্দের উৎস নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন এবং অনেক সময়েই তাদের মধ্যে তীব্র মতান্তর হয়েছে। এই মতান্তরের একটি বিশেষ দিক শব্দের উৎস নিয়ে ক্রিয়াপদ ও কাজের ভূমিকাকে দেখা। যাবতীয় নামশব্দকে শাকটায়ন ক্রিয়ামূলক ও ধাতুনিষ্পন্ন বলে মনে করেছেন। তাঁর অনুসারী যাস্ক ব্যুৎপত্তি নির্ণয়ের মাধ্যমে একে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। পাণিনি পূর্ববর্তীকালের ব্যাকরণবিদ গার্গ্য এটি মানতে চান নি। তিনি দু ধরনের শব্দের কথা ভেবেছেন – সংবিজ্ঞাত শব্দ ও অসংবিজ্ঞাত শব্দ। সংবিজ্ঞাত শব্দগুলির ক্ষেত্রে ক্রিয়াবাচক ধাতুতে প্রত্যয়যোগ মানতে তিনি রাজী হয়েছেন। সংবিজ্ঞাত শব্দকে পাণিনি বলেছেন ব্যুৎপন্ন প্রাতিপদিক অর্থাৎ যাদের ব্যুৎপত্তি নির্ণয় করা যায়। কিন্তু এসব শব্দ ছাড়াও ব্যুৎপত্তি নির্ণয় সম্ভব নয়, এমন অনেক নামশব্দ রয়েছে। এগুলিকে অব্যুৎপন্ন প্রাতিপদিক বা গার্গ্যর পরিভাষায় অসংবিজ্ঞাত শব্দ বলে। এগুলির ক্রিয়াগত উৎস খুঁজতে যাওয়া গার্গ্যের মতে অর্থহীন। এগুলিকে তিনি অবিভাজ্য বলেছেন। পাণিনি অবশ্য সমস্ত শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক উৎস সন্ধানের তত্ত্বেই আস্থাশীল ছিলেন। এটা তাঁর গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ের উণাদয়ো বহুলম্‌ ও পরবর্তী সূত্রগুলি থেকে বোঝা যায়। শাকটায়ন ও তাঁর অনুসারী নিরুক্ত সমস্ত শব্দের উৎসতেই ক্রিয়াকে খুঁজতে গেছেন এবং যাবতীয় শব্দকে তিনভাগে ভাগ করেছেন – ১) প্রত্যক্ষক্রিয় ২) পরোক্ষক্রিয় ও ৩) প্রকল্প্যক্রিয়। কারক শব্দের উৎস হিসেবে কৃ বা গমন শব্দে উৎস হিসেবে গম্‌ কে সহজেই মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু হংস শব্দের উৎস হিসেবে ‘হম্‌ শব্দকারী যে’ – এই ব্যাখ্যা কষ্টকল্পিত মনে হতেই পারে। হাঁসকে এরকম হম্‌ শব্দ করতে কেই বা শুনেছে! গার্গ্যর আপত্তির পেছনে যুক্তি আছে তা অস্বীকার করা যায় না।

ছন্দ সংক্রান্ত আলোচনা –

বেদাঙ্গের একটি ধারা ছন্দ নিয়ে আলোচনা করেছে। ব্রাহ্মণ গ্রন্থাবলীতে এবং ঋক্‌ প্রাতিশাখ্যে ছন্দ নিয়ে কথাবার্তা থাকলেও তা সুবিন্যস্ত বা পূর্ণাঙ্গ নয়। পিঙ্গলের ছন্দঃসূত্রই ছন্দ সম্পর্কে প্রথম পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করে।  আট অধ্যায় বিশিষ্ট পিঙ্গলছন্দের প্রথম তিনটি অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে বেদের ছন্দ নিয়ে। পরবর্তী অংশে বিভিন্ন লৌকিক ছন্দ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। গায়ত্রী, উষ্ণিক, অনুষ্টুপ, বৃহতী, পুংক্তি, ত্রিষ্টুপ, জগতী – বেদের প্রধান এই সাতটি ছন্দ প্রসঙ্গে এখানে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। তবে বৈদিক ছন্দের থেকে ক্লাসিক্যাল সংস্কৃতের ছন্দ নিয়েই এখানে আলোচনা বেশি। এ থেকে বোঝা যায় এটি বৈদিক যুগের পরবর্তী কালের রচনা।

পরবর্তীকালে বিভিন্ন ছন্দ সংক্রান্ত আলোচনায় প্রধান সাতটি বৈদিক ছন্দ ছাড়াও অতিজগতী, শক্করী, অতিশক্করী, অত্যষ্টি, ধৃতি, অতিধৃতি, কৃতি, প্রকৃতি, আকৃতি, বিকৃতি, সংকৃতি, অভিকৃতি, উৎকৃতি ইত্যাদি ছন্দ নিয়ে আলোচনা দেখা যায়। ছন্দের পাশাপাশি প্রাচীন ভারতীয় ভাষাচিন্তকেরা বুঝেছিলেন অনুপ্রাস, যমক, শেষ, বক্রোক্তি ইত্যাদি শব্দালংকারগুলিও ছন্দের মতোই ধ্বনিসুষমা তৈরি করে। সে বিষয়েও বিস্তারিত আলোচনা তাঁরা করেছেন। প্রাকৃত পৈঙ্গল বইতে আলোচিত হয়েছে প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষার ছন্দ। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে সয়ম্ভূ রচিত সয়ম্ভূছন্দ বইতে প্রাকৃত কবিতার বিভিন্ন ধরনের ছন্দোগত নিরীক্ষা নিয়ে মূল্যবান আলোচনা রয়েছে। এই বইতে সয়ম্ভূ তাঁর পূর্বসূরি পঞ্চাশ জন ছন্দতাত্ত্বিকের কথা বলেছেন, যা ছন্দ সংক্রান্ত চর্চার বলিষ্ঠ ইতিহাসের প্রমাণ। দ্বাদশ শতাব্দীতে জৈন পণ্ডিত হেমচন্দ্র সংকলিত ছন্দ অনুশাসন বইতে প্রাকৃত ও অপভ্রংশ কবিতার ছন্দ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রয়েছে।

পরবর্তীকালের সংস্কৃত ছন্দ বিষয়ক গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল একাদশ শতকে ক্ষেমেন্দ্র রচিত সুবৃত্ততিলক, পঞ্চদশ শতকে কেদারভট্ট রচিত বৃত্তরত্নাকর, একই বৃত্তরত্নাকার নামে নারায়ণ নামেও একজন ছন্দ সম্পর্কিত বই লিখেছিলেন। তবে ছন্দ সংক্রান্ত সবচেয়ে জনপ্রিয় গ্রন্থটি ছিল গঙ্গাদাস রচিত ছন্দমঞ্জরী।

ভারতীয় ব্যাকরণশাস্ত্রের ক্রমবিকাশ

প্রাক পাণিনি উত্তর পাণিনি বৈদিক ব্যাকরণ–

পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী সহ বিভিন্ন গ্রন্থে আমরা পাণিনি পূর্ববর্তী বেশ কয়েকজন ব্যাকরণবিদের উল্লেখ পাই। তবে তাদের রচনাবলী সেভাবে আমাদের কাছে এসে পৌঁছয় নি। এনাদের মধ্যে আছেন ভাগুরি, কমন্দ, শাকটায়ন, সেনক, গালব, গার্গ্য, আপিশলি, কাশ্যপ, স্ফোটায়ন, বাজপ্যায়ন, কাশকৃৎস্ন প্রমুখ। এঁদের উত্তরাধিকার রয়েছে পাণিনি, কাত্যায়ন, পতঞ্জলির ভাষাচিন্তায়। তবে পতঞ্জলির পরে দীর্ঘদিন কোনও মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রবর্তনা দেখা যায় না। পরবর্তী ব্যাকরণচর্চাকারীরা মূলত পাণিনি বা পতঞ্জলির রচনারই টীকাভাষ্য লিখেছেন। ভাষার পরিবর্তনশীল চরিত্র সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসার পরিবর্তে ক্রমশ নৈয়ায়িক কূটতর্ক ও দার্শনিক তত্ত্বজিজ্ঞাসা প্রাধান্য পেয়েছে। এই প্রসঙ্গে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে রচিত ভর্তৃহরির বাক্যপদীয় গ্রন্থটির কথা ভাবা যায়। দার্শনিক তত্ত্বজিজ্ঞাসার আধিক্য এই ব্যাকরণচর্চায় স্পষ্ট। ন্যায়, বৈশেষিক ও মীমাংসা দর্শনের গ্রন্থরাজিতেও ভাষা সম্পর্কে যে আলোচনা রয়েছে, সেখানে নৈয়ায়িক সূক্ষ্মতা থাকলেও ভাষার প্রবাহ সম্পর্কে বিচার বিশ্লেষণ কম।

পাণিনি ও তাঁর অষ্টাধ্যায়ী –

পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীকে শুধু প্রাচীন ভারতীয় ভাষাচিন্তার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন নয়, মানব মনীষারই অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফসল বলে অনেকে মনে করেছেন। সেকালের ব্যাকরণচিন্তায় পাণিনি অনন্য তো বটেই, একালের শ্রেষ্ঠ ভাষাবিদ চমস্কিও তাঁর সবচেয়ে মৌলিক ভাষা তত্ত্ব “ ট্রান্সফরমেটিভ জেনারেটিভ গ্রামার” এর বীজ খুঁজে পেয়েছেন পাণিনির ব্যাকরণ চিন্তার মধ্যে।

পাণিনির আবির্ভাবকাল নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। ভাণ্ডারকরের মতে পাণিনি খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর মানুষ, সুনীতিকুমার মনে করেছেন খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর। ম্যাক্সমুলারের মতে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের মাঝামাঝি সময়ের। তাঁর আবির্ভাবকালের মতো স্থান বা ব্যক্তি পরিচয় সম্পর্কেও সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। পরবর্তীকালের সাহিত্যে তাঁকে শালাতুরীয় বলা হয়েছে বলে মনে করা হয় পাণিনির তক্ষশীলার শালাতুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছেন। কেউ কেউ শালাতুরকে লাহোরের কাছে অবস্থিত বলে মনে করেছেন, কেউ বা পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে।

পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী মোট আটটি অধ্যায়ে বিভক্ত, সে কারণেই গ্রন্থটির এরকম নামকরণ। প্রথম অধ্যায়ে রয়েছে কিছু সংজ্ঞা এবং পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে প্রদত্ত সূত্রগুলি ব্যাখ্যার নিয়মকানুন। দ্বিতীয় অধ্যায়ে পাণিনি আলোচনা করেছেন সমাস ও কারক বিভক্তি নিয়ে। তৃতীয় অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে কৃৎ প্রত্যয়। চতুর্থ ও পঞ্চম অধ্যায়ে তদ্ধিত প্রত্যয়। ষষ্ঠ ও সপ্তম অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে স্বরাঘাত ও ধ্বনিপরিবর্তন সহ ধ্বনিতত্ত্বের বিভিন্ন দিক। অষ্টম অধ্যায়ের প্রথম অংশে আছে স্বরাঘাতবিধি ও সন্ধির নিয়ম। অষ্টম অধ্যায়ের পরবর্তী তিন চতুর্থাংশ জুড়ে রয়েছে ব্যাকরণের বিভিন্ন প্রসঙ্গ এবং সেই প্রসঙ্গে পূর্বসূরি বৈয়াকরণদের বিভিন্ন মত নিয়েও তিনি আলোচনা করেছেন।

পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীর যে চেহারাটি এখন আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে তাতে মোট চার হাজার সূত্র আছে। এই চার হাজার সূত্রের মধ্যে আড়াই হাজার সূত্র পাণিনির ও বাকি দেড় হাজার হল কাত্যায়নের বার্তিক সূত্র। পাণিনির ব্যাকরণে সাত রকমের সূত্র আছে। ১) সংজ্ঞা ২) পরিভাষা ৩) বিধি ৪) নিয়ম ৫) অধিকার ৬) অতিদেশ ৭) অপবাদ। সূত্রগুলি অত্যন্ত সংক্ষেপে বলা এবং টীকা ভাষ্যর সাহায্য ছাড়া একালে তা বুঝে ওঠা সম্ভব নয়।

কাত্যায়ন ও পতঞ্জলির ব্যাকরণ –

পাণিনির প্রায় দুই শতাব্দী পরের খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের ব্যাকরণবিদ ছিলেন কাত্যায়ন। সেই সময় ভাষার প্রবাহ আরো বদলে গিয়েছিল এবং সেইজন্য কাত্যায়ন পাণিনির বেশ কিছু সূত্রকে সংশোধন করার প্রয়োজন মনে করেছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। কাত্যায়নের রচনার নাম বার্তিক। পাণিনির দেড় হাজার সূত্রকে তিনি সংশোধন করেছিলেন। বার্তিক ছাড়াও কাত্যায়ন এর নাম পাওয়া যায় বাজসনেয়ি প্রাতিশাখ্যর রচনাকার হিসেবে। এখানে শুক্ল যজুর্বেদের ভাষার ধ্বনি, বানান ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে। অনেকে মনে করেছেন কাত্যায়ন ছিলেন পাণিনি বিরোধী ব্যাকরণ ধারা ঐন্দ্র সম্প্রদায়ের মানুষ। স্থানগত দিক থেকেও ছিল ভিন্নতা। তিনি সম্ভবত ছিলেন দক্ষিণ ভারতের মানুষ।

কাত্যায়নের প্রায় এক শতাব্দী পরে সংস্কৃত ব্যাকরণের আর এক বিশিষ্ট লেখক পতঞ্জলির আবির্ভাব হয় খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে। পতঞ্জলির মহাভাষ্য কোনও মৌলিক রচনা নয়, পাণিনির ব্যাকরণের এক অসামান্য ভাষ্য। পাণিনির অনেক সূত্রকে কাত্যায়ন খণ্ডন করেছিলেন। পতঞ্জলি কাত্যায়নের সূত্রগুলিকে খণ্ডন করে আবার পাণিনির সূত্রগুলিকেই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। পাণিনির ব্যাকরণের মতোই পতঞ্জলির মহাভাষ্যও আটটি অধ্যায়ে বিভক্ত। পতঞ্জলির ব্যাকরণ রচনা শুধু বিশ্লেষণের দিক থেকে বিশিষ্ট নয়, রচনারীতির দিক থেকে সরস ও প্রাঞ্জল বলে বিশেষ জনপ্রিয় হয়েছিল।

সম্প্রদায় ভিত্তিক ব্যাকরণ –

পাণিনি, কাত্যায়ন, পতঞ্জলির বৈদিক ধারার বাইরে বৌদ্ধ, জৈন ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে ভাষাচিন্তা ও ব্যাকরণচর্চার ভিন্ন একটি ধারা বিকশিত হয়েছিল। খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে বৌদ্ধ চন্দ্রগোমী, জৈন জিনেন্দ্রর রচনা, সপ্তম শতকে কাতন্ত্র সম্প্রদায়ের সর্ববর্মার রচনা, নবম শতকে জৈন শাকটায়নের লেখা, একাদশ শতকে জৈন হেমচন্দ্রের রচনা, ত্রয়োদশ শতকে ব্যোপদেবের মুগ্ধবোধ এবং অনুভূতি স্বরূপাচার্যের রচনা, চতুর্দশ শতকে লেখা পদ্মনাভের রচনা এই জাতীয় ব্যাকরণচর্চার দৃষ্টান্ত। পঞ্চদশ শতকে রূপ গোস্বামী ও জীব গোস্বামী বৈষ্ণব ধর্মান্দোলনের সঙ্গে সংযুক্ত করে হরিনামামৃত ব্যাকরণ রচনা করেন।

পালি ব্যাকরণ –

পাণিনির সময় থেকে যখন সংস্কৃত ব্যাকরণগুলি রচিত হচ্ছে, তখন তার অন্যতম লক্ষ্য ছিল ভাষার বিকৃতিকে আটকানো। আমরা এখন যেভাবে ভাষার পরিবর্তনের স্বাভাবিকতাকে স্বীকার করে তার বৈশিষ্ট্যকে ভাষাচর্চায় স্বীকৃতি দিই, তখন বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখা হত। কিন্তু ভাষা তার স্বাভাবিক নিয়মেই বদলেছে এবং বৈদিক সংস্কৃতের উত্তরাধিকারী হিসেবে ব্যাকরণবিদ অনুশাসিত ক্লাসিক্যাল সংস্কৃত জন্ম নিলেও জনগণের মুখের ভাষায় পালি ও প্রাকৃতের অবিরাম প্রবাহ ছিল। পালি বৌদ্ধধর্মের সূত্রে ভারতে ও ভারতের বাইরে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং অনেকগুলি পালি ব্যাকরণ রচিত হয়। ওয়াস্কারে সুব্বুতি তাঁর নামমালার ভূমিকায় ৪৫ টি পালি ব্যাকরণের নাম ও পরিচয় উল্লেখ করেছেন। এগুলির মধ্যে বেশি বিখ্যাত ছিল কচ্চায়ন, মোগ্‌গল্লান ও সদ্দনীতির রচিত তিনটি ব্যাকরণ। বিধুশেখর শাস্ত্রী মহাশয়ের পালিপ্রকাশ গ্রন্থে পালি ব্যাকরণ সম্পর্কে মূল্যবান আলোচনা আছে। সেখানে তিনি জানিয়েছেন, “পালি ব্যাকরণসমূহ সমস্তই সংস্কৃতের আদর্শে রচিত। কচ্চায়ন ব্যাকরণের অনেক সূত্র কাতন্ত্র ব্যাকরণের সহিত অক্ষরানুপূর্বীতে একরূপ। আবার পাণিনি হইতে অনেক সূত্র গৃহীত হইয়াছে বলিয়াও বোধ হয়। কেহ বলিয়াছেন যে, কচ্চায়ন ও কাতন্ত্র উভয়েই ঐন্দ্র ব্যাকরণ হইতে সূত্র গ্রহণ করিয়াছেন। মোগ্‌গল্লান ব্যাকরণ ও চান্দ্র ব্যাকরণের সূত্র হুবহু একই, মোগ্‌গল্লানে কেবল পালির নিয়ম অনুসারে শব্দাদির যাহা পরিবর্তন সম্ভব, তদ্‌ভিন্ন ঐ সকল সূত্র আর কোনও ভেদ নাই।” (পালিপ্রকাশ, প্রবেশক, পৃষ্ঠা ৮৩ -৮৪)। পালি ব্যাকরণে সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুবর্তন থাকলেও সংস্কৃত ব্যাকরণ ক্রমশ যেমন তত্ত্বজিজ্ঞাসা ও দার্শনিক প্রশ্নে জটিল হয়ে পড়েছে, পালি ব্যাকরণ সেই পথে এগয় নি। সেখানে ভাষাশিক্ষার সহজতম পন্থা নির্ধারণের চেষ্টা দেখা যায়।

প্রাকৃত ব্যাকরণ –

সংস্কৃত ও পালি ব্যাকরণ ছাড়াও প্রাকৃত ব্যাকরণগুলি প্রাচীন ভারতীয় ভাষাচিন্তার আরেকটি বিশিষ্ট ধারা। প্রাকৃত ব্যাকরণ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য এই দুই আঞ্চলিক ভাষাগত বিভাজনের ওপর ভিত্তি করে দুটি আলাদা ধারায় রচিত হয়েছে। বররুচির ‘প্রাকৃত প্রকাশ’ প্রাচ্য ধারার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রচনা। পাশ্চাত্য ধারার প্রাকৃত ব্যাকরণের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বাল্মীকির প্রাকৃতসূত্র। প্রাচ্য প্রাকৃত শাখার অন্যান্য বিখ্যাত ব্যাকরণ গ্রন্থের মধ্যে আছে বসন্তরাজের প্রাকৃত সঞ্জীবনী, রামশর্মা তর্কবাগীশের প্রাকৃত কল্পতরু, লঙ্কেশরের প্রাকৃত কামধেনু, রাবণের প্রাকৃত লঙ্কেশ্বর, পুরুষোত্তমের প্রাকৃতানুশাসন, ক্রমদীশ্বরের সংক্ষিপ্তসার প্রাকৃত ব্যাকরণ, মার্কণ্ডেয় কবীন্দ্রের প্রাকৃত সর্বস্ব। পাশ্চাত্য প্রাকৃত শাখার বিখ্যাত গ্রন্থগুলির মধ্যে বাল্মীকির প্রাকৃত সূত্রের টীকাভাষ্য হিসেবে লেখা হয়েছিল ত্রিবিক্রমের প্রাকৃত ব্যাকরণ, লক্ষীধরের ষড়ভাষাচন্দ্রিকা, সিংহরাজের প্রাকৃত রূপাবতার, অপ্‌পয়দীক্ষিতের প্রাকৃত মণিদীপ, হেমচন্দ্রের সিদ্ধহৈমশব্দানুশাসন।

তামিল ব্যাকরণ –

আর্যভাষা সমূহের এই সব ব্যাকরণের বাইরে দ্রাবিড় ভাষাবংশের তামিল ভাষার ব্যাকরণও বেশ প্রাচীনকালেই রচিত হয়েছিল। প্রাচীনতম তামিল ব্যাকরণের নাম তোল্‌কাপ্পিয়ম। এটি খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় বা দ্বিতীয় শতকে রচিত হয়েছিল। মূলত ব্যাকরণগ্রন্থ হলেও এতে প্রচুর তামিল কবিতার নিদর্শনও রয়েছে। তোল্‌কাপ্পিয়ম গ্রন্থটি তিনটি বর্গে বিভক্ত, প্রতিটি বর্গে রয়েছে নয়টি করে অধ্যায় এবং প্রতিটি অধ্যায়ে রয়েছে অনেকগুলি সূত্র। বইটিতে সর্বমোট ১৬০০ সূত্র আছে। তোল্‌কাপ্পিয়মের প্রথম বর্গটির নাম এলুত্তিতিকারম্‌। এখানে ধ্বনিতত্ত্ব বিষয়ক ৪৮০ টি সূত্র রয়েছে। ধ্বনি, তাদের সংখ্যা, বিভাজন, উচ্চারণ, ধ্বনির উৎপত্তি ও সন্ধি নিয়ে এখানে আলোচনা করা হয়েছে। বইটির দ্বিতীয় বর্গের নাম চোল্লতিকারম্‌। ৪৬০ টি সূত্রে এখানে আলোচিত হয়েছে বাক্যরীতি ও রূপতত্ত্ব। ১, ২, ৩, ৪ নং অধ্যায়ে রয়েছে বাক্যরীতির আলোচনা। ৫ থেকে ৯ নম্বর অধ্যায়ে রয়েছে রূপতত্ত্ব, শব্দগঠন সম্পর্কিত আলোচনা। বইটির তৃতীয় বর্গটির নাম পোরুলতিকারম্‌। এখানে কাব্যশাস্ত্র বিষয়ক আলোচনা রয়েছে। কাব্যশাস্ত্রর শ্রেণিভেদ, অলঙ্কার, ছন্দ, রস প্রভৃতি আলোচিত হয়েছে ৬৬০ টি সূত্রে।

তোল্‌কাপ্পিয়মে তামিল ভাষার শব্দাবলীকে মোট চারভাগে ভাগ করা হয়েছে। ১) ইয়ারচোল – খাঁটি তামিল শব্দ ২) তিরিচোল – এগুলিও খাঁটি তামিল শব্দ। কিন্তু তামিল কবিতায় ব্যবহৃত হবার ফলে এ সব শব্দে কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। ৩) তিচৈচ্চোল – প্রান্তীয় অঞ্চল থেকে আহৃত শব্দ। এগুলি মূলত তেলুগু, কন্নড় ভাষার শব্দ। ৪) বটচোল – সংস্কৃত থেকে গৃহীত শব্দ। সংস্কৃত শব্দসমূহ তামিলে চারভাগে গৃহীত হয়েছে। ক) তৎসম – সংস্কৃত বানান বজায় রেখে খ) অর্ধতৎসম – কৃষ্ণ ; কিরুষ্‌ণন্‌ গ) তদ্ভব – কৃষ্ণ; কন্নন্‌ ঘ) তামিলের ধ্বনি পরিবর্তনের সূত্র অনুযায়ী। ব্রাহ্মণ; পিরাম্মন্‌ (তামিল); বরামন্‌ (তেলুগু)।

পি এস সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রী মনে করেছেন তোল্‌কাপ্পিয়ম্‌ ব্যাকরণে প্রাতিশাখ্য, যাস্কের নিরুক্ত, পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী ও বিভিন্ন শিক্ষা গ্রন্থের প্রভাব পড়েছে। তিনি তাঁর হিস্ট্রি অব গ্রামাটিকাল থিওরিজ ইন তামিল (১৯৩৪) বইতে আরও অনেক তামিল বৈয়াকরণের নাম উল্লেখ করেছেন। যেমন তোল্‌কাপ্পিয়মের টীকাকার ইলম্‌পূরণর্‌ (খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দী), বীরচোলিয়ম্‌ এর রচনাকার পুত্তমিত্তিরণার্‌ (একাদশ শতাব্দী), নেমিনাতম্‌ রচয়িতা কুণবীরপণ্ডিতর্‌ (ত্রয়োদশ শতাব্দী), নন্নূল রচয়িতা পবণন্তি (ত্রয়োদশ শতাব্দী), পিরযোকবিবেকম্‌ রচয়িতা চুপ্পিরমণীয় তিট্‌চিতর্‌ (সপ্তদশ শতাব্দী) ইত্যাদি।

 

আকর

1) Elements of the science of language – I J S Taraporewala

2) Origin and development of the Bengali Language – Suniti Kumar Chatterjee

3) A History of Sanskrit Literature – A Berriadale Keith

4) An account of the different existing Systems of Sanskrit Grammar – S K Belvalakar

5) Theodor Goldstucker – Panini, his place in Sanskrit Literature

6) Maurice Winternitz – A History of Indian Literature

7) Wilhelm Geiger – Pali Literature and Language

8) P S Subrahmanya Sastri – History of grammatical theories in Tamil

9) সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা – ডঃ রামেশ্বর শ

10) প্রাচীন ভারতের ভাষাদর্শন – ডঃ করুণাসিন্ধু দাস

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত