মধ্যযুগে ইংল্যান্ডে এক দৈত্য জাতির গল্প প্রচলিত ছিলো। আমাদের দেশে প্রচলিত ‘বর্গী’র গল্পের মতো ওখানেও নাকি ফসল কাটার মৌসুম আসলেই একদল ‘দৈত্য’ মানুষের বাড়ীঘরে অতর্কিত হামলা চালাতো, আর রাতের আঁধারে লুটতরাজ করে সাগরে মিলিয়ে যেতো। শহরের শিক্ষিত লোকজন গ্রামের এসব গালগপ্পে খুব একটা কান দিতো না অবশ্য। একটা মানুষ কি কখনো আট-দশ ফুট লম্বা হতে পারে নাকি! আর সাগরঘেরা এই দেশে তারা আসবেই বা কোথা থেকে!
কিন্তু ৭৯৩ সালের একটি ঘটনা ওলটপালট করে দেয় সবকিছু। নর্থআমব্রিয়া রাজ্যের উপকূল ঘেষা একটি চার্চে হামলা করে বসে কথিত এই ‘দৈত্য’রা। যাজকদের নির্মম ভাবে কুপিয়ে হত্যার পর তারা লুট করে নিয়ে যায় সেখানে রক্ষিত সমস্ত মূল্যবান সম্পদ। কোনোমতে সেই হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে পালিয়ে আসা যাজকদের মুখে সমস্ত বিবরন শুনে শোক আর আতংকে স্তব্ধ ইংরেজরা বুঝতে পারে প্রচলিত দৈত্যের গল্পগুলো মোটেই কাল্পনিক ছিলো না। তবে রূপকথার দৈত্যদানো নয়, এরা উত্তরের কোনো দেশ থেকে আসা তাদেরই মতো রক্তমাংসের মানুষ – নর্থমেন!
কারা ছিলো এই ‘নর্থমেন’
ভাইকিং বলে পরিচিত এই ‘দৈত্য জাতি’র বাস ছিল আজকের নরওয়ে ও ডেনমার্কে। যুদ্ধে পটু দশাসই শরীর আর অসম্ভব দক্ষতায় জাহাজ চালানোর মেধা কাজে লাগিয়ে প্রায় পাঁচশো বছর ধরে গোটা ইউরোপ দপিয়ে বেড়িয়েছে তারা। তাদের হাতে পতন ঘটেছে প্যারিস বা লুনার মতো সুরক্ষিত সব শহরের।
নিজের দেশের মাটি ছিলো ভয়াবহ রুক্ষ আর অনুর্বর, সেই সাথে তীব্র শীতের প্রকোপ। অনেকটা বাঁচার তাগিদেই প্রতি বছর জাহাজে চেপে বিভিন্ন দেশে অভিযানে বের হতো তারা। লুটের মাল যত বেশী হবে, তত আরামে কাটবে শীতের মৌসুম। তাই লুটপাট চালানোর ব্যাপারে তারা ছিলো অসম্ভব নির্মম আর অসভ্য। এই সমুদ্রচারী দস্যুরাই ইউরোপে পরিচিত হয়েছিলো ‘ভাইকিং’ নামে। নিজের দেশে ভাইকিংদের জাহাজ দেখা আর আজরাইলকে দেখা – এই দুটোই ইউরোপের মানুষের কাছে ছিলো সমান বিষয়।
ততদিনে ক্রিশ্চানিটি ইউরোপে ছড়িয়ে পড়লেও নর্ডিকরা তখনো তাদের বাপ দাদাদের ধর্ম ছাড়েনি। আজকে মার্ভেলের সুবাদে আমরা যে থর, ওডিন আর লোকিদের নিয়ে তৈরী মুভি দেখি, এরাই ছিলো এসব নর্থমেনদের উপাস্য দেবতা।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, সভ্যতার মানদন্ডে রীতিমতো অসভ্য আর বর্বর এই জাতিটা সাগরে অসম্ভব সব দুরত্ব পাড়ি করেছে, নতুন নতুন দেশ আবিষ্কার করেছে – আর এ সমস্ত কিছুই তারা করেছে একদম নিজেদের প্রচেষ্টায়।
ম্যাপ বানানো বা লেখালিখির অভ্যাস তাদের মধ্যে তো সেভাবে ছিলোই না, এমনকি সামান্য একটা কম্পাস পর্যন্ত ছিলো না তাদের কাছে। অথচ জাহাজের গতি বা রণকৌশল দুজায়গাতেই ভাইকিংদের কাছে সমানে মার খেয়েছে সেসময়ের তথাকথিত আধুনিক ও সভ্য দেশগুলো।
ড্রাগন জাহাজ
আগেই বলেছি, ভাইকিংরা জাহাজ বানানোতে ছিলো অসম্ভব রকমের পটু। একটা জাহাজ কোন পথে যাবে বা কি পরিমাণ ভার বহন করতে হবে এসব বিবেচনা করে তারা জাহাজ নির্মাণ করতে পারতো। প্রতিটি অভিযান শেষে নিরাপদে ফেরত আসা নাবিকদের মুখে সমুদ্রযাত্রার বিবরণ শুনে সেই রুটের জাহাজের নকশা তৈরী করতো নির্মাতারা।
সাধারনত দুই ধরনের জাহাজ বানাতো, তার মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত ছিলো ‘ল্যাংস্কিপ’ – যেটা ছিলো আদতে যুদ্ধ জাহাজ। এই জাহাজগুলোতে চেপে তারা হামলা করতো বিভিন্ন দেশে। জাহাজগুলোর সামনে ভয়ংকর এক ড্রাগনের নকশা কাটা থাকতো বলে এটি পরিচিত ছিলো ‘ড্রাগন জাহাজ’ নামে।
ল্যাংস্কিপগুলো বানানো হতো সরু আর লম্বা করে। প্রায় পঞ্চাশ থেকে ষাটজন যোদ্ধা বহন করতে পারতো এই জাহাজগুলো। দুই পাশে ষোলজন করে মোট বত্রিশ জন যোদ্ধা দাড় বাইতো। দ্রুতগামী এবং সহজে বাঁক নিতে সক্ষম হওয়ার কারণে নৌপথের যুদ্ধেও ল্যাংস্কিপ ছিলো রীতিমতো অজেয়।
‘নোর’ নামে আর একটি জাহাজ ভাইকিং-রা ব্যাবহার করতো মালামাল বহণ আর মানুষ পারাপারের কাজে। এটি তৈরী করা হতো বেশ চওড়া করে। ল্যাংস্কিপের চেয়ে ধীরগতির হলেও ভাইকিং-দের বসতি গুলোতে অনায়াসে যাতাযাত করতো ওক কাঠের এই জাহাজগুলো।
দিকচাকতি
দিক চাকতি ছিলো ভাইকিংদের ‘হাতে বানানো কম্পাস’। খুবই সাধারণ একটি যন্ত্র, নকশা কাটা কাঠের চাকতির ঠিক মাঝখানে পেরেক লাগনো থাকতো।
দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে সেই পেরেকের ছায়া বরাবর একটা রেখা টেনে দিতো জাহাজের ‘ক্যাপ্টেন’। তারপর নাবিকদের কাজ ছিলো সোজাসুজি সেই রেখা ধরে জাহাজ চালিয়ে যাওয়া।
দিক ঠিক রাখার এই কৌশল খাটিয়েই ভাইকিংরা প্রতি বছর হানা দিতো ইংল্যান্ডে। প্রতিবছর খোলা সমুদ্রে জাহাজ চালিয়ে যারা একটা দ্বীপদেশে হানা দিতে পারে, তারা চুম্বকের ব্যাবহার পর্যন্ত জানতো না, বিশ্বাস হয়!
রহস্যময় সূর্যপাথর
ভাইকিং-দের লোকগাঁথা গুলোতে বার বার এক জাদুকরী পাথরের কথা বলা হয়েছে। সমুদ্র পথে চলার সময় এই পাথর সবসময় সাথে রাখতো তারা। এর বিশেষত্ব হলো, মেঘলা দিনে যখন আকাশে সূর্য থাকতো না , তখন এই পাথরটি আকাশের দিকে ধরলে তার ভেতরে সূর্যের দেখা পাওয়া যেত। নর্ডিকদের মতে, দেবরাজ ওডিন নাকি সূর্য থেকে একটি টুকরো ভেঙ্গে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন যেনো মেঘাচ্ছন্ন দিনে ভাইকিং জাহাজগুলো পথ হারিয়ে না ফেলে।
আধুনিক গবেষকদের মতে, সূর্যপাথর বলতে তারা আসলে ‘আইসল্যান্ডিক স্পার’ নামের এক ধরনের স্ফটিককে বোঝাতো। সূর্যের হালকা রশ্নি যখন এর ভেতর দিয়ে যায় তখন তা বিভাজিত হয়, ফলে সেই পাথরের ভেতর তাকালে মেঘলা আকাশেও সূর্যের অবস্থান বুঝতে পারা সম্ভব। তবে এই পাথরের খোঁজ ভাইকিংরা কিভাবে পেয়েছিলো সে এক রহস্য বটে!
অসীম জলরাশির মাঝে পথচলা…
যুদ্ধ বা পারাপার যে কারণেই হোক, সাগরে চলার সময় ভাইকিংরা ছিলো পুরোপুরি প্রকৃতি নির্ভর। দিনের আকাশে সূর্য আর রাতে নক্ষত্রের অবস্থান দেখে তারা জাহাজের দিক ঠিক করতে জানতো। আবার, বাতাস ও ঢেউয়ের বেগ দেখে তারা বুঝতে পারতো কখন তীর সন্নিকটে।
যখন তারা কোনো নতুন ভূমি আবিষ্কার করতো, তখন সেখানে যাওয়ার এবং ফিরে আসার পুংখানুপুংখ বিবরন তারা মনে রাখতো। নতুন অভিযাত্রীরা পুরোনো নাবিকদের কাছ থেকে সমুদ্রযাত্রার গোটা বিবরন শুনে নিতো। এভাবে শ্রুতির মাধ্যমে তারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পার করে দিতো লব্ধ জ্ঞান।
নতুন দেশে তীরে ভীড়লো ড্রাগন জাহাজ, তারপর…
আগেই বলেছি প্রতিকূল আবহাওয়া আর অনুর্বর ভূমিতে থাকার কারণে ভাইকিংরা প্রতি বছর খুব উৎসাহের সাথেই নতুন দেশ আবিষ্কারে বের হয়ে যেতো। ছন্নছাড়া ভাবে এইসব জাহাজ অনেক সময় ফিরে আসতো, বেশিরভাগ সময়েই ফিরে আসতো না।
কিন্তু নতুন কোনো জনপদ থেকে একজন অভিযাত্রী বেঁচে ফিরে আসতে পারলেই পরের মৌসুমে সেই রুটে রওনা হয়ে যেতো ড্রাগন জাহাজের বিশাল বহর, আর আক্রান্ত দেশটি নিমেষে পরিনত হতো হাবিয়া দোজখে।
‘ইংল্যান্ড’ নামের দেশ নিয়ে ভাইকিং-দের ভেতর অনেক কথা প্রচলিত ছিলো। তারা জানতো সূর্যাস্তের দিকে সাতদিন একটানা জাহাজ চালালে একটা সবুজ দেশ দেখা যায়। কিন্তু পথের দিশা ঠিক করতে বেগ পেতে হচ্ছিলো তাদের। ফলে সেই সবুজ দেশটি তাদের কাছে অধরা ছিলো বহুবছর।
শুরুতে বলছিলাম ৭৯৩ সালের কথা। সেবছরেই প্রথমবার সফলভাবে ইংল্যান্ডে পৌছে লুটপাট চালিয়ে ফেরত আসতে সক্ষম হয় তারা। আর সেখান থেকে ফেরার মাধ্যমেই শুরু হয়েছিলো ইংল্যান্ডে তাদের দীর্ঘমেয়াদী আগ্রাসন। তবে সেই আলোচনায় এখন আর যাচ্ছি না। ইউরোপের সম্রাজ্যগুলোতে ড্রাগন জাহাজের ক্রমাগত হানা দেয়ার কাহিনী তোলা থাকলো পরের পর্বের জন্য।