ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাস ও ঐতিহ্য । অর্চন চক্রবর্তী
কোন একদিন পুরনো কেল্লার মাঠে গোরা সৈন্যদের পায়ে বল মেরে একটা আজব খেলা দেখে তাজ্জব হয়ে যায় কেল্লার বাঙালি সৈন্যরা। গোরাদের দেখাদেখি তারাও একদিন একটা বল নিয়ে মাঠে নেমে পড়ে পেটাতে শুরু করে দেয়। শুরুর দিকে অর্থাৎ ১৮৭৭ সাল থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত বাংলা তথা ভারতীয় ফুটবলের মানোন্নয়ন ও প্রসার ঘটান বাঙালি ব্যক্তিত্ব শ্রী নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী।
১৮৮৮ সালে তৎকালীন ভারতের বিদেশ সচিব মর্টিমার ডুরান্ড সিমলা ডুরান্ড কাপ চালু করেন।এই টুর্নামেন্ট-টি প্রাচীনতার দিক থেকে পৃথিবীতে তৃতীয়। ভারতে অবস্থানরত ব্রিটিশ সৈন্যদের মনোরঞ্জনের জন্য এই টুর্নামেন্ট-টি শুরু করা হয়।এর কয়েক বছর পরে ১৮৯৩ সালে আই এফ এ শিল্ড চালু হয়, যা পৃথিবীর চতুর্থ প্রাচীন টুর্নামেন্ট।
১৮৮৯ সালে মোহনবাগান স্পোর্টিং ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়, এখন যার নাম মোহনবাগান অ্যাথলেটিক ক্লাব। পরাধীন ভারতে এটি-ই প্রথম ভারতীয়দের তৈরি ক্লাব। এরপর কয়েক বছরের মধ্যে কোলকাতায় ক্যালকাটা এফ সি, শোভাবাজার আর এরিয়ান ক্লাবের প্রতিষ্ঠা হয়। এই সময়েই গ্ল্যাডস্টোন কাপ, ট্রেডার্স কাপ আর কুচ বিহার কাপ- এই তিনটি টুর্নামেন্ট শুরু হয়।
১৮৯৯ সালে কোচি-র পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট আর বি ফার্গুসনের নামে কেরলের ত্রিচুরে আর বি ফার্গুসন ফুটবল ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ ভারতে এটি-ই প্রথম ফুটবল ক্লাব। ইয়ং মেন্স ফুটবল ক্লাব- এই নামে ক্লাবটি সেই সময়ে কেরলে ফুটবলের প্রসারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। এরপর, আরও বেশ কিছু ক্লাবের প্রতিষ্ঠা হয়, টুর্নামেন্টও শুরু হয়ে যায় অনেকগুলি। এই সময়ে সবচেয়ে সাড়াজাগানো ঘটনা হোল ১৯১১ সালে ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্ট-কে ২-১ গোলে হারিয়ে মোহনবাগানের আই এফ এ শিল্ড জয়। এ জয় নিছক ফুটবলের জয় ছিল না। এ জয় ছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ভারতের প্রতিবাদ। ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে এই জয় এক অন্য মাত্রা এনে দিয়েছিল।
১৯৪০ এর দশকে কেরলের ফুটবল প্রেমীরা মিলে তৈরি করলেন,’ অরোরা ফুটবল ক্লাব’। ১৯৪৮ সালের লন্ডন অলিম্পিক্সে ভারতীয় ফুটবল দল পাঠানো হয়, এত বড়ো আন্তর্জাতিক মঞ্চে এই প্রথম ভারতীয় দলের অংশগ্রহণ। শুনতে হয়ত অবাক লাগবে, এই অলিম্পিক্সে বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই খালি পায়ে খেলেছিলেন। ২-১ গোলে ভারতীয় দল ফ্রান্সের কাছে হেরে যায়। ভারত দু-দুটো পেনাল্টি মিস না করলে হয়ত খেলার ফল অন্যরকম হোত।ভারতের খেলা দর্শকের কাছে উচ্চ প্রসংশিত হয়েছিল। খেলার পর সাংবাদিক বৈঠকে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম খালি পায়ে খেলার কারণ জানতে চায়। দলের অধিনায়ক তালিমেরেন আও স্বভাবসিদ্ধ ঢংয়ে বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর দিয়ে বলেন,’ আমরা আমাদের দেশে ফুটবল খেলি, আর তোমরা খেলো বুটবল।’ সেখানে উপস্থিত সব মানুষ করতালি দিয়ে তাঁর এই কথা উপভোগ করেন। পরদিন লন্ডনের কাগজে গুরুত্ব দিয়ে তাঁর এই বক্তব্য ছাপা হয়।
১৯৫১ থেকে ‘ ৬২ পর্যন্ত সময়কালকে ভারতীয় ফুটবলের স্বর্ণযুগ বলা যায়। ১৯৫১ সালে নিজেদের দেশে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমস চ্যাম্পিয়ন হয় ভারত, ফাইনালে ইরানকে ১-০ গোলে পরাজিত করে। এই গৌরবময় ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ভারত শ্রীলংকায় অনুষ্ঠিত ‘ কলোম্বো কোয়াড্রাঙ্গুলার কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়। ইতিমধ্যে বুট পরে খেলা বাধ্যতামূলক হয়ে যাওয়ায় সবাই বুট পরে খেলতেই অভ্যস্ত হয়ে যান। এরপর ১৯৫৩,’৫৪,’৫৫ পরপর তিনবারই কোয়াড্রাঙ্গুলার কাপ চ্যাম্পিয়ন হয় ভারত।
১৯৫৬ সালের অলিম্পিক্সে ভারত চতুর্থ স্থান দখল করে। এই গেমসে ভারত ৪-২ গোলে অস্ট্রেলিয়াকে হারায়। এই ম্যাচে নেভিল ডি সুজা হ্যাট্ট্রিক করেন। ভারত সেমিফাইনালে ওঠে, কিন্তু সেমিফাইনালে যুগোস্লাভিয়া-র কাছে ৪-১ গোলে হেরে যায়। এরপর বুলগেরিয়া -র কাছে ৩-০ গোলে হেরে চতুর্থ স্থান অধিকার করে।
১৯৫৮ সালে টোকিও ওলিম্পিক গেম্ সেও ভারত চতুর্থ স্থান পায়। ১৯৫৯ সালে মারডেকা কাপে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে। ১৯৬২ সালে দক্ষিণ কোরিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়ে আবার এশিয়ান গেমস চ্যাম্পিয়ন হয়। দু-বছর পরে ১৯৬৪ সালে এশিয়ান গেমস-এ ভারত দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে। এরপর ১৯৬৪,’ ৬৫ আর ‘ ৬৬ সালে ভারত যথাক্রমে দ্বিতীয়, তৃতীয় আর চতুর্থ স্থানে শেষ করে।
এরপর ভারতীয় ফুটবলের গরিমা যেন ম্লান হতে শুরু করে। ১৯৭০ সালে এশিয়ান গেমস-এ জাপানকে ১-০ গোলে পরাজিত করে তৃতীয় স্থান দখল করা ছাড়া আর কোন উল্লেখযোগ্য সাফল্য ভারতীয় ফুটবল পায়নি।
