| 29 মার্চ 2024
Categories
ইরাবতী তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা

তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা গল্প: ভালোবাসা কারে কয় । আনিসুজ জামান

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

ক.

দাদার আড়ার বিচিটা অসহ্য লাগে। বিচিটা এক হাতের মত বড়। ওজনে দুই সের; ওটাকে বাম হাতে উঁচু করে ধরে দাদা হাঁটেন। রাত্রে যখন উনার বুকের কাছে শুয়ে সহস্র এক আরব্য রজনীর শেহেরজাদীর গল্প শুনি, বা বোনের সাথে যখন পেটের ঝুলে পড়া চামড়া নিয়ে ডিম ফেটে ভাঁজির খেলা খেলি তখন প্রায়ই আমার হাঁটু গিয়ে লাগে আড়ার বীচিটার গায়ে। উনি ব্যথায় আঃ করে উঠেন। আমার কান্না পায়। উনি কিন্তু তারপরও চিত হয়ে শুয়ে থাকেন অনড়। বোন আর আমি উনির নাভির গর্তটাকে চুল্লি বানিয়ে ভেতরে লাকড়ি ঠেলে দিয়ে উনার চামড়া অনবরত ফেটে যাই।আজ মনে হয় আমাদের এই খেলাতে উনি বাহ্যিক ব্যথা সহ্য করলেও মানসিক আনন্দ পেতেন। ওপর বিচিটা কিন্তু কাকের ডিমের সমান।

প্রতি রাতেই দাদার পিঠ চুলকিয়ে দিতে হয়। আমি চুলকে দিই আগ রাতে আর নানি দেয় মাঝ রাতে। আমার দাদা আসলে নানা। কিন্তু উনি ছোটবেলা থেকেই আমাকে দাদা বলত আর আমিও তাই উনাকে দাদা বলে ডাকি। নানিকে বলি আপা। আপা আসার আগে দাদা হাঁক দেন-‘নুসির মা’। মন খারাপ হলে ডাকেন রাফির মা। আমার মার নাম নুসরাত জাহান রাফি। আগের মানুষ স্ত্রীকে নাম ধরে না ডেকে প্রিয় সন্তানের মা বলে ডাকত। সাধারণত বড় সন্তানই হত প্রিয়। কিন্তু মা চার নম্বর সন্তান হয়েও কেন যেন নানার প্রিয় কয়ে উঠেছিলেন।

আমি বুকের মধ্যে ঘাপটি মেরে শুনি আপা গজগজ করতে করতে উঠে এসে পিঠ চুলকে চলে যান নিজের বিছানায়।

দাদার সাথে আমার অনেক কথা হত। মৌলবির নাতি বলে বাংলা পড়ার সাথে সাথে সাত বছর বয়সেই কোরান খতম দিতে হয়েছিল বাংলা অর্থ সহ। দাদা অনেকগুলো ভাষা জানতেন। দূরদূরান্ত থেকে লোক আসত মাজার ব্যথার জন্য জালের কাঠি পড়ে নিতে। দাদা কি কি দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দিলে সেটা মাজায় বেধে দাদার শিখিয়ে দেয়া কিছু ব্যায়াম নিয়মিত করলেই দিন কয়েকের মধ্যে ব্যথা উধাও। আমি বলতাম দোয়াটা আমাকে শিখিয়ে দিতে। উনি বলতেন- ‘দাদারে, দোয়া কালাম আসলে উসিলা। সব অইল বিশ্বাস আর ব্যামটা’। তখনই কি উনি প্লাসিবো এফেক্টের বিষয়ে জানতেন।

পাশের গ্রামে মাইকে আযান হলেও আমাদের স্কুলের মসজিদে আযান হত খালি গলায়। দাদাকে কারণ জিজ্ঞেস করলে বলতেন নবী করিম সাঃ যেহেতু বুলহরন ব্যবহার করেন নি তাহলে আমরা কেন করব। আর তা ছাড়া সব ধর্মের মানুষ যদি দিনের বিভিন্ন সময়ে পাঁচবার করে ধর্মের ডাক দেয় তাহলে মানুষের কান ঝালাপালা হয়ে যাবে। যার নামাজ পড়ার বা সেহরি খাবার যার ইচ্ছে হবে সে আপনাআপনিই জানবে। মানুষের সময় হচ্ছে তার জীবন। যে ঘুমাতে চায় তাঁকে জোর করে উঠানোর অর্থই হচ্ছে তাঁকে আংশিক খুন করা।

উনার সবসময় ভয় হত মৃত্যুর পর উনাকে না আবার পীর বানিয়ে শিরক করা হয়। তাই চুরাশিতে চুরানব্বই বছর বয়সে ভয়ানক অসুস্থ অবস্থায় যখন বিছানায় পড়া তখন হঠাত করেই এক রাতে উধাও হয়ে যান। সেই থেকে কেউ তার আর কোন খবর পায় নি। অনেক বছর পর উনাকে আবিষ্কার করি এক গোপন জায়গায়। একেবারে একই রকম ধবধবে সাদা দাড়ির লম্বা চিকন মানুষটি একটু কুঁজো হয়ে হাঁটেন বিচিটা বাম হাতে তুলে ধরে।

যখনই মনে কোন প্রশ্ন জাগে তখনই উনার কাছে জিজ্ঞেস করি। এইতো সেদিন জুমার খুতবায় শুনলাম বাংলায় লেখাপড়া নাকি হারাম। যদিও জানতাম যে একমাত্র কোরান শরীফে লেখা আছে হারামের কথা। আর কোরানের কোথাও এরকম কিছু নেই। স্বয়ং নবীজী বলেছেন জ্ঞানের জন্য চীনে যেতে। চীনের ভাষা কি আরবি। আর বাংলা হল মাতৃভাষা। হারাম হলে সে ভাষায় এরা কথা বলে কেন? প্রায়ই এধরনের হাজারটা কথা হয় জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। যতই দিন যাচ্ছে ততই উনি আরও জ্ঞানী হয়ে উঠছেন।

খ.

আপার পিঠ চুলকানি উঠে বিকালে। আমি শহরে থাকি। স্কুলের ছুটিতে বাড়িতে আসলে প্রথম দিকে আমসত্ত্বের লোভে খুব ভালবেসে উনার পিঠ চুলকে দিলেও দুই দিন পরে আর ভাল লাগে না। উনাদের বয়স হয়েছে। পিঠের সব জায়গায় হাত যায় না। আমার খারাপ লাগে।

বাড়িতে আসলে মাঝে মাঝে আপার কাছেও শুতে হয়। দাদা আর আপাকে আমি আর আমার ছোট বোন ভাগাভাগি করে নিতাম। দুজনের দেহই ছিল আমাদের খেলার বস্তু। আপার ঝোলা কুঁচকে যাওয়া দুই স্তন নিয়েও একই ভাবে ডিম ফেটে ভাজার খেলা খেলেছি। আপাও কিছু বলতেন না।বরঞ্চ প্রায়ই দাদার কাছে বেশী শুলে উনি অভিযোগ করতেন। বলতেন ‘ আমি কিচ্ছা জানিনা দেইখা তোমরা আমার কাছে থাকবার চাও না’।

এবারে এসেছি অনেক দিনের জন্যে। এক রাত্রে গোলাগুলির শব্দ। পরের দিন কয়েক হেঁটে রাস্তায় কারও বাড়ির গোয়াল ঘরে ছাতু খেয়ে ঘুমিয়ে শেষে বাড়িতে এসেছিলাম। রাস্তায় আসার সময় অনেক মিলিটারি ছিল। মাঝে মাঝে মা আমার চোখ ঢেকে রাখত হাত দিয়ে আর কোন মেয়েমানুষের বা পুরুষের চিৎকার কানে আসত। আমরা আরও জোরে জোরে পা ফেলতাম।

এসে দেখি পাড়ার করাতি কাইউম চাচা আম বাগানের মাঝখানের আমার ভীষণ প্রিয় বিশাল কড়ুই গাছ, জমরুদটাকে কাইটা বাঁশের মাচায় উঠাইছে। তক্তা বানাবে। আমি আর দাদা কড়ুইগাছটার নাম রেখেছিলাম আরব্যরজনীর চরিত্র থেকে। অভাবের সংসারে আপা প্রতিবার ভাত রান্নার সময় চাল মেপে হাড়িতে ফেলার আগে একমুঠ করে চাল জমিয়ে রাখত গর্তের ভেতর পুতে রাখা কলসিতে। যখন চাল কেনার টাকা থাকত না, তখন হাত যেত সেই কলসিতে। গাঁয়ের প্রায় সব বাড়িতেই তখন সেই ব্যবস্থা ছিল। একদিন সেই চাল রাখার অবস্থাও আর থাকল না। তখন দাদার চোখ গিয়ে পড়ল কড়ুইগাছে। গাছটি কেটে তক্তা বানাবে। কাইউম চাচা কিনবেন। কটা টাকা হাতে আসবে। গাছটা কাটার সময় আমরা কেঁদেছিলাম।

এবার এসে বুদ্ধি করে পিঠ চুলকানোর জন্য আপাকে বাঁশের হাত বানিয়ে দিলাম। আমাকে আর পিঠ চুলকিয়ে দিতে হবে না। কাউম চাচাকে বাঁশ ও বুদ্ধি দিলে তিনিই বানিয়ে দিলেন। একদম হাতের মতো পাঁচটা আঙুলও করা হলো। আমি জাঁতাকলের পাথরে ঘষে ঘষে ওটাকে মসৃণ করলাম। একটা সফল হলে আরেকটা বানিয়ে দাদাকেও দিলাম।

দুদিন পর দেখি দাদারটা নিখোঁজ। ওদিকে কাইউম চাচা কাজ শেষ করে চলে গেছে। আপাতত আতাগাছের ডাল কেটে দাদার হাতে দিলাম কোনোরকমে কাজ চালিয়ে নিতে। সেটাও দুদিন পরে দেখি নেই।

আপা ঠিকই মাঝরাতে এসে চুলকিয়ে যায়। বকবক করে। বিরক্তি প্রকাশ করে।

আমি আপার কষ্ট দেখে একটা বানিয়ে দিই। এবার আর দাদার হাতে দিতে পারি না। তার আগেই আপা আমার হাত থেকে নিয়ে উঠোনে চুলোর মধ্যে দিয়ে দেয়।

আমি কারণ জানতে চাইলে সে রহস্যজনক হাসি হাসে। বলে, বড়ো হলে বুঝবি।

গ.

আমার রাতে পিঠ চুলকায়। বউ আমার পিঠ চুলকে দেয় প্রায় প্রতি রাতেই । আমার মত ওরও মাঝে পিঠ চুলকায়। তখন আমি ওর চুলকে দিই। আমাদের দুজনের এটা অভ্যাস হয়ে গেছে।

দুদিন আগে ওর অপারেশন হয়েছে। আমি আমাজন থেকে বাঁশের ব্যাক স্ক্রাচার অর্ডার করি। এটা চীনারা ভালোই বানায়। আমি পঞ্চাশ বছর আগে যেমনটা বানিয়েছিলাম, ঠিক তেমনই। যেহেতু বউ অসুস্থ আমি নিজে এটা দিয়ে পিঠ চুলকিয়ে নিই।

দুদিন পর দেখি স্ক্রাচারটা উধাও। কোথাও খুঁজে পাই না। যেখানে রাখা ছিল সেই জায়গাটা খালি। একটা পেরেক দিয়ে বিছানার পাশে টাঙানো ছিল, পেরেকটাও নেই।এদিক ওদিক তাকিয়ে অত্যন্ত অস্বস্তিতে আছি। একবার অনুভূতিটা উঠলে না চুলকানো পর্যন্ত শান্তি নেই। নড়াচড়াও করতে পারছি না, পাছে ওর ঘুম ভেঙ্গে যায়। লেপের বাইরে ভীষণ শীত। উঠে যে কিছু নিয়ে আসব তাও ইচ্ছে করছে না। ভাবছি কি করব। এমন সময় পাশে শোয়া অসুস্থ বউ বাঁ হাতটা আস্তে করে বাড়িয়ে আমার পিঠ চুলকাতে শুরু করে। আমার কিছু বলতে হয় না।

ওর কষ্ট দেখে আরেকটা স্ক্রাচার অর্ডার করি। চলেও আসে দ্রুত। দেখি, দুদিন পর সেটিও লাপাত্তা।

সকাল ঘুম থেকে উঠে চোখে পড়ে ব্যাক স্ক্রাচারটা ডাস্টবিনে ময়লার মধ্যে থেকে মুখটা বের করে নিজের অক্ষমতা ও পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে আমার দিকে মুখ ব্যদান করে তাকিয়ে আছে। আমি জোর করে ওকে ব্যাগের আরও ভেতরে ঢুকিয়ে, বাইরে ময়লার মধ্যে ফেলে আসি।

ভাবি, আমি এখন বড়ো হয়েছি।

 গল্পকার, অনুবাদক, সাহিত্যসংগঠন ও সংগীতশিল্পী। তাঁর জন্ম ১৯৬২ সালে মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর থানার সৈয়দনগর গ্রামে। ১৯৮৫ সাল থেকে প্রবাসজীবনে আছেন। প্রথমে জাপানে চাকরিসূত্রে, পরে মেহিকোতে চাকরিসূত্রে গেলেও সেখানে নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। বর্তমানে স্ত্রী সন্তানসহ যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তিনি কলোম্বিয়ার নোবেলজয়ী লেখক গাবরিয়েল গারসিয়া মার্কেসের ‘শত বছরের নিঃসঙ্গতা’ উপন্যাসটি স্প্যানিশ ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন। সম্প্রতি তাঁর অনুবাদে উরুগুয়ের লেখক হুয়ান কার্লোস ওনেত্তির উপন্যাস “কূপ” এবং সমকালীন কলোম্বীয় গল্প সংকলন ‘গাবোর দেশে গাবোর পরে’ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি নিয়মিত ছোটগল্প লিখছেন। সংগীত নিয়ে কাজ করছেন।

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত